প্রাকৃতিকী/ডপ্লার সাহেবের সিদ্ধান্ত
ডপ্লার সাহেবের সিদ্ধান্ত
কোন স্রোতস্বিনী নদীতে এক ব্যক্তি দৃঢ়পদে স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া স্নান করিতেছে, আর এক ব্যক্তি স্রোতের বিপরীত দিকে সাঁতার কাটিয়া চলিয়াছে। মনে করা যাউক, দশ মিনিট্ কাল ঐ দুইজন জলে ছিল। এখন যদি কেহ প্রশ্ন করেন, এই দুইটি লোকের মধ্যে কাহার গায়ে অধিক ঢেউ লাগিল, তাহা হইলে প্রশ্নটির উত্তর দেওয়া বোধ হয় কঠিন হয় না। যে লোকটি সাঁতার কাটিয়া স্রোতের বিরুদ্ধে চলিয়াছিল নিশ্চয়ই তাহার গায়ে অধিক ঢেউ ধাক্কা দিয়াছিল।
ইহার কারণ জিজ্ঞাসা করিলে অনায়াসে বলা যায়, যে লোকটি দাঁড়াইয়া স্নান করিতেছিল সে অধিক ঢেউয়ের ধাক্কা খাইবার জন্য একটুও গরজ দেখায় নাই। ঢেউ যেমন নিয়মিত চলে ঠিক্ সেই প্রকাৱে চলিয়াই নিশ্চল স্নাতকের গায়ে নিয়মিত ধাক্কা দিয়া চলিয়াছিল। কিন্তু যে লোকটি স্রোতের বিরুদ্ধে সাঁতার কাটিতেছিল, তাহাকে পূর্ব্বোক্ত নিয়মিত ঢেউগুলির ধাক্কা ছাড়া আরো কতকগুলি নূতন ঢেউয়ের ধাক্কা সহ্য করিতে হইয়াছিল। কারণ যে-দিক্ হইতে ঢেউ আসিতেছে, লোকটি সেই দিকেই সাঁতার কাটিয়া অগ্রসর হইয়া কতকগুলি নূতন ঢেউয়ের সাক্ষাৎ পাইয়াছিল। কাজেই দেখা যাইতেছে, যদি দণ্ডায়মান স্নাতক দশ মিনিটে দুই শত ঢেউয়ের ধাক্কা খাইয়া থাকে তবে সন্তরণশীল স্নাতক হয়ত দুইশত পঁচিশটি ঢেউয়ের ধাক্কা খাইয়াছে।
এখন মনে করা যাউক, দণ্ডায়মান স্নাতক ঠিক দাঁড়াইয়াই আছে, কেবল সন্তরণকারী লোকটি স্রোতের দিকে দ্রুত সাঁতরাইয়া চলিয়াছে। এস্থলে কোন লোকটিকে অধিক ঢেউয়ের ধাক্কা সহ্য করিতে হইবে? বিবেচনা করিলে দেখা যায়, দণ্ডায়মান লোকটির গায়েই অধিক ঢেউ স্পর্শ করিতেছে। কারণ সন্তরণশীল লোকটি ঢেউয়ের সহিত দ্রুত সাঁতরাইতে আরম্ভ করায় পিছনের ঢেউগুলি বিলম্বে আসিয়া তাহাকে ধাক্কা দিবে। কাজেই ধাক্কার সংখ্যা অল্প হইয়া পড়িবে। দণ্ডায়মান ব্যক্তি যদি দশ মিনিট সময়ে দুই শত ঢেউয়ের ধাক্কা পাইয়া থাকে, তবে এই ক্ষেত্রে সন্তরণকারী লোকটি হয় ত এক শত পঁচাত্তরের অধিক ঢেউয়ের ধাক্কা পাইবে না।
