প্রভাত সংগীত/নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ

লুয়া ত্রুটি মডিউল:Header_template এর 241 নং লাইনে: attempt to call method 'getId' (a nil value)।

নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ

আজি এ প্রভাতে প্রভাত-বিহগ
কী গান গাইল রে।
অতিদূর—দূর আকাশ হইতে
ভাসিয়া আইল রে।
না জানি কেমনে পশিল হেথায়
পথহারা তার একটি তান,
আঁধার গুহায় ভ্রমিয়া ভ্রমিয়া,
গভীর গুহায় নামিয়া নামিয়া,
আকুল হইয়া কাঁদিয়া কাঁদিয়া,
ছুঁয়েছে আমার প্রাণ
আজি এ প্রভাতে সহসা কেনরে
পথহারা রবি-কর
আলয় না পেয়ে পড়েছে আসিয়ে
আমার প্রাণের পর।
বহুদিন পরে একটি কিরণ
গুহায় দিয়েছে দেখা,
পড়েছে আমার আঁধার সলিলে
একটি কনক-রেখা।
প্রাণের আবেগ রাখিতে নারি,
থর থর করি কাঁপিছে বারি,
টলমল জল করে থল থল,
কল কল করি ধরেছে তান।

আজি এ প্রভাতে কী জানি কেনরে
জাগিয়া উঠেছে প্রাণ।
জাগিয়া দেখিনু চারিদিকে মোর
পাষাণে রচিত কারাগার ঘোর,
বুকের উপরে আঁধার বসিয়া
করিছে নিজের ধ্যান
না জানি কেনরে এত দিন পরে
জাগিয়া উঠেছে প্রাণ।

জাগিয়া দেখিনু আমি আঁধারে রয়েছি আঁধা
আপনারি মাঝে আমি আপনি রয়েছি বাঁধা।
রয়েছি মগন হয়ে আপনারি কলস্বরে,
ফিরে আসে প্রতিধ্বনি নিজেরি শ্রবণ পরে।
গভীর—গভীর গুহা, গভীর আঁধার ঘোর,
গভীর ঘুমন্ত প্রাণ একেলা গাহিছে গান,
মিশিছে স্বপন-গীতি বিজন হৃদয়ে মোর।
দূর—দূর—দূর হতে ভেদিয়া আঁধারকারা,
মাঝে মাঝে দেখা দেয় একটি সন্ধ্যার তারা।
ঘুমায়ে দেখিরে যেন স্বপনের মোহমায়া,
পড়েছে প্রাণের মাঝে একটি হাসির ছায়া।
তারি মুখ দেখে দেখে, আঁধার হাসিতে শেখে,;
তারি মুখ চেয়ে চেয়ে করে নিশি অবসান;
শিহরি উঠেরে বারি, দোলেরে—দোলেরে প্রাণ,
প্রাণের মাঝারে ভাসি, দোলেরে—দোলেরে হাসি,

দোলেরে প্রাণের পরে আশার স্বপন মম,
দোলেরে তারার ছায়া সুখের আভাস সম।
প্রণয়-প্রতিমা যবে স্বপনে দেখেরে কবি,
অধীর সুখের ভরে কাঁপে বুক থর থরে,
কম্পমান বক্ষ পরে দোলে সে মোহিনী ছবি;
দুখীর আঁধার প্রাণে সুখের সংশয় যথা,
দুলিয়া দুলিয়া সদা মৃদু মৃদু কহে কথা;
মৃদু ভয়, কভু মৃদু আশ,
মৃদু হাসি, কভু মৃদু শ্বাস।
বহুদিন পরে শোনা বিস্মৃত গানের তান,
দোলেরে প্রাণের মাঝে, দোলেরে আকুল প্রাণ;
আধো আধো জাগিছে স্মরণে,
পড়ে পড়ে, নাহি পড়ে মনে।
তেমনি তেমনি দোলে, তারাটি আমার কোলে,
করতালি দিয়ে বারি কল কল গান গায়,
দোলায়ে দোলায়ে যেন ঘুম পাড়াইতে চায়।

মাঝে মাঝে একদিন আকাশেতে নাই আলো,
পড়িয়া মেঘের ছায়া কালো জল হয় কালো।
আঁধার সলিল পরে ঝর ঝর বারি ঝরে
ঝর ঝর ঝর ঝর, দিবানিশি অবিরল,
বরষার দুখ-কথা, বরষার আঁখি-জল।
শুয়ে শুয়ে আনমনে দিবানিশি তাই শুনি,
একটি একটি ক’রে দিবানিশি তাই গুণি,

