প্রজাপতির নির্বন্ধ/৫
(৫)
অক্ষয় বলিলেন—স্বামীই স্ত্রীর একমাত্র তীর্থ। মান কি না?
পুরবালা। আমি কি পণ্ডিত মশায়ের কাছে শাস্ত্রের বিধান নিতে এসেছি? আমি মার সঙ্গে আজ কাশী চলেছি এই খবরটি দিয়ে গেলুম।
অক্ষয়। খবরটি সুখবর নয়—শোনবামাত্র তোমাকে শাল দোশালা বক্শিশ দিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে না।
পুরবালা। ইস্, হৃদয় বিদীর্ণ হচ্চে! না? সহ্য করতে পারচ না?
অক্ষয়। আমি কেবল উপস্থিত বিচ্ছেদটার কথা ভাব্চি নে— এখন তুমি দুদিন না রইলে, আরো ক’জন রয়েছেন, এক রকম করে এই হতভাগ্যের চলে যাবে। কিন্তু এর পরে কি হবে? দেখ, ধর্ম্ম কর্ম্মে স্বামীকে এগিয়ে যেয়ো না,—স্বর্গে তুমি যখন ডব্ল্ প্রোমোশন্ পেতে থাক্বে আমি তখন পিছিয়ে থাক্ব-তোমাকে বিষ্ণুদূতে রথে চড়িয়ে নিয়ে যাবে, আর আমাকে যমদূতে কানে ধরে হাঁটিয়ে দৌড় করাবে—
স্বর্গে তোমায় নিয়ে যাবে উড়িয়ে,
পিছে পিছে আমি চলব খুঁড়িয়ে!
ইচ্ছা হবে টিকির ডগা ধরে
বিষ্ণু দূতের মাথাটা দিই গুঁড়িয়ে।
পুরবালা আচ্ছা, আচ্ছা, থাম!
অক্ষয়। আমি থামব, কেবল তুমিই চল্বে। ঊনবিংশ শতাব্দীর এই বন্দোবস্ত? নিতান্তই চল্লে?
পুরবালা। চল্লুম।
অক্ষয়। আমাকে কার হাতে সমর্পণ করে গেলে?
পুরবালা। রসিক দাদার হাতে।
অক্ষয়। মেয়ে মানুষ, হস্তান্তর করবার আইন কিছুই জান না! সেই জন্যেই ত বিরহাবস্থায় উপযুক্ত হাত নিজেই খুঁজে নিয়ে আত্মসমর্পণ করতে হয়।
পুরবালা। তোমাকে ত বেশী খোঁজাখুঁজি করতে হবে না!
অক্ষয়। তা হবে না। (গান)-কাফি।
কার হাতে যে ধরা দেব প্রাণ;
(তাই) ভাবতে বেলা অবসান!
ডান দিকেতে তাকাই যখন, বাঁয়ের লাগি কাঁদেরে মন
বাঁয়ের দিকে ফিরলে তখন দক্ষিণেতে পড়ে টান!
আচ্ছা আমার যেন সান্ত্বনার গুটি দুই তিন সদুপায় আছে কিন্তু তুমি
বিরহ যামিনী কেমনে যাপিবে,
বিচ্ছেদ তাপে যখন তাপিবে
এপাশ ওপাশ বিছানা মাপিবে,
মকর কেতনে কেবলি শাপিবে,
পুরবালা। রক্ষে কর, ও মিলটা ঐ খানেই শেষ কর!
অক্ষয়। দুঃখের সময় আমি থাম্তে পারিনে—কাব্য আপনি বেরতে থাকে। মিল ভাল না বাস অমিত্রাক্ষর আছে, তুমি যখন বিদেশে থাকবে আমি “আর্তনাদ বদ্ কাব্য” বলে একটা কাব্য লিখ্ব—সখি আর আরম্ভটা শোন—(সাড়ম্বরে)
বাষ্পীয় শকটে চড়ি নারী চূড়ামণি
পুরবালা চলি যবে গেলা কাশীধামে
বিকালে, কহ হে দেবি অমৃত ভাষিণী
কোন্ বরাঙ্গনে বরি বরমাল্যদানে
যাপিলা বিচ্ছেদ মাস শ্যালীত্রয়ীশালী
শ্রীঅক্ষয়!
