পৃথিবী/পৃথিবীর গতিপ্রণালী
দ্বিতীয় অধ্যায়।
পৃথিবীর গতি প্রণালী।
পূর্ব্বেই বলা হইয়াছে বুধ মঙ্গল ও শুক্র ছাড়া আর সকল গ্রহ অপেক্ষাই পৃথিবী আয়তনে ছোট। পৃথিবীর বিষুবরেখার ব্যাস প্রায় ৭৯২৫ মাইল, এবং মেরু-ব্যাস ৭৮৯৯ মাইল মাত্র। আয়তনে পৃথিবী ২৬১০০০০ লক্ষ ঘন মাইল এবং ভূপৃষ্ঠ ১৯৭৩১০০০০ বর্গ মাইল মাত্র। পৃথিবী গোলাকার এবং ইহার প্রত্যেক মেরু ১৩ মাইল করিয়া চাপা—অর্থাৎ মেরুদ্বয়ে আর ২৬ মাইল স্থান থাকিলে সম্পূর্ণ গোলাকার হইত। পৃথিবীর গোলাকৃতির প্রমাণ একখানি চলিত ভূগোল গ্রন্থেও দেখিতে পাওয়া যায় সুতরাং এস্থানে এই আকৃতি সম্বন্ধে বহুল বর্ণনা না করিয়া একেবারে ইহার গতি-আলোচনাই আরম্ভ হইল।
আমরা দেখিতে পাই পর্য্যায়-ক্রমে দিনের পর রাত্রি, রাত্রির পর দিন আইসে। সূর্য্য প্রভাতে পূর্ব্ব দিকে উদিত হইয়া ক্রমশঃ পশ্চিমে অস্তমিত হয়। ইহাতে সহজেই বোধ হইতে পারে একদিনে সূর্য্য পৃথিবীর চারি দিকে ঘুরিয়া আসে। রাত্রে আকাশের নক্ষত্র দেখিলেও এইরূপ মনে হয় সেই জন্য পুরাকালে সর্ব্বত্রই বিশ্বাস ছিল যে স্থির পৃথিবীকে কেন্দ্র-স্বরূপ অবলম্বন করিয়া সূর্য্য ও নক্ষত্র সকল মণ্ডলাকারে তাহার চারি দিকে পরিভ্রমণ করে। যদিও টলেমির পূর্ব্ব্ববর্ত্তী হিপার্কস নামে একজন জ্যোতির্বেত্তা এই মতটির উদ্ভাবক তথাপি দ্বিতীয় খৃষ্ট শতাব্দীর মধ্য ভাগে মিশর দেশীয় টলেমিই প্রথমে ইহা বিশেষ পরিষ্কার করিয়া লিপিবদ্ধ করেন এনিমিত্ত তাঁহার নাম হইতে জ্যোতিষ্ক-জগতের এই কল্পিত ভ্রমণ-প্রণালীকে টলেমিক প্রণালী কহে। খৃষ্টীয় ১৫ শ শতাব্দী পর্য্যন্ত ইউরোপে এই মত প্রবল রূপে প্রচলিত ছিল। পরে বিখ্যাত জ্যোতির্ব্বেত্তা কোপর্ণিকস ইহার ভ্রম দেখাইয়া সপ্রমাণ করেন যে পৃথিবী ২৪ ঘণ্টায় এক একবার আপনার মেরুদণ্ডের চারিদিক আবর্ত্তন করে সেই জন্য সূর্য্য ও নক্ষত্রমণ্ডলীর ঐরূপ দৃশ্যমান গতি অনুভূত হয়। কিন্তু কোপর্ণিকস ইউরোপে ১৫শ শতাব্দীতে যে সত্যটি প্রমাণ করেন ভারতবর্ষীয় পণ্ডিতগণ তাহার বহু পূর্ব্বে সে সত্যটি জানিতেন। জ্যোতির্ব্বিদ-শ্রেষ্ঠ আর্য্যভট্ট, কোপর্ণিকসের প্রায় এক সহস্র বৎসর পূর্ব্বে পৃথিবীর গতিবিধি পরিষ্কার রূপে বর্ণনা করিয়া গিয়াছেন। এক সময়ে ভারতবর্ষে যে জ্যোতিষ শাস্ত্রের বিশেষ চর্চ্চা হইয়াছিল তাহার আর সন্দেহ নাই। তথাপি দুর্ভাগ্য ভারতবর্ষ এজন্য যশস্বী হইতে পারিল না।
যদি দুইটি বস্তুর মধ্যে একটি স্থির থাকে এবং অপরটি চলিয়া যায়, তাহা হইলে ঐ গমনশীল বস্তুর গতি দুই প্রকারে অনুভূত হইতে পারে। গমনশীল বস্তুর মধ্যে লোক থাকিলে সে এক প্রকার গতি অনুভব করে, আর স্থির বস্তুর মধ্যে যে লোক থাকে সে আর এক প্রকার গতি অনুভব করে। প্রথমোক্ত লোক মনে করে নিজের অধিকৃত বস্তু স্থির আছে এবং স্থির বস্তুটি বিপরীত দিকে সরিয়া যাইতেছে। শেষোক্ত ব্যক্তি ঠিক ইহার বিপরীত অনুভব করে। সৌর জগৎ সম্বন্ধেও এইরূপ। পৃথিবী, সূর্য্য প্রভৃতি জ্যোতিষ্কমণ্ডলীর তুলনায় একটি বালুকা-কণা হইতেও ক্ষুদ্র, ব্রহ্মাণ্ড অনন্ত অসীম। এই অনন্ত অসীম ব্রহ্মাণ্ডের, পৃথিবীর চারিদিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে একবার ঘুরিতে অনন্ত গতি শক্তির আবশ্যক, এবং পরস্পর হইতে অসীম দূরে অবস্থিত জ্যোতিষ্ক মণ্ডলীর যে ঠিক একই সময়ে পৃথিবীকে আবর্ত্তন করিবে ইহাও সম্ভাব্য নহে। এই নিমিত্ত কোপর্ণিকস প্রথমে সিদ্ধান্ত করেন পৃথিবী ২৪ ঘণ্টায় পশ্চিম হইতে পূর্ব্বাভিমুখে ঘুরিয়া আপনাকে আপনি একবার আবর্ত্তন করে, সেই জন্য আমাদের মনে হয় সূর্য্যাদি নক্ষত্রমণ্ডলী পূর্ব্ব হইতে পশ্চিমে চলিতেছে।
বর্ত্তমান সময়ের সর্ব্ববাদিসম্মত বিশ্বাস এই যে পৃথিবী ঈষদূন ২৪ ঘণ্টার মধ্যে একবার আপনার মেরুদণ্ডের চারিদিকে ঘুরিয়া আবার পূর্ব্বাবস্থায় ফিরিয়া আইসে, (ইহাই পৃথিবীর আহ্ণিক গতি) এবং সূর্য্যাদি জ্যোতিষ্কমণ্ডলী পৃথিবী সম্পর্কে স্থির। এই আহ্ণিক গতিই দিন রাত্রির কারণ। আহ্ণিক গতি দ্বারা পৃথিবীর যখন যে অংশ সূর্য্যাভিমুখী হয় তখন সেই ভাগে দিন, আবার সূর্য্য হইতে যে ভাগ যখন ফিরিয়া অন্য দিকে যায় সেই ভাগে তখন রাত্রি হয়।
কোন একটি দীপের সম্মুখে একটা গোলাকার বস্তু রাখিয়া ঘুরাইয়া দেখিলে আমরা দিন রাত্রের বিভাগ সহজেই বুঝিতে পারি।
উপরের সূ চিহ্ণিত ছবিটি যেন সূর্য্য আর দণ্ডে বিদ্ধ গোলাকার বস্তুটি যেন পৃথিবী। গোলাকার বস্তুর যে দুই প্রান্ত দিয়া ঐ দণ্ডটি চলিয়া গিয়াছে সেই দুইটি প্রান্ত পৃথিবীর দুইটি মেরু—উপরটি উত্তর, নিম্নটি দক্ষিণ—এবং মধ্যে লম্বমান যে দণ্ডটি দ্বারা এই দুই মেরু সংযুক্ত তাহা যেন পৃথিবীর মেরুদণ্ড। উভয় মেরু হইতে সর্ব্বত্র সমদূরে রাখিয়া গোলাকার বস্তুটির মধ্য দেশে যদি একটি বৃত্ত টানা যায় সেইটি পৃথিবীর বিষুবরেখা। উপরি উক্ত কল্পিত মেরুদণ্ডের চারিদিকে পৃথিবী ঘুরিতেছে। ঘুরিয়া যখন পশ্চিম অর্দ্ধাংশ একটু একটু করিয়া মেরুদণ্ডের পূর্ব্বে আসিতেছে তখনি তাহা সূর্য্যের বিমুখে পড়িয়া অন্ধকারাচ্ছন্ন হইতেছে, এবং পূর্ব্ব অর্দ্ধাংশ পশ্চিমে আসিয়া সূর্য্যাভিমুখে পড়ায় আলোক পাইতেছে। এইরূপে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পৃথিবীর প্রত্যেক অর্দ্ধাংশে একবার দিন একবার রাত্রি হয়, এক অর্দ্ধাংশে যখন রাত্রি অপর অর্দ্ধাংশে তখন দিন থাকে।