তারি সাথে মিলাইয়া কল কল গান গাই,
ঝর ঝর কল কল দিন নাই, রাত নাই।
এমনি নিজেরে ল’য়ে রয়েছি নিজের কাছে,
আঁধার সলিল পরে আঁধার জাগিয়া আছে।
এমনি নিজের কাছে খুলেছি নিজের প্রাণ,
এমনি পরের কাছে শুনেছি নিজের গান।
আজি এ প্রভাতে রবির কর
কেমনে পশিল প্রাণের পর,
কেমনে পশিল গুহার আঁধারে
প্রভার-পাখির গান।
না জানি কেনরে এত দিন পরে
জাগিয়া উঠিল প্রাণ।
জাগিয়া উঠেছে প্রাণ,
ওরে উথলি উঠেছে বারি,
ওরে প্রাণের বাসনা প্রাণের আবেগ
রুধিয়া রাখিতে নারি।
থর থর করি’ কাঁপিছে ভূধর,
শিলা রাশি রাশি পড়িছে খ’সে,
ফুলিয়া ফুলিয়া ফেনিল সলিল
গরজি উঠিছে দারুণ রোষে।
হেথায় হোথায় পাগলের প্রায়
ঘুরিয়া ঘুরিয়া মাতিয়া বেড়ায়,
বাহিরিতে চায়, দেখিতে না পায়
কোথায় কারার দ্বার।

প্রভাতেরে যেন লইতে কাড়িয়া
আকাশেরে যেন ফেলিতে ছুঁড়িয়া
উঠে শূন্য পানে পড়ে আছাড়িয়া
করে শেষে হাহাকার।
প্রাণের উল্লাসে ছুটিতে চায়,
ভূধরের হিয়া টুটিতে চায়,
আলিঙ্গন তরে ঊর্ধ্বে বাহু তুলি
আকাশের পানে উঠিতে চায়।
প্রভাত-কিরণে পাগল হইয়া
জগৎ মাঝারে লুটিতে চায়।
কেনরে বিধাতা পাষাণ হেন,
চারি দিকে তার বাঁধন কেন।
ভাঙ্‌রে হৃদয় ভাঙ্‌রে বাঁধন,
সাধ্‌রে আজিকে প্রাণের সাধন,
লহরীর পরে লহরী তুলিয়া
আঘাতের পরে আঘাত কর্‌;
মাতিয়া যখন উঠিছে পরান,
কিসের আঁধার, কিসের পাষাণ,
উথলি যখন উঠিছে বাসনা,
জগতে তখন কিসের ডর।


সহসা আজি এ জগতের মুখ
নুতন করিয়া দেখিনু কেন।

একটি পাখির আধখানি তান
জগতের গান গাহিল যেন।
জগত দেখিতে হইব বাহির,
আজিকে করেছি মনে,
দেখিব না আর নিজেরি স্বপন
বসিয়া গুহার কোণে।
আমি—ঢালিব করুণা-ধারা,
আমি–ভাঙিব পাষাণ-কারা,
আমি—জগৎ প্লাবিয়া বেড়াব গাহিয়া
আকুল পাগলপারা।
কেশ এলাইয়া, ফুল কুড়াইয়া,
রামধনু-আঁকা পাখা উড়াইয়া,
রবির কিরণে হাসি ছড়াইয়া,
দিবরে পরান ঢালি।
শিখর হইতে শিখরে ছুটিব,
ভূধর হইতে ভূধরে লুটিব,
হেসে খল খল, গেয়ে কল কল,
তালে তালে দিব তালি।
তটিনী হইয়া যাইব বহিয়া—
যাইব বহিয়া—যাইব বহিয়া—
হৃদয়ের কথা কহিয়া কহিয়া,
গাহিয়া গাহিয়া গান,
যত দেব প্রাণ ব’হে যাবে প্রাণ
ফুরাবে না আর প্রাণ।



এত কথা আছে, এত গান আছে,
এত প্রাণ আছে মোর,
এত সুখ আছে, এত সাধ আছে,
প্রাণ হয়ে আছে ভোর।


রবি শশী ভাঙি গাঁথিব হার
আকাশ আঁকিয়া পরিব বাস।
সাঁঝের আকাশে করে গলাগলি,
অলস কনক জলদরাশ,
অভিভূত হয়ে কনক-কিরণে
রাখিতে পারে না দেহের ভার।
যেনরে বিবশা হয়েছে গোধূলি,
পুরবে আঁধার বেণী পড়ে খুলি,
পশ্চিমেতে পড়ে খসিয়া খসিয়া
সোনার আঁচল তার।
মনে হবে যেন সোনা মেঘগুলি
খসিয়া পড়েছে আমারি জলে,
সুদূরে আমারি চরণতলে।
আকুলি বিকুলি শত বাহু তুলি
যতই তাহারে ধরিতে যাব
কিছুতেই তারে কাছে না পাব।
আকাশের তারা অবাক হবে,
সারাটি রজনী চাহিয়া র’বে
জলের তারার পানে।

