প্রাকৃতিকী/ধাতুর কয়েকটি গুণ

ধাতুর কয়েকটি গুণ

যেখানে সীমারেখা টানা যায়, সেখানেই যত সন্দেহ, যত বিরোধ একে একে দেখা দিতে থাকে। সীমা-সরহদ্দ লইয়া যে, কেবল রাজায় রাজায় লড়াই বাধে তাহা নহে, বৈজ্ঞানিকগণ যেখানে সীমা-রেখা টানিয়া প্রাণি-জগৎকে উদ্ভিদ্ হইতে পৃথক্ করেন বা চেতন পদার্থকে অচেতন হইতে বিচ্ছিন্ন রাখিতে চেষ্টা করেন, সেখানেও বিরোধ ও সন্দেহ দেখা দেয়। এই বিরোধে গোলাগুলি বর্ষণ বা রক্তপাত হয় না সত্য, কিন্তু তর্ককোলাহলের আর অন্ত থাকে না। নির্জীব জড়জগৎকে ধাতু ও অধাতু, এই দুইটি প্রধান ভাগে বিভক্ত করিবার রীতি আছে; খুব মোটামুটি কতকগুলি লক্ষণ মিলাইয়া এই শ্রেণীবিভাগ করা হয়; কিন্তু যখনই বৈজ্ঞানিকগণ সুস্পষ্ট রেখা টানিয়া ধাতুকে অধাতু হইতে পৃথক্ করিতে গিয়াছেন, তখনই ঘোর দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হইয়াছে। যেগুলিকে একদল বৈজ্ঞানিক ধাতুর কোটায় ফেলিতে চাহিয়াছেন, অপর একদল বৈজ্ঞানিক সেগুলিকেই অধাতু বলিয়া গ্রহণ করিয়াছেন। কাজেই কতকগুলি পদার্থ চূড়ান্ত বিচারের অভাবে কোন বিশেষ শ্রেণীতে স্থান পায় নাই। সেলেনিয়ম্, টেলুরিয়ম্, আর্সেনিক্ এণ্টিমণি প্রভৃতি পদার্থ এই প্রকারে সমাজচ্যুত হইয়া রহিয়াছে। ধাতু ও অধাতুর সীমান্ত রেখায় ইহাদের বসতি।

 সার্ হেন্‌রি রস্কো আধুনিক যুগের একজন খ্যাতনামা রসায়নবিৎ। ধাতুর লক্ষণ জানিবার জন্য তাঁহার গ্রন্থাদির অনুসন্ধান করিলে দেখা যায়, এক পারদ ব্যতীত সকল ধাতুই সাধারণতঃ কঠিনাবস্থায় থাকে, সুতরাং কাঠিন্য ধাতুর প্রধান লক্ষণ। তা’ ছাড়া আলোক রোধ করিয়া তাহার কিয়দংশ প্রতিফলিত করা, তাপ ও বিদ্যুৎ পরিবাহন করা, অল্প তাপে দ্রবীভূত না হওয়া, কঠিন আঘাত দিলে ভাঙ্গিয়া না গিয়া আকারান্তর পরিগ্রহ করা ইত্যাদি আরও অনেক লক্ষণের উল্লেখ দেখা যায়। বলা বাহুল্য, এই সকল লক্ষণ কেবল ধাতুরই বিশেষত্ব নয়; যেগুলি প্রত্যক্ষ অধাতু, সেগুলিতেও এই সকল লক্ষণ একাধিক পরিমাণে দেখা গিয়া থাকে। কাজেই কোন্ কোন্ বিশেষ ধর্ম্ম দেখিলে পদার্থকে ধাতু বলা যাইবে, তাহা নূতন করিয়া নির্ণয় করার প্রয়োজন উপস্থিত হইয়াছে।

