প্রাকৃতিকী/আলোক ও বর্ণজ্ঞান

আলোক ও বর্ণজ্ঞান

অক্ষি-যবনিকায় (Retina) বিস্তৃত দৃষ্টিনাড়ীর (Optic Nerve) প্রান্তে বাহিরের আলোক পড়িলে তাহা কি প্রকারে মস্তিষ্কে চালিত হইয়া দৃষ্টিজ্ঞান উৎপন্ন করে, প্রকৃত কথা বলিতে গেলে অদ্যাপি কেহই তাহার সন্ধান দিতে পারেন নাই। বিষয় যতই জটিল ও দুর্ব্বোধ্য হউক না কেন, আজকালকার দিনে কোন ব্যাপারেরই ব্যাখ্যানের অভাব হয় না। শারীরতত্ত্বসম্বন্ধীয় গ্রন্থে এজন্য আজকাল এ সম্বন্ধে অনেক বাজে কথা স্থান পাইয়া গিয়াছে। কেবল পুস্তক পড়িয়া এই সকল বিষয়ে জ্ঞানলাভ করিতে গেলে জ্ঞানলিপ্সুর বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা আবশ্যক হইয়া পড়িয়াছে।

 প্রসিদ্ধ শারীরতত্ত্ববিৎ হালিবার্টন্ সাহেব তাঁহার প্রসিদ্ধ গ্রন্থের এক স্থানে লিখিয়াছেন, আলোক অক্ষি যবনিকার উপর পড়িয়া যে পরিবর্ত্তন করে, সেটা সম্ভবতঃ নিছক্ রাসায়নিক পরিবর্ত্তন। যবনিকায় যে জীবসামগ্রী (Protoplasm) বিস্তৃত থাকে, তাহার উপর আলোক পড়িলেই রাসায়নিক পরিবর্ত্তনের সূত্রপাত হয়, এবং এই পরিবর্ত্তনই দৃষ্টিনাড়ীর প্রান্তকে উত্তেজিত করিয়া তোলে। কিন্তু ইহার পর উত্তেজনাটা মস্তিষ্কে পরিবাহিত হইয়া যে কি প্রকারে দৃষ্টিজ্ঞান উৎপন্ন করায়, হালিবার্টন সাহেব তৎসম্বন্ধে কোন কথাই বলেন নাই। ব্যাপারটা এতই জটিল যে, এ সম্বন্ধে কোন সুনিশ্চিত মত প্রকাশ করা সত্যই অসম্ভব।

 আলোক পদার্থ-বিশেষের উপর পড়িয়া তাহাকে যে নানাপ্রকারে পরিবর্ত্তিত করে, ইহাতে আর এখন অবিশ্বাস করা চলে না। শত শত প্রত্যক্ষ পরীক্ষায় আলোকের রাসায়নিক কার্য্যের পরিচয় পাওয়া গিয়াছে। ক্লোরিন (Chlorine) ও হাইড্রোজেন্ (Hydrogen) বায়ুকে একটি কাচপাত্রে মিশাইয়া অন্ধকার ঘরে রাখিলে, উভয় বায়ু কেবল মিশিয়া থাকে মাত্র। এ অবস্থায় তাহাদের কোনই রাসায়নিক পরিবর্ত্তন দেখা যায় না। কিন্তু ঐ পাত্রটিকে কিছুক্ষণ সূর্য্যালোকে রাখিয়া দিলে আলোকের স্পর্শে হাইড্রোজেন্ ও ক্লোরিন্ পরস্পর সংযুক্ত হইয়া হাইড্রোক্লোরিক এসিড উৎপন্ন করে। ফোটোগ্রাফের কাচের উপরকার প্রলেপ আলোক পাইলেই যে কালো হইয়া যায় তাহাও আলোকের রাসায়নিক কার্য্যের একটি উদাহরণ। বৃক্ষের পত্রাদিতে যে-সকল সবুজবর্ণের অণু পরিব্যাপ্ত থাকে, তাহারাই বাতাসের অঙ্গারক বাষ্পকে বিশ্লিষ্ট করিয়া অঙ্গার উৎপন্ন করে, এবং তাহাই দেহস্থ করিয়া উদ্ভিদ পরিপুষ্ট হয়। পরীক্ষা করিয়া দেখা গিয়াছে, সূর্য্যের আলোকই উদ্ভিদের হরিদণুগুলিকে সক্রিয় করায়। সুতরাং অক্ষি-যবনিকায় পড়িলে তদ্দ্বারা জীবসামগ্রীর পক্ষে রাসায়নিক পরিবর্ত্তন হওয়ারই যে সম্ভাবনা অধিক, তাহা আর অস্বীকার করা যায় না।

