প্রাকৃতিকী/একটি নূতন আবিষ্কার
একটি নূতন আবিষ্কার
গত শতাব্দীর শেষার্দ্ধে ডারুইনের অভিব্যক্তিবাদ সুপ্রতিষ্ঠিত হইলে, জীবের উৎপত্তির উপর বৈজ্ঞানিকদিগের দৃষ্টি পড়িয়াছিল। এক দল বৈজ্ঞানিক বলিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন, জীব হইতেই জীবের উৎপত্তির সম্ভাবনা; মাতৃপিতৃসাহায্য-ব্যতীত জীবের জন্ম হইতেই পারে না। আর একদল পণ্ডিত ইহার প্রতিবাদ করিয়া স্বতঃজনন(Spontaneous generation) সিদ্ধান্ত প্রচার করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। সুপ্রসিদ্ধ জীবতত্ত্ববিৎ পুচে (Pouchet) সাহেব স্বতঃজননবাদীদিগের নেতা ছিলেন, এবং পরে অধ্যাপক বাষ্টিয়ান্ (Bastion) ইহার সহযোগী হইয়াছিলেন। ইঁহারা বলিতেন, জীব হইতে জীবের উৎপত্তি হয় সত্য, কিন্তু ইহাই জীবোৎপত্তির একমাত্র ধারা নয়। অজীব হইতে জীবের উৎপত্তি আমাদের চারিদিকে নিয়তই চলিতেছে। উদাহরণ জিজ্ঞাসা করিলে ইঁহারা গলিত উদ্ভিদ্ ও প্রাণিদেহের প্রতি অঙ্গুলি নির্দ্দেশ করিয়া বলিতেন, এগুলিতে যে অতিক্ষুদ্র অসংখ্য কীটের উৎপত্তি দেখা যায়, তাহাই স্বতঃজননের প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
১৮৬২ খৃষ্টাব্দে ফরাসী বৈজ্ঞানিক লুই পাষ্টুর (Pasteur) এই স্বতঃজননবাদীদিগের সমগ্র যুক্তিতর্কের মূলোচ্ছেদ করিয়াছিলেন। গলিত জীবদেহে যে-সকল ক্ষুদ্র কীটের উৎপত্তি হয়, সেগুলি যে মাতৃপিতৃয়াহায্য গ্রহণ করিয়াই জন্মগ্রহণ করে, পাষ্টুর সাহেব এবং ইংরাজ বৈজ্ঞানিক টিন্ডাল্ সাহেব তাহা প্রত্যক্ষ দেখাইয়াছিলেন।
ইহার পর বহুকাপ স্বতঃজননবাদীদিগের কণ্ঠস্বর শুনা যায় নাই। বিরোধী পণ্ডিতসম্প্রদায় প্রত্যক্ষ পরীক্ষায় স্বতঃজননের প্রায় সকল ব্যাপারগুলির উচ্ছেদ সাধন করিয়াছিলেন সত্য, কিন্তু পৃথিবীর আদিম জীব যে স্বতঃজাত নয়, তাহা ইঁহারা প্রমাণ করিতে পারেন নাই। কাজেই স্বতঃজনন কথাটা জীবতত্ত্ব সম্বন্ধীয় গ্রন্থের এক অংশে থাকিয়া গিয়াছিল।
আজ প্রায় তিন বৎসর হইল বার্ক নামক জনৈক ইংরাজ বৈজ্ঞানিক কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগারে রেডিয়ম্ নামক নবাবিষ্কৃত ধাতুটির পরীক্ষায় নিযুক্ত ছিলেন। তিনি সেই সময়ে স্বতঃজননের সন্ধান পাইয়াছিলেন বলিয়া একটা সংবাদ জানা গিয়াছিল; ইহাতে স্বতঃজননবাদের ছিন্ন মূল এই আবিষ্কারে পল্লবিত হইবে বলিয়া আশা হইয়াছিল। কিন্তু অপর বৈজ্ঞানিকদিগের কঠোর পরীক্ষায় বার্কের আবিষ্কার অটল থাকিতে পারে নাই। বিচারে ইঁহার অনেক ভুল ধরা পড়িয়াছিল।
