প্রাকৃতিকী/বৃক্ষের চক্ষু
বৃক্ষের চক্ষু
বাহির হইতে দেহে আঘাত-উত্তেজনা প্রয়োগ করিলে, প্রাণীর স্বায় বৃক্ষগণও যে তাহা অনুভব করে, আমাদেরই দেশের মহাপণ্ডিত বিজ্ঞানাচার্য্য জগদীশচন্দ্র বসু মহাশয় ইহা প্রত্যক্ষ পরীক্ষা করিয়া দেখাইয়া প্রতিপন্ন করিয়াছেন। লজ্জাবতী লতার শাখায় চিম্টি কাটিতে থাক বা শাখার কোন অংশ একটু পোড়াইয়া দাও, দেখিবে দূরের পাতাগুলি এই সকল অত্যাচারের বেদনায় গুটাইয়া আসিতেছে। এই বেদনাটা যে কি রকমের তাহা আমাদের জানা নাই, এবং বোধ হয় জানিবার উপায়ও নাই; কিন্তু চিম্টি কাটায় বৃক্ষদেহে যে একটা পরিবর্ত্তন শুরু করা যায়, তাহা যে দেহের ভিতর দিয়া চলিয়া দূরের পাতাগুলিকে গুটাইয়া দেয়, ইহাতে আর সন্দেহ নাই। সম্প্রতি বসু মহাশয় ইহাও দেখাইয়াছেন যে, প্রাণিদেহের ন্যায় উদ্ভিদের দেহও স্নায়ুজালে আবৃত। প্রাণীর কোন অঙ্গে বেদনা দিলে তাহা যেমন স্নায়ুসূত্রগুলির সাহায্যে বাহিত হইয়া সর্ব্বাঙ্গে নীত হয়, উদ্ভিদের দেহেও আঘাতের উত্তেজনা অবিকল সেই প্রকারে চলাচল করে। কিন্তু উদ্ভিদের চক্ষু আছে, এই কথাটি সম্পূর্ণ নূতন।
মনুষ্য প্রভৃতি উচ্চশ্রেণীর প্রাণীর দেহযন্ত্র ও ইন্দ্রিয়গুলি এক দিনে এত উন্নত অবস্থায় উপনীত হয় নাই। বিজ্ঞানের কথা মানিলে স্বীকার করিতে হয়, লক্ষ লক্ষ বৎসরের বহু পরিবর্ত্তনের ধারায় পড়িয়া মানুষ তাহার এখনকার এমন সুব্যবস্থিত চক্ষু কর্ণ প্রভৃতি জ্ঞানেন্দ্রিয়গুলি লাভ করিয়াছে। সুতরাং যে সকল প্রাণী এখনও জীব-পর্য্যায়ের খুব নীচের কোটায় অবস্থিত, তাহাদের দেহে মানুষের চক্ষু কর্ণাদির ন্যায় সুব্যবস্থিত ইন্দ্রিয় না থাকিবারই কথা। মানুষের চক্ষুর সহিত পতঙ্গাদি ইতর প্রাণীর চক্ষুর তুলনা করিলে এই ভেদ সুস্পষ্ট বুঝা যায়। জীবতত্ত্ববিদ্গণ উদ্ভিদ্-জাতিকে জীবপর্য্যায়ের নিম্নতম স্তরে স্থান দিয়া থাকেন, কাজেই মানুষ চক্ষুর সাহায্যে বাহিরের নানা বস্তু ও নানা বর্ণ দেখিয়া যে সৌন্দর্য্য অনুভব করে উদ্ভিদের তাহা প্রয়োজন হয় না। আঁধার হইতে আলোককে চিনিয়া লওয়া এবং কোন্ দিক্ হইতে আলোক আসিতেছে তাহা বুঝিয়া লওয়া যেমন নিম্নশ্রেণীর প্রাণীদিগের দর্শনেন্দ্রিয়ের প্রধান কার্য্য, উদ্ভিদের চক্ষুর কার্য্যও কতকটা তদ্রূপ। বৃক্ষের চক্ষুকে মানবচক্ষুর সহিত তুলনা করা যায় না, কিন্তু ইতর পতঙ্গদিগের চক্ষুর সহিত তুলনা করিলে, ইহাকে কোন অংশে হীন বলা যায় না।
জর্ম্মান্ অধ্যাপক হাবারল্যাণ্ড (Haberlandt) সাহেব উদ্ভিদের শরীরতত্ত্বের অনেক নূতন কথা প্রকাশ করিয়া প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছেন। বৃক্ষের চক্ষুর কথাটাও তিনি সম্প্রতি প্রচার করিয়াছেন। চক্ষুর মোটামুটি কার্য্য কি, তাহা অনুসন্ধান করিলে দেখা যায়, বাহিরের নানা পদার্থের ছবি চক্ষুর ভিতরে আনিয়া ফেলিতে পারিলেই তাহার কাজ এক প্রকার শেষ হইয়া যায়। অবশ্য মনুষ্য প্রভৃতি উচ্চশ্রেণীর চক্ষু যেমন জটিল, তাহার কার্য্যও সেই প্রকার বিচিত্র; কিন্তু সমগ্র প্রাণিজাতির চক্ষুর কার্য্যও কি তাহা অনুসন্ধান করিলে, পূর্ব্বোক্ত ব্যাপারটিই আমাদের নজরে পড়িয়া যায়।