ঢেউয়ের ধাক্কা পাওয়ার এই যে উদাহরণ দেওয়া হইল, ইহারই সাহায্যে জ্যোতিঃশাস্ত্রের ও শব্দতত্ত্বের যে কত রহস্যের মীমাংসা হইয়াছে সত্যই তাহার ইয়ত্তা করা যায় না। ঈথর, বাতাস বা জল, যে কোন পদার্থে যখন ঢেউ উঠে, তখন তাহাতে মজ্জমান নিশ্চল পদার্থ অপেক্ষা সচল পদার্থ যে, কখন অধিক এবং কখন কম ঢেউয়ের ধাক্কা পায়, ইহা বিজ্ঞানে Doppler’s Principle অর্থাৎ ডপ্লার সাহেবের সিদ্ধান্ত বলিয়া প্রসিদ্ধ।
মনে করা যাউক, একখানি রেলের এঞ্জিন দূরে দাঁড়াইয়া বাঁশি বাজাইতেছে এবং একজন শ্রোতা অদূরে ষ্টেশনের প্লাট্ফরমে দাঁড়াইয়া আছে। বাঁশি বাজিবার সময় বাতাসে যে ঢেউ তুলিতেছে তাহা শ্রোতার কর্ণে প্রবেশ করিয়া তাহাতে নিশ্চয়ই একটি শব্দ শুনাইবে। এখন মনে করা যাউক, সেই এঞ্জিনটিই বাঁশি বাজাইতে বাজাইতে ষ্টেশনের দিকে অগ্রসর হইতেছে। পূর্ব্বে দণ্ডায়মান গাড়ির বাঁশির কম্পনে বাতাসে যে প্রকার ঢেউ হইতেছিল, এখনো তাহাই হইবে বটে, কিন্তু গাড়িখানি বাঁশি বাজাইয়া শ্রোতার দিকে ছুটিয়া আসায়, তাহার শ্রবণেন্দ্রিয়ে পূর্ব্বাপেক্ষা অনেক অধিক শব্দতরঙ্গের ধাক্কা লাগিবে। কিন্তু শব্দতরঙ্গের সংখ্যারই উপর সুরের উঁচুনীচু নির্ভর করে। প্রতি সেকেণ্ডে বারো শত বার ধাক্কা পাওয়ায় আমরা যে শব্দ শুনিব, তাহা সেকেণ্ডে দুই হাজার বার ধাক্কা পাওয়ার শব্দ অপেক্ষা অনেক নীচু অর্থাৎ মোটা হইবে। চরকার বন্ বন্ শব্দ খুব মোটা, কারণ ইহা বাতাসে যে শব্দতরঙ্গের উৎপন্ন করে তাহা লম্বায় অত্যন্ত বড়, কাজেই শ্রোতার কানে অতি ধীরে আসিয়া আঘাত দেয়, কিন্তু মশকের গুন গুন শব্দ খুব মিহি, কারণ পুনঃ পুনঃ পক্ষান্দোলনে ইহারা বাতাসে যে তরঙ্গ তুলে তাহা অতি ছোট, কাজেই শ্রোতার কর্ণে এগুলি অতি দ্রুতভাবে আঘাত করিতে থাকে। সুতরাং দেখা যাইতেছে, আমাদের উদাহৃত এঞ্জিন্খানির বাঁশি হইতে এখন যে শব্দ শ্রোতার কর্ণে প্রবিষ্ট হইবে, তাহা পুর্ব্ব শব্দের তুলনায় মিহি হইবার কথা। ষ্টেশনের দিকে বাঁশি বাজাইয়া ছুটিতেছে, এমন কোন গাড়ির শব্দ পরীক্ষা করিলে, পাঠক সত্যই বাঁশির শব্দকে ক্রমেই মিহি হইতে শুনিবেন।