 ইলেক্ট্রন বা অতি-পরমাণু নামক যে এক অতি সূক্ষ্ম জড়কণার উপরে আধুনিক বৈজ্ঞানিকগণ সৃষ্টিকে দাঁড় করাইতে চাহিতেছেন, তাহারই সাহায্যে ধাতুতত্ত্ব-সম্বন্ধে অনেক রহস্যের প্রকাশ হইবে বলিয়া আশা হইতেছে। ইহাতে ধাতুর প্রকৃত লক্ষণ কি এবং সেই লক্ষণগুলি কি প্রকারে প্রকাশ লাভ করে, তাহা নূতন করিয়া একে একে জানা যাইতেছে। ধাতু আধুনিক সভ্যতার একটি প্রধান উপাদান; কলকারখানা, ঘরবাড়ী এবং গৃহসজ্জার নানা উপকরণ প্রধানতঃ ধাতু দ্বারাই নির্ম্মিত; কাজেই ধাতুর প্রকৃতি জানিয়া তাহাকে যথোপযুক্তভাবে আমাদের সংসারের কার্য্যে লাগাইবার জন্য বৈজ্ঞানিকগণ বহু দিন হইতে চেষ্টা করিয়া আসিতেছেন। এই চেষ্টা যে কোন শুভ ফল প্রদান করে নাই, ইহা বলা যায় না। গণিতবিশারদগণ ধাতুর আণবিক অবস্থা ও অণুর গতিবিধি-সম্বন্ধে অনেক সন্ধান দিয়াছেন। রশ্মিনির্ব্বাচনযন্ত্র দ্বারা বৈজ্ঞানিকগণ জ্বলন্ত ধাতুর রশ্মিজালের অনেক নুতন তত্ত্ব আবিষ্কার করিয়াছেন। দুই বা ততোধিক ধাতু মিশাইয়া যে সঙ্কর ধাতুর (Alloy) উৎপত্তি হয়, তাহার ভিতরকার অণুগুলির বিন্যাস নানা পণ্ডিতের চেষ্টায় আমরা জানিতে পারিয়াছি। তরল বায়ুর (Liquid Air) ন্যায় শীতল পদার্থে এবং বৈদ্যুতিক চুল্লীর ন্যায় গরম স্থানে ধাতু সকল কিপ্রকার অবস্থায় থাকে, দক্ষ রসায়নবিদগণ নানা পরীক্ষায় তাহা আমাদিগকে দেখাইয়াছেন। এই সকল আবিষ্কারে আমাদের যে প্রচুর জ্ঞান বৃদ্ধি হইয়াছে, তাহা অবশ্যই স্বীকার করিতে হয়; কিন্তু এই জ্ঞানবৃদ্ধির সহিত আমাদের কাজের দিক্‌টা যে উন্নত হইয়া পড়িয়াছে, ইহা কখনই স্বীকার করা যায় না। ধাতুর ধাতুত্ব কোথায় তাহা অঙ্গুলি নির্দ্দেশ করিয়া না দেখাইলে, ধাতুর ব্যবহারের দিক্‌টা কখনই উন্নতি লাভ করিবে না। আজকাল অনেকে নানা ধাতু বিভিন্ন পরিমাণে মিশাইয়া কখন কখন ইচ্ছানুরূপ বহুগুণসম্পন্ন সঙ্কর ধাতু প্রস্তুত করিতেছেন বটে, কিন্তু এই মিশ্রণব্যাপারের কোনও বাঁধা নিয়ম ধরা পড়িতেছে না, কাজেই সকল সময়ে ইচ্ছানুরূপ কার্য্য করা যাইতেছে না। যে মূল ব্যাপার ধাতুকে তাপ ও বিদ্যুতের পরিচালক করে, এবং সঙ্গে সঙ্গে ঘাতসহ ও কোমল করে, তাহার আবিষ্কার না হইলে, কখনই ধাতুকে আমাদের সম্পূর্ণ ব্যবহারোপযোগী করা যাইবে না।

