পূর্ব্ববঙ্গ গীতিকা (চতুর্থ খণ্ড, দ্বিতীয় সংখ্যা)/রতন ঠাকুরের পালা
রতন ঠাকুর
রতন ঠাকুরের পালাটি শ্রীযুক্ত চন্দ্রকুমার দে প্রায় এক বৎসর পূর্ব্বে মৈমনসিংহ জেলার কাঠঘর নিবাসী গাছিম সেখ ও অপর এক গ্রামের রামচরণ বৈরাগী নামক দুই ব্যক্তির নিকট হইতে সংগ্রহ করেন।
এই পালাটির মাঝে মাঝে গদ্য রচনা; কিন্তু তাহা খুব বেশী নয়। পালাটি ২৬২ ছত্রে সম্পূর্ণ।
পালাটিতে গীতিরসের প্রাচুর্য্য আছে। কাহিনীটি বেশ স্পষ্ট এবং ঘটনাগুলি সুকৌশলে গ্রথিত। কিন্তু নাট্যরস হইতে গীতিরসই ইহাতে সমধিক।
আমরা অনেকগুলি পালায় (বিশেষতঃ যেগুলি চতুর্দ্দশ ও পঞ্চদশ শতাব্দীতে রচিত) সহজিয়া-ভাবের প্রেম বিশেষভাবে দেখিতে পাই। বর্ত্তমান পালাটি কতকটা পূর্ব্ব-প্রকাশিত “ধোপার পাটে”র (দ্বিতীয় খণ্ড—দ্বিতীয় ভাগ) অনুরূপ। সেখানে এক রাজকুমার এক রাজক-কন্যার প্রেমে পড়িয়া শেষে তাহাকে পরিত্যাগ করেন। এই পালাটিতেও রাজকুমার এক মালাকর-দুহিতার প্রেমে পড়েন এবং শেষে রাজপুত্রের বিশ্বাসঘাতকতায় মেয়েটির মৃত্যু হয়। ধোপার পাটের নায়ক রাজপুত্র অতি নির্ম্মম ও কৃতঘ্ন কিন্তু বর্ত্তমান পালাটিতে নায়ক কিছুদিনের জন্য এক পতিত নারীর মোহে আত্মবিস্মৃত হইলেও শেষে অনুতাপে দগ্ধ হইয়া জীবনের সমস্ত সুখ-সম্ভোগ বিসর্জন দিয়াছিলেন। সুতরাং তাঁহার চরিত্রের নষ্ট মহিমার কতকটা পুনরুদ্ধার হইয়াছিল।
নায়িকার সম্বন্ধে বেশী কিছু বলিবার নাই। ইনি প্রেমে আত্মবিস্মৃত, একান্ত নির্ভরশীল ও অনন্যমনা-যেমন বহু পালাগানে পাইয়াছি, ইনিও সেই সকল রূপগুণের মাধুরী দিয়া আমাদের মনোহরণ করিয়াছেন। ইঁহাদের কোমলতা ও তেজস্বিতা উভয়ই অপূর্ব্ব। যিনি ‘ফুলসম সুকুমারী’ও লতিকার ন্যায় পরমুখাপেক্ষী—প্রয়োজন হইলে তিনি বর্ম্মাবৃত-দেহ, কঠোর বীরপুরুষের মত প্রতিকূলতার অগ্নিবাণ উপেক্ষা করিয়া তাহা তাঁহার কোমল হৃদয়ের অশেষ সহিষ্ণুতা দিয়া সংবরণ করিয়া লইতে পারেন। চণ্ডীদাসের কথায় ইঁহাদের সম্বন্ধে বলা যায়—“এতেক সহিল অবলা ব’লে। ফাটিয়া যাইত পাষাণ হ’লে॥”
রতন ঠাকুরের পালা
রতন ঠাকুরের পালা
(১)
“চান্দের বাগের ফুল নারে সূরজে দিলাইন দড়ি[১]।
এই না ফুল দিয়া আমি মালা খানি গাঁথি॥২
গাঁথিতে গাঁথিতে রে মালা, মালা আরে মালঞ্চ উজার[২]।
এই না মালার নাম আমার ‘বসন্ত-বাহার’॥৪
