প্রাকৃতিকী/ঘ্রাণতত্ত্ব
ঘ্রাণতত্ত্ব
ঘ্রাণেন্দ্রিয় দ্বারা আমরা কি প্রকারে গন্ধ অনুভব করি, তাহা বর্ত্তমান প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয় নয়। গন্ধপ্রদ পদার্থ কি প্রকার অবস্থায় নাসিকায় পৌঁছিলে গন্ধ উৎপন্ন হয়, তাহাই আমরা আলোচনা করিব।
অভিধানকারকে ঘ্রাণের সংজ্ঞা জিজ্ঞাসা কর, তিনি বলিবেন,— কোন বস্তু হইতে নির্গত হইয়া যাহা আমাদের ঘ্রাণোত্তেজক স্নায়ুকে (Olfactory Nervo) আঘাত দেয়, তাহাই ঘ্রাণ। বলা বাহুল্য, এটা ঘ্রাণের নির্দ্দোষ সংজ্ঞা হইল না। গন্ধপ্রদ পদার্থ হইতে যে-সকল অংশ নির্গত হইয়া নাসা-বিবরে প্রবেশ করে, তাহার অবস্থাটা যে কি, সংজ্ঞা হইতে তাহা জানা যায় না। নাকের নিকট চন্দন রাখ, তাহার মৃদু গন্ধ অনুভব করিতে থাকিবে। এখানে চন্দন বায়বীয় বা তরল অবস্থায় নাসিকায় প্রবেশ করে, কি কঠিনাবস্থায় থাকিয়াই ধূলিকণার ন্যায় নাসারন্ধ্রে আসিয়া উপস্থিত হয়, অভিধানে তাহার সন্ধান পাওয়া যায় না।
পদার্থের নানা অবস্থার নানা গুণের আলোচনা করা জড়বিজ্ঞানের কার্য্য। এই জন্য ঘ্রাণতত্ত্বের আলোচনা কালে, ঘ্রাণ জিনিষটাকে বৈজ্ঞানিকেরা পূর্বোক্ত প্রকারে চাপা দিয়া রাখিতে পারেন নাই। এ সম্বন্ধে ইহাদিগকে একটা স্পষ্টাপষ্টি জবাব দিতে হইয়াছে। বৈজ্ঞানিকগণ বলেন, গন্ধোৎপাদক পদার্থের অতি ক্ষুদ্র কণা কঠিনাকারে থাকিয়া আমাদের নাসিকায় প্রবেশ করে, এবং নাসিকাস্থ ইন্দ্রিয়বিশেষ তাহাদেরই সংস্পর্শে আসিয়া গন্ধজ্ঞান উৎপন্ন করে। উদাহরণ স্বরূপ ইঁহারা বলিয়া থাকেন,—বৃহৎ ঘরের কোন স্থানে রতিপ্রমাণ মৃগনাভি লুক্কায়িত রাখ, ইহারি গন্ধে ঘরটি বহু বৎসর পরিপূর্ণ থাকিবে। অথচ এই সুদীর্ঘকাল ধরিয়া মৃগনাভিটুকু স্বদেহের অণুগুলিকে গন্ধাকারে ছাড়িয়া, ওজনে অধিক কমিবে না। গন্ধপ্রদ জিনিষের কণাগুলি এতই সূক্ষ্মাকারে বিভক্ত হইয়া ছড়াইয়া পড়ে!
