চা-পান

প্রাতে শয্যাত্যাগ করার পরে যখন শরীরে জড়তা থাকে, সেই সময়ে এক পেয়ালা চা-পান যে কত প্রীতিকর, তাহা চা-পায়ী পাঠককে স্মরণ করাইয়া দেওয়া নিষ্প্রয়োজন। তা’র পরে অপরাহ্লে বা সন্ধ্যায় যখন দিবসব্যাপী শ্রমে শরীর অবসন্ন, তখন আর এক পেয়ালা গরম চা যে, কিপ্রকার স্ফূর্ত্তিজনক, তাহাও চা পায়ীকে নূতন করিয়া বলিতে যাওয়া ধৃষ্টতামাত্র। চা-পায়ীদের এইপ্রকার আরাম দেখিয়া যদি কেহ বলেন, চা-পান একটা নেশা,—আফিং, গাঁজা, সিদ্ধি বা তামাকের মত তীব্র নেশা না হউক, একটা মৃদু রকমের নেশা,— তাহা হইলে চা-পায়ীদের উপরে যথেষ্ট অবিচার করা হয়। নিকোটাইন্, মরফাইন্ প্রভৃতি যে সকল উদ্ভিজ্জ-সামগ্রী দেহস্থ হইলে নেশার উদ্রেক করে, সেগুলির লেশমাত্র চায়ে নাই; কাজেই জিনিষটাকে গাঁজা, সিদ্ধি, আফিং বা তামাকের কোটায় ফেলিতে গেলে অন্যায় হয়। পক্ষান্তরে ইহাও স্বীকার করিতে হইবে, যদি কোন চা-পায়ী বলেন যে, স্নায়ুমণ্ডলীকে একটু উত্তেজিত করিয়া শরীরটাকে চাঙ্গা করিতে পারে এমন কোন বস্তু চায়ে নাই; তাহা হইলেও কথাটা সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক হয়। পৃথিবীর উপরে যে-সকল গাছ-গাছড়া আছে, তাহা মানুষের উপকারের জন্য ভগবান সৃষ্টি করিয়াছেন কিনা জানি না, তবে বুদ্ধিমান্ মানুষ যুগযুগান্তর ধরিয়া লতা পাতা ফল মূল আহরণ করিয়াই যে, নানা ঔষধপত্রের আবিষ্কার করিয়াছে, তাহা আমরা প্রত্যক্ষ দেখিতে পাইতেছি। ডাক্তারি, কবিরাজি বা হকিমি চিকিৎসকদের বোধ হয় প্রায় পনেরো আনা ঔষধ উদ্ভিদ্ হইতে সংগ্রহ করা, বাকি এক আনা হয় ত আকরিক বা অপর কিছু। উদ্ভিদের যে অংশটা প্রাণিশরীরে প্রবেশ করিয়া শরীরে নানা প্রকার কার্য্য দেখায়, বিজ্ঞানের ভাষায় সাধারণতঃ তাহাকে আল্‌কালইড্ (Alkaloids) বলে। কুইনিন্, সিন‍্কোনা, কোকেন, ষ্ট্রিক‍্নাইন্ এগুলির সকলেই আল্‌কালইড্‌। রসায়নবিদ্‌গণ চা-কে বিশ্লিষ্ট করিয়া তাহাতে ঐ প্রকার একটা বিশেষ গুণসম্পন্ন আল‍্কালইড্ দেখিতে পাইয়াছেন। ইহাকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় কাফিন্ (Caffeine) বলা হইয়া থাকে। আমাদের দেহের উপৱে এই জিনিষটার যে একটুও প্রভাব নাই, একথা কখনই বলা যায় না। এই জন্যই বলিতেছিলাম, যদি কোন চা-পায়ী বলেন, চিনি, দুধ ও গরম জলের সরবতে চায়ের ক্কাথ্ মিশাইলে, এই অপূর্ব্ব পানীয়টিতে একটা সুগন্ধ ও একটু স্বাদুতা আনা হয় মাত্র, তবে তাঁহার উক্তিকে কখনই পক্ষপাতদোষশূন্য বলা যায় না। চা’য়ে এমন কিছু আছে, যাহা চা-পায়ীদিগকে চায়ের পেয়ালার দিকে আকর্ষণ করে। জঠরানলকে এই আকর্ষণের কারণ বলিতে পারা যায় না; সম্মুখে স্তুপীকৃত গরম লুচি ও মিষ্টান্ন থাকা সত্ত্বেও কেবল এক পেয়ালা চা খাইয়া চলিয়া গেলেন, এমন চা-পায়ী অনেক দেখা যায়। ফ্যাসানও ইহার কারণ নয়, ভাঙা কড়াইয়ে জল গরম করিয়া ঘটির মধ্যে চা প্রস্তুত হইয়াছে এবং সেই চা পিতল বা কাঁসার পাত্রে ঢালিয়া পান করিয়াছেন, এমন পাকা চা-পায়ীও দুর্লভ নয়। দু’চার জন একত্র বসিয়া চা পান না করিলে চায়ের সভা জমে না; সুতরাং মনে হইতে পারে, বন্ধুবান্ধবদের সহিত কিছুক্ষণের জন্য মিলনই চা’য়ের পেয়ালায় দিকে আমাদিগকে আকর্ষণ করে। কিন্তু এরকম লোকও অনেক দেখিয়াছি, যাঁহারা অন্তঃপুরের কোন নিভৃত কক্ষে বসিয়া একা একা চাপান করেন এবং ইহাতে তাঁহাদের তৃপ্তিলাভের কোনই বিঘ্ন হয় না।

