প্রাকৃতিকী/বিজ্ঞানে সূক্ষ্মগণনা

বিজ্ঞানে সূক্ষ্মগণনা

সূর্য্যের অতি নিকটে যে বুধ নামক গ্রহটি রহিয়াছে, তাহার তুলনায় সূর্য্যের গুরুত্ব একাত্তর লক্ষ গুণ অধিক কি বাহাত্তর লক্ষ গুণ অধিক, এই প্রশ্নের মীমাংসায় আমাদের কিছুই যায় আসে না, এই প্রকার অভিযোগ ‘অবৈজ্ঞানিক’ বন্ধুগণের নিকট হইতে অনেক সময়ে শুনিয়াছি। তাঁহারা বলেন, বিজ্ঞানে এত চুল চেরা হিসাব কেন? পৃথিবী হইতে সূর্য্যের দূরত্ব নয় কোটি আটাশ লক্ষ আশী হাজার মাইল, এই কথাটা শুনিলে, তাঁহারা অবাক্ হইয়া বলেন, “হাঁ, সূর্য্যটা খুব দূরে আছে বটে।” কিন্তু যখন বলা যায়, আধুনিক গবেষণায় সূর্য্যের দুরত্ব নয় কোটি ত্রিশ লক্ষ মাইল বলিয়া নির্ণীত হইয়াছে, তখন এই কথাটা তাঁদের মনে একটুও বিস্ময়ের উদ্রেক করে না। তাঁহারা হয়ত বলিয়া ফেলেন, এই এক লক্ষ কুড়ি হাজার মাইলের ন্যূনাধিকো আমাদের জ্ঞান-বৃদ্ধি হইল কোথায়! এই চুল চেরা হিসাবের ত কোন প্রয়োজনই দেখা যায় না।

 বিজ্ঞানে সূক্ষ্মগণনার প্রয়োজন এই অভিযোগকারীদিগকে এক কথায় বুঝানো কঠিন। আমরা বর্ত্তমান প্রবন্ধে কতকগুলি উদাহরণ দিয়া ঐ প্রয়োজনের বিষয় পাঠকদিগের সম্মুখে উপস্থিত করিব।

 জ্যোতিঃশাস্ত্রের কথাই আলোচনা করা যাউক; প্রাচীনত্বে বিজ্ঞানের কোন শাখাই ইহার সমকক্ষ নয়। অতি প্রাচীনযুগের সভ্য মানবগণ চন্দ্রসূর্য্য-গ্রহ-নক্ষত্রের গতিবিধি ও উদয়াস্তের মধ্যে শৃঙ্খলা দেখিয়া যে কত আনন্দ উপভোগ করিয়াছেন, তাহা আমরা অনায়াসেই অনুমান করিতে পারি। কিন্তু প্রাচীন জ্যোতিষীরা গণনা করিয়া চন্দ্র-সূর্য্যের গ্রহণ ও গ্রহগণের উদয়াস্ত প্রভৃতি ব্যাপারে যে ভবিষ্যদ্বাণী প্রচার করিতেন, তাহাই বোধ হয় অবৈজ্ঞানিক জনসাধারণকে বিস্মিত করিত। আজও ইংরাজি নৌপঞ্জিকা (Nautical Almanac) এবং আমাদের দেশীয় পঞ্জিকায় গ্রহণাদিসম্বন্ধে যে-সকল ভবিষ্যদ্বাণী লিপিবদ্ধ থাকে, তাহা মিলিয়া গেলে, জনসাধারণকে কম বিস্মিত করে না।

 এখন প্রশ্ন হইতে পারে, জ্যোতিঃশাস্ত্রের এই মোহিনী শক্তিটির উৎপত্তি কোথায়? বিজ্ঞ পাঠককে অবশ্যই স্বীকার করিতে হইবে, জ্যোতিষিক ব্যাপারগুলির কারণ অনুসন্ধান করিয়া ভবিষ্যদ্বাণী প্রচারের সামর্থ্য মানব কখনই একদিনে পায় নাই। বৎসরের পর বৎসর বহু অনুসন্ধিৎসুকে রাত্রি জাগিয়া জ্যোতিষ্কদিগের গতিবিধি পর্য্যবেক্ষণ করিতে হইয়াছে, কত গণনায় সময়ক্ষেপ করিতে হইয়াছে, কত পরিমাপ করিতে হইয়াছে, তবে তাঁহারা জ্যোতিঃ-শাস্ত্রের প্রতি জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে পারিয়াছেন।

