প্রজাপতির নির্বন্ধ/৪
(৪)
আহারের পর শৈলবালা ডাকিল—মুখুজ্জে মশায়!
অক্ষয় অত্যন্ত ত্রস্তভাব দেখাইয়া কহিলেন—আবার মুখুজ্জে মশায়! এই বালখিল্য মুনিদের ধ্যানভঙ্গ ব্যাপারের মধ্যে আমি নেই!
শৈলবালা। ধ্যানভঙ্গ আমরা করব। কেবল মুনিকুমার গুলিকে এই বাড়িতে আনা চাই।
অক্ষয় চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া কহিলেন—সভাসুদ্ধ এইখানে উৎপাটিত করে আন্তে হবে? যত দুঃসাধ্য কাজ সবই এই একটিমাত্র মুখুজ্জে মশায়কে দিয়ে?
শৈলবালা হাসিয়া কহিল, মহাবীর হবার ঐত মুস্কিল! যখন গন্ধমাদনের প্রয়োজন হয়েছিল তখন নল নীল অঙ্গদকে ত কেউ পোছেও নি!
অক্ষয় গর্জন করিয়া কহিলেন, ওরে পোড়ারমুখী, ত্রেতাযুগের পোড়ারমুখোকে ছাড়া আর কোন উপমাও তোর মনে উদয় হল না? এত প্রেম!
শৈলবালা কহিল—হাঁ গো এতই প্রেম!
অক্ষয় ভৈরোঁতে গাহিয়া উঠিলেন—
পোড়া মনে শুধু পোড়া মুখখানি জাগে রে!
এত আছে লোক, তবু পোড়া চোখে
আর কেহ নাহি লাগে রে!
আচ্ছা, তাই হবে! পঙ্গপাল ক’টাকে শিখার কাছে তাড়িয়ে নিয়ে আস্ব। তাহলে চট্করে আমাকে একটা পান এনে দাও। তোমার স্বহস্তের রচনা!
শৈল। কেন দিদির হস্তের—
অক্ষয়। আরে দিদির হস্ত ত জোগাড় করেইচি, নইলে পাণিগ্রহণ কি জন্যে? এখন অন্য পদ্মহস্ত গুলির প্রতি দৃষ্টি দেবার অবকাশ পাওয়া গেছে।
শৈল। আচ্ছা গো মশায়! পদ্মহস্ত তোমার পানে এমনি চুন মাখিয়ে দেবে যে, পোড়ার মুখ আবার পুড়বে!
অক্ষয় গাহিলেন—
যারে মরণ দশায় ধরে
সে যে শতবার করে মরে।
পোড়া পতঙ্গ যত পোড়ে তত
আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ে!
শৈল। মুখুজ্জে মশায় ও কাগজের গোলাটা কিসের?
অক্ষয়। তোমাদের সেই সভ্য হবার আবেদন পত্র এবং প্রবেশিকার দশটাকার নোট পকেটে ছিল, ধোবা বেটা কেচে এমনি পরিষ্কার করে দিয়েছে, একটা অক্ষরও দেখতে পাচ্চিনে। ও বেটা বোধ হয় স্ত্রীস্বাধীনতার ঘোরতর বিরোধী, —তাই তোমার ঐ পত্রটা একেবারে আগাগোড়া সংশোধন করে দিয়েছে।
শৈল। এই বুঝি! অক্ষয়। চারটিতে মিলে স্মরণশক্তি জুড়ে বসে আছ, আর কিছু কি মনে রাখ্তে দিলে?সকলি ভুলেছে ভোলামন
ভোলেনি ভোলেনি শুধু ঐ চন্দ্রানন।
১০ নম্বর মধুমিস্ত্রির গলিতে একতলার একটি ঘরে চিরকুমার সভার অধিবেশন হয়। বাড়িটি সভাপতি চন্দ্রমাধব বাবুর বাসা। তিনি লোকটি ব্রাহ্ম কালেজের অধ্যাপক। দেশের কাজে অত্যন্ত উৎসাহী; মাতৃভূমির উন্নতির জন্য ক্রমাগতই নানা মৎলব তাঁহার মাথায় আসিতেছে। শরীরটি কৃশ কিন্তু কঠিন, মাথাটা মস্ত, বড় দুইটি চোখ অন্যমনস্ক খেয়ালে পরিপূর্ণ। প্রথমটা সভায় সভ্য অনেকগুলি ছিল। সম্প্রতি সভাপতি বাদে তিনটিতে আসিয়া ঠেকিয়াছে। যুথভ্রষ্টগণ বিবাহ করিয়া গৃহী হইয়া রোজগারে প্রবৃত্ত। এখন তাঁহারা কোনপ্রকার চাঁদার খাতা দেখিলেই প্রথমে হাসিয়া উড়াইয়া দেন, তাহাতেও খাতাধারী টিঁকিয়া থাকিবার লক্ষণ প্রকাশ করিলে গালি দিতে আরম্ভ করেন। নিজেদের দৃষ্টান্ত স্মরণ করিয়া দেশহিতৈষীর প্রতি তাঁহাদের অত্যন্ত অবজ্ঞা জন্মিয়াছে।