আমরা প্রত্যহ যে সময় সূর্য্যকে উদয় হইতে দেখিতে পাই তাহার ২৪ ঘণ্টা পরে আবার সূর্য্য উদিত হয় এই নিমিত্ত আমরা বুঝিতে পারি পৃথিবীর যে স্থান সূর্য্য হইতে বিমুখে যাইতে আরম্ভ করে; সে স্থানের আবার সুর্য্যাভিমুখে আসিতে ২৪ ঘণ্টা লাগে অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টায় পৃথিবী পূর্ব্বাবস্থায় ফিরিয়া আইসে।
চিত্রিত গোলাকার বস্তুটিকে তাহার মেরুদণ্ডের উপব যেরূপ সোজা ভাবে রাখা হইয়াছে দণ্ডে বিদ্ধ কোন গোলাকার বস্তুকে ঠিক এই রূপ সোজা ভাবে রাখিয়া কোন দীপের চারিদিকে ঘুরাইলে দেখা যাইবে গোলাকার বস্তুর এক অর্দ্ধাংশ যতক্ষণ আলোকে থাকিবে, অপরার্দ্ধ ঠিক ততক্ষণ অন্ধকারে থাকিবে। কেন না গোলাকার বস্তুটি এখন যে পথে ঘুরিতেছে তাহা এই বস্তুটির মেরুদণ্ড দ্বারা ঠিক দুই ভাগে বিভক্ত। সেই জন্য এই মেরুদণ্ডই অন্ধকার ও আলোকের সীমা নির্দ্দিষ্ট করিতেছে।
পৃথিবী যদি এই গোলাকার বস্তুর ন্যায় আপন মেকদণ্ডকে অয়নমণ্ডলের উপর ঠিক সোজা ভাবে রাখিয়া ঘুরিত, তাহা হইলে পৃথিবীর সকল স্থানে সকল সময় দিন রাত্রির দৈর্ঘ্য সমান থাকিত। কিন্তু বাস্তব পক্ষে সকল সময় সকল স্থানে দিন রাত্রি সমান থাকে না। আমরা শীত কালে যখন দিন ছোট রাত্রি বড় এবং গ্রীষ্ম কালে দিন বড় রাত্রি ছোট দেখিতে পাই তখন পৃথিবী উপরের চিত্রটির ন্যায় আপন গতির পথে ঠিক সোজা ভাবে মেরুদণ্ড রাখিয়া ঘোরে না। পৃথিবী অয়নমণ্ডলের উপর কিরূপ ভাবে থাকিয়া ঘুরিলে দিন রাত্রের এরূপ বৈষম্য হইতে পারে তাহা নিম্নের চিত্রটি হইতে কিয়ৎ পরিমাণে বুঝা যাইতে পারে।
উপরের চিত্রটির ন্যায় একটি গোলাকার লৌহ তার বাম হস্তে ধরা যাউক। সেই গোলাকার তারটি যেন পৃথিবীর অয়নমণ্ডল। ঐ অয়নমণ্ডলের মধ্যে যেমন সূর্য্য চিত্রিত হইয়াছে সেই তারের মধ্যে তেমনি একটি দ্বীপ রাখা হউক। তাহার পর দণ্ডবিদ্ধ কোন গোলাকার বস্তুর দণ্ডটি দক্ষিণ হস্তে ধরিয়া উপরের চিত্রটির ন্যায় তাহাকে তারের গাত্রে ঈষৎ হেলাইয়া বাতিটির চারিদিকে ঘোরান যাউক তাহা হইলেই পৃথিবীর দিন রাত্রের বৈষম্যের কারণ বুঝা যাইবে। ঐরূপ অবস্থাপন্ন গোলাকার বস্তুকে নিজের চারি দিকে ঘুরাইলে তাহার সকল অংশ যতক্ষণ আলোকে থাকিবে ঠিক ততক্ষণ আবার অন্ধকারে থাকিবে। বরঞ্চ তদ্বিপরীতে যে অংশ যখন আলোকে অধিক ক্ষণ থাকিবে সে অংশ তখন অন্ধকারে অল্প ক্ষণ থাকিবে, এবং তাহার বিপরীত অংশ আবার সেই সময় আলোকে অল্প ক্ষণ থাকিয়া অধিক ক্ষণ অন্ধকারে থাকিবে।
উপরের চিত্রিত গোলাকার পৃথিবী স্থির মেরুদণ্ডকে অবলম্বন করিয়া অয়নমণ্ডলে যেন কৌণিক ভাবে ঘুরিতেছে। উত্তর মেরু এখন সূর্য্যের অভিমুখে এবং দক্ষিণ মেরু সূর্য্যের বিমুখে হেলিয়া আছে। সেই নিমিত্ত উত্তর ভাগে—অর্থাৎ বিষুবরেখার উত্তর দিকে যত পরিমাণে দিবসের দৈর্ঘ্য বিষুবরেখার দক্ষিণ ভাগে তত পরিমাণে রাত্রের দৈর্ঘ্য অধিক, কেবল ঠিক বিষুবরেখাবর্ত্তী প্রদেশে দিবা রাত্রি সমান। যতক্ষণ পৃথিবী এই অবস্থায় থাকিয়া ঘুরিবে ততক্ষণ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে একবার ঘুরিয়া গেলেও দক্ষিণ মেরু সূর্য্যের অভিমুখী ও উত্তর মেরু সূর্য্যের বিমুখী হইবে না সুতরাং দক্ষিণ মেরুতে ২৪ ঘণ্টা রাত্রি—ও উত্তর মেরুতে ২৪ ঘণ্টাই দিন থাকিবে।
এদিকে পৃথিবীর ঘূরিবার সময় দক্ষিণ মেরু হইতে দূরবর্ত্তী স্থান সকল তাহাদের দূরত্বের পরিমাণ অনুসারে ক্রমেই একটু একটু করিয়া সূর্য্যের অভিমুখে পড়িতেছে তবে বিষুবরেখা ও দক্ষিণ মেরুর মধ্যবর্ত্তী স্থল যতটুক সূর্য্যের অভিমুখে পড়িতেছে—তাহা অপেক্ষা অধিক ভাগ বিমুখে পড়িতেছে—সেই জন্য এখানে রাত্রির দীর্ঘতা অধিক। অধিক স্থল অতিক্রম করিয়া সূর্য্যাভিমুখী হইতে কাজেই ইহার অধিক সময় লাগে।
কিন্তু বিষুবরেখাবর্ত্তী প্রদেশে আবার দিনরাত্রি সমান দীর্ঘ—কেন না বিষুবরেখার ঠিক অর্দ্ধভাগ সূর্য্যাভিমুখে এবং অপরার্দ্ধভাগ সূর্য্যের বিমুখে পড়িতেছে—সুতরাং বিষুবরেখাবর্ত্তী প্রদেশের সূর্য্যাভিমুখী হইতেও সে সময় লাগে ইহার বিমুখে পড়িতেও সেই সময় লাগে। তাহার পর বিষুবরেখা ছাড়াইয়া যতই উত্তরে যাওয়া যাইবে ততই দিবসের দৈর্ঘ্য বাড়িয়া বাড়িয়া উত্তর মেরুতে পৌঁছিলে একেবারে আলোকের রাজ্যে আসিয়া উপস্থিত হইতে হয়। বিষুবরেখার উত্তর অংশ ক্রমেই অধিক পরিমাণে সূর্য্যাভিমুখী হইতে আরম্ভ হইয়া সমস্ত মেরু প্রদেশ একেবারে সূর্য্যের দিকে হেলিয়া পড়িয়াছে সেই জন্য এ মেরুতে ২৪ ঘণ্টাই দিন।
এইরূপে পৃথিবীর দক্ষিণ মেরু হইতে আরম্ভ করিয়া উত্তর মেরু পর্য্যন্ত আসিলে নিরবচ্ছিন্ন রাত্রের রাজত্ব হইতে ক্রমশ আমরা নিরবচ্ছিন্ন দিনের রাজত্বে আসিয়া পড়ি, এবং মধ্যস্থানে দিন রাত্রি সমান দেখিতে পাই। পৃথিবীর বিষুবরেখা বা কটিদেশের দুইটি স্থান প্রত্যহ অয়নমণ্ডলকে ছুঁইয়া ছুঁইয়া যায় এবং সেই দুই বিন্দু দ্বারাই অন্ধকার ও আলোকের সমান বিভাগ করিতেছে, কাজেই কটিদেশে দিনরাত্রি সমান।
অয়নমণ্ডলে কৌণিক ভাবে থাকিয়া প্রত্যহ পৃথিবী একবার করিয়া আপন মেরুদণ্ড যেন আবর্ত্তন করিতেছে—এই আবর্ত্তন হেতু যেন দিন রাত্রির বৈষম্য উপস্থিত হইতেছে কিন্তু প্রশ্ন এই পৃথিবীতে চিরকাল একই মেরুতে দিন, একই মেরুতে রাত্রি ও একই স্থানে রাত্রের দৈর্ঘ্য একই স্থানে দিবসের দৈর্ঘ্য না থাকিয়া কখনো উত্তর মেরু অন্ধকার কখন আলোকিত কখনো একস্থানে দিন ছোট আবার কখন দিন বড় এরূপ পরিবর্ত্তন হয় কেন?