 বিদ্যুৎ-পরিচালন-শক্তি ধাতুমাত্রেরই একটা প্রধান ধর্ম্ম। কাঠ ও পাথরের ভিতর দিয়া বিদ্যুৎ সহজে চলাফেরা করিতে পারে না, কিন্তু ধাতুর ভিতর দিয়া বিদ্যুৎ অনায়াসেই চলিয়া যাইতে পারে। এই কারণে টেলিগ্রাফ্, টেলিফোন্ বা অপর কলে বিদ্যুৎ লইয়া যাইবার জন্য ধাতুর তারের ব্যবহার হয়। কার্পাস-সূত্র বা দড়াদড়ির ভিতর দিয়া বিদ্যুৎ চলিতে পারে না। ধাতুর এই বিদ্যুৎ-পরিবাহন শক্তির উপরেই বৈজ্ঞানিকদিগের প্রথম নজর পড়িয়াছিল। ধাতুর অণুপরমাণু কোন্ বিশেষ গুণে বিদ্যুৎ বহিয়া লইয়া যাইতে পারে, ইহাই তাঁহারা প্রথমে খোঁজ করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। এই অনুসন্ধানের ফলে যে সকল তত্ত্ব আবিষ্কৃত হইয়াছে, তাহা বড়ই অদ্ভুত। ডাল্‌টন সাহেবের আণবিক সিদ্ধান্ত প্রচার হইবার পর হইতে আমরা জানি, পদার্থমাত্রই অতি সূক্ষ্ম অণু দিয়া গঠিত এবং এই অণুগুলি আবার দুই বা ততোধিক আরও সূক্ষ্মতর পরমাণুর যোগে উৎপন্ন। অণুপরমাণুর অস্তিত্ব সম্বন্ধে এত অধিক প্রমাণ সংগ্রহ করা হইয়াছে যে, ডাল্‌টনের সিদ্ধান্তে সন্দেহ করিবার আর কারণ দেখা যাইতেছে না। কিন্তু এত জানা সত্ত্বেও পদার্থে অণুপরমাণু কি প্রকারে বিন্যস্ত থাকে তাহা আমরা নিঃসন্দেহে জানিতে পারি নাই। আধুনিক বৈজ্ঞানিকদিগের গবেষণায় ধাতুর ভিতরকার এই আণবিক অবস্থার অনেক কথা জানা গিয়াছে। ইঁহারা বলিতেছেন, যে ধাতুপিণ্ডটিকে আমরা স্থূল দৃষ্টিতে নিরেট্ দেখিতেছি, তাহা প্রকৃত নিরেট্ নয়; ধাতুর ভিতরে পরমাণুগুলি সুবিন্যস্ত থাকিয়া মৌচাকের মত এক সচ্ছিদ্র পিণ্ডের রচনা করে। পরমাণুর এই প্রকার সুবিন্যাসের সহিত বৈজ্ঞানিকগণ পূর্ব্বেই পরিচিত ছিলেন; গাঢ় চিনির রস জমিয়া যখন দানাদার চিনি বা মিছরি উৎপন্ন করে, তখন ঐ প্রকার আণবিক সুবিন্যাস দেখা যায়। কিন্তু গুরু ধাতুপিণ্ডের ভিতরেও যে, অণুপরমাণু সুসজ্জিত হইয়া দানার উৎপত্তি করে, এবং মধুচক্রের ন্যায় ধাতুপিণ্ডমাত্রই যে সচ্ছিদ্র এই ব্যাপারটি সম্পূর্ণ নুতন। কেবল ইহাই নহে, আধুনিক বৈজ্ঞানিকগণ আরও বলিতেছেন, ধাতুর ভিতরকার সেই সূক্ষ্ম ছিদ্রগুলি ইলেক্ট্রন অর্থাৎ অতিপরমাণুতে পূর্ণ। বায়ব বস্তুর