সম্প্রতি ডুবার্ন্ (Dubarn) নামক জনৈক ফরাসী বৈজ্ঞানিক এই প্রসঙ্গের আর একটি নূতন তত্ত্ব আবিষ্কার করিয়াছেন বলিয়া শুনা যাইতেছে। আবিষ্কারটি কেবল স্বতঃজননেরই পোষক নয়, ইহা পদার্থমাত্রেরই গোড়ার খবর আনিয়া দিবার উপক্রম করিতেছে। আবিষ্কারক জৈব অজৈব সকল পদার্থকে অতি সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম কণায় চূর্ণ করিয়া প্রত্যেক কণাকেই সজীব পদার্থের ্যায় নড়িতে চড়িতে দেখিয়াছিলেন।
আবিষ্কারক ডুবার্ন্ সাহেব বিদেশী হইলেও, তিনি কয়েক বৎসর আমাদের দেশে বাস করিতেছিলেন, এবং এই কলিকাতায় বসিয়াই তাঁহার আবিষ্কার সুসম্পন্ন করিয়াছেন, তাই আমরা অতি আগ্রহের সহিত আবিষ্কারবিবরণটি লিখিতে বসিয়াছি।
জীববিদ্যা আজকাল যে প্রকার দ্রুতগতিতে উন্নতির পথে চলিয়াছে, তাহা আলোচনা করিলে এক অণুবীক্ষণ যন্ত্রকেই উন্নতির প্রধান সহায় বলিয়া মনে হয়। প্রাণী ও উদ্ভিদের প্রধান গঠনোপাদান, জীবসামগ্রীর (Protoplasm) অত্যাশ্চর্য্য কার্য্য এবং জীবদেহের কোষগুলির জন্মমৃত্যুর রহস্য এক অণুবীক্ষণ যন্ত্রই চক্ষুতে দিব্য দৃষ্টি যোজনা করিয়া আমাদিগকে দেখাইতেছে। জীবতত্ত্বের গবেষণায় আজকাল যে-সকল অণুবীক্ষণযন্ত্রের ব্যবহার হয়, সেগুলিকে নানা প্রকারে সুব্যবস্থিত করা সত্ত্বেও সর্ব্বাঙ্গসুন্দর করা যায় নাই। জীবাণু (Bacteria) প্রভৃতি অতিক্ষুদ্র বস্তু অণুবীক্ষণ দ্বারা দেখিতে গেলে, নানাপ্রকার রঙ্ দিয়া সেগুলিকে আজও রঞ্জিত করিতে হয়, নচেৎ পরীক্ষাকালে তাহারা মোটেই আমাদের চোখে পড়ে না। তা’ছাড়া জীবাণুগুলি যাহাতে নড়িয়া চড়িয়া যন্ত্রের দৃষ্টিক্ষেত্র হইতে বহির্গত হইয়া না পড়ে, তজ্জন্য সময়ে সময়ে বলপ্রয়োগ করিয়া তাহাদিগকে দৃষ্টিক্ষেত্রে আবদ্ধ রাখা হয়। প্রচলিত অণুবীক্ষণযন্ত্রকে সংস্কৃত করিয়া নূতন প্রথায় একটি উন্নত যন্ত্র নির্মাণ করিবার জন্য ডুবার্ন্ সাহেব অনেকদিন অবধি চেষ্টা করিয়াছিলেন। জীবাণুর ন্যায় অতি সুক্ষ্ম জীবগণের স্বচ্ছন্দবিহার বন্ধ করিয়া এবং তাহাদের দেহাভ্যন্তরে রঙ্ প্রবেশ করাইয়া পর্য্যবেক্ষণ করিলে যে, তাহাদের জীবনের স্বাভাবিক কার্য্য প্রত্যক্ষ করা কঠিন হইয়া পড়ে, তাহা বুঝিয়াই তিনি নূতন যন্ত্র নির্ম্মাণের চেষ্টা আরম্ভ করিয়াছিলেন। সম্প্রতি ইহার চেষ্টা সফল হইয়াছে। সূর্য্যালোককে বা বিদ্যুদালোককে আবশ্যক মত প্রথর করিয়া যন্ত্রে ফেলিবারও একটি সুন্দর কৌশল সঙ্গে সঙ্গে আবিষ্কৃত হইয়া পড়িয়াছে। তা-ছাড়া ইনি অণুবীক্ষণের শক্তিকে বৃদ্ধি করিবারও একটি সুন্দর উপায় উদ্ভাবন