বিপিন, শ্রীশ, এবং পূর্ণ তিনটি সভ্য কালেজে পড়িতেছে, এখনো সংসারে প্রবেশ করে নাই। বিপিন ফুটবল্ খেলে, তাহার শরীরে অসামান্য বল, পড়াশুনা কখন্ করে কেহ বুঝিতে পারে না, অথচ চট্পট্ একজামিন পাস করে। শ্রীশ বড় মানুষের ছেলে, স্বাস্থ্য তেমন ভাল নয় তাই বাপ মা পড়াশুনার দিকে তত বেশী উত্তেজনা করেন না—শ্রীশ নিজের খেয়াল লইয়া থাকে। বিপিন এবং শ্রীশের বন্ধুত্ব অবিচ্ছেদ্য।
পূর্ণ গৌরবর্ণ, একহারা, লঘুগামী, ক্ষিপ্রকারী, দ্রুতভাষী, সকল বিষয়ে গাঢ় মনোেযোগ, চেহারা দেখিয়া মনে হয় দৃঢ় সংকল্প কাজের লোক।
সে ছিল চন্দ্রমাধব বাবুর ছাত্র। ভালরূপ পাশ করিয়া ওকালতী দ্বারা সুচারুরূপ জীবিকা নির্ব্বাহ করিবার প্রত্যাশায় সে রাত জাগিয়া পড়া করে। দেশের কাজ লইয়া নিজের কাজ নষ্ট করা তাহার সংকল্পের মধ্যে ছিল না। চিরকৌমার্য্য তাহার কাছে অত্যন্ত মনোহর বলিয়া বোধ হইত না। সন্ধ্যাবেলায় নিয়মিত আসিয়া সে চন্দ্রবাবুর নিকট হইতে পাস করিবার উপযুক্ত নোট লইত; এবং সে মনে মনে নিশ্চয় জানিত যে, চিরকৌমার্য্য ব্রত না লওয়াতে এবং নিজের ভবিষ্যৎ মাটি করিবার জন্য লেশমাত্র ব্যগ্র না হওয়াতে তাহার প্রতি চন্দ্রমাধব বাবুর শ্রদ্ধামাত্র ছিল না, কিন্তু সেজন্য সে কখনো অসহ্য দুঃখানুভব করে নাই। তাহার পরে কি ঘটিল তাহা সকলেই জানেন।
সে দিন সভা বসিয়াছে। চন্দ্রমাধব বাবু বলিতেছেন, আমাদের এই সভার সভ্যসংখ্যা অল্প হওয়াতে কারো হতাশ্বাস হবার কোন কারণ নেই—
তাঁহার কথা শেষ না হইতেই রুগ্নকায় উৎসাহী শ্রীশ বলিয়া উঠিল—হতাশ্বাস! সেইত আমাদের সভার গৌরব! এ সভার মহৎ আদর্শ এবং কঠিনবিধান কি সর্ব্বসাধারণের উপযুক্ত! আমাদের সভা অল্প লোকের সভা।
চন্দ্রমাধব বাবু কার্য্যবিবরণের খাতাটা চোখের কাছে তুলিয়া ধরিয়া কহিলেন—কিন্তু আমাদের আদর্শ উন্নত এবং বিধান কঠিন বলেই আমাদের বিনয় রক্ষা করা কর্ত্তব্য; সর্ব্বদাই মনে রাখা উচিত আমরা আমাদের সংকল্প সাধনের যোগ্য না হতেও পারি। ভেবে দেখ পূর্ব্বে আমাদের মধ্যে এমন অনেক সভ্য ছিলেন যাঁরা হয়ত আমাদের চেয়ে সর্ব্বাংশে মহত্তর ছিলেন, কিন্তু তাঁরাও নিজের সুখ এবং সংসারের প্রবল আকর্ষণে একে একে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছেন। আমাদের কয় জনের পথেও যে প্রলোভন কোথায় অপেক্ষা করচে তা কেউ বল্তে পারে না। সেই জন্য আমরা দম্ভ পরিত্যাগ করব, এবং কোন রকম শপথেও বদ্ধ হতে চাইনে— আমাদের মত এই যে, কোন কালে মহৎ চেষ্টাকে মনে স্থান না দেওয়ার চেয়ে চেষ্টা করে অকৃতকার্য্য হওয়া ভাল।