পুরবালা। (সগর্ব্বে) আমার মাথা খাও, ঠাট্টা নয়, তুমি একটা সত্যিকার কাব্য লেখনা!
অক্ষয়। মাথা খাওয়ার কথাটা যদি বল্লে, আমি নিজের মাথাটি খেয়ে অবধি বুঝেছি ওটা সুখাদ্যের মধ্যে গণ্য নয়। আর ঐ কাব্য লেখা, ও কার্য্যটাও সুসাধ্য বলে জ্ঞান করিনে। বুদ্ধিতে আমার এক জায়গায় ফুটো আছে, কাব্য জম্তে পারে না—ফস্ ফস্ করে বেরিয়ে পড়ে।
তুমি জান আমার গাছে ফল কেন না ফলে!
যেমনি ফুলটি ফুটে ওঠে আনি চরণতলে!
কিন্তু আমার প্রশ্নের ত কোন উত্তর পেলুম না। কৌতূহলে মরে যাচ্চি। কাশীতে যে চলেছ, উৎসাহটা কিসের জন্যে? আপাততঃ সেই বিষ্ণু দূতটাকে মনে মনে ক্ষমা করলুম, কিন্তু ভগবান্ ভূতনাথ ভবানীপতির অনুচরগুলোর উপর ভারি সন্দেহ হচ্চে। শুনেছি নন্দী ও ভূঙ্গি অনেক বিষয়ে আমাকেও জেতে, ফিরে এসে হয়ত এই ভূতটিকে পছন্দ না হতেও পারে!
অক্ষয়ের পরিহাসের মধ্যে একটু যে অভিমানের জ্বালা ছিল, সেটুকু পুরবালা অনেক্ষণ বুঝিয়াছে। তাহা ছাড়া, প্রথমে কাশী যাইবার প্রস্তাবে তাহার যে উৎসাহ হইয়াছিল, যাত্রার সময় যতই নিকটবর্ত্তী হইতে লাগিল ততই তাহা ম্লান হইয়া আসিতেছে।
সে কহিল—আমি কাশী যাব না।
অক্ষয়। সে কি কথা! ভূতভাবনের যে ভৃত্যগুলি একবার মরে ভূত হয়েছে—তারা যে দ্বিতীয়বার মরবে!
রসিকের প্রবেশ।
পুরবালা। আজ যে রসিকদাদার মুখ ভারি প্রফুল্ল দেখাচ্চে?
রসিক। ভাই, তোর রসিকদাদার মুখের ঐ রোগটা কিছুতেই ঘুচল না। কথা নেই বার্ত্তা নেই প্রফুল্ল হয়েই আছে—বিবাহিত লোকেরা দেখে’ মনে মনে রাগ করে।
পুরবালা। শুন্লে ত, বিবাহিত লোক! এর একটা উপযুক্ত জবাব দিয়ে যাও!
অক্ষয়। আমাদের প্রফুল্লতার খবর ও বৃদ্ধ কোথা থেকে জানবে? সে এত রহস্যময় যে, তা উদ্ভেদ করতে আজ পর্য্যন্ত কেউ পারলে না, —সে এত গভীর যে আমরাই হাত্ড়ে খুঁজে পাইনে, হঠাৎ সন্দেহ হয় আছে কি না।
পুরবালা “এই বুঝি!” বলিয়া রাগ করিয়া চলিয়া যাইবার উপক্রম করিল।
অক্ষয় তাহাকে ধরিয়া ফিরাইয়া কহিল—দোহাই তোমার এই লোকটির সাম্নে রাগারাগি কোরো না—তাহলে ওর আস্পর্ধা আরো বেড়ে যাবে।—দেখ দাম্পত্য তত্ত্বানভিজ্ঞ বৃদ্ধ, আমরা যখন রাগ করি তখন স্বভাবতঃ আমাদের কণ্ঠস্বর প্রবল হয়ে উঠে, সেইটেই তোমাদের কর্ণগোচর হয়; আর অনুরাগে যখন আমাদের কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে, কানের কাছে মুখ আন্তে গিয়ে মুখ বারম্বার লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে পড়তে থাকে, —তখন ত খবর পাও না!
