প্রাকৃতিকী/প্রকৃতির বর্ণ-বৈচিত্র্য
প্রকৃতির বর্ণ-বৈচিত্র্য
আকাশের নীলিমা, বৃক্ষলতাতৃণের শ্যামলতা, পশুপক্ষীর দেহের বিচিত্র বর্ণ, সব মিলিত হইয়া জগতে দিনের পর দিন যে এক রঙের খেলা দেখাইতেছে, তাহা না থাকিলে বোধ হয় পৃথিবীর অর্ধেক আনন্দ কমিয়া যাইত।
মনে করা যাক, জলস্থল আকাশ, সজীব-নির্জীব, তরুগুল্ম, সকল বস্তুই যেন বরফের ন্যায় শ্বেত বা সমুদ্রের ন্যায় নীল হইয়া দাঁড়াইয়াছে। এই একঘেয়ে রঙ্ আমাদের চক্ষুকে যে কত পীড়া দিত তাহা অনুমান করা কঠিন নয়। ফোটোগ্রাফের এক-রঙা ছবি প্রকৃতিকে নিখুঁত করিয়া আঁকে এবং নিপুণ চিত্রকর সেই প্রকৃতিকেই কল্পনার চক্ষে দেখিয়া রঙিন করিয়া নকল করে,—কিন্তু দর্শক আসলের চেয়ে নকলকেই আদর করে অধিক। বলা বাহুল্য ইহাকে দর্শকের বিচারমূঢ়তা বলা যায় না; আমাদের চক্ষু যে বর্ণের লীলা দেখিবার জন্য লালায়িত, তাহা এক-রঙা ফোটোগ্রাফে নাই, তাই ফোটোগ্রাফের এত অনাদর।
এখন প্রশ্ন হইতেছে, রঙের খেলা দেখাইবার জন্য প্রকৃতি ঋতুসম্বৎসর ধরিয়া বৃক্ষের বীজে ও প্রাণীর কোষে যে আয়োজন করেন, তাহার উদ্দেশ্য কি? জগৎকে সুন্দর ও মধুর করিবার জন্য প্রকৃতিতে যে শত শত আয়োজন আছে, ইহা তাহাদেরি মধ্যে একটি বলিলে প্রশ্নের মীমাংসা হইয়া যায়। কিন্তু বৈজ্ঞানিকগণ এ প্রকার ব্যাখ্যা দিয়া তৃপ্ত হন না। প্রাণিদেহে এত জটিল-যন্ত্রের সমাবেশ কেন? এই প্রশ্নের উত্তরে যদি কেহ বলেন, প্রাণীকে জীবিত এবং সুস্থ রাখিবার জন্যই দেহে এত ইন্দ্রিয় ও যন্ত্রাদি স্থান পাইয়াছে, তাহা হইলে উত্তরটা বৈজ্ঞানিকোচিত হয় না; কোন্ শারীর-যন্ত্র জীবনে কোন্ ক্রিয়া করিতেছে, তাহা দেখানোই বৈজ্ঞানিকের কাজ। এইজন্য জগৎকে বিচিত্র বর্ণে রঞ্জিত করিয়া প্রকৃতি সৃষ্টিরক্ষার কি সহায়তা করিতেছে তাহা নির্ণয় করিবার উদ্দেশ্যে বৈজ্ঞানিকগণ কিছুদিন ধরিয়া গবেষণা করিতেছেন। ইহাতে যথেষ্ট সুফল লাভ করা গিয়াছে সত্য; কিন্তু সকল প্রহেলিকার মীমাংসা হয় নাই।
যে-সকল মহাপণ্ডিত আজীবন আলোক ও বর্ণতত্ত্ব লইয়াই কাটাইয়াছেন, বর্ণ-বৈচিত্র্যের রহস্য জানিবার জন্য প্রশ্ন করিলে তাঁহারা সদুত্তর দিতে পারেন না। ইঁহারা বলেন, এই যে শুভ্র সূর্য্যালোক দেখিতেছ, উহা এক-রঙা আলো নয়; লাল হইতে আরম্ভ করিয়া বেগুনে পর্য্যন্ত অনেক মূল বর্ণরশ্মি মিলিয়া এই শ্বেতরশ্মি উৎপন্ন হইয়াছে। তে-শিরা কাচের উপর সূর্য্যের সাদা আলো ফেলিলে, ইহার সেই মৌলিক রঙিন বর্ণরশ্মিগুলা প্রত্যক্ষ দেখা যায়। যে জিনিষটা লাল, তাহার বিশেষ গুণ হইতেছে এই যে, শুভ্র সূর্য্যালোককে বিশ্লেষ করিয়া তাহার মধ্য হইতে কেবল লাল আলোকটিকে প্রতিফলিত করা এবং অবশিষ্ট রশ্মিকে ভিতরে প্রবেশ করাইয়া লোপ করা। কাজেই প্রতিফলিত লাল রশ্মিতে আমরা দ্রব্যটিকে লাল দেখি। যে বস্তু নীল সেটিও ঠিক এই প্রকারে শুভ্র সূর্যরশ্মির নীল আলোকটিকে প্রতিফলিত করিয়া অপরগুলিকে হরণ করিয়া ফেলে।
