প্রজাপতির নির্বন্ধ/১৬
(১৬)
অক্ষয়। বাপারটা কি? রসিক দা, আজকাল ত খুব খাওয়াচ্চ দেখচি। প্রত্যহ যাকে দুবেলা দেখচ তাকে যে হঠাৎ ভুলে গেলে?
রসিক। এঁদের নতুন আদর, পাতে যা পড়ছে তাতেই খুসী হচ্চেন তোমার আদর পুরোণো হয়ে এল, তোমাকে নতুন করে খুসী করি এমন সাধ্য নেই ভাই।
অক্ষয়। কিন্তু শুনেছিলেম, আজকের সমস্ত মিষ্টান্ন এবং এ পরিবারের সমস্ত অনাস্বাদিত মধু উজাড় করে নেবার জন্যে দুটি অখ্যাতনামা যুবকের অভ্যুদয় হবে—এঁরা তাঁদেরই অংশে ভাগ বসাচ্ছেন না কি? ওহে রসিক দা ভুল করনি ত?
রসিক। ভুলের জন্যেইত আমি বিখ্যাত। বড় মা জানেন তাঁর বুড়ো রসিককাকা যাতে হাত দেবেন তাতেই গলদ হবে।
অক্ষয়। বল কি রসিক দাদা? করেছ কি? সে দুটি ছেলেকে কোথায় পাঠালে?
রসিক। ভ্রমক্রমে তাদের ভুল ঠিকানা দিয়েছি!
অক্ষয়। সে বেচারাদের কি গতি হবে?
রসিক। বিশেষ অনিষ্ট হবে না। তাঁরা কুমারটুলিতে নীলমাধব চৌধুরীর বাড়িতে এতক্ষণে জলযোগ সমাধা করেছেন। বনমালী ভট্টাচার্য্য তাঁদের তত্ত্বাবধানের ভার নিয়েছেন।
অক্ষয়। তা যেন বুঝ্লুম, মিষ্টান্ন সকলেরই পাতে পড়ল, কিন্তু তোমারই জলযোগটি কিছু কটু রকমের হবে! এইবেলা ভ্রমসংশোধন করে নাও! শ্রীশ বাবু, বিপিন বাবু কিছু মনে কোরো না, এর মধ্যে একটু পারিবারিক রহস্য আছে।
শ্রীশ। সরল প্রকৃতি রসিক বাবু সে রহস্য আমাদের নিকট ভেদ করেই দিয়েছেন! আমাদের ফাঁকি দিয়ে আনেন নি!
বিপিন। মিষ্টান্নের থালায় আমরা অনধিকার আক্রমণ করি নি, শেষ পর্য্যন্ত তার প্রমাণ দিতে প্রস্তুত আছি।
অক্ষয়। বল কি বিপিন বাবু? তা হলে চিরকুমার সভাকে চিরজন্মের মত কাঁদিয়ে এসেছ? জেনেশুনে, ইচ্ছা পূর্ব্বক?
রসিক। না, না, তুমি ভুল করচ অক্ষয়।
অক্ষয়। আবার ভুল? আজ কি সকলেরই ভুল করবার দিন হল না কি? বিপিন দা।
(গান)
ভুলে ভুলে আজ ভুলময়!
ভুলের লতায় বাতাসের ভুলে,
ফুলে ফুলে হোক্ ফুলময়!
আনন্দ ঢেউ ভুলের সাগরে
উছলিয়া হোক্ কুলময়।
রসিক। একি বড় মা আস্ছেন যে।
অক্ষয়। আস্বারইত ত কথা! উনি ত আর কুমারটুলির ঠিকানায় যাবেন না!
জগত্তারিণীর প্রবেশ। শ্রীশ ও বিপিনের ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম। দুই জনকে দুই মোহর দিয়া জগত্তারিণীর আশীর্ব্বাদ। জনান্তিকে অক্ষয়ের সহিত জগত্তারিণীর আলাপ।
অক্ষয়। মা বল্চেন, তোমাদের আজ ভাল করে খাওয়া হল না সমস্তই পাতে পড়ে রইল।
শ্রীশ। আমরা দুবার চেয়ে নিয়ে খেয়েছি।
বিপিন। যেটা পাতে পড়ে আছে, ওটা তৃতীয় কিস্তী।
শ্রীশ। ওটা না পড়ে থাক্লে আমাদেরই পড়ে থাক্তে হত।
জগত্তারিণী। (জনান্তিকে) তা হলে তোমরা ওঁদের বসিয়ে কথাবার্তা কও বাছা আমি আসি। (প্রস্থান)
রসিক। না এ ভারি অন্যায় হল।
অক্ষয়। অন্যায়টা কি হল?
