পৃথিবী/সৌর পরিবারবর্ত্তী পৃথিবী
পৃথিবী।
সৌরপরিবারবর্ত্তী পৃথিবী।
“তারকা-কনক-কুচি, জ্বলদ-অক্ষর-রুচি
গীত লেখা নীলাম্বর-পাতে।”
নিঃস্তব্ধ নিশীথে অসংখ্য তারকা-মালা-খচিত অনন্ত নীল নভোমণ্ডল দেখিলে সকলেই রোমাঞ্চিত হয়—সকলের হৃদয়ই অনন্তের ভাবে পরিপূর্ণ হয়। এমন অসাড়চেতা কেহই নাই যে তাহার মনশ্চক্ষু তারকাপূর্ণ আকাশে পরম মঙ্গলময় পরমেশ্বরের হস্তাক্ষর-লিখিত অনন্ত জীবনের অনন্ত কাব্য না পড়ে।
একটি মেঘশূন্য অন্ধকার রাত্রি জ্যোতিষ্কপূর্ণ আকাশ নিরীক্ষণ করিয়া অতিবাহিত করিলে আমরা দেখিতে পাই যে কতক গুলি জ্যোতিষ্ক সমান-দলবদ্ধ ভাবে পূর্ব্ব দিকে উদয় হইয়া ক্রমে ক্রমে পশ্চিমে গিয়া অস্তমিত হইতেছে; কতকগুলির উদয় ও অস্ত নাই, তাহারা ক্রমে ক্রমে ঊর্দ্ধে উঠিয়া চক্রাকার গতিতে আবার নিম্নগামী হইতেছে;[১] এবং অপর এক একটি স্বতন্ত্র ভাবে আকাশ-পথে বিচরণ করিতেছে।[২]
আকাশ-সমুদ্রে ভাসমান এই সকল সুবর্ণ-বালুকা-কণার দৃশ্যতঃ বিশৃঙ্খলতার মধ্যেও, একটি নিয়ম দেখা যায়, যেমন কতকগুলি মানুষের সমষ্টি একটী পরিবার, কতকগুলি পরিবারের সমষ্টি একটী সম্প্রদায়, কতকগুলি সম্প্রদায়ে একটী জাতি, কতকগুলি জাতিতে সমগ্র মনুষ্যমগুলী, জ্যোতিষ্ক জগতেও সেইরূপ।
পৃথিবী এবং অপর কয়েকটি গ্রহ উপগ্রহ লইয়া একটি পরিবার—সূর্য্য এই পরিবারের কর্ত্তা। এইরূপ কত লক্ষ লক্ষ-জ্যোতিষ্ক-পরিবারের কর্ত্তা কত লক্ষ লক্ষ সূর্য্য— ব্রহ্মাণ্ডে বিরাজমান তাহার সংখ্যা নাই। নক্ষত্র-খচিত যে অল্পমাত্র আকাশথও আমাদের নিকট অনন্ত বলিয়া মনে হয় সেই আকাশেই সৌর জগতের কয়েকটি গ্রহ উপগ্রহ ছাড়া সকল নক্ষত্রই এক একটি সূর্য্য—এই সকল সূর্য্য আমাদের নিকট হইতে এত দূরে স্থিত যে ইহাদের গ্রহ উপগ্রহ্ আমাদের দৃষ্টিগোচরই হয় না। জ্যোতির্ব্বিদদিগের অধ্যবসায়ে এই সূর্য্যমণ্ডলীর মধ্যে আমাদের সূর্য্য অপেক্ষা অসংখ্য বৃহত্তর সূর্য্য আবিষ্কৃত হইয়াছে।
আকাশের কটি-বন্ধ স্বরূপ ব্রহ্ম-কটাহের এক প্রান্ত হইতে অপরপ্রান্তব্যাপী মৃদুজ্যোতিঃশালী যে সঙ্কীর্ণ আলোক-পথ আমরা দেখিতে পাই, যাহাকে আমরা ছায়াপথ বলি, সেই ছায়াপথ অতলস্পর্শ অসীমগভীর একটি তারকাসমুদ্র। দূরবীণ যন্ত্রের সাহায্যে এই দুর্ভেদ্য তারকা-সমুদ্রের যতটুকু দেখা যায় হারসেল তাহাতেই ২০০ লক্ষটি সূর্য্য আবিষ্কার করিয়াছেন। ইহা ছাড়া দুরবীণ যন্ত্রের দৃষ্টিবহির্ভূত যে কত শত ব্রহ্মাণ্ড একটির পর একটি করিয়া অনন্ত আকাশের কোলে মিশিতেছে এবং এই অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডে যে কত সহস্র সহস্র সূর্য্য সহস্র সহস্র জ্যোতিষ্ক জগতের সম্রাটরূপে ঘুরিতেছে তাহা আমাদের জ্ঞানাতীত।