পাশের ঘরে ঈষৎ মুক্ত দরজার অন্তরালে একটি শ্রোত্রী এই কথায় যে একটুখানি বিচলিত হইয়া উঠিল, তাহার অঞ্চলবদ্ধ চাবির গোচ্ছায় দুই একটা চাবি যে একটু ঠুন্ শব্দ করিল তাহা পূর্ণ ছাড়া আর কেহ লক্ষ্য করিতে পারিল না।
চন্দ্রমাধব বাবু বলিতে লাগিলেন, আমাদের সভাকে অনেকেই পরিহাস করেন; অনেকেই বলেন তোমরা দেশের কাজ কর্বার জন্য কৌমার্য্য ব্রত গ্রহণ কর্চ, কিন্তু সকলেই যদি এই মহৎ প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ হয় তা হলে পঞ্চাশ বৎসর পরে দেশে এমন মানুষ কে থাক্বে যার জন্যে কোন কাজ করা কারো দরকার হবে। আমি প্রায়ই নম্র নিরুত্তরে এই সকল পরিহাস বহন করি; কিন্তু এর কি কোন উত্তর নেই?—বলিয়া তিনি তাঁহার তিনটী মাত্র সভ্যের দিকে চাহিলেন।
পূর্ণ নেপথ্যবাসিনীকে স্মরণ করিয়া সোৎসাহে কহিল—আছে বৈ কি। সকল দেশেই একদল মানুষ আছে যারা সংসারী হবার জন্যে জন্মগ্রহণ করেনি, তাদের সংখ্যা অল্প। সেই কটিকে আকর্ষণ করে এক উদ্দেশ্যবন্ধনে বাঁধবার জন্যে আমাদের এই সভা—সমস্ত জগতের লোককে কৌমার্য্যব্রতে দীক্ষিত কর্বার জন্যে নয়। আমাদের এই জাল অনেক লোক্কে ধর্বে এবং অধিকাংশকেই পরিত্যাগ কর্বে, অবশেষে দীর্ঘকাল পরীক্ষার পর দুটি চারটি লোক থেকে যাবে। যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে তোমরাই কি সেই দুটি চারিটী লোক তবে স্পর্ধাপূর্ব্বক কে নিশ্চয়রূপে বল্তে পারে। হাঁ আমরা জালে আকৃষ্ট হয়েছি এই পর্য্যন্ত কিন্তু পরীক্ষায় শেষ পর্য্যন্ত টিঁক্তে পারব কি না তা অন্তর্যামীই জানেন। কিন্তু আমরা কেউ টিক্তে পারি বা না পারি, আমরা একে একে স্খলিত হই বা না হই, তাই বলে আমাদের এই সভাকে পরিহাস করবার অধিকার কারো নেই। কেবল যদি আমাদের সভাপতি মশায় একমাত্র থাকেন, তবে আমাদের এই পরিত্যক্ত সভাক্ষেত্র সেই এক তপস্বীর তপঃপ্রভাবে পবিত্র উজ্জ্বল হয়ে থাকবে, এবং তাঁর চিরজীবনের তপস্যার ফল দেশের পক্ষে কখনই ব্যর্থ হবে না।
কুণ্ঠিত সভাপতি কার্য্যবিবরণের খাতা খানি পুনর্ব্বার তাঁহার চোখের অত্যন্ত কাছে ধরিয়া অন্যমনস্কভাবে কি দেখিতে লাগিলেন। কিন্তু পূর্ণর এই বক্তৃতা যথাস্থানে যথাবেগে গিয়া পৌঁছিল। চন্দ্রমাধব বাবুর একাকী তপস্যার কথায় নির্ম্মলার চক্ষু ছল ছল করিয়া আসিল এবং বিচলিত বালিকার চাবির গোছর ঝনক শব্দ উৎকর্ণ পূর্ণকে পুরস্কৃত করিল।
বিপিন চুপ করিয়া ছিল, এতক্ষণ পরে সে তাহার জলদমন্দ্র গম্ভীর কণ্ঠে কহিল—আমরা এ সভার যোগ্য কি অযোগ্য, কালেই তার পরিচয় হবে, কিন্তু কাজ করাও যদি আমাদের উদ্দেশ্য হয় তবে সেটা কোনো এক সময়ে শুরু করা উচিত। আমার প্রশ্ন এই— কি কর্তে হবে?