পুরবালা। আঃ-চুপ কর!
অক্ষয়। যখন গয়নার ফর্দ্দ হয় তখন বাড়ীর সরকার থেকে স্যাকরা পর্য্যন্ত সেটা কারো অবিদিত থাকে না কিন্তু বসন্ত নিশীথে যখন
পুরবালা। আঃ—থাম!
অক্ষয়। বসন্ত-নিশীথে প্রেয়সী—
পুরবালা। আঃ—কি বক্চ তার ঠিক নেই!
অক্ষয়। বসন্তনিশীথে যখন প্রেয়সী গর্জ্জন করে বলেন, আমি কালই বাপের বাড়ি চলে যাব, আমার একদণ্ড এখানে থাক্তে ইচ্ছে নেই—আমার হাড় কালী হল—আমার—
পুরবালা। হাঁগো মশায়, কবে তোমার প্রেয়সী বাপেরবাড়ি যাব বলে বসন্তনিশীথে গর্জ্জন করেছে?
অক্ষয়। ইতিহাসের পরীক্ষা? কেবল ঘটনা রচনা করে নিষ্কৃতি নেই? আবার সন তারিখ সুদ্ধ মুখে মুখে বানিয়ে দিতে হবে? আমি কি এত বড় প্রতিভাশালী?
রসিক। (পুরবালার প্রতি) বুঝেছ ভাই, সোজা করে ও তোমার কথা বল্তে পারে না—ওর এত ক্ষমতাই নেই—তাই উল্টে বলে; আদরে না কুলোলে গাল দিয়ে আদর করতে হয়!
পুরবালা। আচ্ছা মল্লিনাথজি, তোমার আর ব্যাখ্যা করতে হবে না। মা যে শেষকালে তোমাকেই কাশী নিয়ে যাবেন স্থির করেছেন।
রসিক। তা বেশ ত, এতে আর ভয়ের কথাটা কি? তীর্থ যাবার ত বয়সই হয়েছে। এখন তোমাদের লোল কটাক্ষে এ বৃদ্ধের কিছুই করতে পারবে না—এখন চিত্ত চন্দ্রচূড়ের চরণে—
মুগ্ধস্নিগ্ধবিদগ্ধমুগ্ধমধুরৈর্লোলৈঃ কটাক্ষৈরলং
চেতশ্চুম্বতি চন্দ্রচূড়চরণধ্যানামৃতে বর্ত্ততে।
পুরবালা। সে ত খুব ভাল কথা—তোমার উপরে আর কটাক্ষের অপব্যয় কর্তে চাই নে—এখন চন্দ্রচূড় চরণে চল—তাহলে মাকে ডাকি!
রসিক। (করজোড়ে) বড়দিদি ভাই, তোমার মা আমাকে সংশোধনের বিস্তর চেষ্টা করচেন, কিন্তু একটু অসময়ে সংস্কার কার্য্য আরম্ভ করেচেন—এখন তাঁর শাসনে কোন ফল হবে না! বরঞ্চ এখনো নষ্ট হবার বয়স আছে, সে বয়সটা বিধাতার কৃপায় বরাবরই থাকে, লোল কটাক্ষটা শেষকাল পর্য্যন্ত খাটে, কিন্তু উদ্ধারের বয়স আর নেই। তিনি এখন কাশী যাচ্চেন, কিছুদিন এই বৃদ্ধ শিশুর বুদ্ধিবৃত্তির উন্নতিসাধনের দুরাশা পরিত্যাগ করে শান্তিতে থাকুন—কেন তোরা তাঁকে কষ্ট দিবি।
জগত্তারিণীর প্রবেশ।
জগত্তারিণী। বাবা তা হলে আসি।
অক্ষয়। চল্লে না কি মা? রসিকদাদা যে এতক্ষণ দুঃখ করছিলেন যে তুমি—
রসিক। (ব্যাকুলভাবে) দাদার সকল কথাতেই ঠাট্টা! মা, আমার কোন দুঃখ নেই—আমি কেন দুঃখ করতে যাব?