আহ্ণিক গতিই পৃথিবীর একমাত্র গতি হইলে সময়-ভেদে দিন রাত্রির এরূপ দৈর্ঘ্য প্রভেদ হইত না সন্দেহ নাই, কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে তাহা নহে, আপনার চারি দিকে প্রত্যহ একবার করিয়া ঘুরিতে ঘুরিতে পৃথিবী এক বৎসরে সূর্য্যকে আবার একবার প্রদক্ষিণ করিয়া আসে। প্রতিদিন সূর্য্য ও নক্ষত্রাদির স্থান পরিবর্ত্তনই ইহার প্রমাণ। কেবল আহ্নিক গতিই যদি পৃথিবীর একটি মাত্র গতি হইত তাহা হইলে প্রতিদিন সূর্য্য একই স্থানে উদয় হইত। অর্থাৎ আজ সূর্য্য যে নক্ষত্ররাশির নিকটে উঠিত, চিরকালই সেই স্থানে তাহাকে আমরা উঠিতে দেখিতে পাইতাম। কিন্তু বাস্তব পক্ষে তাহা হয় না, যদি আমরা সূর্য্যের গতি পর্য্যবেক্ষণ করিয়া দেখি তাহা হইলে দেখিতে পাই, যে সূর্য্য চৈত্র মাসের এক দিন ঠিক পূর্ব্বে উদয় হইয়া ঠিক পশ্চিমে অস্ত যায়, তাহার পর দিন হইতে সূর্য্য উত্তরোত্তর উচ্চ হইয়া একটু উত্তর পূর্ব্বে উঠিতে আরম্ভ করে। এইরূপ প্রত্যহ ক্রমশ উত্তর দিকে অগ্রসর হইয়া তিন মাস পরে যতদূর সম্ভব উত্তরে যায়, আবার বক্রগতিতে ফিরিয়া তিন মাসের পর ঠিক পূর্ব্বে উদয় হয়। পরে প্রথমে যেরূপ উত্তরের দিকে অগ্রসর হইয়াছিল সেইরূপ পূর্ব্ব, হইতে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হইতে থাকে—এবং তিন মাস পরে দক্ষিণে যতদূর যাইবার গিয়া আবার দক্ষিণ হইতে পূর্ব্বে ফিরিতে আরম্ভ করে। এইরূপ একবার উত্তর প্রান্ত হইতে আরম্ভ করিয়া আবার উত্তর প্রান্তে ফিরিয়া আসিতে সূর্য্যের এক বৎসর লাগে—এবং উত্তর হইতে দক্ষিণ যাইবার সময় একবার এবং দক্ষিণ হইতে উত্তরে ফিরিয়া আসিবার সময় একবার পূর্ব্বে উদিত হয়। সূর্য্যের এই দৃশ্যতঃ গতি দ্বারা আকাশে একটি বৃত্তাভাষ অঙ্কিত হয় তাহাকে রাশিচক্র বা সূর্য্যের অয়নমণ্ডল কহা যায়।
আমরা ইতিপূর্ব্বে দেখিয়াছি সূর্য্য স্থির, তবে সূর্য্যের এই দৃশ্যমান গতি হয় কেন? পৃথিবী দিন দিন সূর্য্য হইতে একটু একটু করিয়া সরিয়া আবার এক বৎসরে সেই পূর্ব্বস্থানে আইসে এই নিমিত্তই আমাদের মনে হয় সূর্য্য স্থান পরিবর্ত্তন করিতেছে। এই গতির নিমিত্ত সূর্যের ন্যায় তারাদিগকেও আমরা প্রত্যহ স্থান পরিবর্তন করিতে দেখিতে পাই। যদি একই স্থানে থাকিয়া পৃথিবী প্রত্যহ নিজ মেরুদণ্ড আবর্ত্তন করিত তাহা হইলে আজ আমরা সন্ধ্যাকালে যে নক্ষত্রমালা দেখিতে পাইতাম চিরকাল ধরিয়া সন্ধ্যাকালে সেই তারকাগুলিই দেখিতাম। আজ আমরা দ্বিপ্রহর রাত্রে যে তারকাগুলি দেখিলাম চিরকাল দ্বিপ্রহর রাত্রে সেইগুলি সেইস্থানে দেখা দিত, এবং চিরদিন ঊষাকালে এই তারকা-রাশি দেখিতে পাইতাম। এক কথায় মেরুদণ্ড আবর্ত্তনের সঙ্গে সঙ্গে যে আকাশভাগ যে সময় আমাদের দৃষ্টিপথে পড়িত, ঠিক সেই অংশ আমরা চিরকালই সমান দেখিতে পাইতাম। কিন্তু বাস্তব পক্ষে আমরা চির কাল ধরিয়া এক সময়ে একই তারকা-মালা দেখিতে পাই না, যে তারকামালা গ্রীষ্ম কালের দ্বিপ্রহর রাত্রে দেখা দেয় তাহা আর শীত কালের দ্বিপ্রহর রাত্রে দেখা যায় না, সে সময় আমরা অন্য তারা দেখিতে পাই। ৬ মাস আমরা মস্তকের উপরকার ব্রহ্মকটাহে যে সকল তারা দেখি আর ৬ মাস তাহারা সেই সময় আমাদের পদনিম্নের ব্রহ্মকটাহে থাকে, সেই জন্য প্রতি ৬ মাসে আমরা ভিন্ন ভিন্ন তারকা-মালা দেখিতে পাই। অথবা সন্ধ্যাকালে পৃথিবীর একদিক হইতে যে সকল নক্ষত্র দেখিতে পাওয়া যায় রাত্রি শেষে অতি প্রত্যুষে সেই সমুদায় নক্ষত্র অন্তর্হিত হইয়া ঠিক বিপরীত দিকের দৃষ্টিপথে পতিত হয়, তবে প্রভেদ এই, এক সময়ে আজ যে সকল নক্ষত্র উপরে, ছয় মাস পরে সেই সমুদায় নক্ষত্র নীচে, এবং নীচের নক্ষত্র উপরে আসিবে। লক্ষ্য করিয়া দেখিলে দেখা যায়, দিন দিন তারাগুলি কিরূপে পশ্চিমে সরিয়া সরিয়া উদিত হইয়া কিছুদিন পরে একেবারে অদৃশ্য হইয়া পড়ে, এবং ঠিক এক বৎসর পরে আবার সেই পূর্ব্বস্থানে উদিত হয়। সূর্য্যকে ঘুরিয়া পূর্ব্বস্থানে আসিতে পৃথিবীর যে এক বৎসর লাগে এই তাহার প্রমাণ। পৃথিবীর উভয় মেরুবর্ত্তী তারকা ব্যতীত সূর্য্য পরিভ্রমণের সঙ্গে সঙ্গে অন্য সকল তারারই উপরোক্ত রূপ দৃশ্যতঃ গতি হয়। পৃথিবীর মেরুদ্বয়ের উপরকার আকাশে যে সকল তারকা আছে, তাহারা কখন অদৃশ্য হয় না। কারণ পৃথিবী আপন অয়নমণ্ডলের উপর যে ২৩ ডিগ্রি ২৮ মিনিট[১] কৌণিক ভাবে অবস্থিত তাহা চিরকালি প্রায় একরূপ সমান ভাবে রহিয়াছে।[২] সেই জন্য উভয় মেরুর লক্ষ্য ঠিক একই দিকে নিবদ্ধ। একটি ভাঁটা গড়াইয়া দেখিলে ইহা স্পষ্টরূপে বুঝা যাইবে। একটি ভাঁটা পূর্ব্ব হইতে পশ্চিমাভিমুখে সোজা গড়াইয়া দাও, ঘুরিবার সময় ইহার দুই প্রান্ত ছাড়া অন্য সকল অংশই একবার করিয়া নিম্নাভিমুখী ও একবার করিয়া উর্দ্ধাভিমুখী হইবে। যদি ভাঁটাটি কোন রূপ ক্ষুদ্র জীবের বাসস্থান হয় এবং মাটীর পরিবর্ত্তে শূন্যে ঘুরিতে থাকে তাহা হইলে ঘুরিবার সঙ্গে সঙ্গে ইহার প্রত্যেক অংশের জীব একবার করিয়া নিম্ন আকাশ এবং একবার করিয়া ঊর্দ্ধ আকাশ দেখিতে পাইবে। কিন্তু ভাঁটাটি পূর্ব্ব হইতে পশ্চিমে যতই ঘুরুক তাহার প্রান্তের জীবগণ উত্তর দক্ষিণ আকাশ ছাড়া অন্য স্থানের জীবগণের ন্যায় সময়ে সময়ে ভিন্ন ভিন্ন আকাশখণ্ড কখনই দেখিতে পাইবে না। সেইরূপ পৃথিবীর মেরু দ্বয়ের চিরকালি উত্তর দক্ষিণে লক্ষ্য নিবদ্ধ বলিয়া সেখানকার তারকারাশি আর কখনো অস্তমিত হয় না। মেরু দেশে মনুষ্য থাকিলে পৃথিবীর দৈনিক গতির সঙ্গে সঙ্গে তারকারাশি চক্রাকারে তাহাদের ঠিক মাথার উপরকার তারাটির চারি দিকে ঘুরিয়া বেড়াইত মাত্র, একেবারে তাহাদের নেত্র হইতে কখনই অন্তর্হিত হইত না। এই একই কারণে অর্থাৎ উত্তর মেরুর লক্ষ্য চিরকাল উত্তরে নিবদ্ধ বলিয়াই আমরা উত্তর মেরুবর্ত্তী তারাটিকে (যাহা ধ্রুবতারা নামে খ্যাত) চির কালি সমভাবে একই স্থানে দেখিতে[৩] পাই এবং পৃথিবীর দৈনিক গতির সঙ্গে সঙ্গে উত্তর আকাশের তারকাগণ আমাদের নিকট অস্তমিত না হইয়া ধ্রুব তারাটির চারি দিকে ঘুরিতে থাকে। আমরা বিষুবরেখার উত্তরে বলিয়া উত্তর-মেরু-সন্নিহিত তারকা দেখিতে পাই, দক্ষিণ মেরু আমাদের দিগ্বলয় (দৃষ্টি-ব্যাপিকা। Horizon) রেখার নীচে এই জন্য তৎসন্নিহিত তারা আমরা দেখিতে পাই না, কিন্তু যাহারা ঠিক বিষুব-রেখাবর্ত্তী দেশে বাস