প্রাকৃতিকী/অমৃত ও গরল
অমৃত ও গরল
কলিযুগে অমৃত কোথায় আছে জানি না, কিন্তু গরলের সন্ধান করিবার জন্য একটুও কষ্টস্বীকার করিতে হয় না। সাপের মুখে গরল, কুকুরের দাঁতে গরল, ডাক্তারের শিশিতে গরল, কবিরাজের পুঁটুলিতে গরল, দোকানের খাদ্য পানীয় ত একবারে গরলেই ভরা। ‘অমৃতং বাল ভাষিতম্’ এই বাক্যটির যদি কিছু সার্থকতা থাকে, তবে বুঝিতে হয় এক ছোট ছেলেমেয়ের ফাঁকা কথাতেই এখন অমৃত আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছে,—কিন্তু জিনিষটা একবারেই ফাঁকা; ধরিয়া ছুঁইয়া পাইবার উপায় নাই। কাজেই ইহাকে লইয়া আর বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা করা চলে না। তার পর যদি গৃহের অপর প্রান্ত হইতে কোন ক্ষীণতর কণ্ঠের গরলময় শব্দস্রোত আসিয়া উপস্থিত হয়, তবে এই গরল-প্লাবনে “বালভাষিতম্” নিঃশেষে neutralised হইয়া যায়,—সুতরাং “বালভাষিতের” অমৃত লইয়া পরীক্ষাই বা চলে কি প্রকারে?
সত্যযুগের মানুষ কি খাইয়া প্রাণ ধারণ করিত, পাঁজিতে তাহার সন্ধান পাইলাম না,—হয় ত অমৃতই তাহাদের আহার্য্য ছিল। কিন্তু পাঁজিতে দেখিতেছি “কলৌ অন্নগতাঃ প্রাণাঃ”, কাজেই কলিতে অন্নাদি খাদ্যই অমৃতের স্থলাভিষিক্ত হইয়াছে বলিলে বোধ হয় ভুল হয় না। তা ছাড়া,
“দুগ্ধং শর্করাচৈব ঘৃতং দধি তথা মধু।
পঞ্চামৃতমিদং প্রোক্তং বিধেয়সর্ব্বকর্ম্মসু”॥
এই বচনও ত আজকাল মানিয়া চলিতে হইতেছে। কাজেই পঞ্চামৃতের দধি, দুগ্ধ, ঘৃত, মধু ও চিনি সকলই কলিকালে অমৃত। অতএব সুখাদ্যমাত্রকেই যদি অমৃত বলা যায়, তাহা হইলে ভুলের মাত্রা খুবই কমিয়া আসে।
শুনিয়াছি অন্ততঃ কিছুদিন পূর্ব্বে আমাদের পাহাড়-পর্ব্বতের নিভৃত স্থানে এমন সাধু-সন্ন্যাসী প্রায়ই দেখা যাইত, যাঁহারা মহাদেবের ন্যায় বিষ খাইয়া হজম করিয়া ফেলিতেন; ইঁহাদের খাদ্যাখাদ্যের বিচার ছিল না, গরল ও অমৃত ইঁহাদের হিসাবে একই শ্রেণীর খাদ্যের মধ্যে পড়িত। এই সন্ন্যাসি-সম্প্রদায়ের আর দেখা পাওয়া যায় না। কিন্তু এই কলিকালে ঠিক্ ঐ প্রকার আর এক দল লোক দেখা দিয়াছে, যাঁহারা অমৃত ও গরলকে একই কোটায় ফেলিতে চাহিতেছেন। ইঁহারা সন্ন্যাসী নহেন, সম্পূর্ণ গৃহী, আমাদেরি মত আহার বিহার কাজকর্ম্ম করিয়া বেড়ান। ইঁহারাই আমাদের আধুনিক বৈজ্ঞানিক। ইঁহাদের সকলেই একবাক্যে বলিতেছেন, অমৃত ও গরল জিনিষ হিসাবে একই কোটায় পড়ে। আমাদের সন্ন্যাসি-সম্প্রদায়ের ন্যায় ইঁহারা গরল ভক্ষণ করিয়া হজম করিতেছেন না বটে, কিন্তু হাতে কলমে এমন প্রমাণ প্রয়োগ করিতেছেন যে, অমৃত ও গরল একই পদার্থ নয়, একথা এখন আর বলা চলিতেছে না।
