প্রাকৃতিকী/মৃত্যুর নবরূপ
মৃত্যুর নবরূপ
জীবজগতের প্রতি স্থূলভাবে দৃষ্টিপাত করিলে দেখা যায়, যেন বংশরক্ষা করাই প্রাণী ও উদ্ভিদের জন্মগ্রহণের প্রধান উদ্দেশ্য। প্রাণীই বল, আর উদ্ভিদ্ই বল, এক একটি সুক্ষ্ম জীবকোষ হইতে ইহাদের প্রত্যেকেরই উৎপত্তি। এই এককোষময় জীবই ভ্রূণের মধ্যে বহুকোষবিশিষ্ট হইয়া তাহাদের নির্দ্দিষ্ট আকার প্রাপ্ত হয়। ইহার পরে নিজেদের দেহ পরিণত হইলে তাহারাই আবার একাধিক এককোষময় নুতন জীবাকে জন্ম দিয়া জীবনের কার্য্য সমাপন করে। এই অবস্থায় উপনীত হইলে জীব যেন প্রকৃতির ত্যাজ্যপুত্র হইয়া পড়ে এবং মৃত্যুর ক্রোড়ই তাহাদের বিশ্রামের স্থান হয়। ঔষধিজাতীয় সকল উদ্ভিদ্ই একবারমাত্র ফল প্রদান করিয়া এই প্রকারে মৃত হয় এবং অনেক ইতর প্রাণীও সন্তানের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে মরিয়া যায়। সুতরাং দেখা যাইতেছে, সমগ্র সংসার চক্রের আবর্ত্তনের সহিত জীবের জীবনটাও চক্রপথে আবর্ত্তিত হইতেছে। এককোধময় জীব হইতে আবার নূতন এককোষময় জীবে পরিণতি, জীবজগতে আসৃষ্টি চলিয়া আসিতেছে। এই সকল দেখিয়া সত্যই মনে হয়, নিজের বংশের ধারাটিকে অক্ষুণ্ণ রাখিয়া মরিয়া যাওয়াই জীবনের সার্থকতা।
বলা বাহুল্য, জীবনের লক্ষ্য ও মৃত্যুসম্বন্ধে পূর্ব্বোক্ত কথাগুলি খাঁটি জড়বিদ্গণের স্থূল কথা। মাতাপিতা হইতে জন্ম গ্রহণ করিয়া আহারাদির দ্বারা শরীর পুষ্ট করা এবং শেষে নিজের জীবনের ধারা সন্তানের দেহে রাখিয়া দেহত্যাগ করা, উদ্ভিদ্ ও ইতর প্রাণীর জীবনের লক্ষ্য হইলেও, তাহা কখনই মানুষের জীবনের লক্ষ্য নয়। মানুষ যে উচ্চ বুদ্ধির অধিকারী হইয়া জন্মগ্রহণ করে, বংশরক্ষার জন্য তাহার প্রয়োজন অতি অল্প। কাজেই প্রকৃতিদেবী নিজের হাতে যে অমূল্য শক্তিটুকু মানুষের দেহে যোজনা করিয়া রাখিয়াছেন, অপর প্রয়োজন-সিদ্ধির জন্য তাহার ব্যবহার আছে বলিয়া স্বীকার করিতেই হয়। যাহা হউক এই কঠিন দার্শনিক ব্যাপারে প্রবেশ করা বর্ত্তমান প্রবন্ধলেখকের অধিকার বহির্ভূত। আমাদের আলোচ্য বিষয় হইতেছে,—মৃত্যু। মৃত্যুর ন্যায় কঠোর সত্য বোধ হয় জগতে আর দ্বিতীয় নাই।
পৃথিবীর সকল প্রাণীই মানুষের মত জটিল ইন্দ্রিয়সম্পন্ন হইয়া জন্মে না। যাহাদের চক্ষু কর্ণ নাসিকা জিহ্বা কিছুই নাই, এপ্রকার প্রাণীর সংখ্যা ভূমণ্ডলে বড় অল্প নয়। ইহারা অচেতন জড়কণার ন্য়ায় জলে বা স্থলে অবস্থান করে, কোন খাদ্যদ্রব্য গায়ে ঠেকিলে তাহার সারভাগ শোষণ করিয়া দেহের পুষ্টিসাধন করে। ইহাদের মধ্যে স্ত্রীপুরুষ-ভেদও দেখা যায় না, নিজেদের দেহগুলিকে খণ্ডিত করিয়া বংশবিস্তার করাই ইহাদের ক্ষুদ্র জীবনের সার্থকতা বলিয়া মনে হয়। এই সকল প্রাথমিক প্রাণীর মৃত্যু পরীক্ষা করিলে দেখা যায়, মৃত্যুটা অতি সোজা ব্যাপার, তাহাতে জটিলতার লেশমাত্র বর্ত্তমান নাই। ঘুতে উত্তাপ দিলে তাহা যেমন গলিয়া তরলাকার প্রাপ্ত হয়, ইহাদের মৃত্যুও যেন সেইপ্রকার। জীবনের কার্য্য শেষ হইলে তাহাদের