করিয়াছন। ইহার স্বহস্তনির্ম্মিত যন্ত্রটির শক্তি এত অধিক হইয়াছে যে, ইহা দ্বারা কোন ক্ষুদ্র জিনিষ পরীক্ষা করিলে যন্ত্রে তাহার আকার ছয় লক্ষ চল্লিশ হাজার গুণ দীর্ঘপ্রস্থে বড় দেখায়। অণুবীক্ষণযন্ত্র এপর্য্যন্ত কেবল নামেই অণুবীক্ষণ ছিল। কোন যন্ত্র সাহায্যে অদ্যপি অণুর সাক্ষাৎ পাওয়া যায় নাই। ডুবার্ন্ সাহেব তাঁহার অণুবীক্ষণকে সত্যই অণুবীক্ষণ করিয়া গড়িয়া তুলিয়াছেন।
স্বর্ণ রৌপ্য প্লাটিনম্ প্রভৃতি কতকগুলি ধাতুকে চুর্ণ করিয়া ও পিষিয়া তাহাদেরি ইন্দ্রিয়াগ্রাহ্য অতিসূক্ষ্ম কণাগুলিকে লইয়া ডুবার্ন্ সাহেব তাঁহার নিজের হাতের অণুবীক্ষণযন্ত্রে পরীক্ষা আরম্ভ করিয়াছিলেন। কণাগুলির প্রকৃত ব্যাসের পরিমাণ এক ইঞ্চির চল্লিশ হাজার ভাগের এক ভাগ মাত্র ছিল, কিন্তু যন্ত্রে সেগুলির প্রত্যেককে এক একটি শিশিরবিন্দুর আকারে দেখা গিয়াছিল। আশ্চর্য্যের বিষয়, ইনি যতগুলি পদার্থের কণা লইয়া পরীক্ষা করিয়াছিলেন, সকলকেই সম্পূর্ণ গোলাকার এবং একই আয়তনবিশিষ্ট দেখিয়াছিলেন।
ইহার পর আরো সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ করিয়া ডুবার্ন্ সাহেব অপর যে-সকল কার্য্য প্রত্যক্ষ করিয়াছিলেন, তাহা আরো বিস্ময়কর। পরীক্ষায় প্রত্যেক কণাটিকেই তিনি চঞ্চল দেখিয়াছিলেন, মাধ্যাকর্ষণের নিয়ম না মানিয়া প্রত্যেকেই সজীব পদার্থের ন্যায় চলাফেরা আরম্ভ করিয়াছিল। কণাগুলিতে অত্যন্ত তাপ প্রয়োগ করিয়া এবং পুনঃপুনঃ চূর্ণিত ও মর্দ্দিত করিয়াও ঐ সজীবতার লক্ষণের পরিবর্ত্তন করা যায় নাই।
দুইটি চলিষ্ণু জিনিষ বিপরীত দিক হইতে আসিয়া পরস্পরকে ধাক্কা দিলে, উভয়েরই বেগ কমিয়া আসে। কিন্তু ডুবার্ন্ সাহেবের আবিষ্কৃত আণুবীক্ষণিক বর্ত্তুলকণাগুলি সংঘর্ষণের এই সুপরিচিত নিয়ম মানিয়া চলে নাই। ধাক্কায় তাহাদের প্রত্যেকটির বেগের বৃদ্ধি দেখা গিয়াছিল। পদার্থমাত্রেরই সুক্ষ্ম কণার এই সকল অদ্ভুত কার্য্য দেখিয়া আবিষ্কারক বিস্মিত হইয়া পড়িয়াছিলেন। তাপ বা আলোক অতি সূক্ষ্ম পদার্থের উপর গড়িলে চাপ (Radiation pressure) দিয়া তাহাকে গতিশীল করায়। নানা প্রকারে তাপালোকের চাপের পরিচয় পাওয়া গিয়াছে। উহাই অতিসূক্ষ্ম কণাগুলিকে চঞ্চল করে বলিয়া আবিষ্কারক প্রথমে মনে করিয়াছিলেন। কিন্তু কণাগুলিকে অনিয়মিতভাবে যথেচ্ছ চলিতে দেখিয়া ইহা যে, তাপালোকের চাপের কার্য্য নয়, তাহা তিনি বুঝিতে পারিয়াছিলেন। এই প্রকারে জড়পদার্থের পরিজ্ঞাত সাধারণ ধর্ম্মগুলির মধ্যে কোনটিরই সহিত ঐ সকল জড়কণার কার্য্যের