প্রতি সেকেণ্ডে আলোকের গতি প্রায় ১ লক্ষ ৮৫ সহস্র মাইল, কিন্তু আমাদের নিকট হইতে এই সকল অপরিজ্ঞাত তারকাবলী এত দূরে অবস্থিত যে ঐরূপ প্রভূত দ্রুতগতিতে আবহমান কাল দৌড়িয়াও উহাদের আলোক এখনো আমাদের পৃথিবীতে পৌঁছে নাই। পৃথিবী প্রভৃতি জ্যোতিষ্ক জগতের কর্ত্তা যে সূর্য্য পৃথিবী হইতে বহু লক্ষ গুণ বড় সেই সূর্য্যই যখন এই অনন্ত জ্যোতিষ্ক-মণ্ডলী মধ্যে একটি বিন্দু স্বরূপ—তখন পৃথিবী ইহার একটি অণুকণার সহস্র অংশের এক অংশও নহে।
আমরা স্বাভাবিক চক্ষে আকাশে যে সকল জ্যোতিষ্ক দেখিতে পাই তাহারা তিন ভাগে বিভক্ত।
প্রথম—স্থির নক্ষত্র।
দ্বিতীয়—গ্রহ।
তৃতীয়—উপগ্রহ কিম্বা চন্দ্র।
পৃথিবীবাসী মনুষ্যের পক্ষে যে সকল জ্যোতিষ্ক চির কালই এক স্থানে অবস্থিত বলিয়া মনে হয় তাহারাই স্থির নক্ষত্র নামে অভিহিত। আমরা যে কয়েকটি জ্যোতিষ্ককে সূর্য্যের পরিবারভুক্ত বলিয়া জানি—তাহা ছাড়া আমাদের পক্ষে সকলেই স্থির নক্ষত্র; কেন না পৃথিবীর দৈনিক গতি এবং বাৎসরিক গতির সঙ্গে সঙ্গে আমরা অধিকাংশ জ্যোতিষ্কেরই দৃশ্যতঃ এক-রূপ গতি অনুভব করি, অর্থাৎ পৃথিবী ঘুরিতেছে ইহাতে আমরা অনুভব করি না কাজেই পৃথিবী যতই ঘুরিতে থাকে আমরা ততই তারকারাশিকে ঘুরিয়া যাইতে দেখি; কিন্তু এই দৃশ্যতঃ গতি ছাড়া অন্যান্য নক্ষত্রের সম্বন্ধে অর্থাৎ পরম্পর আপনাদিগের সম্পর্কে ইহাদের দূরত্বের কোন পরিবর্ত্তন হয় না। শত শত বৎসর পুর্ব্বে হিপারকাস টলেমি প্রভৃতি জ্যোতির্ব্বিদগণ স্থির নক্ষত্র রাশিকে আকাশের যেস্থানে দেখিয়া গিয়াছেন, স্বাভাবিক চক্ষে দেখিলে আজও তাঁহারা তাহাদিগকে ঠিক সেই একই স্থানে দেখিতে পাইতেন। আসল কথা ইহারা আমাদের নিকট হইতে এত প্রভূত দূরে অবস্থিত যে সহস্র সহস্র বৎসরের কমে স্বাভাবিক চক্ষুতে ইহাদের গতি কিছুই অনুভূত হয় না। তবে দূরবীণ যন্ত্রের সাহায্যে স্থির নক্ষত্রের পরস্পর দূরত্বের পরিবর্ত্তন অপেক্ষাকৃত অল্প সময়ের মধ্যে লক্ষিত হয়।
