(১০)

 পথে বাহির হইয়াই শ্রীশ কহিল-ওহে বিপিন, আজ মাঘের শেষে প্রথম বসন্তের বাতাস দিয়েছে, জ্যোৎস্নাও দিব্যি, আজ যদি এখনি ঘুমতে কিম্বা পড়া মুখস্থ করতে যাওয়া যায় তাহলে দেবতারা ধিক্কার দেবেন।

বিপিন। তাঁদের ধিক্কার খুব সহজে সহ্য হয় কিন্তু ব্যামোর ধাক্কা কিম্বা―

 শ্রীশ। দেখ, ঐ জন্যে তোমার সঙ্গে আমার ঝগড়া হয়। আমি বেশ জানি দক্ষিণে হাওয়ায় তোমারও প্রাণটা চঞ্চল হয়, কিন্তু পাছে কেউ তোমাকে কবিত্বের অপবাদ দেয় বলে মলয় সমীরণটাকে একেবারেই আমল দিতে চাও না। এতে তোমার বাহাদুরীটা কি জিজ্ঞাসা করি? আমি তোমার কাছে আজ মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করছি, আমার ফুল ভাল লাগে, জ্যোৎস্না ভাল লাগে, দক্ষিণে হাওয়া ভাল লাগে―

 বিপিন। এবং―

 শ্রীশ। এবং যাহা কিছু ভাল লাগ্‌বার মত জিনিষ সবই ভাল লাগে।

 বিপিন। বিধাতা ত তোমাকে ভারি আশ্চর্য্য রকম ছাঁচে গড়েছেন দেখচি।

 শ্রীশ। তোমার ছাঁচ আরও আশ্চর্য্য। তোমার লাগে ভাল কিন্তু বল অন্য রকম—আমার সেই শোবার ঘরের ঘড়িটার মত—সে চলে ঠিক কিন্তু বাজে ভুল।

 বিপিন। কিন্তু শ্রীশ, তোমার যদি সব মনোরম জিনিষই মনোহর লাগতে লাগ্‌ল তাহলে ত আসন্ন বিপদ।

 শ্রীশ। আমি ত কিছুই বিপদ বোধ করিনে।

 বিপিন। সেই লক্ষণটাই ত সব চেয়ে খারাপ। রোগের যখন বেদনা বোধ চলে যায় তখন আর চিকিৎসার রাস্তা থাকে না। আমি ভাই স্পষ্টই কবুল করচি, স্ত্রীজাতির একটা আকর্ষণ আছে―চিরকুমার সভা যদি সেই আকর্ষণ এড়াতে চান তাহলে তাঁকে খুব তফাৎ দিয়ে যেতে হবে।

 শ্রীশ। ভুল, ভুল, ভয়ানক ভুল! তুমি তফাতে থাক্‌লে কি হবে, তাঁরা ত তফাতে থাকেন না। সংসার রক্ষার জন্যে বিধাতাকে এত নারী সৃষ্টি করতে হয়েছে যে, তাঁদের এড়িয়ে চলা অসম্ভব। অতএব কৌমার্য্য যদি রক্ষা করতে চাও তাহলে নারীজাতিকে অল্পে অল্পে সইয়ে নিতে হবে। ঐযে স্ত্রীসভ্য নেবার নিয়ম হয়েছে এতদিন পরে কুমারসভা চিরস্থায়ী হবার উপায় অবলম্বন করেছে। কিন্তু কেবল একটিমাত্র মহিলা হলে চলবে না বিপিন, অনেকগুলি স্ত্রীসভ্য চাই। বদ্ধ ঘরের একটি জানলা খুলে ঠাণ্ডা লাগালে সর্দ্দি ধরে, খোলা হাওয়ায় থাক্‌লে সে বিপদ নেই।

 বিপিন। আমি তোমার ঐ খোলা হাওয়া বদ্ধ হাওয়া বুঝিনে ভাই! যার সর্দ্দির ধাত তাকে সর্দ্দি থেকে রক্ষা কর্‌তে দেবতা মনুষ্য কেউ পারে না।

 শ্রীশ। তোমার ধাত কি বল্‌চে হে?

 বিপিন। সে কথা খোলসা করে বল্লেই বুঝতে পারবে তোমার ধাতের সঙ্গে তার চমৎকার মিল আছে। নাড়ীটা যে সব সময়ে ঠিক চিরকুমারের নাড়ীর মত চলে তা জাঁক করে বল্‌তে পারব না।

 শ্রীশ। ঐটে তোমার আর একটা, ভুল! চিরকুমারের নাড়ীর উপরে উনপঞ্চাশ পবনের নৃত্য হতে দাও—কোন ভয় নেই—বাঁধাবাঁধি চাপাচাপি কোরো না। আমাদের মত ব্রত যাদের, তারা কি হৃদয়টিকে তুলো দিয়ে মুড়ে রাখতে পারে? তাকে অশ্বমেধ যজ্ঞের ঘোড়ার মত ছেড়ে দাও, যে তাকে বাঁধবে তার সঙ্গে লড়াই কর!