করে তাহারা উভয় মেরুবর্ত্তী তারকাই আকাশের উত্তর দক্ষিণ দিগ্বলয়ে সমান দেখিতে পায়। যতই বিষুব রেখা ছাড়াইয়া যাওয়া যায় ততই এক মেরুর আকাশ ক্রমে ক্রমে অদৃশ্য হইতে থাকে এবং অন্য মেরুর আকাশ ছাড়াইয়াও অপর দিকের আকাশে দৃষ্টি চলে, সেই জন্য বিষুব-রেখা হইতে মেরুদ্বয়ের তারকা যেমন ঠিক উত্তর দক্ষিণ দিগ্বলয়ে থাকে বিষুব রেখা ছাড়াইলে তাহা থাকে না। যতই বিষুবরেখা ছাড়াইয়া কোন মেরু অভিমুখে যাওয়া যায় ততই সেই মেরুর তারকা ঠিক আমাদের উত্তর কিম্বা দক্ষিণ দিগ্বলয়ে না থাকিয়া অপেক্ষাকৃত ঊর্দ্ধে উঠিতে থাকে, অর্থাৎ মেরু ছাড়াইয়া যত দূরের আকাশে আমাদের দৃষ্টি পড়ে সেই আকাশই ঠিক আমাদের দক্ষিণ কিম্বা উত্তর দিগ্বলয় হয় এবং মেরুবর্ত্তী আকাশ তাহা অপেক্ষা ঊর্দ্ধভাগে আসিয়া পড়ে। এইরূপে উত্তর মেরুতে পৌঁছিলে আমরা দেখিতে পাই বিষুবরেখা-বাসী লোকের নিকট যাহা উত্তর দিগ্বলয় তাহাই ঠিক আমাদের, মাথার উপরকার আকাশ। বিষুবরেখা হইতে কলিকাতা প্রায় ৭ শত ক্রোশ উত্তরে বলিয়াই উত্তর মেরুবর্ত্তী ধ্রুব তারাকে ঠিক আমরা উত্তর দিগ্বলয়ে না দেখিয়া কিছু উপরেই দেখিতে পাই।
এখন আমরা দেখিয়া আসিলাম ২৪ ঘণ্টায় যেমন পৃথিবী আপনাকে আপনি একবার আবর্ত্তন করে এক বৎসরে তেমনি সূর্য্যকে একবার প্রদক্ষিণ করিয়া আইসে। পৃথিবীর এই দুইটি গতি মিশ্রিত হইয়া যে একটি গতির উৎপত্তি হয় তাহা অনেকটা লাটিমের গতির মত। একটা লাটিমকে ঘুরাইয়া দিলে অনেক সময় সে নিজের চারি দিকে ঘুরিতে ঘুরিতে আবার একটি স্বতন্ত্র চক্রাকার পথে যায়। পৃথিবী ঈষৎ বেঁকিয়া বেঁকিয়া ঠিক সেইরূপে আকাশ-পথে সর্পকুণ্ডলাকৃতি চক্র কাটিতে কাটিতে চলিতেছে। পৃথিবী ঘুরিতে ঘুরিতে এইরূপে যে চক্রাকার পথে সূর্য্যকে প্রদক্ষিণ করে তাহাই পৃথিবীর অয়নমণ্ডল। পৃথিবীর অয়নমণ্ডল সম্পূর্ণ গোলাকার নহে ইহা অনেকটা ডিম্বাকৃতি (বৃত্তাভাস)। এই অয়নমণ্ডলের দুইটি অধিশ্রয় (focus) আছে।[৪] একটি অধিশ্রয় শূন্য একটি অধিশ্রয়ে সূর্য্য অবস্থিত। সেই জন্য অয়নমণ্ডলের সকল স্থান সূর্য্য হইতে সমান দূরে নহে।
দ্বিতীয় চিত্রটি দেখিলে দেখা যাইবে খ প্রান্ত সূর্য্য হইতে যেমন অপেক্ষাকৃত দূরে ক প্রান্ত তেমনি অপেক্ষাকৃত নিকটে। এই ডিম্বাকৃতি অয়নমণ্ডল দিয়া পৃথিবী সূর্য্যকে প্রদক্ষিণ করে।
পৃথিবী প্রত্যহ নিজের মেরুদণ্ডের চারি দিকে আবর্ত্তন করে বলিয়া যেমন দিন রাত্রি হয় ও অয়নমণ্ডলের উপর সেই মেরুদণ্ড কৌণিক ভাবে অবস্থিত বলিয়া যেমন দিন রাত্রের দৈর্ঘ্য বৈষম্য হয় পৃথিবী ঘূরিবার সময় তেমনি সূর্য্য সম্পর্কে আপন অবস্থা পরিবর্ত্তন করে সেই হেতু আবার উত্তরার্দ্ধে ও দক্ষিণার্দ্ধে সময়ভেদে রাত্রি দিনের দৈর্ঘ্যের পরিবর্ত্তন হয়। যদি পৃথিবী সূর্য্য সম্পর্কে আপন অবস্থা পরিবর্ত্তন না করিত, তাহা হইলে এক মেরু চিরকালি সূর্য্যের বিমুখে ও আর এক মেরু চির কালি তাহার অভিমুখে থাকিত, এবং পৃথিবীর অন্যান্য স্থানেও রাত্রি দিনের দৈর্ঘ্য পরিবর্ত্তনশীল হইত না—তাহা চিরকালি সমান থাকিত। উত্তর বিভাগে রাত্রি অপেক্ষা দিবস বড় হইলে সেখানে চিরকালই দিবস বড় থাকি এবং—দক্ষিণ বিভাগে রাত্রি বড় হইলে সেখানে চিরকালই রাত্রি বড় থাকিত, সুতরাং আমরা শীতকালে, দিন ছোট ও গ্রীষ্মকালে দিন বড় দেখিতে পাইতাম না। কিন্তু আমরা যে কালে ভিন্ন ভিন্ন ঋতুতে দিন রাত্রের দৈর্ঘ্যের প্রভেদ দেখিতে পাই সেকালে বার্ষিক গতির সময় পৃথিবী সূর্য্য সম্পর্কে তাহার অবস্থা পরিবর্ত্তন করে ইহাতে আর সন্দেহ নাই। এই অবস্থা পরিবর্ত্তন হেতুই ভিন্ন ভিন্ন সময়ে দিবারাত্রের দীর্ঘতার প্রভেদ হয়। এই কারণ বশতঃ বৎসরের মধ্যে পৃথিবীর দুই অংশ দুই বার করিয়া সূর্য্যের অভিমুখে এবং দুইবার বিমুখে ঝুঁকিয়া পড়ে, এবং দুইবার সূর্য্যের পাশাপাশি হইয়া সূর্য্যের সম্পর্কে পৃথিবীর মেরুদণ্ড ঠিক সোজা ভাবে থাকে। তৃতীয় চিত্রটি হইতে ইহা স্পষ্টরূপে বুঝা যাইতে পারে।
অয়নমণ্ডলের খ প্রান্তে আসিয়া যে দিন পৃথিবীর উত্তরাংশ সূর্য্যের অভিমুখে যত দূর যাইবার যায় সেই দিন দক্ষিণাংশ যতদূর বিমুখে ঝুঁকিবার ঝোঁকে সেই জন্য উত্তরাংশে এই দিনে দিবসের দৈর্ঘ্য সর্ব্বাপেক্ষা যেমন অধিক, দক্ষিণাংশে রাত্রির দৈর্ঘ্য সর্ব্বাপেক্ষা তেমনি অধিক হয়। ইহার পর দিন হইতে আবার উত্তরাংশ সূর্য্যের বিমুখে এবং দক্ষিণাংশ সূর্য্যের দিকে যাইতে আরম্ভ করে, সেই জন্য উত্তরাংশে অল্পে অল্পে দিবসের দৈর্ঘ্য ও দক্ষিণাংশে রাত্রির দৈর্ঘ্য কমিয়া কমিয়া দিন রাত্রি সমান হইতে আরম্ভ হয়, এবং তিন মাস পরে যখন পৃথিবী গ চিহ্নিত স্থানে আইসে তখন একেবারে সূর্য্যের পাশাপাশি হইয়া পড়ে, তাহাতে পৃথিবীর ঠিক অর্দ্ধ ভাগ সূর্য্যের অভিমুখী আর ঠিক অর্দ্ধভাগ বিমুখী হয়, সেই নিমিত্ত পৃথিবী এই স্থানে পৌঁছিলে এক দিন সমস্ত পৃথিবীময় অর্থাৎ পৃথিবীর এক মেরু হইতে অপর মেরু পর্য্যন্ত সমান দিন রাত্রি হয়। ইহার পর দিন হইতে উত্তর মেরু সূর্য্যের বিমুখে ও দক্ষিণ মেরু তদভিমুখে ঘুরিয়া যায়। এই দিন হইতে উত্তর মেরুতে রাত্রি ও দক্ষিণ মেরুতে দিন আরম্ভ হইয়া ৬ মাস ধরিয়া এক মেরুতে আলোক ও এক মেতে অন্ধকার থাকে[৫] এবং উত্তরাংশে উত্তরোত্তর রাত্রির ও দক্ষিণাংশে দিবসের দৈর্ঘ্য বাড়িতে আরম্ভ হয়। তদনন্তর তিন মাস পরে যখন পৃথিবী ক চিহ্নিত স্থানে আইসে তখন উত্তরাংশ সূর্য্যের যতদূর বিমুখে এবং দক্ষিণাংশ যতদূর অভিমুখে যাইবার যায়। সেই জন্য এই দিনে উত্তরে সর্ব্বাপেক্ষা রাত্রির দৈর্ঘ্য ও দক্ষিণে দিবসের দৈর্ঘ্য বাড়ে। ইহার পর দিন হইতে উত্তর মেরু আবার সূর্য্যের অভিমুখে ও দক্ষিণ মেরু সূর্য্যের বিমুখে যাইতে আরম্ভ করে, উত্তরাংশে আবার রাত্রির দৈর্ঘ্য ও দক্ষিণাংশে দিবসের দৈর্ঘ্য কমিতে আরম্ভ করিয়া দিন রাত সমান হইতে থাকে। তিন মাস পরে পৃথিবী ঘ চিহ্নিত স্থানে আসিয়া আবার সূর্য্যের পাশাপশি হইয়া পড়ে সেই নিমিত্ত তখন আর এক দিন পৃথিবীর এক মেরু হইতে অপর মেরু পর্য্যন্ত সমান দিন রাত্রি হয়। ইহার পর দিন হইতে উত্তর মেরু সূর্য্যের অভিমুখে পড়িয়া উত্তর মেরুতে দিবস ও দক্ষিণ মেরুতে রাত্রি আরম্ভ হয়। ৬ মাস ধরিয়া ২৪ ঘণ্টাই এক মেরুতে আলোক ও আর এক মেরুতে অন্ধকার থাকে। এবং উত্তরার্দ্ধে দিবসের দৈর্ঘ্য ও দক্ষিণার্দ্ধে রাত্রির দৈর্ঘ্য উত্তরোত্তর বাড়িয়া তিন মাস পরে আবার পৃথিবী খ চিহ্নিত স্থানে আইসে। সেই দিন উত্তরার্দ্ধ সূর্য্যাভিমুখে যত দূর ঝুঁকিবার এবং দক্ষিণার্দ্ধে সূর্য্যের যত দূর বিমুখে যাইবার যায় সেই জন্য উত্তরে দিবসের দৈর্ঘ্য এবং দক্ষিণে রাত্রির দৈর্ঘ্য সেই দিন সর্ব্বাপেক্ষা বাড়িয়া পর দিন হইতে আবার কমিতে থাকে।