অধিকাংশ পদার্থে প্রচুর উত্তাপ দিলে, তাহারা খুব সূক্ষ্ম অংশে বিভক্ত হইয়া যায়। এই প্রকারে বিভক্ত জিনিষকে আমরা বাষ্প বলি। ইহা পদার্থের একটা বিশেষ রূপ। তরল বা কঠিনাকার ত্যাগ করিয়া পদার্থ ঐ রূপ গ্রহণ করে। কিন্তু নিজের রূপ অক্ষুণ্ণ রাখিয়া মৃগনাভি ইত্যাদি গন্ধপ্রদ দ্রব্য যে, পূর্ব্বোক্ত প্রকার অতি সূক্ষ্ম অংশে বিভক্ত হইতে পারে তাহা জানা ছিল না। বৈজ্ঞানিকগণ অণু-পরমাণু প্রভৃতি আরো সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম জিনিষ লইয়া নাড়াচাড়া করিয়া থাকেন। সুতরাং তাঁহারা যখন ঘ্রাণোৎপত্তির মূলে ঘ্রাণপ্রদ জিনিষের অতিক্ষুদ্র কঠিন কণার কার্য্য দেখিতে পাইয়াছেন বলিয়া প্রচার করিলেন, তখন এ সম্বন্ধে আর সন্দেহ করিবার কারণ রহিল না। বৈজ্ঞানিক অবৈজ্ঞানিক সকলেই স্বীকার করিলেন, দ্রব্যের অতি সূক্ষ অংশ কঠিনাকারে থাকিয়া নাসিকায় প্রবেশ করিলে গন্ধ-জ্ঞান জন্মায়।
এই সিদ্ধান্তের পোষক নানা উদাহরণ সংগ্রহ হইতে লাগিল। স্থির হইল, শিকারের দেহনিঃসৃত মলাদি অতি সূক্ষ্ম কণার আকারে চারিদিকে ছড়াইয়া পড়ে। শিকারী কুকুর নাসিকার সাহায্যে সেই কণাপ্রবাহের দিক্ নির্ণয় করিয়া, শিকারকে আক্রমণ করে। পরীক্ষা করিয়া দেখা গিয়াছে, একজাতীয় প্রজাপতিকে ধরিয়া কোন দূরস্থানে লুক্কায়িত রাখিলে, সহচর প্রজাপতিগুলি অতি অল্পকাল মধ্যে ধৃত সঙ্গীকে খুঁজিয়া বাহির করে। ইহার ব্যাখ্যানে সকলে বলিতে লাগিলেন,—প্রজাপতির দেহনিঃসৃত কোন দ্রব্যের ক্ষুদ্রকণা ছড়াইয়া পড়িয়া পরস্পরের ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের উপর কার্য্য করে। এইজন্য কোন্ পথ ধরিয়া কণাপ্রবাহ চলিতেছে তাহা ঠিক্ করিয়া, ধৃত সঙ্গীর সন্ধান করা উহাদের পক্ষে কঠিন হয় না।
ঘ্রাণতত্ত্বের ঐ পুরাতন সিদ্ধান্তটিকে বিজ্ঞানের নুতন আলোকে পরীক্ষা করিয়া লওয়ার কথা, এ পর্য্যন্ত কোন বৈজ্ঞানিকেরই মনে স্থান পায় নাই। ডাক্তার এট্কিন্ (Dr. John Aitkin) এখনকার একজন খ্যাতনামা বৈজ্ঞানিক। ইনি ইংলণ্ডের সুপ্রসিদ্ধ রয়্যাল্ সোসাইটির জনৈক পুরাতন সভ্য। তা’ছাড়া কয়েকটি সুসজ্জিত পরীক্ষাগারের পরিচালন ভারও তাঁহার উপর ন্যস্ত আছে। প্রাণতত্ত্ব লইয়া অধ্যাপক মহাশয় সম্প্রতি অনেক গবেষণা করিয়াছেন। এই গবেষণার ফলে যাহা জানা যাইতেছে, তাহাতে সকলে বিস্মিত হইয়া পড়িয়াছেন। ইনি বলিতেছেন, কোন দ্রব্য যখন বাষ্পাকারে পরিণত হইয়া নাসিকারন্ধ্রে প্রবেশ করে, আমরা তখনি তাহার গন্ধ অনুভব করি। পদার্থের অতি সূক্ষ্ম অংশ কঠিনাকারে থাকিয়া নাসিকায় পৌঁছিলে গন্ধজ্ঞান হয় না, বাষ্পাকারে পরিণত হওয়া একান্ত আবশ্যক।
