ভূমি-কম্প

আমাদের পৃথিবীকে নানা দৈব উপদ্রব সহ্য করিয়া আসিতে হয়। অতি অল্পকাল মধ্যে সান্‌ফ্রান্‌সিস্‌কো, চিলি, কিংস্টন্ এবং সুমাত্রাদি স্থানে যে কয়েকটি ভয়াবহ ভূমিকম্পের কথা শুনা গিয়াছে, তাহাতে সত্যই স্তম্ভিত হইতে হয়। মনে হয়, যেন পৃথিবীর উপর দিয়া এক একটা খণ্ড প্রলয় চলিয়া গিয়াছে।

 ভূ-কম্পন পৃথিবীর চিরসঙ্গী। অতি প্রাচীনকালে যখন পৃথিবী অতান্ত উষ্ণাবস্থায় ছিল, বড় বড় ভূমিকম্প তখনকার একটা দৈনন্দিন ব্যাপারের মধ্যে পরিগণিত হইত। বড় বড় পাহাড় পর্ব্বত ও সাগর মহাসাগর সেই সকল উৎপাতেরই এক একটা মহাকীর্ত্তি বলিয়া অনুমিত হইয়া আসিতেছে। কিন্তু এখন পৃথিবীর আর সে অবস্থা নাই। প্রাচীনকালের অগ্নিময় পৃথিবী তাপ বিকিরণ করিতে করিতে এখন অগ্নিগর্ভ হইয়া পড়িয়াছে। ইহার জঠরাগ্নির পরিচয় আমরা কেবল আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত এবং মৃদু ভূ-কম্পনে দেখিয়া আসিতেছিলাম। কাজেই গত কয়েক বৎসরের বড় বড় ভূমিকম্পগুলি বৈজ্ঞানিকসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছে।

 ভূমিকম্পের উৎপত্তি প্রসঙ্গে এ পর্য্যন্ত অনেক বৈজ্ঞানিক অনেক কথা বলিয়াছেন। ইংলণ্ডের রয়্যাল সোসাইটির এক বিশেষ অধিবেশনে বর্ত্তমান কালের দৈব উপদ্রবগুলির আলোচনা কালে লর্ড কেল্‌ভিন (Lord Kelvin) এ সম্বন্ধে যে কতকগুলি নূতন কথা বলিয়াছিলেন, সে গুলি বড় সারগর্ভ। আমরা বর্ত্তমান প্রবন্ধে তাহারি আলোচনা করিব।

 লর্ড কেল্‌ভিনের কথাগুলি ভাল করিয়া বুঝিতে হইলে, এই জলস্থলময় পৃথিবীর গোড়ার খবর কিছু জানা আবশ্যক। প্রাচীন গ্রীক রোমান পণ্ডিতগণ এ সম্বন্ধে কি সিদ্ধান্ত করিয়াছিলেন, প্রথমে তাহাই দেখা যাউক। ইঁহাদের সকলেই প্রায় একবাক্যে বলিতেন, সৃষ্টির পূর্ব্বে আমাদের পৃথিবীর গঠনোপাদান অতি সূক্ষ্ম পরমাণুর আকারে মহাকাশের কোটি কোটি যোজন বিস্তৃত স্থান অধিকার করিয়া পরিব্যাপ্ত ছিল; এবং প্রত্যেক পরমাণু সমান্তরাল গতিতে (Parallel Motion) ছুটাছুটি করিত। কিন্তু এই সমান্তরাল গতিবিশিষ্ট পরমাণুগুলি যে কিপ্রকারে মিলিত হইয়া, এই পৃথিবীতে বিচিত্র পদার্থের উৎপত্তি করিয়াছে, পূর্ব্বোক্ত প্রাচীন পণ্ডিতগণ তাহার মীমাংসা করেন নাই। লর্ড কেল্‌ভিন্ বলিতেছেন, পৃথিবীর গঠনোপাদানগুলিকে সমান্তরালগতিবিশিষ্ট বলিয়া কল্পনা করিলে জগৎ-রচনার মূল প্রক্রিয়া বুঝা যায় না। সম্ভবতঃ মহাকাশে পরিব্যাপ্ত বিচ্ছিন্ন পরমাণুগুলির প্রত্যেকেরই প্রথমে এক একটি কেন্দ্রাভিমুখী গতি ছিল, এবং ইহা দ্বারাই নানা জাতীয় পরমাণু কাছাকাছি হইয়া ও জোট্ বাঁধিয়া নানাপদার্থের উৎপত্তি করিয়াছে।

 জোট্ বাঁধিতে আরম্ভ করিলেই, তদুৎপন্ন পদার্থের ঘনত্ব জল মৃত্তিকাদির অনুরূপ হয় নাই। লর্ড কেল্‌ভিন্ হিসাব করিয়া দেখাইয়াছেন, ঐ অবস্থায় পদার্থের গুরুত্ব সম্ভবতঃ জল অপেক্ষাও প্রায় দশ গুণ লঘু ছিল; এবং ইহার পর পরমাণুগুলি আরো কাছাকাছি হইয়া পড়িলে, আমাদের পরিচিত নানা যৌগিক পদার্থের উৎপত্তি হইয়াছিল।