অণু যেমন সর্ব্বদাই চঞ্চল থাকে এবং পরস্পরকে ধাক্কা দিয়া অবিরাম ছুটাছুটি করিতে থাকে, ধাতুর ছিদ্রস্থ ইলেক্ট্রনগুলিও সেই প্রকার চঞ্চল হইয়া চলাফেরা করে। আজ প্রায় বারো বৎসর ধরিয়া নানা দেশের বৈজ্ঞানিকগণ ইলেক্ট্রন্ লইয়া গবেষণা করিতেছেন। রেডিয়ম্ ধাতু হইতে নির্গত ইলেক্ট্রনে বা ক্রুক্‌স্ সাহেবের নলের ভিতরকার ইলেক্ট্রনে ইঁহারা সকল অবস্থাতেই ঋণাত্মক বিদ্যুতের সন্ধান পাইয়াছেন, ইলেক্টন মাত্রেই যে, ঋণাত্মক বিদ্যুতের (Negative Electricity) বাহক, তাহা নিঃসন্দেহে স্থির হইয়া গিয়াছে। কাজেই ধাতুর ভিতরকার ছিদ্রে যে ইলেক্ট্রন আবদ্ধ থাকিয়া চলাফেরা করে, তাহাতে প্রচুর ঋণাত্মক বিদ্যুৎ থাকে। বৈজ্ঞানিকগণ বলিতেছেন, ইলেক্ট্রনের ঋণাত্মক বিদ্যুৎ এবং অণুতে সঞ্চিত ধনাত্মক বিদ্যুৎ (Positive Electricity) পরস্পর টানাটানি করিয়া এমন সাম্যাবস্থায় থাকে যে, আমরা বাহির হইতে ধাতুতে ধন বা ঋণ, কোন বিদ্যুতেরই লক্ষণ দেখিতে পাই না।

 ধাতুমাত্রেই অল্প বা অধিক পরিমাণে যে বিদ্যুৎ পরিবাহন-শক্তি দেখা যায়, ধাতুর মধ্যে আবদ্ধ পূর্ব্বোক্ত ইলেক্ট্রনের সাহায্যে আজকাল তাহার ব্যাখ্যান পাওয়া যাইতেছে। বৈজ্ঞানিকগণ বলিতেছেন, একখণ্ড ধাতুকে বৈদ্যুতিক শক্তির সীমার মধ্যে আনিলে, তাহার ছিদ্র মধ্যবর্ত্তী ইলেক্ট্রনগুলি বৈদ্যুতিক শক্তির দিকে ছুটিয়া চলিতে আরম্ভ করে। ইহাতে ধাতুর মধ্যে যে একটা ইলেক্ট্রনের প্রবাহ উৎপন্ন হয়, তাহাই আমাদের নিকট বিদ্যুতের প্রবাহরূপে ধরা দেয়।

 সঙ্কীর্ণ স্থানে আবদ্ধ বায়ব পদার্থে তাপ প্রয়োগ করিলে, পদার্থটা স্ফীত হইতে চায় এবং পাত্রের গায়ে জোরে চাপ দিতে থাকে। এই ব্যাপারটির কারণ অনুসন্ধান করিয়া স্থির করা হইয়াছে যে, তাপ পাইলেই বায়ব পদার্থের অণুগুলির চঞ্চলতা বাড়িয়া যায়। এই অবস্থায় ইহারা দ্রুতবেগে পরস্পরকে ধাক্কা দিয়া জোরে পাত্রের গায়ে আসিয়া পড়ে, কাজেই চাপের মাত্রা তাপ প্রয়োগের সঙ্গে সঙ্গে বাড়িয়াই চলে। তাপ প্রয়োগ করিলে ধাতুর বিদ্যুৎ পরিবাহন-শক্তি কমিয়া আসে; এই সুপরিচিত ব্যাপারটির ব্যাখ্যান দিতে গিয়া বৈজ্ঞানিকগণ তাপবৃদ্ধির সহিত ধাতুমধ্যস্থ ইলেক্ট্রনের