এখন সেই গাড়িখানি বাঁশি বাজাইতে বাজাইতে ষ্টেশনের দিকে না আসিয়া ষ্টেশন হইতে দূরে যাইতেছে, এপ্রকার অবস্থা যদি কল্পনা করা যায়, তাহা হইলে বাঁশির ধ্বনি মিহি হইবে কি মোটা হইবে বিবেচনা করা যাউক। আমরা পূর্ব্বেই বলিয়াছি শব্দের উঁচু নীচু অর্থাৎ মিহি মোটা ব্যাপারটা কর্ণে প্রবিষ্ট শব্দতরঙ্গের সংখ্যার উপর নির্ভর করে। এঞ্জিন্ স্থির থাকিয়া বাঁশি বাজাইবার সময় যতগুলি শব্দতরঙ্গ শ্রোতার কর্ণে প্রবিষ্ট করাইতেছিল, এখন দূরে যাইতে আরম্ভ করায় তাহা অপেক্ষা অনেক অল্প তরঙ্গ কর্ণে প্রবিষ্ট হইবে, কাজেই শব্দ মোটা হইয়া দাঁড়াইবে। পরীক্ষা করিলে সত্যই এই অবস্থায় গাড়ির শব্দকে মোটা হইতে দেখা যায়।
জলতরঙ্গের উদাহরণ যেমন বায়ুতরঙ্গে প্রয়োগ করায় একই ফল পাওয়া গেল, এখন উহাকে ঈথর-তরঙ্গে প্রয়োগ করিলে কি হয় দেখা যাউক।
পাঠক অবশ্যই অবগত আছেন, আমরা যাহাকে আলোক বলি, তাহা সর্ব্বব্যাপী ঈথর নামক এক পদার্থের তরঙ্গ হইতে নাকি উৎপন্ন। ঈথরকে দেখা যায় না, কিন্তু সর্ব্বস্থানে অবস্থান করে। বায়ু কেবল পৃথিবীর উপরেই আছে,—পঞ্চাশ ষাটি মাইল উপরে উঠিলে আর বায়ুর অস্তিত্ব থাকে না। কিন্তু ঈথর জিনিষটা সে প্রকার নয়, ইহা সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডকে জুড়িয়া আছে। বায়ুতে বা জলের কোন স্থানে একটু আলোড়ন উপস্থিত হইলে যেমন তরঙ্গাকারে সেই আলোড়ন চারিদিকে ছুটিয়া চলে, ঈথরেও তাহাই হয়। কোটি কোটি মাইল দূরের জ্যোতিষ্কে অগ্নি প্রজ্বলিত হইলে ঈথরের যে আলোড়ন উপস্থিত হয়, তাহা তরঙ্গ পরম্পরায় আসিয়া আমাদের দর্শনেন্দ্রিয়ে ধাক্কা দেয়, এবং এই ধাক্কাতেই আমরা আলোককে দেখিতে পাই। শব্দ বা ধ্বনির বৈচিত্র্য বায়ুর তরঙ্গের সংখ্যার উপর নির্ভয় করে। আমরা পূর্ব্বেই বলিয়াছি সেকেণ্ডে বারো শত বার বায়ুতরঙ্গের আঘাত পাইলে আমরা যে শব্দ শুনি, দুই হাজার বারের আঘাতে শব্দ তাহা অপেক্ষা অনেক মিহি হইয়া দাঁড়ায়। বায়ু-তরঙ্গের সহিত ঈথর-তরঙ্গের এস্থলেও সাদৃশ্য আছে। সা, রে, গা, মা, ইত্যাদি ধ্বনির মিহি-মোটাভাব যেমন বায়ু-তরঙ্গের সংখ্যার উপর নির্ভর করে, রক্ত, পীত, হরিৎ, নীল ইত্যাদি বর্ণের বৈচিত্র্যও ঠিক্ সেই প্রকারে ঈথর তরঙ্গের সংখ্যার উপর নির্ভর করে। যতগুলি ঈথরতরঙ্গ চক্ষে ধাক্কা দিয়া পীতালোক উৎপন্ন করিতেছে, তাহার সংখ্যা বাড়াইয়া দাও; দেখিবে, এখন তাহাতে আর পীতালোক উৎপন্ন হইতেছে না, পীতালোক হইতে উচ্চ কোনও বর্ণ, হয় ত সবুজ বা নীল ইত্যাদি কিছু প্রকাশ হইয়া পড়িয়াছে। ঈথর-তরঙ্গের সংখ্যা কমাইয়া