বিষয়টা একটু খোলসা করিয়া বলা যাউক। বিজ্ঞ পাঠক অবশ্যই জানেন, আমরা এই যে খাদ্য-অখাদ্য নানা জিনিষ চারিদিকে দেখিতেছি, কতকগুলি ছাড়া তাহাদের প্রায় প্রত্যেকটিই দুই, তিন, চার বা তাহার অধিক মূল-পদার্থের যোগে উৎপন্ন। আমরা যে জিনিষটার সহিত খুব পরিচিত সেই জলকে লইয়া দেখি। পরীক্ষাশালায় জলকে ভাঙ্গিয়া বৈজ্ঞানিক দুইটি বায়বীয় পদার্থ অক্সিজেন্ ও হাইড্রোজেনের উৎপত্তি দেখাইয়া দিবেন। অক্সিজেন্ ও হাইড্রোজেন্ এই দুইটি বায়ু মূলপদার্থ, ইহাদিগকে কোনক্রমে বিশ্লেষ করা যায় না, অর্থাৎ ভাঙ্গিয়া নূতন কোন পদার্থ উৎপন্ন করা যায় না। সুতরাং বলিতে হয়, জল জিনিষটা অক্সিজেন্ ও হাইড্রোেজনের মিলনে উৎপন্ন। যে-কোন জিনিষকে বৈজ্ঞানিকদিগের হাতে ফেলিয়া দিলে, সেটি কোন্ কোন্ মূলপদার্থের যোগে উৎপন্ন তাহা ইঁহারা ঐ প্রকার পরীক্ষায় বলিয়া দিতে পারেন। শিলা মৃত্তিকা বৃক্ষ তৃণ ধাতু অধাতু কোন জিনিষই ইঁহাদের পরীক্ষা এড়াইয়া থাকিতে পারে না, আত্মপ্রকাশ করিতেই হয়।
বলা বাহুল্য, জগতে যত জৈব ও জড় পদার্থ আছে বৈজ্ঞানিকগণ আজও নিঃশেষে তাহাদিগকে বিশ্লেষ করিতে পারেন নাই, সকলগুলিকে খুঁজিয়া পরীক্ষাশালায় বিশ্লেষ করাও বোধ হয় অসম্ভব। কিন্তু যেগুলিকে বিশ্লেষ করা হইয়াছে, তাহাদের মধ্যে একটা অত্যাশ্চর্য্য ব্যাপার ধরা পড়িয়াছে। জীব হইতে উৎপন্ন পদার্থমাত্রকেই ভাঙ্গিয়া ইঁহারা প্রত্যেকটিতেই কয়েকটিমাত্র মূলপদার্থের অস্তিত্ব দেখিতে পাইতেছেন। হরিণের শিঙ্, ময়ূরের পালক, আমের আঁটি, আঙুরের রস, মাথার মগজ, ঘাসের বীজ, বনমানুষের লেজ, চাম্চিকার ডানা, খরগোসের মাংস; টিকটিকির ঠ্যাঙ্, এবং এদিকে দুগ্ধ, ঘৃত, নবনীত, চাল, ডাল, মাছ, তেল, সরভাজা, সরপুরিয়া, খাসাগোল্লা, মিহিদানা, পোলাও, কারি, কালিয়া প্রভৃতি জীব হইতে উৎপন্ন যে-কোন জিনিষ লইয়া পরীক্ষা করিয়া ইঁহারা তাহাতে কয়েকটি নির্দ্দিষ্ট পদার্থ ব্যতীত অপর কোন নূতন পদার্থের চিহ্ন মাত্র দেখিতেছেন না। এই নির্দ্দিষ্ট পদার্থগুলির সংখ্যাও খুব অধিক নয়। একটু অঙ্গারক বাষ্প, একটু জল, একটু এমোনিয়া, একটু অক্সিজেন্, একটু গন্ধক ও ফস্ফরস্ এবং কখন কখন একটু আধটু আকরিক পদার্থ ব্যতীত কোন জৈব জিনিষে অপর পদার্থের সন্ধান পাওয়া যায় না।