গতিবৃদ্ধির কথা প্রচার করিতেছেন। ইলেক্ট্রনগুলি গুরুত্বে ও আয়তনে এত ক্ষুদ্র যে, ইহাদের তিন হাজার ছয় শতটি একত্র না হইলে একটি হাইড্রোজেনের অণুর সহিত সমান হয় না। গুরুত্বের এই পরিমাণ লইয়া হিসাব করিয়া দেখা গিয়াছে, কোন নির্দ্দিষ্ট উষ্ণতায় হাইড্রোজেনের অণুগুলি যে বেগে পরিভ্রমণ করে, ধাতুর ভিতরে ইলেক্ট্রনগুলি সেই অবস্থায় প্রায় তাহার ষাট্ গুণ বেগে চলাফেরা আরম্ভ করে। এই হিসাবে বরফের ন্যায় শীতল অবস্থাতেও প্রত্যেক ইলেক্ট্রনকে প্রতি সেকেণ্ডে শতাধিক মাইল বেগে পরিভ্রমণ করিতে দেখা গিয়াছে। কামানের গোলা ও বন্দুকের গুলি যত জোরে ছোঁড়া যায়, বাহিরের ভূমধ্যাকর্ষণ বা অপর কোন বাধাবিঘ্ন ভেদ করিয়া তাহা ততই বেগে ধাবমান হয়। তাপ প্রয়োগে ধাতুগর্ভে আবদ্ধ ইলেক্ট্রনগুলি যখন গোলাগুলির ন্যায় প্রবলতর বেগে ছুটাছুটি আরম্ভ করে, তখন বাহিরের নির্দ্দিষ্ট বৈদ্যুতিক শক্তি তাহাদিগকে নিজের দিকে টানিয়া প্রবাহের উৎপত্তি করিবার সুযোগ পায় না; কাজেই এই অবস্থায় বিদ্যুৎশক্তির টান অপেক্ষা তাপের চঞ্চলতাই প্রাধান্য লাভ করে; সুতরাং অধিক বিদ্যুৎ প্রবাহ উৎপন্ন হইতে পারে না।

 কেবল বিদ্যুতের পরিবাহনেই ইলেক্ট্রনের কার্য্য ধরা পড়ে নাই;—ধাতুর তাপ পরিচালন ব্যাপারটাও এখন ইলেক্ট্রনের সাহায্যে বুঝা যাইতেছে। বৈজ্ঞানিকগণ বলিতেছেন, দীর্ঘ ধাতুদণ্ডের এক প্রান্তে তাপ দিলে যখন তাহার দুরবর্ত্তী প্রান্ত পর্য্যন্ত উত্তপ্ত হইয়া দাঁড়ায়, তখন বুঝিতে হয়, তাপ প্রাপ্ত অংশের ইলেক্টনই উত্তাপ বহন করিয়া ধাতুর সর্ব্বাঙ্গে তাপ সঞ্চারিত করে। এই ব্যাখ্যানেও তাপসংযোগে অভি সূক্ষ্ম ইলেক্ট্রনগুলির যে বেগ বৃদ্ধি হয়, বৈজ্ঞানিকগণ তাহারই শরণাপন্ন হইয়াছেন। ইঁহারা বলিতেছেন, তাপ পাইলে ধাতুর ছিদ্রস্থিত সেই ইলেক্ট্রনগুলির চঞ্চলতা অত্যন্ত বৃদ্ধি পাইতে থাকে; কাজেই এই অবস্থায় সেগুলি তাহাদের সঙ্কীর্ণ গণ্ডীর মধ্যে আর আবদ্ধ না থাকিয়া ধাতুর সর্ব্বাঙ্গের তাপ বহন করিয়া ছুটাছুটি আরম্ভ করে।

