প্রজাপতির নির্বন্ধ/১১
(১১)
রসিক। ভাই শৈল!
শৈল। কি রসিক দাদা!
রসিক। এ কি আমার কাজ? মহাদেবের তপোভঙ্গের জন্যে স্বয়ং কন্দর্পদেব ছিলেন—আর আমি বৃদ্ধ―
শৈল। তুমি ত বৃদ্ধ, তেমনি যুবক দুটিও ত যুগল মহাদেব নন্!
রসিক। তা নন্, আমি বেশ ঠাহর করেই দেখেছি। সেই জন্যেই ত নির্ভয়ে এসেছিলুম। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে রাস্তার মধ্যে হিমে দাঁড়িয়ে অর্দ্ধেক রাত পর্য্যন্ত রসালাপ করবার মত উত্তাপ আমার শরীরে ত নেই!
শৈল। তাঁদের সংসর্গে উত্তাপ সঞ্চয় করে নেবে।
রসিক। সজীব গাছ যে সূর্য্যের তাপে প্রফুল্ল হয়ে ওঠে মরাকাঠ তাতেই ফেটে যায়, যৌবনের উত্তাপ বুড়োমানুষের পক্ষে ঠিক উপযোগী বোধ হয় না।
শৈল। কই তোমাকে দেখে ফেটে যাবে বলে ত বোধ হচ্চে না।
রসিক। হৃদয়টা দেখলে বুঝতে পারতিস্ ভাই।
শৈল। কি বল রসিক দা। তোমারি ত এখন সব চেয়ে নিরাপদ বয়েস। যৌবনের দাহে তোমার কি করবে?
রসিক। শুষ্কেন্ধনে বহ্নিরুপৈতি বৃদ্ধিম্। যৌবনের দাহ বৃদ্ধকে পেলেই হু হুঃ শব্দে জ্বলে ওঠে—সেই জন্যেই ত বৃদ্ধস্য তরুণীভার্য্যা বিপত্তির কারণ! কি আর বল্ব ভাই।
নীরবালার প্রবেশ।
রসিক। আগচ্ছ বরদে দেবি! কিন্তু বর তুমি আমাকে দেবে কি না জানিনে আমি তোমাকে একটি বর দেবার জন্যে প্রাণপাত করে মর্চি। শিব ত কিছুই কর্চেন না তবু তোমাদের পূজো পাচ্চেন, আর এই যে বুড়ো খেটে মরচে একি কিছুই পাবে না?
নীরবালা। শিব পান ফুল, তুমি পাবে তার ফল―তোমাকেই বরমাল্য দেব রসিকদাদা!
রসিক। মাটির দেবতাকে নৈবেদ্য দেবার সুবিধা এই যে সেটি সম্পূর্ণ ফিরে পাওয়া যায়—আমাকে ও নির্ভয়ে বরমাল্য দিতে পারিস্, যখনি দরকার হবে তখনি ফিরে পাবি―তার চেয়ে ভাই আমাকে একটা গলাবন্ধ বুনে দিস্, বরমাল্যের চেয়ে সেটা বুড়োমানুষের কাজে লাগ্বে।
নীর। তা দেব—এক জোড়া পশমের জুতো বুনে রেখেছি সেও শ্রীচরণেষু হবে।
রসিক। আহা, কৃতজ্ঞতা একেই বলে? কিন্তু নীরু, আমার পক্ষে গলাবন্ধই যথেষ্ট—আপাদমস্তক নাই হোল, সে জন্যে উপযুক্ত লোক পাওয়া যাবে, জুতোটা তাঁরি জন্যে রেখে দে।
নীর। আচ্ছা, তোমার বক্ত্তৃতাও তুমি রেখে দাও?
রসিক। দেখেছিস, ভাই শৈল, আজকাল নীরুরও লজ্জা দেখা দিয়েছে―লক্ষণ খারাপ।
শৈল। নীরু তুই করচিস্ কি? আবার এ ঘরে এসেছিস্। আজ যে এখানে আমাদের সভা বস্বে―এখনি কে এসে পড়বে, বিপদে পড়বি।
রসিক। সেই বিপদের স্বাদ ও একবার পেয়েছে, এখন বারবার বিপদে পড়বার জন্যে ছট্ফট করে বেড়াচ্ছে।
নীর। দেখ রসিকদাদা তুমি যদি আমাকে বিরক্ত কর তা’হলে গলাবন্ধ পাবে না বল্চি। দেখ দেখি দিদি, তুমিও যদি রসিকদার কথায় ঐ রকম করে হাস তা’হলে ওঁর আস্পর্দ্ধা আরও বেড়ে যায়।
রসিক। দেখেছিস্ ভাই শৈল, নীরু আজ কাল ঠাট্টাও সইতে পারছে না, মন এত দুর্ব্বল হয়ে পড়েছে! নীরু দিদি, কোন কোন সময় কোকিলের ডাক শ্রুতিকটু বলে ঠেকে এই রকম শাস্ত্রে আছে, তোর রসিকদাদার ঠাট্টাকেও কি তোর আজকাল কুহুতান বলে ভ্রম হতে লাগ্ল?
নীর। সেই জন্যেইত তোমার গলায় গলাবন্ধ জড়িয়ে দিতে চাচ্চি তানটা যদি একটু কমে।
শৈল। নীরু আর ঝগড়া করিস্নে—আয়, এখনি সবাই এসে পড়বে। (উভয়ের প্রস্থান)
পূর্ণর প্রবেশ।
রসিক। আসুন পূর্ণবাবু!
পূর্ণ। এখনো আর কেউ আসেন নি?
রসিক। আপনি বুঝি কেবল এই বৃদ্ধটিকে দেখে হতাশ হয়ে পড়েচেন। আরো সকলে আস্বেন পূর্ণবাবু।
পূর্ণ। হতাশ কেন হব রসিক বাবু?
রসিক। তা কেমন করে বলব বলুন? কিন্তু ঘরে যেই ঢুক্লেন আপনার দুটি চক্ষু দেখে বোধ হল তারা যাঁকে ভিক্ষা করে বেড়াচ্চে সে ব্যক্তি আমি নই।
পূর্ণ। চক্ষুতত্বে আপনার এতদূর অধিকার হল কি করে?