 অনেকে মনে করেন, কিছুকাল ভাল করিয়া জ্যোতিষ্ক-পর্য্যবেক্ষণে আমরা তাহাদের গতিবিধির মধ্যে যে নিয়ম দেখিতে পাই, ভবিষ্যতে গ্রহ-নক্ষত্রেরা বুঝি সেই নিয়মেই চলে, কাজেই জ্যোতিঃশাস্ত্রটা চরমে জ্যোতিষীদের হাত হইতে গণিতবিশারদদিগের হাতে পড়াই উচিত। এই অবস্থায় গণিতজ্ঞেরাই কেবল কাগজকলমের হিসাবে জ্যোতিষিক ঘটনার কথা বলিয়া দিতে পারিবেন। যাঁহারা বৃহৎ বৃহৎ জ্যোতিষিক আবিষ্কারের ইতিহাস অনুসন্ধান করিয়াছেন, তাঁহাদের নিকট হইতে অবশ্যই এই প্রকার উক্তি আশা করা যায় না। দীর্ঘ পর্য্যবেক্ষণের উপরেই ক্ষুদ্র বৃহৎ সকল জ্যোতিষিক নিয়মই প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু যতই সাবধানে পর্য্যবেক্ষণ করা যাউক না কেন, যন্ত্রের দোষে বা পর্য্যবেক্ষণের অসতর্কতায় একটু আধটু ভ্রম হিসাবের মধ্যে প্রবিষ্ট হওয়া অবশ্যম্ভাবী। প্রারম্ভের এই অবশ্যম্ভাবী ক্ষুদ্র ভ্রম কালক্রমে জমিতে জমিতে এত বৃহৎ হইয়া দাঁড়ায় যে, পূর্ব্বেকার গণনায় যে ফল পাওয়া যাইত, তখন আর তাহা পাওয়া যায় না। গ্রহণের বা অপর কোন ঘটনার কালনিরূপণের জন্য হিসাবে বসিয়া জ্যোতিষিগণ যে ফল লাভ করেন, তখন প্রত্যক্ষদৃষ্ট জ্যোতিষিক ব্যাপারের সহিত তাহার মিল দেখা যায় না। ভুল পর্য্যবেক্ষণ করিয়া নিয়ম আবিষ্কার করার পরে, নিয়মের এই প্রকার স্খলন প্রাচীন জ্যোতিষিগণ পদে পদে প্রত্যক্ষ করিয়াছেন। ইহা হইতে জ্যোতিষিক গণনায় চুল-চেরা হিসাবের প্রয়োজনীয়তা আমরা অনায়াসেই বুঝিতে পারি। গণনার সহিত প্রত্যক্ষদৃষ্ট ঘটনার মিল দেখানোর উপরেই জ্যোতিঃশাস্ত্রের মহিমা প্রতিষ্ঠিত। প্রথম পর্য্যবেক্ষণে ভুল হইলে, এই মিল রক্ষা করিয়া গণনা করা একেবারে অসম্ভব। কাজেই মোটামুটি পর্য্যবেক্ষণের ফলে কোন নিয়মের সন্ধান পাইয়াও জ্যোতিষীরা নিশ্চিন্ত থাকিতে পারেন না; বংশের পর বংশ বৎসরের পর বৎসর এবং রাত্রির পর রাত্রি ইহাদিগকে বার বার জ্যোতিষ্ক-পর্য্যবেক্ষণ ও বড় বড় হিসাবের খাতা লিখিয়া জীবন কাটাইতে হয়; আমাদের ন্যায় ‘অবৈজ্ঞানিক’দিগের নিকটে এই প্রকার চুল-চেরা হিসাবপত্র বাড়াবাড়ি ঠেকিতে পারে, কিন্তু জ্যোতিঃশাস্ত্রের মহিমাটুকু এই বাড়াবাড়ি এবং চুল-চেরা হিসাবের উপরেই সুপ্রতিষ্ঠিত!

