প্রাকৃতিকী/জীবনটা কি?
জীবনটা কি?
প্রবন্ধ-শীর্ষের এই ক্ষুদ্র প্রশ্নটির উত্তর দিতে গিয়া পণ্ডিত-মূর্খ দার্শনিক-অদার্শনিক, বৈজ্ঞানিক-অবৈজ্ঞানিক কত লোকে যে, কত কথা বলিয়াছেন তাহার সীমা নাই। বোধ হয় যে দিন চিন্তা করিবার শক্তি মানুষকে আশ্রয় করিয়াছিল, সেই দিন হইতেই প্রশ্নটির সদুত্তরের জন্য চেষ্টা হইতেছে, কিন্তু আজও তাহার উত্তর মিলিল না। ঘোর দার্শনিক তাঁর পাঁজি পুঁথি খুলিয়া হয় ত গম্ভীরভাবে বলিবেন, এই যে তুমি, আমি, ঘটপট যাহা কিছু দেখিতেছ, সবই মায়ার রচনা। রসিক কবি হাস্যমুখে বলিবেন,
“নাঃ জীবনটা কিছু না,
একটা ইঃ একটা উঃ একটা আঃ”
কিন্তু ইহাতে ত মন বুঝে না। এই সংসারটা না হয় মায়াই হইল, এবং জীবনটা না হয় একটা ইঃ একটা উঃ এবং আর একটা আঃ হইয়া সুখে দুঃখে কাটিয়া গেল, কিন্তু এই তত্ত্বজ্ঞানটুকু দিয়া মনকে ত শান্ত করা যায় না। যে সকল জিনিষ জড়, কি প্রকারে তাহারা চেতনা পায় এবং কি প্রকারে তাহাদের ভিতরে জীবনের নানা অদ্ভুত কার্য্য চলিতে থাকে, মন তাহাই জানিতে চায়। সুতরাং দেখা যাইতেছে, তত্ত্বজ্ঞানের সীমা ছাড়াইয়া প্রশ্নটা আসিয়া পড়িল বিজ্ঞানে। আধুনিক বিজ্ঞানে ইহার কি প্রকার উত্তর পাওয়া যায়, আমরা বর্ত্তমান প্রবন্ধে তাহারই আভাস দিব।
আধুনিক বৈজ্ঞানিকদিগের নিকট প্রশ্নটির উত্তর চাহিলে তাঁহারা বলেন, দুগ্ধে ‘দম্বল’ অর্থাৎ দধিবীজ দিলে তাহা যেমন গাঁজিয়া উঠিয়া রূপান্তর প্রাপ্ত হয়, সেই প্রকার রূপান্তর পাইয়াই জীবনের কার্য্য চলে। দুগ্ধে দধিবীজ দেওয়াই গাঁজানো বা মাতানোর (Fermentation) একমাত্র উদাহরণ নয়। ময়দা বা সুজীতে খামী দিয়া যখন আমরা পাঁউরুটি প্রস্তুত করি, ভাতে জল দিয়া আমরা যখন পান্তাভাত প্রস্তুত করি, তখনো আমরা ঐসব জিনিষকে গাঁজাই। বিজ্ঞানের মতে আমরা যাহাকে জীবন বলি, তাহা এই প্রকারের নানা গাঁজানো বা মাতানো লইয়াই চলে। কথাটা হঠাৎ শুনিলে অসম্ভব বলিয়া মনে হয় সত্য, কিন্তু এই সিদ্ধান্তের অভ্রান্ততার এত প্রমাণ আছে যে, ইহাকে সত্য বলিয়া মানিতেই হইতেছে।
কখনই কোন বৃহৎ সিদ্ধান্তের প্রতিষ্ঠা একদিনে এবং এক জনের চেষ্টায় হয় নাই। কেহ উপাদান সংগ্রহ করিয়াছেন, কেহ সেগুলিকে একত্র করিয়াছেন, কেহ বা তাহাতে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করিয়াছেন। যুগযুগান্তের চেষ্টায় এই প্রকারেই এক একটি সিদ্ধান্ত দৃঢ় ভিত্তির উপরে দাঁড়াইয়া যায়। আমরা যে সিদ্ধান্তের আলোচনা করিতে যাইতেছি, তাহারও প্রতিষ্ঠা ঐ প্রকারে ধীরে ধীরে হইতেছে। প্রাচীন ও আধুনিক বহু শারীরতত্ত্ববিদের হস্তচিহ্ন ইহাতে ধরা পড়ে। যাঁহারা ইহার গোড়া পত্তন