কাজেই ঐ কয়েকটি পদার্থের যোগে যে, জৈব জিনিষ মাত্রই প্রস্তুত তাহা স্বীকার করিতে হইতেছে। কিন্তু কয়েকটিমাত্র সুপরিচিত পদার্থেরই মিলনে সহস্র সহস্র বিচিত্র জিনিষের উৎপত্তির কথাটা শুনিলে যেন মনে খট্কা লাগে। ব্যাপারটা দাঁড়ায় যেন এই প্রকার,—ছানা ও চিনি লইয়া ময়রার দল ভিয়ানে বসিয়া গিয়াছে, ঐ দুই অপূর্ব্ব পদার্থের যোগে যেন এক খোলায় হইল খাসাগোল্লা, এক খোলায় হইল পাঁপর ভাজা, এক খোলায় হইল ঢাকার পরেটা, এক খোলায় হইল মাগুর মাছের ঝোল এবং শেষের খোলায় হইল পদ্মগন্ধ কুন্তলীন তৈল। এপ্রকার অদ্ভুত ব্যাপার ত আমরা এ জগতে দেখিতে পাই না। পাণ, চূণ, খয়ের ও মসলার যোগে সুস্বাদু পাণের খিলিই প্রস্তুত হয়, এগুলির মিলনে কোনদিন জগন্নাথ দেবের প্রসাদ, ক্ষীরের লাড়ু বা অপর কিছু প্রস্তুত হইল, এমন ত কোন দিন দেখা যায় নাই এবং শুনাও যায় নাই।
কয়েকটি মাত্র পদার্থের যোগে সৃষ্টির প্রত্যেক বিচিত্র জৈব পদার্থের উৎপত্তির অসম্ভবতার কথা তুলিলে বৈজ্ঞানিকগণ নীরব থাকেন না। তাঁহারা বলেন,—ঐযে ময়রার ভিয়ানের উদাহরণ দিলে, তাহার সহিত বৈজ্ঞানিকের ভিয়ানের মিল নাই। ময়রা ঘৃত, চিনি, ও সুজি ভাগে ভাগে লইয়া মোহনভোগ প্রস্তুত করে। জিনিষটা খুবই উপাদেয় হয় সন্দেহ নাই, কিন্তু মোহনভোগে ঘৃত ঘৃতই থাকে, চিনি চিনিই থাকে এবং সুজি সুজিই থাকে। এই তিন জিনিষের একটা উপর-উপর মিশ্রণে মোহনভোগের উৎপত্তি হয়। কিন্তু বৈজ্ঞানিক যখন দুই পরমাণু হাইড্রোজেন্ এবং এক পরমাণু অক্সিজেন্ লইয়া ভিয়ানে বসেন, তখন এই দুই পদার্থের যোগে এমন একটা জিনিষ হয়, যার সঙ্গে অক্সিজেন্ বা হাইড্রোজেন কাহারো মিল থাকে না। বৈজ্ঞানিক-ভিয়ানের রকমই এই প্রকার। যে-সকল মাল-মসলায় দ্রব্য প্রস্তুত হয়, তাহাদের সহিত দ্রব্যের মিল থাকে না; না আকারে, না গুণে। তার পর আবার পরিমাণ লইয়া কথা-বার্ত্তা আছে। এক সের ছানার সহিত আধ সের চিনি মিশাইয়া গোল্লা প্রস্তুত করিলে, বেশ ভাল গোল্লাই হয়। কিন্তু সেই এক সের ছানার সহিত এক সের চিনি মিশাইলে, তাহা কখনই গুড়ে মণ্ডায় পরিণত হয় না,—গোল্লাই হয়, না হয় জিনিষটা একটু শক্ত হয়, মিষ্ট একটু বেশি হয়। কিন্তু বৈজ্ঞানিকের ভিয়ানে, মাল-মসলার ওজনের একটু কম বেশিতে সম্পূর্ণ পৃথক পৃথক জিনিধ প্রস্তুত হইয়া পড়ে।
