প্রাকৃতিকী/বাবিলোনীয় জ্যোতিষিগণ
বাবিলোনীয় জ্যোতিষিগণ
য়ুরোপীয় প্রাচীন-লেখকগণ বাবিলোনীয়দিগকে জ্যোতিষশাস্ত্রের প্রবর্ত্তয়িতা বলিয়া লিপিবদ্ধ করিয়াছেন। তৎপরবর্ত্তী অপেক্ষাকৃত আধুনিক লেখকগণও প্রাচীনদিগের পদাঙ্কানুসরণ করিয়া জ্যোতির্বিদ্যাপ্রতিষ্ঠার উচ্চাসন বাবিলোনীয়দিগকে দিয়া আসিতেছেন। কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে ইঁহারা এই উচ্চ সম্মানের উপযুক্ত পাত্র কি না, তাহা বড় কেহ এ পর্য্যন্ত অনুসন্ধান করেন নাই, এবং অনেকেই প্রাচীন লেখকদের বিরুদ্ধে প্রশ্ন উত্থাপন না করিয়া পুরাতন মত অভ্রান্ত বলিয়া গ্রহণ করিয়া আসিতেছেন। সম্প্রতি কয়েকটি পাশ্চাত্য পণ্ডিত প্রাচীনগণের যুক্তিহীন কথায় সম্পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন না করিয়া জ্যোতিষশাস্ত্রের আমূল ইতিহাস যথাসম্ভব পর্য্যালোচনা করিতে আরম্ভ করিয়াছেন, এবং এই প্রসঙ্গে বাবিলোনীয় জ্যোতিষের ইতিহাসও কিঞ্চিৎ প্রকাশ করিয়াছেন।
কোন্ সময়ে বাবিলনে প্রথম জ্যোতিষ-চর্চ্চা আরম্ভ হয় তাহা আজও ঠিক নির্দ্ধারিত হয় নাই, এবং কোন সময়ে হইবে কি না সে বিষয়েও বিশেষ সন্দেহ বর্ত্তমান। প্রাচীন গ্রন্থাদি অনুসন্ধান করিলে দুই এক স্থানে ইহার উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায় বটে, কিন্তু তদ্বারা অভ্যুদয়-কালনিরূপণের কোনই সহায়তা হয় না। কারণ, এই সকল গ্রন্থাদিতে লিপিবদ্ধ কালে প্রায়ই একতা লক্ষিত হয় না এবং একাধিক গ্রন্থলিখিত, একই ঘটনার বিবরণ-মধ্যে অনেক সময়েই নানা পার্থক্য দেখা গিয়া থাকে; কাজেই এই প্রকার বিভিন্ন প্রকৃতির গ্রন্থের মধ্যে কোনটি প্রকৃত তাহা এখন নির্দ্দেশ করা প্রকার অসম্ভব হইয়া দাঁড়াইয়াছে, এবং অন্য উপায়ে নিরূপিত কাল ও বিবরণের উপরও সন্দেহ হইতেছে। আধুনিক পণ্ডিতগণ অনুমান করেন, বেলস্ নামক সুবিখ্যাত নৃপতির রাজত্বকালে জ্যোতিষ-চর্চ্চ বাবিলনে প্রথম আরম্ভ হয়। বেলস্ একজন নানাবিদ্যাপারদর্শী গুণবান নৃপতি ছিলেন, ইঁহার রাজত্বকালে অনেক জ্যোতিষগ্রন্থ লিখিত হইয়াছিল। যে-সকল প্রাচীন গ্রন্থ বিখ্যাত জ্যোতিষাচার্য্য বেরোসস্ লিখিত বলিয়া প্রসিদ্ধ, আধুনিক পণ্ডিতগণ বলেন, সেগুলির সমস্তই উক্ত বাবিলোনীয় নৃপতি বেলস্ প্রণয়ন করিয়াছিলেন। বেরোসস্ কেবল গ্রন্থগুলি ভাষান্তরিত করিয়াছিলেন মাত্র।
