পোকা-মাকড়/ষষ্ঠ শাখার প্রাণী/ঝিল্লীপক্ষ পতঙ্গ/পিপীলিকা
পিপীলিকা
এইবার আমরা পিঁপ্ড়ের কথা বলিব। ইহারা মৌমাছি ও বোল্তার দলের প্রাণী, কিন্তু তাহাদের চেয়ে অনেক বুদ্ধিমান্। হাতী ঘোড়া বাঘ ভালুক প্রভৃতি বড় প্রাণীরা বুদ্ধি খরচ করিয়া যাহা করিতে না পারে, পিঁপ্ড়েরা তাহা করে। এই পৃথিবীতে মানুষ ছাড়া আর কোনো প্রাণীই পিঁপ্ড়ের মত বুদ্ধিমান্ নয়।
পিঁপ্ড়েরা নিজের তৈয়ারি ঘরে দল বাঁধিয়া বাস করে, দলের উন্নতির জন্য প্রাণপণে পরিশ্রম করে, নিজেদের ঘর বাড়ী ও ছেলেপিলেদের রক্ষা করিবার জন্য শত্রুর সঙ্গে লড়াই করে। ইহাদের ভাষা নাই বটে, কিন্তু নানা রকমে মনের ভাব পরস্পরকে জানাইতে পারে। আমরা যেমন গোরু পুষিয়া তাহার দুধ খাই, ইহারাও তেমনি এক রকম পোকা পুষিয়া সেগুলির নিকট হইতে মিষ্ট খাদ্য আদায় করিয়া লয়। আবার দুই এক রকম পিঁপ্ড়ে আমাদের মত চাষ-আবাদও করে। ইহার ঘাসের ছোট বীজ মুখে করিয়া বহিয়া আনে এবং তাহা বুনিয়া শস্য উৎপন্ন করে। সুতরাং সাধারণ বুদ্ধিতে পিঁপ্ড়েরা মানুষের চেয়ে খুব কম নয়।
ভালো আতসী-কাচ দিয়া দেখিলে পিঁপ্ড়েকে যে-রকম
চিত্র ৪৭—পিঁপ্ড়ে।
দেখায় এখানে তাহার একটা ছবি দিলাম। ছবিতে পিঁপ্ড়ের বুক ও লেজের জোড়ের জায়গায় বলের মত দুইটি পিণ্ড আছে। ইহা পিঁপ্ড়ের দেহের প্রধান চিহ্ন। কোনো কোনো পিঁপ্ড়ের দেহে ঐ-রকম একটি মাত্র পিণ্ড থাকে।
মৌমাছি ও বোল্তার মতই পিঁপ্ড়েদের মধ্যে স্ত্রী-পুরুষ ও কর্ম্মী এই তিন জাতি আছে। স্ত্রী ও কর্ম্মী পিঁপ্ড়ের লেজের অংশটা প্রায়ই ছয় থাক্ আংটি জুড়িয়া প্রস্তুত হয়। পুরুষদের লেজে সাত থাক্ আংটি থাকে। কিন্তু ইহাদের সকলেরি ছয়খানা লম্বা পা এবং মাথায় একজোড়া শুঁয়ো থাকে। পিঁপ্ড়ের শুঁয়ো বোল্তা বা মৌমাছির শুঁয়োর মত নয়। আমাদের হাত ও পা যেমন কতকগুলি ছোট ও বড় খণ্ড খণ্ড অংশ জুড়িয়া প্রস্তুত, পিঁপ্ড়ের শুঁয়োও ঠিক সেই রকম দুইটি খণ্ড জুড়িয়া প্রস্তুত হয়। মৌমাছিদের পায়ে চিরুণীর দাঁতের মত যে-সকল কাঁটা লাগানো আছে, ইহাদের পায়েও ঠিক তাহাই দেখা যায়। গায়ে মাথায় বা শুঁয়োতে ধূলা মাটি বা অন্যান্য কোন আবর্জ্জনা লাগিলে, উহারা পায়ের চিরুণী দিয়া তাহা ঝাড়িয়া