রসিক। আমার পানে কেউ কোন দিন তাকায় নি পূর্ণবাবু তাই এই প্রাচীন বয়স পর্য্যন্ত পরের চক্ষু পর্য্যবেক্ষণের যথেষ্ট অবসর পেয়েছি। আপনাদের মত শুভাদৃষ্ট হলে দৃষ্টিতত্ত্ব লাভ না করে অনেক দৃষ্টিলাভ করতে পারতুম। কিন্তু যাই বলুন পূর্ণবাবু, চোখ দুটির মত এমন আশ্চর্য্য সৃষ্টি আর কিছু হয় নি—শরীরের মধ্যে মন যদি কোথাও প্রত্যক্ষ বাস করে সে ঐ চোখের উপরে।
পূর্ণ। (সোৎসাহে) ঠিক বলেছেন রসিকবাবু! ক্ষুদ্র শরীরের মধ্যে যদি কোথাও অনন্ত আকাশ কিংবা অনন্ত সমুদ্রের তুলনা থাকে সে ঐ দুটি চোখে!
রসিক।নিঃসীমশোভাসৌভাগ্যং নতাঙ্গ্যা নয়নদ্বয়ং
অন্যোহন্যালোকনানন্দবিরহাদিব চঞ্চলং―
বুঝেছেন পূর্ণবাবু?
পূর্ণ। না, কিন্তু বোঝবার ইচ্ছা আছে।
রসিক।আনতাঙ্গী বালিকার শোভাসৌভাগ্যের সার নয়ন যুগল,
না দেখিয়া পরস্পরে তাই কি বিরহভরে হয়েছে চঞ্চল?
পূর্ণ। না রসিকবাবু, ও ঠিক হ’ল না! ও কেবল বাক্চাতুরী! দুটো চোখ পরস্পরকে দেখ্তে চায় না।
রসিক। অন্য দুটো চোখকে দেখতে চায় ত? সেই রকম অর্থ করেই নিন্ না! শেষ দুটো ছত্র বদ্লে দেওয়া যাক—
প্রিয়চক্ষু দেখাদেখি যে আনন্দ, তাই সে কি খুঁজিছে চঞ্চল?
পূর্ণ। চমৎকার হয়েছে রসিক বাবু!
প্রিয়চক্ষু-দেখাদেখি যে আনন্দ, তাই সে কি খুঁজিছে চঞ্চল?
অথচ সে বেচারা বন্দী—খাঁচার পাখীর মত কেবল এপাশে ওপাশে ছট্ফট্ করে—প্রিয়চক্ষু যেখানে, সেখানে পাখা মেলে উড়ে যেতে পারে না।
রসিক। আবার দেখাদেখির ব্যাপারখানাও যে কি রকম নিদারুণ, তাও শাস্ত্রে লিখেছে—
হত্বা লোচনবিশিখৈর্গত্বা কতিচিৎপদানি পদ্মাক্ষী
জীবতিযুবা ন বা কিং ভূয়ো ভূয়ো বিলোকয়তি।
বিঁধিয়া দিয়া আঁখিবাণে
যায় সে চলি গৃহপানে,―
জনমে অনুশোচনা;―
বাঁচিল কি না দেখিবারে
চায় সে ফিরে বারে বারে
কমলবরলোচনা!
পূর্ণ। রসিকবাবু বারে বারে ফিরে চায় কেবল কাব্যে।
রসিক। তার কারণ, কাব্যে ফিরে চাবার কোন অসুবিধে নেই। সংসারটা যদি ঐ রকম ছন্দে তৈরি হত তা হলে এখানেও ফিরে ফিরে চাইত পূর্ণবাবু―এখানে মন ফিরে চায়, চক্ষু ফেরে না!
পূর্ণ। (সনিঃশ্বাসে) বড় বিশ্রী জায়গা রসিক বাবু! কিন্তু ওটা আপনি বেশ বলেচেন― প্রিয়চক্ষু দেখাদেখি যে আনন্দ, তাই সে কি খুঁজিছে চঞ্চল?
রসিক। আহা পূর্ণবাবু; নয়নের কথা, যদি উঠল ও আর শেষ করতে ইচ্ছা করে না―
লোচনে হরিণগর্ব্বমোচনে
মা বিদূষয় নতাঙ্গি কজ্জলৈঃ!
সায়কঃ সপদি জীবহারকঃ
কিং পুনর্হি গরলেন লেপিতঃ?
হরিণগর্ব্বমোচন লোচনে
কাজল দিয়ো না, সরলে!
এমনিতে বাণ নাশ করে প্রাণ
কি কাজ লেপিয়া গরলে?
পূর্ণ। থামুন রসিকবাবু থামুন? ঐ বুঝি কারা আস্চেন?
চন্দ্রবাবু ও নির্ম্মলার প্রবেশ।
চন্দ্র। এই যে অক্ষয় বাবু!
রসিক। আমার সঙ্গে অক্ষয় বাবুর সাদৃশ্য আছে শুনলে তিনি এবং তাঁর আত্মীয়গণ বিমর্ষ হবেন। আমি রসিক।
চন্দ্র। মাপ করবেন—রসিক বাবু—হঠাৎ ভ্রম হয়েছিল।
রসিক। মাপ করবার কি কারণ ঘটেছে মশায়! আমাকে অক্ষয়বাবু ভ্রম করে কিছুমাত্র অসম্মান করেন নি। মাপ তাঁর কাছে চাইবেন। পূর্ণবাবুতে আমাতে এতক্ষণে বিজ্ঞানচর্চ্চা করছিলুম চন্দ্রবাবু।
চন্দ্র। আমাদের কুমারসভায় আমরা মাসে একদিন করে বিজ্ঞান আলোচনার জন্যে স্থির করব মনে কর্ছিলুম। আজ কি বিষয় নিয়ে আলোচনা চলছিল পূর্ণবাবু?
পূর্ণ। না, সে কিছুই না চন্দ্রবাবু!
রসিক। চোখের দৃষ্টি সম্বন্ধে দুচার কথা বলাবলি করা যাচ্ছিল।
চন্দ্র। দৃষ্টির রহস্য ভারি শক্ত রসিক বাবু।
রসিক। শক্ত বৈকি! পূর্ণবাবুরও সেই মত।
চন্দ্র। সমস্ত জিনিষের ছায়াই আমাদের দৃষ্টিপটে উল্টো হয়ে পড়ে, সেইটেকে যে কেমন করে আমরা সোজাভাবে দেখি সে সম্বন্ধে কোন মতই আমার সন্তোষজনক বলে বোধ হয় না।
রসিক। সন্তোষজনক হবে কেমন করে? সোজা দেখা বাঁকা দেখা এই সমস্ত নিয়ে মানুষের মাথা ঘুরে যায়। বিষয়টা বড় সঙ্কটময়।
চন্দ্র। নির্ম্মলার সঙ্গে রসিকবাবুর পরিচয় হয় নি? ইনিই আমাদের কুমার সভার প্রথম স্ত্রীসভ্য।
রসিক। (নমস্কার করিয়া) ইনি আমাদের সভার সভালক্ষ্মী। আপনাদের কল্যাণে আমাদের সভায় বুদ্ধি বিদ্যার অভাব ছিল না, ইনি আমাদের শ্রী দান করতে এসেছেন।
চন্দ্র। কেবল শ্রী নয়, শক্তি।
রসিক। একই কথা চন্দ্রবাবু। শক্তি যখন শ্রীরূপে আবির্ভূতা হন তখনই তাঁর শক্তির সীমা থাকে না! কি বলেন পূর্ণবাবু?