বর্ণোৎপত্তির এই বৈজ্ঞানিক সিন্ধান্তে লাল নীল প্রভৃতি বর্গের উৎপত্তির কথা বুঝা যায় বটে, কিন্তু গোলাপের গঠনোপাদানের কোন্ বৈচিত্র্যে একটি গোলাপকে আমরা লাল এবং আর একটিকে সাদা দেখি তাহার তত্ত্ব আলোকবিদের নিকট হইতে পাওয়া যায় না। তা’ ছাড়া একটি ফুলকে লাল এবং অপরটিকে সাদা করায় প্রকৃতির কোন্ উদ্দেশ্য সফল হইতেছে, তাহারও কিনারা হয় না। সমগ্র বর্ণতত্ত্বটাই মনে হয় যেন আজও রহস্য যবনিকার অন্তরালে আছে।
যাহা হউক পশুপক্ষী ইত্যাদির বর্ণবৈচিত্র্যের উদ্দেশ্য অনুসন্ধান করিতে গিয়া আধুনিক বৈজ্ঞানিকগণ যে একটা তত্ত্ব আবিষ্কার করিয়াছেন, আজকাল কাগজপত্র সভাসমিতি ও কথাবার্ত্তায় তাহার উল্লেখ দেখা যাইতেছে। তত্ত্বটা এই যে, পশুপক্ষী কীটপতঙ্গ প্রভৃতি ইতর প্রাণীর গায়ে যে নানা রঙ্ দেখা যায়, তাহা কেবল প্রবল শত্রুর কবল হইতে দুর্ব্বল প্রাণীদিগকে রক্ষা করিবার একটা ব্যবস্থা মাত্র। পক্ষীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এড়াইয়া জীবিত থাকিবার জন্যই ঘাসের ভিতরকার ফড়িঙের রঙ্ সবুজ এবং শুষ্ক তৃণমধ্যস্থ ফড়িঙের রঙ্ পাটল হইয়াছে। শিকারী জন্তুর খরদৃষ্টি এড়াইয়া নিরীহ শশকের টিকিয়া থাকা বড় সহজ নয়। এই প্রাণিকুলকে শত্রুর গ্রাস হইতে রক্ষা করিবার জন্যই প্রকৃতি তাহাদের দেহ শুষ্কতৃণের বর্ণের ন্যায় লাল্চে লোমে আবৃত রাখিয়াছেন; একবার শুষ্ক লতাপাতার মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করিলে, শিকারী মানুষ বা শিকারী জন্তু শশককে চিনিয়া বাহির করিতে পারে না। বহুরূপী সরীসৃপ এবং কয়েক জাতীয় ভেক ক্ষণে ক্ষণে নিজেদের বর্ণ পরিবর্ত্তন করিতে পারে। ইহার কারণ প্রসঙ্গেও জীবতত্ত্ববিদ্গণ ঐ কথাই বলেন;—বহুরূপী যখন আহারান্বেষণে ডালে ডালে বেড়ায় তখন তাহার গায়ের রঙ সবুজ থাকে এবং মাটীতে নামিলেই রঙ্ ঠিক্ মাটীর রঙের মত হইয়া দাঁড়ায়।