ঐক্য দেখিতে না পাইয়া আবিষ্কারক তাহাদিগকে “সজীবকণা” (Vital particles) নামে আখ্যাত করিয়াছেন। প্রাণী ও উদ্ভিদ দেহের অতি ক্ষুদ্র অংশ এবং ধাতু প্রস্তরাদির সূক্ষ্ম কণা পরীক্ষা করিয়া সকলেরই ঠিক একই কার্য্য দেখা গিয়াছিল, সুতরাং আবিষ্কারকের মতে এই সকল সজীব কণাই সজীব নির্জীব সকল পদার্থেরই গঠনোপাদান এবং শেষ পরিণাম।
আধুনিক জীবতত্ত্ববিদ্গণ জীবসামগ্রী (Protoplasm) নামক এক জিনিষকে জীবদেহের প্রধান উপাদান বলিয়া স্বীকার করেন। নির্জীব অঙ্গার, হাইড্রোজেন প্রভৃতি কতকগুলি পদার্থ কোন এক অজ্ঞাত শক্তিতে একত্র হইয়া পড়িলে তখন তাহাতে প্রাণপ্রতিষ্ঠা হয়, এবং পূর্ব্বেকার নির্জীব পদার্থ সজীবের সকল ধর্ম্ম পাইয়া জন্ম মৃত্যু ক্ষয় বৃদ্ধি প্রভৃতি কার্য্যগুলি দেখাইতে থাকে। ইহাই জীবসামগ্রী। অবশ্য কোন বৈজ্ঞানিকই অদ্যাপি জীবসামগ্রীকে নিজের পরীক্ষাগারে প্রস্তুত করিতে পারেন নাই। বিধাতার ব্রহ্মাণ্ডব্যাপী শিল্পশালাতেই ইহার উৎপত্তি, এবং কোন প্রক্রিয়ার নির্জীব পদার্থ জীবধর্ম্মী হয়, তাহা বিশ্বকর্ম্মা ব্যতীত আর কেহই জানেন না। ডুবার্ন্ সাহেব তাঁহার “সজীবকণার” সাক্ষাৎ পাইয়া বলিতেছেন, বৈজ্ঞানিকগণ যাহাকে জীবসামগ্রী (Protoplasm) বলেন, তাহা সজীবকণারই সমষ্টি এবং কণাগুলিই জীবসামগ্রীতে সজীবতা আনয়ন করে; অর্থাৎ “সজীবকণা” জীৱসামগ্রীর এক ধাপ নীচেকার জিনিষ।
আমরা পূর্ব্বে বলিয়াছি সজীব নির্জীব নানা পদার্থের সূক্ষ্ম কণা পরীক্ষা করিয়া ডুবারন্ সাহেব যে সজীবতার লক্ষণ দেখিয়াছিলেন, তাপ দিয়া আঘাত দিয়া চূর্ণ বিচূর্ণ করিয়া তিনি সেগুলির জীবধর্ম্মের লোপ করিতে পারেন নাই, এবং সেগুলিকে কোন ক্রমে মাধ্যাকর্ষণের নিয়মেই বাধ্য করা যায় নাই। এখন প্রশ্ন হইতে পারে, সৃষ্ট পদার্থমাত্রই যখন ঐ “সজীবকণা” দ্বারা গঠিত তখন একত্র হইলেই তাহারা কেন প্রাকৃতিক নিয়ম মানিয়। চলে? আবিষ্কারক এই প্রশ্নটির পরিষ্কার উত্তর দিতে পারেন নাই। তবে “সজীবকণা” পুঞ্জীভূত হইয়া পড়িলেই যে, তাহাদের সজীবতা লোপ পাইয়া যায়, এবং বিযুক্ত হইলেই যে আবার তাহার পুনর্বিকাশ হয়, পরীক্ষায় তিনি তাহা প্রত্যক্ষ দেখিয়াছেন।