দেহ অতি ধীরে ধীরে বিশ্লিষ্ট হইয়া পড়ে, —পঞ্চভূতে গড়া জিনিষ আবার পঞ্চভূতে মিশিয়া যায়। উচ্চপ্রাণীদের দেহের গঠন যেমন জটিল, তাহাদের মৃত্যুও তেমনি আকস্মিক ও ভয়ানক। ষ্টীম এঞ্জিনের মত একটা জটিল যন্ত্রের কোন কল-কব্জা খারাপ হইলে তাহা কতই বিকৃত স্বরে আর্ত্তনাদ করে এবং শেষে হঠাৎ তাহার ক্রিয়া বন্ধ হইয়া যায়, কিন্তু ঢেঁকির মত কোন সরল যন্ত্রের বিকলতায় এত আর্ত্তনাদ, এত ঝনঝনানি এত ফোঁস্ফাঁস্ শব্দ শুনা যায় না। উচ্চপ্রাণীর দেহ ষ্টীম এঞ্জিনের মতই জটিল, ভাই তাহার দেহ-যন্ত্রের কোন অংশে একটু খুঁৎ হইলেই কল বন্ধ হইয়া যায়। সর্ব্বাঙ্গের রক্তসঞ্চালন জীবনরক্ষার একটা প্রধান অবলম্বন, কাজেই রক্তের চলাচল বন্ধ হইলেই প্রাণীর মৃত্যু ঘটে। রক্তে যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র লোহিত কণিকাগুলি ভাসিয়া বেড়ায় তাহা অক্সিজেন বহন করিয়া সর্ব্বাঙ্গে ছড়াইয়া দেয়, সুতরাং রক্তে যদি অক্সিজেন না থাকে তবে মৃত্যু অনিবার্য্য হয়। অক্সিজেন শ্বাস-প্রশ্বাসের দ্বারাই দেহাভ্যন্তরে প্রবেশ করে, অতএব নিশ্বাসরোধ হইলেই প্রাণীর মৃত্যু সংঘটিত হয়। সুতরাং দেখা যাইতেছে, আত্মা দেহপঞ্জর ত্যাগ করিলেই মৃত্যু ঘটে এই প্রকার ব্যাখ্যান দিয়া দার্শনিকগণ যেপ্রকার নিশ্চিন্ত হন, শারীরবিদ্গণ -মৃত্যুর সেপ্রকার ব্যাখ্যান দিতে পারেন না। অনুসন্ধান করিতে গিয়া ইঁহারা প্রাণীর সকল ইন্দ্রিরে-ও সকল অঙ্গে প্রাণ দেখিতে পাইয়াছেন। সমগ্র প্রাণিশরীর ইঁহাদের মতে প্রাণময়।
সম্প্রতি ফ্রান্সের এক বৈজ্ঞানিক-পরিষদে (French Academy of Medicine) ডাক্তার ক্যারেল্ (Dr. Alexis Carrel) মৃত্যুসম্বন্ধে যে কতকগুলি নূতন কথা বলিয়াছেন, তাহাই বড়ই বিস্ময়াবহ। আজকাল আজ্গবি বৈজ্ঞানিক সংবাদের অভাব নাই, সংবাদপত্রের পাতা উল্টাইলেই অনেক অদ্ভুত খবর জানা যায়। কিন্তু ডাক্তার ক্যারেল্ একজন নামজাদা শারীরবিৎ এবং ফ্রান্সের একাডেমি অব্ মেডিসিন্ নামক পরিষৎটিও সর্ব্বদেশে সুপরিচিত; এই সকল কারণে নূতন কথাগুলির উপর আস্থা-স্থাপন করিতে হইতেছে। কয়েক বৎসর পূর্ব্বে এই ক্যারেল্ সাহেবই সদ্যোমৃত প্রাণীর দেহ হইতে মাংস ছিন্ন করিয়া তাহা জীবিত রাখিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন। চেষ্টা সার্থক হইয়াছিল। নানা প্রকার আরকের মধ্যে নিমজ্জিত থাকিয়া মাংসখণ্ড জীবনের লক্ষণ দেখাইতে আরম্ভ করিয়াছিল, এবং শেষে তিনি এই মাংসখণ্ড জীবিত পশু-প্রভৃতির ক্ষত স্থানে জোড় লাগাইতেও কৃতকার্য্য হইয়াছিলেন। এই অত্যাশ্চর্য্য পরীক্ষার ফলে বৈজ্ঞানিকমণ্ডলী বুঝিয়াছিলেন, যে দেহটিকে আমরা মৃত বলি তাহার অংশবিশেষ মৃত্যুর ভান করিয়া কিছুক্ষণ জীবিত থাকে। ইহারা মৃতদেহের এই জীবনকে “Intra-cellular Life” অর্থাৎ কৌষের জীবন নামে আখ্যাত করিয়াছিলেন। এই আবিষ্কার খুবই বিস্ময়কর, কিন্তু সম্প্রতি ডাক্তায় ক্যারেল্ তাঁহার যে নবাবিষ্কারের বিধরণ দিয়াছেন তাহা আরও বিস্ময়জনক। ইনি