 চা বিশ্লেষ করিলে কাফিন্ নামক যে একটি পদার্থ ধরা পড়ে, তাহা আমরা পূর্ব্বে উল্লেখ করিয়াছি। ইহা ছাড়া টানিন্ বা ট্যানিক্ এসিড্ নামক একটি অম্ল এবং একপ্রকার সুগন্ধি তৈলবৎ পদার্থও ইহাতে পাওয়া যায়। পাকা হাতে প্রস্তুত চায়ে যে একটি সুগন্ধ অনুভব করা যায়, তাহা ঐ তৈলেরই গন্ধ। জিনিষটা সহজেই বাষ্পীভূত হইয়া যায়, এজন্য খুব দক্ষ লোক ব্যতীত কেহই চায়ের এই সুঘ্রাণটি রাখিতে পারে না। চা ঠাণ্ডা হইয়া গেলে বা ঠাণ্ডা চা’কে পুনরায় গরম করিয়া খাইতে গেলে সেই তৈল উড়িয়া যায়, সুতরাং চা মাটি হইয়া যায়। বাহা হউক আমরা একে একে চা’য়ের উপাদানগুলির কার্য্য আলোচনা করিব, চায়ের কোন্ উপাদান মানুষকে এত মুগ্ধ করে, ইহাতে ধরা পড়িয়া যাইবে।