 বহুযোজনস্থানব্যাপ্ত পরমাণুগুলির প্রত্যেকেই এক কেন্দ্রের দিকে চালিত হইলে, দূরাগত অণুর ধাক্কায় কেন্দ্রে সঞ্চিত অণুগুলির উপর একটা প্রবল চাপ পড়িবার কথা। লর্ড কেল্‌ভিন্ এই চাপের পরিমাণ তাঁহার হিসাবে দেখাইয়াছেন। চলিষ্ণু পদার্থ কোন স্থানে আসিয়া প্রবলবেগে ধাক্কা দিলে, প্রথমে আহত স্থান একটি প্রবল চাপ পায়, কিন্তু পর মুহূর্ত্তে পদার্থটি প্রতিহত হইয়া বিপরীত দিকে চলিতে আরম্ভ করিলে, তখন আহত স্থানে আর কোন চাপই থাকে না। লর্ড কেল্‌ভিন্ বলিতেছেন, কেন্দ্রাভিমুখী পরমাণুগুলির ঘাত-প্রতিঘাতে, কেন্দ্রের নিকটবর্ত্তী স্থানের চাপ কিছুকাল ধরিয়া ঠিক্ পূর্ব্বোক্ত প্রকারে তালে তালে বাড়িয়া কমিয়া চলিয়াছিল। পৃথিবীর অভ্যন্তরের এই চঞ্চলতা কত দিন ছিল ঠিক্ বলা যায় না। সম্ভবতঃ পুরমাণুগুলি কালক্রমে অণুতে পরিণত হইয়া পড়িলে পৃথিবীর ঐ অস্থিরতার অবসান হইয়াছিল। লর্ড কেল্‌ভিন্ বলেন, এই অবস্থায় পৃথিবী তরল পদার্থময় ছিল, এবং এইখানেই সৃষ্টির আরম্ভ। পৃথিবী সেই সময় সূর্য্যের ন্যায় উজ্জল ছিল, এবং তাপ বিকিরণ করিতে করিতে ইহার বহুকাল পরে ভূপৃষ্ঠের উপরটা এক কঠিন আবরণে আবৃত হইয়া পড়িয়াছিল।

 কোন জিনিষকে সঙ্কুচিত করিলে, তাহা দ্বারা জিনিষটিতে তাপের উৎপত্তি হয়। এজন্য পৃথিবীর উপরিভাগ কঠিন আবরণে আচ্ছন্ন হওয়া সত্ত্বেও, তাহার ভিতরের তাপ সহসা কমে নাই। সঙ্কুচনের প্রভাবে ভিতরের উষ্ণতা বরং বহুকাল ধরিয়া বাড়িয়াই চলিয়াছিল; এবং পরে তাপের মাত্রা চরম হইয়া দাঁড়াইলে, উপরের সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর ভিতরটাও শীতল হইতে আরম্ভ করিয়াছিল।

 তরল পদার্থের উপরের অংশ জমাট বাঁধিয়া ঘনতর ও ভারি হইয়া পড়িলে, উপরকার ভারি জিনিষগুলি ভাঙ্গিয়া চুরিয়া নীচে নামিয়া পড়ে। কেল্‌ভিন্ অনুমান করিতেছেন, পৃথিবীর কঠিন আবরণের ঐ প্রকার ভাঙ্গাচোরা এককালে পৃথিবীতে বহুদিন ধরিয়া চলিয়াছিল, এবং ইহাতে পৃষ্ঠদেশ হইতে আগত বৃহৎ বৃহৎ কঠিন স্তূপগুলি ভিতরকার উত্তপ্ত তরল পদার্থে সঞ্চিত হইতে আরম্ভ করিয়াছিল। লর্ড কেল্‌ভিন এই সকল অনুমানের উপর নির্ভর করিয়া বলিতেছেন, বর্ত্তমান কালে ভূগর্ভ কখনই নিছক্ তরল পদার্থময় নয়। উপরকার গুরুভারবিশিষ্ট কঠিন আবরণ গুলি ভাঙ্গিয়া চুরিয়া তাহাতে নিমজ্জিত থাকায় এখন ভূগর্ভ কঠিন ও তরল উভয় পদার্থময় হইয়া দাঁড়াইয়াছে।


