প্রজাপতির নির্বন্ধ/৬
(৬)
শ্রীশ তাহার বাসায় দক্ষিণের বারান্দায় একখানা বড়হাতা ওয়ালা কেদারার দুই হাতার উপর দুই পা তুলিয়া দিয়া শুক্লসন্ধ্যায় চুপচাপ বসিয়া সিগারেট ফুঁকিতেছিল। পাশে টিপায়ের উপর রেকাবীতে একটি গ্লাস বরফ দেওয়া লেমনেড ও স্তূপাকার কুন্দফুলের মালা।
বিপিন পশ্চাৎ হইতে প্রবেশ করিয়া তাহার স্বাভাবিক প্রবল গম্ভীর কণ্ঠে ডাকিয়া উঠিল—কি গাে সন্ন্যাসী ঠাকুর!
শ্রীশ তৎক্ষণাৎ হাতা হইতে পা নামাইয়া উঠিয়া বসিয়া উচ্চৈঃস্বরে হাসিয়া উঠিল—কহিল, এখনো বুঝি ঝগড়া ভুল্তে পার নি?
শ্রীশ কিছুক্ষণ আগেই ভাবিতেছিল, একবার বিপিনের ওখানে যাওয়া যাক্। কিন্তু শরৎ সন্ধ্যার নির্ম্মল জ্যোৎস্নার দ্বারা আবিষ্ট হইয়া নড়িতে পারিতেছিল না। একটি গ্লাস্ বরফশীতল লেমনেড ও কুন্দফুলের মালা আনাইয়া জ্যোৎস্নাশুভ্র আকাশে সিগারেটের ধূমসহযোগে বিচিত্র কল্পনাকুণ্ডলী নির্ম্মাণ করিতেছিল।
শ্রীশ। আচ্ছা ভাই, শিশুপালক, তুমি কি সত্যি মনে কর আমি সন্ন্যাসী হতে পারিনে?
বিপিন। কেন পার্ব্বে না! কিন্তু অনেকগুলি তল্পিদার চেলা সঙ্গে থাকা চাই।
শ্রীশ। তার তাৎপর্য্য এই যে, কেউ বা আমার বেলফুলের মালা গেঁথে দেবে, কেউবা বাজার থেকে লেমনেড ও বরফ ভিক্ষে করে আন্বে, এই ত? তাতে ক্ষতিটা কি? যে সন্ন্যাস ধর্ম্মে বেলফুলের প্রতি বৈরাগ্য এবং ঠাণ্ডা লেমনেডের প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মায় সেটা কি খুব উঁচুদরের সন্ন্যাস?: বিপিন। সাধারণ ভাষায় ত সন্ন্যাসধর্ম্ম বলতে সেই রকমটাই বোঝায়।
শ্রীশ। ঐ শোন! তুমি কি মনে কর ভাষায় একটা কথার একটা বৈ অর্থ নেই? এক জনের কাছে সন্ন্যাসী কথাটার যে অর্থ, আর একজনের কাছেও যদি ঠিক সেই অর্থ ই হয় তা হলে মন বলে একটা স্বাধীন পদার্থ আছে কি কর্ত্তে?
বিপিন। তোমার মন সন্ন্যাসী কথাটার কি অর্থ করচেন আমার মন সেইটি শোনবার জন্য উৎসুক হয়েছেন!
শ্রীশ। আমার সন্ন্যাসীর সাজ এই রকম—গলায় ফুলের মালা, গায়ে চন্দন, কানে কুণ্ডল, মুখে হাস্য। আমার সন্ন্যাসীর কাজ মানুষের চিত্ত আকর্ষণ। সুন্দর চেহারা, মিষ্টি গলা, বক্তৃতায় অধিকার, এ সমস্ত না থাকলে সন্ন্যাসী হয়ে উপযুক্ত ফল পাওয়া যায় না। রুচি বুদ্ধি কার্য্যক্ষমতা ও প্রফুল্লতা, সকল বিষয়েই আমার সন্ন্যাসী সম্প্রদায়কে গৃহস্থের আদর্শ হতে হবে।
বিপিন। অর্থাৎ একদল কার্ত্তিককে ময়ুরের উপর চড়ে রাস্তায় বেরতে হবে।
শ্রীশ। ময়ূর না পাওয়া যায়, ট্রাম, আছে, পদব্রজেও নারাজ নই। কুমার সভা মানেই ত কার্ত্তিকের সভা। কিন্তু কার্ত্তিক কি কেবল সুপুরুষ ছিলেন? তিনিই ছিলেন স্বর্গের সেনাপতি।
বিপিন। লড়াইয়ের জন্যে তাঁর দুটি মাত্র হাত, কিন্তু বক্তৃতা করবার জন্যে তাঁর তিন জোড়া মুখ।
শ্রীশ। এর থেকে প্রমাণ হয় আমাদের আর্য্য পিতামহরা বাহুবল অপেক্ষা বাক্যবলকে তিন গুণ বেশী বলেই জান্তেন। আমিও পালোয়ানীকে বীরত্বের আদর্শ বলে মানিনে।
বিপিন। ওটা বুঝি আমার উপর হ’ল?