 বিপিন। ও কেহে! পূর্ণ দেখ্‌চি। ও বেচারার এ গলি থেকে আর বেরবার জো নেই! ঐ বীরপুরুষের অশ্বমেধের ঘোড়াটি বেজায় খোঁড়াচ্চে। ওকে একবার ডাক দেব?

 শ্রীশ। ডাক। ও কিন্তু আমাদেরই দুজনকে অন্বেষণ করে গলিতে গলিতে ঘুরচে বলে বোধ হচ্ছে না।

 বিপিন। পূর্ণবাবু, খবর কি?

 পূর্ণ। অত্যন্ত পুরোনো। কাল পর্শু যে খবর চল্‌ছিল আজও তাই চল্‌চে।

 শ্রীশ। কাল পর্শু শীতের হাওয়া বচ্ছিল, আজ বসন্তের হাওয়া দিয়েছে―এতে দুটো একটা নতুন খবরের আশা করা যেতে পারে।

 পূর্ণ। দক্ষিণের হাওয়ায় যে সব খবরের সৃষ্টি হয়, কুমার সভার খবরের কাগজে তার স্থান নেই। তপোবনে এক দিন অকাল বসন্তের হাওয়া দিয়েছিল তাই নিয়ে কালিদাসের কুমার সম্ভব কাব্য রচনা হয়েছে—আমাদের কপালগুণে বসন্তের হাওয়ায় কুমার-অসম্ভব কাব্য হয়ে দাঁড়ায়।

 বিপিন। হয় ত হোক্ না পূর্ণ বাবু—সে কাব্যে যে দেবতা দগ্ধ হয়েছিলেন এ কাব্যে তাঁকে পুনর্জীবন দেওয়া যাক্।

 পূর্ণ। এ কাব্যে চিরকুমার সভা দগ্ধ হোক্! যে দেবতা জ্বলেছিলেন তিনি জ্বালান্! না, আমি ঠাট্টা করচিনে শ্রীশ বাবু আমাদের চিরকুমার সভাটি একটি আস্ত জতুগৃহ বিশেষ। আগুণ লাগ্‌লে রক্ষে নেই। তার চেয়ে বিবাহিত সভা স্থাপন কর স্ত্রীজাতি সম্বন্ধে নিরাপদ থাক্‌বে। যে ইঁট পাঁজায় পুড়েছে তা’ দিয়ে ঘর তৈরি করলে আর পোড়বার ভয় থাকে না হে!

 শ্রীশ। যে সে লোক বিবাহ করে করে বিবাহ জিনিষটা মাটি হয়ে গেছে পূর্ণ বাবু। সেই জন্যেইত কুমার সভা। আমার যত দিন প্রাণ আছে ততদিন এ সভায় প্রজাপতির প্রবেশ নিষেধ।

 বিপিন। পঞ্চশর?

 শ্রীশ। আসুন্ তিনি। একবার তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়ে গেলে, বাস্, আর ভয় নেই।

 পূর্ণ। দেখো শ্রীশবাবু।

 শ্রীশ। দেখব আর কি। তাঁকে খুঁজে বেড়াচ্ছি! এক চোট দীর্ঘ নিশ্বাস ফেল্‌ব, কবিতা আওড়াব, কনকবলয়ভ্রংশরিক্তপ্রকোষ্ঠ হয়ে যাব, তবে রীতিমত সন্ন্যাসী হতে পারব। আমাদের কবি লিখেছেন―

নিশি না পোহাতে জীবন প্রদীপ
জ্বালাইয়া যাও প্রিয়া
তোমার অনল দিয়া!
কবে যাবে তুমি সমুখের পথে
দীপ্ত শিখাটি বাহি
আছি তাই পথ চাহি!
পুড়িবে বলিয়া রয়েছে আশায়
আমার নীরব হিয়া
আপন আঁধার নিয়া!
নিশি না পোহাতে জীবন প্রদীপ
জ্বালাইয়া যাও প্রিয়া!

 পূর্ণ। ওহে শ্রীশ বাবু, তোমার কবিটি ত মন্দ লেখেনি!―

নিশি না পোহাতে জীবন প্রদীপ
জ্বালাইয়া যাও প্রিয়া!

 ঘরটি সাজান রয়েছে- থালায় মালা, পালঙ্কে পুষ্পশয্যা, কেবল জীবন প্রদীপটি জ্বলচে না, সন্ধ্যা ক্রমে রাত্রি হতে চল্‌ল। বাঃ দিব্যি লিখেছে! কোন্ বইটাতে আছে বল দেখি?