পুরুষবেশী শৈলের প্রবেশ।
শৈল। মাপ করবেন চন্দ্রবাবু, আমার কি আস্তে দেরি হয়েছে?
চন্দ্র। (ঘড়ি দেখিয়া) না এখনও সময় হয় নি। অবলাকান্ত বাবু আমার ভাগ্নী নির্ম্মলা আজ আমাদের সভার সভ্য হয়েছেন।
শৈল। (নির্ম্মলার নিকট বসিয়া) দেখুন পুরুষরা স্বার্থপর, মেয়েদের কেবল নিজেদের সেবার জন্যই বিশেষ করে বন্ধ করে রাখ্তে চায়—চন্দ্রবাবু যে আপনাকে আমাদের সভার হিতের জন্যে দান করেছেন তাতে তাঁর মহত্ত্ব প্রকাশ পায়।
নির্ম্মলা। আমার মামার কাছে দেশের কাজ এবং নিজের কাজ একই! আমি যদি আপনাদের সভার কোন উপকার করতে পারি তাতে তাঁরই সেবা হবে।
শৈল। আপনি যে সৌভাগ্যক্রমে চন্দ্র বাবুকে ভাল করে জান্বার যোগ্যতা লাভ করেছেন এতে আপনি ধন্য।
নির্মলা। আমি ওঁকে জান্ব না ত কে জান্বে?
শৈল। আত্মীয় সব সময় আত্মীয়কে জানে না। আত্মীয়তায় ছোটকে বড় করে তোলে বটে, তেমনি বড়কেও ছোট করে আনে। চন্দ্রবাবুকে যে আপনি যথার্থভাবে জেনেছেন তাতে আপনার ক্ষমতা প্রকাশ পায়।
নির্ম্মলা। কিন্তু আমার মামাকে যথার্থভাবে জানা খুব সহজ, ওঁর মধ্যে এমন একটি স্বচ্ছতা আছে।
শৈল। দেখুন সে ত ওঁকে ঠিক মত জানা শক্ত। দুর্য্যোধন স্ফটিকের দেয়ালকে দেয়াল বলে দেখতেই পান নি। সরল স্বচ্ছতার মহত্ত্ব কি সকলে বুঝতে পারে? তাকে অবহেলা করে। আড়ম্বরেই লোকের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়।
নির্ম্মলা। আপনি ঠিক কথা বলেছেন। বাইরের লোকে আমার মামাকে কেউ চেনেই না। বাইরের লোকের মধ্যে এতদিন পরে আপনার কাছে মামার কথা শুনে আমার যে কি আনন্দ হচ্চে সে কি বল্ব!
শৈল। আপনার ভক্তিও আমাকে ঠিক সেই রকম আনন্দ দিচ্ছে।
চন্দ্র। { উভয়ের নিকটে আসিয়া) অবলাকান্ত বাবু, তোমাকে যে বইটি দিয়েছিলেম সেটা পড়েছ?
শৈল। পড়েছি, এবং তার থেকে সমস্ত নোট্ করে আপনার ব্যবহারের জন্যে প্রস্তুত করে রেখেছি।
চন্দ্র। আমার ভারি উপকার হবে,—আমি বড় খুসি হলুম অবলাকান্ত বাবু। পূর্ণ নিজে আমার কাছে ঐ বইটি চেয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু ওঁর শরীর ভাল ছিল না বলে কিছুই করে উঠতে পারেন নি। খাতাটি তোমার কাছে আছে?
শৈল। এনে দিচ্চি। (প্রস্থান)
রসিক। পূর্ণ বাবু আপনাকে কেমন ম্লান দেখছি অসুখ করচে কি?
পূর্ণ। না; কিছুই না! রসিক বাবু, যিনি গেলেন এঁরই নাম অবলাকান্ত?
রসিক। হাঁ।
পূর্ণ। আমার কাছে ওঁর ব্যবহারটা তেমন ভাল ঠেক্ছে না।
রসিক। অল্প বয়স কি না সেই জন্যে―
পূর্ণ। মহিলাদের সঙ্গে কি রকম আচরণ করা উচিত সে শিক্ষা ওঁর বিশেষ দরকার।
রসিক। আমিও সেটা লক্ষ্য করে দেখেছি মেয়েদের সঙ্গে উনি ঠিক পুরুষোচিত ব্যবহার করতে জানেন না—কেমন যেন গায়ে-পড়া ভাব! ওটা হয়ত অল্প বয়সের ধর্ম্ম।
পূর্ণ। আমাদেরও ত বয়স খুব প্রাচীন হয় নি, কিন্তু আমরা ত—
রসিক। তা ত দেখচি, আপনি খুব দূরে দূরেই থাকেন, কিন্তু উনি হয়ত সেটাকে ঠিক ভদ্রতা বলেই গ্রহণ করেন না। ওঁর হয়ত ভ্রম হচ্চে আপনি ওঁকে অগ্রাহ করেন।
পূর্ণ। বলেন কি রসিক বাবু? কি করব বলুন ত? আমি ত ভেবেই পাইনে কি কথা বলবার জন্যে আমি ওঁর কাছে অগ্রসর হতে পারি।
রসিক। ভাবতে গেলে ভেবে পাবেন না। না ভেবে অগ্রসর হবেন তার পরে কথা আপনি বেরিয়ে যাবে।
পূর্ণ। না রসিক বাবু, আমার একটা কথাও বেরয় না। কি বল্ব আপনিই বলুন না।
রসিক। এমন কোন কথাই বল্বেন না যাতে জগতে যুগান্তর উপস্থিত হবে। গিয়ে বলুন, আজকাল হঠাৎ কি রকম গরম পড়েছে।
পূর্ণ। তিনি যদি বলেন হাঁ গরম পড়েছে তার পরে কি বলব?
বিপিন ও শ্রীশের প্রবেশ।
শ্রীশ। (চন্দ্রবাবু ও নির্ম্মলাকে নমস্কার করিয়া নির্ম্মলার প্রতি) আপনাদের উৎসাহ ঘড়ির চেয়ে এগিয়ে চল্চে―এই দেখুন্ এখনো সাড়ে ছটা বাজে নি!
