বর্ণচ্ছত্র

শুভ্রালোকবিশ্লেষণজাত বর্ণবৈচিত্র্য আমরা জগতে সর্ব্বদাই দেখিতে পাই। রামধনুর অপূর্ব্ব বর্ণবিন্যাসে ও পত্রপ্রান্তসংলগ্ন শিশির বিন্দুতে বালসৌরকিরণের অদ্ভুত বর্ণচ্ছটা সকলই ইহার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এই ত গেল স্বভাবের কথা,—কৃত্রিম উপায়েও আমরা সহজে আলোক-বিশ্লেষণ দেখিতে পারি। ত্রিকোণ কাচফলকের মধ্য দিয়া, সাধারণ শুভ্রালোক আসিতে দিলে, ইহা মৌলিক বর্ণে বিশ্লিষ্ট হইয়া উজ্জ্বল লোহিত পীতাদি বর্ণযুক্ত একটি অপূর্ব দৃশ্য রচনা করে,—বৈজ্ঞানিকেরা ইহাকেই Spectrum, বর্ণচ্ছত্র বলিয়া থাকেন। ঝাড় দেওয়ালগিরি-লম্বিত বহুকোণযুক্ত কাচফলকগুলি দ্বারা কোন পদার্থ দেখিলে, এই জন্যই ইহা নানা বিচিত্র বর্ণে রঞ্জিত দেখা যায়। ত্রিকোণ কাচফলকের এই বর্ণবিশ্লেষণী শক্তির কথা বালকবৃদ্ধ সকলেই অবগত আছেন। বাল্যকালে উৎসবের সময় দেয়ালগিরিচ্যুত দুই একখানি কাচ সংগ্রহ ইচ্ছায়, তৈলগন্ধামোদিত ক্ষুদ্র ফরাস-গৃহে ভৃত্যগণের সহিত কিছু অধিক বন্ধুত্ব স্থাপনের চেষ্টায় নানা মিষ্টান্ন ঘুষ দিয়া পরে একখানি ভগ্ন কাচ লাভের কথা আজও স্মরণ আছে। এই কাচ দ্বারা অপূর্ব্ব বর্ণময় একটা নূতন সংসার দেখিয়া, বোধ হয় তখনকার জন্য অকৃতজ্ঞ ভৃত্যের উৎকোচলিপ্সা ও উৎসবের সকল আমোদের কথা একবারে ভুলিয়াছিলাম। প্রবীণ বৈজ্ঞানিকদের নিকটেও এই ক্ষুদ্র কাচখণ্ডের কম আদর নয়। বালক ইহা দ্বারা পার্থিক পদার্থের বিবিধ উজ্জ্বল বর্ণের সমাবেশ দেখিয়া আহ্লাদিত হয়,—বৈজ্ঞানিক কোটি যোজনস্থিত ক্ষুদ্র নক্ষত্রের গঠনোপাদান ও গতিবৈচিত্র্য নির্দ্ধারণ করিয়া ও অতীন্দ্রিয় নক্ষত্রমালার নিখুঁৎ ছবি তুলিয়া দৃষ্টির অনন্ত প্রসারতায় বিমুগ্ধ হন। অল্পায়াসেই ত্রিকোণ কাচ সংগ্রহ করিয়া যথেষ্ট আলোক বিশ্লেষণ করিতে পারা যায়, এজন্য অপরাপর বৈজ্ঞানিক যন্ত্রের ন্যায়, বর্ণচ্ছত্র দেখিবার জন্য জটিল যন্ত্র নির্ম্মাণের কোনই আবশ্যক হয় না। কেবল এই ক্ষুদ্র কাচখণ্ডের সাহায্যে আজকাল যে-সকল অভাবনীয় আবিষ্কার হইতেছে, তাহার হিসাবে, আধুনিক বিজ্ঞানে এই সামান্য যন্ত্রটি অমুল্য বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। কেবলমাত্র আলোক-বিজ্ঞানে