অক্ষয়। বল্ছিলে না, সে, বড়মা একলাই কাশী যাচ্চেন, আমাকে সঙ্গে নিলেন না?
রসিক। হাঁ, সে ত ঠিক কথা! মনে ত লাগ্তেই পারে—তবে কি না মা যদি নিতান্তই—
জগত্তারিণী। না বাপু, বিদেশে তোমার রসিকদাদাকে সাম্লবে কে? ওঁকে নিয়ে পথ চল্তে পারব না।
পুরবালা। কেন মা, রসিকদাদাকে নিয়ে গেলে উনি তোমাকে দেখতে শুন্তে পার্ত্তেন।
জগত্তারিণী। রক্ষে কর, আমাকে আর দেখে শুনে কাজ নেই। তোমার রসিকদাদার বুদ্ধির পরিচয় ঢের পেয়েছি।
রসিকদাদা। (টাকে হাত বুলাতে বুলাইতে) তা মা, যেটুকু বুদ্ধি আছে তার পরিচয় সর্ব্বদাই দিচ্চি—ও ত চেপে রাখবার জো নেই—ধরা পড়তেই হবে। ভাঙা চাকাটাই সব চেয়ে খড় খড় করে—তিনি যে ভাঙা সেটা পাড়াসুদ্ধ খবর পায়। সেই জন্যেই বড়মা চুপচাপ করে থাক্তেই চাই, কিন্তু তুমি যে আবার চালাতেও ছাড় না!
নিজের শৈথিল্যে যাহার কিছুই মনের মত হয় না, সর্ব্বদা ভর্ৎসনা করিবার জন্য তাহার একটা হতভাগ্যকে চাই। রসিকদাদা জগত্তারিণীর বহিস্থিত আত্মগ্লানি বিশেষ।
জগত্তারিণী। আমি তাহলে হারাণের বাড়ি চল্লুম, একেবারে তাদের সঙ্গে গাড়িতে উঠ্ব—এর পরে আর যাত্রার সময় নেই। পুরো, তোরাত দিনক্ষণ মানিস্নে, ঠিক সময়ে ইষ্টেশনে যাস্!
তাঁহার কন্যাজামাতার অসামান্য আসক্তি মা বেশ অবগত ছিলেন। পঞ্জিকার খাতিরে শেষ মুহূর্ত্তের পূর্ব্বে তাহাদের বিচ্ছেদ সংঘটনের চেষ্টা তিনি বৃথা বলিয়াই জানিতেন।
কিন্তু পুরবালা যখন বলিল, মা আমি কাশী যাব না—সেটা তিনি বাড়াবাড়ি মনে করিলেন। পুরবালার প্রতি তাঁহার বড় নির্ভর। সে তাঁহার সঙ্গে যাইতেছে বলিয়া তিনি নিশ্চিন্ত আছেন। পুরবালা স্বামীর সঙ্গে সিম্লা যাতায়াত করিয়া বিদেশ ভ্রমণে পাকা হইয়াছে; পুরুষ অভিভাবকের অপেক্ষা পুরবালাকেই তিনি পথসঙ্কটে সহায়রূপে আশ্রয় করিয়াছেন। হঠাৎ তাহার অসম্মতিতে বিপন্ন হইয়া জগত্তারিণী তাঁহার জামাতার মুখের দিকে চাহিলেন।
অক্ষয় তাঁহার শ্বাশুড়ির মনের ভাব বুঝিয়া কহিলেন—সে কি হয়? তুমি মার সঙ্গে না গেলে ওঁর অসুবিধা হবে। আচ্ছা মা, তুমি এগোও, আমি ওকে ঠিক সময়ে ষ্টেশনে নিয়ে যাব। জগত্তারিণী নিশ্চিন্ত হইয়া প্রস্থান করিলেন। রসিক দাদা টাকে হাত বুলাইতে বুলাইতে বিদায় কালীন বিমর্ষতা মুখে আনিবার জন্য চেষ্টা করিতে লাগিলেন।
অক্ষয়। কে মশায়! আপনি কে?