যে সকল জ্যোতিষ্ক স্থির নক্ষত্রের সম্পর্কে আপনার দৃশ্যতঃ দূরত্ব পরিবর্ত্তন করে তাহারাই গ্রহ উপগ্রহ। এই পরিবর্ত্তন দেখিয়াই অতি প্রাচীন কাল হইতে বুধ বৃহস্পতি চন্দ্র প্রভৃতি জ্যোতিষ্কদিগকে স্থির-নক্ষত্র-মণ্ডলী হইতে ভিন্ন শ্রেণীভুক্ত করা হইয়াছে। এই শ্রেণীর জ্যোতিষ্ককে আজ আমরা অন্যান্য নক্ষত্রের সহিত যে সম্বন্ধে অবস্থিত দেখি কাল তাহার অনেক ব্যতিক্রম দেখিতে পাই সুতরাং পৃথিবীর গতি হেতু ইহার পূর্ব্ব হইতে পশ্চিমে দৃশতঃ ঘুরিয়া গিয়াই ক্ষান্ত থাকে না, ইহাদের নিজের একটি স্বতন্ত্র গতি আমাদের চক্ষে প্রতীত হয়।
যে সকল জ্যোতিষ্ক সূর্য্যের চারিদিকে ঘুরে তাহাকেই আমরা গ্রহ বলি, কতকগুলি এমন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রহ আছে যাহা দুরবীন যন্ত্রের সাহায্য ব্যতীত স্বাভাবিক চক্ষে আমরা দেখিতে পাই না—ইহাদিগকে গ্রহখণ্ড (Asteroid) বলে, এবং গ্রহগণের চারিদিকে আবার যাহারা ঘুরে তাহাদের নাম উপগ্রহ। চন্দ্র ছাড়া অন্য উপগ্রহও দূরবীণ ব্যতীত দেখা যায় না।
এই তিন শ্রেণীর জ্যোতিষ্ক ব্যতীত ধূমকেতু, নীহারিকারাশি এবং উল্কাপিণ্ড প্রভৃতি অন্য শ্রেণীভুক্ত যে সকল জ্যোতিস্ক আছে তাহা সচরাচর আমরা স্বাভাবিক চক্ষে আকাশে দেখিতে পাই না। ধূমকেতু ও উল্কাপিণ্ড আমরা কখনো কখনো স্বাভাবিক চক্ষে দেখিতে পাই বটে কিন্তু নীহারিকারাশি দূরবীণ ব্যতীত স্বাভাবিক চক্ষে কখনই দেখিতে পাই না। সেই জন্য এস্থলে তাহাদের উল্লেখ হইল না।
এই তিন শ্রেণীর জ্যোতিষ্কের মধ্যে আমরা যে সকল গ্রহ উপগ্রহ দেখিতে পাই তাহারা সূর্য্য-পরিবার-ভুক্ত। প্রাচীন ভারতবর্ষীয় পণ্ডিতদিগের মতে সূর্য্যকে লইয়া সর্ব শুদ্ধ নয়টি গ্রহ রবি, সোম, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র, শনি, রাহু ও কেতু।
কিন্তু রাহু ও কেতু প্রকৃত পক্ষে কোন জ্যোতিষ্কই নহে, এবং চন্দ্র সূর্য্যও গ্রহ নামে বাচ্য হইতে পারে না—সূর্য্য একটি স্থির নক্ষত্র, চন্দ্র পৃথিবীর একটি উপগ্রহ; এবং চন্দ্র, সূর্য্য পূর্ণিমা অমাবস্যার সময় যে স্থলে আসিলে গ্রহণ কয় সেই দুই স্থানকে প্রাচীন পণ্ডিতেরা রাহু ও কেতু নাম দিয়াছেন। বাস্তব পক্ষে বুধ, শুক্র, পৃথিবী, মঙ্গল, বৃহস্পতি শনি, ও অপেক্ষাকৃত আধুনিক সময়ে আবিষ্কৃত, ইয়ুরেনাস, এবং নেপচুন, এই আটটি সূর্য্যের গ্রহ। ইহাদের মধ্যে আবার অধিকাংশ গ্রহের উপগ্রহ আছে।[৩]