সকল শাস্ত্রের মুলে প্রায়ই কতকগুলি অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের সমষ্টি দেখিতে পাওয়া যায়। মানুষ এই সকল বিশ্বাসের বশবর্ত্তী হইয়া সংসারে কাজ করিতে আরম্ভ করে। কিন্তু কেবল বিশ্বাস দ্বারা কাজ করা শীঘ্রই তাহাদের পক্ষে অসম্ভব হইয়া দাঁড়ায়। তাহারা স্বতঃই একটি দৃঢ় অবলম্বন খুঁজিতে আরম্ভ করে, এবং শেষে পূর্ব্ববিশ্বাসের নানা সংস্কার করিয়া ও তাহাকে নানা প্রকারে ভাঙ্গিয়া গড়িয়া অন্ধবিশ্বাসের মূলগত কারণ আবিষ্কার করে, এবং পূর্ব্বেকার ভিত্তিহীন শাস্ত্রকে সজীব ও সমূল করিয়া গড়িয়া তোলে। বাবিলোনীয় জ্যোতির্বিদ্যা পূর্ব্বোক্ত প্রকারে স্ফূর্ত্তি প্রাপ্ত হইয়াছিল। প্রথমতঃ, অধিবাসিগণ গ্রহনক্ষত্রযুক্ত আকাশমণ্ডলকে পার্থিব ঘটনাবলির অবিকল প্রতিবিম্ব বলিয়া বিশ্বাস করিত, এবং গ্রহাদির ভেদযোগ প্রভৃতি সংঘটনকালে পৃথিবী যে অবস্থায় থাকে ও যে-সকল ঘটনা ইহাতে সংঘটিত হয়, গ্রহাদি সেই সেই অবস্থায় পুনরায় উপস্থিত হইলে, তত্তৎ ঘটনা পৃথিবীতে নিশ্চয়ই লক্ষিত হইবে বলিয়া তাহাদের মনে দৃঢ় সংস্কার ছিল। জ্যোতিষশাস্ত্র দ্বারা ভবিষ্য ঘটনা জানা যায়, এ প্রকার বিশ্বাস আদিম বাবিলোনীয় জ্যোতিষিগণের মধ্যে ছিল না। পৃথিবীতে কোন একটি ঘটনা সংঘটিত হইলে, নভঃস্থ জ্যোতিষ্কগণ পরস্পর কি প্রকার অবস্থায় থাকিবে, এবং এতদুভয় মধ্যে প্রকৃত সম্বন্ধই বা কি, তাহা নির্ণয় করা উহারা শাস্ত্রের একমাত্র উদ্দেশ্য বলিয়া মনে করিতেন। এতদ্ব্যতীত ইঁহাদের মধ্যে আরও একটি বিশ্বাস অতি প্রবল ছিল। ইহারা বলিতেন,—অদ্য পৃথিবীতে যে-সকল ঘটনা প্রত্যক্ষ হইল, তিনশত ষাইট হাজার বৎসর পূর্ব্বে অবিকল সেই সকল ঘটনা পৃথিবীতে লক্ষিত হইয়াছিল, এবং ৩৬০,০০০ বৎসর পরেও ঠিক ঐ ঘটনাগুলি সংঘটিত হইবে।
জ্যোতিষিগণ কি প্রকারে গণনা করিয়া এই তিনশত ষাইট হাজার সংখ্যা প্রাপ্ত হইয়াছিলেন, সেসম্বন্ধে আধুনিক পণ্ডিতগণের মধ্যে নানা মতভেদ দেখা যায়। অনেকেই বলেন, গ্রহাদি-পরিদর্শন বা অন্য কোন নির্দ্দিষ্ট নিয়মাবলম্বনে উক্ত সংখ্যা আবিষ্কৃত হয় নাই। সেমাইট্ (Semite) ধর্ম্মশাস্ত্রোক্ত মূল সংখ্যা ছয়কে দশ (উভয় হস্তের অঙ্গুলিসংখ্যা) দ্বারা গুণ করিয়া গুণফল ৬০কে বাবিলোনীয়গণ সস্ বলিত, এবং ইহাকে আর দশ দ্বারা গুণ করিয়া লব্ধ সংখ্যা ৬০০ শত “নার্” নামে অভিহিত হইত। এই শেষোক্তসংখ্যাটি তাহাদের ধর্ম্মশাস্ত্রোক্ত ক্রিয়া-কার্য্যে সর্ব্বদা ব্যবহৃত হইত, এবং ইহা সাক্ষাৎ ঈশ্বর হইতে আগত পরিত্র সংখ্যা বলিয়া পূজ্য ছিল। ইহা হইতে আজকাল অনেকেই অনুমান করিতেছেন, এই স্বর্গীয় ও পবিত্র সংখ্যা ছয় শতের বর্গ করিয়াই সম্ভবতঃ বাবিলোনীয়গণ ৩৬০,০০০ সংখ্যায় উপনীত হইয়াছিলেন। যাহাই হউক, বাবিলনে জ্যোতিষশাস্ত্রপ্রতিষ্ঠার এই প্রথম উদ্যমের ইতিহাসে কোনই বিশেষত্ব লক্ষিত হয় না। যে-কোন জাতির আদিম ইতিবৃত্ত অনুসন্ধান করিলে পূর্ব্বোক্ত প্রকার দুই একটি সংস্কার প্রায়ই লক্ষিত হইয়া থাকে। পাশবপ্রকৃতি ঘোর অসভ্যজাতির মধ্যেও সৃষ্টিপ্রকরণাদি-সম্বন্ধে এইরূপ অনেক আজ্গুবি সিদ্ধান্ত বড় দুষ্প্রাপ্য নহে।