রসিক। আমি ওঁদের বারবার করে বলে এসেছি যে, ওঁরা কেবল আজ আহারটি করেই ছুটি পাবেন কোন রকম বধ বন্ধনের আশঙ্কা নেই!―কিন্তু―
শ্রীশ। ওর মধ্যে কিন্তুটা কোথায় রসিক বাবু, আপনি অত চিন্তিত হচ্ছেন কেন?
রসিক। বলেন কি শ্রীশবাবু, আপনাদের আমি কথা দিয়েছি যখন―
বিপিন। তা বেশ ত, এমনিই কি মহাবিপদে ফেলেচেন!
শ্রীশ। মা আমাদের যে আশীর্ব্বাদ করে গেলেন আমরা যেন তার যোগ্য হই!
রসিক। না, না, শ্রীশবাবু, সে কোন কাজের কথা নয়। আপনারা যে দায়ে পড়ে ভদ্রতার খাতিরে―
বিপিন। রসিকবাবু আপনি আমাদের প্রতি অবিচার করবেন না― দায়ে পড়ে
রসিক। দায় নয় ত কি মশায়। সে কিছুতেই হবে না! আমি বরঞ্চ সেই ছেলে দুটোকে বনমালীর হাতছাড়িয়ে কুমারটুলি থেকে এখনও ফিরিয়ে আনব তবু―
শ্রীশ। আপনার কাছে কি অপরাধ করেছি রসিক বাবু?―
রসিক। না, না, এ ত অপরাধের কথা হচ্ছে না। আপনারা ভদ্রলোক, কৌমার্য্য ব্রত অবলম্বন করেছেন—আমার অনুরোধে পড়ে পরের উপকার করতে এসে শেষকালে―
বিপিন। শেষকালে নিজের উপকার করে ফেলব এটুকু আপনি সহ করতে পারবেন না―এমনি হিতৈষী বন্ধু!
শ্রীশ। আমরা যেটাকে সৌভাগ্য বলে স্বীকার করচি―আপনি তার থেকে আমাদের বঞ্চিত করতে চেষ্টা করচেন কেন?
রসিক। শেষকালে আমাকে দোষ দেবেন না?
বিপিন। নিশ্চয় দেব যদি না আপনি স্থির হয়ে শুভকর্ম্মে সহায়তা করেন।
রসিক। আমি এখনো সাবধান করচি—গতং তদ্গাম্ভীর্যং তটমপি চিতং জালিকশতৈঃ সখে হংসোত্তিষ্ঠ, ত্বরিতমমুতো গচ্ছ সরসীং!
সে গাম্ভীর্য্য গেল কোথা, নদীতট হের হোথা
জালিকেরা জালে ফেলে ঘিরে―
সখে হংস ওঠ ওঠ, সময় থাকিতে ছোট
হেথা হতে মানসের তীরে!
শ্রীশ। কিছুতেই না! তা, আপনার সংস্কৃত শ্লোক ছুড়ে মারলেও সখা হংসরা কিছুতেই এখান থেকে নড়চেন না!
রসিক। স্থান খারাপ বটে নড়বার জো নেই! আমি ত অচল হয়ে বসে আছি―হায়, হায়―
অয়ি কুরঙ্গ তপোবন বিভ্রমাৎ
উপগতাসি কিরাতপুরীমিমাম্!
ভৃত্যের প্রবেশ।
ভৃত্য। চন্দ্রবাবু এসেচেন।
অক্ষয়। এইখানে ডেকে নিয়ে আয়।
(ভৃত্যের প্রস্থান)
রসিক। একেবারে দারোগার হাতে চোর দুটিকে সমর্পণ করে দেওয়া হক্।
চন্দ্রবাবুর প্রবেশ।
চন্দ্র। এই যে আপনারা এসেছেন। পূর্ণ বাবুকেও দেখচি!
অক্ষয়। আজ্ঞে না, আমি পূর্ণ নই, তবু অক্ষয় বটে!
চন্দ্র। অক্ষয় বাবু! তা বেশ হয়েছে, আপনাকেও দরকার ছিল!
অক্ষয়। আমার মত অদরকারী লোককে যে দরকারে লাগাবেন তাতেই লাগতে পারি―বলুন কি কর্তে হবে?
