পরশ-পাথর

রসায়ন শাস্ত্রের ইতিহাস অনুসন্ধান করিলে দেখা যায়, এক সময়ে এক দল লোক পরশ-পাথয়ের খোঁজে ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছিলেন। তখন আধুনিক রসায়নী বিদ্যার ভিত্তিও প্রোথিত হয় নাই। এই সম্প্রদায়ের বিশ্বাস ছিল, পৃথিবীতে নিশ্চয়ই এমন একটা বস্তুর অস্তিত্ব আছে, যাহার স্পর্শে লৌহ প্রভৃতি ইতর ধাতুকে সুবর্ণে পরিণত করিতে পারা যায়। কোথা হইতে এই বিশ্বাস তাঁহারা পাইয়াছিলেন, তাহার খোঁজ পাওয়া যায় না। তাঁহারা আধুনিক বৈজ্ঞানিকদিগের ন্যায় বৈদ্যুতিক চুল্লী, বুনসেনের শিখা, তাপমান বা বায়ুমান যন্ত্র কিছুই ব্যবহার করিতেন না,—নানা প্রকার গাছের শিকড়ের রস, তন্ত্রমন্ত্র, জপ হোম প্রভৃতি উপকরণ লইয়া লৌহকে সুবর্ণে পরিণত করিবার জন্য সাধনা করিতেন। শুনা যায়, এই সাধনায় নাকি তাঁহার সিদ্ধিলাভও করিয়াছিলেন। এই বৈজ্ঞানিকদের অস্তিত্ব আর নাই, তাঁহাদের পুঁথিপত্রও লোপ পাইয়াছে, সুতরাং কোন্ সূত্র ধরিয়া তাঁহারা পরশ-পাথরের আবিষ্কারে নিযুক্ত হইয়াছিলেন, তাহা এখন জানিবার উপায় নাই। আছে কেবল তাঁহাদের নাম—আল্‌কেমিষ্ট্।

 আধুনিক বৈজ্ঞানিকগণ এই আল্‌কেমিষ্টদের অদ্ভুত খেয়াল ব্য পাগলামির কথা স্মরণ করিয়া যে কত বিদ্রূপ করিয়াছেন তাহার ইয়ত্তাই হয় না। কিন্তু গত দশ বৎসরে রসায়ন শাস্ত্রে যে সকল অদ্ভুত আবিষ্কার হইয়াছে, তাহাতে সেই বিদ্রূপকারিগণই বুঝিতেছেন, আল্‌কেমিষ্টরা পাগল ছিলেন না, তাঁহাদেরও সাধনা ছিল এবং তাহার ফলে তাঁহাদের সত্যদর্শন ঘটিয়াছিল। ইংলণ্ডের প্রধান রসায়নবিদ র‍্যাম্‌জে (Sir William Ramsay) সাহেব আজকাল মুক্তকণ্ঠে বলিতে আরম্ভ করিয়াছেন, লৌহকে সুবর্ণে এবং রাঙ্‌কে রৌপ্যে পরিণত করা অসাধ্যসাধন নয়। সুতরাং বহু শতাব্দী পূর্ব্বে সেই আল্‌কেমিষ্টের দল যে পরশ-পাথরের সন্ধানে ছুটিয়াছিলেন, আধুনিক বৈজ্ঞানিকগণকেও তাহারি অনুসন্ধানে ছুটিতে হইতেছে।

