পোকা-মাকড়/ষষ্ঠ শাখার প্রাণী/শিরা-পক্ষ পতঙ্গ/জল-ফড়িং

জল-ফড়িং

 তোমরা এই পোকা নিশ্চয়ই দেখিয়াছ। পুষ্করিণী বা অন্য জলাশয়ের ধারে ইহাদিগকে অনেক দেখা যায়। জলে যদি বাঁশ বা কাঠ পোঁতা থাকে, তবে ইহারা ডানা মেলিয়া সেগুলির উপরে চুপ করিয়া বসিয়া থাকে। কখনো কখনো জলাশয় হইতে দূরেও জল-ফড়িংকে উড়িতে দেখা যায়। চিল শকুনি আকাশে ডানা মেলিয়া ঘুরিয়া বেড়ায়, ইহাদিগকেও সেই রকমে অবিরাম উড়িয়া বেড়াইতে দেখা যায়। ইহারা মৌমাছির মত কখনই ডানা গুটাইতে পারে না।

 এখানে জল-ফড়িঙের একটা ছবি দিলাম। আমরা

চিত্র ৫২—জল-ফড়িং।

কোন্ পোকাকে জল-ফড়িং বলিতেছি, ছবি দেখিলেই তোমরা বুঝিতে পারিবে। অনেক জায়গায় ইহাদিগকে জলঝিঁঝি বা ঝিঁজি বলে। সত্যই ইহারা ঝিঁজি নয়। পুরুষ ও স্ত্রী-উইয়ের ডানায় যেমন শিরার মত দাগ কাটা থাকে, ইহাদের ডানাতেও সেই রকম দাগ থাকে। ডানাগুলি খুব পাত্‌লা ও স্বচ্ছ। এইজন্য জল-ফড়িংকে উইয়ের দলের শিরা-পক্ষ পতঙ্গ বলা হয়। কিন্তু উইয়ের মত ইহারা দলবদ্ধ হইয়া কখনই বাস করে না।

 জল-ফড়িং আকারেও নিতান্ত ছোট হয় না। একএকটি দুই ইঞ্চি পর্য্যন্ত লম্বা হয়। ইহাদের গায়ের রঙ্ লাল হল্‌দে সবুজ নানা রকম দেখা যায়। মাথাটা প্রায়ই শরীরের তুলনায় বড় এবং চোখ দুটাও প্রকাণ্ড হয়। একএকটা চোখ প্রায় বারো চৌদ্ধ হাজার ছোট চোখ লইয়া প্রস্তুত। সুতরাং বলিতে হয়, ইহাদের আটাশ হাজার চোখ আছে। অনেক পতঙ্গেরই এই রকম হাজার হাজার চোখ আছে, কিন্তু জল ফড়িঙের চোখ অন্যদের চোখের চেয়ে অনেক উন্নত। আমাদের মাথায় দুটা বড় বড় চোখ আছে, কিন্তু এই চোখের গঠন এমন খারাপ যে, তাহা দিয়া খুব কাছের বা খুব দূরের জিনিস দেখিতে গেলে মুস্কিলে পড়িতে হয়। আমরা চোখের খুব কাছে বই রাখিয়া পড়িতে পারি না, আবার দশ হাত দূরে বই রাখিয়াও অক্ষর চিনিতে পারি না। জল-ফড়িঙের মাথার দুই ধারে যে দুই-গাদা চোখ বসানো আছে, তাহার মধ্যে কতকগুলি দিয়া উহারা কাছের জিনিস দেখে এবং আর কতকগুলিকে দূরের জিনিস দেখিবার সময়ে কাজে লাগায়। কাজেই অন্য পোকাদের চেয়ে ইহাদের দৃষ্টি-শক্তি অনেক বেশি।

 উইয়েরা গাছ-পালা ও বাঁশ-খড় খায়। জল-ফড়িং উহাদের মত প্রাণী হইয়াও কিন্তু নিরামিষ খাবার ছোঁয় না। ছোট ছোট পোকা ও মশা-মাছি ইহাদের প্রধান খাদ্য। উড়িবার সময়ে ইহারা কেবল ছোট পোকারই সন্ধান করে। কাছে কোনো পোকাকে উড়িতে দেখিলে জল-ফড়িংরা তাহার উপরে চিলের মত ছোঁ মারে এবং ছয়খানা পা দিয়া তাহাকে আট্‌কাইয়া ফেলে। তার পর উড়িতে উড়িতেই শিকারটিকে দাঁত দিয়া পিষিয়া ফেলে। ইহাদের পা-গুলি মুখের খুব কাছে সাজানো থাকে, এজন্য শিকার ধরিয়া মুখে গুঁজিয়া দিবার খুব সুবিধা হয়। কিন্তু এই পায়ে হাঁটিয়া বেড়াইবার কাজ চলে না। জল-ফড়িং কখনই পিঁপ্‌ড়ে, বোল্‌তা বা উইয়ের মত হাঁটিতে পারে না। গোরুর গাড়ীর পিছনটা যদি সাম্‌নের চেয়ে ভারি হয়, তবে গাড়ী ওলা হইয়া যায়। তখন গাড়ী আর চালানো যায় না। জল-ফড়িঙের মাথা ও বুকের চেয়ে লেজের অংশটা বেশি ভারি। এইজন্য হাঁটিয়া বেড়াইতে গেলে, তাহাদের লেজ মাটিতে লুটাইতে থাকে। কাজেই তাহাদের হাঁটিয়া চলা একেবারে অসম্ভব। তোমরা এইবার যখন জল-ফড়িং দেখিবে, তখন উহাদের উঠা-বসা চলা-ফেরা সকলি পরীক্ষা করিয়া দেখিয়ো।