চন্দ্র। আমি ভেবে দেখেছি, আমাদের সভা থেকে কুমার ব্রতের নিয়ম না ওঠালে সভাকে অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ করে রাখা হচ্ছে! শ্রীশ বাবু বিপিন বাবুকে এই কথাটা একটু ভাল করে বোঝাতে হবে।
অক্ষয়। ভারি কঠিন কাজ, আমার দ্বারা হবে কি না সন্দেহ!
চন্দ্র। একবার একটা মতকে ভাল বলে গ্রহণ করেছি বলেই সেটাকে পরিত্যাগ করবার ক্ষমতা দূর করা উচিত নয়। মতের চেয়ে বিবেচনাশক্তি বড়। শ্রীশবাবু, বিপিন বাবু―
শ্রীশ। আমাদের অধিক বলা বাহুল্য―
চন্দ্র। কেন বাহুল্য? আপনারা যুক্তিতেও কর্ণপাত করবেন না?
বিপিন। আমরা আপনারই মতে―
চন্দ্র। আমার মত এক সময় ভ্রান্ত ছিল সে কথা স্বীকার করছি, আপনারা এখনো সেই মতেই―
রসিক। এই যে পূর্ণবাবু আস্চেন! আসুন্ আসুন্!
পূর্ণর প্রবেশ।
চন্দ্র। পূর্ণবাবু, তোমার প্রস্তাবমতে আমাদের সভা থেকে কুমার ব্রত তুলে দেবার জন্যেই আজ আমরা এখানে মিলিত হয়েছি। কিন্তু শ্রীশবাবু এবং বিপিনবাবু অত্যন্ত দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, এখন ওদের বোঝাতে পারলেই—
রসিক। ওঁদের বোঝাতে আমি ত্রুটি করিনি চন্দ্রবাবু―
চন্দ্র। আপনার মত বাগ্মী যদি ফল না পেয়ে থাকেন তা হলে―
রসিক। ফল যে পেয়েছি তা ফলেন পরিচীয়তে।
চন্দ্র। কি বলচেন ভাল বুঝতে পারচিনে।
ওহে রসিক দা, চন্দ্রবাবুকে খুব স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দেওয়া দরকার। আমি দুটি প্রত্যক্ষ প্রমাণ এখনি এনে উপস্থিত কর্চি!
শ্রীশ। পূর্ণবাবু, ভাল আছেন ত?
পূর্ণ। হাঁ।
বিপিন। আপনাকে একটু শুক্নো দেখাচ্ছে।
পূর্ণ। না, কিছু না।
শ্রীশ। আপনাদের পরীক্ষার আর ত দেরী নেই।
পূর্ণ। না।
(নৃপ ও নীরকে লইয়া অক্ষয়ের প্রবেশ।)
অক্ষয়। (নৃপ ও নীরর প্রতি) ইনি চন্দ্রবাবু ইনি তোমাদের গুরুজন, এঁকে প্রণাম কর। (নৃপ নীরর প্রণাম) চন্দ্রবাবু, নূতন নিয়মে আপনাদের সভায় এই দুটি সভ্য বাড়ল!
চন্দ্র। বড় খুসি হলেম। এঁরা কে?
অক্ষয়। আমার সঙ্গে এঁদের সম্বন্ধ খুব ঘনিষ্ঠ। এঁরা আমার দুটি শ্যালী। শ্রীশবাবু এবং বিপিনবাবুর সঙ্গে এঁদের সম্বন্ধ শুভলগ্নে আরো ঘনিষ্ঠতর হবে। এঁদের প্রতি দৃষ্টি করলেই বুঝ্বেন, রসিক বাবু এই যুবক দুটির যে মতের পরিবর্ত্তন করিয়েছেন সে কেবল মাত্র বাগ্মিতার দ্বারা নয়।
চন্দ্র। বড় আনন্দের কথা।
পূর্ণ। শ্রীশ বাবু, বড় খুসি হলুম! বিপিন বাবু আপনাদের বড় সৌভাগ্য! আশা করি, অবলাকান্ত বাবুও বঞ্চিত হন নি,তাঁরো একটি―
নির্ম্মলার প্রবেশ।
চন্দ্র। নির্ম্মলা শুনে খুসি হবে, শ্রীশবাবু এবং বিপিন বাবুর সঙ্গে এঁদের বিবাহের সম্বন্ধ স্থির হয়ে গেছে। তা হলে কুমারব্রত উঠিয়ে দেওয়া সম্বন্ধে প্রস্তাব উত্থাপন করাই বাহুল্য।
নির্ম্মলা। কিন্তু অবলাকান্তবাবুর মত ত নেওয়া হয় নি―তাঁকে এখানে দেখচিনে―
চন্দ্র। ঠিক কথা, আমি সেটা ভুলেই গিয়েছিলুম, তিনি আজ এখনো এলেন না কেন?