শ্রীশ। ঐ দেখ! মানুষকে অহঙ্কারে কি রকম মাটি করে। তুমি ঠিক করে রেখেচ, পালোয়ান বল্লেই তোমাকে বলা হল! তুমি কলিযুগের ভীমসেন! আচ্ছা এস, যুদ্ধং দেহি! একবার বীরত্বের পরীক্ষা হয়ে যাক্!
এই বলিয়া দুই বন্ধু ক্ষণকালের জন্য লীলাচ্ছলে হাত কাড়াকাড়ি করিতে লাগিল। বিপিন হঠাৎ “এইবার ভীমসেনের পতন” বলিয়া ধপ করিয়া শ্রীশের কেদারাটা অধিকার করিয়া তাহার উপরে দুই পা তুলিয়া দিল; এবং “উঃ অসহ তৃষ্ণা” বলিয়া লেমনেডের গ্লাসটি এক নিঃশ্বাসে খালি করিল। তখন শ্রীশ তাড়াতাড়ি কুন্দফুলের মালাটি সংগ্রহ করিয়া—“কিন্তু বিজয় মাল্যটি আমার” বলিয়া সেটা মাথায় জড়াইল এবং বেতের মোড়াটার উপরে বসিয়া কহিল আচ্ছা ভাই সত্যি বল, একদল শিক্ষিত লোক যদি এই রকম সংসার পরিত্যাগ করে’ পরিপাটি সজ্জায় প্রফুল্ল প্রসন্ন মুখে গানে এবং বক্তৃতায় ভারতবর্ষের চতুর্দ্দিকে শিক্ষা বিস্তার করে’ বেড়ায় তাতে উপকার হয় কি না?
বিপিন এই তর্কটা লইয়া বন্ধুর সঙ্গে আর ঝগড়া করিতে ইচ্ছা করিল না―কহিল, আইডিয়াটা ভাল বটে!
শ্রীশ। অর্থাৎ শুন্তে সুন্দর কিন্তু কর্ত্তে অসাধ্য! আমি বল চি অসাধ্য নয় এবং আমি দৃষ্টান্ত দ্বারা তার প্রমাণ করব। ভারতবর্ষে সন্ন্যাসধর্ম্ম বলে একটা প্রকাণ্ড শক্তি আছে, তার ছাই ঝেড়ে তার ঝুলিটা কেড়ে নিয়ে তার জটা মুড়িয়ে তাকে সৌন্দর্য্য এবং কর্ম্মনিষ্ঠায় প্রতিষ্ঠিত করাই চিরকুমার সভার একমাত্র উদ্দেশ্য। ছেলে পড়ান এবং দেশলাইয়ের কাটি তৈরি করবার জন্যে আমাদের মত লোক চিরজীবনের ব্রত অবলম্বন করে নি। বল বিপিন, তুমি আমার প্রস্তাবে রাজি আছ কি না?
বিপিন। তোমার সন্ন্যাসীর যে রকম চেহারা গলা এবং আস বাবের প্রয়োজন আমার ত তার কিছুই নেই। তবে তল্পিদার হয়ে পিছনে যেতে রাজি আছি! কানে যদি সোনার কুণ্ডল, অন্তত চোখে যদি সোনার চস্মাটা পরে’ যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়াও তা হলে একটা প্রহরীর দরকার, সে কাজটা আমার দ্বারা কতকটা চল্তে পারবে!
শ্রীশ। আবার ঠাট্টা।
বিপিন। না ভাই ঠাট্টা নয়। আমি সত্যিই বলছি তোমার প্রস্তাবটাকে যদি সম্ভবপর করে’ তুলতে পার তা হলে খুব ভালই হয়। তবে এরকম একটা সম্প্রদায়ে সকলেরই কাজ সমান হতে পারে না, যার যেমন স্বাভাবিক ক্ষমতা সেই অনুসারে যোগ দিতে পারে।
শ্রীশ। সে ত ঠিক কথা। কেবল একটি বিষয়ে আমাদের খুব দৃঢ় হতে হবে, স্ত্রীজাতির কোন সংস্রব রাখ্ব না!