চন্দ্রমাধব উজ্জ্বল উৎসাহিত হইয়া বলিয়া উঠিলেন, এই প্রশ্নের জন্য আমরা এতদিন অপেক্ষা করেছিলাম, কি কর্তে হবে? এই প্রশ্ন যেন আমাদের প্রত্যেককে দংশন করে অধীর করে তোলে, কি কর্তে হবে? বন্ধুগণ কাজই একমাত্র ঐক্যের বন্ধন। এক সঙ্গে যারা কাজ করে তারাই এক! এই সভায় আমরা যতক্ষণ সকলে মিলে একটা কাজে নিযুক্ত না হব ততক্ষণ আমরা যথার্থ এক হতে পারব না। অতএব বিপিন বাবু, আজ এই যে প্রশ্ন কর্চেন—কি করতে হবে—এই প্রশ্নকে নিব্তে দেওয়া হবে না। সভ্যমহাশয়গণ, আপনারা উত্তর করুন্ কি করতে হবে?
দুর্ব্বল দেহ শ্রীশ অস্থির হইয়া বলিয়া উঠিল আমাকে যদি জিজ্ঞাসা করেন কি করতে হবে, আমি বলি আমাদের সকলকে সন্ন্যাসী হয়ে ভারতবর্ষের দেশে দেশে গ্রামে গ্রামে দেশহিতব্রত নিয়ে বেড়াতে হবে, আমাদের দলকে পুষ্ট করে তুল্তে হবে, আমাদের এই সভাটিকে সূক্ষ্ম সূত্র স্বরূপ করে সমস্ত ভারতবর্ষকে গেঁথে ফেলতে হবে।
বিপিন হাসিয়া কহিল; সে ঢের সময় আছে, যা কালই সুরু করা যেতে পারে এমন একটা কিছু কাজ বল। “মারি ও গণ্ডার লুঠি ত ভাণ্ডার” যদি পণ করে বস, তবে গণ্ডারও বাঁচবে ভাণ্ডারও বাঁচবে, তুমিও যেমন আরামে আছ তেমনি আরামে থাকবে। আমি প্রস্তাব করি, আমরা প্রত্যেকে দুটি করে বিদেশী ছাত্র পালন করব, তাদের পড়া শুনো এবং শরীর মনের সমস্ত চর্চ্চার ভার আমাদের উপর থাক্বে।
শ্রীশ কহিল-এই তোমার কাজ। এর জন্যই আমরা সন্ন্যাসধর্ম গ্রহণ করেছি? শেষকালে ছেলে মানুষ কর্তে হবে, তাহলে নিজের ছেলে কি অপরাধ করেছে?
বিপিন বিরক্ত হইয়া কহিল, তা যদি বল তাহলে সন্ন্যাসীর ত কর্ম্মই নেই; কর্ম্মের মধ্যে ভিক্ষে আর ভ্রমণ আর ভণ্ডামি!
শ্রীশ রাগিয়া কহিল, আমি দেখ্চি আমাদের মধ্যে কেউ কেউ আছেন এসভার মহৎ উদ্দেশ্যের প্রতি যাঁদের শ্রদ্ধামাত্র নেই, তাঁরা যত শীঘ্র এ সভা পরিত্যাগ করে সন্তানপালনে প্রবৃত্ত হন ততই আমাদের মঙ্গল!