নয়, বর্ণচ্ছত্র দ্বারা বিজ্ঞানের সকল শাখাতেই নানা অভিনব তত্ত্ব আবিষ্কৃত হইতেছে। আধুনিক রসায়নবিৎ পণ্ডিতগণ বর্ণচ্ছত্রের পরীক্ষা দ্বারা পদার্থের প্রকৃতি নির্ণয় করিতেছেন এবং অল্পদিনের মধ্যে এই উপায়ে কয়েকটি সম্পূর্ণ অপরিজ্ঞাত মৌলিক পদার্থের অস্তিত্ব আবিষ্কার করিয়াছেন। এতদ্ব্যতীত পদার্থ-বিশ্লেষণের পরিজ্ঞাত উপায়গুলির মধ্যে, বর্ণচ্ছত্র পরীক্ষার প্রথাই (Spectrum Analysis), অতি সূক্ষ্ম ও সরল উপায় বলিয়া নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে।

 জড়বিজ্ঞানের ইতিহাস পর্য্যালোচনা করিলে দেখিতে পাওয়া যায়, ইহার প্রত্যেক শাখাপ্রশাখার পূর্ণতার জন্য অনেক পণ্ডিতের বহুকালব্যাপী অনুসন্ধান ও গবেষণার আবশ্যক হইয়াছে। একজনের আজীবন পরিশ্রম দ্বারা কোন বিজ্ঞানই উন্নতির উর্দ্ধ সোপানে পৌঁছে নাই। আলোক বিজ্ঞান ও বর্ণচ্ছত্রের ইতিহাসে এ নিয়মের ব্যভিচার হয় নাই। অনেক খ্যাতনামা বিজ্ঞানাচার্য্যের অবিচ্ছিন্ন অধ্যবসায় ও পরিশ্রমের ফলে আলোক বিজ্ঞানের আজ এই উন্নতি হইয়াছে,—তবে তাড়িৎ-বিজ্ঞানাদির পরিণতি হইতে যেমন অধিক সময় লাগিয়াছে, সৌভাগ্যক্রমে বর্ণচ্ছত্রের উন্নতির জন্য তত সময়ের আবশ্যক হয় নাই। আলোক-বিশ্লেষণ দ্বারা জটিল যৌগিক পদার্থের প্রকৃতি নির্ণয়ের কথা ত্রিশ বৎসর পূর্ব্বে কোন রসায়নবিং পণ্ডিত কল্পনাই করিতে পারেন নাই, কিন্তু আজ কেবল বর্ণচ্ছত্রের সাহায্যে পার্থিব পদার্থ ত দূরের কথা, সূর্য্য ও বহুদূরস্থিত নক্ষত্রাদির গঠন উপাদান এবং চিররহস্যময় ছায়াপথের প্রকৃত তথ্য স্থিরীকৃত হইতেছে।

 বর্ণচ্ছত্রের আদিম ইতিহাস পর্য্যালোচনা করিতে হইলে, সার আইসাক্ নিউটনের কথা প্রথমেই আসিয়া উপস্থিত হয়। সাধারণ শুভ্রালোক যে, রামধনুস্থ কয়টি মূল বর্ণের সমষ্টি, তাহা নিউটনই খৃষ্টীয় ১৬৭৫ অব্দে সর্ব্বপ্রথম প্রচার করেন। একটি অন্ধকার গৃহে ক্ষুদ্র ছিদ্র দ্বারা সূর্য্য-কিরণ প্রবিষ্ট করাইয়া পরে পূর্ব্ববর্ণিত ত্রিকোণ কাঁচসাহায্যে আলোক বিশ্লিষ্ট করিয়া, লোহিত পীত বেগুনিয়া ইত্যাদি কয়েকটি বর্ণচ্ছত্র অর্থাৎ বর্ণশ্রেণী ইনিই সর্ব্বপ্রথমে বিজ্ঞানের আয়ত্তীভূত করিয়াছেন। কিন্তু বিশুদ্ধ বর্ণচ্ছত্র প্রাপ্তির