বিপিন। মাল্যচন্দন অঙ্গদকুণ্ডল সবই রাখতে চাও কেবল ঐ একটা বিষয়ে অত বেশী দৃঢ়তা কেন?
শ্রীশ। ঐ গুলো রাখচি বলেই দৃঢ়তা। যে জন্যে চৈতন্য তাঁর অনুচরদের স্ত্রীলোকের সঙ্গ থেকে কঠিন শাসনে রেখেছিলেন। তাঁর বর্ম্ম, অনুরাগ এবং সৌন্দর্য্যের ধর্ম্ম, সে জন্যেই তার পক্ষে প্রলোভনের ফাঁদ অনেক ছিল।
বিপিন। তা হলে ভয়টুকুও আছে!
শ্রীশ। আমার নিজের জন্য লেশমাত্র নেই। আমি আমার মনকে পৃথিবীর বিচিত্র সৌন্দর্য্যে ব্যাপ্ত করে রেখে দিই, কোনও একটা ফাঁদে আমাকে ধরে কার সাধ্য, কিন্তু তোমরা যে দিনরাত্রি ফুট্বল্ টেনিস ক্রিকেট নিয়ে থাক―তোমরা একবার পড়লে ব্যাট্বল্ গুলিডাণ্ডা সব সুদ্ধ ঘাড়মোড় ভেঙে পড়বে।
বিপিন। আচ্ছা ভাই, সময় উপস্থিত হলে দেখা যাবে।
শ্রীশ। ও কথা ভাল নয়! সময় উপস্থিত হবে না, সময় উপস্থিত হতে দেব না। সময় ত রথে চড়ে আসেন না―আমরা তাঁকে ঘাড়ে করে নিয়ে আসি―কিন্তু তুমি যে সময়টার কথা বলচ তাকে বহন অভাবে ফিরতেই হবে।
পূর্ণবাবুর প্রবেশ।
উভয়ে। এস পূর্ণ বাবু!
বিপিন তাহাকে কেদারাটা ছাড়িয়া দিয়া একটা চৌকী টানিয়া লইয়া বসিল। পূর্ণর সহিত শ্রীশ ও বিপিনের তেমন ঘনিষ্ঠতা ছিল না বলিয়া তাহাকে দুজনেই একটু বিশেষ খাতির করিয়া চলিত।
পূর্ণ। তোমাদের এই বারান্দায় জ্যোৎস্নাটির মন রচনা কর নি―মাঝে মাঝে থামের ছায়া ফেলে ফেলে সাজিয়েছ ভাল!
শ্রীশ। ছাদের উপর জ্যোৎস্না রচনা করা প্রভৃতি কতকগুলি অত্যাশ্চর্য্য ক্ষমতা জন্মাবার পূর্ব্ব হতেই আমার কাছে। কিন্তু দেখ পূর্ণ বাবু, ঐ দেশলাই করা টরা ও গুলো আমার ভাল আসে না।
পূর্ণ। (ফুলের মালার দিকে চাহিয়া) সন্ন্যাসধর্ম্মেই কি তোমার অসামান্য দখল আছে না কি?
শ্রীশ। সেই কথাইত হচ্ছিল। সন্ন্যাসধর্ম্ম তুমি কাকে বল শুনি!
পূর্ণ। যে ধর্ম্মে দর্জ্জি ধোবা নাপিতের কোন সহায়তা নিতে হয় না, তাঁতীকে একেবারেই অগ্রাহ্য করিতে হয়, পিয়ার্সসােপের বিজ্ঞাপনের দিকে দৃক্পাত করতে হয় না―
শ্রীশ। আরে ছিঃ, সে সন্ন্যাসধর্ম্ম ত বুড়াে হয়ে মরে গেছে—এখন নবীন সন্ন্যাসী বলে’ একটা সম্প্রদায় গড়্তে হবে—
পূর্ণ। বিদ্যাসুন্দরের যাত্রায় যে নবীন সন্ন্যাসী আছেন তিনি মন্দ দৃষ্টান্ত নন্—কিন্তু তিনি ত চিরকুমার সভার বিধানমতে চলেন নি।
শ্রীশ। যদি চল্তেন তা হলে তিনিই ঠিক দৃষ্টান্ত হতে পার্ত্তেন। সাজে সজ্জায় বাক্যে আচরণে সুন্দর এবং সুনিপুণ হতে হবে—
পূর্ণ। কেবল রাজকন্যার দিক থেকে দৃষ্টি নামাতে হবে এই ত? বিনি সুতোর মালা গাঁথতে হবে কিন্তু সে মালা পরাতে হবে কার গলায় হে?
শ্রীশ। স্বদেশের! কথাটা কিছু উচ্চ শ্রেণীর হয়ে পড়ল, কি করব বল, মালিনী মাসী এবং রাজকুমারী একেবারেই নিষিদ্ধ কিন্তু ঠাট্টা নয় পূর্ণ বাবু—
পূর্ণ। ঠাট্টার মত মােটেই শোনাচ্চেনা—ভয়ানক কড়া কথা, একেবারে খট্খটে শুক্নো!
শ্রীশ। আমাদের চিরকুমার সভা থেকে এমন একটি সন্ন্যাসী সম্প্রদায় গঠন করতে হবে যারা রুচি, শিক্ষা ও কর্ম্মে সকল গৃহস্থের আদর্শ হবে। যারা সঙ্গীত প্রভৃতি কলাবিদ্যায় অদ্বিতীয় হবে, আবার লাঠি তলােয়ার খেলা, ঘােড়ায় চড়া, বন্দুক লক্ষ্য করায় পারদর্শী হবে—
পূর্ণ। অর্থাৎ মনােহরণ এবং প্রাণ হরণ দুই কর্ম্মেই মজবুত হবে। পুরুষ দেবী চৌধুরাণীর দল আর কি।
শ্রীশ। বঙ্কিম বাবু আমার আইডিয়াটা পূর্ব্বে হতেই চুরি করে রেখেছেন—কিন্তু ওটাকে কাজে লাগিয়ে আমাদের নিজের করে নিতে হবে।
পূর্ণ। সভাপতি মশায় কি বলেন?
শ্রীশ। তাঁকে ক’দিন ধরে বুঝিয়ে বুঝিয়ে আমার দলে টেনে নিয়েছি। কিন্তু তিনি তাঁর দেশলাইয়ের কাঠি ছাড়েন নি। তিনি বলেন সন্ন্যাসীরা কৃষিতত্ত্ব বস্তুতত্ত্ব প্রভৃতি শিখে গ্রামে গ্রামে চাষাদের শিখিয়ে বেড়াবে―এক টাকা করে শেয়ার নিয়ে একটা ব্যাঙ্ক খুলে বড় বড় পল্লীতে নূতন নিয়মে এক একটা দোকান বসিয়ে আস্বে—ভারতবর্ষের চারিদিকে বাণিজ্যের জাল বিস্তার করে দেবে। তিনি খুব মেতে উঠেছেন।
পূর্ণ। বিপিন বাবুর কি মত?
বিপিনের মতে শ্রীশের এই কল্পনাটি কার্য্যসাধ্য নয়, কিন্তু শ্রীশের সর্ব্বপ্রকার পাগ্লামিকে সে স্নেহের চক্ষে দেখিত;― প্রতিবাদ করিয়া শ্রীশের উৎসাহে আঘাত দিতে তাহার কোনমতেই মন সরিত না। সে বলিল—যদিচ আমি নিজেকে শ্রীশের নবীন সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের আদর্শ পুরুষ বলে জ্ঞান করিনে কিন্তু দল যদি গড়ে ওঠে ত আমিও সন্ন্যাসী সাজ্তে রাজি আছি।
পূর্ণ। কিন্তু সাজ্তে খরচ আছে মশায়—কেবল কৌপীন নয় ত― অঙ্গদ, কুণ্ডল, আভরণ, কুন্তলীন, দেল খোস―
শ্রীশ। পূর্ণ বাবু ঠাট্টাই কর আর যাই কর, চিরকুমার সভা সন্ন্যাসী সভা হবেই। আমরা একদিকে কঠোর আত্মত্যাগ করব, অন্যদিকে মনুষ্যত্বের কোন উপকরণ থেকে নিজেদের বঞ্চিত করব না― আমরা কঠিন শোর্য্য এবং ললিত সৌন্দর্য্য উভয়কেই সমান আদরে বরণ করব―সেই দুরূহ সাধনায় ভারতবর্ষে নবযুগের আবির্ভাব হবে
পূর্ণ। বুঝেছি শ্রীশবাবু—কিন্তু নারী কি মনুষ্যত্বের একটা সর্ব্বপ্রধান উপকরণের মধ্যে গণ্য নয়? এবং তাঁকে উপেক্ষা করলে ললিত সৌন্দর্য্যের প্রতি কি সমাদর রক্ষা হবে? তার কি উপায় করলে?