মঙ্গল বুধ ও শুক্র ছাড়া আর সকল গ্রহ অপেক্ষাই পৃথিবী আয়তনে ছোট। এবং এই অষ্ট গ্রহের সমষ্টিতে যে আয়তন হইতে পারে সূর্য্য তাহা অপেক্ষাও বৃহদায়তন। সূর্য্যের পরিবার আবার দুই দলে বিভক্ত। প্রথম নিকটস্থ দল, দ্বিতীয় দূরস্থ দল। সূর্য্য হইতে দূরত্ব অনুসারে পর্য্যায় ক্রমে বুধ, শুক্র, পৃথিবী, মঙ্গল এই চারিটি গ্রহ সূর্য্যের নিকটে এবং বৃহস্পতি, শনি, ইয়ুরেনস্ ও নেপচুন দূরে অবস্থিত। কতগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রহ উপরোক্ত দুই দলের মধ্যে থাকিয়াই উহাদিগকে ভাগ করিয়াছে।
অনন্ত কাল হইতে এই সকল গ্রহ যে সুর্য্যের চতুর্দ্দিকে ধাবমান ইহার কারণ কি? কি শক্তির বলে এইরূপ হইতেছে? শক্তিপ্রয়োগ দ্বারা পৃথিবীর বস্তুকে চালিত করিলে আবার কতক্ষণ পরে ইহা থামিয়া যায়, উর্দ্ধক্ষিপ্ত পদার্থ ভূপৃষ্ঠে আসিয়া পড়ে; ইহা দেখিয়া কেপলার প্রভৃতি পণ্ডিতদিগের বিশ্বাস ছিল গ্রহদিগকে চিরন্তন একই পথে চালিত করিতে নুতন নুতন শক্তির প্রয়োজন। তাঁহারা বলিতেন সূর্য্য হইতে এক শক্তি নির্গত হইয়া ইহাদিগকে আকর্ষণ করিতেছে, এবং অপর এক শক্তি পৃথিবীকে গতি প্রদান করিতেছে। টলেমি প্রভৃতি আবার যে সকল প্রোচীন জ্যোতির্ব্বেত্তা বলিতেন যে সূর্য্যাদি নক্ষত্র প্রত্যহ, পৃথিবীকে আবর্ত্তন করিতেছে তাঁহাদের মতে পৃথিবী স্থির সুতরাং পৃথিবীকে চালাইতে তাঁহাদের নুতন শক্তির অবতারণা করিতে হয় নাই।
শক্তি যে অবিনশ্বর এবং কোন বস্তুতে শক্তি প্রয়োগ করিলে বাধা না পাওয়া পর্য্যন্ত সে শক্তির চালকতা যে চির কাল থাকিবে এসত্যটি প্রাচীন পণ্ডিতেরা জানিতেন। পরে অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালে নিউটনের অব্যবহিত-পূর্ব্ববর্ত্তী সময়ের লোক গেলিলিও ও হাইগেন্স্ গতিবিষয়ক অনেকগুলি নিয়ম আবিষ্কার করেন। নিউটন তাহার পরে গতি বিষয়ক সমস্ত নিয়ম বিশেষ রূপে লিপিবদ্ধ করিয়া প্রকাশিত করেন এবং যাহার জন্য তাঁহার নাম চিরস্মরণীয় হইয়াছে সেই মাধ্যাকর্ষণের নিয়ম তিনিই প্রথমে বুঝাইয়া দেন। প্রকৃতির দৃশ্যতঃ বৈষম্যের মধ্যেও যে একটি বিশেষ সাম্য আছে তাহা তাঁহার চক্ষেই প্রথমে প্রতিভাত হয়। যে শক্তির বলে বৃন্তচ্যুত আম্র পৃথিবীপৃষ্ঠে পড়ে, এক খণ্ড প্রস্তর উঠাইতে আমাদের বলের প্রয়োজন হয়, সেই শক্তির বলেই যে সমস্ত ব্রহ্মাণ্ড সুশৃঙ্খলে চলিতেছে ইহা তিনিই প্রথমে দেখাইয়া দেন।
নিউটনের বিখ্যাত আবিষ্ক্রিয়া বিশেষরূপ বুঝাইবার স্থান বর্ত্তমান প্রস্তাব নহে, তবে মাধ্যাকর্ষণের স্থল নিয়ম এই;
প্রথম, বিশ্বসংসারের প্রত্যেক অণু প্রত্যেক অণুকে আকর্ষণ করিতেছে।