“আজ্ঞে মশায়, আপনার সহধর্ম্মিণীর সঙ্গে আমার বিশেষ সম্বন্ধ আছে” বলিয়া পুরুষ বেশধারী শৈল অক্ষয়ের সঙ্গে শেক হ্যাণ্ড্, করিল।
শৈল। মুখুজ্জেমশায় চিন্তে ত পারলে না?
পুরবালা। অবাক্ করলি! লজ্জা করচে না?
শৈল। দিদি, লজ্জা যে স্ত্রীলোকের ভূষণ—পুরুষের বেশ ধরতে গেলেই সেটা পরিত্যাগ করতে হয়। তেমনি আবার মুখুজ্জেমশায় যদি মেয়ে সাজেন, উনি লজ্জায় মুখ দেখাতে পারবেন না। রসিক দাদা, চুপ করে রৈলে যে।
রসিক। আহা শৈল! যেন কিশোর কন্দর্প! যেন সাক্ষাৎ কুমার, ভবানীর কোল থেকে উঠে এল! ওকে বরাবর শৈল বলে দেখে আস্চি, চোখে অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল, ও সুন্দরী, কি মাঝারি, কি চলনসই সে কথা কখনো মনেও ওঠেনি—আজ ঐ বেশটি বদল করেছে বলেই ত ওর রূপ খানি ধরা দিলে! পুরো দিদি, লজ্জার কথা কি বল্চিস্ আমার ইচ্ছে করচে ওকে টেনে নিয়ে ওর মাথায় হাত দিয়ে আশীর্ব্বাদ করি!
পুরবালা শৈলের তরুণ সুকুমার প্রিয়দর্শন পুরুষ মূর্ত্তিতে মনে মনে মুগ্ধ হইতেছিল। গভীর বেদনার সহিত তাহার কেবলি মনে হইতেছিল, আহা শৈল আমাদের বোন না হয়ে যদি ভাই হত! ওর এমন রূপ এমন বুদ্ধি ভগবান সমস্তই ব্যর্থ করে দিলেন। পুরবালার স্নিগ্ধ চোখ দুইটী ছল ছল করিয়া উঠিল।
অক্ষয় স্নেহাভিষিক্ত গাম্ভীর্যের সহিত ছদ্মবেশিনীকে ক্ষণকাল নিরীক্ষণ করিয়া বলিলেন—সত্যি বলছি শৈল, তুমি যদি আমার শ্যালী না হয়ে আমার ছোট ভাই হতে তা হলেও আমি আপত্তি করতুম না।
শৈল ঈষৎ বিচলিত হইয়া কহিল, আমিও কর্ত্তুম না মুখুজ্জেমশায়! বাস্তবিক ইহারা দুই ভাইয়ের মতই ছিল। কেবল সেই ভ্রাতৃভাবের সহিত কৌতুকময় বয়স্যভাব মিশ্রিত হইয়া কোমল সম্বন্ধ উজ্জল হইয়া উঠিয়াছিল।
পুরবালা শৈলকে বুকের কাছে টানিয়া কহিল, এই বেশে তুই কুমার সভার সভ্য হতে যাচ্চিস্ শৈল?
