তুমি

ওই ছাপাখানাটার ভূত,
আমার ভাগ্যবশে তুমি তারই দূত।
দশটা বাজল তবু আস নাই;
দেহটা জড়িয়ে আছে আরামের বাসনাই;
মাঝে থেকে আমি খেটে মরি যে—
পণ্য জুটেছে, খেয়াতরী যে
ঘাটে নাই। কাব্যের দধিটা
বেশ করে জমে গেছে, নদীটা
এইবার পার ক’রে প্রেসে লও,
খাতার পাতায় তারে ঠেসে লও।
কথাটা তো একটুও সোজা নয়;
স্টেশন-কুলির এ তো বোঝা নয়।
বচনের ভার ঘাড়ে ধরেছি,
চিরদিন তাই নিয়ে মরেছি;
বয়স হয়েছে আশি, তবুও
সে ভার কি কমবে না কভুও॥


আমার হতেছে মনে বিশ্বাস—
সকালে ভুলালো তব নিশ্বাস

রান্নাঘরের ভাজাভুজিতে,
সেখানে খোরাক ছিলে খুঁজিতে,
উতলা আছিল তব মনটা,
শুনতে পাও নি তাই ঘণ্টা॥


শুঁটকি মাছের যারা রাঁধুনিক
হয়তো সে দলে তুমি আধুনিক।
তব নাসিকার গুণ কী যে তা,
বাসি দুর্গন্ধের বিজেতা
সেটা প্রোলিটেরিটের লক্ষণ,
বুর্জোয়া-গর্বের মোক্ষণ ৷
রৌদ্র যেতেছে চড়ে আকাশে,
কাঁচা ঘুম ভেঙে মুখ ফ্যাকাশে।
ঘন ঘন হাই তুলে গা-মোড়া,
ঘসঘস্ চুলকোনো চামোড়া।
আ-কামানো মুখ ভরা খোঁচাতে—
বাসি ধুতি, পিঠ ঢাকা কোঁচাতে।
চোখ দুটো রাঙ। যেন টোমাটো,
আলুথালু চুলে নাই পোমাটো।
বাসি মুখে চা খাচ্ছ বাটিতে,
গড়িয়ে পড়ছে ঘাম মাটিতে।

কাঁকড়ার চচ্চড়ি রাত্রে,
এঁটো তারই পড়ে আছে পাত্রে।
‘সিনেমার তালিকার কাগজে
কে সরালো ছবি’ ব’লে রাগো যে॥


যত দেরি হতেছিল ততই যে
এই ছবি মনে এল স্বতই যে।
ভোরে ওঠা ভদ্র সে নীতিটা,
অতিশয় খুঁৎখুঁতে রীতিটা।
সাফসোফ বুর্জোয়া অঙ্গেই
ধবধবে চাদরের সঙ্গেই
মিল তার জানি অতিমাত্র—
তুমি তো নও সে সৎ-পাত্র।
আজকাল বিড়ি-টানা শহুরে
যে চাল ধরেছ আট-পহুরে,
মাসিকেতে একদিন কে জানে
অধুনাতনের মন-ভেজানে
মানে-হীন কোনো এক কাব্য
নাম করি দিবে অশ্রাব্য॥

শান্তিনিকেতন:৪ অগস্ট ১৯৪০ [১৯ শ্রাবণ ১৩৪৭]