কিপ্রকারে এইসকল প্রাণী ক্ষণে ক্ষণে বাহিরের রঙের সহিত নিজেদের রঙ্ মিলাইয়া আত্মত্রাণ করে তাহা আবিষ্কার করিবার জন্য চেষ্টার ত্রুটি হয় নাই। পাঠক অবশ্যই অবগত আছেন, প্রাণীর চর্ম্মে এক প্রকার বর্ণকোষ থাকে, তাহাতে যে বর্ণসঞ্চিত হয় প্রাণীর চর্ম্মও ঠিক্ সেই বর্ণে রঞ্জিত হইয়া পড়ে। আমাদের গায়ের বর্ণকোষের রঙ্ কালো না হউক কতটা ময়লা; তাই আমাদের রঙ্টাও ময়লা। শীতপ্রধান দেশের অধিবাসীদের বর্ণকোষের রঙ্ শ্বেত, তাই তাহাদের গায়ের রঙ সাদা। যাহা হউক, প্রাচীন পণ্ডিতগণ বহুরূপীর বর্ণ পরিবর্ত্তনের ব্যাখ্যা দিতে গিয়া বলিতেন,—এই প্রাণিগণ যখন কোন বিশেষ বর্ণযুক্ত পদার্থের মধ্যে আসিয়া লুকায়, তখন চারিপার্শ্বের রঙ্ প্রতিফলিত হইয়া তাহাদের গায়ে লাগিতে আরম্ভ করে, এবং ইহাতেই তাহাদের গায়ের বর্ণকোষের রঙ্ পরিবর্ত্তিত হইয়া ঠিক পার্শ্ববর্ত্তী পদার্থের রঙের অনুরূপ হইয়া দাঁড়ায়। কিন্তু আধুনিক বৈজ্ঞানিকগণ এখন আর এই সিদ্ধান্তটিকে গ্রাহ্য করিতেছেন না। ইঁহারা বলিতেছেন, বহুরূপী তাহার চক্ষু দ্বারা যে বর্ণ দেখে, তাহা মস্তিষ্কের এক নির্দ্দিষ্ট অংশকে উত্তেজিত করে এবং পরে এই উত্তেজনা বিশেষ স্নায়ুমণ্ডলীর দ্বারা চর্ম্মের বর্ণকোষগুলিতে নীত হইলে গায়ের রঙ্ বদলাইয়া যায়।
আধুনিক সিদ্ধান্তটিই যে অভ্রান্ত কয়েকজাতীয় বহুরূপী প্রাণীর দেহব্যবচ্ছেদ করিয়া প্রসিদ্ধ জীবতত্ত্ববিৎ ডাক্তার ওয়ের (Dr. Weir) তাহা দেখাইয়াছেন। ইনি বিষপ্রয়োগ করিয়া কয়েকটি বহুরূপীর মস্তিষ্ক অসাড় করিয়া ফেলিয়াছিলেন, ইহার ফলে উহাদের বর্ণপরিবর্ত্তনশক্তি লোপ পাইয়াছিল। তা ছাড়া তিনি আরো দেখাইয়াছিলেন যে, বহুরূপী জাতীয় যে-সকল প্রাণীর দৃষ্টিশক্তি কম, তাহারা কখনই সহজে বর্ণপরিবর্ত্তন করিতে পারে না। কাজেই এখন স্বীকার করিতে হইতেছে, চারিপার্শ্বের বর্ণ রশ্মি চক্ষুতে আঘাত করিলে মস্তিষ্কের স্থানবিশেষে যে উত্তেজনা উপস্থিত হয়, তাহাই স্নায়ু দ্বারা সর্ব্বাঙ্গে পরিবাহিত হইলে দেহের বর্ণপরিবর্ত্তন ঘটে।
বহু গবেষণা ও পর্য্যবেক্ষণের পর এই সিদ্ধান্তের প্রতিষ্ঠা হইলেও এখন ইহার সাহায্যে কেবল কতকগুলি প্রাণীর বর্ণপরিবর্ত্তনের ব্যাখ্যা পাওয়া যাইতেছে। পতঙ্গ জাতীয় প্রাণিগণ পক্ষযুক্ত হইবার পূর্ব্বে কিছুদিন স্বরচিত আবরণের মধ্যে নিদ্রিত থাকে। এই নিষ্ক্রিয় অবস্থায় ভিতরে ভিতরে দেহের পরিবর্ত্তন হইলে তাহারা প্রজাপতির আকারে গুটি বা আবরণ ভেদ করিয়া বহির্গত হয়। পরীক্ষা করিয়া দেখা গিয়াছে, এই বিনিদ্র অবস্থাতেও পতঙ্গের গাত্রাবরণের বর্ণ পরিবর্ত্তিত হয়। বলা বাহুল্য, জীবনের এই অবস্থায় প্রজাপতিদের দৃষ্টিশক্তি থাকে না, তথাপি ইহারা, কি প্রকারে পার্শ্বের রঙের সহিত নিজের দেহের রঙ মিলাইয়া অবস্থান করে, তাহার ব্যাখ্যান পূর্ব্বোক্ত সিদ্ধান্ত হইতে পাওয়া যায় না। মেরু