করিয়াছেন, তাঁহাদের কথা স্মরণ করিলে, প্রথমেই ফ্রান্সের জগদ্বিখ্যাত মহাপণ্ডিত পাষ্টুরের (Pasteur) কথা মনে আসে। দুগ্ধে দধিবীজ দিলে বা ময়দায় খামী দিলে সেগুলি কেন গাঁজিয়া রূপান্তরিত হয়, ইহা লইয়া তিনি এক সময় গবেষণা আরম্ভ করিয়াছিলেন। ইহাতে জানিয়াছিলেন, এক প্রকারে অতিক্ষুদ্র জীব দুগ্ধে বা ময়দায় আশ্রয় গ্রহণ করে। আমরা যখন দধি প্রস্তুত করিবার জন্য দুগ্ধে ‘দম্বল’, দিই, তখন সেই জীবাণুরই কতকগুলি দুগ্ধে ছাড়িয়া দিই, তার পর সেগুলি বংশবিস্তার করিয়া সমস্ত দুগ্ধকে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিলে দুগ্ধ দধির মূর্ত্তি গ্রহণ করে। কেবল ইহার নহে,—ওলাউঠা ডিপ্থিরিয়া প্রভৃতি নানা রোগের মূলেও তিনি ঐকার জীবাণুর কার্য্য দেখিয়াছিলেন। ঐ সকল রোগের জীবাণু মানুষ বা অপর প্রাণীর দেহে আশ্রয় গ্রহণ করিয়া বংশবিস্তার করিতে থাকিলেই যে, প্রাণীর দেহে ঐ বিশেষ রোগের লক্ষণ প্রকাশ হইয়া পড়ে, তাহা প্রত্যক্ষ দেখা গিয়াছিল। তা ছাড়া প্রাণীর স্বাস্থ্য অক্ষুণ্ণ রাখাতেও তিনি বিশেষ বিশেষ জীবাণুর কার্য্য আবিষ্কার করিয়াছিলেন। পাষ্টুর পরম বৈজ্ঞানিক ছিলেন এবং রসায়নবিদ্যাতেও তাঁহার অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল। তিনি স্পষ্ট বুঝিয়াছিলেন, জীবাণু দ্বারা মানুষের দেহে বা নানা জড়পদার্থে যে পরিবর্ত্তন হয়, তাহা রাসায়নিক পরিবর্ত্তন। কিন্তু এই কথা প্রকাশ করিবার পাপ তিনি নিজস্কন্ধে লইতে সাহস করেন নাই। জীবনের কার্য্যের সঙ্গে যে, রাসায়নিক কার্য্যের কোনও সম্বন্ধ আছে তাহা প্রকাশ করা সত্যই সে সময়ে পাপের বিষয় ছিল। খুব বড় বড় বৈজ্ঞানিকগণও তখন জীবনের কার্য্যকে একটা সৃষ্টিছাড়া রহস্য বলিয়া মনে করিতেন! পরীক্ষাগারে নানা পদার্থের যোগবিয়োগে আমরা যে-সকল ঘটনা ঘটিতে দেখি এবং যে প্রাকৃতিক নিয়মের সাক্ষাৎ পাই, তাহা জীবশরীরের কার্য্যে কখনই চলে না, এই এক সংস্কার তাৎকালিক বৈজ্ঞানিকদিগের মনে বদ্ধমূল ছিল। কাজেই প্রাণিদেহে জীবাণুর কার্য্য সম্পূর্ণ জৈব কার্য্য বলিয়াই স্থির হইয়া রহিল, ইহার সহিত রাসায়নিক কার্য্যের যে, কোন যোগ থাকিতে পারে তাহা আর কাহারও মনে হইল না।
পাষ্টুরের মৃত্যুর পর জর্ম্মানীতে বুক্নার (Büchner) নামক এক অসাধারণ প্রতিভাশালী বৈজ্ঞানিকের আবির্ভাব হইয়াছিল। ইঁহার স্বাধীন চিত্ত সংস্কারের গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ থাকিতে চাহে নাই। জীবাণুর কার্য্য গোড়ায় জৈব কার্য্য হইলেও তাহা যে, রাসায়নিক কার্য্য তাহা তিনি প্রচার করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। কেবল