মনে করা যাউক, দুইটি হাইড্রোজেনের পরমাণু ও একটি অক্সিজেনের পরমাণু লইয়া বৈজ্ঞানিক কোন পদার্থ প্রস্তুত করিতে বসিলেন। এগুলির মিশ্রণে অণুপ্রমাণ জল উৎপন্ন হইয়া পড়িল। কিন্তু ঐ দুই পরমাণু হাইড্রোজেনের সহিত এক পরমাণু অক্সিজেন না মিশাইয়া যদি দুই পরমাণু অক্সিজেন মিশানো যায়, তাহা হইলে আর জল প্রস্তুত হয় না। এমন একটা জিনিষ হয়, যাহার সহিত জলের অতি দূর সম্বন্ধও কল্পনা করিতে পারা যায় না। মূলপদার্থের এই প্রকার বিচিত্র মিলনে নূতন নূতন দ্রব্য প্রস্তুত হইতে দেখিয়া বৈজ্ঞানিকগণ বলিতেছেন, জৈব পদার্থমাত্রেরই মালমসলা একই বটে, কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন পরিমাণে সেগুলি মিশে বলিয়া আমরা তাহাদের মধ্যে এত বৈচিত্র্য দেখিতে পাই। কেবল জৈব নয়, জড়সৃষ্টির বৈচিত্র্যেরও উহাই কারণ। তবে অজৈব জিনিষ কি কি উপাদানে প্রস্তুত তাহা নির্ণয় করিয়া আবার সেই সকল উপাদানকে একত্র করিয়া আমরা সেটিকে যেমন পরীক্ষাগারে প্রস্তুত করিতে পারি, জৈব জিনিষকে তাহা পারি না। এগুলিকে আমরা ভাঙ্গিতে পারি; কোন্ কোন্ মূল উপাদান তাহার ভিতর আছে তাহা নির্ণয় করিয়া নিক্তির ওজনে সেগুলিকে মাপিতেও পারি, কিন্তু যখন ঠিক সেই ওজনের মালমসলা সংগ্রহ করিয়া বিজ্ঞানাগারের খোলায় ভিয়ান আরম্ভ করি, তখন যে জৈব জিনিষের উৎপত্তির আশা করিতেছিলাম তাহা জন্মায় না। তাহা হইলেই হইল, জৈব পদার্থকে আমরা ভাঙ্গিতে পারি কিন্তু গড়িতে পারি না।
একটা উদাহরণ দিয়া কথাটা বুঝানো যাউক। জল একটা অজৈব জিনিষ। বিজ্ঞানাগারে ইহাকে বিশ্লেষ করিলে, দুই পরমাণু হাইড্রোজেন্ ও এক পরমাণু অক্সিজেন্ ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না। এখন যদি আমরা দুই পরমাণু হাইড্রোজেনের সহিত এক পরমাণু অক্সিজেন্ মিশাই তাহা হইলে ঠিক এক অণু প্রমাণ জল গড়িয়া তুলিতে পারিব। কিন্তু জৈব পদার্থে এই প্রকার সংগঠন-কার্য্য চালানো যায় না। চিনি একটা জৈব পদার্থ, আমাদের দেশে প্রধানত ইক্ষুরস হইতেই ইহার উৎপত্তি। জিনিষটাকে বৈজ্ঞানিক প্রণালীতে