পাঠকের অবশ্যই জানা আছে, বাহিরের দৃশ্যকে যখন আমরা কোন সংকীর্ণ স্থানে আনিতে চাই, তখন আমাদিগকে Convex Lens অর্থাৎ স্থূলমধ্য কাচ ব্যবহার করিতে হয়। ফোটোগ্রাফার যখন একটি চৌদ্দ পোয়া মানুষের ছবি একখানি ক্ষুদ্র কাগজের উপরে উঠাইতে চাহেন, তখন তিনিও ঐ স্কুল-মধ্য কাচ ব্যবহার করেন। তাঁহার ক্যামেরার সম্মুখে সেই কাচ লাগানো থাকে, বাহিরের বৃহৎ বস্তুর ক্ষুদ্র ছবি ঐ কাচেরই সাহায্যে ছোট হইয়া ক্যামেরার ভিতরে আসিয়া পড়ে। আমাদের চক্ষু যখন বাহিরের ছবিকে ছোট করিয়া ভিতরে ফেলে তখন তাহাও ঐ কৌশল অবলম্বন করে; চক্ষুর ভিতরে অবশ্য স্থূলমধ্য কাচ থাকে না, কিন্তু কাচের মতই এক প্রকার স্বচ্ছ তরল পদার্থ এমন ভাবে চক্ষুর ভিতরে সজ্জিত থাকে যে, তাহা ক্যামেরার স্থূলমধ্য কাচখণ্ডেরই ন্যায় বাহিরের নানা দৃশ্যকে ছোট করিয়া অক্ষি পর্দ্দার (Retina) উপরে ফেলে। সুতরাং বৃক্ষের কোন অঙ্গে যদি ঐ প্রকার স্থূলমধ্য স্বচ্ছ পদার্থ দেখা যায় এবং তাহা বাহিরের দৃশ্যকে ছোট করিয়া বৃক্ষদেহের ভিতরে ফেলিতেছে ইহাও যদি অনুসন্ধানে জানা যায়, তাহা হইলে স্বীকার করিতেই হয়, গাছেরও চক্ষু আছে। সম্প্রতি পূর্ব্বোক্ত জর্ম্মান্ পণ্ডিতটি গাছের শাখাপত্রাদির ছালে অবিকল এই প্রকার চক্ষু আবিষ্কৃত করিয়াছেন। ছালের উপরি ভাগে যে-সকল কোষ সজ্জিত থাকে তাহাদেরই মধ্যে কতকগুলি এক প্রকার অতি স্বচ্ছ রসে পূর্ণ থাকিয়া স্থূলমধ্য কাচের মত কার্য্য করে। ইহাতে যে কোষগুলির মধ্যে কেবল বাহিরের দৃশ্যাবলীর ক্ষুদ্র ছবি আসিয়া পড়ে তাহা নয়, বাহিরের সূর্যকিরণের তাপও ঐ স্থূলমধ্য স্বচ্ছ পদার্থের সাহায্যে কেন্দ্রীভূত হইয়া কোষে জমা হয় এবং ইহাতে উদ্ভিজ্জ-কোষ সক্রিয় হইয়া পড়ে।
বৃক্ষের পাতায় ও ছালে পরিব্যাপ্ত এই সহস্র সহস্র চক্ষুগুলি বাহিরের দৃশ্যের সহস্র সহস্র ক্ষুদ্র ছবি কোষের মধ্যে উৎপন্ন করিয়া কি কার্য্য সম্পন্ন করে, তাহা বলা কঠিন, কিন্তু তাই বলিয়া এই চক্ষুগুলি যে বৃথা ছবি উৎপন্ন করে তাহা কখনই বলা যায় না। পাঠক অবশ্যই অবগত আছেন, সাধারণ মক্ষিকার মস্তকের দুই পার্শ্বে যে দু’টা বড় বড় চক্ষু দেখা যায়, সে গুলি বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চক্ষুর সমষ্টি। মক্ষিকার প্রত্যেক চক্ষুটি প্রায় চারি হাজার অতি ক্ষুদ্র চক্ষুর যোগে উৎপন্ন, সাধারণ অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়া পরীক্ষা করিলে এগুলিকে সুস্পষ্ট দেখা যায়। প্রজাপতির চক্ষু সংখ্যা আবার আরও অধিক। ইহাদের মস্তকের দুই পার্শ্বে যে দু’টা চক্ষু থাকে তাহাদের প্রত্যেকটি সতেরো হাজার ক্ষুদ্রতর চক্ষুর যোগে উৎপন্ন। মক্ষিকা, প্রজাপতি প্রভৃতি পতঙ্গগণ এই সহস্র সহস্র চক্ষুর সাহায্যে তাহাদের চারিদিকের দৃশ্যাবলীকে কি প্রকারে দেখে তাহা আমাদের জানা নাই, কিন্তু দেহরক্ষার জন্য এই সকল চক্ষুর যে কোন প্রকার কার্য্য আছে, তাহা আমরা অনুমান করিতে পারি। অধ্যাপক হাবারল্যাণ্ড সাহেব বলিতেছেন, উদ্ভিদের পত্র ও শাখার উপরে যে অসংখ্য চক্ষু সজ্জিত রহিয়াছে সেগুলি পতঙ্গের চক্ষুর ন্যায়ই কার্য্য করে। যেদিন পতঙ্গের দৃষ্টিতত্ত্ব আমাদের নিকটে সুস্পষ্ট হইবে, হয় ত সেই দিনই বৃক্ষের চক্ষুগুলির কার্য্য আমরা বুঝিতে পারিব।