শতেক না চাম্পা ফুলে আরে গাঁথলাম মালা।
মাধ্যে মাধ্যে দিছি ফুল কালা না রে ধলা[৩]॥৬
শুন শুন বিরধবিরধ=বৃদ্ধ। বাপ শুন বলিরে তোমারে।
এই মালা লইয়া যাহ রে তুমি তিরপুরার হাটে।৮
তিরপুরার হাটখানি বইসে বিয়ান বেলা[৪]।
সেই না হাটে বিকাইয়া আইস চিকণ ফুলের মালা॥১০
শুন শুন বাপ আরে কহি যে তোমার আগে।
এই মালা বিকাইয়া আইস কাহনার দরে[৫]॥”১২
মালা লইয়া বিরধ মালী হাটে চল্যা যায়।
একেলা ঘরেত কন্যা শুইয়া নিদ্রা যায়॥১৪
(২)
“শুন শুন মালী আরে কহি যে তোমারে।
কোন বা জনে গাঁথিল মালা কহ না সত্য ক’রে॥২
কেওয় না কেতকীর গন্ধ বাতাসে মিলায়।
কেমুন জনে গাঁথে মালা দেহ পরিচয়॥”৪
“ঘরে আছে এক কন্যা দুই নয়নের তারা।
তুলিয়া মালঞ্চের ফুল সে গাঁথিল মালা॥৬
পূবের বাতাস পাইচ[৮] মাইল[৯] বয়ারে[১০] নদী বাড়ে ঢেউ।
এহি কন্যা ছাড়া আমার দুইনায় নাইরে কেউ॥৮
চালে আমার নাইরে ছানি, কুলায় নাই সে ধান।
এই মালা বেচিয়া খাই তবে বাঁচে পরাণ॥”১০
“শুন শুন বুড়া মালী আরে কহি যে তোমারে।
কি মত বয়স কন্যা আছে তোমার ঘরে॥১২
দিছ কি না দিছ বিয়া কহ পরিচয়।
বড় ঘরে দিত বিয়া তবে উচিত হয়॥”১৪
“আ-বিয়াত[১১] কন্যা আমার ফুলের কুমারী।
একেলার কন্যা মোর শিয়রের পরী॥১৬
ভাত রান্ধে কন্যা আমার পান্থে[১২] যোগায় পানি।
পরের হাতে সঁপ্যা কেমনে বাঁচাবো পরাণী॥”১৮
(হায়!) হাস্যা কয়রে রতন ঠাকুর শুন বিরধ[১৩] মালী।
“কি দরে বিকাবে মালা কহ মোরে শুনি॥”২০
“বুড়ীতে বুড়ীতে পনরে পনে কাহন মিলে।
এক কাহন কড়ি দিলে মালা দিয়াম তারে॥২২
হাসি হাসি রতন ঠাকুর মালা দিল গলে।
গণ্যা বাছ্যা কাউন কড়ি তুল্যা দিল হাতে॥২৪
(৩)
একেলা সুন্দর কন্যা গাঙ্গের ঘাটে খাড়া।
মধু ভরা ফুলের খবর না পাইছে ভমরা॥২
“যৈবনে যৈবতী লো কন্যা একলা থাক ঘরে।
কতখানি বয়স হইল না জান আপনে॥৪
টলমল অঙ্গলো কন্যা যৈবন বাইয়া পরে।
নিজে নাই জান খবর না দিয়াছে পরে[১৪]॥৬
আঁখি মেল্যা দেখে কন্যা সুন্দর নাগর।
কেওয়া কেতকী পুষ্পে উইড়াছে ভ্রমর॥৮
“দিনের আলো নিমি ঝিমি[১৫] রে কুমার রাইতের আলো ভালা।
একেত অবুলা নারী তা হতে একলা॥১০
দিনের আলো নিমিরে ঝিমিরে কুমার ঘিরিল আন্ধারে।
পন্থ ছাড়রে কুমার যাইব নিজ ঘরে॥”১২
“কেবা তোর বাপ মাও লো কন্যা কহ পরিচয়।
একেলা আইসাছ ঘাটে তাতে নাইলো ভয়॥১৪
ভারি যদি কলসী কন্যা ভইরা দিবাম আমি।
আগুয়াইয়া দিবাম তোরে গায়ের[১৬] পন্থ[১৭] খানি॥১৬
চিন বা নাচিন পন্থ তাতে ক্ষতি নাই।
যথায় যাইবা কন্যা তথা আমি যাই॥”১৮
“আমার না বাপ রে কুমার,
কুমার আরে, তোমার বাগের[১৮] মালী।
জলেত খাড়ইয়া রে কুমার পরিচয় করি॥২০
জল লড়ে স্থলরে লড়ে জলে না পাই ভর।
আন্ধাইরে ডড়িনা কেবুল কলঙ্কের ডড়[১৯]॥২২
বাঘ ভালুকেরে কুমার,
কুমার আরে, যত না ডরাই।
অবুলা কুলের নারী কুলের ভয় সে পাই॥২৪
আসমানেতে ফুটে তারা, জমিন আন্ধারে।
পন্থ ছাড় রে কুমার যাইব নিজ ঘরে॥”২৬
“বায়ে[২০] লড়ে[২১] বন বাহুরা[২২] জলে উঠে ডেউ।
মনের কথা কইব কন্যা এইখানে নাইরে কেউ॥”২৮
“আজুকার নিশি রে কুমার, কুমার আরে,
চিত্তে দেও রে ক্ষেমা।
ফুল বাগানে অইব দেখা কালুকা বিয়ানে॥”৩০
(৪)
“ডাল ভাঙ্গ, ফুল তুললো, উগ্রাইয়া[২৩] নেও চারা।
হাতে হাতে আইজ কন্যা পইরা গেছ ধরা॥২
আজুকা বাগানে মোর নিছাদি[২৪] পাহারা।
(কন্যালো) নিত্তি নিত্তি লৈয়া যাহলো কন্যা
পুষ্পনা কইরা চুরি।
ভালা শাস্তি দিবাম লো আজি শুনলো সুন্দরী॥৫
কাটিয়া চামর কেশ লো কন্যা আলো গলায় বাঁধিম।
তোর যৈবন পুষ্প তুল্যা লো কন্যা মালা সে গাঁথিম॥৭
দুই আখ্খি অপরাজিতা, বদন চাম্পা ফুল—
এই না ফুলে গাঁথিয়া মালা পড়িবাম গলায়।
চোরের ধন চুরি কর্লে নাই সে বড় দায়॥”১০
“কি কথা কইলা রে কুমার বড় দুঃখু পাই।
অবিচার্যা দেশে কুমার বিচার না সে পাই॥১২
কোটালিয়া দেশের রাজা রাজা দেয় রে পারা[২৫]।
যার লাগ্যা করিলাম চুরি সেই সে বলে চোরা॥১৪
এই দেশ ছাড়িয়া যাইম বৈদেশী হইয়া।
পুষ্পে মোর কাজ্জ[২৬] নাই হস্ত দেওরে ছাইরা॥”১৬
“না ছার্বো, ছার্বো হাত লো, কন্যা আলো,
রৈয়া শুন্লো কথা।
যৈবন করলো দান রাখলো মোর কথা”১৮
“এই ত বিয়ান বেলারে বন্ধরে পুষ্প ফুটে ডালে।
হাটের সময় বৈয়া যায় বন্ধু! ছাইরা দেওরে মােরে॥”২০
“সত্য কর সুন্দর কন্যা লো সত্য কর তুমি রৈয়া।
গোপন কালে করবানি লো দেখা, মোরে
যাওলো কৈয়া॥”২২
“নিশিকালে যাইও বন্ধুরে আমার ওই না বাড়ী।
চারি না দিকে বেউর[২৭] কলা রূইছি সারি সারি।
কলাবনে আইব দেখা গেলাম সত্য করি॥”২৫
(৫)
“পৈথান[২৮] দিয়া আইস বন্ধুরে শিথান দিয়া[২৯] বইও[৩০]।
বাটায় আছে পান শুপারী, বন্ধু চুণ দেখিয়া খাইও রে॥২
পরাণ পাগেলা বন্ধুরে—
হাম আবুল নারীরে বন্ধু পরথম যৈবন।