দ্বিতীয়, প্রত্যেক অণু যখন আকর্ষণশক্তির আধার তখন যে পদার্থে অণু-সমষ্টি অধিক, তাহার কলেবর হ্রস্ব হইলেও তাহার আকর্ষণী শক্তি অধিক। এবং দুইটি পদার্থের মধ্যে যেটি অধিক অণুবিশিষ্ট তাহা অপরটিকে টানিয়া আত্মসাৎ করে।
তৃতীয়, পদার্থদিগের মধ্যে দূরত্বের বর্গ পরিমাণ অনুসারে এই আকর্ষণ-শক্তির পরিমাণের হাস বৃদ্ধি হয়। দুইটি বস্তুর মধ্যে যে ব্যবধান থাকিলে আকর্ষণের বলের পরিমাণ এক হইবে তাহার অপেক্ষা দ্বিগুণ ব্যবধান থাকিলে আকর্ষণ শক্তির পরিমাণ এক চতুর্থাংশ হইবে, এবং অর্দ্ধেক ব্যবধান হইলে আকর্ষণের বল চতুর্গুণ হইবে।
নিউটন আরো বলেন কোন বস্তু একবার চালিত হইয়া যতক্ষণ বাধা না পায় ততক্ষণ ক্রমাগত চলিতে থাকে। পৃথিবী হইতে আমরা যদি কোন প্রস্তর-খণ্ড ছুড়ি তাহা চিরকাল না চলিবার প্রধান কারণ দুই; প্রথম, বাতাসের বাধা; দ্বিতীয়, পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ-শক্তি।
এখন প্রশ্ন এই যদি প্রত্যেক অণু প্রত্যেক অণুকে আকর্ষণ করে এবং অধিক অণুবিশিষ্ট বস্তু অল্প-অণুবিশিষ্ট বস্তুকে আত্মসাৎ করে তাহা হইলে সূর্য্য, গ্রহ-মণ্ডলীকে কেন আত্মসাৎ করে না?
যদি কেবল মাত্র সূর্য্যের আকর্ষণী শক্তিই গ্রহদিগের উপর কার্য্য করিত তাহা হইলে গ্রহগণ সূর্য্য দ্বারা বিলুপ্ত হইত। কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে সৌরাকর্ষণ ব্যতীত গ্রহদিগের নিজের নিজের আবার একটি গতি আছে।
শক্তির একটী সাধারণ ধর্ম্ম এই যে শক্তি দ্বারা কোন পদার্থ একবার চালিত হইয়া যদি অন্য কোন প্রতিবাধক শক্তির দ্বারা বাধা না পায় তবে তাহা চিরকাল সরল রেখা-পথে চলিবে, এ নিমিত্ত, সূর্য্যের আকর্ষণী শক্তি অতিক্রম করিয়া প্রতি মুহূর্ত্তে গ্রহগণ সরল-রেখাভিমুখে পলায়ন করিতে যত্নশীল। ইহাকেই কেন্দ্রাতিগ গতি বলে। সূর্য্য ক্রমাগত যতই গ্রহদের আপন কেন্দ্রাভিমুখে টানিতেছে গ্রহগণ ততই সেই আকর্ষণকে অতিক্রম করিয়া সরল রেখায় পলাইতে চেষ্টা করিতেছে। কাজেই এই দুই শক্তি-প্রভাবে গ্রহগণ একটি বৃত্তাকার পথে সূর্য্য প্রদক্ষিণ করিতেছে। যদি মুহূর্ত্তের জন্য কখনো কোন গ্রহ আপন গতি শক্তি হারায়, তাহা হইলে অমনি বৃহদায়তন সূর্য্য তাহাকে টানিয়া আত্মসাৎ করিয়া ফেলিবে। উপরের চিত্রটি হইতে গ্রহ দিগের গতি কিয়ৎপরিমাণে বুঝা যাইতে পারে। সূ চিহ্নিত চিত্রটি এ স্থলে সূর্য্য এবং তাহার চতুস্পার্শ্বস্থ বৃত্তাকার রেখাটি পৃথিবীর সূর্য্য-প্রদক্ষিণের পথ। পৃথিবী যখন ক চিহ্নিত স্থানে পৌঁছিয়া খ সরল রেখায় যাইতে যত্নশীল তখনি সূর্য্যের কেন্দ্রাকর্ষণ দ্বারা খ স্থানে যাইতে না পাইয়া বৃত্তাকার পথে ঘুরিয়া পড়িতেছে, এইরূপে ক্রমে চ চিহ্নিত স্থানে সরিয়া সেখান হইতে আবার সরল রেখায় যাইতে উদ্যত কিন্তু সূর্য্য তাহাতে বাধা দিয়া আবার টানিতে থাকে তখন পৃথিবী ট স্থানে ঘুরিয়া আসিয়া ঠ রেখায় পলাইতে যায়।