কৌশল এবং রশ্মি সকলের বাঁকিবার পরিমাণ, সে সময় সম্পূর্ণ অপরিজ্ঞাত ছিল, এজন্য নিউটনের পাতিত বর্ণচ্ছত্রে সমগ্র মৌলিক বর্ণ দেখা যায় নাই। ইহা দ্বারা কেবল দুই বা ততোধিক বর্ণ মিলিয়া একটি অবিচ্ছিন্ন ও মিশ্র বর্ণচ্ছত্র রচিত হইয়াছিল মাত্র। যাহা হউক, শুভ্রালোক যে, কয়েকটি মৌলিক বর্ণের সমষ্টি তাহা নিউটনই সর্ব্বপ্রথম প্রচার করেন, এবং বর্ণচ্ছত্রের বর্ণগুলি একখানি স্থূলমধ্য কাচের (Double convex lens) সাহায্যে একত্র করিয়া পুনরায় শ্বেতালোক উৎপাদন দ্বারা তাহা প্রত্যক্ষ দেখাইয়াছিলেন। কিন্তু নিউটন অবলম্বিত উপায়ে অবিমিশ্র বর্ণচ্ছত্র রচনা অসম্ভব বলিয়া, সৌর বর্ণচ্ছত্রের প্রধান লক্ষণ প্রসিদ্ধ কৃষ্ণরেখাগুলি সে সময় আবিষ্কৃত হয় নাই।

 বর্ণচ্ছত্র দ্বারা আজ কাল যে-সকল অদ্ভুত কার্য্য সাধিত হইতেছে, তাহা বুঝিতে হইলে আলোক কি প্রকারে বিশ্লিষ্ট হয়, তাহা মোটামুটি জানা আবশ্যক। আধুনিক পণ্ডিতগণ বলেন, শুভ্রালোকের উপাদান মূল বর্ণগুলির প্রকৃতি সমান নয়। প্রত্যেক বর্ণ, বিশ্বব্যাপী ঈথর নামক পদার্থের কম্পনজাত এক একটি নির্দ্দিষ্ট তরঙ্গ দ্বারা উৎপন্ন হয়। এই তরঙ্গের দৈর্ঘ্য বর্ণচ্ছত্রের লোহিতাংশেই সর্ব্বাপেক্ষা অধিক এবং লোহিত হইতে বর্ণানুক্রমে কমিতে কমিতে ভায়লেটৃ অংশে ইহা অত্যন্ত অল্প হইতে দেখা যায়; গণনা করিলে লোহিতের তরঙ্গ-দৈর্ঘ্য ভায়লেট তরঙ্গের প্রায় দ্বিগুণ হইয়া পড়ে। যদিও মৌলিক বর্ণগুলির তরঙ্গদৈর্ঘ্যের এই প্রকার পার্থক্য লক্ষিত হয়, কিন্তু কোন নির্দ্দিষ্ট পদার্থ মধ্যে ইহাদের গতি একই থাকে না, এজন্য তরঙ্গের দৈর্ঘ্যহিসাবে ঈশ্বরকণার কম্পন-পরিমাণের হ্রাসবৃদ্ধি হইতে দেখা যায় এবং দীর্ঘ তরঙ্গযুক্ত বর্ণের কম্পন-সংখ্যা ক্ষুদ্র তরঙ্গযুক্ত বর্ণের কম্পন-পরিমাণ অপেক্ষা অল্প হইয়া থাকে। এই কারণে লোহিতাদি বর্ণ অপেক্ষা ভায়লেট দ্বারাই ঈথরকণা সকল অতি দ্রুত কম্পিত হয়। বিজ্ঞানানুরাগী পাঠকপাঠিকাগণ জানেন, আলোক রশ্মি কোন এক নির্দ্দিষ্ট স্বচ্ছ পদার্থ দিয়া গমনকালে, সকল সময়েই সরল পথ অবলম্বন করিয়া থাকে। একটি অন্ধকার গৃহের জানালার ছিদ্র দিয়া সূর্য্যকিরণ প্রবেশ করাইয়া, বায়ুতে ভাসমান ধূলিকণা দ্বারা রশ্মিপথ সহজেই পরীক্ষা করা যাইতে পারে। কিন্তু উক্ত নির্দ্দিষ্ট পদার্থ ত্যাগ করিয়া, গাঢ় বা তরলতর আর একটি নূতন পদার্থে প্রবেশ করিতে আরম্ভ করিলে রশ্মিসকল পূর্ব্ব-অবলম্বিত সরল পথানুক্রমে চলিতে পারে না, এই দুই পদার্থের সন্ধিস্থলে আসিয়া ইহাদের পথপরিবর্ত্তন হয় এবং পদার্থের গাঢ়তা হিসাবে বাঁকিয়া নূতন পথানুক্রমে চলিতে হয়। এতদ্ব্যতীত আলোকপথ বাঁকিবার আরো কয়েকটি নির্দ্দিষ্ট নিয়ম আছে, বর্ত্তমান প্রবন্ধে সকল গুলির বিবরণ অনাবশ্যক।

 আলোকপথ-পরিবর্ত্তনের কোন পরিমাণ নির্দ্দিষ্ট নাই, একই রশ্মি অবস্থাভেদে নানা পথে চলিতে পারে। আলোকবাহক (Medium) পদার্থগুলি সমান থাকিলে, রশ্মি সকল কোন পদার্থ হইতে গাঢ়তর পদার্থে বক্রভাবে প্রবেশ করিয়া যে নূতন পথ অনুসরণ করে, পরীক্ষা করিলে তাহাকে আলোকবাহক পদার্থদ্বয়ের সন্ধিতলস্থ লম্বের সহিত প্রায় এক সরল রেখায় দেখা যায়, কিন্তু গাঢ় পদার্থ হইতে তরলতর পদার্থে প্রবেশ করিলে ইহার ঠিক বিপরীত ফল লক্ষিত হয়,—এস্থলে নূতন আলোকপথ উক্ত লম্ব হইতে দূরে গিয়া সন্ধিভূমির সহিত এক সমতলস্থ হইবার চেষ্টা করে। সকল আলোক-পথ পরিবর্ত্তনই এই দুইটি স্থূল নিয়ম দ্বারা সাধিত হয়। যদি কোন দুইটি স্বচ্ছ পদার্থের সন্ধিভুমিদ্বয় পরস্পর সমান্তরাল হয়, তাহা হইলে পূর্ব্বোক্ত নিয়ম প্রয়োগ করিলে দেখা যায় আলোক-পথ ভূমিদ্বয়ে দুইবার বাঁকিয়া, ইহার পূর্ব্ব পথের সহিত ঠিক্ সমান্তরাল হইয়া বাহির হইয়া আসিতেছে। কিন্তু ত্রিকোণ কাচফলকের মধ্যে সমান্তরাল ভূমি নাই, এজন্য আলোক-পথ ভুমিদ্বয়ে দুইবার বাঁকিয়া গিয়া, পরস্পর বিচ্ছিন্ন হইতেই চেষ্টা করে, সমান্তরাল হইবার কোনই সম্ভাবনা থাকে না। ত্রিকোণ কাচফলকের গঠনে এই বিশেষত্ব আছে বলিয়া ইহা দ্বারা আলোক বিশ্লেষণ হইয়া থাকে। নিউটনপ্রমুখ পণ্ডিতগণ রশ্মিপথের এই জটিল পরিবর্ত্তনের নানা কারণ উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন। কিন্তু প্রাচীন সিদ্ধান্ত ভ্রান্ত বলিয়া প্রমাণিত হওয়ায়, আধুনিক পণ্ডিত-সমাজে ইহা অগ্রাহ্য হইয়াছে এবং গাঢ় পদার্থ অপেক্ষা তরল স্বচ্ছ পদার্থে আলোকের গতি দ্রুত হওয়াই রশ্মিপথ বাঁকিবার একমাত্র কারণ বলিয়া আজ কাল নির্দ্দিষ্ট হইয়া থাকে।