 র‍্যাম্‌জে সাহেবের আবিষ্কারের কথা বুঝিতে হইলে একটু ভূমিকার প্রয়োজন হইবে। সৃষ্টিতত্ত্বের কথা উঠিলেই অতি প্রাচীন পণ্ডিতগণ পঞ্চভূতের অবতারণা করিতেন। তাঁহাদের বিশ্বাস ছিল, ক্ষিতি অপ্ তেজঃ প্রভৃতি পঞ্চ পদার্থ দিয়াই এই ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি এবং এই পাঁচটি পদার্থের প্রত্যেকটিই মূলপদার্থ অর্থাৎ তাহাদের আর রূপান্তর নাই। এই যে বৃক্ষলতা, পশুপক্ষী, ঘরদুয়ার, সকলি সেই পঞ্চভূতের বিচিত্র মিলনে উৎপন্ন; এগুলি যখন নষ্ট হইয়া যায় তখন আবার সেই পঞ্চভূতের আকার গ্রহণ করে। প্রাচীনদের এই সিদ্ধান্ত আধুনিক বৈজ্ঞানিকদের হাতে পড়িয়া স্থির থাকিতে পারে নাই। গত উনবিংশ শতাব্দীতে সুপ্রসিদ্ধ বৈজ্ঞানিক ডাল্‌টন সাহেব প্রত্যক্ষ দেখাইয়াছিলেন, ক্ষিতি অপ্ প্রভৃতির কোনটিই মূলপদার্থ নয়। ইহাদের প্রত্যেকটিকেই বিশ্লেষ করা যায় এবং ইহাতে তাহাদের মধ্যে একাধিক অপর বস্তুর মিশ্রণ দৃষ্ট হয়। ডাল্‌টন্ সাহেব প্রচার করিলেন, এই ব্রহ্মাণ্ড পঞ্চভূতে সৃষ্ট নয়; হাইড্রোজেন অক্সিজেন প্রভৃতি বায়ব পদার্থ, গন্ধক অঙ্গার প্রভৃতি কঠিন পদার্থ এবং স্বর্ণ রৌপ্য প্রভৃতি ধাতব পদার্থ দিয়া এই জগতের সৃষ্টি। তিনি প্রত্যক্ষ দেখাইতে লাগিলেন, বায়ু জল প্রভৃতি ভূতপদার্থ, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন্ ও হাইড্রোজেন্ দিয়াই গঠিত। কাজেই প্রাচীন যুগের পঞ্চভূতের স্থানে বহু ভূতকে বসাইতে হইল; বৈজ্ঞানিকগণ স্বীকার করিয়া লইলেন, হাইড্রোজেন অক্সিজেন গন্ধক স্বর্ণ রৌপ্য প্রভৃতি প্রায় নব্বইটি বস্তু দিয়াই এই বিশ্বের সৃষ্টি এবং এগুলিই প্রকৃত মূলপদার্থ। ইহাদের ধ্বংস বা রূপান্তর নাই।

 ডাল্‌টন সাহেবের এই সিদ্ধান্তটি দীর্ঘকাল ধরিয়া বৈজ্ঞানিক মহলে আদৃত হইয়া আসিতেছিল; কোন কালে যে ইহার অসত্যতা প্রতিপন্ন হইবে এ কথা কেহ কখন কল্পনাও করিতে পারেন নাই। কিন্তু এই সুপ্রতিষ্ঠিত সিদ্ধান্তের মূলেও কুঠারাঘাত হইল। ফ্রান্সের বিখ্যাত রসায়নবিদ্ ক্যুরি সাহেব ও তাঁহার সহধর্ম্মিণী রেডিয়ম্ নামক এক ধাতু পরীক্ষা করিয়া দেখিলেন, ইহা আপনা হইতেই বিশ্লিষ্ট হইয়া পরমাণু অপেক্ষাও অতি সূক্ষ্ম কণায় বিভক্ত হইয়া পড়িতেছে। রেডিয়ম ধাতুটি মূলপদার্থ বলিয়াই জানা ছিল, কাজেই একটা মূল বস্তুকে ঐপ্রকারে বিশ্লিষ্ট হইতে দেখিয়া সমগ্র জগতের বৈজ্ঞানিকগণ অবাক্ হইয়া গেলেন। ক্যুরি সাহেব এক রেডিয়মেরই বিশ্লেষ দেখাইয়া ক্ষান্ত হইলেন না, থোরিয়ম্, ইউরেনিয়ম্ প্রভৃতি বহু ধাতব মূলপদার্থের ঐ প্রকার বিশ্লেষ দেখাইতে লাগিলেন এবং এগুলি বিশ্লিষ্ট হইয়া যে, একই অতি সূক্ষ্ম পদার্থে পরিণত হয় তাহাও সকলে দেখিলেন। পরমাণুর এই সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ভগ্নাংশগুলির নাম দেওয়া হইল ইলেক্ট্রন বা অতি-পরমাণু।

 ক্যুরি সাহেবের পূর্ব্বোক্ত আবিষ্কার অতি অল্প দিনই হইল প্রচারিত হইয়াছে। ইহার সংবাদ কর্ণগোচর হইবামাত্র রদারফোর্ড, সডি, টম্‌সন প্রমুখ বর্ত্তমান যুগের প্রধান বৈজ্ঞানিকগণ প্রত্যেকে স্বাধীনভাবে বিষয়টি লইয়া গবেষণা আরম্ভ করিয়াছিলেন; আজও এই সকল গবেষণায় বিরাম নাই; ইহার ফলে আজকাল বিজ্ঞানের নূতন তত্ত্ব নিত্যই আবিষ্কৃত হইতেছে। ইঁহারা দেখিতে পাইলেন, রেডিয়ম ধাতু বিশ্লিষ্ট হইলে কেবলি ইলেক্ট্রন অর্থাৎ অতি-পরমাণুতে পরিণত হয় না, সঙ্গে সঙ্গে উহা নাইটন্ (Niton) নামক আর এক নূতন ধাতুতেও রূপান্তরিত হয় এবং এই নাইটন্ জিনিষটা জন্মগ্রহণ করিয়াই আবার হেলিয়ম্ এবং রেডিয়ম্ জাতীয় আর একটি বস্তুতে (Radium-A) রূপান্তর গ্রহণ করে। কাজেই যে-সকল ধাতু এ পর্য্যন্ত মূলপদার্থ বলিয়া স্বীকৃত হইয়া আসিতেছিল, তাহাদিগকেই বিশ্লিষ্ট ও রূপান্তরিত হইতে দেখিয়া ইঁহাদের আর বিস্ময়ের সীমা রহিল না।