এইরূপে পৃথিবীর সকল অংশে বৎসরে দুই দিন করিয়া সমান রাত্রি দিন (Equinox) হয়; একদিন ২২ মার্চ একদিন ২২ সেপ্টেম্বর। এবং দুই দিন করিয়া পৃথিবীর দুই অর্দ্ধ এক এক বার সূর্য্যের দিকে সর্ব্বাপেক্ষা অধিক ঝোঁকে। এক দিন ২২ জুন ও এক দিন ২২ ডিসেম্বর। ২২ মার্চ পৃথিবীতে যে দিন সমরাত্র হয় সেই দিন হইতে ইয়োরাপীয় জ্যোতির্ব্বিদগণ জ্যোতিষিক নূতন বৎসর গণনা করেন। সেই বাসন্তিক সমরাত্র-দিনের পর হইতে উত্তর মেরু সূর্য্যের দিকে, ও দক্ষিণ মেরু সূর্য্যের বিমুখে ঝুকিতে আরম্ভ করে সেই জন্য ২২ মার্চের পর হইতে উত্তরাংশে দিবসের দৈর্ঘ্য ও দক্ষিণাংশে রাত্রির দৈর্ঘ্য বাড়িতে থাকে। উত্তর মেরুতে ৬ মাসের জন্য দিন দক্ষিণ মেরুতে ৬ মাসের জন্য রাত্রি আরম্ভ হয়। তিন মাস পরে ২২ জুনে পৃথিবী অয়নমণ্ডলের খ চিহ্নিত স্থানে পৌছিলে, উত্তর দিক সূর্য্যের দিকে ও দক্ষিণ দিক সূর্য্যের বিমুখে যত দূর যাইবার যায় সেই দিন উত্তরে সর্বাপেক্ষা দিবসের দৈর্ঘ্য ও দক্ষিণে রাত্রির দৈর্ঘ্য বাড়ে। সেই দিনকে উত্তরায়ন দিন (Summer solstice) কহে। সূর্য্যকে সেই দিন দৃশ্যতঃ আমর| উত্তরের শেষ সীমায় দেখিতে পাই। সেই জন্য এই দিন হইতে আবার দক্ষিণায়ন শারম্ভ হয়। ইহার পর দিন হইতে উত্তরে দিন ও দক্ষিণে রাত্রি কমিয়া ক্রমে দিন রাত্রি সমান হইতে থাকে। পরে ২২শে সেপ্টেম্বরে আবার পৃথিবীময় এক দিন সমান রাত্রি দিন হইয়া তাহার পর দিন হইতে উত্তর মেরুতে ৬ মাস অন্ধকার ও দক্ষিণ মেরুতে ৬ মাস আলোক হয় ও উত্তরে রাত্রির দৈঘ্য ও দক্ষিণে দিবসের দৈর্ঘ্য বাড়িতে থাকে। এবং ২২ শে ডিসেম্বরে আবার উত্তরার্দ্ধ যতদূর সূর্য্যের বিমুখে দক্ষিণার্দ্ধ তত দূর অভিমুখে ঝোঁকে সেই জন্য উত্তরাংশে এই দিবসে সর্ব্বাপেক্ষা রাত্রি বড় ও দক্ষিণার্দ্ধে দিন বড় হয়। এই দিনের নাম দক্ষিণায়ন দিন (Winter Solstice) কেন না এই দিন আমরা সূর্য্যকে দক্ষিণের শেষ সীমায় দেখিতে পাই। এই দিন হইতে সূর্য্য আবার উত্তরে ফিরিতে যাবম্ভ করে। উত্তরায়ন ও দক্ষিণায়ন দিনে আমাদের মনে হয় যেন সূর্য্য এক দিন করিয়া তাহার শেষ সীমায় থামিয়া আবার চলিতে আরম্ভ করিতেছে।
মার্চ ও সেপ্টেম্বর মাসের দুই সমরাত্রদিনে যখন পৃথিবী আপন কক্ষের গ ঘ বিন্দুতে গিয়া সূর্য্যের পাশাপাশি হইয়া পড়ে তখন আমরা সূর্য্যকে ঠিক পূর্ব্বে উঠিতে দেখি এবং পৃথিবী যখন অয়নমণ্ডলের ক খ বিন্দুতে যায় তখন সূর্য্যকে একবার আমরা দক্ষিণ সীমায় ও একবার উত্তর সীমায় দেখিতে পাই।
আমরা পৃথিবীতে অবস্থিত বলিয়া পৃথিবীর গতি অনুভব করিতে পারি না, সেই জন্য সূর্য্যকেই ক্রমাগত সরিতে দেখি। এইরূপে দৃশ্যতঃ সূর্য্য যে পথে পৃথিবীর চারিদিকে ঘোরে তাহাকে রাশিচক্র বলা যায়। এই রাশিচক্রের যে অংশ যে নক্ষত্ররাশির সম্মুখীন তাহা সেই নক্ষত্ররাশির নাম পাইয়াছে। মেষ, বৃষ, মিথুন, কর্কট, সিংহ, কন্যা, তুলা, বৃশ্চিক, ধনু, মকর, কুম্ভ, মীন এই বার রাশিতে রাশিচক্র বিভক্ত। এই রাশিচক্রে সূর্য্যের গতি অনুসারে আর্য্যগণ বৎসর গণনা প্রণালী স্থির করিয়া গিয়াছেন। মেষরাশিতে উদয় হইয়া যথাক্রমে অপর ১১ রাশি অতিক্রম করিয়া পুনরায় সূর্য্যের মেষরাশিতে আসিতে যে সময় লাগে তাহাই আমাদের এক বৎসর। সূর্য্য এক এক রাশিতে এক এক মাস অবস্থিতি করে। ইয়োরোপের জ্যোতিষিক বৎসর গণনার প্রথা অন্যরূপ। পৃথিবীর বিষুবরেখা ও রাশিচক্রের যে দুই স্থান পরস্পর কর্ত্তন করে সেই দুই স্থানে সূর্য্য আসিলে সমরাত্রদিবা হয়। বাসন্তিক সমরাত্রদিবার সময় সূর্য্য যে স্থানে থাকে সেই স্থান হইতে ছাড়িয়া আবার সেই স্থানে আসিলে ইয়োরোপীয় জ্যোতিষিক বৎসর পূর্ণ হয়। ইয়োরোপীয় জ্যোতিবের্ত্তারা অধুনা রাশি বিভাগ পরিত্যাগ করিয়াছেন। অপরাপর বৃত্তের ন্যায় সূর্য্যের দৃশ্যতঃ বাৎসরিক গতির পথকেও তাহারা তিন শত ষাট ভাগে বিভক্ত করেন।
এই প্রসঙ্গে ক্রমে আর একটি কথা বলিবার আবশ্যক আছে। পৃথিবীতে এক সম্বৎসরে যে ভিন্ন ভিন্ন ঋতুর পরিবর্ত্তন হয় দিবারাত্রের দৈর্ঘ্য-বৈষম্যই তাহার কারণ। যদি চিরকাল পৃথিবীতে সমরাত্রদিবা থাকিত তাহা হইলে পৃথিবীতে ঋতুর পরিবর্ত্তন হইত না, সমস্ত বৎসরেই পৃথিবীতে একটি মাত্র ঋতু থাকিত। সূর্য্যোত্তাপবৈষম্যই ঋতুর প্রধান কারণ। পৃথিবীর যখন যে অংশে দিবসের দৈর্ঘ্য অধিক হয় সেই অংশ তত অধিক ক্ষণ ধরিয়া সূর্য্যের উত্তাপ পায়, অথচ রাত্রি ছোট বলিয়া সেই সঞ্চিত উত্তাপ সমস্ত রাত্রি ধরিয়াও প্রতিনিক্ষেপ করিতে পারে না, কাজেই সেই অংশে তখন গ্রীষ্ম কাল উপস্থিত হয়। আবার যে অংশে রাত্রির দৈর্ঘ্য অধিক সে অংশ দিবসে অল্প উত্তাপ পায়—এবং যাহাও পায় রাত্রি বড় বলিয়া সমস্তই নিক্ষেপ করিতে পারে। বসন্ত কালে ও শরৎকালে দিনরাত্রি অনেকটা সমান থাকে সে জন্য এই দুই সময় শীত গ্রীষ্ম কিছুরই প্রভাব থাকে না, দিবসে পৃথিবী যত উত্তাপ পায় সমান রাত্রি বলিয়া তাহা নিক্ষেপ করিতে পারে। এইরূপে আমরা গ্রীষ্ম হইতে শরৎ, শরৎ হইতে শীত, শীত হইতে বসন্তে আসি। পৃথিবীতে যথার্থ পক্ষে এই চারি ঋতুর প্রাদুর্ভাব। অপর দুই ঋতুর মধ্যে, বর্ষা গ্রীষ্মের অন্তর্গত ও হেমন্ত শীতের মধ্যবর্ত্তী। পৃথিবীর উত্তর কিম্বা দক্ষিণাংশ যখন সূর্য্যের দিকে সর্ব্বাপেক্ষা ঝুঁকিয়া পড়ে--তখনি কি না দিবস কিম্বা রাত্রির পরিমাণ সর্ব্বাপেক্ষা বৃদ্ধি হয়, সেই জন্য এই সময়েই রাত্রি বৃদ্ধির সহিত শীতের ও দিবস বৃদ্ধির সহিত গ্রীষ্মের অভাব বাড়ে। দক্ষিণ কিম্বা উত্তর যতদূর সূর্য্যের অভিমুখে ও বিমুখে ঝুঁকিবার ঝুঁকিয়া যখন পরে আবার একটু একটু করিয়া সমান হইতে আরম্ভ হয়, তখন দিন রাত্রিও সমান হইতে আরম্ভ করে, সেই জন্য শীত গ্রীষ্মের মধ্যবর্ত্তী এই সময়ে শরৎ ও বসন্ত কালে আমরা একটি সুখজনক ঋতু উপভোগ করি। পৃথিবীর কটিদেশে দিবারাত্রি সমান বলিয়া সেখানে ঋতুপ্রভেদ নাই। কিন্তু তাহা হইলে যেখানে চির বসন্ত না হইয়া অতিশয় গ্রীষ্ম কেন? পূর্ব্বেই বলা হইয়াছে, যেখানে সূর্য্যোত্তাপ অধিক পরিমাণে সঞ্চিত হইতে পারে সেই খানেই অধিক গ্রীষ্ম হয়। দুই প্রকারে আমরা সূর্য্যের উত্তাপ অধিক পরিমাণে পাই, প্রথমতঃ রাত্রি অপেক্ষা দিবস বড় হইলে, দ্বিতীয়তঃ সূর্য্য ঠিক মাথার উপর দিয়া লম্ব ভাবে কিরণ প্রদান করিলে।[৬] সূর্য্য প্রতিদিন দ্বিপ্রহরে ঠিক আমাদের মস্তকের উপর দিয়া যখন কিরণ প্রদান করে তখন আমরা অধিক পরিমাণে গ্রীষ্ম বোধ করি। গ্রীষ্মকালে একে দিবস বড়, তাহাতে শীতকাল অপেক্ষা সূর্য্য আমাদের শিরোবিন্দুর নিকট থাকিয়া কিরণ দেয় সেই জন্য উত্তাপের এত প্রাখর্য্য হয়। শীতকালে একে দিবস ছোট তাহাতে সূর্য্য কৌণিক ভাবে পার্শ্ব দিয়া উত্তাপ দেয়, সেই জন্য সে উত্তাপ আমাদের পক্ষে যথেষ্ট হয় না।