বাবিলনে প্রকৃত জ্যোতিষচর্চ্চার সূত্রপাত ঠিক কোন সময়ে হয় তাহার স্থিরতা নাই। আকাডিয়ান্দিগের অভ্যুদয়ের পূর্ব্বেকার অর্থাৎ খৃষ্ট-পূর্ব্ব সাত সহস্র অব্দে লিখিত যে-সকল গ্রন্থাদি প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে, তাহাতে গ্রহণাদির পূর্ণ বিবরণ ও গ্রহোপগ্রহাদির উদয়াস্ত-সম্বন্ধে নানা কথা লিপিবদ্ধ দেখিতে পাওয়া যায়। ইহা দ্বারা অনুমিত হয়, খৃঃ পূঃ সপ্ত সহস্রাব্দে বাবিলোনীয় পণ্ডিতগণ কিঞ্চিৎ জ্যোতিষশাস্ত্র জানিতেন, এবং গ্রহতারকাদির পরিদর্শন প্রথা তাঁহাদের নিকট সম্পূর্ণ অপরিজ্ঞাত ছিল না। ব্রিটিশ মিউজিয়ামে প্রাচীন বাবিলনের কয়েকখানি প্রস্তরলিপি রক্ষিত আছে, ইহার সাহায্যে জ্যোতিষশাস্ত্র-প্রতিষ্ঠার কালনিরূপণার্থে কয়েক বৎসর হইল নানাবিধ চেষ্টা হইয়াছিল এবং প্রকৃত প্রস্তাবে প্রস্তরফলকগুলি যথার্থই বাবিলনের খোদিত হইলে এই চেষ্টা ব্যর্থ হইবার কোনই কারণ থাকিত না! কিন্তু উক্ত প্রস্তরস্থ খোদিত গ্রহণাদির চিত্র ও বিবরণের মধ্যে কোনটিতেই সংঘটনকালের উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায় নাই, ইহাতে এগুলি অপ্রকৃত এবং আধুনিক সময়ে খোদিত বলিয়া সকলেই স্থির করিয়াছেন। কাজেই জ্যোতিষচর্চ্চারম্ভের প্রকৃত কালনির্ণয় অতীব দুঃসাধ্য ব্যাপার হইয়া দাঁড়াইয়াছে।
বাবিলোনীয় পণ্ডিতগণ নভঃস্থ দৃষ্টমান জ্যোতিষ্কগণকে নানা অংশে বিভক্ত করিতেন এবং এই গ্রহনক্ষত্রযুক্ত আকাশের অংশ সকল এক একটি পৃথক দেবতার নামে অভিহিত করিয়া তত্তৎ দেবতার নির্দ্দিষ্ট গুণাবলি তারকামণ্ডলিতে আরোপিত করিতেন। জ্যোতিষশাস্ত্রের এই শৈশবাবস্থায় গ্রহাদির নামকরণে পূর্ব্বোক্ত প্রথা প্রচলিত থাকায় আকাশের তাৎকালিক অবস্থার সহিত আধুনিক অবস্থার তুলনা করা বড়ই দুরূহ হইয়া পড়িয়াছে। এক এক দিগংশস্থ সকল গ্রহ তারা একই নামে অভিহিত হওয়ায় এবং কখন কখন গতিবৈচিত্রা দ্বারা একই জ্যোতিষ্ক একাধিক নামে আখ্যাত হওয়ায় প্রাচীন গ্রন্থোল্লিখিত গ্রহাদির সম্যক্ পরিচয় পাইবার আর উপায়ান্তর নাই। এতদ্ব্যতীত এক জাতীয় সাতটি করিয়া জ্যোতিষ্ক লইয়া শ্রেণী-বিভাগ দ্বারা নামকরণপ্রথা কয়েকখানি গ্রন্থে দৃষ্ট হইয়াছে। ইহার মধ্যে এক গ্রন্থে সপ্তগ্রহ ও সপ্ত যমজতারকা ডিফু ও মাসু নামে অভিহিত