বিপিন আরক্তবর্ণ হইয়া বলিল—নিজের সম্বন্ধে কিছু বল্তে চাইনে কিন্তু এ সভায় এমন কেউ কেউ আছেন, যাঁরা সন্ন্যাস গ্রহণের কঠোরতা এবং সন্তানপালনের ত্যাগ স্বীকার দুয়েরই অযোগ্য, তাঁদের—
চন্দ্রমাধব বাবু চোখের কাছ হইতে কার্য্যবিবরণের খাতা নামাইয়া কহিলেন, উত্থাপিত প্রস্তাব সম্বন্ধে পূর্ণ বাবুর অভিপ্রায় জান্তে পারলে আমার মন্তব্য প্রকাশ করবার অবসর পাই।
পূর্ণ কহিল, অদ্য বিশেষরূপে সভার ঐক্য বিধানের জন্য একটা কাজ অবলম্বন করবার প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু কাজের প্রস্তাবে ঐক্যের লক্ষণ কি রকম পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে সে আর কাউকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাবার দরকার নেই। ইতিমধ্যে আমি যদি আবার একটা তৃতীয় মত প্রকাশ করে বসি তাহলে বিরোধানলে তৃতীয় আহুতি দান করা হবে—অতএব আমার প্রস্তাব এই যে সভাপতি মশায় আমাদের কাজ নির্দ্দেশ করে দেবেন এবং আমরা তাই শিরোধার্য্য করে নিয়ে বিনা বিচারে পালন করে যাব, কার্য্যসাধন এবং ঐক্য সাধনের এই এক মাত্র উপায় আছে।
পাশের ঘরে এক ব্যক্তি আবার একবার নড়িয়া চড়িয়া বসিল এবং তাহার চাবি ঝন্ করিয়া উঠিল।
বিষয়কর্ম্মে চন্দ্রমাধব বাবুর মত অপটু কেহ নাই কিন্তু তাঁহার মনের খেয়াল বাণিজ্যের দিকে। তিনি বলিলেন, আমাদের প্রথম কর্ত্তব্য ভারতবর্ষের দারিদ্র্যমোচন, এবং তার আশু উপায় বাণিজ্য। আমরা কয়জনে বড় বাণিজ্য চালাতে পারিনে, কিন্তু তার সূত্রপাত করতে পারি। মনে কর আমরা সকলেই যদি দিয়াশলাই সম্বন্ধে পরীক্ষা আরম্ভ করি। এমন যদি একটা কাটি বের করতে পারি যা সহজে জ্বলে, শীঘ্র নেবে না এবং দেশের সর্ব্বত্র প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়, তা হলে দেশে সস্তা দেশালাই নির্ম্মাণের কোন বাধা থাকে না।—এই বলিয়া জাপানে এবং য়ুরোপে সবসুদ্ধ কত দেশালাই প্রস্তুত হয়,তাহাতে কোন্ কোন্ কাঠের কাঠি ব্যবহার হয়, কাঠির সঙ্গে কি কি দাহ্যপদার্থ মিশ্রিত করে, কোথা হইতে কত দেশালাই রপ্তানি হয়, তাহার মধ্যে কত ভারতবর্ষে আসে এবং তাহার মূল্য কত, চন্দ্রমাধববাবু তাহা বিস্তারিত করিয়া বলিলেন। বিপিন শ্রীশ নিস্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল। পূর্ণ কহিল, পাকাটি এবং খ্যাংরা কাঠি দিয়ে শীঘ্রই পরীক্ষা করে দেখ্ব।—শ্রীশ মুখ ফিরাইয়া হাসিল।
এমন সময় ঘরের মধ্যে অক্ষয় আসিয়া প্রবেশ করিলেন। কহিলেন, মশায় প্রবেশ করতে পারি?
ক্ষীণদৃষ্টি চন্দ্রমাধব বাবু হঠাৎ চিনিতে না পারিয়া ভ্রূকুঞ্চিত করিয়া অবাক্ হইয়া চাহিয়া রহিলেন। অক্ষয় কহিলেন, মশায় ভয় পাবেন না এবং অমন ভ্রূকুটি করে আমাকেও ভয় দেখাবেন না—আমি অভূতপূর্ব্ব নই—এমন কি, আমি আপনাদেরই ভূতপূর্ব্ব—আমার নাম—
চন্দ্রমাধব বাবু তাড়াতাড়ি উঠিয়া কহিলেন আর নাম বলতে হবে না— আসুন্ আসুন্ অক্ষয় বাবু—
তিন তরুণ সভ্য অক্ষয়কে নমস্কার করিল। বিপিন ও শ্রীশ দুই বন্ধু সদ্যোবিবাদের বিমর্ষতায় গম্ভীর হইয়া বসিয়া রহিল; পূর্ণ কহিল, মশায়, অভূতপূর্ব্বর চেয়ে ভূতপূর্ব্বকেই বেশী ভয় হয়!
