পোকা-মাকড়/প্রথম শাখা/খড়িমাটির পোকা
খড়িমাটির পোকা
যে-সব প্রাণীর শত্রু বেশি, তাহারা ক্রমে নিজের শরীর বদলাইয়া শত্রুকে ফাঁকি দেয়। সজারু শরীরকে বড় বড় কাঁটা দিয়া ঢাকিয়া রাখে। কোনো শত্রু যদি তাহাকে ধরিতে আসে, তবে গায়ের কাঁটা দেখিয়া কাছে ঘেঁষিতে পারে না। শত্রু আসিতেছে জানিলেই, শামুক তাহার সমস্ত শরীর পিঠের উপরকার সেই শক্ত খোলের ভিতরে টানিয়া লয়। ইহাতে শত্রুর মুখে ছাই পড়ে। এ সম্বন্ধে আগেই তোমাদের কিছু বলিয়াছি।
এক-কোষ প্রাণীদের শত্রু অনেক। নিজেরা কাম্ড়াকাম্ড়ি
চিত্র ৪।
করিয়া মরে, তার পরে জলের অন্য জন্তুরা কাছে পাইলেই তাহাদিগকে গিলিয়া ফেলে। শত্রুর হাত হইতে বাঁচিবার জন্য এক-কোষীদের মধ্যে কয়েক জাতি এক মজার ফন্দি আঁটিয়াছে। এখানে সেই চালাক এক-কোষ প্রাণীর কতকগুলি ছবি দিলাম।
ছবিগুলি দেখিলে মনে হইবে, যেন কেহ অনেক কারুগিরি করিয়া এইগুলি আঁকিয়াছে। কিন্তু তাহা নয়—শামুক বা গুগ্লির যেমন খোলা থাকে, ঐগুলি সেই রকমের জিনিস এবং আপনা হইতেই উহা এক-কোষীদের গায়ে জন্মে। এই প্রাণীরা কত ছোট তাহা তোমরা আগেই শুনিয়াছ; ইহারা হাজারে হাজারে একত্র না হইলে এক ইঞ্চির মতও ছোট জায়গা জুড়িতে পারে না। খালি চোখে ইহাদিগকে দেখাই দায়। তাই অণুবীক্ষণ যন্ত্রের মধ্যে ফেলিয়া তাহাদিগকে দেখিলে যে-রকম দেখায় ছবিতে তাহাই আঁকিয়া দিলাম। দেখ,—ইহাদের গায়ে কত রকম খোলা।
খোলা-ওয়ালা এই সকল প্রাণী সমুদ্রে থাকে, কাজেই তোমাদের পুকুরের জলে খালে বা নদীতে ইহাদের সন্ধান পাইবে না। সমুদ্রের জলে যে চূণ মিশানো থাকে, তাহা টানিয়া লইয়া উহারা গায়ের খোলা প্রস্তুত করে। ইহাদেরি এক জ্ঞাতি-ভাইকে তোমরা চেষ্টা করিলে দেখিতে পাইবে। পরিষ্কার কাচের গ্লাসে জল রাখিয়া তাহাতে কতকগুলা লতাপাতা কয়েক দিনের জন্য রাখিয়া দিয়ো। সেগুলি যখন একটু পচিতে আরম্ভ করিবে, তখন গ্লাসের পরিষ্কার জল লাল্চে হইয়া পড়িবে এবং উপরে একটা পাত্লা সর পড়িবে। এই জল যদি তোমরা অণুবীক্ষণ দিয়া দেখিতে সুবিধা পাও, তবে খোলা-ওয়ালা এক-কোষ প্রাণীদের জ্ঞাতি-ভাইদের দেখিতে পাইবে। তখন এক বিন্দু জলে হাজার হাজার এই প্রাণী ঘুরিয়া বেড়াইতেছে দেখিবে। ইহাদের প্রত্যেকের দেহে শুঁয়ো লাগানো থাকে; সেই শুঁয়ো নাড়িতে নাড়িতে তাহারা আনন্দে ঘুরিয়া বেড়ায়। পূর্ব্বে যে আমিবা অর্থাৎ এক-কোষ প্রাণীর কথা বলিয়াছি, তাহারা ইচ্ছা করিলে শরীর হইতে আঙুলের মত শুঁয়ো বাহির করিতে পারে; কিন্তু ইহাদের শুঁয়ো স্থায়িভাবে গায়ে আঁটা থাকে। কাচের বোতলে শুক্নো খড় বা পাতা রাখিয়া তাহাতে খানিকটা গরম জল ঢালিয়া রাখিলে, কয়েক দিন পরে জলে এই রকম শুঁয়োওয়ালা এক-কোষ প্রাণী অনেক দেখা যায়। কিন্তু ইহাদের গায়ের উপরে কখনই খোলা হয় না,— খোলা কেবল সমুদ্রের এক-কোষীদের গায়ের উপরে দেখা যায়।
