পোকা-মাকড়/ষষ্ঠ শাখার প্রাণী/ঝিল্লীপক্ষ পতঙ্গ/রাণী-মাছি ও পুরুষ-মাছি

রাণী-মাছি ও পুরুষ-মাছি

 কর্ম্মী মাছিদের কথা বলিতে অনেক সময় কাটিয়া গেল। এখন তোমাদিগকে স্ত্রী-মাছি অর্থাৎ রাণী এবং পুরুষ-মাছির কাজ-কর্ম্মের কথা বলিব। ইহাদের চলাফেরা সকলি বড় মজার।

 চাক প্রস্তুত হইলে রাণী বড় চঞ্চল হইয়া পড়ে এবং এক-একবার চাক ছাড়িয়া পলাইবার চেষ্টা করে। কিন্তু কর্ম্মী মাছিরা সাধ্য-সাধনা করিয়া তাহাকে আট্‌কাইয়া রাখে। শেষে একদিন হঠাৎ সে উড়িয়া পলাইয়া যায় এবং চাকে যে দুই একটি পুরুষ মাছি থাকে, তাহারাও রাণীর পিছনে ছুটিয়া যায়। রাজা রাস্তায় বাহির হইলে যেমন অনেক সিপাহী ও পাহারা-ওয়ালা তাঁহার সঙ্গে চলে, রাণী বেড়াইতে বাহির হইলে তেমনি পুরুষ-মাছিরা তার সঙ্গে যায়। এক ঘণ্টার মধ্যে রাণীর বেড়ানো শেষ হয় এবং সে আবার চাকে ফিরিয়া আসে। কিন্তু পুরুষদের আর দেখা পাওয়া যায় না। তাহারা রাণীর সঙ্গে একটু এদিক্ ওদিক্ আনন্দে বেড়াইয়া প্রায়ই মারা যায়।

 ইহার দুই-তিন দিন পরে রাণীর ডিম পাড়িবার সময় উপস্থিত হয়। সময় আসিতেছে বুঝিয়া কর্ম্মী-মাছিরা আগেই চাকে অনেক ঘর তৈয়ার করিয়া রাখে। কয়েকটি কর্ম্মীকে সঙ্গে লইয়া রাণী প্রত্যেক ছিদ্রে এক-একটি ডিম প্রসব করিতে থাকে। এই রকমে প্রতিদিন প্রায় দুই-তিন শত ছিদ্রে ডিম জমা হয়।

 মৌমাছির ডিম ফুটিতে দেরি হয় না। দুই তিন দিনের মধ্যেই ছিদ্রের ডিম হইতে এক একটি শুঁয়ো-পোকার মত বাচ্চা বাহির হয়। এই সময়ে কর্ম্মীদের খুব পরিশ্রম করিতে হয়। কিন্তু ডিম প্রসব করিয়া রাণী তাহার সন্তানদের দিকে ফিরিয়াও চায় না। কর্ম্মী-মাছিরাই বাচ্চাদের পালন করে। ফুলের রেণু ও মধু মিশাইয়া যে মিষ্ট খাদ্য তৈয়ারি করা হয়, তাহা উহারাই প্রত্যেক বাচ্চার মুখের কাছে রাখিয়া খাওয়ায়। এই রকমে আট দশ দিনের মধ্যে বাচ্চারা বেশ বড় হইয়া পড়ে।

 ইহার পরে বাচ্চারা পুত্তলি-অবস্থায় আসিয়া পড়ে। তখন ইহারা একেবারে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করিয়া দেয় এবং কর্ম্মী-মাছিরা সেই সময়ে মোমের খুব পাত্‌লা পর্‌দা দিয়া ছিদ্রের মুখ বন্ধ করিয়া দেয়। ছিদ্রের মধ্যে বাচ্চারা এই রকমে দশ বারো দিন নিরিবিলি বাস করে এবং মুখের লালা দিয়া এক রকম সূতা প্রস্তুত করিয়া নিজেদের দেহগুলিকে ঢাকিয়া ফেলে।