শ্রীশ। নারীর একটা দোষ নরজাতিকে তিনি লতার মত বেষ্টন করে ধরেন, যদি তাঁর দ্বারা বিজড়িত হবার আশঙ্কা না থাক্ত, যদি তাঁকে রক্ষা করেও স্বাধীনতা রক্ষা করা যেত, তা হলে কোন কথা ছিল না। কাজে যখন জীবন উৎসর্গ করতে হবে তখন কাজের সমস্ত বাধা দূর করতে চাই—পাণিগ্রহণ করে ফেল্লে নিজের পাণিকেও বন্ধ করে ফেল্তে হবে, সে হলে চল্বে না পূর্ণবাবু।
পূর্ণ। ব্যস্ত হোয়না ভাই, আমি আমার শুভ বিবাহে তোমাদের নিমন্ত্রণ করতে আসিনি। কিন্তু ভেবে দেখ দেখি, মনুষ্য জন্ম আর পাব কি না সন্দেহ―অথচ হৃদয়কে চিরজীবন যে পিপাসার জল থেকে বঞ্চিত করতে যাচ্চি তার পূরণস্বরূপ আর কোথাও আর কিছু জুট্বে কি? মুসলমানের স্বর্গে হুরি আছে হিন্দুর স্বর্গেও অপ্সরার অভাব নেই, চিরকুমার সভার স্বর্গে সভাপতি এবং সভ্যমহাশয়দের চেয়ে মনোরম আর কিছু পাওয়া যাবে কি!
শ্রীশ। পূর্ণবাবু বল কি? তুমি যে―
পূর্ণ। ভয় নেই ভাই, এখনো মরিয়া হয়ে উঠিনি। তোমার এই ছাদভরা জ্যোৎস্না আর ঐ ফুলের গন্ধ কি কৌমার্য্যব্রতরক্ষার সহায়তা করবার জন্যে সৃষ্ট হয়েছে? মনের মধ্যে মাঝে মাঝে যে বাষ্প জমে আমি সেটাকে উচ্ছ্বসিত করে দেওয়াই ভাল বোধ করি—চেপে রেখে নিজেকে ভোলাতে গেলে কোন্ দিন চিরকুমারব্রতের লোহার বয়লার খানা ফেটে যাবে। যাই হোক্ যদি সন্ন্যাসী হওয়াই স্থির কর ত আমিও যোগ দেব―কিন্তু আপাততঃ সভাটাকে ত রক্ষা করতে হবে।
শ্রীশ। কেন? কি হয়েছে?
পূর্ণ। অক্ষয় বাবু আমাদের সভাকে যে স্থানান্তর করবার ব্যবস্থা করচেন এটা আমার ভাল ঠেক্চে না।
শ্রীশ। সন্দেহ জিনিষটা নাস্তিকতার ছায়া। মন্দ হবে, ভেঙে যাবে, নষ্ট হবে এ সব ভাব আমি কোন অবস্থাতেই মনে স্থান দিইনে। ভালই হবে—যা হচ্চে বেশ হচ্চে―চিরকুমার সভার উদার বিস্তীর্ণ ভবিষ্যৎ আমি চোখের সম্মুখে দেখ তে পাচ্চি—অক্ষয় বাবু সভাকে এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে তার কি অনিষ্ট কর্তে পারেন? কেবল গলির এক নম্বর থেকে আরেক নম্বরে নয়, আমাদের যে পথে পথে দেশে দেশে সঞ্চরণ করে বেড়াতে হবে! সন্দেহ শঙ্কা উদ্বেগ এগুলো মন থেকে দূর করে দাও পূর্ণবাবু―বিশ্বাস এবং আনন্দ না হলে বড় কাজ হয় না!
পূর্ণ নিরুত্তর হইয়া বসিয়া রহিল। বিপিন কহিল―দিনকতক দেখাইযাক্ না—যদি কোন অসুবিধার কারণ ঘটে তা হলে স্বস্থানে ফিরে আসা যাবে—আমাদের সেই অন্ধকার বিবরটি ফস্ করে কেউ কেড়ে নিচ্ছে না!