বিষুবরেখাবর্ত্তী প্রদেশে চিরকালি সূর্য্য ঠিক মাথার উপর হইতে কিরণ প্রদান করে—সেই জন্য দিন রাত্রি সমান হইলেও সেখানে উত্তাপের প্রভাব অত্যন্ত অধিক। সেই জন্য সমস্ত বৎসরেই সেখানে গ্রীষ্মকাল। পৃথিবীর মেরুদেশেও বিশেষ ঋতুপরিবর্ত্তন দেখা যায় না, বৎসরের মধ্যে সেখানে দুইবার মাত্র ঋতুপরিবর্ত্তন হয়। একবার শীত একবার গ্রীষ্ম। যে ছয় মাস করিয়া সেখানে রাত্রি সেই ছয় মাস সেখানে শীত এবং যে ছয় মাস সেখানে দিন সেই ছয় মাস সেখানে গ্রীষ্ম।
পৃথিবী নিজ অয়নমণ্ডলে চিরকাল প্রায় সমান ভাবে ২৩ ডিগ্রি ২৮ মিনিট করিয়া হেলিয়া আছে বলিয়া পৃথিবীর যে মেরু যখন সূর্য্যাভিমুখে ঝুঁকিতে আরম্ভ করে তখন সেই মেরু ঐ ২৩ ডিগ্রি ২৮ মিনিট পর্যন্ত ঝুঁকিয়া আবার বিমুখে ফিরিতে থাকে। আবার সূর্য্য হইতে বিমুখে ঝুঁকিবার সময়ও ঐ ২৩ ডিগ্রি ২৮ মিনিট পর্য্যন্ত ঝুঁকিয়া অভিমুখে ফিরিতে আরম্ভ করে এই জন্য একই সময়ে পৃথিবীর এক মেরুতে ২৩ ডিগ্রি ২৮ মিনিট স্থান জুড়িয়া আলোক ও অপর মেরুতে ঐ পরিমাণ স্থান জুড়িয়া অন্ধকার হয়। পৃথিবী এইরূপ হেলিয়া আছে বলিয়া দৃশ্যতঃ মনে হয় সূর্য্য বিষুবরেখার ২৩ ডিগ্রি ২৮ মিনিট পর্য্যন্ত উত্তরে গিয়ে দক্ষিণে ফিরিতে আরম্ভ করে আবার দক্ষিণেও ঐ পরিমাণ গিয়া উত্তরে ফেরে। সূর্য্য কর্কটরাশি হইতে দক্ষিণে এবং মকররাশি পর্যন্ত গিয়া আবার উত্তরে ফিরিতে আরম্ভ করে। পৃথিবীর বিষুব-রেখার সমান্তরাল যে বৃত্ত অঙ্কিত করিলে সুর্য্যায়ন মণ্ডলের উত্তরস্থ শেষ সীমা চিহ্নিত হয় তাহার নাম কর্কটরেখা ও দক্ষিণস্থ ঐ রূপ বৃত্তের নাম মকররেখা।
পূর্ব্বেই বলা হইয়াছে পৃথিবীর অয়নমণ্ডলের সকল স্থান সূর্য্য হইতে সমান দুরস্থ নহে। অয়নমণ্ডলের যে বিন্দু সূর্য্য হইতে অধিক দূরবর্ত্তী পৃথিবী তাহার নিকট পৌঁছিলে এখন আমাদের উত্তরাংশে গ্রীষ্ম কাল হয়, অর্থাৎ সেই সময় উত্তর ভাগ অধিক পরিমাণে সূর্য্যের অভিমুখে থাকে, আর অয়নমণ্ডলের যে বিন্দু সূর্য্যের নিকটবর্ত্তী পৃথিবী আমাদের শীতকালে তাহার নিকট পৌঁছায়।
গ্রীষ্মকালে আমরা সূর্য্যের নিকটে না থাকিয়া শীতেই নিকটে থাকি সে জন্য আমাদের একটু সুবিধা হয়। ইহার বিপরীত হইলে শীতকালে এখনকার অপেক্ষা অধিক শীত এবং গ্রীষ্মকালে এখনকার অপেক্ষা অধিক গ্রীষ্ম হইত। কিন্তু দক্ষিণাংশে আমাদের ঠিক বিপরীত। অয়নমণ্ডলের যে প্রান্ত সর্ব্বাপেক্ষা সূর্য্যের নিকট পৃথিবী সেই স্থানে উপস্থিত হইলে দক্ষিণাংশে গ্রীষ্ম উপস্থিত হয় অর্থাৎ সেই সময় দক্ষিণ ভাগ অধিক পরিমাণে সূর্য্যাভিমুখী হয় এবং যখন দক্ষিণাংশে শীত উপস্থিত হয় তখন পৃথিবী আবার অয়নমণ্ডলের দূর বিন্দুর নিকটে থাকে। এই জন্য দক্ষিণাংশে শীতের সময় যেমন শীত, গ্রীষ্মের সময় তেমনি গ্রীষ্ম।
আহ্নিক ও বাৎসরিক গতি ছাড়া পৃথিবীর আর দুইটি গতি আছে, তাহার বিশেষ জটিল। একটি ক্রান্তিপাতের বক্র গতি (Precession of the Equinoxes) আর একটি মেরু লক্ষ্য পরিবর্ত্তন গতি, (Nutation)।
বর্ত্তমান গ্রন্থে তাহাদের সম্পূর্ণ আলোচনা সম্ভাব্য নহে; এ বিষয়ে যদি কাহারো কৌতুহল উদ্রিক্ত হয় তবে বিজ্ঞানের বিশেষ সাধনা না করিলে তাহা নিবারিত হইবার উপায় নাই।
পৃথিবীর বিষুবরেখা ও অয়নমণ্ডলের সংযোগ-স্থলকে ক্রান্তিপাত কহে।
পৃথিবী আপন অয়নমণ্ডলে কৌণিক ভাবে অবস্থিত বলিয়া ঘুরিবার সময় বিষুবরেখার দুইটি বিন্দু মাত্র প্রতি দিন কক্ষকে ছুঁইতেছে। কিন্তু সেই একই বিন্দুদ্বয় চিরকাল কক্ষের উপর পড়িতেছে না। প্রতি বৎসর ক্রান্তিপাত ৫০ সেকেণ্ডের কিছু অধিক পূর্ব্বে পড়িতেছে, অর্থাৎ আজ বিষুবরেখার যে বিন্দু কক্ষের উপর পড়িতেছে আগামী বৎসর এই দিবসে সেই বিন্দু হইতে ৫০ সেকেণ্ড পূর্ব্বে স্থিত বিন্দু কক্ষকে স্পর্শ করিতেছে। এইরূপে ২৫৮৬৮ বৎসরে আবার সেই একই বিন্দু কক্ষের উপর আসিয়া পড়িতেছে। ক্রান্তিপাতের এই গতি পৃথিবীর দুই স্বতন্ত্র গতির কার্য্যফল। পৃথিবীর মেরু দেশ অপেক্ষা বিষুবরেখার পদার্থ সমষ্টি অধিক, সুতরাং মেরুদেশে চন্দ্র সূর্য্যের যেরূপ আকর্ষণ প্রভাব বিষুবরেখায় সে রূপ নহে; এই আকর্ষণ বৈষম্যবশতঃ ক্রান্তিপাত ক্রমশঃ পূর্ব্বদিকে পিছাইয়া পড়িতেছে। কিন্তু কেবল এই কারণে ক্রান্তিপাতের যে পরিমাণ বক্রগতি হইবার কথা আর একটি কারণে তাহা অপেক্ষা অল্প হয়। চন্দ্র সূর্য্যের আকর্ষণ দ্বারা যেমন ক্রমেই ক্রান্তিপাতের বক্র গতি হইতেছে, তেমনি গ্রহদিগের সমবেত আকর্ষণ দ্বারা পৃথিবীর আর একটি অগ্র গতি উৎপন্ন হইতেছে এই উভয় গতির কার্য্য ফলে বৎসরে ক্রান্তিপাত কিছু অধিক ৫০ সেকেণ্ড পিছাইয়া যাইতেছে অর্থাৎ ৫০ সেকেণ্ড অগ্রে সম্পন্ন হইতেছে।
এই গতির দ্বারা আমরা দুই তিনটি ঘটনা দেখিতে পাই।
প্রথম, বিষুবরেখার প্রত্যেক বিন্দু, যতই সরিতে থাকে ততই পৃথিবীর মেরু চক্রাকার পথে ঘুরিয়া যায়।
পৃথিবীর মেরু যে চক্রাকার পথে ঘুরিয়া যায় তাহার কেন্দ্র পৃথিবীর কক্ষের মেরু। সুতরাং ২৫৮৬৮ বৎসরে এই কেন্দ্রের চারিদিকে পৃথিবীর মেরু এক একটি বৃত্ত অঙ্কিত করে।
এই গতির দ্বারা মেরুবর্ত্তী নক্ষত্র রাশির সুদীর্ঘ কালে স্থান পরিবর্ত্তন হয়, এই কারণে ধ্রুব নক্ষত্র সর্ব্বদা এক থাকে না।
