প্রাকৃতিকী/রসায়নীবিদ্যার উন্নতি

রসায়নীবিদ্যার উন্নতি

গত কয়েক বৎসরে জড়বিজ্ঞানের নানা বিভাগে যে উন্নতি হইয়াছে, তাহা দেখিলে অবাক্ হইতে হয়। এই দ্রুত উন্নতিতে পুরাতন সিন্ধান্ত গুলি নূতন মূর্ত্তি গ্রহণ করিয়া এমন হইয়া দাঁড়াইয়াছে যে, এখন দেখিলে তাহাদিগকে চিনিয়া লওয়া কঠিন হয়। কয়েক বৎসর পূর্ব্বে হেলম্‌হোজ্, হার্জ ও কেভিন প্রমুখ বৈজ্ঞানিকগণ যে সকল সিন্ধান্তকে অভ্রান্ত বলিয়া গিয়াছেন, এখনকার নূতন আবিষ্কারে তাহাদেরও পুনর্গঠনের প্রয়োজন দেখা দিয়াছে। শারীরবিদ্যা, জীবাণুতত্ত্ব ও চিকিৎসা বিজ্ঞানও উন্নতির পথে দ্রুত ধাবমান হইয়াছে। ভূতত্ত্ব, জ্যোতির্ব্বিদ্যা ও মানবতত্ত্বের ন্যায় প্রাচীন শাস্ত্রও তাদের পুরাতন মুর্ত্তিগুলিকে অক্ষুণ্ণ রাখিতে পারে নাই, কীটদষ্ট, প্রাচীন পুঁথির জীর্ণ পাতা ত্যাগ করিয়া তাহাদিগকেও নবীন রূপ গ্রহণ করিতে হইয়াছে। ডারুইনের অভিব্যক্তিবাদ বহু পূর্ব্বে প্রচারিত হইলেও, যাঁহারা ইহার সুপ্রতিষ্ঠার সহায় ছিলেন, তাঁহাদের মধ্যে দুই একজন এখনো জীবিত আছেন। বৃদ্ধ ওয়ালেস্[] এখনো অভিব্যক্তিবাদ প্রসঙ্গে পুস্তকাদি লিখিতেছেন। কিন্তু সম্প্রতি জীবতত্ত্ব সম্বন্ধে যে সকল নূতন তথ্য সংগ্রহ করা হইয়াছে, তাহাতে অভিব্যক্তিবাদেরও সংস্কারের প্রয়োজন দেখা যাইতেছে।

 গত দশ বৎসরের মধ্যে রসায়নী-বিদ্যায় যে সকল উন্নতি ও পরিবর্ত্তনের লক্ষণ প্রকাশ পাইয়াছে, তাহার আলোচনা করিতে গেলে, রেডিয়ম্ (Radium) ধাতুর আবিষ্কারের কথা মনে পড়িয়া যায়। এই

অদ্ভুত জিনিষটি হইতে অবিরাম কয়েক জাতীয় তেজোরশ্মি ও তাপ নির্গত হয়। এগুলির মধ্যে একটিকে অতিসূক্ষ্ম জড়-কণিকা বা শক্তি কণিকা বলিয়া স্থির করা হইতেছে। ডাল্‌টন্‌ তাম্রলৌহাদি ধাতু এবং হাইড্রোজেন অক্সিজেন্‌, গন্ধক প্রভৃতি অধাতুকে যে, মূলপদার্থ বলিয়া প্রচার করিয়াছিলেন, রেডিয়ম্ ও অপর ধাতু হইতে অতিসূক্ষ্ণ অণুর নির্গমন দেখিয়া তাহা স্বীকার করিতে অনেকে সঙ্কোচ বোধ করিতেছেন। এই অণুগুলি হাইড্রোজেনের ন্যায় লঘু বস্তুর পরমাণু অপেক্ষাও অনেক ক্ষুদ্র; প্রায় হাজারটি কণিকা একত্র না হইলে, তাহারা গুরুত্বে বা আকারে এক পরমাণু প্রমাণ হাইড্রোজেনের সমান হয় না।