তোমরা ছবিতে যে খোলা-ওয়ালা এক-কোষ প্রাণী দেখিলে, তাহার প্রত্যেকটি এক-একটি প্রাণী, ইহাই বোধ হয় মনে করিতেছ। কিন্তু তাহা নয়; একটা খোলাতে একটা প্রাণী থাকে না। প্রথমে একটি প্রাণী সমুদ্র-জল হইতে চূণ টানিয়া লইয়া খোলা গড়িতে আরম্ভ করে; কিন্তু সেটি যখন বড় হইয়া নিজের শরীর ভাঙিয়া দুইটি প্রাণী হইয়া দাঁড়ায়, তখন একটি খোলায় দুইটির স্থান হইতে পারে না। এই অবস্থায় খোলার উপরকার ছোট ছিদ্র দিয়া সেই নূতন প্রাণীটি বাহির হইয়া পড়ে এবং পুরাণো খোলার গায়ে নিজের জন্য নূতন খোলা প্রস্তুত করে। এই রকমে একই প্রাণীর পুত্রপৌত্রাদি মিলিয়া, প্রথম খোলার চারিদিকে থাকে-থাকে অনেক ছোট কুঠারি গড়িয়া বাস করে। সুতরাং, তোমরা ছবিতে যে-সব থোলা দেখিতেছ, তাহার প্রত্যেকটি হাজার হাজার এক-কোষ প্রাণীর ঘর।
এই সকল ছোট প্রাণীরা সমুদ্রের তলায় কাদার মধ্যে বা শেওলার গায়ে জন্মিয়া কিছু দিন বাঁচিয়া থাকে এবং তাহার পর মরিয়া যায়। ইহাদের জন্মমৃত্যুর সঙ্গে মানুষের কোনো সম্বন্ধ নাই, হঠাৎ এই কথাই মনে হয়। কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার তাহা নয়। মানুষ ইহাদের দ্বারা যে উপকার পায়, তাহার কথা শুনিলে তোমরা অবাক্ হইয়া যাইবে। তোমরা চূণের পাথর দেখিয়াছ কি? পাহাড়ে এই পাথর অনেক পাওয়া যায়। আমাদের দেশের আসাম অঞ্চলে চূণের পাথর অনেক আছে। ইহা খুব ভালো করিয়া আগুনে পোড়াইয়া জলে ফেলিয়া দিলে সুন্দর চূণ হয়। এই পাথুরে-চূণ আমরা পাণের সঙ্গে খাই এবং তাহা দিয়া ঘর-বাড়ী প্রস্তুত করি। এই চূণের পাথর জিনিসটা কি, তাহা বোধ হয় তোমরা জান না। বৈজ্ঞানিকেরা পরীক্ষা করিয়াছেন, ইহা এক-কোষ প্রাণীদেরই গায়ের জমাট খোলা ব্যতীত আর কিছুই নয়। সেগুলি লক্ষ লক্ষ বৎসর ধরিয়া সমুদ্রের তলে জমা হইয়া চূণের পাথরের সৃষ্টি করিয়াছে। হিমালয় ও আল্প্স্ পর্ব্বত খুব উঁচু, তাহা বোধ হয় তোমরা শুনিয়াছ। এই সকল পর্ব্বত এককালে সমুদ্রের তলে ছিল, ক্রমে জল ছাড়িয়া এখন সেগুলি এত উঁচু হইয়াছে। আল্প্স্ পর্বতের মাথাতেও চূণের পাথর পাওয়া যায়। ভাবিয়া দেখ, কতকাল ধরিয়া এক-কোষ প্রাণীরা সমুদ্রের তলায় বাস করিয়া আসিতেছে! তার পর ভাবিয়া দেখ, যাহাদের গায়ের খোলায় চূণের পাথরের হাজার হাজার পাহাড় হইয়াছে, তাহাদের সংখ্যাই বা কত! কেবল ইহাই নয়। যে খড়িমাটি দিয়া তোমরা বোর্ডে অঙ্ক লেখ এবং দাঁত মাজো, তাহাও এক-কোষ প্রাণীদের গায়ের খোলা দিয়া প্রস্তুত; তাহাতে মাটির নাম-গন্ধ নাই। খড়িমাটিরও পাহাড় আছে,—শত শত মাইল জুড়িয়া প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড পাহাড়। সুতরাং বলিতে হয়, খড়িমাটির পাহাড়ও এককালে সমুদ্রের তলায় ছিল, এখন জল হইতে গা ঝাড়া দিয়া উঠিয়াছে।
নানা রকম এক-কোষ প্রাণীর মধ্যে আমরা তোমাদিগকে কেবল কয়েকটির সামান্য পরিচয় দিলাম। ইহা ছাড়া আরো যে সকল এক-কোষ প্রাণী আছে, তাহাদের নানা রকম কাজ দেখা যায়। তোমরা বোধ হয় শুনিয়াছ, সমুদ্রের স্থির জলে রাত্রিতে অনেক মাইল জুড়িয়া এক রকম আলো দেখা যায়। নানা লোকে ইহার নানা নাম দেয়। কেহ কেহ ইহাকে বাড়বানল বলেন। এক রকম এক-কোষ প্রাণী এই আলো উৎপন্ন করে। জোনাকি পোকার শরীর হইতে যেমন আলো বাহির হয়, ইহাদের শরীর হইতে সেই রকম আলো বাহির হয়; ইহাই সমুদ্রের জল আলো করিয়া রাখে। যে-সকল ছোট প্রাণী শত শত মাইল জুড়িয়া সমুদ্রের জল আলোকিত করে, তাহাদের সংখ্যা কত ভাবিয়া দেখ।