 শ্রীশ। বইটার নাম আবাহন।

 পূর্ণ। নামটাও বেছে বেছে দিয়েছে ভাল! (আপন মনে)―

নিশি না পোহাতে জীবন প্রদীপ
জ্বালাইয়া যাও প্রিয়া

(দীর্ঘনিশ্বাস)

 তোমরা কি বাড়ির দিকে চলেচ?

 শ্রীশ। বাড়ি কোন্ দিকে ভুলে গেছি ভাই!

 পূর্ণ। আজ পথ ভোলবার মতই রাতটা হয়েছে বটে! কি বল বিপিন বাবু!

 শ্রীশ। বিপিন বাবু এ সকল বিষয়ে কোন কথাই কন না, পাছে ওঁর ভিতরকার কবিত্ব ধরা পড়ে। কৃপণ যে জিনিষটার বেশি আদর করে সেইটেকেই মাটির নীচে পুঁতে রাখে।

 বিপিন। অস্থানে বাজে খরচ করতে চাইনে ভাই, স্থান খুঁজে বেড়াচ্চি। মরতে হলে একেবারে গঙ্গার ঘাটে গিয়া মরাই ভাল!

 পূর্ণ। এ ত উত্তম কথা, শাস্ত্রসঙ্গত কথা! বিপিনবাবু একেবারে অন্তিমকালের জন্যে কবিত্ব সঞ্চয় করে রাখ্‌চেন, যখন অন্যে বাক্য কবেন কিন্তু উনি রবেন নিরুত্তর! আশীর্ব্বাদ করি আগের সেই বাক্যগুলি যেন মধুমাখা হয়―

 শ্রীশ। এবং তার সঙ্গে যেন কিঞ্চিৎ ঝালের সম্পর্কও থাকে―

 বিপিন। এবং বাক্যবর্ষণ করেই যেন মুখের সমস্ত কর্ত্তব্য নিঃশেষ না হয়,―

 পূর্ণ। বাক্যের বিরামস্থলগুলি যেন বাক্যের চেয়ে মধুমত্তর হয়ে ওঠে!

 শ্রীশ। সে দিন নিদ্রা যেন না আসে―

 পূর্ণ। রাত্রি যেন না যায়―

 বিপিন। চন্দ্র যেন পূর্ণচন্দ্র হয়—

 পূর্ণ। বিপিন যেন বসন্তের ফুলে প্রফুল্ল হয়ে উঠে―

 শ্রীশ। এবং হতভাগ্য শ্রীশ যেন কুঞ্জদ্বারের কাছে এসে উঁকি ঝুঁকি না মারে।

 পূর্ণ। দুর হোক্ গে শ্রীশ বাবু, তোমার সেই আবাহন থেকে আর একটা কিছু কবিতা আওড়াও। চমৎকার লিখেছে হে।

নিশি না পোহাতে জীবন প্রদীপ
জ্বালাইয়া যাও প্রিয়া!

 আহা! একটি জীবন প্রদীপের শিখাটুকু আরেকটি জীবন প্রদীপের মুখের কাছে কেবল একটু ঠেকিয়ে গেলেই হয়, বাস্, আর কিছুই নয়— দুটি কোমল অঙ্গুলি দিয়ে প্রদীপখানি একটু হেলিয়ে একটু ছুঁইয়ে যাওয়া তার পরেই চকিতের মধ্যে সমস্ত আলোকিত! (আপন মনে) নিশি না পোহাতে (ইত্যাদি)।

 শ্রীশ। পূর্ণ বাবু, যাও কোথায়?

 পূর্ণ। চন্দ্রবাবুর বাসায় একখানা বই ফেলে এসেছি সেইটে খুঁজ্‌তে যাচ্চি।

 বিপিন। খুঁজ্‌লে পাবে ত? চন্দ্রবাবুর বাসা বড় এলোমেলো জায়গা―সেখানে যা হারায় সে আর পাওয়া যায় না।

(পূর্ণের প্রস্থান)

 শ্রীশ। (দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলিয়া) পূর্ণ বেশ আছে ভাই বিপিন!