 ডাল্‌টনের নিয়মে পরমাণুকে বিভাগ করা যায় না। রেডিয়ম্ জিনিষটা হাইড্রোজেন্‌, নাইট্রোজেন্‌ বা স্বর্ণ-রৌপ্যের ন্যায় একটা মূলপদার্থ, সুতরাং ইহার পরমাণু অবিভাজ্য হইবারই কথা। কিন্তু অবিভাজ্য পরমাণুগুলিকেই এখন বিভক্ত হইতে দেখিয়া প্রচলিত রাসায়নিক সিদ্ধান্তে বৈজ্ঞানিকদিগের বিশ্বাস শিথিল হইয়া আসিতেছে। কেবল রেডিয়মের পরমাণুই এই প্রকারে বিভক্ত হয় না, ইউরেনিয়ম্ (Uraninm) প্রভৃতি আরো অনেক মূলপদার্থের পরমাণুকে এই প্রকারে বিশ্লিষ্ট হইতে দেখা গিয়াছে। এবং বিশ্লেষণের ফলে যে অতি সূক্ষ্ম কণিকার উৎপত্তি হইতেছে, তাহার আকৃতি-প্রকৃতি সকল জিনিষেই এক দেখা যাইতেছে। সকলে ভাবিতেছেন, এই অতিসূক্ষ্ম কণিকাগুলিই বিশ্বের একমাত্র উপাদান এবং ইহাদেরই সংযোগবিয়োগে তাম্রলৌহ, শিলামৃত্তিকা প্রভৃতি নানা যৌগিক-অযৌগিক বস্তু উৎপন্ন হইয়া জগতকে এত বিচিত্র ও এত সুন্দর করিয়া তুলিয়াছে। সুতরাং আভাস পাওয়া যাইতেছে যে, তাম্রলৌহ বা হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন প্রভৃতি সেই সত্তরটি মূলপদার্থের কোনটিই প্রকৃত মূলপদার্থ নয়, সেই রেডিয়ম্ প্রভৃতি ধাতুর দেহনির্গত সূক্ষ্ম কণাই বিশ্বে একমাত্র মূল জিনিষ।

 জগতের সমস্ত বস্তুই এক মূলপদার্থ দ্বারা গঠিত, এই মহাসত্যটির আভাস পাইয়া রসায়নশাস্ত্র কম গৌরবান্বিত হয় নাই। একই মহাশক্তিকে আশ্রয় করিয়া যে, একই পদার্থ বিচিত্র মূর্ত্তিতে প্রকাশ পাইতেছে, ইহা দেশবিদেশের দার্শনিকগণ বহু পূর্ব্বে প্রকারান্তরে স্থির করিয়াছিলেন। বিজ্ঞান আজ সেই পরম সত্যটিকে চাক্ষুষ দেখাইবার উপক্রম করিয়া ধন্য হইয়াছে।

 রেডিয়ম ধাতুর আবিষ্কারের ইতিহাস অনুসন্ধান করিলে দেখা যায়, ফ্রান্সের ভুবনবিখ্যাত পণ্ডিত ক্যুরি সাহেবের পত্নী মাডাম্ ক্যুরিই ইহার সন্ধান পাইয়াছিলেন। জনৈক মহিলা দ্বারা এই প্রকার একটা বৃহৎ আবিষ্কারের সূত্রপাত বড়ই বিস্ময়কর ব্যাপার। যাহা হউক রেডিয়ম্ আবিষ্কারের পর ফরাসী ও ইংরাজ বৈজ্ঞানিক ব্যতীত অপর কেহই এই জিনিষটি লইয়া নাড়াচাড়া করিতে পারেন নাই।