না পাবে ভাবিয়া এল কোথা হতে,
নিজের ছায়ারে যাবে চুম খেতে
হেরিবে স্নেহের প্রাণে।
শ্যামল আমার দুইটি কূল,
মাঝে মাঝে তাহে ফুটিবে ফুল।
খেলাছলে কাছে আসিয়া লহরী
চকিতে চুমিয়া পলায়ে যাবে;
শরম-বিভলা কুসুম-রমণী
ফিরাবে আনন শিহরি অমনি,
আবেশেতে শেষে অবশ হইয়া
খসিয়া পড়িয়া যাবে।
ভেসে গিয়ে শেষে কাঁদিবে সে হায়
কিনারা কোথায় পাবে।
মেঘ গরজনে বরষা আসিবে,
মদির-নয়নে বসন্ত হাসিবে,
বিশদ-বসনে শিশির-মালা
আসিবে সুধীরে শরত বালা।
কুলে কুলে মোর উছলি জল,
কুলু কুলু ধোবে চরণতল।
কুলে কুলে মোর ফুটিবে হাসি,
বিকশিত কাশ-কুসুম-রাশি।
বিমল-গগনা, বিভোর নগনা,
পুরণিমা নিশি জোছনা-মগনা;
ঘুম-ঘোরে কভু গাহিবে কোকিল,

দূরে দুরে কভু বাজিবে বাঁশি।
দূর হতে আসে ফুলের বাস,
মুরছিয়া পড়ে মলয় বায়;
দুরু দুরু মোর দুলিবে হিয়া
শিহরিয়া মোর উঠিবে কায়।
এত সুখ কোথা, এত রূপ কোথা
এত খেলা কোথা আছে,
যৌবনের বেগে বহিয়া যাইব
কে জানে কাহার কাছে।
অগাধ বাসনা অসীম আশা,
জগৎ দেখিতে চাই।
জাগিয়াছে সাধ—চরাচর ময়
প্লাবিয়া বহিয়া যাই।
যত প্রাণ আছে ঢালিতে পারি,
যত কাল আছে বহিতে পারি,
যত দেশ আছে ডুবাতে পারি,
তবে আর কিবা চাই,
পরানের সাধ তাই।

কী জানি কী হোলো আজি, জাগিয়া উঠিল প্রাণ,
দূর হতে শুনি যেন মহাসাগরের গান।
সেই সাগরের পানে হৃদয় ছুটিতে চায়,
তারি পদপ্রান্তে গিয়ে জীবন টুটিতে চায়।
অহো কী মহান সুখ অনন্তে হইতে হারা,

মিশাতে অনন্ত প্রাণে অনন্ত প্রাণের ধারা।
ডাকে যেন—ডাকে যেন—সিন্ধু মোরে ডাকে যেন,
আজি চারিদিকে মোর কেন কারাগার হেন।
পৃথিবীরে বুকে লয়ে সমুদ্র একেলা বসি’
অসীম প্রাণের কথা কহিতেছে দিবানিশি,
আপনি জানে না যেন,
আপনি বুঝে না যেন,
মহাসিন্ধু ধ্যানে বসি’, আপনি উঠিছে বাণী;
কেহ শুনিবার নাই—নাই কোথা জনপ্রাণী।
কেবল আকাশ একা দাঁড়ায়ে রয়েছে তথা,
নীরব শিষ্যের মতো শুনিছে মহান্‌ কথা।
কী কথা রে—কী কথা সে—শুনিতে ব্যাকুল প্রাণ,
একেলা কবির মতো গাহিছে কিসের গান।
শীত নাই, গ্রীষ্ম নাই, দিন নাই, রাত্রি নাই,
সঙ্গী নাই, জনপ্রাণী নাই,
একাকী চরণ প্রান্তে বসিয়া শুনিব তাই।
আসিবে গভীর রাত্রি আঁধারে জগত ঢাকি
দিশাহারা অন্ধকারে মুদিয়া রহিব আঁখি।
স্তব্ধতার প্রাণ উঘাটিয়া
ভেদি সেই অন্ধকার ঘোর
কেবলি সে একতান
সমুদ্রের বেদগান
সারারাত্রি অবিশ্রাম পশিবে শ্রবণে মোর।
ওই যে হৃদয় মোর আহ্বান শুনিতে পায়,

"কে আসিবি, কে আসিবি, কে তোরা আসিবি আয়।
পাষাণ বাঁধন টুটি’, ভিজায়ে কঠিন ধরা,
বনেরে শ্যামল করি, ফুলেরে ফুটায়ে ত্বরা,
সারাপ্রাণ ঢালি দিয়া,
জুড়ায়ে জগৎ-হিয়া
আমার প্রাণের মাঝে কে আসিবি আয় তোরা।
আমি যাব—আমি যাব—কোথায় সে, কোন্‌ দেশ—
জগতে ঢালিব প্রাণ,
গাহিব করুণা গান;
উদ্বেগ-অধীর হিয়া
সুদূর সমুদ্রে গিয়া
সে প্রাণ মিশাব, আর সে গান করিব শেষ।
ওরে চারিদিকে মোর
এ কী কারাগার ঘোর।
ভাঙ্‌ ভাঙ্‌ ভাঙ্‌ কারা, আঘাতে আঘাত কর্‌।
ওরে আজ কী গান গেয়েছে পাখি,
এয়েছে রবির কর।