 দুইটি পৃথক ধাতুকে জুড়িয়া, তাহাদের সংযোগস্থানে তাপ দিতে থাকিলে, আপনা হইতেই এই সংযুক্ত ধাতুতে বিদ্যুতের প্রবাহ উৎপন্ন হয়। বিজ্ঞানের ভাষায় এই বিদ্যুৎকে Thermo- Electricity অর্থাৎ তাপজ বিদ্যুৎ বলা হইয়া থাকে। বিদ্যুতের নাম যাহাই হউক, কি প্রকারে কেবল তাপ দ্বারা বিদ্যুতের উৎপত্তি হয়, এ পর্য্যন্ত তাহার সন্তোষজনক ব্যাখ্যান আমাদের জানা ছিল না। আধুনিক ইলেক্ট্রন সিদ্ধান্ত দ্বারা এই ব্যাপারটারও কারণ নির্দ্দেশ করা যাইতেছে। বৈজ্ঞানিকগণ বলিতেছেন, ধাতুর চিত্রে যে-সকল ইলেক্ট্রন থাকে, সকল ধাতুতে তাহাদের সংখ্যা সমান দেখা যায় না। সীসক (Lead) এবং বিস্‌মথ্ উভয়ই ধাতু পদার্থ, কিন্তু তাহাদের ভিতরকার ইলেক্ট্রনের সংখ্যা হিসাব করিতে গেলে দেখা যায়, বিস্‌মথের কোন নির্দ্দিষ্ট অংশে যে পরিমাণ ইলেক্ট্রন আছে, সীসাতে ঠিক তাহার দ্বিগুণ পরিমাণ বর্ত্তমান থাকে। বৈজ্ঞানিকগণ ধাতুমধ্যস্থ ইলেক্ট্রনের সংখ্যার এই অসমতাকেই তাপজ বিদ্যুতের কারণ বলিয়া নির্ণয় করিয়াছেন।

 মনে করা যাউক, যেন একটি বিস্‌মথের দণ্ড এবং আর একটি সীসকের দণ্ড জোড়া দিয়া তাহাদের সন্ধিস্থলে তাপ দেওয়া যাইতেছে। এই ব্যবস্থায় বিস্‌মথ হইতে সীসকের দিকে এক সুস্পষ্ট বিদ্যুৎ প্রবাহ চলিতে দেখা যাইবে। বৈজ্ঞানিকগণ ইহার ব্যাখ্যানে বলিতেছেন, সীসাতে ইলেক্ট্রনের সংখ্যা বিস্‌মথের তুলনায় অনেক অধিক থাকে, কাজেই তাপসংযোগে সেগুলি অত্যন্ত বেগবান হইয়া এবং উত্তপ্ত সন্ধিস্থল অতিক্রম করিয়া বিস্‌মথের দিকে ধাবমান হয়। ইহাতে সীসক হইতে বিস্‌মথের দিকে ঋণাত্মক তাড়িতপূর্ণ ইলেক্ট্রনের প্রবাহ চলিতে আরম্ভ করে; আমরা বাহির হইতে এই ঋণাত্মক প্রবাহকেই বিস্‌মথ্ হইতে সীসার দিকে চালিত বিপরীতমুখী ধনাত্মক তড়িতের প্রবাহরূপে দেখিতে পাই।

 দুইটি পৃথক্ ধাতুকে পূর্ব্বোক্ত প্রকারে জুড়িয়া তাহাদের সন্ধিস্থলের ভিতর বিদ্যুৎ প্রবাহ চালাইতে থাকিলে কখনও সন্ধিস্থল গরম এবং কখনও শীতল হইয়া পড়ে। মনে করা যাউক, পূর্ব্বোক্ত উদাহরণে বিস্‌মথ হইতে সীসার দিকে যেন প্রবাহ চালানো যাইতেছে। পরীক্ষা করিয়া দেখিলে স্পষ্টই বুঝা যাইবে, সন্ধিস্থল গৱম হইয়া উঠিয়াছে। কিন্তু প্রবাহটিকে বিস্‌মথ্ হইতে সীসকের দিকে না চালাইয়া, যদি তাহাকে গুরুভারবিশিষ্ট সীসক হইতে বিস্‌মথের দিকে চালানো যায়, তবে উহারই ঠিক্ বিপরীত ফল দেখা যাইবে;—এই অবস্থায় সন্ধিস্থল অপর অংশের তুলনায় স্পষ্ট শীতল হইয়া পড়িবে। বিদ্যুৎপ্রবাহে যুগ্ম ধাতুর এই প্রকার কার্য্যের কথা বহু দিন হইতে আমাদের জানা আছে; বৈজ্ঞানিকগণ ইহাকে Pelfier Effer1 নাম দিয়াই এ পর্য্যন্ত তৃপ্ত ছিলেন। ব্যাপারটির কারণ নির্দ্দেশ করিবার জন্য চেষ্টার ত্রুটি হয় নাই, কিন্তু এ পর্য্যন্ত এ সম্বন্ধে যে-সকল ব্যাখ্যান প্রদত্ত হইয়াছে, তাহাদের কোনটিকেই সন্তোষজনক বলিয়া মনে হয় নাই। যাহা হউক, ইলেক্ট্রনের সাহায্যে ধাতুপদার্থের এই বিশেষত্বটিরও এক ব্যাখ্যান পাওয়া যাইতেছে। বৈজ্ঞানিকগণ বলিতেছেন, আমরা যখন সীসক এবং বিস্‌মথের ভিতর দিয়া বিদ্যুৎ প্রবাহ চালনা করি, তখন প্রকৃত প্রস্তাবে বিস্‌মথের ইলেক্ট্রনগুলিকে জোর করিয়া যেন সীসকের ইলেক্ট্রনের সহিত মিশাইতে থাকি। কাজেই ফুটবলের থলির ভিতরে জোরে বাতাস পম্প্ করিলে যেমন বল্ গরম হইয়া উঠে, এখানেও জোরে বিস্‌মথের ইলেক্ট্রন সীসাতে প্রবেশ করায় সন্ধিস্থল গরম হইয়া উঠে। এখন মনে করা যাউক যেন প্রবাহটিকে সীসক হইতে বিস্‌মথের দিকে চালানো যাইতেছে। আমরা পূর্ব্বেই বলিয়াছি, সীসক জিনিষটা বিস্‌মথ্ অপেক্ষা গুরু, কাজেই ইহাতে ইলেক্ট্রনের সংখ্যা বিস্‌মথের তুলনায় অনেক অধিক থাকে। সুতরাং সীসক হইতে বিস্‌মথের দিকে বিদ্যুৎ পরিচালনা করায় সীসকেরই ইলেক্ট্রন্‌ভাণ্ডার ক্রমে শূন্য হইতে থাকে এবং পূর্ব্বে যে স্থানে বহু ইলেক্ট্রন্‌ জড় হইয়াছিল, তাহা এখন শূন্য স্থান পাইয়া ফাঁপিয়া দাঁড়াইতে আরম্ভ করে। আবদ্ধ স্থানের বায়ব বস্তুকে হঠাৎ ফাঁপিয়া উঠিবার অবকাশ দিলে, জিনিষটার তাপ আপনা হইতেই কমিয়া আসে। কাজেই সীসকের ইলেক্ট্রন্‌গুলি পরস্পর বিচ্ছিন্ন হইয়া প্রসারিত হওয়ায় এখানেও তাপের মাত্রা কমিয়া যায়।

 পদার্থের অণুপরমাণুগুলি অতীন্দ্রিয় বস্তু হইলেও বৈজ্ঞানিকগণ নানা কৌশলে তাহাদের আয়তন এবং গুরুত্বাদি নির্ণয় করিয়াছেন। ইলেক্ট্রন্‌-সিদ্ধান্তের সাহায্যে ধাতুর অণুপরমাণুর আয়তনাদি সম্বন্ধে নূতন করিয়া পরিচয় স্থাপনের সুবিধা হইয়াছে। পূর্ব্বে তাপজাত বিদ্যুতের (Thermo-Electricity) উৎপত্তিপ্রসঙ্গে যে ইলেক্ট্রনের প্রবাহের কথা