হইয়াছে শুনা যায়। এই গ্রন্থে নামকরণের আরও একটি অভিনব উপায় আবিষ্কৃত হইয়াছে। আকাশের যে অংশে যে জ্যোতিষ্ক অবস্থিত সেই অংশের নামানুসারে গ্রহগণের নামকরণ হইত, এবং এই প্রকার এক একটি নির্দ্দিষ্ট তারকাপুঞ্জ এক একটি নির্দ্দিষ্ট দেবতা কর্ত্তৃক রক্ষিত হইতেছে কল্পনা করিয়া উক্ত দেবতাগণকে বৎসরের নানা অংশের অধিপতিরূপে উল্লেখ করা হইত।
প্রাচীন জ্যোতিষগ্রন্থাদি পাঠ করিলে বাবিলোনীয়দিগের জ্যোতিষচর্চ্চার একটি গূঢ় কারণ দৃষ্টিগোচর হয়। আজকাল আমরা যে উদ্দেশ্যে জ্যোতিষশাস্ত্রালোচনা করি তাহাদের সেই উচ্চতর উদ্দেশ্য আদৌ ছিল না, কোন প্রকারে শুভাশুভ লক্ষণাদি জ্ঞাত হওয়াই তাহাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল। বোধ হয়, এই হীন উদ্দেশ্যে জ্যোতিষচর্চ্চা আরম্ভ হওয়া বশতঃ ইহাতে আশানুরূপ উন্নতির কোনই লক্ষণ দেখা যায় নাই। তাহাদের ক্ষুদ্র আকাঙ্ক্ষাটি পরিতৃপ্ত হইলেই তাহারা যথেষ্ট মনে করিত, এবং জ্যোতিষশাস্ত্রের সর্ব্বপ্রধান অঙ্গ গ্রহতারকাদির গতিবিধি-নির্দ্ধারণ তাহাদের নিকট একটি অনাবশ্যক বিষয় বলিয়া বিবেচিত হইত। কোন একটি আরব্ধ কার্য্যের ফলাফল স্থির করিতে হইলে বাবিলোনীয়গণ সাধারণতঃ আকাশকে আট সমানাংশে বিভক্ত করিত এবং প্রত্যেক বিভাগস্থ নক্ষত্র সকল কি অবস্থায় আছে তাহা পরিদর্শন করিয়া আবার কোন্ সময়ে জ্যোতিষ্কগণ ঠিক উক্ত প্রকার অবস্থায় ছিল, তাহা পঞ্জিকার সাহায্যে দেখিত এবং সেই অতীত কালের সংঘটিত কার্য্যাদির যে ফল হইয়াছিল, বর্ত্তমান কালেও অবিকল সেই ফল হইবে বলিয়া স্থির করিত।
মানবশিশুর মনে একটু জ্ঞানের উন্মেষ হইলেই প্রথমতঃ কাল ও স্থান, এই দুইটি জগতের চিরন্তন সামগ্রীর উপর তাহারা স্বতঃই আকৃষ্ট হইয়া পড়ে, এবং ক্রমে এই অনন্ত ও অব্যয় ভাবদ্বয়কে বুদ্ধির ক্ষুদ্র ভাবমধ্যে সীমাবদ্ধ করিয়া তাহাদের একটা স্মৃতি যাহাতে থাকিয়া যায় তাহার জন্য ঐকান্তিক চেষ্টা করে, এবং এই চেষ্টার ফলস্বরূপই সময়াদির পরিমাপের একটি স্থূল নিয়ম আবিষ্কৃত হয়। এই কারণেই বোধ হয়, সময়ের স্থূল পরিমাপবিষয়ে মহা অসভ্য জাতি হইতে সভ্যতম জাতির মধ্যেও একই নিয়ম বর্ত্তমান দেখিতে পাওয়া যায়।
প্রাকৃতিক পরিবর্ত্তনের মধ্যে ঋতুপরিবর্ত্তনটি সহজদৃশ্য ও সুবৃহৎ ব্যাপার বলিয়া বোধ হয়, ইহা দ্বারা সময়নির্দ্দেশ করিবার প্রথা সকল জাতির মধ্যেই প্রচলিত আছে। এক ঋতু হইতে আরম্ভ করিয়া সেই ঋতুর পুনরাগমন পর্য্যন্ত কালটিকে সকলেই স্থূল সময়গণনার পরিমাপদণ্ড-স্বরূপ নির্দ্দেশ করিয়া থাকেন। জ্ঞানালোকবর্জিত মহারণ্যবাসী কাফ্রির মধ্যেও