পরথম পিরীত বন্ধু, বন্ধুরে পরথম মিলন রে॥৪
পরাণ পাগেলা বন্ধুরে—
থর থরিয়া কঁপে অঙ্গরে বন্ধু মুখে দিল সে ঘাম।
পাড়ার দুষ্মন্ লোকে বন্ধু রটাইব বদনাম রে॥৬
পরাণ পাগেলা বন্ধুরে—
পরথমে যখনি বন্ধুরে গলায় হাত দিল।
অঝুরে[৩১] অবশা অঙ্গ কাঁপ্যা না উঠিল রে॥৮
পরাণ পাগেলা বন্ধুরে—
পরথমে যখন বন্ধুরে মুখে দিল মুখ।
অঝুরে অবশা অঙ্গ আমার কাঁপ্যা উঠে বুকরে॥১০
পরাণ পাগেলা বন্ধুরে—
চান্দ সাক্ষী সূরুজ সাক্ষীরে সাক্ষী তারাগণ।
এই মতে সঁপ্যা দিলাম জীবন যৈবন রে॥১২
পরাণ পাগেলা বন্ধুরে—
জীবন দিলাম যৈবন দিলাম, আর সে কিছু নাই।
ঘুম থাক্যা জাগিয়া দেখি বন্ধু কাছে নাই ওরে॥১৪
পরাণ পাগেলা বন্ধুরে—”
(৬)
পরভাত কালে উঠে কন্যা সামনে পুষ্পডালা।
চক্ষে লাগ্ল কাল ঘুমরে কেম্নে গাঁথি মালা॥২
কালী হইল সোণার অঙ্গরে লোকে কাণাকানি।
দিবসে না হইব দেখারে হইলাম পাগলিনী॥৪
দিবসে মোর কাজ্জ[৩২] নাইরে রাত্রি মোর ভালা।
সংসারে মোর কাজ্জ নাইরে ঝইড়া পড়ে মালা॥৬
হাটে মোর কাজ্জ নাইরে কিসের বিকি-কিনি-
ছানে[৩৩] মোর কাজ্জ নাইরে কিসের খাউনী জিউনী[৩৪] রে॥৮
ঘুমে মোর কাজ্জ নাইরে এ সবে না চাই।
পন্থ পানে চাইয়া থাকিরে কেবল একটু দেখা পাই—
রে বন্ধু একটু দেখা পাই॥১০
বাপ বাদী হইল কুমাররে মাও সে বাদী হইল।
জলেত যাইতে তারা মানা মোরে করে রে॥১২
বাপ সে বাদী হইল কুমার রে মাও সে হইল বাদী।
পুষ্প তুলিতে গেলে তারা পরতিবাদী রে—
কাল কালিন্দী বিষ রে॥১৪
রাধন না সয় বন্ধুরে বাড়ন[৩৫] না সয়।
ঘর গরল জ্বালা রে বিষে তনু দয়[৩৬] রে—
কাল কালিন্দী বিষ রে॥১৬
বাউরা[৩৭] পাগল মন রে ঘরে নাই সে টিকে।
শিকল কাটা টিয়া যেমুন বনে বনে উড়ে রে—
কাল কালিন্দী বিষ রে॥১৮
দুষ্মন পাড়ার লোকরে, দেশে নাই সে ঠাঁই।
বৈদেশী হইয়া চল বন্ধু অন্য দেশে যাই রে—
কাল কালিন্দী বিষ রে॥২০
(৭)
রতন ঠাকুর ছান করতো যায় গাম্ছা কান্ধে দিয়া।
মালীর ছেড়ী[৩৮] চাইয়া থাকে ভাঙ্গা বেড়া দিয়া রে—
আর, কান্দে নদীর কূলে বৈয়া[৩৯]॥২
রতন ঠাকুর পন্থে বাইর হইল হাতে লৈয়া বাঁশী।
মালীর ছেড়ী ঘাটে যায় রে ভালা কাঙ্কেতে কলসী রে—
আর, কান্দে পন্থ পানে চাইয়া॥৪
গাঙ্গের ঘাটে রতন ঠাকুর রে করে আনিগুনি।
মালীর ছেড়ী ঢাইল্যা দিল ভরা কলসীর পানি রে—
আর, কান্দে নদীর কূলে যাইয়া॥৬