এইরূপে সুর্য্যের আকর্ষণ ও নিজ নিজ কেন্দ্রাতিগ শক্তির বলে গ্রহগণ সূর্য্যকে ক্রমাগত আবর্ত্তন করিতেছে। এই দুই শক্তির যতক্ষণ সামঞ্জস্য ততক্ষণ কেহই কক্ষচ্যুত হয় না, ইহার কোনটার আধিক্য হইলেই অমনি বিশৃঙ্খলতা ঘটে। ধূমকেতুর অতি জটিল গতিবিধিও এই নিয়ম-প্রসূত। গণিতজ্ঞ পণ্ডিতেরা এই দুইটি নিয়ম অবলম্বন করিয়া অবরোহী প্রণালী অনুসারে সমস্ত ব্রহ্মাণ্ডের শাসনতন্ত্র নির্দ্ধারিত করিতে পারিয়াছেন।
যে সকল গ্রহ উপগ্রহের কথা উল্লেখ করা হইল তাহা ব্যতীত আমরা কখনো কখনো যে ধূমকেতু এবং উল্কাপিণ্ড দেখিতে পাই, তাহারা সূর্য্যের পরিবার-ভুক্ত কিম্বা সৌর জগতের অতিথি মাত্র এ বিষয়ে অনেক বাদানুবাদ আছে। ধুমকেতু সম্বন্ধে অনেক প্রাচীন কাল হইতে একটি কুসংস্কার দেখা যায়। ‘ধুমকেতোরুদয়েন প্রজায়ং সূচ্যতে’ ধূমকেতু যেরূপ পথে সুর্য্যকে প্রদক্ষিণ করে তাহা গ্রহগণ হইতে ভিন্ন প্রকারের, সেই জন্য ধূমকেতুর সূর্য্য প্রদক্ষিণ করিতে অনেক বৎসর লাগে, এমন অনেক ধূমকেতু দেখা গিয়াছে যে তাহারা একবার উদয় হইয়াই অমনি একেবারে অদৃশ্য হইয়াছে। ঐ সকল ধূমকেতু সহস্র সহস্র বৎসর পরেও আর ফিরিয়া আসিবে কি না তাহা আজও পর্য্যন্ত নিশ্চিত হয় নাই। বহুকালব্যাপী জ্যোতিষিক পরীক্ষা দ্বারা দেখা গিয়াছে যে কেবল নয়টি ধুমকেতুর সূর্য্য প্রদক্ষিণ করিবার সময় কিয়ৎ পরিমাণে নিয়মিত। এই নয়টির মধ্যে হ্যালি কর্ত্তৃক আবিষ্কৃত ধূমকেতু সর্ব্বাপেক্ষা অধিক সময়ে এবং এন্কি কর্ত্তৃক আবিষ্কৃত ধূমকেতু সর্ব্বাপেক্ষা অল্প সময়ে একবার সূর্য্য প্রদক্ষিণ করে। প্রথমটি ন্যূনাধিক ৭৬ বৎসরে এবং দ্বিতীয়টি ন্যূনাধিক ৩ বৎসরেই এক একবার উদিত হয়। ইহা ছাড়া অনেক ধূমকেতু এত বহু সহস্র বৎসরে সূর্য্য প্রদক্ষিণ করে যে আমাদের নিকট তাহা যুগযুগান্তর জ্ঞান হয়। ১৮৪৪ খৃষ্টাব্দে যে ধূমকেতুটি উদিত হইয়াছিল তাহার সূর্য্য-প্রদক্ষিণ-সময় এক লক্ষ বৎসর নির্দ্ধারিত হইয়াছে। ধূমকেতুর কক্ষ যেমন গ্রহগণের অপেক্ষা ভিন্ন তেমনি অন্যান্য বিষয়েও গ্রহগণ হইতে ধূমকেতু ভিন্ন। ধূমকেতুর গুরুত্ব অতি অল্প; এমন কি অনেক বাষ্প অপেক্ষাও ইহা লঘু। ধুমকেতু লম্বায় সহস্র সহস্র ক্রোশ হইলেও উহাকে স্বচ্ছন্দে একটা বড় বোতলে ধরিয়া রাখা যায়।