ডাক্তার এট্কিনের পূর্ব্বোক্ত সিদ্ধান্তটি কেবলমাত্র অনুমানমূলক নয়। প্রত্যক্ষ ও সহজ পরীক্ষা দ্বারা ইনি নিজের প্রত্যেক কথার সমর্থন করিয়াছেন।
পাঠক অব্যই শুনিয়াছেন, কোন বায়বীয় জিনিষকে জমাট বাঁধাইতে ধূলিকণাদির ন্যায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কঠিন জড়কণা অনেক সাহায্য করে। দুইটি একই আকারের পরিষ্কার কাচপাত্রে কেবল মাত্র জলীয় বাষ্প আবদ্ধ রাখিলে, জল যতক্ষণ তাহাদের মধ্যে বাষ্পাকারে থাকে, ততক্ষণ তাহাকে জল বলিয়া চেনা যায় না। কিন্তু একটি পাত্রে কিছু ধূলিকণা ফেলিয়া, পরে উভয় পাত্রস্থ বাষ্পকে জমাইবার চেষ্টা করিলে, ধূলিযুক্ত পাত্রটির বাষ্পকে সর্ব্বাগ্রে জমাট বাঁধিতে দেখা যায়। পূর্ব্বের স্বচ্ছ বাষ্পপূর্ণ পাত্রে, কুয়াশার ন্যায় অস্বচ্ছ জলকণার সঞ্চার হইতে থাকিবে। বড় বড় সহরে প্রাতে ও সন্ধ্যায় যে একপ্রকার কুয়াশা দেখা যায়, তাহা বাতাসে উড্ডীয়মান সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ধূলিকণা ও ধোঁয়ার কণারই কাজ বলিয়া স্থির হইয়াছে। সহরের বায়ুতে ধূলিকণা অত্যন্ত অধিক পরিমাণে মিশানো থাকে। কাজেই ঐ সকল স্থানের জলীয় বাষ্প ঐ কণাগুলির চারিপাশে জমাট বাঁধিয়া কুয়াশার উৎপত্তি করে।
বায়বীয় পদার্থের মধ্যস্থিত কঠিন জড়কণার এই কার্য্যটির সাহায্যে এট্কিন সাহেব তাঁহার নূতন সিদ্ধান্তটির সার্থকতা দেখাইয়াছেন। ইনি দুইটি পরিচ্ছন্ন কাচপাত্র লইয়া, উভয়েই প্রথমে ধূলি বা অপর কোনও জড়কণা বর্জ্জিত জলীয় বাষ্প রাখিয়াছিলেন, এবং পরে একটি পাত্রে কিছু মৃগনাভি ফেলিয়া দিয়াছিলেন। বলা বাহুল্য, গন্ধটা যদি সত্যই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণার আকারে মৃগনাভি হইতে বাহির হইত, তবে ঐ সকল কণাকে অবলম্বন করিয়া পাত্রটির জলীয় বাষ্প নিশ্চয়ই জমাট হইয়া পড়িত। কিন্তু পরীক্ষায় তাহা দেখা যায় নাই। মৃগনাভির গন্ধপূর্ণ পাত্রটি, অপর পাত্রের ন্যায় স্বচ্ছই রহিয়া গিয়াছিল। কাজেই মৃগনাভির অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ কঠিনাকারে থাকিয়া চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িলে গন্ধের উৎপত্তি হয় বলিয়া যে বিশ্বাস ছিল, তাহার অমূলকতা এই সহজ পরীক্ষায় বেশ বুঝা গিয়াছিল।