 এতদ্ব্যতীত আলোক-পথের পরিবর্ত্তনে আরো দুই একটি ঘটনা দেখিতে পাওয়া যায়। রশ্মিপুঞ্জ পদার্থদ্বয়ের সন্ধিতল ঠিক লম্বভাবে ভেদ করিয়া পদার্থান্তরে প্রবিষ্ট হইলে ইহার পথের কোনই পরিবর্ত্তন হয় না, যে সকল রশ্মি তির্য্যগ্‌ভাবে প্রবিষ্ট হয় তাহাদেরই কেবল পথ পরিবর্ত্তন হইয়া থাকে। পূর্ব্বেই বলা হইয়াছে, পদার্থান্তরে প্রবেশ দ্বারা আলোকের গতি পরিবর্ত্তিত হয় বলিয়া আলোক-পথেরও পরিবর্ত্তন হয়। আলোকরশ্মিমাত্রেই এই নিয়মের অধীন, কিন্তু পদার্থান্তরে প্রবেশকালে লম্ব রশ্মিপুঞ্জস্থ প্রত্যেক রশ্মির গতি এককালে পরিবর্ত্তিত হয় বলিয়া আলোক-পথের পরিবর্ত্তন দেখা যায় না। কিন্তু রশ্মিসকল তির্যগ্‌ভাবে প্রবেশ করিলে আলোকতরঙ্গের সকল অংশ এক কালে ভিন্ন পদার্থে প্রবেশ করে না। তরঙ্গের যে অংশ প্রথম সন্ধিতল স্পৃষ্ট হয়, তাহাই কেবল পৃথক্ গতিতে চলিতে থাকে এবং কিছুকালের জন্য তরঙ্গের অবশিষ্টাংশের গতি পূর্ব্ববৎ থাকিয়া যায়। এই প্রকারে একই আলোকতরঙ্গের বিভিন্নাংশ যুগপৎ ধীর ও দ্রুত গতিতে চলে বলিয়া, সমগ্র তরঙ্গ ঐ পদার্থ মধ্যে প্রবিষ্ট হইলে পূর্ব্বের গতিবৈচিত্র হেতু আলোকতরঙ্গ ভিন্নপথাবলম্বী হয়, এবং ইহারই ফলে পথ-পরিবর্ত্তন সাধিত হয়।

 আলোক-পথপরিবর্ত্তন বুঝিবার জন্য, প্রায় সকল বিজ্ঞানগ্রন্থেই একটি সুন্দর উদাহরণ দেখা যায়। এটি বুঝিলে বিষয়টি অপেক্ষাকৃত সহজবোধ্য হইতে পারে। ইহাতে রশ্মিসকল একদল চলিষ্ণু সৈন্যের সহিত এবং সৈন্যশ্রেণীকে আলোকতরঙ্গের সহিত তুলনা করা হইয়া থাকে। সৈন্যদল সরল পথানুক্রমে এক গতিতে ও সমপদক্ষেপে অগ্রসর হইয়া যেমন সম্মুখবর্ত্তী জলাশয় পদব্রজে পার হয় এবং প্রত্যেক সৈন্যশ্রেণী জলপ্রবিষ্ট হইবামাত্র জলের বাধা অতিক্রমণার্থে যেমন ইহার গতি হ্রাস করে, আলোকরশ্মির গাঢ়তর পদার্থে প্রবেশকালে কতকটা এই প্রকারই ঘটিয়া থাকে। সৈন্যদল সরল পথানুক্রমে আসিয়া লম্বভাবে জলপ্রবিষ্ট হইলে, প্রত্যেক সৈন্যশ্রেণী একই সময়ে জলপ্রবিষ্ট হয় এবং ইহার গতি এককালে সমভাবে পরিবর্ত্তিত হয়। কাজেই ইহা দ্বারা সৈন্যদলের গমনপথের কোনই পরিবর্ত্তন দেখা যায় না এবং শ্রেণী ভঙ্গও হয় না। কিন্তু ইহারা তির্য্যগ ভাবে আসিয়া