প্রদেশের জীবজন্তুর বর্ণ প্রায়ই শ্বেত। এই ব্যাপারের ব্যাখ্যানেও বলা যায় না যে, চারি পার্শ্বের তুষাররাশির সহিত বর্ণ মিলাইয়া রাখিবার জন্য ইহারা বহুরূপীর মত নিজেদের বর্ণ পরিবর্ত্তিত করে। বৈজ্ঞানিকগণ ইহার অপর ব্যাখ্যান দিয়া থাকেন। সূর্য্যালোকই যে অনেক জীবদেহে রঙ্ ফলায় তাহার প্রমাণ আছে;—অন্ধকার ঘরে একটি গাছ রাখিয়া দাও, কয়েকদিন পরে তাহার ডাল ও পাতার রঙ্ স্পষ্ট সাদা দেখা যাইবে। এই প্রকার প্রমাণের উপর নির্ভর করিয়া প্রাণিতত্ত্ববিদ্গণ বলেন, মেরু প্রদেশের আকাশ প্রায় সর্ব্বদাই মেঘ বা তুষারকণিকায় আচ্ছন্ন থাকে, এজন্য সে দেশে সূর্য্যালোক দুর্লভ। কাজেই ইহাতে জীবজন্তুর বর্ণ সাদা হওয়া বিচিত্র নয়। গ্রীষ্মপ্রধানদেশে অপর্য্যাপ্ত সূর্য্যালোকে যত বিচিত্র বর্ণের পুষ্পপত্র জন্মায়, শীতপ্রধানদেশে তত দেখা যায় না। ইহাও বৈজ্ঞানিকদিগের পূর্ব্বোক্ত উক্তির প্রমাণস্বরূপ উল্লেখ করা যাইতে পারে। কিন্তু তাই বলিয়া এই অনুমানটিকে সকল স্থানে প্রয়োগ করা যায় না। গভীর জলে সূর্য্যালোক প্রবেশ করে না, অথচ সেইসকল স্থানের মৎস্য প্রভৃতিকে বিচিত্রবর্ণে রঞ্জিত দেখা যায়। প্রাণীর রক্ত লাল, কিন্তু ইহা কখনই সূর্য্যার মুখ দেখে না; নির্জীব জিনিষকে যদি টানিয়া লওয়া যায়, তাহা হইলে যে-সকল আকরিক প্রস্তর ভূগর্ভের অন্ধকারে থাকিয়া বিচিত্র বর্ণ প্রাপ্ত হয়, তাহাদের বর্ণোৎপত্তির কারণ খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। মুসুরি খেঁসারি, ও মটরের ডাল আজন্ম বীজকোষের মধ্যে আবৃত থাকিয়া কেন এত সুন্দর রঙে রঞ্জিত হয়, তাহারো কারণ নির্দ্দেশ করা যায় না।
যাহাই হউক শত্রুর গ্রাস হইতে রক্ষা করিবার জন্য যে, কতকগুলি প্রাণীর দেহে বিচিত্র বর্ণ যোজিত হইয়াছে তাহা স্বীকার করিতেই হইতেছে, কিন্তু তাই বলিয়া রঞ্জিত জীবমাত্রেরই দেহাবরণের বর্ণ তাহার আত্মরক্ষার জন্য উৎপন্ন হইয়াছে একথা বলা যায় না। সামুদ্রিক জলচর পক্ষীমাত্রেরই বর্ণ শ্বেত। ঈগল পাখী সাদা, আমাদের দেশের বক সাদা। এই শ্বেতবর্ণকে কখনই আত্মরক্ষার ছদ্মবেশ বলা যায় না। গল্ যখন নীলসমুদ্রে ভাসে, তখন তাহাকে চিনিয়া লইতে শত্রুপক্ষের অণুমাত্র কালবিলম্ব হইবার সম্ভাবনা থাকে না। স্থলচর পক্ষীদের ত কথাই নাই;—কাক, কোকিল, শালিক, ফিঙে, হাঁড়িচাচা, মাছরাঙা, চন্দনা, ময়ূর, মোরগ, পায়রা, ঘুঘু, নীলকণ্ঠ, প্রভৃতি পক্ষীর পালকের বর্ণ তাহাদের পরম শত্রু। আমাদের সুপরিচিত পাখীদের মধ্যে কেবল টিয়ার রঙ গাছের রঙের মত সবুজ এবং ছাতারে ও চড়াইয়ের রঙ মাটির রঙের মত মেটে।