পন্থে বাইরইল রতন ঠাকুর নব রঙ্গের বেশ।
এরে দেখ্যা মালীর ছেড়ী ঝাইরা বান্ধে কেশ রে—
আর, কান্দে আরশীর দিকে চাইয়া॥৮
ঘাটে বাটে যায় রতন রে সকাল সৈন্ধ্যা বেলা।
মালীর ছেড়ী ফুল তুল্ত যায় হাতে লৈয়া ডালা রে—
আর, কান্দে ফুলের পানে চাইয়া॥১০
রতন ঠাকুর হাটে যায় রে বেইল[৪০] ফুরাইয়া গেল।
আমার লাগিল্[৪১] আইন্য কিন্যা সাঁচি গন্ধের তেল রে—
* * * * * *১২
(৮)
পলায়ন
দেওয়ায়[৪২] ডাকে গুরু গুরু রে
ঘাটে নাইরে খেয়া॥
ঢেউয়ের উপর ভাইঙ্গা পড়েরে
ঝাউ হিজলের ছায়া রে—
আরে কান্দে রতন ঠাকুর বুইলা॥২
চিলিক চিলিক বিজ্ঞলী ঠাডারে[৪৩] পবনের বাও।
আজুকা রাত্রিতে বান্ধা সাধু মাল্লার নাও রে
আরে কান্দে রতন ঠাকুর বুইলা॥৪
“ঘরের বাইরি[৪৪] অইলাম কন্যালো
আর না যাইম[৪৫] ঘরে।
তোমারে লৈয়া কন্যা লো ভাসিম[৪৬] সায়রে॥৬
রাজ্য থাকুক ধন থাকুক, থাকুক বাপ মাও।
তোরে লইয়া ছারম[৪৭] দেশ লো, কপালে থাকে যাও[৪৮]॥”
আরে কান্দে রতন ঠাকুর বুইলা॥৮
“পইরা[৪৯] রইল কাক কোইলা দেশের বাড়ী ঘর।
বৈদেশ করিলাম দেশ রে আপন কৈলাম পর রে[৫০]॥১০
বাপ মাও ছাড়লাম বন্ধুরে ছাড়লাম নিজ ঘরে।
কালুকা[৫১] বিয়ানে[৫২] লোকে কি বলিবে মোরে॥১২
ছয় মাসের বান্ধা ঘর লহমাতে[৫৩] ভাঙ্গে রে—”
আর কান্দে রতন ঠাকুর বুইলা॥১৪
সজিন্তার দেশ খানি দেখিতে সুন্দর।
মালী আর মাল্যানী তথা বান্ধে বাড়ী ঘর॥১৬
চিরল কুটি[৫৪] দিয়া তারা ঘর যে বান্ধিল।
* * * * ॥১৮
খাগরের ছানি দিল ইকরের[৫৫] বেড়া।
রাজার হুকুম লৈয়া বান্ধিল বাসুরা[৫৬]॥২০
[এদিকে দেশ জুড়িয়া রতন ঠাকুরের খোঁজ পড়িল। খুঁজিতে খুঁজিতে লোকজন জানিয়া গেল যে এই সজিন্তার দেশের মালী-মালিনীই রতন ঠাকুর ও তা’র প্রণয়িণী—সেই বৃদ্ধ মালীর কন্যা।]
(৯)
গাও না গেরাম লৈয়া ভালা যুক্তি যে করিল।
রঙ্গিলা বেশ্যারে কৈয়া সজিন্তা পাঠাইল॥২
“শুন শুন রঙ্গিলা বেশ্যা বলি যে তোমারে।
আমার পুত্র পাগল হইয়া গিয়াছে বৈদেশে॥৪
অৰ্দ্ধেক রাজত্বি দিবাম আর সে দিবাম তার।
সোণাতে বান্ধিয়া দিবাম তোমার গলার হার॥”৬
পান খাইয়া রঙ্গিলা বেশ্যা আরে ঠোঁট কইরাছে লাল।
হাল আবেস্থা[৫৯] তার শুন দিয়া মন।
যাদুমন্ত্র জানে কন্যা পরথম যৌবন॥৯
দুষ্মনে সুহৃদ্ করে পান পড়া দিয়া।
সতী নারীর পতি সে যে নেয় ত ভুলাইয়া॥১১
এক ফোটা জল পইরা[৬০] গায়ে ছিটা দিলে।