প্রচার করা নয়, হাতে হাতে তাহা দেখাইতেও লাগিলেন। ‘দম্বল’ বা অপর কোন খামী (Yeast) লইয়া তিনি সেগুলির উপর চাপ প্রয়োগ করিতে লাগিলেন; খামীর কোষগুলি (Cells) ভাঙ্গিয়া গেল এবং সেগুলি হইতে এক প্রকার রস নির্গত হইতে লাগিল। বুক্নার এই রস পরীক্ষা করিয়া দেখাইতে লাগিলেন, তাজা জীবাণুযুক্ত বীজ নিক্ষেপ করিলে দুগ্ধ বা চিনির রস প্রভৃতিতে যে পরিবর্ত্তন হয়, ঐ সকল জীবকোষের রস দিয়াও অবিকল সেই পরিবর্ত্তনই শুরু হয়। লোকে বুঝিতে লাগিল জীবাণুর কার্য্যে জীবনীশক্তি নামক কোন রহস্য জড়িত নাই। ইহাতে জীবাণুগণ তাহাদের দেহে কি প্রকারে রস প্রস্তুত করে তাহা স্থির হইল না বটে, কিন্তু সেই রসই যে, নানা পদার্থের সহিত মিলিয়া রাসায়নিক ক্রিয়া চালায় তাহাতে আর কাহারো সন্দেহ রহিল না। পাষ্টুর সাহেব, যে ‘জীবনীশক্তি’র ভয়ে কোন কথা বলিতে পারেন নাই, তাহার ভিত্তি চঞ্চল হইয়া উঠিল।
ইহার অব্যবহিত পরে বার্ট্রাণ্ড (Gabriel Bertrand) নামক জনৈক ফরাসী বৈজ্ঞানিক বিষয়টি লইয়া গবেষণা আরম্ভ করিয়াছিলেন, ইহাতে ইনি যে ফল পাইয়াছিলেন, তাহাতে জীবনের কার্য্য ও রাসায়নিক কার্য্যের একতা আরো সুস্পষ্ট বুঝা গিয়াছিল। জীবনীশক্তি ও রাসায়নিক শক্তির একতার কথা ইতিপূর্ব্বে প্রসিদ্ধ ফরাসী পণ্ডিত লাভোসিয়ার দেখাইয়াছিলেন। পরীক্ষাগারে অক্সিজেন্ সংগ্রহ করিতে হইলে আমরা যেমন কখন কখন বায়ুর নাইট্রোজেনকে বর্জ্জন করিয়া অক্সিজেন্ গ্রহণ করি, প্রাণীর ফুস্ফুস্ও যে ঠিক সেই প্রকারেই অক্সিজেন সংগ্রহ করিয়া জীবনের কার্য্য চালায়, তাহা বহুপূর্ব্বে এই লাভোসিয়ায় সাহেবই প্রচার করিয়াছিলেন। বার্ট্রাণ্ড সাহেব দেখাইতে লাগিলেন, প্রাণীর ফুস্ফুসে এমন একটি জিনিষ আছে, বায়ু হইতে অক্সিজেন সংগ্রহ করাই যাহার কাজ। তাপপ্রয়োগে তাহা নষ্ট হয়, এসিড্ বা বিষের সহিত সংযুক্ত হইলে তাহার ক্রিয়া লোপ পায়। ইহার প্রত্যেক কার্য্য পাষ্টুরের আবিষ্কৃত সেই খামীর (Yeast cells) কার্য্যের সহিত অবিকল মিলিয়া গেল। বার্ট্রাণ্ড সাহেব এই জিনিষটাকে (Oxydase) নামে অভিহিত করিলেন।
এই আবিষ্কারের পূর্ব্বে জীবতত্ত্ববিদ্গণ ও শারীরবিদ্গণ নিশ্চিন্ত ছিলেন না। পাষ্টুরের আবির্ভাবের বহু পূর্ব্বে বীজের অঙ্কুরিত হওয়ার বিষয় অনুসন্ধান করিতে গিয়া বৈজ্ঞানিকগণ দেখিয়াছিলেন, সদ্য অঙ্কুরিত বীজে এমন একটা জিনিষ আছে যাহা বীজের শ্বেতসারকে (Starch) বিশ্লিষ্ট করিয়া অপর কতকগুলি নূতন পদার্থে রূপান্তরিত করে। প্রাণীর মুখের লালাতেও যে, ঐ প্রকার একটা পদার্থ মিশ্রিত আছে তাহাও সকলে জানিয়াছিলেন। তার পর প্রাণীর পাকাশয়ে পেপ্সিন (Pepsin) নামক একটা