প্রাণী ছাড়িয়া উদ্ভিদের দিকে দৃষ্টিপাত করিলেও যথেষ্ট বর্ণ-বৈচিত্র্য দেখা যায়। গাছপালায় লতাপাতা পুষ্পফলের বর্ণলীলা দেখিয়া সত্যই অবাক্ হইতে হয়। কিন্তু কোন্ শক্তির অধীন হইয়া এবং কোন্ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য প্রত্যেক ঋতুতে উহারা নব নব উৎসববেশে সজ্জিত হইতেছে তাহা স্থির করা বড় কঠিন। বর্ষার শেষে, শীতে ও বসন্তে যেসকল ফুল ফোটে প্রায়ই তাহাদের রঙ সাদা হয়, শেফালি, গন্ধরাজ, মাধবী, মল্লিকা, কুন্দ, চামেলি, মালতী, ইহাদের সকলেরি রঙ্ সাদা! গ্রীষ্মের ফুল,—চাঁপা, অতসী, বলরামচূড়া, সোঁদাল, করবী প্রভৃতির রঙ্ উজ্জ্বল ও বিচিত্র। যে-সকল উদ্ভিদের ফল আমাদের খাদ্য, তাহাদের পুষ্পের বর্ণ প্রায়ই শ্বেত হয়; বেল, কয়েতবেল, নিচু, আম, পেঁপে, কুল, পেয়ারা, লেবু, নারিকেল, খর্জ্জুর, চালিতে, করমচা, জামরুল, গোলাপজাম, ইহাদের সকলেরি ফুল সাদা। কেবল বেগুন, শশা, বিলাতি কুমড়া, ঝিঙে ও দাড়িম তাহাদের রঙিন ফুল লইয়া বাগানের এক কোণে দাঁড়াইয়া থাকে। কিন্তু এক দাড়িম ও শশা ছাড়া এই শেষোক্ত ফলগুলির মধ্যে কোনটিকেই অপক্ক অবস্থায় খাওয়া যায় না। ঋতুর সহিত এবং ফলের স্বাদুতার সহিত ফুলের বর্ণের সম্বন্ধ কোথায় তাহা আজও স্থির হয় নাই; কিন্তু একটা যে নিকট সম্বন্ধ বর্ত্তমান আছে তাহা সুনিশ্চিত।
ডারুইন্ যে অভিব্যক্তির নিয়ম জীবজগতে লক্ষ্য করিয়াছিলেন, আজিকাল সকল ব্যাপারেই তাহার লক্ষণ প্রকাশ পাইতেছে। যেমন এক আদিম জীব হইতে এই বিচিত্র প্রাণী ও উদ্ভিদের সৃষ্টি হইয়াছে, সেই প্রকার এক মূল বর্ণ হইতে এখনকার ফুলের বিচিত্র বর্ণ অভিব্যক্ত হইয়াছে, একথাটা মনে হওয়া আশ্চর্য্য নয়। কিছুদিন পূর্ব্বে প্রসিদ্ধ উদ্ভিদ্তত্ত্ববিৎ অধ্যাপক হেন্স্লো (Henslow) সাহেবের মনে ঠিক্ এই কথাটির উদয় হইয়াছিল। তিনি বড় বড় অরণ্যের বনফুলের বর্ণপরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছিলেন, উহাদের অনেকের বর্ণ পীত। এই প্রমাণের উপর নির্ভর করিয়া অনেকে বলিতেছেন, পুষ্পমাত্রেরই আদিম বর্ণ পীত; নানা অবস্থার মধ্যে পড়িয়া এবং চাষ আবাদের গুণে বুনো হলদে রঙ্টাই পরিবর্ত্তিত হইয়া এখন নানা বর্ণে পরিণত হইয়াছে। উদ্যানে আনিয়া যত্ন করায় যে-সকল বনজ উদ্ভিদের ফুলের বর্ণ এখন পরিবর্ত্তিত হইয়াছে, অযত্নে ফেলিয়া রাখিলে কয়েক পুরুষের মধ্যে তাহাদেরি ফুল আধুনিক বিচিত্র-বর্ণ ত্যাগ করিয়া প্রাচীন পীতবর্ণ ধারণ করিতে আরম্ভ করে। আমাদের দেশের শেয়ালকাঁটা, বাবলা