পিচ্‌-ব্লেণ্ডি (Pitch blende) নামক যে আকরিক পদার্থ হইতে রেডিয়ম্ ঘটিত বস্তু সংগ্রহ করা হয়, তাহা পৃথিবীর সর্ব্বত্র পাওয়া যায় না,[] কাজেই উহা সাধারণ বৈজ্ঞানিকদিগের নিকট দুর্লভ হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। এখন রেডিয়মের ন্যায় তেজোনির্গমনক্ষম প্রায় চব্বিশটি ধাতুর অস্তিত্ব জানা গিয়াছে। ইহাতে রসায়নবিদ্‌গণের গবেষণার খুবই সুবিধা হইয়াছে। থোরিয়ম্ (Thorium) নামক ধাতুটি খুব দুর্লভ নয়। আজকাল গ্যাসের শিখার উপরে যে সাদা রঙের আবরণ লাগাইয়া আলোকের পরিমাণ বৃদ্ধি করা হইতেছে, তাহা সেই থোরিয়ম্-ঘটিত উপাদানে প্রস্তুত। ইহার পরীক্ষায় জর্ম্মান পণ্ডিত অধ্যাপক হান্‌ (Prof. Otto Hahn) আরো কতকগুলি তেজোনির্গমনক্ষম নুতন পদার্থের আবিষ্কার করিয়াছেন। এ পর্যন্ত রেডিয়ম লইয়া যে-সকল পরীক্ষা চলিতেছিল, তাহাতে বিশুদ্ধ রেডিয়মের ব্যবহার করা হয় নাই। ইহাকে বিশুদ্ধ আকারে পাইবার উপায়ও জানা ছিল না। কাজেই রেডিয়ম্ ও ব্রোমিনের (Bromine) মিশ্রজাত রেডিয়ম্‌ব্রোমানাইড্‌কে নাড়াচাড়া করিয়া তৃপ্ত থাকা ব্যতীত আর উপায় ছিল না। সম্প্রতি মাডাম্‌ ক্যুরি বিশুদ্ধ রেডিয়ম্ প্রস্তুতের এক পদ্ধতি আবিষ্কার করিয়া গবেষণার এক বৃহৎ অভাব মোচন করিয়াছেন।
বীক্ষণাগারে মাডাম ক্যুরি
 অধিক তাপে ও অধিক ঠাণ্ডায় পদার্থের অবস্থা কি প্রকার হইয়া দাঁড়ায়, তাহা পরীক্ষা করিয়া দেখা অনেক সময় আবশ্যক হয়। কিন্তু পদার্থকে খুব উষ্ণ বা শীতল করিবার উপায় বৈজ্ঞানিকগণ এ পর্য্যন্ত আবিষ্কার করিতে পারেন নাই, কাজেই অনেক পরীক্ষা দুঃসাধ্য বলিয়া পরিত্যক্ত হইয়া আসিতেছিল। বৈদ্যুতিক চুল্লীতে এখন নানা পদার্থকে অনায়াসে তিন হাজার ডিগ্রি পরিমাণে উষ্ণ করা যাইতেছে। এক শত ডিগ্রি তাপে জল ফুটিতে আরম্ভ করে, ইহার তিন শত গুণ তাপ যে কত অধিক তাহা আমরা অনায়াসে অনুমান করিতে পারি। চাপ দিয়া ও শীতল করিয়া বায়ুকে জলের ন্যায় তরল পদার্থে পরিণত করা যাইতেছে। এই তরল বায়ুর ন্যায় শীতল বস্তু এ পর্য্যন্ত দেখা যায় নাই। আজ কাল ইহা দ্বারা নানা পদার্থকে শীতল করিয়া অনেক পরীক্ষাদি হইতেছে।