 ভূপৃষ্ঠের জমাট অংশের পূর্ব্বোক্ত প্রকার ভাঙ্গাচোরাকে লর্ড কেল্‌ভিন্‌ আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুদগমন ও ভূ-কম্পনের কারণ বলিয়া প্রচার করিয়াছেন। ইনি বলিয়াছেন, কালক্রমে পৃথিবীর কঠিন আবরণটি খুব গভীর হইয়া পড়িয়াছে বটে, কিন্তু তাহার ভাঙ্গাচোরার কাজ এখনো পূর্ব্বের ন্যায়ই চলিতেছে। কাজেই ভূপৃষ্ঠের গভীর অংশের মাটিপাথর যখন ভাঙ্গিয়া ভূগর্ভস্থ দ্রবপদার্থে ডুবিতে আরম্ভ করে, তখন সেই দ্রবপদার্থ উছলিয়া বহির্গত হইবার জন্য ছিদ্র অন্বেষণ করে। আগ্নেয়গিরির গহ্বরগুলি ভূগর্ভের খুব গভীর অংশ পর্য্যন্ত বিস্তৃত থাকে। কাজেই ঐ সকল ছিদ্রপথে সেই উচ্ছ্বলিত গলিত ধাতু যে, বাহির হইয়া ভূপৃষ্ঠকে প্লাবিত করিবে তাহাতে আশ্চর্য্য কি? ইহাই আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুদ্গম। লর্ড কেল্‌ভিন্ ভূ-কম্পনকেও ঐ আভ্যন্তরীণ আন্দোলনের কার্য্য বলিয়া স্থির করিয়াছেন। কারণ ভূপৃষ্ঠের গভীর স্থানের মৃত্তিকাপ্রস্তরাদি যখন ভাঙ্গিয়া চুরিয়া ভূগর্ভে পতিত হইতে আরম্ভ করে, তখন সেই আন্দোলনে পৃথিবী কম্পিত না হইয়া থাকিতে পারে না।

 পৃথিবী কালক্রমে শীতল হইয়া পড়িতেছে, কাজেই উহার ভিতরকার দ্রবপদার্থ যে, শীতল হইয়া এককালে কঠিন হইয়া পড়িবে, তাহা নিশ্চয়। এখন প্রশ্ন হইতে পারে, দূরভবিষ্যতে পৃথিবীর সমস্তটা জমাট বাঁধিয়া গেলে, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত ও ভূ-কম্পন কি বন্ধ হইয়া যাইবে?

 লর্ড কেল্‌ভিন্ এ প্রশ্নের মীমাংসা করিয়াছেন। তাঁহার মতে ভবিষ্যতে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুদ্গিরণ নিশ্চয়ই লোপ পাইবে। অতি প্রাচীনকালে ভূপৃষ্ঠে অনেক বড় বড় আগ্নেয়গিরির অস্তিত্ব ছিল, কিন্তু পৃথিবী শীতল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেগুলিতে আর বড় অগ্নির চিহ্ন দেখা যায় না। সুতরাং বিসুভিয়স্ প্রভৃতি যে কয়েকটি সজীব আগ্নেয়গিরি আছে, তাহারাও যে কালক্রমে নির্ব্বাপিত হইয়া যাইবে, তাহা আমরা বেশ অনুমান করিতে পারি। ভূমিকম্পের লোপ-সম্বন্ধে কিন্তু লর্ড কেল্‌ভিন বিশেষ আশ্বাস প্রদান করিতেছেন না। এ সম্বন্ধে তাঁহার মত এই যে, ভূগর্ভস্থ সমগ্র গলিত পদার্থ শীতল হইয়া জমাট বাঁধিয়া গেলেও, ভূগর্ভের আকুঞ্চন রোধ পাইবে না। তখন পৃথিবীর ভিতরে বৃহৎ বৃহৎ গহ্বরের সৃষ্টি হইতে থাকিবে এবং সময়ে সময়ে উপরকার মাটি পাথর ভাঙ্গিয়া পড়িয়া সেই সকল গহ্বর পূর্ণ করিতে থাকিবে। কাজেই এই প্রকার ভাঙ্গাচোরার দ্বারা পৃথিবীতে ভূমিকম্প পূর্ণমাত্রাতেই চলিতে থাকিবে।

 ভূপৃষ্ঠের মাটি ভাঙ্গিয়া পড়িয়া ভূগর্ভস্থ গহ্বর পূর্ণ করিতে থাকিলে যে ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়, কয়েকটি আধুনিক ভূমিকম্পের কার্য্য আলোচনা করিলে, আমরা তাহা বেশ বুঝিতে পারি। সুমাত্রা দ্বীপে যে বৃহৎ ভূমিকম্প হইয়া গিয়াছে, তাহাতে ভূপৃষ্ঠ অনেকটা নীচু হইয়া একটি শহরের কতক অংশকে প্রায় সমুদ্রতলশায়ী করিয়াছে। গত ১৮৯৭ সালের বাঙ্গালা দেশের বৃহৎ ভূমিকম্পের কথা পাঠকের অবশ্যই স্মরণ আছে। ইহাতেও উত্তর বঙ্গের অনেক স্থানকে উঁচুনীচু হইতে দেখা গিয়াছে। সম্প্রতি জাপানে যে এক ভূমিকম্প হইয়াছে, তাহাতে তথাকার একটি স্থান প্রায় ২০ ফুট নীচু হইয়া গিয়াছে। সুতরাং ভূমিকম্পের উৎপত্তি সম্বন্ধে লর্ড কেল্‌ভিনের বর্ত্তমান সিদ্ধান্তটি যে অভ্রান্ত তাহাতে সন্দেহ নাই।