দ্বিতীয়, যতই বিষুবরেখার এক একটি বিন্দু সরিয়া তাহার পূর্ব্বেস্থিত বিন্দু কক্ষের উপর আসিয়া পড়িতে থাকে, ততই সূর্য্যের নক্ষত্র রাশিতে উদয় কাল প্রভেদ হইয়া পড়ে, এবং ঋতুর বৈষম্য উপস্থিত হয়। তাহা কিরূপে হয় দেখা যাউক। একটি নক্ষত্র হইতে সেই নক্ষত্রে ফিরিয়া আসিতে পৃথিবীর যে সময় লাগে তাহাকে নাক্ষত্র (Sidreal) বৎসর বলে। আমাদের পঞ্জিকায় যে বৎসর গণনা থাকে তাহা নাক্ষত্র বৎসর। কৃত্তিকা নক্ষত্রের উদয় স্থান হইতে সূর্য্য পুনর্ব্বার কৃত্তিকায় দৃশ্যত ফিরিয়া আসিলে এখন একটি বৎসর পূর্ণ হয়। ইহাই যথার্থ বৎসর; একবার সূর্য্য প্রদক্ষিণ করিয়া আসিলে এই বৎসর পূর্ণ হয়।
এক ক্রান্তিপাত হইতে আরম্ভ করিয়া পুনরায় ক্রান্তিপাতে ফিরিয়া আসিতে পৃথিবীর যে সময় লাগে তাহাকে এক সৌর বৎসর (Tropical) বলা যায়। সৌর বৎসর নাক্ষত্র বৎসর অপেক্ষা বিশ মিনিট বিশ সেকেণ্ড অল্প সময়ে পূর্ণ হয়। পূর্ব্বে বলা হইয়াছে বিষুবরেখার একই বিন্দুতে চিরকাল ক্রান্তিপাত হইতেছে না, হটিয়া হটিয়া বিষুবরেখার প্রত্যেক বিন্দুই পর্য্যায় ক্রমে পৃথিবীর কক্ষের দ্বারা অবচ্ছিন্ন হইতেছে। ক্রান্তিপাতের এই গতির পরিমাণ ৫০.২২ সেকেণ্ড, অর্থাৎ সূর্য্য প্রদক্ষিণ করিবার সময় পৃথিবীর যে দিকে গতি হইতেছে, তাহার বিপরীত দিকে ক্রান্তিপাত বিষুবরেখার ৫০.২২ সেকেণ্ড পরিমাণ স্থান সরিয়া যাইতেছে। সুতরাং একই বিন্দুতে চিরকাল ক্রান্তি পাত হইলে পৃথিবীকে যতদূর ভ্রমণ করিয়া আবার ক্রান্তিপাতে উপস্থিত হইতে হইত, তাহা অপেক্ষা অল্প দূর ভ্রমণ করিয়াই পৃথিবী ক্রান্তিপাতে উপস্থিত হয়। পৃথিবী ক্রান্তিপাতে উপস্থিত হইলে সমরাত্র-দিন হয় সেই জন্য বাসন্তিক সমরাত্র-দিন হইতে সৌর বৎসরের আরম্ভ।
সৌর বৎসরের উপর যে ঋতুর পরিবর্ত্তন নির্ভর করে ভাহা পূর্ব্বেই বলা হইয়াছে। যদি প্রতি বৎসরে ঋতু উৎপাদক সৌর বৎসর নাক্ষত্র বৎসর হইতে ২০ মিনিট কুড়ি সেকেণ্ড হ্রাস হইতে থাকে অর্থাৎ ২০ মিনিট ২০ সেকেণ্ড অগ্রে হয়, তাহা হইলে ঐ পরিমাণে প্রত্যেক ঋতুও প্রতি বৎসরে নাক্ষত্র বৎসরের অগ্রে সম্পন্ন হইবে। এবং এই প্রকারে ২৫৮৬৮ বৎসর পরে আবার নাক্ষত্র ও সৌর নূতন বৎসর ঠিক একই সময়ে আরম্ভ হইবে। অর্থাৎ আজ নাক্ষত্র বৎসরের যে মাসে যে দিনে যে মুহূর্ত্তে সমরাত্রদিবা হইতেছে আবার ২৫৮৬৮ বৎসর পরে ঠিক সেই সময়ে সমরাত্রদিবা হইবে। হিন্দুরা নাক্ষত্র এবং ইয়োরোপীয়গণ সৌর বৎসর গণনা করিয়া থাকেন। ইয়োরোপীয় গণনায় যে মাসে যে ঋতু তাহা চিরকাল একই প্রকার থাকিবে, কিন্তু আর্য্যদের নাক্ষত্র বৎসর গণনায় প্রতি বৎসরে সমরাত্রদিবা ২০ মিনিট কুড়ি সেকেণ্ড অগ্রে হওয়াতে ক্রমশ অনেক বৎসরে অল্পে অল্পে ঋতুর সময়ের পরিবর্ত্তন হইয়া পড়ে। পূর্ব্বে যে মাসে বসন্ত ছিল সে মাসে গ্রীষ্ম, শ্রীষ্মের সময় বর্ষা এইরূপে পৃথিবীর দুই অর্দ্ধে ঋতুর সময়ের একেবারে পরিবর্ত্তন হইয়া যায়। বৈশাখ মাসের প্রথম দিনে যখন বাসন্তিক সমরাত্রদিন হইত তখন সেই দিন হইতে আর্য্যগণ নুতন বৎসর গণনা আরম্ভ করিয়াছিলেন, কিন্তু এখন ১০ চৈত্র সমরাত্র-দিবা আরম্ভ হইয়াছে, পুনরায় বৈশাখ মাসের প্রথমে সমরাত্রদিবা হইতে প্রায় ২৫০০০ বৎসর লাগিবে। পূর্ব্বে বাসন্তিক সমরাত্রদিবায় সূর্য্য মেষ রাশিতে উদয় হইত, এখন ঐ দিন মীনরাশি ব্যতিক্রম করিতেও সূর্য্যের ১০ ডিগ্রি বাকি থাকে। এই রূপে ক্রমেই সূর্য্য পিছাইয়া উদয় হইতে হইতে ২৫৮৬৮ বৎসরে সেই একই নক্ষত্রে উদয় হইবে।
ক্রান্তিপাত সচল বলিয়া পৃথিবী যেরূপ আবার ক্রমে বেঁকিয়া বেঁকিয়া চলিতেছে, অর্থাৎ তাহরি ইহাতে যেরূপ এক মৃদুগতি হইতেছে, তাহা দ্বারা অয়নমণ্ডল ক্রমশই অবার অতি ধীরে ধীরে পরিবর্ত্তিত হইতেছে। এই কক্ষ পরিবর্ত্তন গতি দ্বারা পৃথিবীর আর যে একটি বৎসর উৎপন্ন হয়, তাহাকে সৌরব্যবধান বৎসর (anomalistic year) নামে উল্লেখ করা গেল। পৃথিবীর কক্ষের যে বিন্দু সূর্য্য হইতে সর্বাপেক্ষা নিকট, সেই বিন্দু হইতে আরম্ভ করিয়া আবার সর্ব্বাপেক্ষা নিকটস্থ বিন্দুতে ফিরিয়া আসিলে এই বৎসর পূর্ণ হয়। কক্ষ অপরিবর্ত্তিত থাকিয়া এই বিন্দুটি যদি অচল থাকিত তাহা হইলে সৌর ব্যবধান ও নাক্ষত্র বৎসরের পরিমাণ সমান হইত।
কিন্তু পৃথিবী এমন একটি মৃদু গতিতে তাহার অয়নমণ্ডল পরিবর্ত্তন করে যে এই হেতু পৃথিবীর কক্ষের এক অবস্থা হইতে পুনরায় সেই অবস্থায় ফিরিয়া আসিতে ১০৮০০০ এক লক্ষ আট হাজার বৎসর লাগে।
উপরের চিত্রে দেখা যাইতেছে, পৃথিবী অয়নমণ্ডলের ক বিন্দুতে আসিলে সর্ব্বাপেক্ষা সূর্য্যের নিকটে ও খ বিন্দুতে আসিলে সর্ব্বাপেক্ষা সূর্য্য হইতে দূরে পড়ে কিন্তু পৃথিবীর কক্ষ-পরিবর্ত্তন গতি দ্বারা ৫৪০০০ বৎসরে অয়নমণ্ডলটি সম্পূর্ণ রূপে ঘুরিয়া গিয়া খ বিন্দুটি সূর্য্যের নিকটে ও ক বিন্দুটি সূর্য্য হইতে দূরে পড়িবে এবং আবার ৫৪০০০ হাজার বৎসরে ক বিন্দু সূর্য্যের নিকটস্থ হইয়া খ বিন্দু দূরে যাইবে। এই রূপে ১০৮০০০ বৎসরে পৃথিবীর কক্ষ এক অবস্থা হইতে পুনরায় পূর্ব্বাবস্থায় ফিরিয়া আসিবে। তাহা কিরূপে হয় এইবার দেখা যাউক। উপরে পৃথিবীর কক্ষ যেরূপ ভাবে রাখা হইয়াছে পৃথিবী স্থির সূর্য্যের চারিদিকে ঐরূপে ঘুরিতে ঘুরিতে ক্রমশঃ সরিয়া ভিন্ন পথে চলে, ইহাতে তাহার কক্ষের আকৃতি ক্রমশঃ পঞ্চম চিত্রের ন্যায় হইয়া পড়ে,আবার কিছু দিন পরে ষষ্ঠ চিত্রের ন্যায় আরো কিছু দিন পরে সপ্তম চিত্রের ন্যায় পরিবর্ত্তিত হইয়া ৫৪০০০ হাজার বৎসরে আবার অষ্টম চিত্রের মত হইয়া দাঁড়ায়। এক সময়ে অয়নমণ্ডলের যে অংশ সর্ব্বাপেক্ষা সূর্য্যের নিকটে ছিল তাহা দূরে গিয়া দূরের অংশ নিকট আসে।
কক্ষের এইরূপ পরিবর্ত্তন হেতু এক বৎসর পূর্ব্বে কক্ষের যে বিন্দুতে আসিলে পৃথিবী সূর্য্য হইতে সর্ব্বাপেক্ষা নিকটবর্ত্তী হইত, সেই বিন্দু পর বৎসরে জারো ১২ সেকেণ্ড অগ্রসর হইলে তবে আবার পূর্ব্বের মত সর্ব্বাপেক্ষা সূর্য্যের নিকটবর্ত্তী হয় সুতরাং সেই স্থানে আসিতে পৃথিবীর আবার ১২ সেকেণ্ড অধিক সময় লাগে। এইহেতু সৌর ব্যবধান বৎসরের পরিমাণ নাক্ষত্র বৎসর হইতে প্রায় ৪ মিনিট ৩৯ সেকেও অধিক, অর্থাৎ সূর্য্য সম্পর্কে পৃথিবীর ব্যবধান সমান হইতে প্রতি বৎসরে ৪ মিনিট ৩৯ সেকেণ্ড অধিক সময় লাগে।[৭]