পদার্থ আবিষ্কৃত হইয়া পড়িয়াছিল। এই জিনিষটার গুণেই যে প্রাণীরা মাংস বা ডিম্ব প্রভৃতি খাদ্য আহার করিয়া হজম করিতে পারে, তাহাও সকলে দেখিয়াছিলেন। যকৃৎ হইতে প্রাণীর দেহে, যে পিত্ত-রস (Bile) নির্গত হয়, তাহা কি প্রকারে তৈলময় খাদ্যকে শরীরের কাজে লাগায় তাহারও আভাস পাওয়া গিয়াছিল। এতদ্ব্যতীত পাকাশয়ের অপর রসগুলির কার্য্যের লক্ষণও বৈজ্ঞানিকদিগের জানা ছিল। পাষ্টুরের আবিষ্কার ও বার্ট্রাণ্ডের পরীক্ষার ফল প্রচারিত হইলে, কাজেই এই সকল তথ্যের দিকে সকলের দৃষ্টি আকৃষ্ট হইতে লাগিল। জীবদেহের নানারসের কার্য্যের সহিত পাষ্টুরের আবিষ্কৃত ‘খামী’র কার্য্যের একতা দেখিয়া সকলে অবাক্ হইয়া গেলেন। কিন্তু তথাপি ‘খামী’র সজীব জীবাণু ও প্রাণিদেহের নানা রসের মধ্যে পার্থক্য রাখিবার জন্য, দেহ-রসগুলিকে নানা লোকে নানা নামে অভিহিত করিতে লাগিলেন। কেহ সেগুলিকে Enzymes কেহ বা তাহাদিগকে Zymases বলিতে লাগিলেন।
যখন পাষ্টুরের আবিষ্কৃত জীবাণুর কার্য্যের সহিত নানা শারীরিক কার্য্যের এই প্রকার ঐক্য একে একে ধরা পড়িতেছিল, তখন এক অভাবনীয় বাধা আসিয়া গবেষণার গতি রোধ করিয়া দিয়াছিল। বৈজ্ঞানিকগণ চিন্তা করিয়া দেখিলেন, পাষ্টুরের সেই জীবাণুর কাজ কেবল জিনিষকে ভাঙ্গিয়া ফেলে ব্যতীত আর কিছুই নয়। যখন শর্করায় আমরা বিশেষ জীবাণুযুক্ত খামী নিক্ষেপ করি, তখন শর্করা ভাঙ্গিয়া গিয়া মদ্য (Alcohol) এবং অঙ্গারক বাষ্প (Carbonic Acid) উৎপন্ন করিতে থাকে। পাকাশয়ের পেপ্সিন নামক রসও ঠিক ঐ প্রকারেই উদরস্থ খাদ্যের মাংস ইত্যাদিকে ভাঙ্গিয়া নানা নূতন পদার্থ উৎপন্ন করে। কিন্তু জীবদেহে ভাঙ্গার সহিত অবিরাম যে গড়ার কাজও চলিতেছে তাহার ব্যাখ্যান কোথায়? কেবল ভাঙ্গা লইয়াই ত জীবন নয়,—ভাঙ্গা ও গড়ার অপূর্ব্ব যোগেই জীবনের কার্য্য। সুতরাং গাঁজানো (Fermentation) লইয়াই জীবন, এই কথা বলিয়া যাঁহারা জয়োল্লাসে উন্মত্ত হইলেন, তাঁহাদিগকে কিছুদিনের জন্য নীরব থাকিতে হইল।
কিন্তু গবেষণার বিরাম হইল না,—নানা দেশে নানা বৈজ্ঞানিক গাঁজানোর কার্য্যে কোন নূতন জিনিষ গঠিত হয় কি না, অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন। কত জিনিষে কত প্রকার খামী দিয়া পরীক্ষা চলিতে লাগিল, কিন্তু কোন পরীক্ষাতেই সংগঠন দেখা গেল না। শেষে ইংরাজ রসায়নবিৎ হিল্ সাহেব (Croft Hill) এক পরীক্ষায় খামী দ্বারা প্রকৃত সংগঠন দেখাইয়া সকলকে বিস্মিত করিলেন। শ্বেতসারে (Starch) খামী দিলে তাহা চিনি প্রভৃতি পদার্থে বিশ্লিষ্ট হইয়া পড়ে। যতক্ষণ শ্বেতসারের এক কণিকা পর্য্যন্ত অবশিষ্ট থাকে, ততক্ষণ এই পরিবর্ত্তনের বিরাম