শৈল। অন্য বেশে হতে গেলে যে ব্যাকরণের দোষ হয় দিদি! কি বল রসিক দাদা!
রসিক। তা ত বটেই, ব্যাকরণ বাঁচিয়ে ত চলতেই হবে। ভগবান পাণিনি বোপদেব এঁরা কি জন্যে জন্মগ্রহণ করেছিলেন? কিন্তু ভাই শ্রীমতী শৈলবালার উত্তর চাপ্ কান্ প্রত্যয় করলেই কি ব্যাকরণ রক্ষে হয়!
অক্ষয়। নতুন মুগ্ধবোধে তাই লেখে। আমি লিখে পড়ে দিতে পারি চিরকুমার সভার মুগ্ধদের কাছে শৈল যেমন প্রত্যয় করাবে তাঁরা তেমনি প্রত্যয় যাবেন। কুমারদের ধাতু আমি জানি কি না।
পুরবালা একটুখানি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া শৈলকে কহিল—তোর মুখুজ্জেমশায়কে আর এই বুড়ো সমবয়সীটিকে নিয়ে তোর খেলা তুই আরম্ভ কর—আমি মার সঙ্গে কাশী চল্লুম।
পুরবালা এই সকল নিয়মবিরুদ্ধ ব্যাপার মনে মনে পছন্দ করিত না। কিন্তু তাহার স্বামীর ও ভগিনীটির- বিচিত্র কৌতুক লীলায় সর্ব্বদা বাধা দিতেও তাহার মন সরিত না। নিজের স্বামী-সৌভাগ্যের কথা স্মরণ করিয়া বিধবা বোনটির প্রতি তাহার করুণা ও প্রশ্রয়ের অন্ত ছিল না। ভাবিত, হতভাগিনী যেমন করিয়া ভুলিয়া থাকে থাক্। পুরবালা জিনিষপত্র গুছাইতে গেল।
এমন সময় নৃপবালা ও দীরবালা ঘরে প্রবেশ করিয়াই পলায়নোদ্যত হইল। নীর দরজার আড়াল হইতে আর একবার ভাল করিয়া তাকাইয়া “মেজদিদি” বলিয়া ছুটিয়া আসিল—কহিল, মেজদিদি তােমাকে ভাই জড়িয়ে ধর্ত্তে ইচ্ছে করছে, কিন্তু ঐ চাপকানে বাধ্ছে। মনে হচ্চে তুমি যেন কোন্ রূপকথার রাজপুত্র, তেপান্তর মাঠ পেরিয়ে আমাদের উদ্ধার করতে এসেচ।
নীরর সমুচ্চ কণ্ঠস্বরে আশ্বস্ত হইয়া নৃপও ঘরে প্রবেশ করিয়া মুগ্ধ নেত্রে চাহিয়া রহিল। নীর তাহাকে টানিয়া লইয়া কহিল, অমন করে লােভীর মত তাকিয়ে আছিস্ কেন? যা মনে করছিস্ তা নয়, ও তাের দুষ্যন্ত নয়―ও আমাদের মেজদিদি!
রসিক।ইয়মধিকমনােজ্ঞা চাপ্কানেনাপি তন্বী
কিমিব হি মধুরানাং মণ্ডনং নাকৃতীনাম্!
অক্ষয়। মূঢ়ে, তােরা কেবল চাপ্কানটা দেখেই মুগ্ধ! গিল্টির এত আদর? এদিকে যে খাঁটি সােনা দাঁড়িয়ে হাহাকার করচে।
নীর। আজ কাল খাঁটি সােনার দর যে বড় বেশি, আমাদের এই গিল্টিই ভাল! কি বল ভাই মেজদিদি! বলিয়া শৈলর কৃত্রিম গোঁফটা একটু পাকাইয়া দিল।
রসিক। (নিজেকে দেখাইয়া) এই খাঁটি সােনাটি খুব সস্তায় যাচ্চে ভাই—এখনাে কোন ট্যাঁকশালে গিয়ে কোন মহারাণীর ছাপটি পর্য্যন্ত পড়েনি!