দেখিয়াছেন, দেহ হইতে বিচ্ছিন্ন হইলে যে, কেবল মাংসপিণ্ডই জীবিত থাকে তাহা নয়; হৃৎপিণ্ড প্রভৃতি বিশেষ বিশেষ যন্ত্রগুলিকেও দেহ হইতে ছিন্ন করিলেও সেগুলিকে জীবিত রাখা যায় এবং দেহে সংযুক্ত থাকিলে তাহারা যে-সকল কার্য্য চালাইত, এই অবস্থায় তাহারা অবিকল সেই সকল কার্য্য চালায়। প্রাণীর হৃৎপিণ্ড তালে তালে সঙ্কুচিত ও প্রসারিত হইয়া দেহে রক্ত সঞ্চার করে; ফুস্ফুস্ বায়ু হইতে অক্সিজেন গ্রহণ করে এবং বিষময় অঙ্গারক বাষ্প দেহচ্যুত করে; পাকাশয়ের যন্ত্রগুলি খাদ্যের সার অংশ গ্রহণ করে এবং ইহা হইতে রক্তকণিকা প্রস্তুত করে। আশ্চর্য্যের বিষয়, এই সকল শারীরযন্ত্রগুলিকে দেহ হইতে ছিন্ন করিয়া সাবধানে রাখিলে সেগুলি জীবিত থাকিয়া নিজেদের নির্দ্দিষ্ট কার্য্যগুলিও দেখায়। কাজেই স্বীকার করিতে হইতেছে, দেহ হইতে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় সেগুলি জীবনের কার্য্য দেখাইতে থাকে।
এ পর্য্যন্ত জগতে যত বৃহৎ আবিষ্কার হইয়াছে, তাহাদের ইতিহাস অনুসন্ধান করিলে দেখা যায়, আবিষ্কারকগণ এক একটা অবান্তর ব্যাপারে তাঁহাদের আবিষ্কারগুলির আভাস পাইয়া পরে কঠোর সাধনায় সে গুলির প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন। ক্যারেল্ সাহেবও এই আবিষ্কারের আভাস একটা অবান্তর ব্যাপারে দেখিয়াছিলেন। অল্পদিন হইল রাত্রি দশটার সময়ে ফ্রান্সের জনৈক বিখ্যাত ধনীর মৃত্যু হয়। ইঁহার অগাধ সম্পত্তির উত্তরাধিকারী একমাত্র নাবালক পুত্র। আইন অনুসারে সাবালকত্ব পাইবার যে বয়সের সীমা আছে, পুত্রটি সেইদিন রাত্রি বারোটার পর তাহা উত্তীর্ণ করিবে। আত্মীয়-স্বজনগণ চিন্তিত হইলেন; কারণ নাবালক অবস্থায় পিতৃবিয়োগ হইলে পিতার ত্যক্ত সম্পত্তি পরে করায়ত্ত করা অনেক ব্যয়সাধ্য। মৃত পিতাকে দুই ঘণ্টা জীবিত রাখার ব্যবস্থার জন্য ফ্রান্সের বিখ্যাত চিকিৎসকগণকে আহ্বান করা হইল। ক্যারেল্ সাহেব মৃতদেহের বিশেষ বিশেষ স্থানে নানাপ্রকার ঔষধ ক্ষুদ্র পিচ্কারি দ্বারা প্রবেশ করাইতে লাগিলেন। নিঃস্পন্দ হৃদযন্ত্রে আবার স্পন্দন দেখা দিল, দেহের উত্তাপ বাড়িয়া চলিল, এবং ফুস্ফুস্ও ঔষধের উত্তেজনায় সাড়া দিয়া শ্বাসকার্য্য চালাইতে লাগিল। কাজেই মৃতদেহে নবজীবনের সঞ্চার হইল। ডাক্তার ক্যারেল এই প্রকারে দশটার সময়ে মৃত ব্যক্তিকে সজীব করিয়া বারোটা পনেরো মিনিট পর্যন্ত জীবিত রাখিয়াছিলেন; কিন্তু মৃতদেহে চেতনার সঞ্চার করিতে পারেন নাই। এই ঘটনাই ক্যারেল্ সাহেবকে গবেষণার পথ নির্দ্দেশ করিয়া দিয়াছিল।
যাহা হউক, আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের পূর্ব্বোক্ত আবিষ্কারে দেশবিদেশের বৈজ্ঞানিকগণ খুব উৎসাহিত হইয়া পড়িয়াছেন এবং আশা করিতেছেন, হয় ত কোন দিন মৃতদেহে চেতনারও সঞ্চার করিতে পারিবেন। চেতনা জিনিষটা যে কি, তাহা আজও জড়বিদ্গণের জ্ঞানের বাহিরে রহিয়াছে, সুতরাং মৃতদেহে চেতনার সঞ্চার করা এখন সম্ভবপর কিনা সুধী পাঠক বিবেচনা করুন।