 এই সকল আবিষ্কারে ডাল্‌টন সাহেবের পারমাণবিক সিদ্ধান্ত (Atomic Theory) আর অটল থাকিতে পারিল না। বৈজ্ঞানিকগণ বুঝিতে লাগিলেন, হাইড্রোজেন্, অক্সিজেন্ প্রভৃতি নব্বুইটি ধাতু ও অধাতু মূলপদার্থ জগতে নাই; মূলপদার্থ জগতে একটি মাত্রই আছে এবং তাহাই ঐ ইলেক্ট্রন বা অতি-পরমাণু। এগুলিই অল্প বা অধিক সংখ্যায় জোট বাঁধিয়া আমাদের সুপরিচিত অক্সিজেন, হাইড্রোজেন, স্বর্ণ, লৌহ প্রভৃতির উৎপত্তি করে। ইঁহারা আরও অনুমান করিলেন, এই ব্রহ্মাণ্ডে কেবল যে, রেডিয়ম্ বা সেই জাতীয় বস্তুই রূপান্তর গ্রহন করিয়া অতি-পরমাণুতে পরিবর্ত্তিত হইতেছে তাহা নহে, জগতের সকল বস্তুই ধীরে ধীরে ক্ষয় পাইয়া অতি-পরমাণুতে পরিণত হইতেছে এবং অতি-পরমাণু জোট বাঁধিয়া আবার নূতন বস্তুর সৃষ্টি করিতেছে। ইঁহারা কল্পনার চক্ষে দেখিতে লাগিলেন, এই প্রকার এক বিশ্বব্যাপী ভাঙাগড়া লইয়াই এই জগৎ। এই ভাঙাগড়ার আদিও নাই অন্তও নাই।

 যখন সমগ্র জগৎ পূর্ব্বোক্ত নবাবিষ্কারে এবং নবভাবে আবিষ্ট, তখন ইংলণ্ডের প্রধান রসায়নবিৎ সার উইলিয়ম্ র‍্যাম্‌জে ঐ রেডিয়ম্ লইয়াই নীরবে গবেষণা করিতেছিলেন। ইনি দেখিলেন, এই যে রেডিয়ম রূপান্তরিত হইয়া নাইটনে পরিণত হইল এবং নাইটন্ বহু তাপ ত্যাগ
অধ্যাপক ক্যুরি ও সার উইলিয়ম্ র‍্যামজে
করিয়া হেলিয়ম্ হইয়া দাঁড়াইল, এই সমস্ত ভোজবাজি শক্তিরই লীলা। হিসাব করিয়া দেখিলেন, এক ঘন সেণ্টিমিটার (One Cubie Centimeter) স্থানে আবদ্ধ নাইটন্‌ বিশ্লিষ্ট হইয়া হেলিয়ম্ ইত্যাদিতে পরিণত হইলে, সেই আয়তনের চল্লিশ লক্ষ গুণ হাইড্রোজেন্‌কে পোড়াইলে যে তাপ উৎপন্ন হয়, সেই প্রকার তাপ আপনা হইতেই জন্মে। তিনি সুস্পষ্ট বুঝিতে পারিলেন, এই বিপুল শক্তিরাশি খুব নিবিড়ভাবে রেডিয়মেই লুক্কায়িত থাকে এবং রেডিয়ম্ নিজেকে ক্ষয় করিয়া যখন লঘুতর পদার্থে পরিণত হয়, তখন ঐ শক্তিই তাপের প্রকাশ করে। র‍্যাম্‌জে সাহেবের বিশ্বাস হইল, ব্রহ্মাণ্ডের সকল বস্তুতেই এই প্রকার বিশাল শক্তিস্তূপ সঞ্চিত আছে, এবং সেই সুরক্ষিত শক্তিভাণ্ডারের দ্বার খুলিয়া প্রকৃতিদেবী জগতে ভাঙাগড়ার ভেল্কি দেখান। রেডিয়মের ন্যায় গুরু ধাতু যখন তাহার অন্তর্নিহিত শক্তি ত্যাগ করিয়া নাইটন ও হেলিয়ম্ প্রভৃতি লঘুতর বস্তুতে পরিণত হইতেছে, তখন লঘু পদার্থের উপরে প্রচুর শক্তি প্রয়োগ করিয়া কেন তাহাকে গুরুতর পদার্থে পরিণত করা যাইবে না; —এই প্রশ্নটি র‍্যাম্‌জে সাহেবের মনে উদিত হইল। এই রাসায়নিক প্রক্রিয়াটি আবিষ্কার করিতে পারিলে লৌহকে স্বর্ণে পরিবর্তিত করা কঠিন হইবে না, ইহা সকলেই বুঝিতে লাগিলেন।