নীর। আচ্ছা বেশ, সেজদিদিকে দান করলুম। (বলিয়া রসিক দাদার হাত ধরিয়া নৃপর হাতে সমর্পণ করিল)। রাজি আছিস্ ত ভাই?
নৃপ। তা আমি রাজি আছি।―বলিয়া রসিকদাদাকে একটা চৌকীতে বসাইয়া সে তাহার মাথার পাকাচুল তুলিয়া দিতে লাগিল।
নীর শৈলর কৃত্রিম গোঁফে তা দিয়া পাকাইয়া তুলিবার চেষ্টা করিতে লাগিল। শৈল কহিল—আঃ কি কর্চিস্ আমার গোঁফ পড়ে যাবে!
রসিক। কাজ কি, এদিকে আয়না ভাই, এ গোঁফ কিছুতেই পড়বে না।
নীর। আবার! ফের! সেজদিদির হাতে সঁপে দিলুম কি কর্ত্তে? আচ্ছা রসিক দাদা, তোমার মাথার দুটো একটা চুল কাঁচা আছে, কিন্তু গোঁফ আগাগোড়া পাকালে কি করে?
রসিক। কারো কারো মাথা পাক্বার আগে মুখটা পাকে!
নীর। দিদিদের সভাটা কোন্ ঘরে বস্বে মুখুজ্জে মশায়?
অক্ষয়। আমার বসবার ঘরে।
নীর। তাহলে সে ঘরটা একটু সাজিয়ে গুজিয়ে দিইগে!
অক্ষয়। যতদিন আমি সে ঘরটা ব্যবহার করচি, একদিনও সাজাতে ইচ্ছে হয় নি বুঝি?
নীর। তোমার জন্যে ঝড়ু বেহারা আছে তবু বুঝি আশা মিট্ল না?
পুরবালার প্রবেশ।
পুর। কি হচ্চে তোমাদের?
নীর। মুখুজ্জেমশায়ের কাছে পড়া বলে নিতে এসেছি দিদি। তা উনি বলচেন ওঁর বাইরের ঘরটা ভাল করে ঝেড়ে সাজিয়ে না দিলে উনি পড়াবেন না। তাই সেজদিদিতে আমাতে ওঁর ঘর সাজাতে যাচ্চি! আয় ভাই!
নৃপ। তোর ইচ্ছে হয়েছে তুই ঘর সাজাতে যা না—আমি যাবনা!
নীর। বাঃ, আমি একা খেটে মরব, আর তুমি সুদ্ধ তার ফল পাবে সে হবে না!―নৃপকে গ্রেফতার করিয়া লইয়া নীর চলিয়া গেল।
পুর। সব গুছিয়ে নিয়েছি। এখনো ট্রেণ যাবার দেরী আছে বোধ হয়।
অক্ষয়। যদি মিস্ করতে চাও তাহলে ঢের দেরি আছে।
পুর। তা হলে চল, আমাকে ষ্টেশনে পৌঁছিয়ে দেবে। চল্লুম রসিক দাদা—তুমি এখানে রইলে, এই শিশুগুলিকে একটু সাম্লে রেখ! (প্রণাম)
রসিক। কিছু ভেবো না দিদি, এরা সকলে আমাকে যে রকম বিপরীত ভয় করে, টুঁ শব্দটি করতে পারবে না।
শৈল। দিদি ভাই, তুমি একটু থাম! আমি এই কাপড়টা ছেড়ে এসে তােমাকে প্রণাম করচি।
পুর। কেন! ছাড়তে মন গেল যে?
শৈল। না ভাই, এ কাপড়ে নিজেকে আর এক জন বলে মনে হয় তােদের গায়ে হাত দিতে ইচ্ছে হয় না। রসিক দাদা এই নাও, আমার গোঁফটা সাবধানে রেখে দাও, হারিয়াে না!