 বিপিন। ভিতরকার বাষ্পের চাপে ওর মাথাটা সোডাওয়াটারের ছিপির মত একেবারে টপ্‌করে উড়ে না যায়।

 শ্রীশ। যায় ত যাক্ না! কোনমতে লোহার তার এঁটে মাথাটাকে ঠিক জায়গায় ধরে রাখাই কি জীবনের চরম পুরুষার্থ? মাঝে মাঝে মাথার বেঠিক না হলে রাতদিন মুটের বোঝার মত মাথাটাকে বয়ে বেড়াচ্চি কেন? দাও ভাই তার কেটে, একবার উড়ুক!―সেদিন তোমাকে শোনাচ্ছিলুম―

ওরে সাবধানী পথিক, বারেক
পথ ভুলে মর্ ফিরে!
খোলা-আঁখি দুটো অন্ধ করে’দে
আকুল আঁখির নীরে!
সে ভোলা-পথের প্রান্তে রয়েছে
হারান’-হিয়ার কুঞ্জ;
ঝরে’ পড়ে’ আছে কাঁটাতরুতলে
রক্ত কুসুম পুঞ্জ;
সেথা দুই বেলা ভাঙা-গড়া খেলা
অকূল সিন্ধুতীরে!
ওরে সাবধানী পথিক, বারেক
পথ ভুলে’ মর ফিরে!

 বিপিন। আজ কাল তুমি খুব কবিতা পড়তে আরম্ভ করেছ, শীঘ্রই একটা মুষ্কিলে পড়বে দেখচি!

 শ্রীশ। যে লোক ইচ্ছে করে মুষ্কিলের রাস্তা খুঁজে বেড়াচ্চে তার জন্যে কেউ ভেবোনা। মুষ্কিলকে এড়িয়ে চল্‌তে গিয়ে হঠাৎ মুষ্কিলের মধ্যে পা ফেলেই বিপদ। আসুন্, আসুন্ রসিকবাবু রাত্রে পথে বেরিয়েছেন যে?

(রসিকের প্রবেশ)।

রসিক। আমার রাতই বা কি, আর দিনই বা কি!

বরমসৌ দিবসো ন পুনর্নিশা,
ননু নিশৈব বরং ন পুনর্দিনম্।
উভয় মেত দুপৈত্বথবা ক্ষয়ং
প্রিয়জনেন ন যত্র সমাগমঃ!

 শ্রীশ। অস্যার্থঃ?

 রসিক। অস্যার্থ হচ্ছে—

আসে ত আসুক্ রাতি, আসুক্ বা দিবা,
যায় যদি যাক্ নিরবধি!
তাহাদের যাতায়াতে আসে যায় কিবা
প্রিয় মোর নাহি আসে যদি!

 অনেক গুলো দিন রাত এ পর্য্যন্ত এসেছে এবং গেছে কিন্তু তিনি আজ পর্য্যন্ত এসে পৌঁছলেন না—তাই, দিনই বলুন্ আর রাতই বলুন ও দুটোর পরে আমার আর কিছুমাত্র শ্রদ্ধা নেই!

 শ্রীশ। আচ্ছা রসিক বাবু, প্রিয়জন এখনি যদি হঠাৎ এসে পড়েন?

 রসিক। তাহলে আমার দিকে তাকাবেন না, তোমাদের দুজনের মধ্যে একজনের ভাগেই পড়বেন।

 শ্রীশ। তা’হলে তদ্দণ্ডেই তিনি অরসিক বলে প্রমাণ হয়ে যাবেন।

 রসিক। এবং পরদণ্ডেই পরমানন্দে কালযাপন করতে থাক্‌বেন। তা আমি ঈর্ষ্যা করতে চাইনে শ্রীশবাবু! আমার ভাগ্যে যিনি আস্‌তে বহ বিলম্ব করলেন, আমি তাঁকে তোমাদের উদ্দেশেই উৎসর্গ করলুম। দেবি, তোমার বরমাল্য গেঁথে আন! আজ বসন্তের শুক্ল রজনী, আজ অভিসারে এস!—

মন্দং নিধেহি চরণৌ, পরিধেহি নীলং
বাসঃ, পিধেহি বলয়াবলিমঞ্চলেন!
মা জল্প সাহসিনি, শারদচন্দ্রকান্ত
দস্তাংশবস্তব তমাংসি সমাপয়ন্তি।
ধীরে ধীরে চল তন্বি, পর নীলাম্বর,
অঞ্চলে বাঁধিয়া রাখ কঙ্কণ মুখর;
কথাটি কোয়ো না, তব দন্ত অংশুরুচি
পথের তিমির রাশি পাছে ফেলে মুছি!

 শ্রীশ। রসিকবাবু আপনার ঝুলি যে একেবারে ভরা। এমন কত তর্জ্জমা করে রেখেছেন?

 রসিক। বিস্তর। লক্ষ্মীত এলেন না, কেবল বাণীকে নিয়েই দিন যাপন করছি।

 শ্রীশ। ওহে বিপিন, অভিসার ব্যাপারটা কল্পনা করতে বেশ লাগে।

 বিপিন। ওটা পুনর্ব্বার চালাবার জন্যে চিরকুমার সভায় একটা প্রস্তাব এনে দেখ না!