কালগগনার এই নিয়মটি লক্ষিত হয়। তবে পার্থক্যের মধ্যে এই সুসভ্য জাতিগণ সূক্ষ্ম গণনা দ্বারা এই কালকে বৎসর নামে অভিহিত করিয়া গণনাকার্য্যের সুবিধার্থে বৎসরকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত করে মাত্র। বাবিলোনীয়দেরও মধ্যে পূর্ব্বোক্ত সাধারণ নিয়মে বৎসর-গণনাপ্রথা প্রচলিত ছিল। কিন্তু মাস ইত্যাদির গণনাকার্য্যে ইহাদের সহিত অন্যান্য জাতীয়-প্রথার কিছুই ঐক্য লক্ষিত হয় না; ইহারা বৎসরকে দশমাসে বিভক্ত করিত, কিন্তু ইহাদের বৎসর ঠিক কতদিনে পূর্ণ হইত তাহা জানিতে না পারায় মাসে দিনসংখ্যা কত ছিল তাহা এখন আর জানিবার যথার্থ উপায় নাই। তবে যে আজকালের মত চান্দ্রমাস প্রচলিত ছিল না সে বিষয়ে আর সন্দেহ নাই। কারণ, ত্রিশদিনে মাস গণিত হইলে দুই তিন বৎসর পরে মাসের সহিত ঋতুর একতা ক্রমে লোপ পাইয়া নানা বিভ্রাট উপস্থিত করিত। এইজন্য আধুনিক পণ্ডিতগণ অনুমান করেন, বাবিলোনীয় মাস ৩৬ দিনে পূর্ণ হইয়া দশমাসে বৎসর শেষ করিত। ঈজিপ্টের ন্যায়, প্রাচীন বারিলোনে মাসের বিশেষ কোন নাম ছিল না। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ইত্যাদি ক্রমিক সংখ্যাবাচক শব্দ দ্বারা মাসের পরিচয় পাওয়া যাইত। এই প্রথা বহুকাল ধরিয়া বাবিলোনে প্রচলিত ছিল। আকাডিয়ান্দিগের অভ্যুদয়ের অনেক পরে ইহারা মাসের নামকরণ করিতে শিক্ষা করিয়াছিল।
বাবিলোনীয়গণ মাসগণনার পূর্ব্বোক্ত নিয়ম কয়েক শতাব্দী পরে পরিবর্ত্তন করিয়াছিল। কিন্তু ঠিক কোন্ সময়ে গণনাপ্রথার সংস্কার করিয়া অধুনাতন নিয়মে দ্বাদশ মাসে বৎসরগণনা আরম্ভ করিয়াছিল তাহার স্থিরতা নাই। বোধ হয় চন্দ্রপর্য্যবেক্ষণ দ্বারা ত্রিশ দিনে মাস গণনা সুবিধাজনক বিবেচিত হওয়ায় এই নবপ্রথা প্রবর্ত্তিত হইয়াছিল। খৃঃ পূঃ ৭০০০ অব্দে বাবিলোন্ আকাডিয়ান্গণ কর্ত্তৃক বিজিত হইলে জেতৃগণের প্রভাবে বাবিলোনের প্রাচীন গণনাপ্রথার অনেক পরিবর্ত্তন সাধিত হইয়াছিল, এবং জেতৃগণেরও জাতীয় প্রথার ব্যতিক্রম ঘটিয়াছিল। আকাডিয়ান্গণ পূর্ব্বে ত্রয়োদশ ভাগে বৎসর বিভক্ত করিয়া ২৮ দিনে মাস পূর্ণ করিত। বাবিলোন জয়ের পর বিজিতগণমধ্যে মাসগণনার অভিনব প্রথা দেখিয়া তাহারা ভ্রমসঙ্কুল জাতীয় প্রথা পরিত্যাগ করিয়া বাবিলোনের প্রচলিত নিয়মানুসারে প্রতি মাস ত্রিশ দিনে পূর্ণ করিয়া এই প্রকার দ্বাদশ মাসে বৎসর গণনা করিতে আরম্ভ করিয়াছিল, কিন্তু এই গণনা দ্বারা সৌর বৎসর ৩৬৫ দিন অপেক্ষা কমিয়া যায় দেখিয়া কোন কোন বৎসর ত্রয়োদশ মাসে পূর্ণ করিয়া বৎসরের অল্পতা পূরণ করিত। এই পরিপুরক মাস পুরোহিতগণ কর্ত্তৃক অনির্দ্দিষ্ট নিয়মে নির্দ্ধারিত হইত। আকাডিয়ান্-অভ্যুদয়ের পূর্ব্বে বাবিলোনীয়গণ বৎসরের পূর্ব্বোক্ত স্বল্পতা অন্য উপায়ে পূরণ করিত; ইহারা প্রতি বৎসরের একটি একটি নির্দ্দিষ্ট মাসে বিংশতি দিবসের পর উপর্য্যুপরি দুই দিবস একবিংশতি দিবস বলিয়া গণনা করিত।