হায়, পূর্ণের হৃদয় বেদনা কে বুঝিবে?
অকস্মাৎ চন্দ্রমাধব বাবুর সবেগে প্রবেশ। তিন জনের সসম্ভ্রমে উত্থান।
চন্দ্র। দেখ আমি সেই কথাটা ভাবছিলুম―
শ্রীশ। বসুন!
চন্দ্র। না, না, বস্ব না, আমি এখনি যাচ্চি! আমি বল্ছিলুম, সন্ন্যাসব্রতের জন্যে আমাদের এখন থেকে প্রস্তুত হতে হবে। হঠাৎ একটা অপঘাত ঘট্লে, কিংবা সাধারণ জ্বরজালায়, কি রকম চিকিৎসা সে আমাদের শিক্ষা করতে হবে―ডাক্তার রামরতন বাবু ফি রবিবারে আমাদের দুঘণ্টা করে বক্তৃতা দেবেন বন্দোবস্ত করে এসেছি।
শ্রীশ। কিন্তু তাতে অনেক বিলম্ব হবে না?
চন্দ্র। বিলম্ব ত হবেই, কাজটিত সহজ নয়। কেবল তাই নয়―আমাদের কিছু কিছু আইন অধ্যয়নও দরকার। অবিচার অত্যাচার থেকে রক্ষা করা, এবং কার কতদূর অধিকার সেটা চাষাভূষোদের বুঝিয়ে দেওয়া আমাদের কাজ।
শ্রীশ। চন্দ্রবাবু বসুন্
চন্দ্র। না শ্রীশবাবু, বস্তে পারচিনে, আমার একটু কাজ আছে। আর একটি আমাদের করতে হচ্চে—গোরুর গাড়ি, ঢেঁকি, তাঁত প্রভৃতি আমাদের দেশী অত্যাবশ্যক জিনিষগুলিকে একটু আধ্টু সংশোধন করে যাতে কোন অংশে তাদের শস্তা বা মজবুৎ বা বেশী উপযোগী করে তুল্তে পারি সে চেষ্টা আমাদের করতে হবে। এবারে গর্ম্মির ছুটিতে কেদারবাবুদের কারখানায় গিয়ে প্রত্যহ আমাদের কতকগুলি পরীক্ষা করা চাই।
শ্রীশ। চন্দ্রবাবু অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছেন—(চৌকি অগ্রসরকরণ)।
চন্দ্র। না, না, আমি এখনি যাচ্ছি। দেখ আমার মত এই যে, এই সমস্ত গ্রামের ব্যবহার্য্য সামান্য জিনিষগুলির যদি আমরা কোন উন্নতি করতে পারি তা হলে তাতে করে চাষাদের মনের মধ্যে যে রকম আন্দোলন হবে, বড় বড় সংস্কার কার্য্যেও তেমন হবে না। তাদের সেই চিরকেলে ঢেঁকি ঘানির কিছু পরিবর্ত্তন করতে পারলে তবে তাদের সমস্ত মন সজাগ হয়ে উঠবে, পৃথিবী যে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই এ তারা বুঝতে পারবে―
শ্রীশ। চন্দ্রবাবু বসবেন না কি?
চন্দ্র। থাক্ না। একবার ভেবে দেখ আমরা যে এতকাল ধরে শিক্ষা পেয়ে আস্চি, উচিত ছিল আমাদের ঢেঁকি, কুলো থেকে তার পরিচয় আরম্ভ হওয়া। বড় বড় কল-কারখানা ত দূরের কথা, ঘরের মধ্যেই আমাদের সজাগ দৃষ্টি পড়ল না। আমাদের হাতের কাছে যা আছে আমরা না তার দিকে ভাল করে চেয়ে দেখলুম, না তার সম্বন্ধে কিছুমাত্র চিন্তা করলুম। যা ছিল তা তেমনিই রয়ে গেছে। মানুষ অগ্রসর হচ্চে অথচ তার জিনিষপত্র পিছিয়ে থাকচে, এ কখনো হতেই পারে না। আমরা পড়েই আছি―ইংরাজ আমাদের কাঁধে করে বহন করছে, তাকে এগোনো বলে না! ছোট খাটো সামান্য গ্রাম্য জীবনযাত্রা পল্লীগ্রামের পঙ্কিল পথের মধ্যে বদ্ধ হয়ে অচল হয়ে আছে, আমাদের সন্ন্যাসী সম্প্রদায়কে সেই গরুর গাড়ির চাকা ঠেল্তে হবে—কলের গাড়ির চালক হবার দুরাশা এখন থাক্! কটা বাজ্ল শ্রীশবাবু?