দাও, দেখিবে এখানে কোনও নীচু রঙ্ অর্থাৎ কমলা (Orange) বা লোহিত, এই প্রকার কিছু প্রকাশ হইয়া পড়িতেছে। সা, রে, গা, মা, ইত্যাদি ধ্বনি যেমন বায়ু-তরঙ্গের সংখ্যার ক্রমিক বৃদ্ধি দ্বারা উৎপন্ন হয়, লোহিত, গোলাপী, পীত, সবুজ, নীল প্রভৃতি রামধনুর বিবিধ বর্ণও সেই প্রকার ঈথর-তরঙ্গের ধাক্কার সংখ্যা বৃদ্ধি দ্বারা আমাদের চক্ষুতে প্রকাশ পাইয়া থাকে।
পাঠক রশ্মিনির্ব্বাচন যন্ত্রের কথা হয় ত শুনিয়াছেন। এই যন্ত্রটার নাম যতটা বড়, মূল জিনিষটা কিন্তু তত বড় নয়। একটা তে-শিরা কাচ লইয়াই যন্ত্র গঠিত। সাধারণ সূর্য্যালোক যেমন এই প্রকার কাচের ভিতর দিয়া বাহিরে আসিলে, লাল, গোলাপী, পীত, ইত্যাদি বর্ণের এক বর্ণচ্ছত্র (Spectrum) প্রস্তুত করে, নক্ষত্রের আলোকও সেই প্রকার মৌলিক বর্ণে বিশ্লিষ্ট হইয়া এক-একটি বর্ণচ্ছত্র প্রস্তুত করে। কঠিন তরল বা অধিক চাপপ্রাপ্ত বাষ্প পুড়িয়া যে-সকল বর্ণচ্ছত্র উৎপন্ন করে, সেগুলি সূর্য্যের বর্ণচ্ছত্রের ন্যায় অখণ্ড। অর্থাৎ এ গুলিতে লাল, গোলাপী, হলুদ, সবুজ ইত্যাদি বর্ণ একবারে গায়ে গায়ে লাগা থাকে। কিন্তু সাধারণ বাষ্প পুড়িবার সময় যে বর্ণচ্ছত্র উৎপন্ন করে, তাহা খণ্ডিত হইয়া প্রকাশ পায়। অর্থাৎ ইহাতে সকল রঙ্গুলি গায়ে গায়ে লাগা থাকে না। হাইড্রোজেন্ পোড়াইলে যে বর্ণচ্ছত্র পাওয়া যায়, তাহাতে গোলাপী সবুজ ও নীলের কয়েকটি রেখা প্রকাশ পায়। যখনই হাইড্রাজেনের আলোককে বিশ্লেষ করা যায়, এই কয়েকটি বর্ণরেখা ব্যতীত আর কিছুই বর্ণচ্ছত্রে প্রকাশ পায় না। সেই প্রকার সোডিয়ম্ পোড়াইলে বর্ণচ্ছত্রের পীতাংশে কয়েকটি রেখা দেখা দেয় মাত্র। প্রত্যেক মূল পদার্থের এই প্রকার এক একটি বিশেষ বর্ণচ্ছত্র নির্দ্দিষ্ট থাকায়, আমরা যখন দূরবর্ত্তী নক্ষত্রের রশ্মি বিশ্লেষ করিয়া বর্ণচ্ছত্র উৎপন্ন করি, তখন পরিজ্ঞাত পদার্থের বর্ণচ্ছত্রের সহিত ইহার মিল দেখিয়া, নক্ষত্রে কোন্ কোন পদার্থ পুড়িতেছে তাহা বলিয়া দিতে পারি। এই কারণে বর্ণচ্ছত্র পরীক্ষা দূরবর্ত্তী জ্যোতিষ্কের গঠনোপাদান নির্ণয়ের একটি প্রধান অবলম্বন হইয়া দাঁড়াইয়াছে।