 শ্রীশ। কতকগুলো জিনিষ আছে যার আইডিয়াটা এত সুন্দর যে, সংসারে সেটা চালাতে সাহস হয় না। যে রাস্তায় অভিসার হতে পারে, যেখানে কামিনীদের হার থেকে মুক্তো ছিঁড়ে ছড়িয়ে পড়ে সে রাস্তা কি তোমার পটলডাঙ্গা ষ্ট্রীট? সে রাস্তা জগতে কোথাও নেই। বিরহিনীর হৃদয় নীলাম্বরী পরে’ মনোরাজ্যের পথে ঐ রকম করে বেরিয়ে থাকে— বক্ষের উপর থেকে মুক্তো ছিঁড়ে পড়ে চেয়েও দেখে না—সত্যিকার মুক্তো হলে কুড়িয়ে নিত! কি বলেন রসিকবাবু।

 রসিক। সে কথা মান্‌তেই হয়—অভিসারটা মনে মনেই ভাল, গাড়ি-ঘোড়ার রাস্তায় অত্যন্ত বেমানান্। আশীর্ব্বাদ করি শ্রীশবাবু, এই রকম বসন্তের জ্যোৎস্নারাত্রে কোন একটি জাল্‌না থেকে কোন এক রমণীর ব্যাকুল হৃদয় তোমার বাসার দিকে যেন অভিসারে যাত্রা করে।

 শ্রীশ। তা করবে রসিকবাবু আপনার আশীর্ব্বাদ ফলবে। আজকের হাওয়াতে সেই খবরটা আমি মনে মনে পাচ্চি। বিশে ডাকাত যেমন খবর দিয়ে ডাকাতী করত, আমার অজানা অভিসারিকা তেম্‌নি পূর্ব্বে হতেই আমাকে অভিসারের খবর পাঠিয়েছে।

 বিপিন। তোমার সেই ছাতের বারান্দাটা সাজিয়ে প্রস্তুত হয়ে থেকো।

 শ্রীশ। তা আমার সেই দক্ষিণের বারান্দায় একটি চৌকিতে আমি বসি, আর একটি চৌকি সাজান থাকে।

 বিপিন। সেটাতে আমি এসে বসি।

 শ্রীশ। মধ্বভাবে গুড়ং দদ্যাৎ, অভাবপক্ষে তোমাকে নিয়ে চলে।

 বিপিন। মধুময়ী যখন আস্‌বেন তখন হতভাগার ভাগ্যে লগুড়ং দদ্যাৎ।

 রসিক। (জনান্তিকে) শ্রীশবাবু, আপনার সেই দক্ষিণের ছাতটিকে চিহ্ণিত করে রাখবার জন্যে যে পতাকা ওড়ান আবশ্যক সেটা যে ফেলে এলেন!

 শ্রীশ। রুমালটা কি এখন চেষ্টা করলে পাওয়া যেতে পারবে?

 রসিক। চেষ্টা করতে দোষ কি?

 শ্রীশ। বিপিন, তুমি ভাই রসিকবাবুর সঙ্গে একটু কথাবার্ত্তা কও, আমি চট্ করে আচি।

(প্রস্থান)।

 বিপিন। আচ্ছা রসিক বাবু রাগ করবেন না,―

 রসিক। যদি বা করি আপনার ভয় করবার কোন কারণ নেই―আমি ভারি দুর্ব্বল।

 বিপিন। দুই একটা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করব আপনি বিরক্ত হবেন না।

 রসিক। আমার বয়স সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন নয় ত?

 বিপিন। না।

 রসিক। তবে জিজ্ঞাসা করুন ঠিক উত্তর পাবেন।

 বিপিন। সে দিন যে মহিলাটিকে দেখলাম, তিনি―

 রসিক। তিনি আলোচনার যোগ্য, আপনি সঙ্কোচ করবেন না বিপিনবাবু―তাঁর সম্বন্ধে আপনি যদি মাঝে মাঝে চিন্তা ও চর্চ্চা করে থাকেন তবে তাতে আপনার অসাধারণত্ব প্রমাণ হয় না—আমরাও ঠিক ঐ কাজ করে থাকি।

 বিপিন। অবলাকান্তবাবু বুঝি―

 রসিক। তাঁর কথা বল্‌বেন না—তাঁর মুখে অন্য কথা নেই।

 বিপিন। তিনি কি―

 রসিক। হাঁ তাই বটে! তবে হয়েছে কি, তিনি নৃপবালা নীরবালা দুজনের কাকে যে বেশি ভালবাসেন স্থির করে উঠতে পারেন না― তিনি দুজনের মধ্যে সর্ব্বদাই দোলায়মান।

 বিপিন। কিন্তু তাঁদের কেউ কি ওঁর প্রতি―

 রসিক। না, এমন ভাব নয় যে, ওঁকে বিবাহ করতে পারেন। সে হলে ত কোন গোলই ছিল না!