 প্রাকৃতিক কার্য্যের প্রণালী আবিষ্কার করা কঠিন নয়, কিন্তু যে-সকল উপকরণ সংগ্রহ করিয়া এবং যে অপরিমিত শক্তি প্রয়োগ করিয়া প্রকৃতি জগতের কার্য্য চালাইয়া থাকেন, তাহার অনুকরণ করা মানব-বিশ্বকর্ম্মার সাধ্যাতীত। র‍্যাম্‌জে সাহেব ইহা জানিয়াও কোন কৃত্রিম উপায়ে শক্তি প্রয়োগ করিয়া লঘু পদার্থকে স্বতন্ত্র গুরু পদার্থে পরিণত করিবার জন্য পরীক্ষা করিতে লাগিলেন। কিন্তু সে উপায় ধরা দিল না এবং রেডিয়ম্ বিযুক্ত হইবার সময়ে যে বিপুল শক্তি দেহ হইতে নির্গত করে সে প্রকার শক্তিরও তিনি সন্ধান করিতে পারিলেন না। এই সময়ে আর একটি কথা র‍্যাম্‌জে সাহেবের মনে হইল; তিনি ভাবিতে লাগিলেন, নাইটন্ বিযুক্ত হইবার সময়ে স্বভাবতঃ যে বিপুল শক্তিরাশি দেহচ্যুত করে, তাহা যদি কোন উপায়ে অপর লঘু পদার্থের উপরে প্রয়োগ করা যায়, তাহা হইলে হয় তো সেই লঘু বস্তু কোন গুরু পদার্থে পরিণত হইতে পারিবে। এই প্রকার চিন্তা করিয়াই তিনি ক্ষান্ত হইলেন না। সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষা ও আরম্ভ হইল। প্রথমে কয়েক বিন্দু বিশুদ্ধ জলে নাইটন্ নিক্ষেপ করিয়া তিনি জলের হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের কোন পরিবর্ত্তন হয় কিনা দেখিতে লাগিলেন। জল যথারীতি বিশ্লিষ্ট হইয়া হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন উৎপন্ন করিতে লাগিল, এবং নাইটন্ হইতে হেলিয়ম্ জন্মিতে লাগিল। পাত্র হইতে এই সকল বাষ্প স্থানান্তরিত করিয়া তাহাতে আর কোনও নুতন পদার্থ উৎপন্ন হইয়াছে কিনা, র‍্যাম্‌জে সাহেব তাহার অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন। শেষে দেখা গেল, ঐ সকল বাষ্প ব্যতীত নিয়ন (Neon) নামক একটি মূলপদার্থের উৎপত্তি হইয়াছে। র‍্যাম্‌জে সাহেবের বিস্ময়ের এবং আনন্দের আর সীমা রহিল না। জলের হাইড্রোজেন বা নাইট্রোজেনকে যখন গুরুভারবিশিষ্ট নিয়নে পরিণত করা গেল, তখন অদূর ভবিষ্যতে এক দিন ঐ প্রকার উপায়ে লৌহকে স্বর্ণে পরিণত করাও সম্ভবপর হইবে বলিয়া তাঁহার দৃঢ় বিশ্বাস হইল।