যাহা হউক মনে করা যাউক, যেন আমরা রশ্মি-নির্বাচন যন্ত্র (Spectroscope) দ্বারা কোন দূর নক্ষত্রের আলোক পরীক্ষা করিতেছি। জ্যোতিষ্কটি যদি আমাদের যুবক সূর্য্যের মত হয়, অর্থাৎ ইহার দেহ যদি জ্বলন্ত কঠিন তরল ও বায়বীয় পদার্থের মিশ্রণে প্রস্তুত হইয়া থাকে, তাহা হইলে রক্তপীত হরিৎনীল প্রভৃতি বর্ণ গায়ে গায়ে লাগানো এক অখণ্ড বর্ণচ্ছত্র প্রকাশ হইয়া পড়িবে। জ্যোতিষ্কটি যদি বয়সে সূর্য্যের ছোট হয়, অর্থাৎ যদি এখনো বাষ্পাকারে থাকিয়া উহা আলোক বিতরণ করিতে থাকে, তাহা হইলে বর্ণচ্ছত্র খণ্ডিত হইয়া দেখা দিবে। ইহাতে তখন লাল, নীল ইত্যাদি বর্ণের স্থানে কতকগুলি স্থূল বর্ণরেখা ব্যতীত আর কিছুই দেখা যাইবে না। যদি কেবল হাইড্রোজেন্ পোড়াইয়াই জ্যোতিষ্কটি দীপ্তিশালী হইয়া থাকে তবে, তাহা হাইড্রোজেনেরই বর্ণচ্ছত্র প্রকাশ করিতে থাকিবে। যাহা হউক মনে করা যাউক, এই শেষোক্ত শ্রেণীর জ্বলন্ত বাষ্পময় একটি জ্যোতিষ্ক ভীমবেগে আমাদের দিকে অগ্রসর হইতেছে এবং সেই সময়ে আমরা উহার আলোকের বর্ণচ্ছত্র পরীক্ষা করিতেছি। আমরা পূর্ব্বে দেখিয়াছি, কোন বস্তু নিশ্চল থাকিয়া যে আলোকে আত্মপ্রকাশ করে, তাহাই দশকের দিকে ছুটিয়া আসিতে থাকিলে অপর আলোক দেখাইতে আরম্ভ করে। কারণ নিশ্চল অবস্থায় যতগুলি ঈথর-তরঙ্গ দ্রষ্টার চক্ষে আঘাত দেয়, ছুটিয়া অগ্রসর হওয়ায় তাহা অপেক্ষা অনেক অধিক তরঙ্গ চক্ষে আসিয়া পড়ে। আমাদের চক্ষু এই তরঙ্গমাত্রার পার্থক্য ধরিতে পারে না, কিন্তু রশ্মি-নির্ব্বাচন যন্ত্রকে ফাঁকি দেওয়া চলে না। জ্যোতিষীরা পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছেন, আমাদের উদাহৃত সেই রেলের গাড়ি কাছে ছুটিয়া আসিলে যেমন তাহার মোটা সুরটা মিহি হইয়া দাঁড়ায়, এখানেও ঠিক্ সেই রকমে জ্যোতিষ্কের বর্ণচ্ছত্রস্থ নীচু রঙ্গুলি ক্রমে উঁচু হইয়া দাঁড়ায়। অর্থাৎ বর্ণচ্ছত্রে যদি কেবল নীল বা পীত রেখা থাকে, তবে সেগুলি সরিয়া ভায়লেটের দিকে যাইতে চায়। যে-সকল জ্যোতিষ্ক আমাদের নিকট হইতে দূরে যাইতেছে, তাহাদের বর্ণচ্ছত্র পরীক্ষা করিলে কাজেই সেই উদাহৃত দূরগামী রেলগাড়ির বাঁশির সুরের মত বর্ণচ্ছত্রের “উঁচু” আলো “নীচু” হইয়া পড়িবে। অর্থাৎ বর্ণচ্ছত্রে যদি হল্দে বা নীল প্রভৃতি বর্ণরেখা থাকে, তাহা লালের দিকে সরিয়া যাইতে চাহিবে।