নির্ম্মলা। আজ আপনাদের সভায় আমার প্রথম দিন সেই জন্যে সভা বসবার পূর্ব্বেই এসেছি—প্রথম সভ্য হবার সঙ্কোচ ভাঙতে একটু সময় দরকার।
বিপিন। কিন্তু আপনার কাছে নিবেদন এই যে আমাদের কিছুমাত্র সঙ্কোচ করে চল্বেন না। আজ থেকে আপনি আমাদের ভার নিলেন ―লক্ষ্মীছাড়া পুরুষ সভ্যগুলিকে অনুগ্রহ করে দেখবেন শুন্বেন এবং হুকুম করে চালাবেন।
রসিক। যান্ পূর্ণবাবু, আপনিও একটা কথা বলুন গে।
পূর্ণ। কি বল্ব?
নির্ম্মলা। চালাবার ক্ষমতা আমার নেই।
শ্রীশ। আপনি কি আমাদের এতই অচল বলে মনে করেন?
বিপিন। লোহার চেয়ে অচল আর কি আছে কিন্তু আগুন ত লোহাকে চালাচ্চে― আমাদের মত ভারী জিনিষ গুলোকে চলনসই করে তুল্তে আপনাদের মত দীপ্তির দরকার।
রসিক। শুন্চেন ত পূর্ণবাবু?
পূর্ণ। আমি কি বল্ব বলুন না!
রসিক। বলুন লোহাকে চালাতে চাইলেও আগুন চাই, গলাতে চাইলেও আগুন চাই!
বিপিন। কি পূর্ণবাবু, রসিক বাবুর সঙ্গে পরিচয় হয়েছে?
পূর্ণ। হাঁ।
বিপিন। আপনার শরীর আজ ভাল আছে ত?
পূর্ণ। হাঁ।
বিপিন। অনেকক্ষণ এসেছেন না কি?
পূর্ণ। না।
বিপিন। দেখেছেন এবারে শীতটা ঘোড়দৌড়ের ঘোড়ার মত সজোরে দৌড়ে মাঘের মাঝামাঝি একেবারে খপকরে থেমে গেল।
পূর্ণ। হাঁ।
শ্রীশ। এই যে পূর্ণবাবু, গেলবারে আপনার শরীর খারাপ ছিল―এবারে বেশ ভাল বোধ হচ্চে ত?
পূর্ণ। হাঁ।
শ্রীশ। এতদিন কুমার সভার যে কি একটা মহৎ অভাব ছিল আজ ঘরের মধ্যে ঢুকেই তা বুঝতে পেরেছি;―সোনার মুকুটের মাঝখানটিতে কেবল একটি হীরে বসাবার অপেক্ষা ছিল—আজ সেইটি বসান হয়েছে কি বলেন পূর্ণবাবু!
পূর্ণ। আপনাদের মত এমন রচনাশক্তি আমার নেই—আমি এত বানিয়ে বানিয়ে কথা বাঁটতে পারিনে—বিশেষত মহিলাদের সম্বন্ধে।
শ্রীশ। আপনার অক্ষমতার কথা শুনে দুঃখিত হলেম পূর্ণবাবু― আশা করি ক্রমে উন্নতিলাভ কর্তে পারবেন।
বিপিন। (রসিককে জনান্তিকে টানিয়া) দুই বীর পুরুষে যুদ্ধ চলুক এখন আসুন্ রসিকবাবু আপনার সঙ্গে দুই একটা কথা আছে!―দেখুন―সেই খাতা সম্বন্ধে আর কোন কথা উঠেছিল?
রসিক। অপরাধ করা মানবের ধর্ম্ম আর ক্ষমা করা দেবীর―সে কথাটা আমি প্রসঙ্গক্রমে তুলেছিলেম―
বিপিন। তাতে কি বল্লেন?
রসিক। কিছু না বলে বিদ্যুতের মত চলে গেলেন।
বিপিন। চলে গেলেন?
রসিক। কিন্তু সে বিদ্যুতে বজ্র ছিল না।
বিপিন। গর্জ্জন?
রসিক। তাও ছিল না।
বিপিন। তবে?
রসিক। এক প্রান্তে কিংবা অন্যপ্রান্তে একটু হয়ত বর্ষণের আভাস ছিল।
বিপিন। সেটুকুর অর্থ?
রসিক। কি জানি মহাশয়! অর্থও থাক্তে পারে অনর্থও থাক্তে পারে!
বিপিন। রসিকবাবু আপনি কি বলেন আমি কিছু বুঝতে পারিনে!
রসিক। কি করে বুঝবেন―ভারি শক্ত কথা!
শ্রীশ। (নিকটে আসিয়া) কি কথা শক্ত মশায়?
রসিক। এই বৃষ্টি বজ্রবিদ্যুতের কথা!
শ্রীশ। ওহে বিপিন, তার চেয়ে শক্ত কথা যদি শুনতে চাও তা হলে পূর্ণর কাছে যাও!
বিপিন। শক্ত কথা সম্বন্ধে আমার খুব বেশী সখ নেই ভাই।
শ্রীশ। যুদ্ধ করার চেয়ে সন্ধি করার বিদ্যেটা ঢের বেশী দুরূহ―সেটা তোমার আসে। দোহাই তোমার, পূর্ণকে একটু ঠাণ্ডা করে এসগে। আমি বরঞ্চ ততক্ষণ রসিকবাবুর সঙ্গে বৃষ্টিবজ্রবিদ্যুতের আলোচনা করে নিই। (বিপিনের প্রস্থান) রসিকবাবু, ঐ যে সেদিন আপনি যাঁর নাম নৃপবালা বল্লেন, তিনি― তিনি—তাঁর সম্বন্ধে বিস্তারিত করে কিছু বলুন। সেদিন চকিতের মধ্যে তাঁর মুখে এমন একটি স্নিগ্ধভাব দেখেছি, তাঁর সম্বন্ধে কৌতুহল কিছুতেই থামাতে পারচিনে।
রসিক। বিস্তারিত করে বল্লে কৌতূহল আরো বেড়ে যাবে। এ রকম কৌতূহল “হবিষা কৃষ্ণবর্ত্মেব ভূয় এবাভিবর্দ্ধতে”। আমি ত তাঁকে এতকাল ধরে জেনে আস্চি, কিন্তু সেই কোমল হৃদয়ের দ্বিগ্ন মধুর ভাবটি আমার কাছে “ক্ষণে ক্ষণে তন্নবতামুপৈতি”।
শ্রীশ। আচ্ছা তিনি—আমি সেই নৃপবালার কথা জিজ্ঞাসা করছি—
রসিক। সে আমি বেশ বুঝতেই পারচি।
শ্রীশ। তা তিনি— কি আর প্রশ্ন করব? তাঁর সম্বন্ধে যা হয় কিছু বলুন না—কাল কি বল্লেন, আজ সকালে কি করলেন যত সামান্য হোক্ আপনি বলুন আমি শুনি।
রসিক। (শ্রীশের হাত ধরিয়া) বড় খুসি হলুম শ্রীশ বাবু আপনি যথার্থ ভাবুক বটেন—আপনি তাঁকে কেবল চকিতের মধ্যে দেখে’ এটুকু কি করে ধরতে পারলেন যে তাঁর সম্বন্ধে তুচ্ছ কিছুই নেই। তিনি যদি বলেন, রসিক দা, ঐ কেরোসিনের বাতিটা একটুখানি উস্কে দাও, আমার মনে হয় যেন একটা নতুন কথা শুন্লেম—আদি কবির প্রথম অনুষ্টুপ ছন্দের মত। কি বল ব শ্রীশ বাবু, আপনি শুনলে হয় ত হাস্বেন, সে দিন ঘরে ঢুকে দেখি নৃপবালা ছুঁচের মুখে সূতো পরাচ্ছেন কোলের উপর বালিশের ওয়াড় পড়ে রয়েছে, আমার মনে হল এক আশ্চর্য্য দৃশ্য। কতবার কত দরজির দোকানের সামনে দিয়ে গেছি, কখনো মুখ তুলে দেখিনি কিন্তু―
শ্রীশ। আচ্ছা রসিকবাবু, তিনি নিজের হাতে ঘরের সমস্ত কাজ করেন?