 একটা উদাহরণ দিলে আমাদের বক্তব্যটা পরিষ্কার হইবার সম্ভাবনা। পাঠক অবশ্যই কেপ্‌লার সাহেবের আবিষ্কৃত জ্যোতিষিক নিয়মাবলীর কথা শুনিয়াছেন; সাধারণতঃ এগুলি কেপ্‌লারের নিয়ম (Kepler's Laws) নামে সুপরিচিত। যখন নিয়মগুলির প্রথম প্রচার হইয়াছিল, তখন সে গুলিকে অভ্রান্ত বলিয়াই পণ্ডিতগণ গ্রহণ করিয়াছিলেন। কিন্তু এখন দেখা যাইতেছে, কেপ্‌লারের নিয়মে অনেক গলদ বর্ত্তমান। তাঁহার স্থূল-পর্য্যবেক্ষণ-লব্ধ নিয়মাবলী অনুসারে কয়েক বৎসর গ্রহ-নক্ষত্রের গতিবিধি ঠিকই দেখা গিয়াছিল, কিন্তু কালক্রমে তাঁহার প্রথম পর্য্যবেক্ষণের ভ্রম যখন বৎসরে বৎসরে পুঞ্জীভূত হইয়া বৃহৎ হইয়া দাঁড়াইয়াছিল, তখন আর গ্রহ-নক্ষত্র কেপ্‌লারের নিয়ম মানিয়া চলে নাই। কাজেই নিয়মের সংশোধনের প্রয়োজন হইয়াছিল। জগদ্বিখ্যাত মহাপণ্ডিত নিউটন্ সাহেব তাঁহার মহাকর্ষণের নিয়মাবলী দ্বারা কেপ্‌লারের নিয়মের সংশোধনে লাগিয়া গেলেন, খুব সূক্ষ্ম হিসাবপত্র চলিতে লাগিল এবং শেষে জানা গেল, কেপ্‌লার যে-সকল নিয়ম কেবল পর্য্যবেক্ষণের সাহায্যে আবিষ্কার করিয়াছিলেন, তাহাদের মূল মহাকর্ষণের নিয়মাবলীতেই প্রোথিত। পৃথিবী যে নিয়মের অনুগত হইয়া আতা-ফলকে মাটিতে ফেলে, সৌরজগতের প্রত্যেক জ্যোতিষ্কই যে, সেই নিয়মেরই অধীন হইয়া মহাকাশে পরিভ্রমণ করে; তাহাও সঙ্গে সঙ্গে জানা গেল। এই সকল ছাড়া, চন্দ্রের গতির উচ্ছৃঙ্খলতা এবং জোয়ারভাঁটা প্রভৃতি যে-সকল প্রাকৃতিক ঘটনা জ্যোতিষীদিগের নিকটে মহা প্রহেলিকা হইয়া দাঁড়াইয়াছিল, একে একে সেগুলিরও কারণ আবিষ্কৃত হইয়া পড়িল। ধূমকেতু যখন সৌরজগতে প্রবেশ করিয়া সূর্য্য প্রদক্ষিণ আরম্ভ করে, এবং অতি দুর প্রদেশে যুগ্মতারকাগণ যখন পরস্পরকে প্রদক্ষিণ করে, তখনও যে তলে তলে জ্যোতিষ্কগণ মহাকর্ষণেরই নিয়মাধীন থাকে, তাহাও সকলে জানিতে পারিলেন। সুতরাং দেখা যাইতেছে, নিউটন্ সাহেব খাতাপত্র লইয়া সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম হিসাবে নিযুক্ত থাকিয়া যে সময়টা ব্যয় করিয়াছিলেন, তাহার অপব্যবহার হয় নাই। তাঁহার সূক্ষ্ম হিসাবই এখন গ্রহ-নক্ষত্রের বর্ত্তমান ও ভবিষাৎ গতিবিধি আমাদিগকে সূক্ষ্মরূপে জানাইতেছে, এবং সৌরজগৎ ছাড়িয়া অতিদূর নক্ষত্রলোকের সংবাদও আমাদিগের নিকটে বহিয়া আনিতেছে। আমরা যে পৃথিবীখানির উপরে বাস করিতেছি, তাহার জন্মতত্ত্ব এবং শৈশবের ইতিহাস জানিবার ইচ্ছা কাহার না হয়? নিউটন্ সাহেবের সূক্ষ্ম গণনাই এখন আমাদের সেই সকল ইচ্ছারও পূরণ করিতেছে। নিউটনের হিসাবপত্র খুব সূক্ষ্ম হইলেও ইহা একেবারে অভ্রান্ত নয়। হয় ত বহু শতাব্দী ধরিয়া এই নিয়মে হিসাব করিলে আমরা ভুল পাইব কিন্তু অতিদূর ভবিষ্যতে ঠিক্ এই নিয়মে গ্রহনক্ষত্রেরা চলাফেরা করিবে কি না, তাহা কেহই বলিতে পারেন না। বরং এ প্রকার কতকগুলি লক্ষণ দেখা যাইতেছে, যাহাতে বহু যুগ পরে কেপ্‌লারের নিয়মের ন্যায় নিউটনের নিয়মেরও সংশোধন প্রয়োজন হইবে বলিয়া মনে হয়। দুই হাজার বৎসর পরে যে দিন নিউটনের নিয়ম না মানিয়া জ্যোতিষ্কদিগকে ভ্রমণ করিতে দেখা যাইবে, সেই দিনই কোন সূক্ষ্মতর গণনা-পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে। সুতরাং এখন হইতেই যদি পণ্ডিতগণ জ্যোতিষ্কদের গতিবিধি লইয়া খুব সূক্ষ্মগণনায় কালক্ষেপ করেন, তবে তাহাকে সময়ের অপব্যবহার বলা যায় না।