পূর্ব্বেই বলা হইয়াছে সূর্য্যের দূরত্ব সম্পর্কে এক অবস্থায় আসিতে পৃথিবীর কক্ষের ১০৮০০০ হাজার বৎসর লাগে, কিন্তু ঋতু সম্পর্কে সূর্য্যের দূরত্ব পরিমাণ এক হইতে, ২০০০০ বৎসর লাগে। ঋতু উৎপাদক সৌর বৎসর এবং সৌর ব্যবধান বৎসরের মধ্যে পরস্পর বৃত্তাভাষের ব্যবধান ৬১.৯ সেকেণ্ড; এই দুই বৎসরের এক অবস্থায় অবস্থিত হইতে ২০০০০ বৎসর লাগে, এবং ইহার উপরই ঋতু সম্পর্কে সূর্য্য-দূরত্বের পরিবর্ত্তন সময় নির্ভর করে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, আজ কাল শীত কালে জানুয়ারি মাসে, সূর্য্য দূরত্ব পৃথিবী হইতে সর্ব্বাপেক্ষা অল্প আবার কুড়ি হাজার বৎসর পরে সূর্য্য দুরত্ব এই সময়ে সর্ব্বাপেক্ষা কম হইবে, পৃথিবী কক্ষের নিকট প্রান্তে আসিবে—কিন্তু ইহার অর্দ্ধেক ১০০০০ হাজার বৎসরে আবার জানুয়ারী মাসে শীতকালে সূর্য্য পৃথিবী হইতে অধিক দূরে থাকিবে। তখন দক্ষিণার্দ্ধে শীত গ্রীষ্মের লাঘব হইয়া উত্তরার্দ্ধেই এতদুভয়ের প্রাদুর্ভাব হইবে।
পৃথিবীর মেরু লক্ষ্য পরিবর্ত্তন গতি প্রধানতঃ চন্দ্রের আকর্ষণ-সম্ভূত। কিন্তু গ্রহদিগের সমবেত আকর্ষণ দ্বারা ইহার হ্রাস বৃদ্ধি হয়। এই গতি অনেকটা ডোঙ্গা কলের ন্যায়, এক মেরু যখন উর্দ্ধে উঠিতে থাকে—আর এক মেরু তখন নিম্নে নামিতে থাকে। পৃথিবীর মেরু দ্বয়ের যদিও চিরকাল উত্তর দক্ষিণে লক্ষ্য বদ্ধ তথাপি চন্দ্রের আকর্ষণে উত্তর মেরুর উত্তর আকাশে দক্ষিণ মেরুর দক্ষিণ আকাশে উপরোক্ত রূপ ঊর্দ্ধ নিম্নগামী একটি গতি হয়। এক মেরু যখন আস্তে আস্তে উর্দ্ধে উঠিতে থাকে আর এক মেরু তখন ধীরে ধীরে নিম্নে নামিতে থাকে।[৮]
এখন একটু ভাবিয়া দেখিলেই বুঝা যাইবে পৃথিবীর মেরুর চক্রাকার গতির সঙ্গে সঙ্গে উভয় মেরুতে পূর্ব্বোক্ত রূপ আর একটি গতি হইলে উভয় মেরুই আকাশে বিসর্পিত চিহ্ন সমষ্টি অঙ্কিত করিবে।
১৯ বৎসর পরে চন্দ্র সূর্য্য ও পৃথিবীর এক অবস্থা হয় সেই জন্যই এই রূপ এক একটি চিহ্ন অঙ্কিত করিতে ১৯ বৎসর লাগে—অর্থাৎ এক মেরুর নিম্ন দিক হইতে উর্দ্ধে উঠিয়া আবার সেই নিম্নের স্থানটিতে আসিতে ১৯ বৎসর লাগে।
সৌর পরিবারবর্ত্তী পৃথিবী উপরি উক্ত গতি-প্রণালীতে অনন্ত আকাশ-পথে চক্রের উপর চক্র কাটিয়া সূর্য্য প্রদক্ষিণ করিতে করিতে প্রতি সেকেণ্ডে ১৯ মাইল গতিতে ছুটিয়া এবং আপন মেরুদণ্ডে প্রতি ঘণ্টায় সহস্র মাইল পরিভ্রমণ করিয়া সূর্য্যসহ পুষ্যা নামক (Hercules) নক্ষত্রের দিকে প্রতি সেকেণ্ডে ৫ মাইল বেগে ধাবিত হইতেছে।
- ↑ ডিগ্রি, মিনিট প্রভৃতি দ্বারাই বৃত্তের পরিমাণ স্থির হয়। একটি ঘড়ির কাঁটা ঘুরাইয়া দেখিলে ডিগ্রি বুঝা যাইতে পারে। ঘড়ির একটি কাঁটা দুপ্রহরের ঘরে রাখিয়া আর একটি কাঁটা ৩টার ঘরে রাখিলে দেখা যাইবে যে দুইটা কাঁটা পরস্পর লম্বভাবে অবস্থিত, অর্থাৎ দুই কাঁটার মধ্যে যে কোণ উৎপন্ন হইয়াছে তাহা এক সমকোণ। পরে তিনটার ঘর হইতে শেষের কাঁটাটিকে যদি ৬টার ঘরে আনা যায় তাহা হইলে দুইটি সমকোণ এবং ৯টার ঘরে আনিলে ৩টি সমকোণ এবং বারটার ঘরে আনিলে ৪টি সমকোণ হইবে। এইরূপ ঘর ঘূরিবার সঙ্গে সঙ্গে কাঁটার অগ্রভাগ দ্বারা একটি বৃত্ত অঙ্কিত হইয়া যায়। ইহাতে দেখা যায় একটি বৃত্তে চারিটি সমকোণ আছে। বৃত্তের আয়তন হ্রাস বৃদ্ধি করিলে এই ৪টি সমকোণের হ্রাস বৃদ্ধি হয় না। বৃত্ত বড় করা অর্থে দাঁড়াইতেছে কেবল কাঁটার দৈর্ঘ্য বাড়ান আর বৃত্ত ছোট করার অর্থে দাঁড়াইতেছে কাঁটার দৈর্ঘ্য কমান, কিন্তু তাহাতে কোণের পরিমাণের কোন হ্রাস বৃদ্ধি হয় না, প্রত্যেক বৃত্তে চারিটি সমকোণ থাকিবেই থাকিবে। মাপের সুবিধার জন্য প্রত্যেক সমকোণকে ৯০ ভাগ করা যায় এবং এক সমকোণকে ৯০ ভাগ করিলে চারিটি সমকোণে অর্থাৎ একটি বৃত্তে ৩৬০ ভাগ হইবে। ইহার এক একটি ভাগ এক এক ডিগ্রি। ডিগ্রি আবার ৬০ মিনিটে ও মিনিট ষাট সেকেণ্ডে বিভক্ত। ৬০ সেকেণ্ডে ১ মিনিট, ৬০ মিনিটে এক ডিগ্রি, ৯০ ডিগ্রিতে এক সমকোণ, ৪ সমকোণে এক বৃত্ত। বৃত্ত মাপিবার আর একটি নিয়ম এই বৃত্তের কোন অংশ মাপিতে গেলে সেই অংশের উভয় সীমা হইতে কেন্দ্র পর্য্যন্ত সরল রেখা টানিলে তাহাদের মধ্যে যে পরিমাণ কোণ উৎপন্ন হয় উল্লিখিত বৃত্তাংশেরও সেই পরিমাণ হইবে।
- ↑ সূক্ষ্ম গণনায় এখন বৎসরে প্রায় অর্দ্ধ সেকেণ্ড করিয়া পৃথিবীর এই কৌণিক অবস্থানের পরিমাণ হ্রাস হইতেছে কিন্তু ইহা চিরকাল চলিবে না। হ্রাস বৃদ্ধি ১ ডিগ্রী ২১ মিনিটের অধিক হয় না। ইহার বৈজ্ঞানিক কারণ গ্রহগণের সমবেত আকর্ষণ।
- ↑ ধ্রুব তারাটি যে ঠিক মেরুর আকাশে অবস্থিত তাহা নহে। ঠিক মেরুর উপরকার আকাশে কোন তারাই নাই, তবে মেরুর আকাশ হইতে ধ্রুব তারা এত অল্প দূরে যে ইহাকেই মেরুবর্ত্তী তারা বলা যাইতে পারে। ইহা মেরু হইতে এক ডিগ্রি দূরে মাত্র অবস্থিত। পৃথিবীর ঘুরিবার সঙ্গে সঙ্গে ধ্রুব তারা যে একেবারে ঘুরে না তাহা নহে কিন্তু ঘুরিবার সময় এত ক্ষুদ্র বৃত্ত অঙ্কিত করে যে আমরা স্বাভাবিক চক্ষুতে তাহা কিছুই অনুভব করিতে পারি না।
- ↑ একটি মাত্র কেন্দ্র আশ্রয় করিয়া যেমন বৃত্ত উৎপন্ন হয়। বৃত্তাভাসের উৎপত্তির নিমিত্ত তেমনি দুইটি কেন্দ্রের আবশ্যক। বৃত্তাভাসের কেন্দ্রের নাম অধিশ্রয়।
- ↑ এই জন্যই বোধ হয় পুরাণে উল্লেখিত হইয়াছে আমাদের এক বৎসরে দেবতাদের এক অহোরাত্র। সুমেরু অর্থাৎ উত্তর মেরু দেবতাদের বাস স্থান বলিয়া পুরাণে নির্দ্দিষ্ট।
- ↑ স্থানীয় বিশেষ কারণেও ভিন্ন ভিন্ন স্থানে শীতোষ্ণের প্রভেদ হয়। সমুদ্রতীরবর্ত্তী প্রদেশ সাধারণতঃ নাতিশীতোষ্ণ। জলের গুণ এই, স্থলের ন্যায় তাহা- শীঘ্র উত্তপ্ত হয় না। যেমন আস্তে আস্তে জল উত্তপ্ত হয় তেমনি আস্তে আস্তে জল উত্তাপ প্রতিনিক্ষেপ করে। স্থলে যেমন দিন রাত্রিতে ও ঋতু বিশেষে উষ্ণতার বৈষম্য দেখা যায় উপরোক্ত কারণে দিন রাত্রিতে কিম্বা শীত গ্রীষ্মকালে জলের উত্তাপের বিশেষ প্রভেদ দেখা যায় না।
- ↑ পৃথিবীর কক্ষ পরিবর্ত্তন গতির সম্যক আলোচনা করিবার তাৎপর্য্য এই যে ইহার উপর একটী অতি গুরুতর নৈসর্গিক ঘটনা নির্ভর করে। পরবর্ত্তী অন্যতম প্রস্তাবে যে হিম-শৈল যুগের বর্ণনা হইয়াছে পৃথিবীর এই গতিই তাহার কারণ বলিয়া অনুমিত হয়।
- ↑ সি স’ (see saw) নামে বালক বালিকাদিগের খেলিবার ইংরাজি একরূপ দোলনা আছে তাহা যাঁহারা দেখিয়াছেন, তাহারা সহজেই এই গতিটি বুঝিতে পারিবেন। সেই দোলনায় দুই দিকে দুই জন বালক বসিয়া থাকে এক দিকের বালক যখন ঊর্দ্ধে উঠে আর এক দিকের বালক তখন নীচে নামে।