প্রভৃতি বুনো গাছের ফুল পীত। যে চন্দ্রমল্লিকার এখন বড় বড় বিচিত্র বর্ণের ফুল ফোটে, এককালে তাহা বন্য ছিল এবং তখন তাহার ফুল খুব ছোট হইয়া জন্মিত। আজও ইহার জ্ঞাতিবর্গকে অনেক জঙ্গলে ছোট ছোট হরিদ্রাভ ফুল সহ দেখা যায়। বাগানে চন্দ্রমল্লিকা যত্ন না করিলে কয়েক বৎসরের মধ্যে তাহার ফুল ছোট হইয়া আসে এবং তাহার রঙ সেই প্রাচীন পীতবর্ণে পরিণত হয়।
প্রস্ফুটিত হইবার সময়ের সহিত পুষ্পের বর্ণের যে কোন গূঢ় সম্বন্ধ আছে তাহার আভাষ আমরা পূর্ব্বে দিয়াছি। খোঁজ করিলে প্রাণীদের মধ্যেও ঐ প্রকার একটা বর্ণবিভাগের লক্ষণ ধরা পড়ে। মাংসাশী বন্য জন্তুর বর্ণ প্রায়ই একরঙা হয় না,—ব্যাঘ্র, হায়েনা, বনবিড়াল, জাগুয়ার প্রভৃতি অনেকেরই দেহ বিচিত্র বর্ণের লোমে আবৃত থাকে। উদ্ভিদ্ভোজীদের মধ্যে রঙিন জন্তু নাই একথা বলা যায় না,—জেব্রা, জিরাফ, এবং কয়েক জাতীয় হরিণের রঙ মাংসাশীদের মতই বিচিত্র; কিন্তু ইহাদের সংখ্যা নিতান্ত অল্প। গো-জাতির প্রতি দৃষ্টিপাত করিলে দেখা যায়, গোরুর গায়ে ডোরা ও চিতে উভয়ই দেখা যায় বটে, কিন্তু ঘোড়ার গায়ে কখনই জিরাফ বা জেব্রার মত ডোরা রঙিন দাগ জন্মে না। এগুলিকে কখনই আকস্মিক ব্যাপার বলা যায় না। খুব সম্ভবতঃ ইহাদের মূলে কোন রহস্য লুক্কায়িত আছে; কিন্তু সে রহস্য যে কি, তাহা আজও কেহ জানে না। পূর্ব্বোক্ত বর্ণ-বৈচিত্র্যগুলিকে আত্মরক্ষার ছদ্মবেশ বলিলে অন্যায় বলা হয়।
যে-সকল গোরুর গায়ে দুই বা তিন প্রকার রঙ্ থাকে, তাহাদের দেহের বর্ণবিন্যাসে আর একটি বিশেষত্ব দেখা যায়। ইহাদের ঘাড় বা মাথার রঙ্ কখনই দেহের অবশিষ্টাংশ অপেক্ষা ফিকে হয় না। পিছনটা লাল বা কালো এবং ঘাড় ও মাথা সাদা—এ প্রকার গোরু দুর্লভ। সাদায় ও কালোতে মিশানো পালিত শূকর প্রায়ই দেখা যায়, কিন্তু বন্য-শূকরে কখনই একাধিক রঙ্ দেখা যায় না। পাহাড়ের বন্য ছাগ কদাচিৎ বিচিত্র রঙের লোমে আবৃত হইয়া জন্মগ্রহণ করে। কালো ঘোড়ায় সাদা চিতি অর্থাৎ তিলক-চিহ্ন দুর্লভ নয়, কিন্তু ইহা প্রায়ই চারিখানি পা ও মস্তকে আবদ্ধ থাকে; কালোর উপরে সাদা চিতি, ঘোড়ার অপর অঙ্গপ্রত্যঙ্গে কদাচিৎ জন্মে।
এইসকল বর্ণ-বৈচিত্র্যের ব্যাখ্যান জীবতত্ত্ববিদের নিকট পাওয়া যায় না। আধুনিক বৈজ্ঞানিকগণ যতই দম্ভ প্রকাশ করুন না কেন, প্রাণী ও উদ্ভিদের জীবনে এখনো এমন অনেক ঘটনা নিয়তই ঘটিতেছে যাহার ব্যাখান দিতে গেলে তাঁহাদের জ্ঞানে কুলায় না। জীবের বর্ণ-বৈচিত্র্যকে ঐ প্রকার একটি অব্যাখ্যাত রহস্যপূর্ণ ব্যাপার বলিয়া স্বীকার করিতে হইতেছে।