 বিপিন। তাই বুঝি অবলাকান্তবাবু কিছু―

 রসিক। কিছু যেন চিন্তান্বিত।

 বিপিন। শ্রীমতী নীরবালা বুঝি গান ভালবাসেন?

 রসিক। বাসেন বটে,—আপনার পকেটের মধ্যেই তার সাক্ষী আছে।

 বিপিন। (পকেট হইতে গানের খাতা বাহির করিয়া) এখানা নিয়ে আসা আমার অত্যন্ত অভদ্রতা হয়েছে―  রসিক। সে অভদ্রতা আপনি না করলে আমরা কেউ না কেউ কর্ত্তেম।

 বিপিন। আপনারা করলে তিনি মার্জ্জনা করতেন, কিন্তু আমি― বাস্তবিক অন্যায় হয়েছে, কিন্তু এখন ফিরিয়ে দিলেও ত—

 রসিক। মূল অন্যায়টা অন্যায়ই থেকে যায়।

 বিপিন। অতএব―

 রসিক। যাঁহাতক বাহান্ন তাঁহাতক তিপ্পান্ন। হরণে যে দোষটুকু হয়েছে রক্ষণে না হয় তাতে আরেকটু যোগ হল।

 বিপিন। খাতাটা সম্বন্ধে তিনি কি আপনাদের কাছে কিছু বলেছেন?

 রসিক। বলেছেন অল্পই, কিন্তু না বলেছেন অনেকটা।

 বিপিন। কি রকম?

 রসিক। লজ্জায় অনেকখানি লাল হয়ে উঠলেন।

 বিপিন। ছি ছি, সে লজ্জা আমারি।

 রসিক। আপনার লজ্জা তিনি ভাগ করে নিলেন, যেমন অরুণের লজ্জায় উষা রক্তিম।

 বিপিন। আমাকে আর পাগল করবেন না রসিক বাবু!

 রসিক। দলে টান্‌চি মশায়!

 বিপিন। (খাতা পুনর্ব্বার পকেটে পূরিয়া) ইংরিজিতে বলে দোষ করা মানবের ধর্ম্ম, ক্ষমা করা দেবতার।

 রসিক। আপনি তা হলে মানব ধর্ম্ম পালনটাই সাব্যস্ত করলেন!

 বিপিন। দেবীর ধর্ম্মে যা বলে তিনি তাই করবেন!

শ্রীশের প্রবেশ।

 শ্রীশ। অবলাকান্ত বাবুর সঙ্গে দেখা হল না।

 বিপিন। তুমি রাতারাতিই তাঁকে সন্ন্যাসী করতে চাও না কি?

 শ্রীশ। যা হোক্ অক্ষয়বাবুর কাছে বিদায় নিয়ে এলুম।

 বিপিন। বটে বটে, তাঁকে বলে আস্‌তে ভুলে গিয়েছিলেম—একবার তাঁর সঙ্গে দেখা করে আসিগে।

 রসিক। (জনান্তিকে) পুনর্ব্বার কিছু সংগ্রহের চেষ্টায় আছেন বুঝি? মানব ধর্ম্মটা ক্রমেই আপনাকে চেপে ধরচে!

বিপিনের প্রস্থান।

 শ্রীশ। রসিক বাবু, আপনার কাছে আমার একটা পরামর্শ আছে॥

 রসিক। পরামর্শ দেবার উপযুক্ত বয়স হয়েছে, বুদ্ধি না হতেও পারে।

 শ্রীশ। আপনাদের ওখানে সে দিন যে দুটি মহিলাকে দেখেছিলেম, তাঁদের দুজনকেই আমার সুন্দরী বলে বোধ হল।

 রসিক। আপনার বোধশক্তির দোষ দেওয়া যায় না। সকলেই ত ঐ এক কথাই বলে।

 শ্রীশ। তাঁদের সম্বন্ধে যদি মাঝে মাঝে আপনার সঙ্গে আলাপ আলোচনা করি তাহলে কি―

 রসিক। তাহলে আমি খুসি হব, আপনারও সেটা ভাল লাগ্‌তে পারে এবং তাঁদেরও বিশেষ ক্ষতি হবে না।

 শ্রীশ। কিছুমাত্র না। ঝিল্লি যদি নক্ষত্র সম্বন্ধে জল্পনা করে—

 রসিক। তাতে নক্ষত্রের নিদ্রার ব্যাঘাত হয় না।

 শ্রীশ। ঝিল্লিরই অনিদ্রা রোগ জন্মাতে পারে, কিন্তু তাতে আমার আপত্তি নেই।

 রসিক। আজ ত তাই বোধ হচ্চে।

 শ্রীশ। যাঁর রুমাল কুড়িয়ে পেয়েছিলুম তাঁর নামটি বল্‌তে হবে।

 রসিক। তাঁর নাম নৃপবালা।

 শ্রীশ। তিনি কোন্‌টি?