পাগলিনী হইয়া সতী আপন পতি ভুলে॥”১৩
(হায় ভালা) তবে ত রঙ্গিলা বেশ্যা আরে গমন না করিল।
সজিন্তার দেশে গিয়া দাখিল হইল॥১৫
বাজারে মারিয়া ঢোল বান্ধিলেক ঘর।
বড় বড় লোক রাখে বানাইয়া নফর[৬১]॥১৭
একদিন সজিন্তার রাজা খবর পাইল।
রঙ্গিলার কাছে আইসা হাজির হইল॥১৯
মুখ দেখিয়া রাজা পাগল হইয়া গেল।
আর পাগল হইল রাজা পান যখন খাইল॥২১
হায়! মালীর না গাঁথা মালা ভালা রাজা রঙ্গিলারে দিল।
খুশী হইয়। রঙ্গিলা যে তারিফ করিল॥২৩
“এমন সুন্দর মালা গাঁথে কোন্ জন।
যে জনে গাঁথিল মালা সে জানি কেমুন॥”২৫
রাজা বলে “আমার মালী মালা সে গাঁথিল।”
“কেমুন তোমার মালী” রঙ্গিলা কহিল॥২৭
“আর দিন তারে তুমি সঙ্গেতে আনিও।
আর গাছি ফুলের মালা গাথিয়া সে দিও॥”২৯
রতন ঠাকুর ও বৃদ্ধ মালীর কন্যা
কন্যা। আজুকার নিশিরে বন্ধু স্বপন দেখলাম ভারী।
দুস্কিনীর[৬২] কপালের কথা কইতে নাই সে পারি॥৩১
মরা বির্খে[৬৩] ডাকে কাউয়া[৬৪] পেঁচা ডাকে ঘরে।
কি জানি বিধাতা বন্ধু ফেলায় কোন্ ফেরে॥৩৩
মাও বাপে মনে উঠেরে বন্ধু দিবানিশি কাল।
কি জানি দারুণা বিধি ঘটাইল জঞ্জাল॥৩৫
চক্ষে চক্ষে থাকরে বন্ধু ফুলে কাজ্জ নাই।
তোমার বদলে আমি পুষ্প তোলা[৬৫] যাই॥৩৭
বুকে বুকে থাকরে বন্ধু, বন্ধু আরে না হইও অদেখা।
কি জানি বা এহি দেখা জনমের দেখা॥৩৯
মুখে মুখে থাকরে বন্ধু হেন মনে লয়।
তিলেক হইলে ছাড়া পরাণে না সয়॥৪১
আইঞ্চলে[৬৬] বান্ধিয়া রাখি হেন মনে লয়।
আঁখি কাঁপে ঘন ঘন রে বন্ধু কহিতে ডরাই।
কি জানি আঞ্চলের নিধি বান্ধিতে হারাই॥৪৪
ছয় মাস আছিরে বন্ধু সব্জিন্তার ঘরে।
কাল নিশায় স্বপ্ন দেখি বন্ধু, তুমি গেছ চোরে[৬৭]॥৪৬
রতন ঠাকুর। না কাইন্দ না কাইন্দ লো কন্যা নাই সে কাইন্দ তুমি।
যেখানে থাকিবা তুমি সেইখানে আমি॥৪৮
হিয়াতে লাগিল হিয়া পরাণে পরাণ।
তোমার মরণে কইন্যা আমার মরণ॥৫০
[রতন ঠাকুর যে দিন রঙ্গিলাকে মালা দিতে গেল, সে দিন সে আর বাড়ী ফিরিল না। লোকজন খোঁজ করিতে গিয়া দেখিল যে রঙ্গিলা ও রতন ঠাকুর উভয়েই উধাও হইয়াছে। রাজা এ সংবাদে ভীষণ ক্রুদ্ধ হইয়া রতন ঠাকুরের ঘর পুড়াইয়া দিতে হুকুম দিলেন। তাঁহার অনুচরেরা ফিরিয়া আসিয়া জানাইল যে রতন ঠাকুরের ঘরে একজন সুন্দরী স্ত্রীলোক আছে। রাজা তাহাকে ধরিয়া অন্দরে আনিতে বলিলেন।]
(১০)
আর ত সময় নাইরে বন্ধু, আর সময় নাই!