ভাঙ্গিলে, বারো পরমাণু অঙ্গার, বাইশ পরমাণু হাইড্রোজেন্ এবং এগারো পরমাণু অক্সিজেন্ ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না। এখন যদি কেহ অঙ্গার, হাইড্রোজেন্ ও অক্সিজেনকে ঠিক ঐ প্রকারে ওজন করিয়া মিশাইয়া চিনি প্রস্তুত করিতে চেষ্টা করেন, তাহা হইলে একটা কিম্ভূতকিমাকার জিনিষ প্রস্তুত হয়, চিনি হয় না। হিতোপদেশের রাজপুত্র মৃত পশুর অস্থি যোজনা করিতে পারিতেন, শুষ্ক অস্থিতে মাংসও লাগাইতে পারিতেন, পারিতেন না কেবল প্রাণ দিতে। আমাদের বৈজ্ঞানিকগণ হাড়, মাংস, প্রাণ কিছুই প্রস্তুত করিতে পারেন না। পারেন কেবল ভাঙ্গিতে। প্রকৃতিদেবী অন্তঃপুরে বসিয়া কি কৌশলে আমাদের অতি সুপরিচিত অক্সিজেন্, নাইট্রোজেন্, হাইড্রোজেন্, অঙ্গার প্রভৃতিকে মিলাইয়া, লতাপাতা পুষ্পফল নরবানর গড়িতেছেন, তাহা আমাদের বৈজ্ঞানিকগণ আজও জানিতে পারেন নাই। জীবনসৃষ্টির কৌশল এক প্রকৃতিই জানেন। আধুনিক বৈজ্ঞানিক দুই চারিটি জৈব পদার্থ বিজ্ঞানাগারে প্রস্তুত করিয়াছেন সত্য, যথা,—রেশম, কর্পূর, নীল, রবার,—কিন্তু আসল জিনিষের সহিত এই এই কৃত্রিম দ্রব্যগুলির অবিকল মিল দেখা যায় না। কাজেই বলা যাইতেছে না যে, ইঁহারা সৃষ্টির কৌশল আয়ত্ত করিয়া ফেলিয়াছেন।
যাহা হউক, অমৃত ও গরলের কথা উপস্থিত করিয়া অনেক দূরে আসা গিয়াছে, আবার অমৃত ও গরলে ফিরিয়া যাওয়া যাক্। অমৃতের অনেক কথা পূর্ব্বে বলা হইয়াছে এখন গরল জিনিষটাকে বৈজ্ঞানিকগণ কি বলেন, আলোচনা করা যাউক। ইঁহারা অধিকাংশ জৈব গরল অর্থাৎ যেমন সাপের বিষ, একোনাইট্, আফিং ইত্যাদিকে পরীক্ষাগারে বিশ্লেষ করিয়া ঘৃত, দুগ্ধ, মাখন ও মিষ্টান্নাদির সকল উপাদানগুলিই বিষে দেখিতে পাইয়াছেন। কেবল ইহাই নয়, খুব ভাল পুষ্টিকর সুখাদ্যে উপাদানগুলি যে পরিমাণে মিশানো থাকে, অনেক বিষপদার্থে উপাদানগুলিকে অবিকল সেই পরিমাণেই মিশ্রিত দেখা যাইতেছে। খুব উৎকৃষ্ট দধিতে যে পরিমাণে হাইড্রোজেন্, অক্সিজেন্, নাইট্রোজেন্ ও অঙ্গারাদি মিশ্রিত থাকে, হয় ত গোথুরা সাপের তাজা বিষে ঐসকল মূলপদার্থই ঠিক্ সেই পরিমাণেই মিশ্রিত দেখা যায়। এখন পাঠক বুঝিবেন, কেন আমাদের বৈজ্ঞানিকেরা অমৃত ও গরলকে বিজ্ঞানের দিক্ দিয়া একই কোটায় ফেলিতে চাহেন।