অক্ষয় কহিলেন—পূর্ণ বাবু বুদ্ধিমানের মত কথাই বলেছেন। সংসারে ভূতের ভয়টাই প্রচলিত। নিজে যে ব্যক্তি ভূত অন্যলোকের জীবনসম্ভোগটা তার কাছে বাঞ্ছনীয় হতে পারেই না, এই মনে করে মানুষ ভূতকে ভয়ঙ্কর কল্পনা করে। অতএব সভাপতিমশায়, চিরকুমার সভার ভূতটিকে সভাথেকে ঝাড়াবেন, না পূর্ব্ব সম্পর্কের মমতা বশতঃ একখানি চৌকি দেবেন, এইবেলা বলুন!
“চৌকি দেওয়াই স্থির” বলিয়া চন্দ্রবাবু একখানি চেয়ার অগ্রসর করিয়া দিলেন। “সর্ব্ব সম্মতিক্রমে আসন গ্রহণ করলুম” বলিয়া অক্ষয়বাবু বসিলেন; বলিলেন আপনারা আমাকে নিতান্ত ভদ্রতা করে বস্তে বল্লেন বলেই যে আমি অভদ্রতা করে বসেই থাক্ব আমাকে এমন অসভ্য মনে করবেন না—বিশেষতঃ পান তামাক এবং পত্নী আপনাদের সভার নিয়মবিরুদ্ধ অথচ ঐ তিনটে বদ্ অভ্যাসই আমাকে একেবারে মাটি করেছে সুতরাং চট্পট্ কাজের কথা সেরেই বাড়িমুখো হতে হবে।
চন্দ্রবাবু হাসিয়া কহিলেন, আপনি যখন সভ্য নন্ তখন আপনার সম্বন্ধে সভার নিয়ম নাই খাটালেম— পান তামাকের বন্দোবস্ত বোধ হয় করে দিতে পারব কিন্তু আপনার তৃতীয় নেশাই—
অক্ষয়। সেটি এখানে বহন করে আনবার চেষ্টা কর্বেন না, আমার সে নেশাটি প্রকাশ্য নয়!
চন্দ্রবাবু পান তামাকের জন্য সনাতন চাকরকে ডাকিবার উপক্রম করিলেন। পূর্ণ কহিল আমি ডাকিয়া দিতেছি বলিয়া উঠিল;—পাশের ঘরে চাবি এবং চুড়ি এবং সহসা পলায়নের শব্দ একসঙ্গে শোনা গেল।
অক্ষয় তাহাকে থামাইয়া কহিলেন, “যস্মিন্ দেশে যদাচারঃ” যতক্ষণ আমি এখানে আছি ততক্ষণ আমি আপনাদের চিরকুমার—কোন প্রভেদ নেই! এখন আমার প্রস্তাবটা শুনুন্।
চন্দ্রবাবু টেবিলের উপর কার্য্যবিবরণের খাতাটির প্রতি অত্যন্ত ঝুঁকিয়া পড়িয়া মন দিয়া শুনিতে লাগিলেন।
অক্ষয় কহিলেন আমার কোন মফস্বলের ধনী বন্ধু তাঁর একটি সন্তানকে আপনাদের কুমার সভার সভ্য কর্তে ইচ্ছা করেচেন।
চন্দ্রবাবু বিস্মিত হইয়া কহিলেন, বাপ ছেলেটির বিবাহ দিতে চান না!