ফেলে। তোমরা যদি কিছুক্ষণ কোনো পিঁপ্ড়ের চলা-ফেরা লক্ষ্য কর, তবে দেখিবে, সে মাঝে মাঝে দাঁড়াইয়া পা দিয়া শুঁয়ো ঘসিতেছে। শরীরের ময়লা মাটি ছাড়াইবার জন্যই উহারা ঐ-রকম করে। গোরু যেমন জিভ দিয়া বাছুরের গা চাটে ও গায়ের ময়লা ছাড়াইয়া দেয়, পিঁপ্ড়েরা সেই রকমে পরস্পরের গায়ে পা বা শুঁয়ো বুলাইয়া শরীরের ধূলা মাটি পরিষ্কার করে।
এখানে পিঁপ্ড়ের মুখের একটা বড় ছবি দিলাম। দেখ, কি বিশ্রী মুখ! অন্য পতঙ্গের মুখ কতকটা ছুঁচলো,
চিত্র ৪৮—পিঁপ্ড়ের মাথা।
কিন্তু পিঁপ্ড়ের মুখ একবারে চেপ্টা এবং চোখ দু’টা নিতান্ত ছোট। তোমরা হয় ত ভাবিতেছ, এত ছোট চোখ লইয়া উহারা কি করিয়া চলা-ফেরা করে। মাটির তলায় অন্ধকারে পিঁপ্ড়েরা যখন ঘর-দুয়ার প্রস্তুত করে, তখন চোখের দরকারই হয় না, শুঁয়ো দিয়া সব জিনিসকে ছুঁইয়াই কাজ চালায়। চোখের দরকার হয় না বলিয়াই পিঁপ্ড়েদের চোখ এত ছোট হইয়াছে।
পিঁপ্ড়ের শুঁয়ো বড় আশ্চর্য্য জিনিস। চোখ নাক ও কান দিয়া আমরা যে-সব কাজ করি, সম্ভবত উহারা শুঁয়ো দিয়াই সেই সকল কাজ চালায়। সুতরাং বলিতে হয়, পিঁপ্ড়ের চোখ কান ও নাক এই তিন ইন্দ্রিয়ই শুঁয়োতে আছে। কোথাও এক কণা চিনি পড়িয়া থাকিতে দেখিলে পিঁপ্ড়েরা কি করে তাহা তোমরা নিশ্চয়ই দেখিয়াছ। সে ছুটিয়া গিয়া বাসায় খবর দেয়। তার পরে দলে দলে পিঁপ্ড়ে গর্ত্ত হইতে বাহির হইয়া মিষ্ট খাইয়া ফেলে বা তাহা বাসায় বহিয়া লইয়া যায়। পিঁপ্ড়েরা আমাদের মত কথা বলিয়া মনের ভাব প্রকাশ করিতে পারে না, সম্ভবত তাহারা শুঁয়ো নাড়িয়া দলের পিঁপ্ড়েদের কাছে খবর দেয়। পথে চলিতে চলিতে দুইটি পিঁপ্ড়ে মুখোমুখি হইলে, তাহারা দাঁড়াইয়া কি রকমে শুঁয়ো নাড়ানাড়ি করে, তোমরা তাহা দেখ নাই কি? সম্ভবত এই রকমে শুঁয়ো নাড়িয়াই, তাহারা পরস্পর আলাপ করে এবং দলের পিঁপ্ড়েদের চিনিয়া লয়।
পিঁপ্ড়ের মুখের চোয়াল দুইটি করাতের মত কি-রকম ধারালো তোমরা হয় ত তাহা দেখিয়াছ। ডেঁয়ো-পিঁপ্ড়েরা এই রকম দাঁত দিয়া কামড়াইয়া ধরিলে রক্তপাত করিয়া দেয়। ছাড়াইতে গেলে প্রায়ই ইহাদের গলা ছিঁড়িয়া যায়, কিন্তু তবুও কামড় ছাড়ে না। মাটি কাটিয়া ঘর প্রস্তুতের সময়ে ইহারা ঐ দাঁত জোড়াটা খুব কাজে লাগায়। যখন পরস্পরের মধ্যে ঝগড়া বাধে, তখন ইহারা ঐ দাঁত দিয়াই শত্রুকে কামড়াইয়া মারিয়া ফেলে। কিন্তু ইহাই পিঁপ্ড়েদের আত্মরক্ষার একমাত্র অস্ত্র নয়। কোনো কোনো পিঁপ্ড়ের লেজের শেষে হুলও আছে। কাঠ-পিঁপ্ড়ে দাঁত দিয়া কামড়াইয়া শরীরটাকে বাঁকাইয়া ফেলে এবং ক্ষত স্থানে বিষযুক্ত হুল বসাইয়া দেয়। যে-সকল পিঁপ্ড়ের বুক ও লেজের জোড়ের জায়গায় দুইটা করিয়া বলের মত পিণ্ড থাকে প্রায়ই তাহাদের পিছনে হুল দেখা যায়। এই সকল পিঁপ্ড়েই বিষাক্ত; ইহারা কামড়াইলে ভয়ানক জ্বালা যন্ত্রণা হয়।
দাঁত দিয়া আমরা খাবার চিবাইয়া খাই, কিন্তু পিঁপ্ড়েরা সম্মুখের ঐ দু’টা দাঁত দিয়া কখনই খাবার চিবায় না। চিবাইবার জন্য ভিতর দিকে এক জোড়া ছোট দাঁত আছে এবং জিভও আছে। মিষ্ট জিনিস, ফল এবং ছোট পোকা-মাকড় পিঁপ্ড়েদের প্রধান খাদ্য। খাদ্য কাটিয়া খণ্ড খণ্ড করিবার সময়ে উহারা সেই সাঁড়াশির মত দাঁত জোড়াটা ব্যবহার করে; কিন্তু খাদ্য মুখে দিবার পরে তাহারা ভিতরকার দাঁত ও জিভ ছাড়া আর কিছুরই ব্যবহার করে না।
অনেক পতঙ্গেরই ডানা থাকে, কিন্তু সকল পিঁপ্ড়ের ডানা হয় না। ইহাদের মধ্যে যাহারা স্ত্রী এবং পুরুষ, কেবল তাহাদেরই শরীরে ডানা দেখা যায়। কর্ম্মী পিঁপ্ড়েদের ডানা নাই। তোমরা ঘরে বাহিরে যে-সব পিঁপ্ড়েকে ঘুরিয়া বেড়াইতে দেখ, তাহাদের সকলেই কর্ম্মী। তাই ইহাদের ডানা নাই।
কর্ম্মী পিঁপ্ড়েদের মধ্যে অনেক কাজের ভাগ আছে। কেহ বাসায় পাহারা দেয়, কেহ সৈনিকের কাজ করে, কেহ ঘর বানায়, কেহ বাহির হইতে খাবার জোগাড় করিয়া আনে, কেহ-বা শিশু সন্তানদিগকে লালনপালন করে। তোমরা যদি লক্ষ্য কর, তাহা হইলে পিঁপ্ড়ের গাদার অসংখ্য পিঁপ্ড়ের মধ্যে কতকগুলির আকার বড় দেখিতে পাইবে,—ইহাদের মাথাগুলো যেন শরীরের তুলনায় অনেক বড়। ইহারা সৈনিক পিঁপ্ড়ে। অন্য পিঁপ্ড়ের সঙ্গে যখন লড়াই বাধে তখন উহারা মস্ত মাথার ধারালো দাঁত দিয়া লড়াই করে। সাধারণ কর্ম্মীরাই ছোট আকারে জন্মে। স্ত্রী ও পুরুষ পিঁপ্ড়ের আকার কিছু বড়, কিন্তু ইহারা প্রায়ই গর্ত্ত ছাড়িয়া বাহিরে আসে না।