শৈলের প্রবেশ।
শৈল। রসিকদার সঙ্গে কি পরামর্শ করচেন?
রসিক। কিছুই না, নিতান্ত সামান্য কথা নিয়ে আমাদের আলোচনা চল্চে, যত দূর তুচ্ছ হতে পারে।
চন্দ্র। সভা অধিবেশনের সময় হয়েছে আর বিলম্ব করা উচিত হয় না। পূর্ণবাবু, কৃষিবিদ্যালয় সম্বন্ধে আজ তুমি যে প্রস্তাব উত্থাপন করবে বলেছিলে সেটা আরম্ভ কর।
পূর্ণ। (দণ্ডায়মান হইয়া ঘড়ির চেন নাড়িতে নাড়িতে) আজ― আজ― (কাশি)
রসিক। (পার্শ্বে বসিয়া মৃদুস্বরে) আজ এই সভা―
পূর্ণ। আজ এই সভা―
রসিক। যে নূতন সৌন্দর্য্য এবং গৌরব লাভ করিয়াছে―
পূর্ণ। যে নুতন সৌন্দর্য্য এবং গৌরব লাভ করিয়াছে—
রসিক। প্রথমে তাহারই জন্য অভিনন্দন প্রকাশ না করিয়া থাকিতে পারিতেছি না।
পূর্ণ। প্রথমে তাহারই জন্য অভিনন্দন প্রকাশ না করিয়া থাকিতে পারিতেছি না।
রসিক। (মৃদু স্বরে) বলে যান পূর্ণবাবু!
পূর্ণ। তাহারই জন্য অভিনন্দন প্রকাশ না করিয়া থাকিতে পারিতেছি না।
রসিক। ভয় কি পূর্ণবাবু বলে যান্।
পূর্ণ। যে নূতন সৌন্দর্য এবং গৌরব—(কাশি) যে নূতন সৌন্দর্য্য (পুনরায় কাশি) অভিনন্দন―
রসিক। (উঠিয়া)―সভাপতিমশায়, আমার একটা নিবেদন আছে। আজ পূর্ণবাবু সকল সভ্যের পূর্ব্বেই সভায় উপস্থিত হয়েছেন। উনি অত্যন্ত অসুস্থ, তথাপি উৎসাহ সম্বরণ করতে পারেন নি। আজ আমাদের সভায় প্রথম অরুণোদয়, তাই দেখবার জন্যে পাখী প্রত্যুষেই নীড় পরিত্যাগ করে বেরিয়েছেন—কিন্তু দেহ রুগ্ন তাই পূর্ণহৃদয়ের আবেগ কণ্ঠে ব্যক্ত কর্বার শক্তি নেই—অতএব ওঁকে আজ আমাদের নিষ্কৃতি দান করতে হবে। এবং আজ নব প্রভাতের যে অরুণচ্ছটার স্তবগান করতে উনি উঠেছিলেন তাঁর কাছেও এই অবরুদ্ধকণ্ঠ ভক্তের হয়ে আমি মার্জ্জনা প্রার্থনা করি। পূর্ণবাবু, আজ বরঞ্চ আমাদের সভার কার্য্য বন্ধ থাকে সেও ভাল তথাপি বর্ত্তমান অবস্থায় আজ আপনাকে কোন প্রস্তাব উত্থাপন করতে দিতে পারিনে। সভাপতিমশায় ক্ষমা করবেন এবং আমাদের সভাকে যিনি আপন প্রভা দ্বারা অন্য সার্থকতা দান করতে এসেছেন ক্ষমা করা তাঁদের স্বজাতিসুলভ করুণ হৃদয়ের সহজ ধর্ম্ম।
চন্দ্র। আমি জানি, কিছুকাল থেকে পূর্ণবাবু ভাল নেই, এ অবস্থায় আমরা ওঁকে ক্লেশ দিতে পারি না। বিশেষতঃ অবলাকান্তবাবু ঘরে বসেই আমাদের সভার কাজ অনেকদূর অগ্রসর করে দিয়েছেন। এপর্য্যন্ত ভারতবর্ষীয় কৃষি সম্বন্ধে গবর্মেণ্ট থেকে যতগুলি রিপোর্ট বাহির হয়েছে সবগুলি আমি ওঁর কাছে দিয়েছিলেম—তার থেকে উনি, জমিতে সার দেওয়া সম্বন্ধীয় অংশটুকু সংক্ষেপে সঙ্কলন করে রেখেছেন—সেইটি অবলম্বন করে উনি সর্ব্বসাধারণের সুবোধ্য বাংলা ভাষায় একটি পুস্তিকা প্রণয়ন করতেও প্রতিশ্রুত হয়েছেন! ইনি যেরূপ উৎসাহ ও দক্ষতার সঙ্গে সভার কার্য্যে যোগদান করেছেন সে জন্য ওঁকে প্রচুর ধন্যবাদ দিয়ে অদ্যকার সভা আগামী রবিবার পর্য্যন্ত স্থগিত রাখা গেল। বিপিন বাবু য়ুরোপীয় ছাত্রাগার সকলের নিয়ম ও কার্য্যপ্রণালী সঙ্কলনের ভার নিয়েছিলেন এবং শ্রীশবাবু স্বেচ্ছাকৃত দানের দ্বারা লণ্ডন নগরে যত বিচিত্র লোক-হিতকর অনুষ্ঠান প্রবর্ত্তিত হয়েছে তার তালিকা সংগ্রহ ও