 রসিক। আপনিই আন্দাজ করে বলুন দেখি।

 শ্রীশ। যাঁর সেই লালরঙের রেশমের সাড়ি পরা ছিল?

 রসিক। বলে যান।

 শ্রীশ। যিনি লজ্জায় পালাতে চাচ্ছিলেন অথচ পালাতেও লজ্জা বোধ করছিলেন—তাই মুহূর্ত্তকালের মত হঠাৎ ত্রস্ত হরিণীর মত থম্‌কে দাঁড়িয়েছিলেন, সাম্‌নের দুই এক গুচ্ছ চুল প্রায় চোখের উপরে এসে পড়েছিল―চাবির-গোচ্ছা-বাঁধা চ্যুত অঞ্চলটি বাঁ হাতে তুলে ধরে যখন দ্রুতবেগে চলে গেলেন তখন তাঁর পিঠভরা কালোচুল আমার দৃষ্টিপথের উপর দিয়ে একটি কালো জ্যোতিষ্কের মত ছুটে নৃত্য করে চলে গেল।

 রসিক। এ ত নৃপবালাই বটে! পা দুখানি লজ্জিত, হাতখানি কুণ্ঠিত, চোখ দুটি ত্রস্ত, চুলগুলি কুঞ্চিত,―দুঃখের বিষয় হৃদয়টি দেখ্‌তে পান নি—সে যেন ফুলের ভিতরকার লুকোনো মধুটুকুর মত মধুর, শিশিরটুকুর মত করুণ।

 শ্রীশ। রসিকবাবু, আপনার মধ্যে এত যে কবিত্বরস সঞ্চিত হয়ে রয়েছে তার উৎস কোথায় এবার টের পেয়েছি।

রসিক। ধরা পড়েছি শ্রীশবাবু―

কবীন্দ্রাণাং চেতঃ কমলবনমালাতপরুচিং
ভজন্তে যে সন্তঃ কতিচিদরুণামেব ভবতীং
বিরিঞ্চিপ্রেয়স্যাস্তরুণতর শৃঙ্গারলহরীং
গভীরাভির্বাগ্‌ভির্বিদধতি সভারঞ্জনময়ীং।

 কবীন্দ্রদের চিত্তকমলবনমালার কিরণ লেখা যে তুমি, তোমাকে যারা লেশমাত্র ভজনা করে তারাই গভীর বাক্যদ্বারা সরস্বতীর সভারঞ্জনময়ী তরুণলীলালহরী প্রকাশ করতে পারে। আমি সেই কবিচিত্ত কমলবনের কিরণ লেখাটির পরিচয় পেয়েছি।

 শ্রীশ। আমিও অল্পদিন হল একটু পরিচয় পেয়েছি তার পর থেকে কবিত্ব আমার পক্ষে সহজ হয়ে এসেছে।

অক্ষয়ের প্রবেশ।

 অক্ষয়। (স্বগত) নাঃ, দুটি নবযুবকে মিলে আমাকে আর ঘরে তিষ্ঠতে দিলে না দেখচি। একটি ত গিয়ে চোরের মত আমার ঘরের মধ্যে হাত্‌ড়ে বেড়াচ্ছিলেন—ধরা পড়ে ভাল রকম জবাবদিহি কর্‌তে পার্‌লে না—শেষকালে আমাকে নিয়ে পড়ল। তার খানিক বাদেই দেখি দ্বিতীয় ব্যক্তিটি গিয়ে ঘরের বইগুলি নিয়ে উল্টেপাল্টে নিরীক্ষণ কর্‌চে। তফাৎ থেকে দেখেই পালিয়ে এসেছি। বেশ মনের মত করে চিঠিখানি যে লিখব এরা তা আর দিলে না। আহা চমৎকার জ্যোৎস্না হয়েছে!

 শ্রীশ। এই যে অক্ষয়বাবু!

 অক্ষয়। ঐরে! একটা ডাকাত ঘরের মধ্যে, আর একটা ডাকাত গলির মোড়ে? হা প্রিয়ে, তোমার ধ্যান থেকে যারা আমার মনকে বিক্ষিপ্ত করছে তারা মেনকা উর্ব্বশী রম্ভা হলে আমার কোন খেদ ছিল না—মনের মত ধ্যানভঙ্গও অক্ষয়ের অদৃষ্টে নেই—কলিকালে ইন্দ্রদেবের বয়স বেশি হয়ে বেরসিক হয়ে উঠেছে!