 প্রথমে চা’য়ের গরম জলটার বিষয় আলোচনা করা যাউক। আমাদের মনে হয়, যাঁহারা পাকা চা-পায়ী, তাঁহাদের মধ্যে অন্ততঃ বারো আনা লোক চায়ের ঐ গরম জলটার মোহে আবিষ্ট হইয়া চা পান করেন। কথাটা অদ্ভুত হইল, কিন্তু ইহা সম্পূর্ণ সত্য। আমরা এপ্রকার অনেক লোক দেখিয়াছি, যাঁহারা প্রাতে এক পেয়ালা ঈষদুষ্ণ জল পান না করিয়া কোন কাজে হস্তক্ষেপ করেন না। তাঁহাদের এই জলপানের নেশা ঠিক চা’য়েয় নেশার মতই প্রবল। প্রথমে হয় ত ডাক্তার বা কবিরাজের পরামর্শে ইহারা গরম জল পান স‍ুরু করেন, কিন্তু কালক্রমে ইহা এমন একটা অভাবে পরিণত হয় যে, প্রাতে গরম জল পান না করিয়া ইহাদের সুস্থ থাকা অসম্ভব হইয়া পড়ে। এই ব্যাপারটার একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেওয়া চলে। জলের একটা বিশেষ ধর্ম্ম এই যে, অপর পদার্থের তুলনায় ইহা অধিক তাপ ধরিয়া রাখিতে পারে। একসের লৌহে এবং ঠিক্ একসের জলে সমান তাপ প্রয়োগ কর। লৌহ তাহাতে অত্যন্ত গরম হইয়া দাঁড়াইবে, হয়ত তাহ। স্পর্শ করাও অসম্ভব হইবে; কিন্তু জল তাহাতে সে প্রকার অসহ্য উষ্ণতা দেখাইবে না, অথচ তাপটা সম্পূর্ণ জলেই থাকিয়া যাইবে। এই কারণে ৬০ ডিগ্রী উত্তপ্ত লৌহপিণ্ড অপেক্ষা সেই প্রকার উষ্ণ জলে অধিক তাপ গুপ্তাবস্থায় থাকিয়া যায়। কাজেই আমরা যখন চায়ের সহিত বা চা-বর্জ্জিত গরম জল পান করি, তখন সেই জলের সহিত অনেকটা তাপ শরীরে প্রবেশ করাই। সুতরাং হঠাৎ এই তাপ হৃদপিণ্ড প্রভৃতি শারীরযন্ত্রের নিকটে পৌঁছিয়া যে তাহার নিজের ক্রিয়া দেখাইতে থাকিবে তাহাতে আর আশ্চর্য্য কি? পাক-যন্ত্রের এবং স্নায়ুমণ্ডলীর উপরে গরম জলের যথেষ্ট প্রভাব আছে। অনেক স্নায়বিক পীড়ায় এক প্রকার গরম জলের চিকিৎসাও প্রচলিত রহিয়াছে; এই নূতন চিকিৎসায় অনেক রোগী সুস্থ হইয়া থাকেন; সুতরাং গরম জল পানে আমাদের দেহটিকে একটু উত্তেজিত করিবার ইচ্ছাটাই তলে তলে কাজ করিয়া আমাদিগকে গরম চা’য়ের দিকে আকর্ষণ করে, এই কথাটা নিতান্ত অযৌক্তিক নয়।

 যে সকল রোগে চা-পান নিষিদ্ধ, তাহাদের চিকিৎসায় ডাক্তারেরা চা-পানের পরিবর্ত্তে গরম জল পানের ব্যবস্থা দিয়া থাকেন। রোগী এই ব্যবস্থা-অনুসারে চলিয়া চা-পানের দুর্লভ আনন্দটুকু হইতে একেবারে বঞ্চিত হয় না।

 এই সকল কথা স্মরণ করিলে মনে হয়, চা-পায়ীদের মধ্যে সত্যই বারো আনা লোক অজ্ঞাতসারে গরম জলটুকুরই গুণে মুগ্ধ হইয়া চায়ের পেয়ালার দিকে আকৃষ্ট হন। গরম জলপান সহ্য করিতে পারেন না, অথচ চা-পান করেন, এ প্রকার অনেক লোক দেখা যায়। ইহাদের চা-পান শিশুদের কুইনিন সেবনের ন্যায়। কুইনিনের তিক্ত বটিকার উপরে চিনির পলস্তরা থাকিলে শিশু ঔষধ সেবনে আপত্তি করে না, হয় ত শেষে আগ্রহের সহিত কুইনিনের বড়ি চাহিয়া ভক্ষণ করে। ইহারাও সেই প্রকার স্বাদ-গন্ধবর্জ্জিত গরমজল পান করিতে না পারিয়া তাহার সহিত দুগ্ধ, চিনি ও চায়ের পাতার হুগন্ধি ক্বাথ্ মিশাইয়া সেই গরমজলই পান করেন। চিনির পলগুরা কুইনিনের গুণ হ্রাস করে না; চায়ের ক্বাথ্ ও দুগ্ধ, চিনি মিশাইলে গরম জলেরও গুণ খর্ব্ব হয় না। কাজেই দেখা যাইতেছে, যাঁহারা খাটি গরম জল সেবন করিতে পারেন না, তাঁহারা দুগ্ধ চিনি ইত্যাদি মিশাইয়া সেই গরম জলই পান করেন। গরম জলই ইহাদিগকে চা’য়ের পেয়ালার দিকে অনেকটা টানিয়া আনে।