 এই রকমে নিভৃত-বাস শেষ হইলে, সেই শুঁয়ো-পোকা আকারের বাচ্চারা ডানা পা এবং মুখওয়ালা মৌমাছি হইয়া দাঁড়ায়। শেষে দাঁত দিয়া ছিদ্রের ঢাক্‌নি কাটিয়া চাকের উপরে আসিয়া উপস্থিত হয়। বিড়াল, কুকুর, মানুষ, গোরু ইত্যাদি প্রাণীরা অল্প বয়সে আকারে ছোট থাকে। তার পর বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বাড়িয়া তাহারা বড় হয়। বোল্‌তা ও মৌমাছিদের মধ্যে ইহা দেখা যায় না। শুঁয়ো-পোকার আকারের চেহারা বদ্‌লাইয়া মৌমাছি ও বোল্‌তারা যে আকার পায়, তাহা আর বয়সের সঙ্গে বাড়ে না।

 যাহা হউক, ছিদ্র হইতে ডানাওয়ালা বাচ্চারা বাহির হইতেছে দেখিলেই, কর্ম্মী-মাছিরা তাহাদের নিকটে ছুটিয়া যায় এবং দুই দিন ধরিয়া তাহাদিগকে টাট্‌কা মধু ও ফুলের রেণু খাওয়াইতে থাকে। ইহাতে বাচ্চারা গায়ে বল পাইয়া বেশ উড়িতে ও কাজকর্ম্ম করিতে শিখিয়া ফেলে। তৃতীয় দিনে ইহাদিগকে আর যত্ন করার দরকার হয় না। তখন ইহারা অন্য কর্ম্মী-মাছিদেরই মত চাকের কাজে লাগিয়া যায়।

 এখানে মৌমাছির ভিন্ন ভিন্ন অবস্থার ছবি দিলাম।

চিত্র ৪৬—ডিম, পোকা, পুত্তলি।

ডিম, বাচ্চা ও পুত্তলি কি রকম, ছবিটি দেখিলেই তোমরা বুঝিতে পারিবে।

 চাক বাঁধার পরে দুই মাসের মধ্যে মৌমাছিদের রাণী যে-সকল ডিম পাড়ে, তাহা হইতে কেবল কর্ম্মী-মাছিই জন্মে। কাজেই অনেক মাছিতে চাক বড় হইয়া পড়ে এবং অনেক ছিদ্রে মধু জমা হয়। এই সময়ে মাছিদের কাহারো কোনো অভাব থাকে না। চাকের কাজ বেশ ভালোই চলে। কিন্তু এই সুখের অবস্থা বেশি দিন থাকে না। তোমরা যদি কখনো মৌমাছির বড় চাক পরীক্ষা করিবার সুযোগ পাও, তবে দেখিবে, চাকের এক প্রান্তে কতকগুলি বড় ছিদ্রযুক্ত ঘর আছে। কর্ম্মী মাছিরা চাক বাঁধার দুই তিন মাস পরে এই সকল বড় ছিদ্র প্রস্তুত করে। চাক বড় হইয়া পড়িলে রাণী যে-সকল ডিম পাড়ে, তাহা হইতে প্রায়ই পুরুষ ও স্ত্রী মাছি জন্মে। ঐ বড় ঘরগুলি পুরুষ ও স্ত্রীদের জন্যই প্রস্তুত থাকে।

 চাকের ঐ-সকল ছিদ্রে রাণী ডিম পাড়িতে আরম্ভ করিলেই কর্ম্মী মাছিদের আহার নিদ্রা বন্ধ হইয়া যায়। তাহারা তখন দিবারাত্রি স্ত্রী ও পুরুষ বাচ্চাদের যত্ন করিতে সুরু করে। এই সময়ে বাচ্চাদের মুখের গোড়ায় ভারে-ভারে খাবার ঢালিয়া দিতে হয়। স্ত্রী-বাচ্চারা বেশি পেটুক হইয়া জন্মে। কর্ম্মী-মাছিরা নিজের শরীর হইতে দুধ বাহির করিয়া তাহাদের খাওয়ায়। ইহাতে বাচ্চারা শীঘ্র সবল হইয়া উঠে।