হয় না। শ্বেতসার নিঃশেষিত হইলে এই কার্য্যের লোপ ঘটে, এবং নূতন শ্বেতসার দিলে পুনরায় ঐ বিশ্লেষণ সুরু হয়। হিল্ সাহেব একটি পাত্রে শ্বেতসারের সহিত খামী (Malt Enzyme) মিশাইয়া, তাহাকে নিঃশেষে বিশ্লিষ্ট করিয়াছিলেন, এবং পরে তাহাতে ধীরে ধীরে চিনি নিক্ষেপ করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। এই প্রকারে দেখা গিয়াছিল, চিনির যোগে শ্বেতসারের আবার পুনর্গঠন আরম্ভ হইয়াছে। কাজেই পাষ্টুরের গাঁজানোর কার্য্যে যেমন পদার্থের বিশ্লেষণ ঘটে, তাহাতে সেই প্রকারে নূতন পদার্থের যে সংগঠনও হইতে পারে, তাহা বুঝা গেল।
হিল্ সাহেবের এই আবিষ্কার অতি অল্প দিন হইল প্রচারিত হইয়াছে, বোধ হয় দশ বারো বৎসরের অধিক হইবে না। কিন্তু একমাত্র উদাহরণে বৈজ্ঞানিকগণ সন্তুষ্ট হইলেন না, নানা দেশের পণ্ডিতগণ নূতন উদাহরণ সংগ্রহের জন্য গবেষণা করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। সম্প্রতি জর্ম্মানীর জনৈক বিখ্যাত রসায়নবিৎ ইমারলিঙ্ সাহেব (Emmerling) আর একটি উদাহরণ সংগ্রহ করিয়া সকলকে চমৎকৃত করিয়াছেন। ইনি বাদামের তৈলে একপ্রকার খামী দিয়া সেটিকে চিনি এবং হাইড্রোসাইনিক্ এসিড্ (Hydrocyanic Acid) নামক এক বিষ-পদার্থে বিশ্লিষ্ট হইতে দেখিয়াছিলেন, কিন্তু ইহার পরেই তাহাতে আর এক প্রকার খামী (Malt Ferment) দিবামাত্র সেটি আবার বাদামের তৈলে পুনর্গঠিত হইয়া পড়িয়াছিল।
এই আবিষ্কারের পর হইতে প্রতি বৎসরেই খামীর যোগে আরো নূতন নূতন জিনিষের উৎপত্তির সংবাদ পাওয়া যাইতেছে। পাষ্টুরের আবিষ্কৃত তত্ত্ব পদার্থের বিশ্লেষণেই যে সীমাবদ্ধ নয়, তাহা আজকাল বৈজ্ঞানিকগণ প্রত্যক্ষ দেখিতেছেন। কাজেই স্বীকার করিতে হইতেছে, এক খামীর যোগে যেমন আমরা শ্বেতসারকে ভাঙ্গিয়া চিনি ইত্যাদিতে বিশ্লিষ্ট করি এবং তার পর অপর কিছুর যোগে তাহাকে আবার শ্বেতসারে পুনর্গঠিত করি, প্রাণিদেহে অবিকল সেই প্রকারেই ভাঙ্গাগড়া অবিরাম চলিতেছে! কোন দেহজ খামী উদরস্থ আমিষ খাদ্যকে ভাঙ্গিতেছে, কেহ তৈলময় খাদ্যকে বিশ্লিষ্ট করিতেছে। তার পরে আর এক নূতন খামী ঐগুলির সঙ্গে মিশিয়া হয় ত এমন কতকগুলি জিনিষের গঠন করিতেছে, যাহা স্থায়িরূপে দেহেরই অংশ হইয়া পড়িতেছে।
এই লেখায় এই অংশে একটি চিত্র থাকা উচিৎ। যদি আপনি তা দিতে পারেন, তবে, দয়া করে সাহায্য:চিত্র দেখুন। |