কাচের নলের মধ্যে পরিষ্কার তূলা রাখিয়া, সাধারণ অপরিষ্কৃত বায়ুকে সেই নলের ভিতর দিয়া চালাইতে থাকিলে, বায়ু পরিষ্কৃত হইয়া নল হইতে বাহির হয়। কারণ এখানে বায়ুমিশ্রিত ধূলিকণাদি তূলায় বাধা পাইয়া আটকাইয়া যায়। এই প্রক্রিয়াটি বায়ুশোধন করিবার একটি সুন্দর উপায়। এট্কিন্ সাহেব মৃগনাভি ইত্যাদি দ্বারা গন্ধযুক্ত বায়ুকে কাচনলের ভিতর দিয়া চালাইয়া শোধন করিয়া লইয়াছিলেন। পদার্থের সূক্ষ্ম কণা দ্বারা গন্ধের উৎপত্তি হইলে, শোধিত বায়ুতে গন্ধের লেশমাত্র থাকিত না। কিন্তু প্রত্যক্ষ পরীক্ষায় তাহা দেখা যায় নাই। সুতরাং গন্ধটা যে পদার্থের সূক্ষ্ম কণা দ্বারা উৎপন্ন হয়, এই পরীক্ষাটির দ্বারাও তাহা আমরা বেশ বুঝিতে পারি। ডাক্তার এট্কিন্ কর্পূর, ন্যাপ্থালিন, আতর ইত্যাদি নানা ভালমন্দ গন্ধদ্রব্যের উপর পূর্ব্ববর্ণিত পরীক্ষা করিয়া, সকল পরীক্ষাতে একই ফল পাইয়াছেন। কাজেই প্রাণতত্ত্বের মূল ব্যাপারে যে পুরাতন বিশ্বাস ছিল, তাহা আজকাল ক্রমেই শিথিল হইয়া দাঁড়াইতেছে। গন্ধপ্রদ দ্রব্য হইতে গন্ধটা তরল বা কঠিন আকারে আসিয়া নাসিকায় প্রবিষ্ট হইলে, পরীক্ষায় তাহা ধরা পড়িত। সুতরাং দ্রব্যের বাষ্পীয় অবস্থাতেই যে গন্ধ উৎপন্ন হয়, একথা অস্বীকার করিবার আর উপায় নাই।
নানা আবর্জ্জনাপূর্ণ ড্রেন্ বড় বড় সহর মাত্রেরই নানা অংশে বিস্তৃত থাকে। এই সকল পয়ঃপ্রণালী দ্বারা কি প্রকারে সহরের স্বাস্থ্য নষ্ট হয়, তাহা কিছুদিন পূর্ব্বে কয়েকজন ইংরাজ স্বাস্থ্য-রক্ষক আলোচনা করিয়াছিলেন। স্থির হইয়াছিল, পয়ঃপ্রণালী হইতে উদ্গত দুষ্ট বাষ্প স্বাস্থ্যের ক্ষতিকর এবং বিশেষ ক্ষতিকর ড্রেনের গন্ধ। গলিত আবর্জ্জনার কণাসকল গন্ধের আকারে আমাদের দেহে প্রবেশলাভ করে, এবং নানা ব্যাধির জীবাণু সঙ্গে সঙ্গে বহিয়া আনিয়া অধিবাসিগণকে ব্যাধিগ্রস্ত করিয়া ফেলে। বলা বাহুল্য, গন্ধোৎপত্তির পুরাতন সিদ্ধান্তে বিশ্বাস করিয়া, স্বাস্থ্যরক্ষকগণ পূর্ব্বোক্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছিলেন। কিন্তু গন্ধ যে, কেবল বায়বীয় পদার্থময়, ডাক্তার এট্কিনের পরীক্ষায় তাহা অভ্রান্তরূপে প্রমাণিত হইয়া গিয়াছে। সুতরাং নানা ভয়াবহ পীড়ার বাহক বলিয়া স্বাস্থ্যতত্ত্ববিদ্গণ ড্রেনের গন্ধের উপর যে অযথা দোষারোপ করিয়াছিলেন, এই নবাবিষ্কারে নিশ্চয়ই তাহার ক্ষালন হইবে বলিয়া আশা হয়। এখন ব্যাধি-জীবাণুর সংক্রমণের কারণান্তর অনুসন্ধানের সময় আসিয়াছে।
ঘ্রাণতত্ত্ব-সম্বন্ধীয় এই নূতন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অদ্যাপি কোনও কথা শুনা যায় নাই। এট্কিন্ সাহেব অনুমানের উপর নির্ভর করিয়া কোন কথাই বলেন নাই। অতি সহজ ও প্রত্যক্ষ পরীক্ষা দ্বারা তাঁহার প্রত্যেক উক্তিই সমর্থিত হইয়াছে। সুতরাং এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হঠাৎ দাঁড়াইয়াই যে কেহ কৃতকার্য্য হইতে পারিবেন, তাহা আমাদের মনে হয় না।