অক্ষয়। সে আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন—বিবাহ সে কোনক্রমেই করবে না আমি তার জামিন রইলুম। তার দূর সম্পর্কের এক দাদা সুদ্ধ সভ্য হবেন। তাঁর সম্বন্ধেও আপনারা নিশ্চিন্ত থাক্তে পারেন, কারণ যদিচ তিনি আপনাদের মত সুকুমার নন কিন্তু আপনাদের সকলের চেয়ে বেশী কুমার, তাঁর বয়স ৬০ পেরিয়ে গেছে—সুতরাং তাঁর সন্দেহের বয়সটা আর নেই, সৌভাগ্যক্রমে সেটা আপনাদের সকলেরই আছে।
অক্ষয়বাবুর প্রস্তাবে চিরকুমার সভা প্রফুল্ল হইয়া উঠিল, সভাপতি কহিলেন সভ্যপদপ্রার্থীদের নাম ধাম বিবরণ—
অক্ষয়। অবশ্যই তাঁদের নাম ধাম বিবরণ একটা আছেই—সভাকে তার থেকে বঞ্চিত করতে পারা যাবে না—সভ্য যখন পাবেন তখন নাম ধাম বিবরণ সুদ্ধই পাবেন। কিন্তু আপনাদের এই একতালার স্যাঁতসেঁতে ঘরটি স্বাস্থ্যের পক্ষে অনুকূল নয়; আপনাদের এই চিরকুমার ক’টির চিরত্ব যাতে হ্রাস না হয় সেদিকে একটু দৃষ্টি রাখ্বেন!
চন্দ্রবাবু কিঞ্চিৎ লজ্জিত হইয়া খাতাটি নাকের কাছে তুলিয়া লইয়া বলিলেন—অক্ষয় বাবু আপনি জানেন ত আমাদের আয়—
অক্ষয়। আয়ের কথাটা আর প্রকাশ করবেন না, আমি জানি ও আলোচনাটা চিত্তপ্রফুল্লকর নয়। ভাল ঘরের বন্দোবস্ত করে রাখা হয়েছে সে জন্যে আপনাদের ধনাধ্যক্ষকে স্মরণ কর্তে হবে না। চলুন না আজই সমস্ত দেখিয়ে শুনিয়ে আনি!
বিমর্ষ বিপিন শ্রীশের মুখ উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। সভাপতিও প্রফুল্ল হইয়া উঠিয়া চুলের মধ্যদিয়া বারবার আঙুল বুলাইতে বুলাইতে চুলগুলাকে অত্যন্ত অপরিষ্কার করিয়া তুলিলেন। কেবল পূর্ণ অত্যন্ত দমিয়া গেল। সে বলিল, সভার স্থান পরিবর্ত্তনটা কিছু নয়। অক্ষয় কহিলেন,—কেন, এবাড়ি থেকে ওবাড়ি করলেই কি আপনাদের চিরকৌমার্য্যের প্রদীপ হাওয়ায় নিবে যাবে?
পূর্ণ। এ ঘরটি ত আমাদের মন বোধ হয় না!
অক্ষয়। মন্দ নয়। কিন্তু এর চেয়ে ভাল ঘর সহরে দুষ্প্রাপ্য হবে না!
পূর্ণ। আমার ত মনে হয় বিলাসিতার দিকে মন না দিয়ে খানিকটা কষ্টসহিষ্ণুতা অভ্যাস করা ভাল!
শ্রীশ কহিল, সেটা সভার অধিবেশনে না করে সভার বাইরে করা যাবে।
বিপিন কহিল—একটা কাজে প্রবৃত্ত হোলেই এত ক্লেশ সহ্য করবার অবসর পাওয়া যায় যে, অকারণে বলক্ষয় করা মূঢ়তা।
অক্ষয়। বন্ধুগণ, আমার পরামর্শ শোন, সভাঘরের অন্ধকার দিয়ে চিরকৌমার্য্য ব্রতের অন্ধকার আর বাড়িয়োনা। আলোক এবং বাতাস স্ত্রীলিঙ্গ নয় অতএব সভার মধ্যে ওদুটোকে প্রবেশ কর্তে বাধা দিয়ে না। আরো বিবেচনা করে দেখ, এস্থানটি অত্যন্ত সরস, তোমাদের ব্রতটি তদুপযুক্ত নয়। বাতিকের চর্চ্চা কর্চ কর, কিন্তু বাতের চর্চ্চা তোমাদের প্রতিজ্ঞার মধ্যে নয়। কি বল শ্রীশ বাবু বিপিন বাবুর কি মত?
দুই বন্ধু বলিল —ঠিক কথা। ঘরটা একবার দেখেই আসা যাক্ না।
পূর্ণ বিমর্ষ হইয়া নিরুত্তর রহিল। পাশের ঘরেও চাবি একবার ঠুন্ করিল, কিন্তু অত্যন্ত অপ্রসন্ন সুরে!