 এক রাজার রাজ্যে আর এক রাজা রাজত্ব করিতে ইচ্ছা করিলে, রাজায় রাজায় লড়াই বাধে। তখন রাজা-প্রজা সকলকেই অস্থির হইয়া পড়িতে হয়—দেশে একটুও শান্তি থাকে না। পুরাতন রাণীর ডিম হইতে যখন বাচ্চারা নূতন রাণী সাজিয়া বাহির হইতে চায়, তখন চাকে ঠিক সেই রকম অশান্তি দেখা দেয়। পুরানো রাণী নূতনদের ভয়ে কাঁপিতে থাকে এবং চাক ছাড়িয়া পলাইবার চেষ্টা করে। কর্ম্মী-মাছিরা পুরানো রাণীকে অনেক সাধ্যসাধনা করিয়া চাকে আট্‌কাইয়া রাখে এবং নূতন রাণীরা যাহাতে বাহির না হয়, তাহার জন্য ছিদ্রের মুখে ক্রমাগত মোম চাপাইতে থাকে। কিন্তু সকল চেষ্টা বিফল হইয়া যায়; নরম মোমের ঢাক্‌নি নূতন রাণীকে আট্‌কাইয়া রাখিতে পারে না। হঠাৎ একদিন নূতন রাণী ঢাক্‌নি কাটিয়া ছিদ্রের বাহিরে আসিয়া দাঁড়ায় এবং পুরানো রাণী কয়েকটি পুরুষ ও কয়েক হাজার কর্ম্মীকে সঙ্গে লইয়া চাক ছাড়িয়া আর এক জায়গায় চাক বাঁধিবার চেষ্টা করে।

 নূতন রাণী বুড়ো-রাণীকে তাড়াইয়া কয়েকদিন বেশ আনন্দেই কাটায়। চাকের কর্ম্মীরা ইহাকেই রাণী বলিয়া মানে ও তাহার মুখে ভালো ভালো খাবার গুঁজিয়া দেয়। কিন্তু নূতন রাণীরও এই সুখ বেশি দিন থাকে না। চাকের আর এক ছিদ্র হইতে আার একটি রাণী বাহির হইতেছে দেখিয়া সে বুড়ো-রাণীর মতই বিপদে পড়ে এবং কতকগুলি সঙ্গী লইয়া চাক ছাড়িয়া পলাইয়া যায়। যদি কোন গতিকে দুই রাণী মুখোমুখী হইয়া পড়ে, তবে আর রক্ষা থাকে না। দু’জনের মধ্যে ভয়ানক লড়াই বাধিয়া যায় এবং যতক্ষণ দুইয়ের মধ্যে একটি মারা না যায়, ততক্ষণ ঘোরতর যুদ্ধ চলিতে থাকে।

 যাহা হউক, এই রকমে এক-একটি রাণী এক এক দল মাছিকে সঙ্গে লইয়া পলাইলে, চাক বেশ খালি হইয়া পড়ে। কখনো কখনো এই রকমে চাকে একটি মাছিও থাকে না। কর্ম্মী-মাছিরা ডিম ও বাচ্চাদের মুখে লইয়া রাণীর সঙ্গে নূতন চাক বাঁধিবার চেষ্টায় বাহির হয়। কিন্তু সকলেই নূতন চাকে পৌঁছিতে পারে না। কতক কর্ম্মী জলে ডুবিয়া মরে, কতক হয় ত আগুনে বা রৌদ্রে পুড়িয়া মারা যায়। যদি পুরাতন চাকে বাস করার সুবিধা থাকে, তবে নূতন রাণী রণমূর্ত্তি ধরিয়া ভয়ানক মারামারি আরম্ভ করে। রাণীর এই সময়ের চেহারা দেখিলে ভয় হয়। সে ডানা মেলিয়া প্রত্যেক ছিদ্রে ঘুরিয়া বেড়ায় এবং সেখানে যে স্ত্রী ও পুরুষ বাচ্চা থাকে তাহাদিগকে মারিয়া ফেলে। এই হত্যাকাণ্ডে কর্ম্মী মাছিরাও যোগ দেয়। এই রকমে স্ত্রী ও পুরুষেরা মরিয়া গেলে নূতন রাণী পুরানো চাকের একমাত্র অধীশ্বরী হইয়া পড়ে। পুরুষ মাছিরা মরিয়া যাওয়ায় কর্ম্মীদের কাজ অনেক কমিয়া আসে, কারণ তখন ভারে-ভারে খাবার আনিয়া পুরুষদের খাওয়াইতে হয় না। তখন কর্ম্মীরা নিশ্চিন্ত হইয়া নূতন করিয়া ঘর তৈয়ারি সুরু করিতে পারে এবং নানা প্রকার গাছ হইতে আঠা সংগ্রহ করিয়া ভাঙা ঘর জোড়া দিতে থাকে। মারামারি ও হানাহানির পরে এই রকমে চাকে আবার শান্তি ফিরিয়া আসে।