 এখন চা’য়ের ক্বাথের দুইটি প্রধান উপাদান ট্যানিক্ এসিড্ -এবং কাফিনের গুণাগুণ বিচার করা যাউক। ট্যানিক্ এসিড্ অনেক উদ্ভিদেরই পাতায় ও ছালে অল্পাধিক পরিমাণে পাওয়া যায়, চায়ের পাতাতেও ইহা আছে। সুস্থ প্রাণিদেহের উপরে এই দ্রাবকটির কার্য্য খুব ভাল নয়। জিনিষটা কষায় গুণ-বিশিষ্ট, কাজেই কষায় দ্রব্য ভক্ষণ করিলে যে-সকল অনিষ্ট দেখা দেয়, ইহাতে কেবল তাহাই দেখা যায় মাত্র। ফিট্‌কিরি একটা কষায় দ্রব্য, দাঁতের মাজনের সহিত ইহা মুখে দিলে, মুখ-বিবরের চর্ম্মগুলি যেন সঙ্কুচিত হইয়া আসে, জিহ্বায় যেন একটা টান পড়ে এবং মুখ শুষ্ক হইয়! আসে। কেবল মুখেই যে কথায় দ্রব্যের এই প্রকার কার্য্য দেখা যায় তাহা নয়, ইহা আমাদের দেহাভ্যন্তরের যে অংশের সংস্পর্শে আসে, তাহাকে ঠিক ঐ প্রকারেই শুকাইয়া টানিয়া রাখিতে চেষ্টা করে। পাকাশয়ে উপস্থিত হইলে ইহা পাকযন্ত্রের চর্ম্মগুলিকে ঐ প্রকারে শুষ্ক করিতে ও টানিয়া ধরিতে চায়, কাজেই পাকক্রিয়ার বিঘ্ন উপস্থিত হয়। মুখে থাকিবার সময়ে ইহা মুখ শুষ্ক করিয়া দেয় বলিয়া খাদ্যের সহিত যথেষ্ট লালা মিশ্রিত হইতে পারে না, কাজেই লালাহীন ভুক্তদ্রব্য পাকাশয়ে উপস্থিত হইয়া সহজে হজম হইতে চায় না। পাকাশয়ে ভুক্ত দ্রব্যের সহিত মিশিলেও ইহার ফল ভাল হয় না। উদরস্থ খাদ্য ইহার সংস্পর্শে আসিলে সঙ্কুচিত হইয়া এমন কঠিন দাঁড়ায় যে, তখন সেগুলিকে হজম করা দায় হইয়া উঠে, কাজেই অজীর্ণ দেখা দেয়! মাংসের সহিত ট্যানিক্ এসিড বা অপর কষার দ্রব্যের ঘোর শত্রুতা আছে। ইহার সংস্পর্শে আসিলেই মাংস রবারের ন্যায় এক অপূর্ব্ব বস্তু হইয়া দাঁড়ায়; যাঁহাদের জঠরানল খুব প্রখর, তাঁহারাও এই প্রকারে রূপান্তরিত মাংস সহজে হজম করিতে পারেন না। বৈজ্ঞানিকেরা বলেন যে, মাংসে আল‍্বুমিন্ বলিয়া যে একটা বস্তু আছে, তাহা ট্যানিক্ এসিডের সংস্পর্শে আসিলেই ঐ প্রকার শক্ত হইয়া দাড়ায়।