 হাইড্রোজেন বাষ্পকে যে, কোন কালে তরল করা যাইবে, পূর্ব্বে বৈজ্ঞানিকগণ তাহা কল্পনাই করিতে পারেন নাই। সম্প্রতি ইহাও সুসাধ্য হইয়াছে। তরল হাইড্রোজেনের তাপ, তরল বায়ু আপক্ষাও অনেক কম। উষ্ণতার সীমা সেণ্টিগ্রেডের শূন্য ডিগ্রিতে নামিলে জল বরফে পরিণত হয়। তরল-বায়ুর উষ্ণতা বরফের উষ্ণতা অপেক্ষা কেবল ষাট্ ডিগ্রি মাত্র কম, কিন্তু তরল হাইড্রোজেনের উষ্ণতাকে এখন বরফের তুলনায় ২৫২ ডিগ্রি কম দেখা যাইতেছে। বিজ্ঞানজ্ঞ পাঠক অব্যই জানেন, বৈজ্ঞানিকগণ পদার্থের একটা নিস্তাপ অবস্থা কল্পনা করিয়া থাকেন। উষ্ণতার মাত্রা বরফের শৈতোর ২৭৩ ডিগ্রি নীচে নামিলেই সেই নিস্তাপ অবস্থা আসিয়া পড়ে। ইহাতে পদার্থের অণুর কম্পন রহিত হয় এবং সংকীর্ণ পাত্রে আবদ্ধ রাখিলেও এই অবস্থায় বায়বীয় পদার্থ চাপ-ধর্ম্ম ত্যাগ করে। সুতরাং দেখা যাইতেছে, তরল হাইড্রোজেনের সাহায্যে শীতল করিবার উপায় উদ্ভাবন করিয়া, বৈজ্ঞানিকগণ সেই নিস্তাপ ও নিঃস্পন্দ অবস্থার খুব কাছাকাছি আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন। আর কোন প্রকারে উষ্ণতাকে কুড়ি ডিগ্রি নীচে নামাইতে পারিলেই জড়ের সেই স্তব্ধ প্রকৃতির সহিত প্রত্যক্ষ পরিচয় হইবে। প্রায় বারো বৎসর পূর্ব্বে ইংলণ্ডের রয়াল্ ইনষ্টিটিউসনের অধ্যাপক ডিওয়ার (Dewar) তরল হাইড্রোজেন্ প্রস্তুতের উপায় আবিষ্কার করিয়াছিলেন; এখনো সেই উপায়েই হাইড্রোজেনকে তরল করা হইতেছে।

 বিজ্ঞানের কোন আবিষ্কারই এক বারের চেষ্টায় এক দিনে সুসাধিত হয় নাই। কোন বিশেষ উদ্দেশ্যকে লক্ষ্য করিয়া দীর্ঘকাল গবেষণা করিলে তবে অভীষ্টের সন্ধান পাওয়া যায়। ইহাতে যে অর্থ ব্যয় হয় তাহার পরিমাণ বড় অল্প নয়। যে তরল-বায়ু ও তরল হাইড্রোজেন আজকাল নানা পরীক্ষার প্রধান সহায় হইয়া দাড়াইয়াছে, তাহার প্রস্তুত উপায়ের আবিষ্কারেও বহু ব্যয় হইয়া গিয়াছে। ডাক্তার মণ্ড (Dr. Mond) নামক জনৈক জর্ম্মান্ ধনী ইহার সমগ্র ব্যয় বহন করিয়াছিলেন। যাহা সত্য, তাহাকে কোন ক্রমেই ব্যক্তি বা জাতিবিশেষের সম্পত্তি করিয়া রাখা যায় না। ইহা জানিয়াও আধুনিক নানা আবিষ্কারের কর্ত্তৃত্ব লইয়া নানা দেশের বৈজ্ঞানিকগণ বৃথা বাগ্‌বিতণ্ডার প্রশ্রয় দিয়া থাকেন। ইংরাজ বৈজ্ঞানিক ডিওয়ার সাহেবের গবেষণার আনুকুল্যে জর্ম্মানের দান সত্যই আধুনিক যুগের একটা নূতন কথা।