চক্ষের দেখা দেখা দেওরে, আমি দেইখ্যা প্রাণ জুড়াই
রে বন্ধু—আর ত সময় নাই!৩
দারুণ গরল রে বিষে বন্ধুরে অঙ্গ হইল কালী।
আমার বন্ধু একবার আইস, অন্তিম দেখা দেখিরে বন্ধু—
আর ত সময় নাই!৬
তুমি ত তুলিতে ফুল রে আমি গাঁথতাম মালা,
অবিচারে গেলে রে বন্ধু মোরে ফেলি’ একেলা রে বন্ধু—
আর ত সময় নাই!৯
মাও বাপে পর করিলাম বন্ধুরে ছাড়লাম বাড়ীঘর,
দেশ ছাইরা বৈদেশী হইলাম রে বন্ধু আপন হইল পর রে বন্ধু—
আর ত সময় নাই!১২
আর না দেখবাম চান্দরে সুখ-নিশিতে জাগিয়া
আর না কহিব রে কথা হাসিয়া হাসিয়া রে বন্ধু—
আর ত সময় নাই!১৫
পরাণের বন্ধুরে আমার, দুষ্মনী করিলা
অবলার মজাইয়া কুল রে বন্ধু, ফাঁকি দিয়া গেলা রে বন্ধু—
আর ত সময় নাই!১৮
পরে রে না দিবরে দোষ, দিব সে আপনে
কোন্ জনে পাইয়া এমুন, হারায় বা কোন্ জনে রে বন্ধু—
আর ত সময় নাই!২১
বন্ধেরে[৬৮] না দিবরে দোষ নিজে কর্ম্ম দোষী,
আর ত সময় নাই!২৪
মরিবার কালেরে বন্ধু না পাইলাম দেখা
এই সে ছিল অভাগিনীর সাত করমের লেখা রে বন্ধু—
আর ত সময় নাই!২৭
তোমরা যদি কেউ বুঝগো আমার মনের দাগা
বন্ধু আইলে কইও নাগো আমার মরণ কথা রে বন্ধু—
আর ত সময় নাই!৩০
আর ত সময় নাইরে বন্ধু আর ত সময় নাই—৩১
[রঙ্গিলার মোহ কাটাইয়া যেদিন রতন ঠাকুর আবার সজিন্তার দেশে ফিরিল সে দিন সে আর তার প্রিয়তমাকে পাইল না। সজিন্তার দীর্ঘশ্বাসের মত বাতাস আর বন-সোহাগী পাখীরা কাঁদিয়া কাঁদিয়া তাহাকে কন্যার মরণের খবর দিল।]
এই কথা শুনিয়া রতন ঠাকুর পাগল হইল—
মাও বাপ বাড়ী ঘর সকল ভুল্যা গেল রে!
রতন ঠাকুর! ঠাকুর আরে!
মাও কান্দে পন্থ পানে চাইয়া!৩৫
দেশে নাই সে গেল রে ঠাকুর না ফিরিল ঘরে
দেশে দেশে রতন ঠাকুর পাগল হইয়া ফিরে রে—
রতন ঠাকুর! ঠাকুর আরে!