জ্যোতিষ্কের গতি দ্বারা বর্ণচ্ছত্রের রেখার এই বিচলন পরীক্ষা করিয়া আধুনিক জ্যোতির্বিদ্গণ নক্ষত্রের গতিবিধি সম্বন্ধে যে কত নব নব তথ্য সংগ্রহ করিয়াছেন তাহার ইয়ত্তাই হয় না। এই সকল তথ্য যে, কোন প্রকারে সংগ্রহ করিতে পারা যাইবে পঞ্চাশ বৎসরের পূর্ব্বেকার জ্যোতিষিগণ তাহা স্বপ্নেও ভাবেন নাই।
পাঠক অবশ্যই অবগত আছেন, আমাদের পৃথিবী যেমন প্রায় চব্বিশ ঘণ্টাকালে একবার ঘুরপাক্ খায়, সূর্য্যও সেই প্রকার এক নির্দ্দিষ্ট সময়ে এক-একটা পূর্ণাবর্ত্তন শেষ করে। কিন্তু পূর্ব্বে আবর্ত্তন-কাল নিরূপণের উপায় ছিল না। এক্ষণে, আবর্ত্তনের জন্য সূর্যের বর্ণচ্ছত্রের রেখাগুলির কতটা বিচলন হইল পরিমাপ করিয়া, আবর্ত্তন-কাল নির্ণীত হইয়াছে। নক্ষত্রগুলিকে আমরা আকাশে নিশ্চল দেখি বটে, কিন্তু ইহাদের প্রত্যেকেরই এক একটা গতি আছে। ইহারা পৃথিবী হইতে অতি দূরে অবস্থিত বলিয়া হাজার দুই হাজার বৎসরের পর্য্যবেক্ষণে উহাদের বিচলন চোখে ধরা যায় না, কাজেই গতির পরিমাণ অনির্দ্দিষ্ট ছিল। আজকাল ঐসকল দুরবর্ত্তী নক্ষত্রের কেবল বর্ণচ্ছত্রের বিচলন পরীক্ষা দ্বারা মোটামুটি ভাবে গতি নির্ণয় করা হইতেছে। সুপ্রসিদ্ধ বৈজ্ঞানিক সার্ উইলিয়ম্ হগিন্স্ (Huggins) কতকগুলি নক্ষত্রকে এই প্রকারে প্রতি সেকেণ্ডে ত্রিশ মাইল বেগে ধাবমান হইতে দেখিয়াছেন।
যুগ্ম নক্ষত্রের (Binary Stars) কথা পাঠক হয়ত শুনিয়া থাকিবেন। এই নক্ষত্রগুলি যুগ্ম সূর্য্যবিশেষ। ইহারা জোড়া জোড়া আকাশে অবস্থান করে এবং একটি অপরটির চারিদিকে ঘুরিয়া বেড়ায়। দূরবীক্ষণ দিয়া এই প্রকার যুগ্ম নক্ষত্র অনেক আবিষ্কৃত হইয়াছে, কিন্তু অতি দূরের নক্ষত্রগণের যুগ্মতা দূরবীক্ষণ দ্বারা স্থির হয় না। প্রত্যেক দূরবীক্ষণের শক্তির এক-একটা সীমা আছে। এমন শক্তিসম্পন্ন দূরবীণ, নির্ম্মিত হয় নাই, যাহা অতি দূরের নক্ষত্রগুলির যুগ্মতা দেখাইতে পারে। দূরের নক্ষত্রগুলির যুগ্মতা নির্দ্ধারণে বর্ণচ্ছত্রের রেখার বিচলন পরীক্ষাই একমাত্র উপায়। এই পদ্ধতিতে যে কত নক্ষত্রের যুগ্মতা নিরূপিত হইয়াছে তাহার ইয়ত্তা নাই। কেবল ইহাই নয়, কত বেগে তাহারা পরস্পরকে প্রদক্ষিণ করিতেছে এবং প্রদক্ষিণ-কালই বা কত তাহাও নির্দ্ধারিত হইয়াছে।