 পাঠকের বোধ হয় অবিদিত নাই, অক্ষি-যবনিকার কোষগুলি প্রায় সর্ব্বদাই একপ্রকার রঙিন পদার্থে পূর্ণ থাকে, এবং তাছাড়া দণ্ডাকৃতি ও মোচাকারের (Rods and Cones) কতকগুলি অতি সূক্ষ্ম পদার্থ উহার সর্ব্বাংশে পরিব্যাপ্ত দেখা যায়। পরীক্ষা করিয়া দেখা গিয়াছে, আলোক পাইলেই কোষমধ্যস্থ বর্ণকণিকাগুলি চঞ্চল হইয়া
জর্ম্মান মহাপণ্ডিত হেলম্‌হোজ
পড়ে এবং সঙ্গে সঙ্গে সেই মোচাকার জিনিষগুলাও সঙ্কুচিত হইয়া পড়ে। ভেক প্রভৃতি কতকগুলি ইতর প্রাণীর অক্ষিযবনিকায় যে দণ্ডাকৃতি পদার্থ থাকে, সেগুলিকে প্রায়ই একপ্রকার বর্ণরসে (Visual Purple) পূর্ণ দেখা যায়। পরীক্ষা করিয়া দেখা গিয়াছে,


অন্ধকারে ঐ রসের কোন বিকার হয় না, কিন্তু আলোক পাইলেই তাহা আপনা হইতেই অন্তর্হিত হইয়া যায়। কাজেই আলোক চক্ষুর ভিতর প্রবেশ করিলে যে সত্যসত্যই রাসায়নিক কার্য্য শুরু হয়, তাহাতে আর মতদ্বৈধ থাকিতে পারে না।

 অক্ষিযবনিকায় বিস্তৃত দণ্ড ও মোচাকার কোষগুলির উপরে আলোকের পুর্ব্বোক্ত রাসায়নিক কার্য্য প্রত্যক্ষ করিয়া বর্ণজ্ঞান-উৎপত্তির সহিত ইহার কোনও ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ আছে বলিয়া বৈজ্ঞানিকদিগের মনে হইয়াছিল, এবং এই অনুমানের উপর নির্ভর করিয়া হেরিং ও হেলম্‌হোজ্ সাহেব বর্ণজ্ঞান-সম্বন্ধে দুইটি পৃথক্ সিদ্ধান্ত দাঁড় করাইয়াছেন।

 হেরিং সাহেব বলেন, ভেকের অক্ষিযবনিকাস্থ কোষে যেমন একপ্রকার বর্ণরস দেখা যায়, মানবের চক্ষু-যবনিকায় সম্ভবতঃ সেই প্রকার তিনজাতীয় বর্ণরস বর্ত্তমান আছে, এবং এই রসগুলির প্রত্যেকেই এক বিশেষ বিশেষ ধর্ম্মবিশিষ্ট। লালসবুজ, পীতনীল এবং শ্বেতকৃষ্ণ এই তিন জোড়া বর্ণের আলোক ঐ তিনজাতীয় বর্ণরসের এক একটিকে নির্ব্বাচন করিয়া কার্য্য করে। অর্থাৎ লালসবুজ আলোক যে বর্ণরসের উপর কার্য্য করে, নীলপীত বা শ্বেতকৃষ্ণালোক তাহার কোনই পরিবর্ত্তন করিতে পারে না।