জলাশয় পার হইতে আরম্ভ করিলে, একই শ্রেণীর কতক সৈন্যকে ধীরপদে জল পার হইতে এবং ইহার অপরাংশকে দ্রুতপদে স্থলভাগ অতিক্রম করিতে দেখা যায়। এই প্রকারে একই শ্রেণীর বিভিন্ন অংশ এক সময়ে পৃথক গতিতে অগ্রসর হওয়ায় পূর্ব্বপথের বৈলক্ষণ্য হয়। একটু ভাবিলে স্পষ্টই প্রতীয়মান হইবে, আলোকপথ-পরিবর্ত্তনও অবিকল এই প্রকারে সংঘটিত হইয়া থাকে।

 এই ত গেল আলোকপথ-পরিবর্ত্তনের স্থূল ও সাধারণ নিয়ম; কোন এক নির্দ্দিষ্ট মৌলিক বর্ণ-রশ্মি অর্থাৎ বর্ণচ্ছত্রস্থ লোহিত পীতাদির মধ্যে কোন একটি বর্ণ বাছিয়া লইয়া পরীক্ষা করিলে ঠিক পূর্ব্ববর্ণিত ফল দেখা যাইবে। কিন্তু বর্ণচ্ছত্রস্থ প্রত্যেক বর্ণ লইয়া পরীক্ষা করিলে, ইহাদের প্রত্যেকের পথপরিবর্ত্তনের পরিমাণ মধ্যে কোনই একতা লক্ষিত হইবে না। কোন বর্ণের পথ অধিক, কোনটির বা অল্প বাঁকিয়াছে দেখা যাইবে। এই মৌলিক বর্ণগুলির পথ পরিবর্ত্তনেরও এক নিয়ম আছে। পরীক্ষা দ্বারা দেখা গিয়াছে, বর্ণরশ্মির তরঙ্গের ক্ষুদ্রতা হিসাবে, ইহাদের বাঁকিবার শক্তি বৃদ্ধি পায়, অর্থাৎ ক্ষুদ্রতরঙ্গযুক্ত বর্ণের আলোকপথ বৃহৎ-তরঙ্গযুক্ত বর্ণ অপেক্ষা অধিক বাঁকিয়া যায়। মৌলিক বর্ণগুলির এই এই প্রকার পৃথক বাঁকিবার শক্তি থাকায় বর্ণচ্ছত্রের বিকাশ হয়, অন্যথা বর্ণচ্ছত্র রচনা অসম্ভব হইয়া পড়িত। আমরা শুভ্রালোক ত্রিকোণ কাচ-ফলকের মধ্য দিয়া আনিয়া, শুভ্রালোকস্থ ভিন্ন প্রকৃতির মৌলিক বর্ণগুলিকে পৃথক পৃথক ভাবে বাঁকিবার সুযোগ প্রদান করি। ভায়লেটের রশ্মিতরঙ্গ সর্ব্বাপেক্ষা ক্ষুদ্র বলিয়া, ইহা দ্বারা এগুলি অত্যন্ত বাঁকিয়া কাচ হইতে বাহির হয় এবং দীর্ঘ তরঙ্গশীল লোহিত অল্পই বাঁকিয়া আইসে। এজন্য শুভ্রালোক হইতে লোহিত ও ভায়লেট স্বর্ণ বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়ে, এবং এতদুভয়ের মধ্যবর্ত্তী বর্ণগুলিরও উক্ত অবস্থা ঘটে; ইহাদের তরঙ্গদৈর্ঘ্য পরস্পর সমান নয় বলিয়া, ইহারাও পরস্পর বিচ্ছিন্ন হইয়া, লোহিত ও ভায়লেটের মধ্যবর্ত্তী স্থানে তরঙ্গ-দৈর্ঘ্যানুসারে সজ্জিত হইয়া প্রকাশিত হয়। সাধারণ শুভ্রালোক এই প্রকারেই বিশ্লিষ্ট হইয়া লোহিতাদি সপ্ত মৌলিক বর্ণযুক্ত উজ্জ্বল সুপ্রশস্ত বর্ণচ্ছত্র রচনা করে।