তৎসম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ রচনায় প্রতিশ্রুত হয়েছিলেন, বোধ হয় এখনো তা সমাধা করতে পারেন নি। আমি একটি পরীক্ষায় প্রবৃত্ত আছি―সকলেই জানেন, আমাদের দেশের গরুর গাড়ি এমন ভাবে নির্ম্মিত যে তার পিছনে ভার পড়লেই গাড়ি উঠেপড়ে এবং গরুর গলায় ফাঁস লেগে যায় আবার কোন কারণে গরু যদি পড়ে যায় তবে বোঝাই শুদ্ধ গাড়ি তার ঘাড়ের উপর গিয়ে পড়ে—এরই প্রতিকার করবার জন্যে আমি উপায় উদ্ভাবনে ব্যস্ত আছি—কৃতকার্য্য হব বলে আশা করি। আমরা মুখে গোজাতি সম্বন্ধে দয়া প্রকাশ করি অথচ প্রত্যহ সেই গরুর সহস্র অনাবশ্যক কষ্ট নিতান্ত উদাসীন ভাবে নিরীক্ষণ করে থাকি―আমার কাছে এইরূপ মিথ্যা ও শূন্য ভাবুকতার অপেক্ষা লজ্জাকর ব্যাপার জগতে আর কিছুই নেই—আমাদের সভা থেকে যদি এর কোন প্রতিকার করতে পারি তবে আমাদের সভা ধন্য হবে। আমি রাত্রে গাড়োয়ান পল্লীতে গিয়ে গোরুর অবস্থা সম্বন্ধে আলোচনা করেছি―গোরুর প্রতি অনর্থক অত্যাচার যে স্বার্থ ও ধর্ম্ম উভয়ের বিরোধী হিন্দু গাড়োয়ানদের তা বোঝান নিতান্ত কঠিন বলে বোধ হয় না। এসম্বন্ধে আমি গাড়োয়ানদের মধ্যে একটা পঞ্চায়েৎ করবার চেষ্টায় প্রবৃত্ত আছি। ঐমতা নির্ম্মলা আকস্মিক অপঘাতের আশু চিকিৎসা এবং রোগীচর্য্যা সম্বন্ধে রামরতন ডাক্তার মহাশয়ের কাছ থেকে নিয়মিত উপদেশ লাভ করছেন ―ভদ্র লোকদের মধ্যে সেই শিক্ষা ব্যাপ্ত করবার জন্যে তিনি দুই একটি অন্তঃপুরে গিয়ে শিক্ষাদানে নিযুক্ত হয়েছেন। এইরূপে প্রত্যেক সভ্যের স্বতন্ত্র ও বিশেষ চেষ্টায় আমাদের এই ক্ষুদ্র কুমার সভা সাধারণের অজ্ঞাতসারে ক্রমশই বিচিত্র সফলতা লাভ করতে থাক্বে এ বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ নাই।
শ্রীশ। ওহে বিপিন, আমার কাজ ত আমি আরম্ভও করি নি।
বিপিন। আমারও ঠিক সেই অবস্থা।
শ্রীশ। কিন্তু করতে হবে।
বিপিন। আমাকেও করতে হবে।
শ্রীশ। কিছুদিন অন্য সমস্ত আলোচনা ত্যাগ না করলে চল্চে না।
বিপিন। আমিও তাই ভাবছি।
শ্রীশ। কিন্তু অবলাকান্ত বাবুকে ধন্য বলতে হবে—উনি যে কখন্ আপনার কাজটি করে যাচ্ছেন কিছু বোঝবার জো নেই।
বিপিন। তাই ত বড় আশ্চর্য্য! অথচ মনে হয় যেন ওঁর অন্যমনস্ক হবার বিশেষ কারণ আছে।
শ্রীশ। যাই ওঁর সঙ্গে একবার আলোচনা করে আসিগে।
(শৈলের নিকট গমন)
পূর্ণ। রসিকবাবু আপনাকে কি বলে ধন্যবাদ জানাব?
রসিক। কিছু বলবেন না, আমি এমনি বুঝে নেব। কিন্তু সকলে আমার মত নয় পূর্ণবাবু―আন্দাজে বুঝবে না, বলা কওয়ার দরকার।
পূর্ণ। আপনি আমার অন্তরের কথা বুঝে নিয়েছেন রসিকবাবু― আপনাকে পেয়ে আমি বেঁচে গেছি। আমার যা কথা তা মুখে উচ্চারণ করতেও সঙ্কোচ বোধ হয়। আপনি আমাকে পরামর্শ দিন কি করতে হবে।
রসিক। প্রথমে আপনি ওঁর কাছে গিয়ে যা-হয় একটা কিছু কথা আরম্ভ করে দিন।
পূর্ণ। ঐ দেখুন না, অবলাকান্তবাবু আবার ওঁর কাছে গিয়ে বসেচেন―
রসিক। তা হোক না, তিনি ত ওঁকে চারিদিকে ঘিরে দাঁড়ান নি। অবলাকান্তকে ত ব্যূহের মত ভেদ করে যেতে হবে না! আপনিও এক পাশে গিয়ে দাঁড়ান না!
পূর্ণ। আচ্ছা আমি দেখি!