রসিক। কিছু চিন্তা করবেন না, তাঁর পরিবর্ত্তন দেখলে আপনারা আরো আশ্চর্য্য হবেন।
অক্ষয়। চন্দ্রবাবু, এবারে আমাকেও দলে নেবেন। সভাটি যে রকম লোভনীয় হয়ে উঠলো, এখন আমাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবেন না!
চন্দ্র। আপনাকে পাওয়া আমাদের সৌভাগ্য।
অক্ষয়। আমার সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি সভ্যও পাবেন। আজকের সভায় তাঁকে কিছুতেই উপস্থিত করতে পারলেম না। এখন তিনি নিজেকে সুলভ করবেন না,―বাসরঘরে ভূতপূর্ব্ব কুমারসভাটিকে সাধ্যমত পিণ্ডদান করে তার পরে যদি দেখা দেন! এইবার অবশিষ্ট সভ্যটি এলেই আমাদের চিরকুমারসভা সম্পূর্ণ সমাপ্ত হয়!
শৈলের প্রবেশ।
শৈল। (চন্দ্রকে প্রণাম করিয়া) আমাকে ক্ষমা করবেন!
শ্রীশ। একি, অবলাকান্ত বাবু―
অক্ষয়। আপনারা মত পরিবর্ত্তন করেছেন, ইনি বেশ পরিবর্ত্তন করেছেন মাত্র।
রসিক। শৈলজা ভবানী এতদিন কিরাত বেশ ধারণ করেছিলেন, আজ ইনি আবার তপস্বিনী বেশ গ্রহণ করলেন।
চন্দ্র। নির্ম্মলা আমি কিছুই বুঝতে পারচিনে।
নির্ম্মলা। অন্যায়! ভারি অন্যায়! অবলাকান্তবাবু―
অক্ষয়। নির্ম্মলা দেবী ঠিক বলেছেন—অন্যায়! কিন্তু সে বিধাতার অন্যায়! এঁর অবলাকান্ত হওয়াই উচিত ছিল, কিন্তু ভগবান্ এঁকে বিধবা শৈলবালা করে কি মঙ্গল সাধন করচেন সে-রহস্য আমাদের অগোচর!
শৈল। (নির্ম্মলার প্রতি) আমি অন্যায় করেছি, সে অন্যায়ের প্রতিকার আমার দ্বারা কি হবে? আশা করি কালে সমস্ত সংশোধন হয়ে যাবে।
পূর্ণ। (নির্ম্মলার নিকটে আসিয়া) এই অবকাশে আমি আপনার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি, চন্দ্রবাবুর পত্রে আমি যে স্পর্ধা প্রকাশ করেছিলুম সে আমার পক্ষে অন্যায় হয়েছিল—আমার মত অযোগ্য—
চন্দ্র। কিছু অন্যায় হয় নি পূর্ণবাবু আপনার যোগ্যতা যদি নির্ম্মল না বুঝতে পারেন ত সে নির্ম্মলারই বিবেচনার অভাব! (নির্ম্মলার নতমুখে নিরুত্তরে প্রস্থান)
রসিক। (পূর্ণের প্রতি জনান্তিকে) ভয় নেই পূর্ণবাবু আপনার দরখাস্ত মঞ্জুর―প্রজাপতির আদালতে ডিক্রি পেয়েছেন―কাল প্রত্যুষেই জারি করতে বেরবেন।
শ্রীশ। (শৈলবালার প্রতি) বড় ফাঁকি দিয়েছেন।
বিপিন। সম্বন্ধের পূর্ব্বেই পরিহাসটা করে নিয়েছেন।
শৈল। পরে তাই বলে নিষ্কৃতি পাবেন না!
বিপিন। নিষ্কৃতি চাইনে!
রসিক। এইবারে নাটক শেষ হল—এইখানে ভরতবাক্য উচ্চারণ করে দেওয়া যাক্।
সর্ব্বস্তরতু দুর্গাণি সর্ব্বো ভদ্রাণি পশ্যতু।
সর্ব্ব কামানবাপ্নোতু সর্ব্বঃ সর্ব্বত্র নন্দতু॥
১৩০৭