 ত্রিশ বৎসর পূর্ব্বেও জৈব রসায়ন শাস্ত্রের (Organic Chemistry) বিশেষ কোন উন্নতির লক্ষণ দেখা যাইত না। সেই পুরাতন কয়েকটি ব্যাপার লইয়া বৈজ্ঞানিকগণ তৃপ্ত থাকিতেন। অনেকের বিশ্বাস ছিল, জৈব বস্তুকে আমরা বিশ্লেষ করিতে পারি, কিন্তু উপাদানগুলিকে একত্র করিয়া তাহাকে গঠন করিতে পারি না। এখনো যে, সে বিশ্বাস সম্পূর্ণ অপনীত হইয়াছে, তাহা বলা যায় না; তথাপি বৈদ্যুতিক চুল্লীর উষ্ণতা ও তরল হাইড্রোজেনের শীতলতাকে ব্যবহারে লাগাইয়া গত কয়েক বৎসরে বৈজ্ঞানিকগণ জৈব পদার্থের সংগঠনে কতকটা কৃতকার্য্য হইয়াছেন। প্রবীণ জর্ম্মান্ পণ্ডিতগণ বীক্ষণাগারে দিবারাত্রি পরীক্ষা করিয়া যে সকল রহস্যের সন্ধান পাইতেছেন, সে গুলিকেই কারখানার কাজে প্রয়োগ করিয়া বাণিজ্যের যে কত উন্নতি করিতেছেন, তাহার ইয়ত্তা হয় না।

 যে গভীর বায়ুর আবরণ আমাদের পৃথিবীকে ঘিরিয়া রহিয়াছে, অক্সিজেন্ ও নাইট্রাজেন নামক দুইটি স্বচ্ছ বায়বীয় বস্তু তাহার প্রধান উপাদান। সচরাচর আমরা যে সকল বস্তু দেখিতে পাই, তাহাতে প্রচুর অক্সিজেন ও নাইট্রোজেন আছে, কিন্তু এগুলিতে উহারা সংযুক্ত অবস্থায় থাকে বলিয়া সেই সকল পদার্থ হইতে অক্সিজেন্ বা নাইট্রোজেন্ সংগ্রহ করিয়া কাজে লাগানো কঠিন হয়। তা ছাড়া এ প্রকারে যে অক্সিজেন্ ও নাইট্রোজেন্ পাওয়া যায় তাহার পরিমাণও অধিক হয় না। কিন্তু এই প্রকারে নাইট্রোজেন্ সংগ্রহ করা ব্যতীত আর উপায় ছিল না। মানুষ নাইট্রোজেনের সমুদ্রে ডুবিয়া থাকিয়াও মুক্ত নাইট্রোজেন্‌কে কি প্রকারে কাজে লাগানো যাইতে পারে, তাহা জানিত না। গত কয়েক বৎসরের চেষ্টায় বায়ুর নাইট্রোজেন্‌কে আজ কাল নানা কার্য্যে প্রয়োগ করা হইতেছে।

 নাইট্রোজেন্‌যুক্ত যে-সকল পদার্থ আজ কাল ব্যবসায় বাণিজ্যে অপরিহার্য্য হইয়া দাঁড়াইয়াছে, তাহাদের নাম করিতে গেলে প্রথমে নাইট্রিক এসিড্ নামক দ্রাবকের কথা মনে পড়িয়া যায়। কলকারখানার কাজে ইহার ন্যায় অত্যাবশ্যক বস্তু আর খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। আধুনিক বৈজ্ঞানিকগণ বায়ুর নাইট্রোজেন লইয়া নাইট্রিক্ এসিড্ প্রস্তুত করিবার জন্য দীর্ঘ কাল চেষ্টা করিয়া আসিতেছিলেন। সম্প্রতি ইঁহাদের চেষ্টা সার্থক হইয়াছে। বায়ুর নাইট্রোজেনে বিদ্যুৎ পরিচালন করিয়া ইংরাজ বৈজ্ঞানিক হান্‌পসন্ (Dr. William Hanpson) নাইট্রিক এসিড্‌ প্রস্তুতের এক উপায় আবিষ্কার করিয়াছেন। ইতিমধ্যেই নরওয়ের এক বৃহৎ জলপ্রপাতের নিকট এই উপায়ে এসিড্ প্রস্তুতের জন্য এক কারখানার প্রতিষ্ঠা হইয়াছে। জলপ্রপাতের শক্তিতে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা হইতেছে এবং তাহারই সাহায্যে নাইট্রিক্ এসিড্ প্রস্তুতের কার্য্য চলিতেছে।