মনে করা যাউক, অতি দূরে কোন যুগ্ম নক্ষত্র রহিয়াছে; এবং যেন খুব ভাল দূরবীণ্ দিয়াও ইহাদিগকে পৃথক বলিয়া জানা যাইতেছে না। এখন রশ্মি-নির্ব্বাচন যন্ত্র দ্বারা যদি ইহাদের বর্ণচ্ছত্র গ্রহণ করা যায়, তাহা হইলে দুইটির জন্য উপর্য্যুপরি দুইটি বর্ণচ্ছত্র প্রকাশ হইয়া পড়িবে। আমরা পূর্ব্বেই বলিয়াছি, এই শ্রেণীর নক্ষত্রগণের মধ্যে একটি অপরটির চারিদিকে ঘুরিয়া বেড়ায়। এখন যদি উদাহৃত নক্ষত্রযুগ্মের মধ্যে একটি আমাদিগের দিকে অগ্রসর হয় এবং অপরটি আমাদের নিকট হইতে দূরে যাইতে থাকে, তাহা হইলে যে কেবল আমরা দুইটি বর্ণচ্ছত্রই দেখিব তাহা নয়; প্রথমের বর্ণচ্ছত্র-রেখা সেই ডপ্লারের সিদ্ধান্ত অনুসারে বর্ণচ্ছত্রের বেগুনে রঙের দিকে বিচলিত হইবে এবং অপরটির রেখা লোহিতের দিকে যাইতে চাহিবে। এই প্রকারে কিছুক্ষণ বর্ণচ্ছত্রদ্বয় পরস্পর পৃথক হইয়া আবার ঠিক উপর্য্যুপরি আসিয়া দাঁড়াইবে এবং আবার পৃথক হইয়া পড়িবে। এই উপায়ে নক্ষত্রের যে কেবল যুগ্মতাই জানা যায়, তাহা নয়; বর্ণচ্ছত্রদ্বয় কত সময়ের পরে এক-একবার উপর্য্যুপরি আসিতেছে তাহা নির্ণয় করিয়া নক্ষত্রদের পরিভ্রমণ-কালও নির্ণয় করা যায়। এই পদ্ধতিতে আমাদের উত্তরাকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্র ব্রহ্মহৃদয়কে (Capella) যুগ্ম বলিয়া জানা গিয়াছে এবং ইহার প্রত্যেক নক্ষত্র অপরটিকে ১০৪ বৎসরে প্রদক্ষিণ করে বলিয়া স্থির হইয়াছে। আজকাল যুগ্ম নক্ষত্রের তালিকা এত দীর্ঘ হইয়া পড়িয়াছে যে, জ্যোতিষিগণ বলিতেছেন, আকাশের অধিকাংশ নক্ষত্রই যুগ্ম ও আমাদের সূর্য্যের ন্যায় একক নক্ষত্র অতি অল্পই দেখা যায়।
বিজ্ঞানজ্ঞ পাঠক অবশ্যই অবগত আছেন, আধুনিক জ্যোতিষিগণ সূর্য্যের বাষ্পাবরণটিতে স্থূলতঃ তিনটি স্তর দেখিতে পাইয়াছেন। সূর্য্যের মূল দেহটি কঠিন, কি তরল, কি বাষ্পাকারে আছে জানা যায় নাই। যদি বাষ্পাকারে থাকে, তাহা হইলে উহা যে অত্যন্ত চাপযুক্ত অবস্থায় আছে, আমরা বর্ণচ্ছত্র পরীক্ষায় তাহা বেশ বুঝিতে পারি। কঠিন, তরল বা চাপযুক্ত বাষ্পের বর্ণচ্ছত্র যেমন অখণ্ড হইয়া প্রকাশ পায়, সূর্য্যের মূলদেহের বর্ণচ্ছত্র ঠিক সেই প্রকার অখণ্ড আকারে দেখা দেয়। যাহা হউক সূর্য্যের যে তিনটি বাষ্পাবরণের কথা বলিতেছিলাম, তাহার প্রথমটিকে জ্যোতিষিগণ আলোকমণ্ডল (Photosphere) বলেন। সূর্য্যের এই যে দীপ্তি, তাহা