 আমরা এ পর্য্যন্ত সৌরজগতের কথা লইয়াই আলোচনা করিলাম, যে অনন্ত নক্ষত্রলোক আমাদের চক্ষুর সম্মুখে প্রসারিত রহিয়াছে, এখন তাহার কথা স্মরণ করা যাউক। হার্সেল সাহেবের পর বহু জ্যোতিষী বহু অনিদ্র রজনী নক্ষত্র-পর্য্যবেক্ষণে কাটাইতেছেন; ইহাতে যে, কত সূক্ষ্ম হিসাবপত্র এবং তর্ক-কোলাহলের উৎপত্তি করিতেছে, আধুনিক জ্যোতিঃশাস্ত্রের যাঁঁহারা সংবাদ রাখেন, তাঁহাদের নিকটে তাহার পুনরুল্লেখ নিষ্প্রয়োজন। বলা বাহুল্য, এগুলিও নিষ্কর্ম্মার সময়ক্ষেপণের উপায় নয়। চন্দ্র-সূর্য্যের গ্রহণ, গ্রহগণের উদয়াস্ত এবং তাহাদের চলাফেরাসংক্রান্ত যে-সকল ভবিষ্যদ্বাণীর সার্থকতা দেখিয়া অবৈজ্ঞানিক জনসাধারণ অধাক্ হইয়া যান, তাহাদের মূলও উক্ত হিসাবপত্রের মধ্যে প্রোথিত। পাঠকের বোধ হয় অজ্ঞাত নাই: আমরা যখন জমি-জমা জরিপ করিতে আরম্ভ করি তখন প্রাচীন বৃক্ষ বা অপর কোন স্থায়ী বস্তুকে কেন্দ্রস্বরূপে গ্রহণ করিয়া থাকি। সেই স্থায়ী চিহ্ন হইতে পার্শ্বস্থ জমির দূরত্ব কত, তাহাই জরিপি চিঠীপত্রে লিখিত থাকে। সৌরজগতের গ্রহ-উপগ্রহাদির চলাফেরা লিপিবদ্ধ রাখিতে হইলেও, ঐ প্রকার এক একটা স্থায়ী চিহ্নের প্রয়োজন হয়। কিন্তু অনন্ত আকাশে সে প্রকার চিহ্ন কোথায়! জ্যোতিষীরা উপায়ান্তর না দেখিয়া স্থির নক্ষত্রগণকে চিহ্নস্বরূপ গ্রহণ করিয়া হিসাব করেন। চিহ্নের (Station) গোলযোগ হইলে জমিরদারকে জমিজমার হিসাবপত্র লইয়া ভবিষ্যতে অশেষ হাঙ্গামায় পড়িতে হয়। যেসকল নক্ষত্রকে স্থায়ী চিহ্নরূপে গ্রহণ করিয়া জ্যোতিষীরা হিসাবপত্র করেন, তাহাতেও এক চুল নড়চড় হইলে, গণনার মহা বিভ্রাট আসিয়া উপস্থিত হয়। কাজেই