 সোরা (Salt petre) জিনিষটা আমাদের কম প্রয়োজনে লাগে না। জমির উর্ব্বরতা বৃদ্ধির জন্য ইহা একটি উৎকৃষ্ট সার। তা ছাড়া বারুদ প্রভৃতি প্রস্তুতে ইহার যথেষ্ট ব্যবহার আছে। স্বভাবতঃ নানা স্থলে যে সোরা উৎপন্ন হয়, এ পর্য্যন্ত তাহাই সংগ্রহ করিয়া লোকে কাজ চালাইত। কিন্তু নাইট্রোজেন্‌কেই ইহার প্রধান উপাদান দেখিয়া, বায়ুর নাইট্রোজেন্ লইয়া কোন প্রকারে জিনিষটাকে প্রস্তুত করিবার জন্য খুব চেষ্টা চলিতেছিল। বায়ুর ভিতর দিয়া বিদ্যুৎ পরিচালন করিয়া বৈজ্ঞানিকগণ সম্প্রতি কৃত্রিম সোরা প্রস্তুতে কৃতকার্য্য হইয়াছেন।

 এমোনিয়া জিনিষটাও নাইটোজেন্‌-প্রধান, এবং কারখানায় ইহার ব্যবহারও যথেষ্ট। বায়ুর নাইট্রোজেন্ হইতে ইহারও এক প্রস্তুত-উপায় অল্প দিন হইল আবিষ্কৃত হইয়াছে। অধ্যাপক হাবের (Haber) নামক জনৈক জর্ম্মান ইহার উদ্ভাবক। এমোনিয়া প্রস্তুতের নূতন কারখানা প্রতিষ্ঠার আয়োজন চলিতেছে। অনেকে আশা করিতেছেন, হয়ত অল্প দিনের মধ্যে জিনিষটা খুব সুলভ হইয়া দাড়াইবে।

 ভূ-গর্ভ হইতে তাম্র লৌহ স্বর্ণ রৌপ্য প্রভৃতি ধাতুগুলিকে যখন উদ্ধার করা হয়, তখন তাহারা বিশুদ্ধ অবস্থায় থাকে না। নানা বিজাতীয় বস্তুর সহিত মিশ্রিত হইয়া সেগুলি আকারে প্রকারে এমন বিকৃত অবস্থায় থাকে যে, সেগুলিকে ধাতু বলিয়া চিনিয়া লওয়া কঠিন হয়। এই সকল অবিশুদ্ধ ধাতুকে শুদ্ধ করিবার জন্য যে-সকল উপায় প্রচলিত আছে, তাহাদের কোনটিই সহজ বা অল্পব্যয়সাধ্য নয়। স্বর্ণ বা রৌপ্যকে যদি ঠিক স্বর্ণ বা রৌপ্যের আকারেই খনিতে পাওয়া যাইত, তাহা হইলে সেগুলি এত দুর্মূল্য হইয়া দাঁড়াইত না; অনেক স্থলেই জটিল রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় ধাতুকে শুদ্ধ করিতে হয়। গত ত্রিশ বৎসরের চেষ্টায় বিদ্যুতের সাহায্যে যে-সকল শুদ্ধিপ্রথার আবিষ্কার হইয়াছে, তাহা রাসায়ন-শাস্ত্রকে কম উন্নত করে নাই। স্বর্ণ, রৌপ্য ও তাম্র এই তিনটি প্রধান ধাতু হইতে আকরিক যৌগিক পদার্থ আজকাল এত সহজে বিচ্ছিন্ন করা হইতেছে যে, তাহার বিবরণ শুনিলে বিস্মিত হইতে হয়। লৌহ জিনিষটা সুলভ হইলেও ইহাকে বিশুদ্ধ অবস্থায় সংগ্রহ করা বড় কঠিন। অথচ বিশুদ্ধ লৌহের যথেষ্ট প্রয়োজন আছে। সাধারণ লৌহে তার প্রস্তুত করিতে গেলে, যে শ্রম লাগে, বিশুদ্ধ লৌহ লইয়া কার্য করিলে তাহার শতাংশ শ্রমেরও আবশ্যক হয় না। তা ছাড়া বৈদ্যুতিক যন্ত্রাদিতে এই প্রকার লৌহের চুম্বক ব্যবহার করিলে অল্প শক্তিতে অনেক কাজ আদায় করা যাইতে পারে। জর্ম্মানির লিপ্‌জিক্ (Leipsic) নগরের কারখানায় যে বিশুদ্ধ লৌহ প্রস্তুত করা হইতেছে, তাহা দ্বারা আজকাল অনেক যন্ত্রাদি নির্ম্মাণ করিয়া পরীক্ষা চলিতেছে। সাধারণ যন্ত্রের তুলনায় বিশুদ্ধ লৌহনির্ম্মিত কলে প্রায় আড়াই গুণ অধিক কাজ পাওয়া যাইতেছে। ইহা কম লাভের কথা নয়!