 র‍্যাম্‌জে সাহেবের এই অত্যাশ্চর্য আবিষ্কার-সমাচার অল্প দিন হইল প্রকাশিত হইয়াছে এবং ইহা বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়ে যে আন্দোলন ও বাগ্‌বিতণ্ডার সৃষ্টি করিয়াছে, বোধ হয় আধুনিক যুগের কোন আবিষ্কার তদ্রূপ বিস্ময় ও আন্দোলন সৃষ্টি করে নাই। আজকাল বৈজ্ঞানিক সাময়িক পত্র ও সভাসমিতিতে এই বিষয়
সার জে. জে. টমসন
লইয়াই তর্কবিতর্ক চলিতেছে; জগতের প্রধান প্রধান বিজ্ঞানরথিগণ এই আন্দোলনে যোগ দিয়াছেন। সকলেই যে, র‍্যাম্‌জে সাহেবের আবিষ্কারের অভ্রান্ততা স্বীকার করিতেছেন তাহা বলা যায় না। বেকেরেল্ সাহেব, যিনি সর্ব্বপ্রথমে রেডিয়ম্ জাতীয় পদার্থের গুন লক্ষ্য করিয়াছিলেন, তিনি এখন আর ইহজগতে নাই। ক্যুরি সাহেবেরও মৃত্যু হইয়াছে। মাডাম্ ক্যুরি, রদারফোর্ড, টমসন ও সডি সাহেবই এখন এই আবিষ্কারে মতামত প্রকাশের অধিকারী। রদারফোর্ড সাহেব র‍্যাম্‌জের আবিষ্কার-কাহিনী শুনিয়া বলিয়াছিলেন সম্ভবতঃ পরীক্ষাকালে কোনক্রমে জলের পাত্রে বাতাস প্রবেশ করিয়াছিল; বাতাসের নিয়ন্‌কে র‍্যাম্‌জে সাহেব সদ্য উৎপন্ন নিয়ন মনে করিয়া ভুল করিতেছেন। মাডাম্ ক্যুরিও এই আবিষ্কারে অবিশ্বাস প্রকাশ করিতেছেন। কিন্তু পূর্ব্ববর্ণিত পরীক্ষার পর র‍্যাম্‌জে সাহেব নানা পদার্থের যে-সকল রূপান্তর প্রত্যক্ষ দেখাইয়াছেন, তাহাতে এই সকল বৈজ্ঞানিকদিগের সন্দেহ ক্রমে দূরীভূত হইতেছে বলিয়া মনে হয়।

 সম্প্রতি এক পরীক্ষায় র‍্যাম্‌জে সাহেব তাম্র, নাইট্রোজেন্ ও অক্সিজেন্ মিশ্রিত এক যৌগিক পদার্থে (Copper Nitrate) সেই নাইটন্ নিক্ষেপ করিয়াছিলেন। উক্ত যৌগিক পদার্থটি পরিবর্ত্তিত হইয়া আর্গন (Argon) নামক এক মূলপদার্থ উৎপন্ন করিয়াছিল। এতদ্ব্যতীত সিলিকন্, টিটানিয়ম্, থোরিয়ম্ প্রভৃতি ঘটিত অনেক যৌগিক পদার্থের উপরেও এই পরীক্ষা করা হইয়াছে, এবং এই শেষোক্ত প্রত্যেক পদার্থের রূপান্তরে অঙ্গারের (Carbon) জন্ম হইয়াছে। বিস্‌মথ্‌ ঘটিত এক পদার্থের (Bismmuth Perchloride) রূপান্তরে সেদিন অঙ্গারক বাষ্পের উৎপত্তিও দেখা গিয়াছে।

 র‍্যাম্‌জে সাহেবের এই সকল পরীক্ষার কোনটিই গোপনে করা হয় নাই। তিনি বহু বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিকে আহ্বান করিয়া এই সকল পরীক্ষা দেখাইয়াছেন, এবং কোন কোনটি ইংলণ্ডের কেমিক্যাল সোসাইটির প্রকাশ্য সভার সম্মুখে করা হইয়াছে। সুতরাং এগুলির সত্যতাসম্বন্ধে সন্দেহ করিবার আর কারণ নাই। জগতের লোকে এখন বুঝিবেন, প্রকৃতির এই যে বিচিত্র লীলা তাহা নব্বইটি মূলপদার্থ অবলম্বন করিয়া চলিতেছে না,—সকল পরিবর্ত্তনের গোড়ায় একই বর্ত্তমান। স্বর্ণ, রৌপ্য, হীরক, লৌহ, তাম্র সকল একেরই বিচিত্র রূপ। আল্‌কেমিষ্টরা লৌহকে সুবর্ণে পরিণত করিবার জন্য যে সাধনা আরম্ভ করিয়াছিলেন, তাহা দুঃস্বপ্ন দেখিয়া করেন নাই। লৌহকে সুবর্ণ করিবার জন্য পরশ পাথর এই ভূমণ্ডলে এবং এই প্রকৃতির মধ্যেই আছে।