 কাক, শালিক প্রভৃতি পাখীরা যখন উড়িতে উড়িতে বামে, ডাহিনে বা পিছনে যাইতে চায়, তখন আগে মুখটাকে সেই দিকে ফিরায়, তার পরে সেই দিক্ লক্ষ্য করিয়া উড়িয়া চলে। জল-ফড়িং বামে বা ডাইনে যাইবার সময়ে সেই দিকে মুখ ফিরাইয়া উড়ে না,—অনায়াসে পাশা-পাশি উড়িয়া বেড়াইতে পারে। হাল ঘুরাইয়া যেমন নৌকাকে যে-দিকে খুসি চালানো যায়, লম্বা লেজে মোচড় দিয়া উহারা সেই রকমে যে-দিকে-ইচ্ছা যাওয়া-আসা করে।

 জল-ফড়িঙের জীবনের কথা বড়ই অদ্ভুত। বাচ্চা অবস্থায় ইহারা খাল, বিল বা পুষ্করিণীর জলে বাস করে, তার পরে ডানাযুক্ত সম্পূর্ণ পতঙ্গ হইয়া দাঁড়াইলে জল ছাড়িয়া আকাশে উড়িয়া বেড়ায়। স্ত্রী-জল-ফড়িং কখনই ডাঙায় ডিম পাড়ে না। প্রসবের সময় হইলে ধীরে ধীরে উড়িয়া পুকুরের ধারে যায় এবং জলে পোঁতা কোনো বাঁশ বা কাঠ বাহিয়া জলে ডুব দেয়। তার পরে জলের তলায় শেওলার গায়ে বা কাদার মধ্যে ডিম পাড়িয়া আবার উপরে উঠিয়া আসে। কখনো কখনো আবার জলের উপরকার লতা-পাতায় বসিয়াই ইহারা ডিম পাড়ে এবং ডিমগুলি আপনা হইতেই জলে পড়িয়া ডুবিয়া যায়।

 যাহা হউক, জলে ডিম পাড়ার পর জল-ফড়িং আর ডিমের খবর লয় না। সেগুলি জলের তলায় থাকিয়া আপনা হইতেই ফুটিয়া যায় এবং প্রত্যেক ডিম হইতে একএকটা বাচ্চা বাহির হয়। বাচ্চারা ছয়খানা পা এবং এক কিম্ভুতকিমাকার মুখ লইয়া জন্মে। মুখের নীচেকার ওষ্ঠখানি এত লম্বা থাকে যে, দেখিলেই মনে হয়, যেন সেটা একখানি প্রকাণ্ড হাত। এই ওষ্ঠ সাধারণ অবস্থায় মাথার নীচে গুটানো থাকে। কাছে ছোটখাটো জলের পোকা বা মাছ দেখিলেই উহারা সেই ওষ্ঠ বাড়াইয়া শিকারগুলি ধরিয়া খাইতে আরম্ভ করে।

 জল-ফড়িঙের উৎপাতে ডাঙার পোকা-মাকড় যেমন অস্থির থাকে, উহাদের বাচ্চাদের উপদ্রবে জলের পোকা-মাকড়দেরও সেই রকম ভয়ে ভয়ে থাকিতে হয়।

 জলে বাস করিতে গেলে জল হইতে অক্সিজেন টানিয়া লওয়া দরকার, নচেৎ জলের প্রাণী বাঁচে না। এই কথাটা তোমাদিগকে বার বার বলিয়াছি। মাছ কাঁকড়া প্রভৃতির শরীরে সেই জন্য কান্‌কো থাকে। কান্‌কোর উপর দিয়া জল চলিতে থাকিলে, জলে-মিশানো অক্সিজেন্ রক্তের সহিত মিশিতে পারে। কিন্তু জল-ফড়িংদের বাচ্চার দেহে কান্‌কো থাকে না। ইহাদের দেহে লেজ হইতে আরম্ভ করিয়া মুখ পর্য্যন্ত একটা নল আছে। লেজের ছিদ্র দিয়া জল টানিয়া তাহারা সেই জল ক্রমাগত মুখ দিয়া বাহির করিতে থাকে। এদিকে আবার এই বড় নলের সঙ্গে অনেক ছোট নলের যোগ থাকে। এই ব্যবস্থায় জলের অক্সিজেন্ ঐ-সকল সরু নলের দ্বারা শরীরের সকল অংশে ছড়াইয়া পড়ে।

 জল-ফড়িঙের বাচ্চারা এই রকমে প্রায় এক বৎসর জলের তলায় বাস করে। কিন্তু ইহারা অন্য পতঙ্গের মত পুত্তলি-অবস্থায় মড়ার মত পড়িয়া থাকে না। এক বৎসর উত্তীর্ণ হইলেই ইহাদের গায়ের চামড়ার নীচে ডানা গজাইতে আরম্ভ হয়। তার পরে ধীরে ধীরে ইহারা সম্পূর্ণ জল-ফড়িঙের চেহারা পায়। এই অবস্থায় ইহারা আর জলে ডুব দিয়া থাকিতে চায় না। জলের কোনো গাছ-পালা আঁক্‌ড়াইয়া আস্তে আস্তে উপরে আসে এবং জোর করিয়া গায়ের ছাল ছিঁড়িয়া সম্পূর্ণ জল-ফড়িঙের আকারে উড়িতে আরম্ভ করে।

 যাহারা বাচ্চা অবস্থায় এক বৎসর জলের তলায় বাস করে, তাহারা সম্পূর্ণ পতঙ্গের আকারে পাঁচ সাত বৎসর বাঁচিবে, ইহাই আমাদের মনে হয়। কিন্তু জল-ফড়িং সম্পূর্ণ আকারে বেশি দিন বাঁচে না। সম্ভবত দুই তিন মাসেই উহারা মারা যায়।