আলোকমণ্ডল হইতে উৎপন্ন। মুলে এই মণ্ডল প্রজ্বলিত বাষ্প ব্যতীত আর কিছুই নয়। ইহারই পর সূর্য্যের বাষ্পাবরণের আর যে একটি স্তর আছে তাহাকে বর্ণমণ্ডল (Chromosphere) বলা হইয়া থাকে। পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণকালে যখন সৌরবিম্ব কৃষ্ণ চন্দ্র দ্বারা আচ্ছন্ন হইয়া পড়ে, তখন এই বর্ণমণ্ডল প্রত্যক্ষ দেখা যায়। রক্ত, গোলাপী প্রভৃতি নানা বর্ণে রঞ্জিত বাষ্পরাশি শিখাকারে উপরে উঠিয়া যে অত্যাশ্চর্য দৃশ্য দেখায়, তাহা প্রকৃতই দর্শনীয় ব্যাপার। ইহার পরই সূর্য্যের আকাশের যে তৃতীয় স্তরটি আছে, তাহ। জ্যোতিষিগণের নিকট ছটামুকুট (Corona) নামে প্রসিদ্ধ। দূরবীণ্ দিয়া এই স্তরের সন্ধান পাওয়া যায় না। পূর্ণ সূর্য্যগ্রহণকালেই এই স্তর পরীক্ষার উপযুক্ত সময়। গ্রহণকালে যখন চন্দ্রের কৃষ্ণ বিম্ব সূর্য্যের উজ্জল দেহ ও আলোকমণ্ডলকে আবৃত করিয়া ফেলে, তখন সূর্যের ঐ তৃতীয় স্তর ছটার মত সূর্য্যকে ঘিরিয়া আছে দেখা যায়। যাহা হউক, ডপ্লার সাহেবের সিদ্ধান্ত অনুসারে বর্ণচ্ছত্র পরীক্ষা করায় সূর্য্যের বর্ণমণ্ডল এবং এই মণ্ডল হইতে নির্গত বর্ণ-শিখার অনেক নবতথ্য সংগ্রহ করা যাইতেছে। এই প্রকার পরীক্ষায় কতকগুলি শিখাকে প্রায় ষাইট হাজার মাইল পর্য্যন্ত দীর্ঘ হইতে দেখা গিয়াছে এবং কতকগুলিকে প্রতি সেকেণ্ডে দুই শত হইতে তিন শত মাইল পর্য্যন্ত বেগে উপরে উঠিতে দেখা গিয়াছে। সূর্য্যের তৃতীয় বাষ্পাবরণ অর্থাৎ ছটামুকুট পরীক্ষাতেও আধুনিক জ্যোতিঃশাস্ত্র যথেষ্ট লাভবান হইয়াছে। এই অংশের বর্ণচ্ছত্রে এমন কতকগুলি বর্ণরেখা দেখা যায়, যাহা আমাদের পরিজ্ঞাত কোন পদার্থের বর্ণচ্ছত্রের সহিত মিলে না। বৈজ্ঞানিকগণ এই প্রকারে কোরোনিয়ম্ (Coronium) নামক একটি নূতন মূল পদার্থের আবিষ্কার করিয়াছেন। হেলিয়ম্ (Helium) ধাতুর আবিষ্কারের অনেক পূর্ব্বে সূর্য্যের বাষ্পাবরণে ইহার অস্তিত্ব ধরা পড়িয়াছিল। হেলিয়মের আবিষ্কারক সার উইলিয়ম র্যাম্জে (Ramsay) সাহেব এই প্রকারে প্রথমে এই জিনিষটার সন্ধান পাইয়াছিলেন।
বর্ণচ্ছত্র ও ডপ্লারের সিদ্ধান্তের সাহায্যে এতগুলি নূতন আবিষ্কার সুসম্পন্ন করিয়াও বৈজ্ঞানিকগণ ক্ষান্ত হন নাই; ইহা লইয়া আজও নানা পর্য্যবেক্ষণ ও অনুসন্ধান চলিতেছে।