 ট্যানিক্ এসিডের পূর্ব্বোক্ত গুণগুলির কথা মনে করিলে স্পষ্টই বুঝা যাইবে, খাদ্যের সহিত ইহা অধিক পরিমাণে গ্রহণ করিলে আমাদের পাকযন্ত্র কখনই প্রকৃতিস্থ থাকিতে পারে না। কিন্তু ইহাতে চা-পায়ীদের শঙ্কিত হইবার কোন কারণই দেখিতে পাওয়া যায় না। চা’য়ের পাতায় ট্যানিক্ এসিড্ অতি অল্পই আছে, এবং যাহা আছে তাহার সামান্য অংশই গরম জলের সাহায্যে তিন চারি মিনিটে বাহির হইতে পারে। বৈজ্ঞানিকগণ পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছেন, চায়ের পাতা গরম জলে ফেলিবার পরে চার মিনিট পর্য্যন্ত সেই কাফিন্ নামক বস্তুটিই পাতা হইতে বাহির হইতে থাকে; তার পরে এক একটু করিয়া ট্যানিক্ এসিড্ বাহির হইতে আরম্ভ করে। সমগ্র ট্যানিক্ এসিড্ বাহির করিতে হইলে চায়ের পাতাগুলিকে অন্ততঃ আধ্ ঘণ্টা ফুটন্ত জলে ফেলিয়া রাখার প্রয়োজন। কিন্তু চা-গুলিকে আধ ঘণ্টা জলে ভিজাইয়া রাখিয়া চা-প্রস্তুত করেন এমন আনাড়ি চা-খোর বোধ হয় সমগ্র জগতে দুর্লভ। অতএব পাকা হাতে প্রস্তুত চা-পানে যাঁহারা অভ্যন্ত, ট্যানিক্ এসিডের ভয় না করিয়া তাঁহাদিগকে আনন্দে চাপান করিবার পরামর্শ দিতে পারা যায়।

 এখন চায়ের অপর উপাদান কাফিন্ নামক উদ্ভিজ্জ-বস্তুটির বিষয় আলোচনা করা যাউক। এক কথায় বলিতে গেলে, কাফিনের ন্যায় পরম উপকারী উদ্ভিজ্জ-বস্তু দুর্লভ। দেহস্থ হইলে ইহা স্নায়ুমণ্ডলীকে উত্তেজিত করে, কিন্তু অপর উত্তেজক-পদার্থ গ্রহণ করিলে উত্তেজনার পশ্চাতে যে এক একটা অরসাদ উপস্থিত হয়, ইহাতে তাহার চিহ্নমাত্র দেখা যায় না। এটা বড় কম কথা নয়। সুরা, অহিফেন প্রভৃতি পদার্থ শরীরকে খুবই উত্তেজিত করে, কিন্তু উত্তেজনার শান্তি হইলে যে অবসাদ আসিয়া দেখা দেয়, তাহা পূর্ব্বের উপকার টুকুকে নষ্ট করিয়া মোটের উপর অপকারই আনিয়া ফেলে। এতদ্ব্যতীত প্রাণীর মস্তিষ্কের উপরে কাফিনের প্রভাব অতি আশ্চর্যজনক। কুচিলার সার অর্থাৎ স্ট্রিক‍্নাইন (Strychnine) জিনিষটা কখন কখন মস্তিষ্কের উত্তেজক ঔষধরূপে ব্যবহৃত হয়, কিন্তু ইহা কখনই প্রত্যক্ষভাবে মস্তিষ্ককে উত্তেজিত করিতে পারে না। কাফিন্ জিনিষটা কোন প্রকার অবসাদের সূত্রপাত না করিয়া প্রত্যক্ষভাবে মস্তিষ্ক উত্তেজ়িত করিতে পারে।