এই সকল দেখিয়া ডুবারন্ সাহেব বলিতেছেন, সৃষ্ট পদার্থ মাত্রেই যে-সকল উপাদানে গঠিত তাহা মূলে সজীব। “সঞ্জীবকণা” সকল পুঞ্জীভূত হইয়া যখন তাহাদের মুল-গত জীবধর্ম্মকে অপ্রকাশ রাখিয়া দেয়, তখনি সেই সকল “জীবকণার” সমষ্টি আমাদের নিকট নির্জীব পদার্থ হইয়া দাঁড়ায়, এবং পুঞ্জীভূত হওয়ার পরও সেগুলি যখন তাহাদের স্বাভাবিক সজীবতাকে নানা প্রকারে প্রকাশ করিতে থাকে, তখন সেই কণাসমষ্টি আমাদের নিকট সজীব হইয়া পড়ে। তবেই দেখা যাইতেছে, আমরা যে সজীব ও নির্জীবের ভেদ স্বীকার করিয়া আসিতেছি, তাহা ডুবারন্ সাহেবের মতে মূলগত ভেদ নয়। জীবনের প্রারম্ভ ও শেষ নাই। সমস্ত পদার্থই ভগবানের ইচ্ছায় সজীব হইয়া সৃষ্ট হইয়াছে। কাজেই আদিম জীবের উৎপত্তিতত্ত্ব লইয়া প্রাচীন ও আধুনিক পণ্ডিতগণ যে চেষ্টা করিয়া আসিয়াছেন, তাহা পণ্ডশ্রম হইয়াছে। জীরতত্ত্ববিদ্গণ যাহাকে স্বতঃজনন বলিয়াছেন, তাহা প্রতিদিন এবং প্রতি মুহূর্ত্তে ভগবানের ইচ্ছায়, নিয়তই আমাদের সম্মুখে চলিতেছে।
আণুবীক্ষণিক পরীক্ষায় ডুবারন্ সাহেব সজীর কণাগুলির আকার সম্পূর্ণ গোল দেখিতে পাইয়াছেন, এবং কার্যবিধি পরীক্ষা করিয়া সেগুলিকে শূন্যগর্ভ অনুমান করিতেছেন। শূন্যগর্ভ জিনিষের এক পার্শ্বে ক্ষুদ্র ছিদ্র করিয়া ও তাহার কতকটা জলে পূর্ণ করিয়া যদি জলে ভাসাইয়া দেওয়া যায়, তবে তাহার ভিতরকার জল যেমন সবলে ছিদ্রপথ দিয়া বাহির হইতে থাকে তেমনি ভিতরকার জলের চাপ সমগ্র জিনিষটাকে ঠেলিয়া বিপরীত দিকে ভাসাইয়া লইয়া যায়। আমরা প্রতিদিনই নানাপ্রকারে তরল পদার্থে চাপের এই কার্য্যটিকে দেখিতে পাই। ডুবাবন্ সাহেব “সজীবকণায়” সঞ্চলন ব্যাপারটাকে চাপের কার্য্য বলিয়া অনুমান করিতেছেন। ইহার মতে, “সজীবকণা”-গুলি শূন্যগর্ভ বর্ত্তুলাকার জিনিষ হইলেও, প্রত্যেকের কোষ-প্রাচীরে অন্ততঃ দুইটি কবিয়া ছিদ্র আছে। জল বা অপর কোন তরল পদার্থে ভাসিতে আরম্ভ করিলেই, ইহারা আপনা হইতেই এক ছিদ্র দ্বারা জল উদরস্থ করিয়া অপর ছিদ্রপথে তাহা বাহির করিতে আরম্ভ করে। কাজেই ইহাতে কোষস্থ জলে চাপের একতা নষ্ট হইয়া পড়ে, এবং সঙ্গে সঙ্গে কণাগুলিও বিচিত্রগতিসম্পন্ন হইয়া ঘুরিয়া বেড়ায়।
“সঞ্জীবকণা”-গুলিকে শূন্যগর্ভ বলিয়া স্বীকার করিয়া ডুবারন্ সাহেব কতকগুলি রাসায়নিক ও বৈদ্যুতিক সমস্যারও সমাধান করিবার চেষ্টা করিয়াছেন। লৌহ ও গন্ধক এই দুই মূলপদার্থের এক এক পরমাণু একত্র হইলে একটি যৌগিক পদার্থের (Iron sulphide) উৎপত্তি হয়। লৌহ এবং গন্ধক এই দুইয়ের কোন ধর্ম্মই পদার্থটিতে দেখা যায় না। ডুবার্ন্ সাহেব বলেন, লৌহের “সজীবকণা” সকল যখন গন্ধকের “সজীবকণা” গুলিকে উদরস্থ করিয়া আর এক জাতীয় “সজীবকণার” উৎপত্তি করে, কেবল তখনি লৌহ ও গন্ধকের রাসায়নিক সংমিশ্রণ ঘটে। তিন চারিটি মৌলিক পদার্থের রাসায়নিক সংযোগ হইলেও ঠিক পূর্ব্বোক্তপ্রকারে মৌলিক “সজীবকণা”-গুলি পরস্পরের কোষাভ্যন্তরে প্রবেশ করিয়া এক একটি পৃথক “সজীবকণা”র উৎপত্তি করে। লৌহ ও গন্ধকের রাসায়নিক মিলনে, লৌহের কণা গন্ধকের কণার ভিতর প্রবেশ করে, কি গন্ধকের সজীব কোষ লৌহকোষের ভিতর আশ্রয় লয়, তাহা উপেক্ষার বিষয় নহে। ডুবার্ন্ সাহেব বলিয়াছেন, যে পর্য্যায়ে “সজীবকণা”-গুলি পরস্পরের ভিতর আশ্রয় গ্রহণ করে, তাহা নির্ণয় করিতে পারিলে অনেক রাসায়নিক রহস্যেরও প্রকৃতি নির্ণয় করা যাইতে পারিবে।
ডুবার্ন্ সাহেবের এই আবিষ্কারের বিবরণ আরও বৈজ্ঞানিক জগতের সর্ব্বাংশে প্রচারিত হয় নাই। পরীক্ষায় দৃষ্ট ব্যাপারগুলি প্রত্যক্ষ হইলেই যে ভ্রমপ্রমাদহীন হইবে, এ কথা বলা যায় না। সুতরাং একক ডুবার্ন্ সাহেব একটিমাত্র যন্ত্রে “সজীবকণা”র সন্ধান পাইয়া যে প্রকাণ্ড সিদ্ধান্তের প্রতিষ্ঠা করিতেছেন, তাহার ভিত্তি খুবই দুর্ব্বল বলিয়া মনে হয়। বিশেষতঃ যাহাদিগকে তিনি “সজীবকণা” নামে আখ্যাত করিয়াছেন, তাহারা যে প্রকৃতই সজীব তাহার কোনই প্রমাণ পাওয়া যায় নাই। সুতরাং বিজ্ঞানের প্রচলিত সিদ্ধান্তগুলির প্রতি দৃষ্টিপাত না করিয়াই ইনি যে-সকল কঠিন কঠিন তত্ত্বের অবতারণা করিয়াছেন বোধ হয় তাহার আলোচনা করিবার আজও সময় উপস্থিত হয় নাই। যদি কোন দিন সেই শুভ কাল উপস্থিত হয়, তবে ডুবার্ন্ সাহেব ধন্য হইবেন এবং তাঁহার প্রসাদে আধুনিক বিজ্ঞান অজ্ঞানকুহেলিকা হইতে বিমুক্ত হইয়া উজ্জল হইয়া উঠিবে। আপাততঃ সিদ্ধান্তগুলিকে প্রসিদ্ধ বৈজ্ঞানিকদিগের কঠোর অগ্নিপরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করিতে হইবে।
সমস্ত জিনিষই যে সজীব এই কথাটা শুনিলে এখন আর আতঙ্কিত হইবার কারণ নাই। আমাদের অতি প্রাচীন পিতামহগণ এই ভারতবর্ষে বসিয়াই প্রকারান্তরে এই সত্যের সন্ধান পাইয়াছিলেন। তার পর আমাদের স্বদেশবাসী মহা বৈজ্ঞানিক ডাক্তার জগদীশচন্দ্র বসু মহাশয় পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের আলোকে সেই সত্যকে দেখাইয়াছেন। ডুবার্ন্ সাহেব প্রকারান্তরে তাহাই দেখাইবার চেষ্টা করিয়াছেন। কিন্তু বহু মহাশয়ের প্রত্যেক উক্তিই যেমন শত শত প্রত্যক্ষ পরীক্ষা দ্বারা সমর্থিত হইয়াছে, ডুবার্ন্ সাহেবের কোন কথারই মূলে সে প্রকার যুক্তি খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। স্বদেশী বিদেশী দার্শনিকগণ বহুকাল হইতে মূল জড়কণাকে সজীব বলিয়া কল্পনা করিয়াছেন। বিখ্যাত পণ্ডিত লিবনিজ (Leibnitz) সাহেব আরও উচ্চে উঠিয়াছিলেন। তিনি পরমাণুকে সজীব বলিয়াই নিরস্ত হন নাই, ইহাদের ইচ্ছাশক্তি আছে বলিয়াও তাঁহার মনে হইয়াছিল।