বলা হইয়াছে, তাহার সাহায্যে প্রত্যেক পরমাণুতে কতকগুলি করিয়া মুক্ত ইলেক্ট্রন্ আছে তাহা হিসাব করিয়া নির্ণয় করা হইতেছে। এবং তার পর বিদ্যুৎ পরিবাহনের (Electric Conduction) নব সিদ্ধান্তের সাহায্যে সমবেত ইলেক্ট্রনের সংখ্যা জানিয়া লইয়া ধাতুর কোন নির্দ্দিষ্ট স্থানে কতগুলি পরমাণু রহিয়াছে নির্ণয় করিতে পারিলে প্রত্যেক পরমাণুর আয়তন নির্ণয় করা কঠিন হয় না। কাজেই প্রত্যেক ঘন ইঞ্চ্ স্থানে কতগুলি পরমাণু আছে জানিয়া লইয়া প্রত্যেক পরমাণুর আয়তনও স্থির করা হইতেছে।

 কাচ, জল, বায়ু প্রভৃতি অল্পাধিক পরিমাণে স্বচ্ছ, কিন্তু কোন ধাতুই স্বচ্ছ নয়। ইলেক্ট্রন্‌-সিদ্ধান্ত দ্বারা ধাতুর এই বিশেষ ধর্ম্মটিরও ব্যাখ্যান পাওয়া যাইতেছে। ধাতুর রন্ধ্রস্থ মুক্ত ইলেক্ট্রন্‌ই ধাতুকে অস্বচ্ছ করে বলিয়া বৈজ্ঞানিকগণ সিদ্ধান্ত করিতেছেন। ধাতুর উপরে আলোকপাত হইলেই ইলেক্ট্রন্‌গুলি আলোকতরঙ্গ শোষণ করিয়া লয়। যখন ধাতুকে পিটিয়া খুব সুক্ষ্ম পাতে পরিণত করা যায়, তখনই কেবল এক-একটু আলোক ধাতু ভেদ করিয়া বাহিরে আসিতে পারে। স্বর্ণের সূক্ষ্ম পাতের ভিতর দিয়া যে আলোক বাহিরে আসে তাহা সবুজ, নূতন সিদ্ধান্তীরা বলিতেছেন, এস্‌রাজ্ বা সেতারের তার বিশেষ বিশেষ সুরে বাঁধিয়া রাখিলে তাহারা নাড়া পাইলে যেমন সেই সকল বাঁধা সুর ব্যতীত অপর সুর ধ্বনিত করিতে পারে না, সেইপ্রকার বিশেষ বিশেষ ধাতুর রন্ধ্রে আবদ্ধ ইলেক্ট্রনগুলি এক একটি বিশেষ আলোকতরঙ্গ ব্যতীত অপর তরঙ্গে সাড়া দিতে পারে না। স্বর্ণের রন্ধ্রগত ইলেক্ট্রন্ কেবল সবুজ রঙের উৎপাদক তরঙ্গেই সাড়া দেয়; কাজেই সোণার পাতের ভিতর দিয়া যে আলোক আসে, তাহা সবুজ। নানা জ্বলন্ত ধাতুর বর্ণচ্ছত্রে (Spectrum) কেন কতকগুলি নির্দ্দিষ্ট বর্ণরেখার প্রকাশ হয়, পূর্ব্বোক্ত তত্ত্বটি অবলম্বন করিয়া বৈজ্ঞানিকগণ তাহার মীমাংসা করিতেছেন। তাছাড়া আলোকরশ্মির সমতলীভবন (Polarisation of Light) ইত্যাদি অনেক জটিল প্রাকৃতিক ব্যাপারের কারণ ইলেক্ট্রন্-সিদ্ধান্ত দ্বারা বুঝা যাইতেছে। কিন্তু এই জটিল বিষয়গুলির ব্যাখ্যানও এত জটিল যে, সেগুলির উল্লেখমাত্র করিয়া এখানেই আমাদিগকে নিরস্ত হইতে হইল।