 কাফিনের পূর্ব্বোক্ত গুণগুলির কথা শুনিলে চায়ের সহিত কাফিন‍্ভক্ষণে সুনিদ্রার ব্যাঘাত হইবার কথা আমাদের মনে পড়িয়া যায়। যাহা মস্তিষ্কের উত্তেজক তাহাই অনেক সময়ে সুনিদ্রার বিঘ্নকর, কাজেই চা জিনিসটাকে নিদ্রানাশক বলিতেই হইতেছে। কিন্তু চা’য়ের বহু গুণের মধ্যে এই ক্ষুদ্র দোষটুকু গুণগুলিকেই উজ্জল করিতেছে বলিয়া চা-পায়ী পাঠক সান্ত্বনা পাইতে পারিবেন। তাছাড়া যে চা কাফি আমরা প্রতিদিনই দুইবেলা ব্যবহার করিতেছি, তাহাকেই যখন অহিফেনসেবনে নিদ্রালু ও লুপ্তচেতন ব্যক্তিকে সজাগ করিয়া দিতে দেখা যায়, তখন বাস্তবিকই আনন্দ হয়। চা’য়ের যে ধর্ম্মটিকে সাধারণ লোকে দোষ বলিয়া মনে করেন, তাহাই সুচিকিৎসকের হাতে পড়িয়া গুণে পরিণত হয়।

 যাহা হউক, পূর্ব্বোক্ত আলোচনা হইতে স্পষ্টই বুঝা যাইতেছে, আমরা প্রাতে উঠিয়াই যখন এক পেয়ালা চায়ের জন্য তাগিদ দিতে আরম্ভ করি, তখন গরম জল পানের ইচ্ছা এবং তাহারি সঙ্গে একটু কাফিন্ ভক্ষণ করিয়া মাথাটাকে সজাগ করিবার চেষ্টা একত্র কার্য্য করিয়া আমাদিগকে অজ্ঞাতসারে চা’য়ের পেয়ালার দিকে টানিয়া লইয়া যায়। ভুলভ্রান্তি লইয়াই মানুষ, এবং এই বৃহৎ সংসারটাও ভুলভ্রান্তি ও মোহে আচ্ছন্ন। এগুলি না থাকিলে এই পৃথিবী স্বর্গ হইয়া পড়িত এবং মানুষগুলাও এক-একটা দেবতার স্থান অধিকার করিত। দেবতার আসন আজিও মানুষে দখল করিতে পারে নাই, কাজেই কতকগুলা মানুষ চা-পানের প্রকৃত মর্ম্মটা ভুলিয়া গিয়া সেই অন্তর্নিহিত ইচ্ছার বশে চায়ের পেয়ালা লইয়া টানাটানি করে এবং আর এক দল লোক ইহা দেখিয়া আর এক ভুলের বশে চা-পায়ীদিগকে নেশা-খোর বলিয়া ফেলে।

 আমরা যে প্রকারে চা প্রস্তুত করিয়া পান করি, তাহার দুইটি উপাদান চিনি ও দুধের কথা এখনো কিছু বলা হয় নাই। বলা বাহুল্য, কবোষ্ণ কাঁচা দুধ এবং পরিষ্কার চিনি উভয়ই অতি উপাদেয় সামগ্রী। এই দুইটি দ্রব্য অনেককে চায়ের পেয়ালার দিকে আকর্ষণ করিয়াছে এবং শেষে তাঁহারা নিত্য চা-সেবী হইয়াছেন ইহাও অনেক দেখিয়াছি। চিনি জিনিষটা সুস্বাদু হইলেও চায়ের সহিত ইহার অধিক ব্যবহার একবারেই ভাল নয়; কিন্তু দুধের ইচ্ছানুরূপ ব্যবহারে দোষ নাই। আমরা পূর্ব্বেই বলিয়াছি, চায়ের ট্যানিক্ এসিড্ স্বাস্থ্য হানি করে, কিন্তু চায়ের পাতা চারি মিনিটের উর্দ্ধকাল গরম জলে না রাখিলে উক্ত দ্রাবক পদার্থটি নির্গত হয় না; যদিই বা কিছু বাহির হয়, চায়ের ক্কাথে দুধ মিশাইলে এসিডের অনিষ্টকারিতা নষ্ট হইয়া যায়। এই কারণে যাঁহারা অল্প দুগ্ধ সংযোগে চা-পান করেন, তাঁহাদের এই কার্য্যটিকে কখনই বিজ্ঞানানুগত বলা যায় না। বিনা চিনিতে চা খাওয়া বরং ভাল, কিন্তু বিন! দুগ্ধে চা-পান একবারে নিষিদ্ধ।