জ্যোতিষের সকল ব্যাপারেই আকাডিয়ান্গণ প্রাচীন বাবিলোনীয়দিগের অপেক্ষা অনেকাংশে হীন ছিল, কিন্তু দুই একটি বিষয়ে আকাডিয়ান্দের প্রাধান্য দেখা যায়। দিন ও মাসের পৃথক পৃথক নামকরণ দ্বারা যে সুবিধা প্রাপ্ত হওয়া যায়, তাহা ইহারা বেশ বুঝিত। প্রতি মাস চারি সমান ভাগে বিভক্ত করিয়া প্রত্যেক বিভাগস্থ দিন সকল পরিজ্ঞাত গ্রহাদির নামানুসারে আখ্যাত করা ইহাদের মধ্যে একটি সুন্দর প্রথা ছিল। অনেকে অনুমান করেন দিবসাদি নামকরণের আধুনিক প্রচলিত প্রথা আকাডিয়ান্ জ্যোতিষশাস্ত্র হইতেই গৃহীত হইয়াছে।
বাবিলোনীয়গণ তাহাদের প্রাচীন নামকরণ-প্রথা পূর্ব্বাপর এক অবস্থায় রাখে নাই। কালসহকারে ইহার অপকর্ষ হৃদয়ঙ্গম করিয়া যাহাতে জ্যোতিষ্কগণ সুবিধাজনক নামে অভিহিত হয় তদ্বিষয়ে বিশেষ সচেষ্ট হইয়াছিল, কিন্তু এ বিষয়ে আকাডিয়ান্-প্রথা অনুসৃত হয় নাই। পরস্পর নিকটবর্ত্তী নক্ষত্রকে এক এক শ্রেণীভুক্ত করিয়া প্রত্যেক পুঞ্জকে পশু ইত্যাদির প্রতিকৃতি কল্পনা করিয়া তাহারা সেগুলিকে মেষ-বৃষ-মহিষাদি জীবগণের নামে অভিহিত করিত। নক্ষত্র-নামকরণের অন্যান্য অনেক প্রকৃষ্টতর উপায় থাকিতে বাবিলোনীয়গণ কেন যে, এই অপূর্ব্ব প্রথা অবলম্বন করিয়াছিল তাহার স্থিরতা নাই। যে যে জীবের নামে নক্ষত্রপুঞ্জকে অভিহিত করা হইত, তাহাদের সহিত জীবদিগের আকৃতিগত যে কোন সৌসাদৃশ্য ছিল তাহা কোনক্রমেই বোধ হয় না। অধুনাতন চিন্তাশীল পণ্ডিতগণ অনুমান করেন, নক্ষত্রপুঞ্জের উদয়-ঋতুতে কর্ত্তব্য কৃষিবাণিজ্যাদির উল্লেখ করিয়া তদর্থে প্রয়োজনীয় জীবাদির নামে তারকাপুঞ্জগুলি আখ্যাত হইয়াছে।
পূর্ব্বোক্ত প্রকারে জ্যোতিষ্কগণের নামকরণকার্য্য শেষ হইলে বাবিলোনীয় জ্যোতিষিগণ উল্লিখিত জ্যোতিষিক সঙ্কেত ও প্রতিকৃতি ইত্যাদির সাহায্যে রাশিচক্র-বিভাগ দ্বারা তাঁহাদের পর্য্যবেক্ষণ ও গবেষণার ফল সকল লিপিবদ্ধ করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন। আধুনিক জ্যোতির্ব্বেত্তাগণ স্থির করিয়াছেন,—এই রাশিচক্র-লিখন প্রথা বাবিলোনীয়গণ সর্ব্বপ্রথম উদ্ভাবন করেন এবং বহু শতাব্দী পরে ইজিপ্টের জ্যোতিষীরা বাবিলোনে ইহা শিক্ষা করিয়া পরে পৃথিবীর সমগ্র সভ্যদেশে এই প্রথার বিস্তার করেন।