মাও সে কান্দে পন্থ পানে চাইয়া!৩৯
সমাপ্ত
- ↑ চান্দের.....দড়ি=চন্দ্রের বাগানের ফুলের মধ্যে সূর্য্য-কিরণের সুতা দিয়া নায়িকা মালা গাঁথিয়াছেন। দড়ি=সূত্র, এখানে কিরণ।
- ↑ উজার=উজোড়।
- ↑ ধলা=সাদা।
- ↑ বিয়ান বেলা=প্রাতঃকালে।
- ↑ কাহনার দরে=এক একটি ফুলের মালার দর এক কাহন,—এক টাকা।
- ↑ স’রে=সহরে।
- ↑ বেবাক্=সমস্ত।
- ↑ পাইচ=পাক দিল, চক্রাকারে ঘুরিল।
- ↑ মাইল=মারিল।
- ↑ বয়ারে=হাওয়ার।
- ↑ আ-বিয়াত=অবিবাহিতা।
- ↑ পান্থে=পথে যাইতে তৃষ্ণা পাইলে।
- ↑ বিরধ=বৃদ্ধ।
- ↑ নিজে......পরে=তোমার শরীরে যে যৌবন আসিয়াছে সে খবর তুমি নিজেও জান না এবং অপরকেও জানিতে দাও নাই।
- ↑ নিমি ঝিমি=মৃদু মৃদু।
- ↑ গায়ের=গাঁয়ের, গ্রামের, আমি গাঁয়ের পথ ধরিয়া তোমাকে অগ্রসর করিয়া দিব, তোমার অনুবর্ত্তী হইয়া পথ চিনাইয়া লইয়া যাইব।
- ↑ পন্থ=পথ।
- ↑ বাগের=বাগানের।
- ↑ ডড়=ভর, ভয়।
- ↑ বায়ে=বাতাসে।
- ↑ পড়ে=নড়ে।
- ↑ বন বাহুরা=একরূপ বন্যতরু।
- ↑ উগ্রাইয়া=উপ্ড়াইয়া।
- ↑ নিছাদি=(?)
- ↑ কোটালিয়া......পারা=কোটালই দেশের রাজা এবং রাজা কোটালের মত পাহারা দেন।
- ↑ কাজ্জ=কার্য্য, কাজ (প্রাকৃতে ‘কজ্জ’)।
- ↑ বেউর=বেউড়, একপ্রকার বাঁশ।
- ↑ পৈথান=পায়ের তলা।
- ↑ শিথান দিয়া=শিয়রে।
- ↑ বইও=বসিয়ো।
- ↑ অঝুরে=অজ্ঞাতসারে।
- ↑ কাজ্জ=কজ্জ (প্রাকৃত), কাজ।
- ↑ ছানে=স্নানে।
- ↑ খাউনী জিউনী=খাওয়া এবং বিশ্রাম (জিউনী)।
- ↑ রাধন.....বাড়ন=রাঁধা বাড়া।
- ↑ দয়=দহে, পুড়িয়া যায়।
- ↑ বাউরা=পাগল, উদাসী
- ↑ ছেড়ী=কন্যা।
- ↑ বৈয়া=বসিয়া।
- ↑ বেইল=বেলা।
- ↑ লাগিল্=জন্য।
- ↑ দেওয়ায়=মেঘে।
- ↑ ঠাডারে=বজ্রে
- ↑ বাইরি=বাহির।
- ↑ যাইম=যাইব।
- ↑ ভাসিম=ভাসিব।
- ↑ ছারম=ছাড়িব।
- ↑ যাও=যাহা; কপালে যাহাই থাকুক।
- ↑ পইরা=পড়িয়া।
- ↑ ‘আপন কৈলাম পর’—চণ্ডীদাসের পদ দ্রষ্টব্য।
- ↑ কালুকা=কাল।
- ↑ বিয়ানে=প্রাতে।
- ↑ লহমাতে=নিমেষে।
- ↑ চিরল কুটি=চিরল—সরু, কুটি—খুটি
- ↑ ইকরের=একরূপ লতা।
- ↑ বাসুরা=বাসর ঘর।
- ↑ এহি=এই।
- ↑ খোস্নাম=প্রশংসা।
- ↑ অবেস্থা=অবস্থা।
- ↑ জল পইরা=জলপড়া দিয়া। জলে মন্ত্র পড়িয়া, সেই জল ছিটাইয়া নানারূপ যাদু করা, রোগ ভাল করা প্রভৃতির প্রচলন এখনও দূর পল্লীগ্রামে দেখিতে পাওয়া যায়।
- ↑ নফর=চাকর; বড় বড় লোককে বশীভূত করিয়া ভৃত্য বানাইয়া রাখিল।
- ↑ দুস্কিনীর=দুঃখিনীর।
- ↑ বির্খে=বৃক্ষে।
- ↑ কাউয়া=কাক।
- ↑ পুষ্প তোলা=ফুল তুলিতে।
- ↑ আইঞ্চল=অঞ্চল
- ↑ চোরে=চলিয়া।
- ↑ বন্ধেরে=বন্ধুকে।