 লালসবুজ ইত্যাদি যে তিন জোড়া বর্ণের কথা বলা হইল, তাহাদের প্রত্যেকের দুই দুইটি বর্ণ পরস্পরের বিরোধী। অর্থাৎ লালসবুজ এই বর্ণযুগ্মের লালে সবুজের কোনই উপাদান নাই, এবং এই দুই বর্ণ পরস্পরের বিরোধী বলিয়া ইহাদের মিশ্রণে অপর কোন বর্ণ উৎপন্ন হয় না। শ্বেতকৃষ্ণ এবং নীলপীতের দুই দুইটি বর্ণের মধ্যেও ঠিক ঐ প্রকার সম্বন্ধ বর্ত্তমান। হেরিং সাহেব বলেন, এই তিন জোড়া আলোকের প্রত্যেক জোড়া সাড়া দিবার উপযোগী বর্ণরসের উপর আসিয়া পড়িলে, অবস্থা বিশেষে সেই পদার্থের ক্ষয় বা বৃদ্ধি আরম্ভ করে, এবং এই ক্ষয় বৃদ্ধির দ্বারাই একই বর্ণরসের সাহায্যে দুই দুইটি বর্ণের উৎপত্তি হইয়া পড়ে। পরীক্ষা করিয়া দেখা গিয়াছে, অক্ষি যবনিকার সেই তিন জাতীয় বর্ণরসের মধ্যে যেটি কেবল লালসবুজে সাড়া দিতে পারে, তাহার উপর কোন আলোক পড়িয়া যদি পদার্থের পরিমাণকে বাড়াইয়া দেয়, তবে দ্রষ্টা ইহার ফলে কেবল লাল বর্ণই দেখিতে পাইবে; এবং অপর কোন আলোক দ্বারা যদি সেই পদার্থেরই ক্ষয় আরম্ভ হয়, দর্শকের চক্ষে তবে তাহা সবুজ আলোক হইয়া দাঁড়াইবে।

 এখন হেলম্‌হোজ্ বর্ণজ্ঞান-সম্বন্ধে কি বলেন দেখা যাউক। তিন জোড়ার ছয়টি মূলবর্ণের অস্তিত্ব মানিয়া লইয়া, এবং অক্ষিযবনিকার বর্ণরসের তিনটি পৃথক ধর্ম্ম স্বীকার করিয়া হেরিং সাহেব বর্ণজ্ঞানের পূর্ব্বোক্ত সিদ্ধান্তটির প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। হেলম্‌হোজ্ সাহেব প্রথমেই ঐ প্রকার ছয়টি মৌলিক বর্ণের অস্তিত্বে বিশেষ সন্দেহ প্রকাশ করিয়াছিলেন। ইঁহার মতে, লাল সবুজ ও বেগুনিয়া এই তিনপ্রকার বর্ণ ব্যতীত আর কোন বর্ণই আমাদের চক্ষু দেখিতে পায় না। আমরা যে এগুলি ছাড়া আরো শত শত বর্ণ দেখি, তাহা ঐ তিন বর্ণেরই বিচিত্র সংমিশ্রণের ফল। হেরিং সাহেবের সিদ্ধান্তের সহিত হেলম্‌হোজের মতবাদের ইহাই একমাত্র অনৈক্য নয়। হোলম্‌হোজ্ সাহেব আরো বলিয়াছেন, দৃষ্টিনাড়ীগুচ্ছের প্রান্তে যে-সকল দণ্ড ও মোচাকার কোষ দেখা যায়, তাহারাই আলোকে উত্তেজিত হইয়া চক্ষুতে বর্ণ দেখায়। বাহিরে এই দণ্ড ও মোচাকার কোষগুলির পরস্পরের মধ্যে কোন পার্থক্যই দেখা যায় না বটে, কিন্তু মূলে তাহারা তিন জাতীয় বিধর্ম্মী জিনিষ। লাল সবুজ বেগুনিয়া এই তিনটি মৌলিক বর্ণের আলোক ঐ তিনজাতীয় কোষের উপর একসঙ্গে কাজ করিতে পারে না, এক একটি আলোক ঐ তিন শ্রেণীর কোষের এক একটিকে বাছিয়া লইয়া উত্তেজিত করে, এবং সেই উত্তেজনা দৃষ্টিনাড়ী দ্বারা মস্তিষ্কে নীত হইলে বর্ণজ্ঞানের উৎপত্তি হয়। এই জন্য লোহিতালোক উৎপাদক কোষগুলি যে আলোক দ্বারা উত্তেজিত হয়, তাহাকে আমরা লোহিতালোক রূপেই দেখি। অপর দুই জাতীয় কোষ এই আলোকে মোটেই সাড়া দিবে না।