 এক সূর্যের তাপই পৃথিবীর সমগ্র শক্তির ভাণ্ডারকে পূর্ণ করিয়া রাখে। যে কয়লা পোড়াইয়া আমরা বাষ্পযন্ত্র বা বিদ্যুতের যন্ত্র চালাইতেছি, তাহা উদ্ভিদের দেহে সঞ্চিত শক্তি ব্যতীত আর কিছুই নয়। উদ্ভিদ আবার অতি প্রাচীন যুগে সেই শক্তি সূর্য্যতাপ হইতে আহরণ করিয়া দেহে সঞ্চিত রাখিয়াছিল। কাজেই কয়লার শক্তিকে সৌরশক্তিরই রূপান্তর বলিতে হয়। যে জলপ্রপাতকে শৃঙ্খলিত করিয়া আজকাল নানা কাজ করাইয়া লওয়া হইতেছে, অনুসন্ধান করিলে দেখা যায়, তাহাদের শক্তিও সৌরশক্তি। পর্ব্বত-চূড়ায় জলের সঞ্চয় সূর্যতাপেরই কাজ! জলই সেই সৌরশক্তিকে বক্ষে ধরিয়া রাখে এবং তার পরে নীচে নামিবার সময় তাহার বিকাশ দেখায়। বুদ্ধিমান মানুষ এই সুযোগ ছাড়িতে চায় না, নিম্নগামী জলের প্রবাহ দ্বারা চাকা ঘুরাইয়া অনেক কাজ করাইয়া লয়।