শৈল। (নির্ম্মলার প্রতি) আমাকে এত করে বল্বেন না— আপনি আমার চেয়ে ঢের বেশী কাজ করচেন।―কিন্তু বেচারা পূর্ণবাবুর জন্যে আমার বড় দুঃখ হয়। আপনি আস্বেন বলেই উনি আজ বিশেষ উৎসাহ করে এসেছিলেন—অথচ সেটা ব্যক্ত করতে না পেরে উনি বোধ হয় অত্যন্ত বিমর্ষ হয়ে পড়েছেন। আপনি যদি ওঁকে―
নির্ম্মলা। আপনাদের অন্যান্য সভ্যদের থেকে আমাকে একটু বিশেষভাবে পৃথক্ করে দেখছেন বলে আমি বড় সঙ্কোচ বোধ করছি,― আমাকে সভ্য বলে আপনাদের মধ্যে গণ্য করবেন, মহিলা বলে স্বতন্ত্র করবেন না।
শৈল। আপনি যে মহিলা হয়ে জন্মেছেন সে সুবিধাটুকু আমাদের সভা ছাড়তে পারেন না। আপনি আমাদের সঙ্গে এক হয়ে গেলে যত কাজ হবে, আমাদের থেকে স্বতন্ত্র হলে তার চেয়ে বেশী কাজ হবে। যে লোক গুণের দ্বারা নৌকাকে অগ্রসর করে দেবে তাকে নৌকো থেকে কতকটা দুরে থাক্তে হবে। চন্দ্রবাবু আমাদের নৌকোর হাল ধরে আছেন তিনিও আমাদের থেকে কিছু দূরে এবং উচ্চে আছেন, আপনাকে গুণের দ্বারা আকর্ষণ কর্তে হবে সুতরাং আপনাকে পৃথক থাক্তে হবে। আমরা সব দাঁড়ির দলে বসে গেছি।
নির্ম্মলা। আপনাকেও কর্ম্মে এবং ভাবে এঁদের সকলের থেকে পৃথক্ বোধ হয়। এক দিন মাত্র দেখেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস হচ্চে এ সভার মধ্যে আপনিই আমার প্রধান সহায় হবেন।
শৈল। সেত আমার সৌভাগ্য! এই যে আসুন পূর্ণবাবু! আমরা আপনার কথাই বল্ছিলাম। বসুন।
শ্রীশ। অবলাকান্তবাবু আসুন, আপনার সঙ্গে অনেক কথা বল্বার আছে। (জনান্তিকে লইয়া) আজ সভার পুরাতন সভ্য তিনটিকে আপনারা দুজনে লজ্জা দিয়েছেন। তা ঠিক হয়েছে—পুরাতনের মধ্যে প্রাণসঞ্চার করবার জন্যই নূতনের প্রয়োজন।
শৈল। আবার নূতন চালা কাঠে আগুন জ্বালাবার জন্যে পুরাতন ধরা কাঠের দরকার।
শ্রীশ। আচ্ছা সে বিচার পরে হবে। কিন্তু আমার সেই রুমালটি? সেটি হরণ করে আমার পরকাল খুইয়েছি আবার রুমালটিও খোয়াতে পারিনে! (পকেট হইতে বাহির করিয়া) এই আমি এক ডজন রেসমের রুমাল এনেছি, এই বদল করে নিতে হবে! এ যে তার উচিত মূল্য তা বল্তে পারিনে—তার উপযুক্ত মূল্য দিতে গেলে চীন জাপান উজাড় করে দিতে হয়।
শৈল। মশায়, এছলনাটুকু বোঝ্বার মত বুদ্ধি বিধাতা আমাকে দিয়াছেন। এ উপহার আমার জন্যে আসেও নি—যাঁর রুমাল হরণ করেছেন আমাকে উপলক্ষ করে এগুলি―
শ্রীশ। অবলাকান্তবাবু, ভগবান্ বুদ্ধি আপনাকে যথেষ্ট দিয়াছেন দেখ্তে পাচ্ছি কিন্তু দয়ার ভাগটা কিছু যেন কম বোধ হচ্চে― হতভাগ্যকে রুমালটি ফিরিয়ে দিলেই সেই কলঙ্কটুকু একেবারে দূর হয়।
শৈল। আচ্ছা আমি দয়ার পরিচয় দিচ্ছি—কিন্তু আপনি সভার জন্য যে প্রবন্ধ লিখ্তে প্রতিশ্রুত সেটা লিখে দেওয়া চাই।
শ্রীশ। নিশ্চয় দেব―রুমালটা ফিরে পেলেই কাজে মন দিতে পার্ব —তখন অন্য সন্ধান ছেড়ে কেবল সত্যানুসন্ধান কর্তে থাক্ব।
(ঘরের অন্যত্র) বিপিন। বুঝেছেন রসিকবাবু আমি তাঁর গানের নির্ব্বাচন চাতুরী দেখে আশ্চর্য্য হয়ে গেছি। গান যে তৈরি করেছে তার কবিত্ব থাক্তে পারে কিন্তু এই গানের নির্ব্বাচনে যে কবিত্ব প্রকাশ পেয়েছে তার মধ্যে ভারি একটি সৌকুমার্য্য আছে।
রসিক। ঠিক বলেছেন—নির্ব্বাচনের ক্ষমতাইত ক্ষমতা! লতায় ফুলত আপনি ফোটে, কিন্তু যে লোক মালা গাঁথে নৈপুণ্য এবং সুরুচিত তারি!
বিপিন। আপনার ও গানটা মনে আছে?
তরী আমার হঠাৎ ডুবে যায়
কোন্ পাথারে কোন্ পাষাণের দায়!
নবীন তরী নতুন চলে,
দিইনি পাড়ি অগাধ জলে,
বাহি তারে খেলার ছলে কিনার কিনারায়!
তরী আমার হঠাৎ ডুবে যায়!
ভেসে ছিল স্রোতের ভরে
একা ছিলেম কর্ণ ধরে
লেগে ছিল পালের পরে মধুর মৃদু বায়।
সুখে ছিলেম আপন মনে,
মেঘ ছিল না গগন কোণে;
লাগ্বে তরী কুসুম বনে ছিলাম সে আশায়।
তরী আমার হঠাৎ ডুবে যায়!
রসিক। যাক্ ডুবে, কি বলেন বিপিনবাবু!
বিপিন। যাক্গে! কিন্তু কোথায় ডুব্ল তার একটু ঠিকানা রাখা চাই। আচ্ছা রসিকবাবু এ গানটা তিনি কেন খাতায় লিখে রাখ্লেন?
রসিক। স্ত্রী-হৃদয়ের রহস্য বিধাতা বোঝেন না এই রকম একটা প্রবাদ আছে, রসিক বাবুত তুচ্ছ।
শ্রীশ। (নিকটে আসিয়া) বিপিন, তুমি চন্দ্র বাবুর কাছে একবার যাও! বাস্তবিক, আমাদের কর্ত্তব্যে আমরা ঢিলে দিয়েছি—ওঁর সঙ্গে একটু আলোচনা করলে উনি খুসি হবেন।
বিপিন। আচ্ছা। (প্রস্থান)
শ্রীশ। হাঁ, আপনি সেই যে শেলাইয়ের কথা বল্ছিলেন―উনি বুঝি নিজের হাতে সমস্ত গৃহ কর্ম্ম করেন?
রসিক। সমস্তই।
শ্রীশ। আপনি বুঝি সে দিন গিয়ে দেখ্লেন তাঁর কোলে বালিশের ওয়াড়গুলো পড়ে রয়েছে আর তিনি―
রসিক। মাথা নীচু করে ছুঁচে সূতো পরাচ্ছিলেন।
শ্রীশ। ছুঁচে সূতো পরাচ্ছিলেন। তখন স্নান করে এসেছেন বুঝি?