শ্রীশ। সাড়ে আটটা বেজে গেছে।
চন্দ্র। তা হলে আমি যাই। কিন্তু এই কথা রইল, আমাদের এখন অন্য সমস্ত আলোচনা ছেড়ে নিয়মিত শিক্ষাকার্য্যে প্রবৃত্ত হতে হবে এবং―
পূর্ণ। আপনি যদি একটু বসেন চন্দ্রবাবু তাহলে আমার দুই একটা কথা বলবার আছে―
চন্দ্র। না আজ আর সময় নেই―
পূর্ণ। বেশী কিছু নয় আমি বল্ছিলুম আমাদের সভা―
চন্দ্র। সে কথা কাল হবে পূর্ণবাবু―
পূর্ণ। কিন্তু কালই ত সভা বস্চে―
চন্দ্র। আচ্ছা তা হলে পরশু, আমার সময় নেই―
পূর্ণ। দেখুন, অক্ষয় বাবু যে―
চন্দ্র। পূর্ণবাবু আমাকে মাপ করতে হবে, আজ দেরি হয়ে গেছে। কিন্তু দেখ, আমার একটা কথা মনে হচ্ছিল যে, চিরকুমার সভা যদি ক্রমে বিস্তীর্ণ হয়ে পড়ে তাহলে আমাদের সকল সভ্যই কিছু সন্ন্যাসী হয়ে বেরিয়ে যেতে পারবেন না—অতএব ওর মধ্যে দুটি বিভাগ রাখা দরকার হবে―
পূর্ণ। স্থাবর এবং জঙ্গম।
চন্দ্র। তা সে যে নামই দাও। তা ছাড়া অক্ষয়বাবু সে দিন একটি কথা যা বল্লেন সেও আমার মন্দ লাগ্ল না। তিনি বলেন, চিরকুমার সভার সংস্রবে আর একটি সভা রাখা উচিত যাতে বিবাহিত এবং বিবাহসংকল্পিত লোকদের নেওয়া যেতে পারে। গৃহী লোকদেরও ত দেশের প্রতি কর্ত্তব্য আছে। সকলকেই সাধ্যমত কোন না কোন হিতকর কাজে নিযুক্ত থাক্তে হবে—এইটে হচ্ছে সাধারণ ব্রত। আমাদের একদল কুমারব্রত ধারণ করে দেশে দেশে বিচরণ করবেন, একদল কুমারব্রত ধারণ করে একজায়গায় স্থায়ী হয়ে বসে কাজ করবেন, আর একদল গৃহী নিজ নিজ রুচি ও সাধ্য অনুসারে একটা কোন প্রয়োজনীয় কাজ অবলম্বন করে দেশের প্রতি কর্ত্তব্য পালন করবেন। যাঁরা পর্য্যটক্ সম্প্রদায়ভুক্ত হবেন তাঁদের ম্যাপ প্রস্তুত, জরিপ, ভূতত্ত্ববিদ্যা, উদ্ভিদ বিদ্যা, প্রাণিতত্ত্ব প্রভৃতি শিখতে হবে, তাঁরা যে দেশে যাবেন সেখানকার সমস্ত তথ্য তন্ন তন্ন করে সংগ্রহ করবেন―তা হলেই ভারতবর্ষীয়ের দ্বারা ভারতবর্ষের যথার্থ বিবরণ লিপিবদ্ধ হবার ভিত্তি স্থাপিত হতে পারবে—হণ্টার সাহেবের উপরেই নির্ভর করে কাটাতে হবে না―
পূর্ণ। চন্দ্রবাবু যদি বসেন তা হলে একটা কথা―
চন্দ্র। না—আমি বল্ছিলুম―যেখানে যেখানে যাব সেখানকার ঐতিহাসিক জনশ্রুতি এবং পুরাতন পুঁথি সংগ্রহ করা আমাদের কাজ হবে—শিলালিপি, তাম্রশাসন এগুলোও সন্ধান করতে হবে—অতএব প্রাচীন লিপি পরিচয়টাও আমাদের কিছুদিন অভ্যাস করা আবশ্যক।
পূর্ণ। সে সব ত পরের কথা, আপাততঃ―
চন্দ্র। না, না, আমি বল্চিনে সকলকেই সব বিদ্যা শিখতে হবে, তা হলে কোন কালে শেষ হবে না। অভিরুচি অনুসারে ওর মধ্যে আমরা কেউবা একটা কেউবা দুটো তিনটে শিক্ষা করব―