বিপিনের প্রবেশ।

 বিপিন। এই যে অক্ষয়বাবু, আপনাকেই খুঁজছিলুম।

 অক্ষয়। হায় হতভাগ্য, এমন রাত্রি কি আমাকে খোঁজ করে বেড়াবার জন্যই হয়েছিল?

In such a night as this,
When the sweet wind did gently kiss the trees
And they did make no noise, in such a night
Troilus methinks mounted the Troyan walls,
And sighed his soul toward the Grecian tents,
Where Cressid lay that night.

 শ্রীশ। In such a night আপনি কি করতে বেরিয়েছেন অক্ষয় বাবু?

 রসিক।

অপসরতি ন চক্ষুষো মৃগাক্ষী
রজনিরিয়িং চ ন যাতি নৈতি নিদ্রা!

চক্ষু পরে মৃগাক্ষীর চিত্র পানি ভাসে;
রজনীও নাহি যায়, নিদ্রাও না আসে!

 অক্ষয়বাবুর অবস্থা আমি জানি মশায়!

 অক্ষয়। তুমি কে হে?

 রসিক। আমি রসিকচন্দ্র—দুই দিকে দুই যুবককে আশ্রয় করে যৌবন সাগরে ভাসমান।

 এ বয়সে যৌবন সহ্য হবে না রসিক দাদা।

 রসিক। যৌবনটা কোন্ বয়সে যে সহ্য হয় তা ত জানিনে, ওটা অসহ্য ব্যাপার। শ্রীশবাবু আপনার কি রকম বোধ হচ্চে।

 শ্রীশ। এখনো সম্পূর্ণ বোধ কর্‌তে পারি নি।

 রসিক। আমার মত পরিণত বয়সের জন্যে অপেক্ষা করচেন বুঝি? অক্ষয় দা, আজ তোমাকে বড় অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে।

 অক্ষয়। তুমি ত অন্যমনস্ক দেখ্‌বেই, মনটা ঠিক তোমার দিকে নেই।—বিপিনবাবু তুমি আমাকে খুঁজছিলে বল্লে বটে, কিন্তু খুব যে জরুর দরকার আছে বলে বোধ হচ্চে না অতএব আমি এখন বিদায় হই, একটু বিশেষ কাজ আছে।

(প্রস্থান)

 রসিক। বিরহী চিঠি লিখ্‌তে চল্ল।

 শ্রীশ। অক্ষয়বাবু আছেন বেশ। রসিকবাবু, ওঁর স্ত্রীই বুঝি বড় বোন? তাঁর নাম?

 রসিক। পুরবালা।

 বিপিন। (নিকটে আসিয়া) কি নাম বল্লেন?

 রসিক। পুরবালা।

 বিপিন। তিনিই বুঝি সব চেয়ে বড়?

 রসিক। হাঁ

 বিপিন। সব ছোটটির নাম?

 রসিক। নীরবালা।

 শ্রীশ। আর নৃপবালা কোনটি?

 রসিক। তিনি নীরবালার বড়।

 শ্রীশ। তাহলে নৃপবালাই হলেন মেজ।

 বিপিন। আর নীরবালা ছোট।

 শ্রীশ। পুরবালার ছোট নৃপবালা।

 বিপিন। তাঁর ছোট হচ্চেন নীরবালা।

 রসিক (স্বগত) এরা ত নাম জপ কর্‌তে সুরু করলে। আমার মুষ্কিল। আর ত হিম সহ্য হবে না, পালাবার উপায় করা যাক্।

বনমালীর প্রবেশ।

 বন। এই যে আপনারা এখানে! আমি আপনাদের বাড়িতে গিয়েছিলুম।

 শ্রীশ। এইবার আপনি এখানে থাকুন আমরা বাড়ি যাই!

 বন। আপনারা সর্ব্বদাই ব্যস্ত দেখ্‌তে পাই।

 বিপিন। তা, আপনি আমাদের কখনো সুস্থ দেখেন নি—একটু বিশেষ ব্যস্ত হয়েই পড়ি।

 বন। পাঁচ মিনিট যদি দাঁড়ান।

 শ্রীশ। রসিকবাবু, একটু ঠাণ্ডা বোধ হচ্ছে না?

 রসিক। আপনাদের এতক্ষণে বোধ হল, আমার অনেকক্ষণ থেকেই বোধ হচ্ছে!

 বন। চলুন না, ঘরেই চলুন না!

 শ্রীশ। মশায় এত রাত্রে যদি আমাদের ঘরে ঢোকেন তাহলে কিন্তু―

 বন। যে আজ্ঞে, আপনারা কিছু ব্যস্ত আছেন দেখ্‌চি, তাহলে আর এক সময় হবে।