যে সকল জ্যোতিষ্ককে মধ্যে মধ্যে আমরা খসিয়া পড়িতে দেখি তাহাদের সাধারণ নাম উল্কাপিণ্ড। সচরাচর আমরা ইহাকে তারা খসা বলি। উল্কাপিণ্ডের মধ্যে আবার একটি বিশেষ দল (Zodiacal light) সূর্য্যের চারি দিকে ঘুরিতেছে। প্রতি বৎসর শরদাগমে অধিক সংখ্যায় আমরা উল্কাপাত দেখিতে পাই। ইহাদের সবিশেষ তথ্য এখনো আমরা অবগত নহি।
আধুনিক জ্যোতির্ব্বেত্তারা ঠিক করিয়াছেন যে উল্কাপিণ্ডের সহিত ধূমকেতুর ঘনিষ্ট সম্বন্ধ, কেননা অনেক সময় দেখিতে পাওয়া যায়, যে পথে উল্কাপিণ্ড পরিভ্রমণ করে সেই পথেই ধূমকেতু উদিত হয়। বোধ হয় বহুসংখ্যক উল্কাপিণ্ড একত্র হইয়া পরস্পর আঘাত প্রতিঘাত দ্বারা উত্তপ্ত ও উজ্জ্বল নীহারিকাময় ধূমকেতু উৎপাদন করে।
এই সৌর-পরিবার-ভুক্ত পৃথিবী পূর্ব্বোক্ত দুইটি শক্তির অধীনে কি প্রণালীতে সূর্য্য প্রদক্ষিণ করিতেছে তাহা এই বার দেখা যাইবে।
- ↑ এই তারকাশ্রেণী, ধ্রুব-তারা-পরিবেষ্টক (Circumpolar) ইহারা দৃশ্যতঃ ধ্রুবতারার চারিদিকে ঘুরে।
- ↑ ইহারাই গ্রহ্।
- ↑ সূর্য্য এবং গ্রহ গুলির পরস্পর মাধ্যাকর্ষণ গণনার দ্বারা গ্রহগণের গতিবিধি নির্দ্ধারিত করা যায়। ইয়ুরেনস গ্রহটির গতি, জ্ঞাত গ্রহগুলির মাধ্যাকর্ষণের বশবর্ত্তী হইতেছে না দেখিয়া ফরাসী পণ্ডিত লেভিরিয়ে এবং ইংরাজ পণ্ডিত অ্যাডাম্স্ ঠিক করিলেন অবশ্য এমন আর একটি অনাবিষ্কৃত গ্রহ আছে যাহার আকর্ষণে ইয়ুরেনসের গতির গণনার ব্যতিক্রম হইতেছে। এই ঠিক করিয়া নেপচুন আবিষ্কৃত হইবার পূর্ব্বেই লেভেরিয়ে এবং অ্যাডাম্স্ সেই অজ্ঞাত গ্রহটির কক্ষ, ভার, আয়তন সকল স্থির করেন। পরে নির্দ্ধারিত স্থানে দূরবীণ সংযোগ দ্বারা নেপচুন আবিষ্কৃত হয়। ইয়ুরেনসের ন্যায় বুধের গতিরও এই রূপ অল্প ব্যতিক্রম দেখিয়া লেভেরিয়ে বলেন সূর্যের ও বুধের মধ্যস্থিত কোন অজ্ঞাত গ্রহের আকর্ষণে বুধের গতিকে ঈষৎ অন্যরূপ করিতেছে। সেই অবধি অনেকেই বুধ ও সূর্য্যের মধ্যে একটি গ্রহ কিম্বা ক্ষুদ্র গ্রহমালা আবিষ্কার করিতে যত্ন করিতেছেন। এবং মধ্যে মধ্যে কেহ কেহ এইরূপ আবিষ্কারক হইয়া পড়িতেছেন। কিন্তু বিশেষ চেষ্টাসত্ত্বেও প্রসিদ্ধ কোন জ্যোতির্ব্বেত্তারও এরূপ গ্রহ নয়নগোচর না হওয়ায় বৈজ্ঞানিক জগতে এই আবিষ্ক্রিয়া এখনো গ্রাহ্য হয় নাই।