যদিও বাবিলোনীয়গণ তাঁহাদের উন্নতি যুগের শেষাংশে জ্যোতিষ্কগণের নামকরণাদির উপযোগিতা সম্যক্ উপলব্ধি করিয়াছিলেন, কিন্তু আধুনিকগণের নিকট সেই সকল নাম সম্পূর্ণ অর্থশূন্য হইয়া দাঁড়াইয়াছে। কারণ বহু গ্রন্থাদি অনুসন্ধান করিয়াও কোন্ জ্যোতিষ্কটি বাস্তবিক কি নামে অভিহিত হইয়াছে, তাহা এখন পরিজ্ঞাত হওয়ার বিশেষ সম্ভাবনা আছে বলিয়া বিবেচিত হয় না। তবে অল্পদিন হইল পূর্ব্ববর্ণিত রাশিচক্রাঙ্কিত কয়েকখানি সুবৃহৎ প্রস্তর-ফলক একটি প্রাচীন বাবিলোনীয় ভজনালয়ের তলদেশে প্রাপ্ত হওয়ায় এবং বাবিলোনীয় ভবিষ্যদ্বক্তাদিগের কয়েকখানি প্রাচীন পঞ্জিকারও উদ্ধার সাধিত হওয়ায়, সেগুলি দ্বারা নক্ষত্রাদির পরিচয় অবগতির কিঞ্চিৎ সহায়তা হইবে বলিয়া আশা করা যাইতেছে।
পূর্ব্বেই বলা হইয়াছে বাবিলোনীয়গণ নক্ষত্রাদি পর্য্যবেক্ষণ দ্বারা তাহাদের গতিনির্দ্ধারণ কার্য্যে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ ছিল। জ্যোতিষ্ক সকল গতিশীল ও ইহারা রাত্রিকালে পূর্ব্ব হইতে পশ্চিমাভিমুখে গমন করে, বাবিলোনীয়গণ ইহাই জানা যথেষ্ট বলিয়া জ্ঞান করিত। পৃথিবীর কক্ষে মেরুদণ্ড হেলিয়া থাকায় দক্ষিণাকাশস্থ যে-সকল নক্ষত্র প্রায়ই অদৃশ্য থাকে তাহাদের আকস্মিক উদয়, বাবিলোনীয়গণ বড়ই বিস্ময়কর ব্যাপার বলিয়া বোধ করিত, এবং এই সকল নক্ষত্রের উদয়কালে তাহারা নানাবিধ শুভ ও দৈবকার্য্য মহোৎসবে সম্পন্ন করিত। গ্রহদিগের জটিল গতির বিষয় ইহারা কিছুই জানিত না এবং বাহ্যতঃ ইহাদের গতি উচ্ছৃঙ্খল ও অস্বাভাবিক দেখিয়া গ্রহগণকে অপদেবতা বলিয়া ভয় করিত ও শান্তপ্রকৃতি দেবগণের কৃপায় আশু বিঘ্নশান্তি-মানসে সর্ব্বাগ্রে জগতের নিয়মসংহারকারী দুষ্ট গ্রহগণকে পূজাদি দ্বারা সন্তুষ্ট করিত। অনেকে অনুমান করেন, এই সময় হইতেই সুপ্রসিদ্ধ সেমেটিক্ ধর্ম্ম সংস্থাপনের সূত্রপাত হয়। বাবিলোনীয়গণ কেবলমাত্র কাল্পনিক আশঙ্কার বশবর্ত্তী হইয়া সপ্তগ্রহকে তাহাদের উপাস্য দেবতা করিয়া তুলিয়াছিল এবং অবিকল একই কারণে দুর্ভিক্ষ, মারীভয়, বজ্রাগ্নিভয়াদি আপদকেও দেবতা বলিয়া পূজা করিতে শিক্ষা করিয়াছিল। এতদ্ব্যতীত ইহারা চন্দ্র ও সূর্য্যগ্রহণকে একটি মহা অশুভ লক্ষণ বলিয়া ভয় করিত। কিছুদিন পরে আবার এই মত পরিবর্ত্তন করিয়া চন্দ্রসূর্য্যের গ্রহণকে একটি শুভ চিহ্ন বলিয়া দেখিত।