 কয়লায় যে শক্তি সঞ্চিত থাকে, পোড়াইলেই তাহা তাপালোকে পরিণত হইয়া ক্ষয়প্রাপ্ত হইতে থাকে। ক্ষয়ের সময় ষোন আনা শক্তিকেই যদি আমরা কাজে লাগাইতে পারি, তাহা হইলেই আমাদের লাভ হয়, কিন্তু অতি উৎকৃষ্ট যন্ত্রেও কয়লা পোড়াইলে সমগ্র শক্তিকে আমরা কাজে লাগাইতে পারি না; অধিকাংশই বৃথা তাপালোক উৎপন্ন করিয়া এবং পার্শ্বের জলস্থলবায়ুকে অনাবশ্যক গরম করিয়া নিয়তই নষ্ট হয়। হিসাব করিলে দেখা যায়, এই অপব্যয়ের পরিমাণ শতকরা ৮৫ ভাগ। অর্থাৎ এক শত ভাগ শক্তির মধ্যে কেবল ১৫ ভাগ মাত্র কল চালায়। এই অপচয় বড় অল্প নয়। দীর্ঘকাল এ প্রকার বাজে খরচের প্রশ্রয় দিতে থাকিলে, কয়লার অভাবে কলকারখানা বন্ধ হইবার যথেষ্ট আশঙ্কা আছে। এই সকল কারণে বিজ্ঞানসম্মত প্রথায় কয়লা পোড়াইয়া তাহার অধিকাংশ শক্তিকে কাজে লাগাইবার জন্য আধুনিক বৈজ্ঞানিকগণ যথেষ্ট চেষ্টা করিতেছেন। গত কয়েক বৎসরের রসায়ন শাস্ত্রের ইতিহাস অনুসন্ধান করিলে দেখা যায়, ইঁহারা উদ্দেশ্য-সিদ্ধির পথে যেন কতকটা অগ্রসর হইয়াছেন। সাধারণ চুল্লীতে পোড়াইলে কয়লা হইতে যে কতকগুলি অনাবশ্যক বাষ্প উৎপন্ন হয়, তাহাই শক্তিকে ক্ষয় করায়। আধুনিক বৈজ্ঞানিকগণ এই সকল বাষ্পকে ছাড়িয়া না দিয়া, তাহাদিগকেও কলে পোড়াইবার ব্যবস্থা করিতেছেন এবং আংশিক কৃতকার্য্যও হইয়াছেন। এই প্রকারে কয়লা পোড়াইতে আরম্ভ করিলে, এখন যে পরিমাণ শক্তি কাজে লাগানো যাইতেছে তাহার অন্ততঃ চতুর্গুণ শক্তি আমাদের করায়ত্ত হইবে বলিয়া আশা হইতেছে। তাছাড়া কয়লার বাষ্প প্রস্তুত করিতে গেলে, যে আল্‌কাতরা ও এমোনিয়া উৎপন্ন হইবে তাহাও নষ্ট হইবে না।

 এই ত গেল অজৈব রসায়নের (Inorganic Chemistry) উন্নতির কথা। জৈব রসায়নের নানাবিভাগে গত কুড়ি বৎসরে বহু উন্নতির লক্ষণ প্রকাশ পাইয়াছে। কৃত্রিম রবার, কৃত্রিম শর্করা এবং নানা জাতীয় কৃত্রিম রঙ্গ ও গন্ধদ্রব্য প্রস্তুত করিয়া জর্ম্মানি প্রভৃতি দেশগুলি কি প্রকার ধনশালী হইয়া দাঁড়াইতেছে, তাহার বিশেষ বিবরণ প্রদান নিষ্প্রয়োজন। কৃত্রিম নীল প্রস্তুতের উপায় উদ্ভাবনের পর হইতে আমাদের দেশ হইতে নীলের চাষ এক প্রকার লোপ পাইয়াই গিয়াছে। সুলভ কৃত্রিম রঙ্গ হাতের গোড়ায় পাইয়া লোকে এখন আর মহার্ঘ লাক্ষারস বা মঞ্জিষ্ঠা রঞ্জনকার্য্যে ব্যবহার করে না। যাহা হউক এই সকল কৃত্রিম জিনিষের প্রস্তুতোপায় কি প্রকারে আবিষ্কৃত হইয়াছে, তাহা আলোচনা করিতে গেলে জৈব রসায়নশাস্ত্রের অধিকারে আসিয়া পড়িতে হয়।

  1. সম্প্রতি ইঁহার মৃত্যু হইয়াছে।
  2. সম্প্রতি সংবাদ পাওয়া গিয়াছে, আমাদের দেশের গয়া জেলার এক স্থানে প্রচুর পরিমাণে পিচ-ব্লেণ্ডি আছে। ইহা উত্তোলন করিবার আয়োজন চলিতেছে।