পোকা-মাকড়/ষষ্ঠ শাখার প্রাণী/দ্বিপক্ষ পতঙ্গ

দ্বিপক্ষ পতঙ্গ

(Diptera.)

 এইবার আমরা দ্বিপক্ষ পতঙ্গদের কথা বলিব। এই দলের অনেক পতঙ্গেরই দু’খানা করিয়া পাত্‌লা ডানা থাকে। এই জন্যই আমরা ইহাদিগকে দ্বিপক্ষ নাম দিলাম। কিন্তু ইহাদের মধ্যে এ রকম পোকাও দুই চারিটি আছে, যাহাদের কোনো কালেও ডানা গজায় না। মশা মাছি ছারপোকা প্রভৃতি আমাদের জানা-শুনা অনেক পোকাই এই দলের। ইহারা বড়ই অভদ্র। কেহ অন্য বড় প্রাণীর রক্ত চুষিয়া খায়, কেহ পচা মাংসের রস খায় ও তাহাতে ডিম পাড়ে, কেহ-বা পচা জায়গায় ঘুরিয়া বেড়ায় এবং পচা জিনিস খায়। আবার যে-সব নোংরা ও পচা জায়গায় ব্যারামের বীজ জমা থাকে, সেখানে বেড়াইয়া কোনো কোনো পোকা ব্যারামের বীজ চারিদিকে ছড়াইয়া দেয়। ইহাতে শত শত লোক নানা রকম অসুখে পড়িয়া মারা যায়। তাহা হইলে দেখ, ছোট প্রাণী হইয়াও ইহার বাঘ-ভালুকের চেয়ে মানুষের বেশি অনিষ্ট করে।

 অন্যান্য পতঙ্গদের মতই ইহাদের মুখের উপরে দুটা ছোট শুঁয়ো থাকে এবং তাহার গায়ে সরু সরু চুল লাগানো থাকে। তোমরা যদি মাছির শুঁয়ো আতসী কাচে দেখিবার সুযোগ পাও, তবে ঐ-রকম শুঁয়ো স্পষ্ট দেখিতে পাইবে।

 অণুবীক্ষণে ফেলিয়া দ্বিপক্ষ পতঙ্গের মুখ পরীক্ষা করিলে, সেগুলিকে অতি বিশ্রী দেখায়। মাথার উপরেই বড় বড় দুটা চোখ দেখা যায়। এই চোখগুলির একএকটা হাজার হাজার ছোট চোখের সমষ্টি। চোখের নীচেই মুখ। উহাতে তরল জিনিস চুষিয়া খাইবার জন্য শুঁড় ও অন্য প্রাণীর গায়ের চাম্‌ড়া কাটিবার জন্য অস্ত্র ইত্যাদি নানা সাজসজ্জা থাকে। ইহাদের ডানা দুখানি থাকে বটে, কিন্তু ডানার কাছে দুটি খুঁটির মত অঙ্গ দেখা যায়। তাহা দেখিয়া পণ্ডিতেরা বলেন, এখনকার দ্বিপক্ষ পতঙ্গদের এককালে চারিখানি করিয়া ডানা ছিল—কোনো কারণে পিছনের ডানা জোড়াটা লোপ পাইয়া গিয়াছে। এখন সেই ডানারই মূল খুঁটির আকারে এই সব পতঙ্গের দেহে রহিয়া গিয়াছে। মরা মশা বা মাছি আতসী কাচে পরীক্ষা করিলে তোমরা পিছনের ডানার ঐ-প্রকার চিহ্ন দেখিতে পাইবে। এই পোকারা যখন ডানা মেলিয়া উড়িতে থাকে, ঐ দুটি খুঁটিও আপনা হইতে নড়াচড়া করিতে থাকে।

 সার্‌কাসের খেলোয়াড় যখন তারের উপর দিয়া চলিতে চলিতে খেলা দেখায়, তখন সে কি করে তোমরা দেখ নাই কি? সে তারে উঠিয়াই নিজেকে স্থির রাখিবার জন্য ক্রমাগত হাত পা নাড়াচাড়া করিতে আরম্ভ করে। হাত বাঁধিয়া তারের উপরে দাঁড় করাইতে গেলে খুব ওস্তাদ খেলোয়াড়ও ধপাস্ করিয়া মাটিতে পড়িয়া যায়। দুই ডানায় ভর দিয়া মশা-মাছিরা যখন উড়িতে আরম্ভ করে, তখন তাহাদের দেহগুলিকে স্থির রাখিবার জন্য হাত পা নাড়ার মত একটা-কিছু করার দরকার হয়। দ্বিপক্ষ পতঙ্গের দেহের ঐ লুপ্ত ডানার খুঁটি হেলিয়া দুলিয়া তাহাদিগকে সোজাভাবে উড়িয়া চলিবার সাহায্য করে।

 সাধারণ পতঙ্গের মত দ্বিপক্ষ পোকারা ডিম পাড়ে এবং সেই ডিম হইতে শুঁয়ো-পোকার আকারের বাচ্চা বাহির হয়। শেষে এই পোকাই পুত্তলি-অবস্থায় শরীর বদ্‌লাইয়া ডানা-ওয়ালা সম্পূর্ণ পতঙ্গ হইয়া দাঁড়ায়। কিন্তু সাধারণ শুঁয়ো-পোকাদের যেমন পা ও চোখ থাকে, এই দলের শুঁয়ো-পোকাদের তাহা দেখা যায় না। ইহাদের মুখের গড়ন জটিল নয় এবং মুখের চেয়ে লেজের দিক্‌টাই বেশি মোটা। মুখে বঁড়শির মত বাঁকানো দুটা অস্ত্র থাকে, তাহাই দাঁতের কাজ চালায়।

 সম্পূর্ণ আকার পাইলে অনেক পতঙ্গই ডিম পাড়িয়া চারি দিনের মধ্যে মারা যায়, ইহা তোমরা আগে অনেক বার শুনিয়াছ। কিন্তু দ্বিপক্ষ পতঙ্গদের সম্বন্ধে সে-কথা বলা যায় না। ডানা-ওয়ালা সম্পূর্ণ পতঙ্গের আকারে ইহারা অনেক দিন বাঁচে। ডিম হইতে বাচ্চা জন্মিতে এবং বাচ্চা হইতে সম্পূর্ণ পোকা হইয়া দাঁড়াইতে ইহাদের বেশি সময়ের দরকার হয় না। পুত্তলি-অবস্থায় গুটিপোকা বা অপর পতঙ্গের মত ইহারা বিশেষ কোনো আবরণে গা ঢাকে না। সেই সময়ে তাহাদের গায়ের চামড়াটাই খুব শক্ত হইয়া দাঁড়ায়। ইহাই তাহাদিগকে নিরাপদে রাখে। তার পরে অঙ্গ-প্রতঙ্গ গজাইলে, সেই মোটা চামড়া ছিঁড়িয়া তাহারা সম্পূর্ণ আকারে বাহির হইয়া পড়ে।

 মৌমাছি পিঁপড়ে ও উইয়েরা কি-রকমে দলবদ্ধ হইয়া বাস করে, তাহা তোমরা শুনিয়াছ। কিন্তু দ্বিপক্ষ পতঙ্গেরা একত্রে সে-রকমে বাস করিতে পারে না। যেখানে রাত্রি হয়, সেখানেই রাত্রি কাটায় এবং তার পরে নিজের পেটের জ্বালায় ঘুরিয়া বেড়ায়, দলের অন্যদের দিকে একবার ফিরিয়া তাকায় না।