 আমাদের চক্ষু কেবল লাল সবুজ ও বেগুনিয়া এই তিন মৌলিক বর্ণ দেখিয়াই ক্ষান্ত হয় না: শত শত আলোক চক্ষে পড়িয়া সর্ব্বদাই শত শত বিচিত্র বর্ণের উৎপত্তি করে। এই প্রসঙ্গে হেলম্‌হোজ্ সাহেব বলেন, কোনও মিশ্র আলোক অক্ষি যবনিকায় পড়িয়া যদি পূর্ব্বোক্ত তিন জাতীয় কোষকে একসঙ্গে বিভিন্ন মাত্রায় উত্তেজিত করে, তবে ইহার ফল লাল সবুজ ও বেগুনিয়া এই তিনটি মৌলিক বর্ণের মিশ্রণের ফলের অনুরূপ হয়। কাজেই মূলে তিনটি মাত্র বর্ণ থাকিলেও আমরা এই প্রকারে নানা বর্ণের আলোক দেখিতে আরম্ভ করি।

 সুতরাং দেখা যাইতেছে হেলম্‌হোজের মতে, সেই দণ্ডাকৃতি ও মোচাকার তিন জাতীয় কোষের বিচিত্র উত্তেজনাই বর্ণ-বৈচিত্র্যের মূল কারণ। যদি কোন আলোক কেবল এক জাতীয় কোষকেই উত্তেজিত করে, তবে এই কোষের জাতি হিসাবে আমরা লোহিত সবুজ বা বেগুনিয়া বর্ণের মধ্যে কেবল মাত্র একটিকেই দেখিতে আরম্ভ করিব।

 পূর্ব্বোক্ত দুইটি পৃথক সিদ্ধান্তের মধ্যে বৈজ্ঞানিকগণ আজকাল হেলম্‌হোজের উক্তিকেই সত্য বলিয়া গ্রহণ করিতেছেন। সহস্র সহস্র বর্ণের মধ্যে ইনি কেবল লাল সবুজ ও বেগুনিয়াকে কি কারণে মৌলিক বর্ণ বলিয়া স্থির করিলেন, তাহার বিশেষ আলোচনা এই ক্ষুদ্র প্রবন্ধের উপযোগী নয়। চক্ষুর উপর সুকৌশলে নানা বর্ণের আলোকপাত করিয়া হেলম্‌হোজ সাহেব অক্ষি-যবনিকাকে কেবল লাল সবুজ ও বেগুনিয়া বর্ণেই অবসাদগ্রস্ত হইতে দেখাইয়াছিলেন। এই প্রকার আরো অনেক পরীক্ষার সাহায্যে পূর্ব্বোক্ত বর্ণত্রয়ই যে মৌলিক বর্ণ তাহা নিঃসন্দেহে স্থির হইয়াছিল। হেরিং সাহেবের ন্যায় নিছক্ কল্পনার উপর দাঁড়াইয়া হেলম্‌হোজ সাহেব কোন কথাই বলেন নাই, যাহা বলিয়াছেন হাতে হাতে তাহার প্রমাণ দিয়াছেন। বোধ হয় এইজন্যই আজ হেলম্‌হোজের সিদ্ধান্তটির এত আদর।