আধুনিক জ্যোতিষীদিগের নিকট বাবিলোনীয় জ্যোতিষশাস্ত্র যে, সর্ব্বাংশে হীন তাহাতে আর অণুমাত্র সন্দেহ নাই। ডায়োডোনস্ নামক জনৈক খ্যাতনামা বাবিলোনীয় জ্যোতির্ব্বেত্তা তাঁহার এক গ্রন্থে লিখিয়াছেন, চন্দ্রসূর্য্যের গ্রহণব্যাপার বাবিলোনের জ্যোতিবিদ্গণ কিছুই বুঝিতেন না, এবং কি উপায়ে গ্রহণের কাল নিরূপিত হয় সে বিষয়েও তাঁহারা সম্পূর্ণ অজ্ঞ ছিলেন। বেরেসিস্ স্বয়ং লিপিবদ্ধ করিয়াছেন, বাবিলোনীয়গণ চন্দ্রের একার্দ্ধ উজ্জ্বল এবং অপরার্দ্ধ চিরতামসাবৃত বলিয়া বিশ্বাস করিত। দুই একখানি প্রাচীন গ্রীক্ ও লাটিন্ গ্রন্থেও, জ্যোতিষসম্বন্ধে পূর্ব্বোক্ত প্রকার দুই একটি ভ্রমসঙ্কুল সিদ্ধান্তের উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়। আধুনিক পণ্ডিতগণ অনুমান করেন ইহাও বাবিলোনীয়দিগের ভুল বিশ্বাসের ফল মাত্র। বাবিলোনীয় জ্যোতিষ আলেক্জাণ্ড্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয় সংস্থাপনের পর ক্রমে ইজিপ্টে বিস্তৃত হইয়াছিল এবং তৎপরবর্ত্তী গ্রীক্ ও লাটিন্ গ্রন্থকারগণ তাৎকালিক সার্ব্বভৌম বিদ্যার কেন্দ্রস্থল আলেকজাণ্ড্রিয়া হইতে সম্ভবতঃ ঐ সকল বিবরণ জ্ঞাত হইয়া লিপিবদ্ধ করিয়াছিলেন। কি উপায়ে বারিলোন হইতে জ্যোতিষশাস্ত্র ইজিপ্ট ও অন্যান্য দেশে পরিব্যাপ্ত হইয়াছিল, সেসম্বন্ধে নানা মত প্রচলিত আছে। আধুনিক পণ্ডিতগণের মধ্যে অনেকেই বলেন, যে সময়ে য়িহুদী, সিরিয়ান্, ও বাবিলোনীয়গণ সিলুসিডিয়াগণ কর্ত্তৃক উৎপীড়িত হইয়া মাতৃভূমি পরিত্যাগ পূর্ব্বক ইজিপ্টে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিল, সেই সময়ে ইহারা বাবিলোনীয় জ্যোতিষশাস্ত্র ও তদানুষঙ্গিক কুসংস্কারাদিও সঙ্গে আনিয়া তৎসাহায্যে জাতীয় উৎসব ও পূজাদি সম্পন্ন করিত। নুতন অধিবাসিগণ এই প্রকাৱে তাহাদের জাতীয় বিশ্বাসাদি ত্যাগ করিতে সম্পূর্ণ অনিচ্ছা প্রকাশ করায়, ইজিপ্সীয়ান্ পণ্ডিতগণ বাবিলোনীয় জ্যোতিষের কিয়দংশ গ্রহণ করিয়া তাহা নানা দেশে বিস্তৃত করিয়াছিলেন।
উপসংহারে বক্তব্য এইমাত্র যে, অনেকে মনে করেন আধুনিক উন্নত জ্যোতির্ব্বিদ্যা বাবিলোনের নিকট অনেক বিষয়ে ঋণী, কিন্তু ইহা সম্পূর্ণ ভ্রমসঙ্কুল। বাবিলোনের প্রাচীন গ্রন্থকার বেরোসসের লুপ্ত গ্রন্থ সকলের যদি সম্পূর্ণ উদ্ধার হইত, তাহা হইলেও যে আমরা বিশেষ কোন শিক্ষণীয় বিষয় দেখিতে পাইতাম, এরূপও আশা করা যায় না। তবে বিস্ময়ের বিষয় এই যে, ঘোর তামসাচ্ছন্ন প্রাচীনকালেও জ্যোতির্ব্বিদ্যার উন্নতিকল্পে মনোনিবেশ করা বারিলোনীয়গণ কর্ত্তব্যস্বরূপে জ্ঞান করিতেন, এবং অধুনাতন কালের পরম্পরাগত শিক্ষার সুফল ও আকাশপরিদর্শনার্থ আবশ্যক সুন্দর যন্ত্রাদির সাহায্য ব্যতিরেকেও প্রাচীন জ্যোতিষিগণ তাঁহাদের ক্ষুদ্র আকাঙ্ক্ষা পরিতৃপ্ত করিতে কৃতকার্য্য হইয়াছিলেন। ইহা বড় কম গৌরবের বিষয় নহে!