এই সকল আবিষ্কার দ্বারা শারীরতত্ত্ব যেন নূতন জীবন লাভ করিয়াছে। আধুনিক বৈজ্ঞানিকগণ এ সম্বন্ধে যতই গবেষণা করিতেছেন, নিত্য নূতন তত্ত্ব আবিষ্কৃত হইয়া সকলকে চমৎকৃত করিতেছে। আধুনিক শারীর-তত্ত্ববিদ্গণ বলিতেছেন, দেহের সূচ্যগ্র-প্রমাণ স্থানে কোটি কোটি জীবকোষ (Cells) অবস্থান করিতেছে। ইহাদের এক একটি কোষ এক একটি বৃহৎ বিজ্ঞানাগার বিশেষ। একই বিজ্ঞানাগারে বসিয়া যেমন বহু লোকে নানা পদার্থ করেন—ঐ এক একটি কোষের ভিতরেই দশ বারোটি প্রকোষ্ঠে দশ রকম খামী (Ferment) আপনা হইতেই প্রস্তুত হইতে থাকে। প্রয়োজন বুঝিয়া এই সকল রসই ভাঙ্গা-গড়ার কাজে যোগ দেয় এবং জীবনের কার্য্য দেখায়। প্রাণীর যকৃতের এক একটি অতীন্দ্রিয় সূক্ষ্ম কোষে যে সকল খামী প্রস্তুত হয়, সেগুলির মধ্যে কোনটি ইউরিয়া (Urea), কোনটি পিত্তরস এবং কোনটি নানাপ্রকার রঙ্ উৎপন্ন করিতে ব্যস্ত থাকে। আবার কতকগুলি দেহস্থ বিষ পদার্থকে বিশ্লিষ্ট করিয়া নষ্ট করিতে থাকে, কতকগুলি হয় ত পাকাশয়ে উৎপন্ন অম্লকে অপর পদার্থের সহিত মিশাইতে ব্যাপৃত থাকে। কেবল যকৃতে নয়, প্লীহা, মুত্রাশয়, ফুস্ফুস্ প্রভৃতি দেহের সকল অংশে কোটি কোটি জীবকোষের এই প্রকার কার্য্য নিয়তই চলিতেছে। এমন কি মস্তিষ্কে এবং স্নায়ুমণ্ডলীতেও এই প্রকার বিশেষ খামী জন্মিয়া ভাঙ্গা-গড়ার ভিতর দিয়া জীবনের কার্য্য দেখাইতেছে। সুতরাং দম্বলে দধির উৎপাদন এবং জীবনের কার্য্য একই বলিয়া আমরা প্রবন্ধারম্ভে যে-কথাটার উল্লেখ করিয়াছিলাম, তাহা যে নিরর্থক নয় এই সকল পরীক্ষা-দৃষ্ট ব্যাপার হইতেই স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায়।
এখন জিজ্ঞাসা করা যাইতে পারে,—আজকাল বৈজ্ঞানিকগণ জীবদেহের যে সকল খামীকে জীবনীশক্তির মূল কারণ বলিয়া নির্দ্দেশ করিতেছেন, সেই Enzymes or Zymases জিনিষটি কি? আধুনিক বৈজ্ঞানিকগণ এখনও এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন না। কিন্তু ইহার যথার্থ উত্তর দেওয়াই আজকাল বৈজ্ঞানিকদিগের সাধনার বিষয় হইয়া দাঁড়াইয়াছে। এই উদ্দেশ্যে কত দেশে কত বৈজ্ঞানিক যে, নীরবে গবেষণা করিতেছেন তাহার ইয়ত্তা হয় না। কোন্ শুভদিনে ইঁহাদের সাধনা সিদ্ধিলাভ করিবে তাহা ঠিক্ বলা যায় না। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, রাসায়নিক প্রথায় বিশ্লেষ করিলে সেই হাইড্রোজেন্, অক্সিজেন্, নাইট্রোজেন্ এবং অঙ্গার ছাড়া আর কিছুই ঐ সকল পদার্থে ধরা পড়ে না। কি প্রকারে এই সকল সুপরিচিত পদার্থ সংযুক্ত হইয়া জীবনীশক্তির প্রকাশ করে তাহাই বিজ্ঞানের একটা সমস্যা হইয়া দাঁড়াইয়াছে। রসায়নবিদ্গণ যেমন অক্সিজেন্ ও হাইড্রোজেন্কে একত্র করিয়া পরীক্ষাগারে জল প্রস্তুত করিতে পারেন, সেই প্রকারে যে দিন তাঁহারা অঙ্গার হাইড্রোজেন্, নাইট্রোজেন্ ইত্যাদিকে মিলাইয়া এক বিন্দু খামী (Ferment) বা একটি জীবকোষ প্রস্তুত করিতে পারিবেন সেই দিনই বিজ্ঞান ধন্য হইবে।