শ্রীশ। কিন্তু তা হলেও―
চন্দ্র। ধর, পাঁচ বছর। পাঁচ বছরে আমরা প্রস্তুত হয়ে বেরতে পারব। যারা চিরজীবনের ব্রত গ্রহণ করবে, পাঁচ বছর তাদের পক্ষে কিছুই নয়। তা ছাড়া এই পাঁচ বছরেই আমাদের পরীক্ষা হয়ে যাবে―যাঁরা টিকে থাক্তে পারবেন তাঁদের সম্বন্ধে আর কোন সন্দেহ থাকবে না।
পূর্ণ। কিন্তু দেখুন, আমাদের সভাটা যে স্থানান্তর করা হচ্চে,―
চন্দ্র। না পূর্ণবাবু আজ আর কিছুতেই না, আমার অত্যন্ত জরুরী কাজ আছে। পূর্ণবাবু আমার কথাগুলো ভাল করে চিন্তা করে দেখো। আপাততঃ মনে হতে পারে অসাধ্য― কিন্তু তা নয়। দুঃসাধ্য বটে―তা ভাল কাজ মাত্রই দুঃসাধ্য। আমরা যদি পাঁচটি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ লোক পাই তা হলে আমরা যা কাজ করব তা চিরকালের জন্য ভারতবর্ষকে আচ্ছন্ন করে দেবে।
শ্রীশ। কিন্তু আপনি যে বলছিলেন গোরুর গাড়ীর চাকা প্রভৃতি ছোট ছোট জিনিষ―
চন্দ্র। ঠিক কথা, আমি তাকেও ছোট মনে করে উপেক্ষা করিনে― এবং বড় কাজকেও অসাধ্য জ্ঞান করে ভয় করিনে―
পূর্ণ। কিন্তু সভার অধিবেশন সম্বন্ধেও―
চন্দ্র। সে সব কথা কাল হবে পূর্ণবাবু! আজ তবে চল্লুম!
(চন্দ্রবাবুর দ্রুতবেগে প্রস্থান)
বিপিন। ভাই শ্রীশ, চুপচাপ যে! এক মাতালের মাৎলামী দেখে অন্য মাতালের নেশা ছুটে যায়। চন্দ্রবাবুর উৎসাহে তোমাকে সুদ্ধ দমিয়ে দিয়েছে।
শ্রীশ। না হে, অনেক ভাববার কথা আছে। উৎসাহ কি সব সময়ে কেবল বকাবকি করে? কখনো বা একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে থাকে, সেইটেই হল সাংঘাতিক অবস্থা।
বিপিন। পূর্ণবাবু হঠাৎ পালাচ্চ যে?
পূর্ণ। সভাপতি মশায়কে রাস্তায় ধরতে যাচ্চি―পথে যেতে যেতে যদি দৈবাৎ আমার দুটো একটা কথায় কর্ণপাত করেন।
বিপিন। ঠিক উল্টো হবে। তাঁর যে কটা কথা বাকি আছে সেই গুলো তোমাকে শোনাতে শোনাতে কোথায় যাবার আছে সে কথা ভুলেই যাবেন।
বনমালীর প্রবেশ।
বন। ভাল আছেন শ্রীশ বাবু? বিপিনবাবু ভাল ত? এই যে পূর্ণবাবুও আছেন দেখ্চি! তা বেশ হয়েছে। আমি অনেক বলে কয়ে সেই কুমারটুলির পাত্রী দুটিকে ঠেকিয়ে রেখেছি।
শ্রীশ। কিন্তু আমাদের আর ঠেকিয়ে রাখ্তে পারবেন না। আমরা একটা গুরুতর কিছু করে ফেল্ব।
পূর্ণ। আপনারা বসুন শ্রীশ বাবু। আমার একটা কাজ আছে।
বিপিন। তার চেয়ে আপনি বসুন পূর্ণবাবু। আপনার কাজটা আমরা দুজনে মিলে সেরে দিয়ে আসছি।
পূর্ণ। তার চেয়ে তিনজনে মিলে সারাই ত ভাল।
বন। আপনার ব্যস্ত হচ্ছেন দেখচি। আচ্ছা, তা আর এক সময় আস্ব।