যাহা হউক, অমৃত ও বিষের উপাদান যেন একই হইল, এবং উপাদানগুলির ওজনও যেন একই দেখা গেল;—এখন একই পরিমাণে, মিশিয়া কেন একটিকে বিষ এবং অপরটিকে অমৃতের গুণ দেয় দেখা যাউক; জীবজগতের লীলার রহস্য এক লীগাময় পরমেশ্বরের জানা আছে, সেই লীলার মূলে মানুষের প্রবেশাধিকার নাই, এই আংশিক সত্য কথাটা বলিলেই “কেন”র উত্তর পাওয়া যায়। এপর্য্যন্ত মানুষ ঐপ্রকার উত্তর দিয়াই মনকে শান্ত রাখিয়া আসিতেছিল। আধুনিক বৈজ্ঞানিকগণ এই উত্তরে সন্তুষ্ট হইবার পাত্র নহেন। ইঁহারা দেখিতে চাহেন কেবল প্রকৃতির সহজ ও সুস্পষ্ট নিয়মের ধারা ও কলের ঝন্ঝনানি। রহস্যকুহেলিকাবৃত সৃষ্টির যে-সকল লীলা দেখিয়া সাধারণ মানুষ পুলকিত হইয়া পড়ে, এবং বিশ্বেশ্বরের উদ্দেশ্যে আপনা হইতেই মাথা নত করে, সেই লীলা দেখিলেই বৈজ্ঞানিকের গাত্রজ্বালা উপস্থিত হয়। তিনি দেখিতে চাহেন, কোন প্রাকৃতিক যন্ত্রে কোন্ নিয়মে ঐ লীলার বিকাশ হইতেছে। কাজেই যখন অমৃত ও বিষের উপাদান অবিকল একই দেখা গেল, তখন বৈজ্ঞানিক মহলে পরীক্ষার ধুম পড়িয়া গিয়াছিল, এবং শেষে স্থির হইয়াছিল, উহাদের উপাদান একই বটে কিন্তু প্রত্যেকটিতে যে প্রকারে পরমাণু সজ্জিত আছে, তাহা এক নয়। এইজন্যই অমৃত ও গরলের গুণে এতটা পার্থক্য।
এখন জীবদেহে গরল ও অমৃতের কার্য্য কিপ্রকার আলোচনা করা যাউক। ইহার জন্য একটু ভূমিকার প্রয়োজন হইবে। কারণ বিষয়টির সহিত রসায়নশাস্ত্রের অনেক তত্ত্ব জড়ানো আছে। মূলপদার্থ মাত্রেরই পরমাণুর একটা প্রধান ধর্ম্ম এই যে, তাহারা একা পৃথক্ পৃথক্ অবস্থায় থাকিতে চায় না। কেহ দুই হাত বাড়াইয়া, কেহ তিন, বা চার, পাঁচ ও ছয় হাত বিস্তৃত করিয়া অপর পরমাণুর সহিত মিলিতে চেষ্টা করে। হাতে হাতে জোড় বাঁধিয়া মিলিয়া গেলে, পরমাণু সাম্যাবস্থায় আসিয়া দাঁড়ায়, তখন তাহাদের মধ্যে আর চঞ্চলতা দেখা যায় না। বৈজ্ঞানিকগণ বলেন, যখন পরমাণুগণ এই সাম্যাবস্থায় (Saturated Condition) আসে, তখন তাহাদের রাসায়নিক কার্য্য লোপ পাইয়া যায়। আমরা যাহাকে জীবন বলি, তাহা রাসায়নিক কার্য্য লইয়াই। জীবশরীর যে-সকল পরমাণু দ্বারা গঠিত, সেগুলি সর্ব্বদাই চঞ্চল এবং অপর পরমাণুর সহিত মিলিত হইবার জন্য সর্ব্বদাই সচেষ্ট। এই মিলন যখন কোন প্রকারে হইয়া যায়, তখনই জীবের মৃত্যু ঘটে। মৃত্তিকা, শিলা, ধাতু প্রভৃতি জড় পদার্থের পরমাণুতে এই মিলন হইয়াই আছে, এজন্যই ইহারা নির্জীব।