রসিক। বেলা তখন তিনটে হবে।
শ্রীশ। বেলা তিনটে। তিনি বুঝি তাঁর খাটের উপর বসে―
রসিক। না খাটে নয়—বারান্দার উপর মাদুর বিছিয়ে―
শ্রীশ। বারান্দায় মাদুর বিছিয়ে বসে ছুঁচে সূতো পরাচ্ছিলেন-
রসিক। হাঁ ছুঁচে সুতো পরাচ্ছিলেন। (স্বগত) আর ত পারা যায় না।
শ্রীশ। আমি যেন ছবির মত স্পষ্ট দেখতে পাচ্চি―পা দুটি ছড়ানো, মাথা নীচু, খোলা চুল মুখের উপর এসে পড়েছে—বিকেল বেলার আলো―
বিপিন। (নিকটে আসিয়া) চন্দ্রবাবু তোমার সঙ্গে তোমার সেই প্রবন্ধটা সম্বন্ধে কথা কইতে চান। (শ্রীশের প্রস্থান) রসিক বাবু।
রসিক। (স্বগত) আর কত বক্ব?
(অন্য প্রান্তে) নির্ম্মলা। (পূর্ণর প্রতি) আপনার শরীর আজ বুঝি তেমন ভাল নেই।
পূর্ণ। না, বেশ আছে—হাঁ, একটু ইয়ে হয়েছে বটে—বিশেষ কিছু নয়—তবু একটু ইয়ে বই কি―তেমন বেশ—(কাশি) আপনার শরীর বেশ ভাল আছে?
নির্ম্মলা। হাঁ।
পূর্ণ। আপনি—জিজ্ঞাসা করছিলুম যে আপনি― আপনি আপনার ইয়ে কি রকম বোধ হয় ঐ যে—মিল্টনের আরিয়োপ্যাজিটিকা—ওটা কিনা আমাদের এম, এ, কোর্সে আছে ওটা আপনার বেশ ইয়ে বোধ হয় না?
নির্ম্মলা। আমি ওটা পড়িনি।
পূর্ণ। পড়েন নি? (নিস্তব্ধ) ইয়ে হয়েছে—আপনি—এবারে কি রকম গরম পড়েছে—আমি একবার রসিকবাবু—রসিকবাবুর সঙ্গে আমার একটু দরকার আছে। (নির্ম্মলার নিকট হইতে প্রস্থান)
(ঘরের অন্যত্র) বিপিন। রসিকবাবু, আচ্ছা, আপনার কি মনে হয় ওগানটা তিনি বিশেষ কিছু মনে করে লিখেছেন।
রসিক। হতেও পারে! আপনি আমাকে সুদ্ধ ধোঁকা লাগিয়ে দিলেন যে! পূর্ব্বে ওটা ভাবিনি।
বিপিন। “তরী আমার হঠাৎ ডুবে যায় কোন্ পাথারে কোন্ পাষাণের ঘায়!”
আচ্ছা রসিক বাবু এখানে তরী বল্তে ঠিক কি বোঝাচ্চে?
রসিক। হৃদয় বোঝাচ্চে তার আর সন্দেহ নেই। তবে ঐ পাথারটা কোথায় আর পাষাণটা কে সেইটেই ভাববার বিষয়!
পূর্ণ। (নিকটে আসিয়া) বিপিনবাবু, মাপ করবেন―রসিকবাবুর সঙ্গে আমার একটি কথা আছে—যদি―
বিপিন। বেশ, বলুন, আমি যাচ্চি।
পূর্ণ। আমার মত নির্ব্বোধ জগতে নেই রসিকবাবু!
রসিক। আপনার চেয়ে ঢের নির্ব্বোধ আছে যারা নিজেকে বুদ্ধিমান বলে জানে—যথা আমি।
পূর্ণ। একটু নিরালা পাই যদি আপনার সঙ্গে অনেক কথা আছে, সভা ভেঙে গেলে আজ রাত্রে একটু অবসর করতে পারেন?
রসিক। বেশ কথা।
পূর্ণ। আজ দিব্য জ্যোৎস্না আছে গোলদিঘির ধারে—কি বলেন?
রসিক। (স্বগত) কি সর্ব্বনাশ!
শ্রীশ। (নিকটে আসিয়া) ওঃ পূর্ণবাবু কথা কচ্চেন বুঝি। আচ্ছা এখন থাক্। রাত্রে আপনার অবসর হবে রসিকবাবু?
রসিক। তা হতে পারে।
শ্রীশ। তা হলে কালকের মত ―কি বলেন? কাল দেখ্লেন ত ঘরের চেয়ে পথে জমে ভাল।
রসিক। জমে বৈ কি! (স্বগত) সর্দ্দি জমে, কাশি জমে, গলার স্বর দইয়ের মত জমে যায় (শ্রীশের প্রস্থান)
পূর্ণ। আচ্ছা রসিকবাবু আপনি হলে কি বলে কথা আরম্ভ করতেন?
রসিক। হয় ত বলতুম—সেদিন বেলুন উড়ে ছিল আপনাদের বাড়ির ছাত থেকে দেখতে পেয়েছিলেন কি?
পূর্ণ। তিনি যদি বল্তেন হাঁ―
রসিক। আমি বলতুম, মনকে ওড়বার অধিকার দিয়াছেন বলেই ঈশ্বর মানুষের শরীরে পাখা দেন নি—শরীরকে বদ্ধ রেখে বিধাতা মনের আগ্রহ কেবল বাড়িয়ে দিয়েছেন―
পূর্ণ। বুঝেছি রসিকবাবু—চমৎকার—এর থেকে অনেক কথার সৃষ্টি হতে পারে।
বিপিন। (নিকটে আসিয়া) পূর্ণবাবুর সঙ্গে কথা হচ্চে। থাক্ তবে আমাদের সেই যে একটা কথা ছিল সেটা আজ রাত্রে হবে, কি বলেন?
রসিক। সেই ভাল।
বিপিন। জ্যোৎস্নায় রাস্তায় বেড়াতে বেড়াতে দিব্যি আরামে কি বলেন?
রসিক। খুব আরাম। (স্বগত) কিন্তু বেয়ারামটা তার পরে।
শৈল। (নির্ম্মলার প্রতি) তা বেশ, আপনি যদি ইচ্ছা করেন আমিও ঐ বিষয়টার আলোচনা করে দেখব। ডাক্তারী আমি অল্প অল্প চর্চ্চা করেছি―বেশী নয়—কিন্তু আমি যোগদান করলে আপনার যদি উৎসাহ হয় আমি প্রস্তুত আছি।
(অন্যত্র) পূর্ণ। (নিকটে আসিয়া) সে দিন বেলুন উড়েছিল আপনি কি ছাদের উপর থেকে দেখতে পেয়েছিলেন?
নির্মলা। বেলুন?
পূর্ণ। হাঁ ঐ বেলুন (সকলে নিরুত্তর) রসিকবাবু বলছিলেন আপনি বোধ হয় দেখে থাক্বেন—আমাকে মাপ করবেন আপনাদের আলোচনায় আমি ভঙ্গ দিলুম―আমি অত্যন্ত হতভাগ্য।