পিঁপ্ড়েরা কি খাইয়া বাঁচিয়া থাকে, তোমরা জান কি? এক কথায় বলিতে গেলে ইহারা সর্ব্বভুক্। মাছ, মাংস, ফল-মূল, চাল, ডাল, ঘি, তেল, মিষ্টি, টক্ কিছুই ইহাদের অখাদ্য নয়। একবার একটা পুঁটি মাছ মাটিতে ফেলিয়া পরীক্ষা করিয়াছিলাম। পাঁচ মিনিটেই দলে দলে লাল পিঁপ্ড়ে আসিয়া মাছটি কয়েক ঘণ্টার মধ্যে খাইয়া শেষ করিয়াছিল। মাছের কেবল কাঁটা কয়েকটি পড়িয়া ছিল। ফড়িং বা অপর পোকা-মাকড় আধ-মরা হইয়া মাটিতে পড়িয়া থাকিলে, পিঁপ্ড়ের দল তাহা কি রকমে খাইয়া ফেলে দেখ নাই কি? কেবল নিজের খাওয়া নয়,—বাচ্চাদের এবং বাসায় থাকিয়া যাহারা কাজ করে তাহাদের খাওয়াইবার জন্যও ইহারা খাদ্য মুখে করিয়া বাসায় লইয়া যায়।
মৌমাছিদের মত পিঁপ্ড়েদেরও গলার নীচে থলি থাকে। নিজের পেট ভরিলে ইহারা খাদ্য চিবাইয়া ঐ থলিতে ভরিয়া রাখে। তার পরে উহা উগ্লাইয়া বাচ্চাদের বা কর্ম্মীদের প্রয়োজন-অনুসারে খাইতে দেয়। ইহা বড়ই আশ্চর্য্য ব্যাপার! আমাদের এক-এক সমাজে হয় ত আট-দশ হাজার লোক থাকে। ইহাদের মধ্যে ধনী ও গরিব দুই রকমেরই লোক দেখা যায়। কিন্তু ধনীরা সহজে গরীবদের সাহায্য করে না। তাহারা নিজের ছেলে-মেয়ে ও আত্মীয় স্বজনকে লইয়া সুখে থাকিতে চেষ্টা করে। কিন্তু পিঁপ্ড়েদের মধ্যে এই ভাবটি একেবারে নাই। বহু কষ্টে কিছু খাবার সংগ্রহ করিয়া পিঁপ্ড়েরা যখন বাসার দিকে ছুটিয়া চলে, তখন পথের মাঝে যদি নিজের দলের কোনো পিঁপ্ড়ে শুঁয়ো নাড়িয়া খাবার চায়, তবে তাহারা তখনি গলার থলি হইতে খাবার উগ্লাইয়া ক্ষুধার্ত্ত পিঁপ্ড়েকে খাওয়াইতে থাকে। এই রকম ব্যবস্থা আছে বলিয়াই, পিঁপ্ড়েদের সমাজের কাজ সুন্দরভাবে চলে। যাহার খাবার সংগ্রহ করে, তাহারা সেই খাবার আবশ্যকমত সকলের মধ্যে ভাগ করিয়া দেয়। যাহারা ঘর তৈয়ারি করে, তাহারা কেবল নিজের জন্য ঘর তৈয়ারি করে না, দলের সকলেই যাহাতে সুখে থাকিতে পারে, সেই দিকে নজর রাখে। যাহারা সিপাহী বা পাহারাওয়ালার কাজ করে, তাহারা দলের প্রত্যেককে রক্ষা করিবার জন্য শত্রুদের সঙ্গে লড়াই করে। যাহাদের হাতে সন্তানপালনের ভার আছে, তাহারা সব কাজ ফেলিয়া দিবারাত্রি বাসার মধ্যে থাকে এবং সর্ব্বদা ডিম ও বাচ্চাদের খোঁজ-খবর লয়। এমন সুব্যবস্থা এক মানুষের সমাজ ভিন্ন অন্য প্রাণীর সমাজে দেখা যায় না।