এখন মনে করা যাউক, কোটী কোটী চঞ্চল পরমাণু দ্বারা যে জীব-দেহ গঠিত রহিয়াছে, তাহাতে এমন একটি পদার্থ প্রবেশ করিল, যাহার পরমাণু জীবপরমাণুর সহিত মিলিয়া গেল। বলা বাহুল্য ইহাতে উভয়ের পরমাণুই সাম্যাবস্থায় আসিয়া দাঁড়াইবে—জীবের মৃত্যু হইবে। আধুনিক বৈজ্ঞানিকগণ জীবশরীরে বিষের এই প্রকার কার্য্যই আবিষ্কার করিয়াছেন। বিষ শরীরে প্রবেশ করিলেই দেহের মুক্ত পরমাণুগুলির সহিত স্থায়িভাবে মিলিয়া যায়, কাজেই ইহার পর আর রাসায়নিক কার্য্য চলে না; প্রাণীর মৃত্যু ঘটে। কিন্তু যাহা সুখাদ্য তাহা দেহে প্রবেশ লাভ করিলে শরীরের পরমাণুর সহিত সে-গুলির ঐপ্রকার স্থায়ী মিলন ঘটে না, কাজেই অমৃতপানে জীবের মৃত্যু হয় না।
এই প্রসঙ্গে সুপ্রসিদ্ধ জর্ম্মান্ অধ্যাপক এর্লিক্ (Ehrlich) সাহেব যে এক নূতন সিদ্ধান্ত প্রচার করিয়াছেন, সেটিও উল্লেখযোগ্য মনে হইতেছে। জীবের শরীর কতকগুলি কোষের সমষ্টি ব্যতীত আর কিছুই নয়। একএকটি কোষ যেন একএকটি ক্ষুদ্র কারখানার ঘর, তাহাতে যে কত রাসায়নিক কার্য্যে কত দ্রব্য প্রস্তুত হইতেছে, তাহার ইয়ত্তাই হয় না; তা ছাড়া কোন্ প্রণালীতে ঐসকল কার্য্য চলিতেছে তাহা কল্পনা করা ব্যতীত এখন আমাদের আর অন্য উপায় নাই। এর্লিক্ সাহেব বলিতেছেন, প্রত্যেক জীবকোষের গায়ে অদ্ভূতশক্তিসম্পন্ন কতকগুলি অণু আছে। এই অণুগুলির ভিতরে যে-সকল পরমাণু আছে দেগুলি স্থায়িভাবে পরস্পরের সহিত মিলিয়া থাকে না। প্রাণ-রক্তে যে পুষ্টিকর পদার্থ থাকে তাহা টানিয়া লইয়া ইহারা জীবকোষে চালাইয়া দেয়; কোষ তাহা দেহস্থ করিয়া পুষ্টিলাভ করিতে থাকে। কাজেই দাঁড়াইতেছে এই যে, উক্ত অণুগুলিই বাহির হইতে খাদ্য আনিয়া কোষের বৃদ্ধিকার্য্যে সাহায্য করে, এবং ইহাদের ভিতরকার পরমাণুর মধ্যে স্থায়ী বন্ধন নাই বলিয়াই, ক্ষণিকের জন্য পুষ্টিকর জিনিষের পরমাণুর-সহিত মিলিয়া সেগুলিকে কোষের ভিতর চালাইতে পারে। এর্লিক্ সাহেবের মতে প্রাণিদেহে বিষ প্রবেশ করিলেই কোষসন্নিহিত অণুগুলির এই অদ্ভুত ক্ষমতা লোপ পাইয়া যায়; বিষের পরমাণুর সহিত উক্ত অণুগুলির পরমাণু এমন স্থায়িভাবে মিলিয়া যায় যে, তখন আর কোন পুষ্টিকর খাদ্য জীবকোষে প্রবেশ করিবার পথ পায় না। কাজেই জীবকোষের ক্রিয়া লোপ পায় এবং সঙ্গে সঙ্গে প্রাণীর মৃত্যু ঘটে।