চিহ্নস্বরূপে গৃহীত নক্ষত্রগুলির উপরে জ্যোতিষীদের নিয়তই খরদৃষ্টি রাখিতে হইতেছে। প্রাচীন জ্যোতিষীরা নক্ষত্রগুলিকে নিশ্চল বলিয়া জানিতেন, কিন্তু এখন আর কোন নক্ষত্রকেই নিশ্চল বলা যায় না। এক একটি নক্ষত্র এক একটি মহাসূর্য্যের ন্যায় বৃহৎ; কত গ্রহ-উপগ্রহ-ধূমকেতু নিশ্চয়ই তাহাদিগকে বেষ্টন করিয়া পরিভ্রমণ করিতেছে এবং ইহারা প্রত্যেকেই এই প্রকার জ্যোতিষ্কপরিবারে পরিবৃত হইয়া এক একটি নির্দ্দিষ্টপথ অবলম্বন করিয়া ছুটিয়া চলিয়াছে। আধুনিক জ্যোতিষীদিগকে নক্ষত্রের কথা জিজ্ঞাসা করিলে, সকলেই একবাক্যে এই কথাই বলেন। কাজেই দেখা যাইতেছে, যে-সকল নক্ষত্র নিশ্চল বলিয়া স্থির ছিল, সেইগুলিরও স্বকীয় গতি আবিষ্কৃত হওয়ায় জ্যোতিষীদের কাজ বাড়িয়া গিয়াছে। নিয়তই ইঁহাদিগকে নক্ষত্রপর্য্যবেক্ষণ করিতে হয়, এবং তাহাদের অধিকৃত স্থানের একটু নড়চড় দেখিলে তাহা লিপিবদ্ধ রাখিয়া ভবিষ্যতের গণনার পথ সুগম করিতে হয়। সুতরাং নক্ষত্র-পর্য্যবেক্ষণের জন্য জ্যোতিষিগণ যে শ্রম করেন এবং যে সূক্ষ্ম হিসাবপত্র খাড়া করেন, তাহারও মধ্যে একটুও বাহুল্য নাই বলিয়াই মানিতে হয়।

 আঠারো কোটি ষাইট লক্ষ মাইল ব্যাসবিশিষ্ট এক মহাবৃত্তাকার পথে পৃথিবী সূর্য্যকে এক বৎসরকালে প্রদক্ষিণ করিয়া আসে। অর্থাৎ বলিতে হয়, পৃথিবী আজ আকাশের যে অংশে আছে, ছয় মাস পরে তাহা আঠারো কোটি ষাইট্ লক্ষ মাইল দূরে গিয়া দাঁড়াইবে। আমরা যখন গাড়িতে বা ঘোড়ায় চড়িয়া চলিতে থাকি তখন পথের পার্শ্বের বৃক্ষগুলিকেও স্থানচ্যুত হইতে দেখি। যে গাছটি একটু পূর্ব্বে আমাদের সম্মুখে ছিল, গাড়ি অগ্রসর হইলে তাহা পিছাইয়া পড়ে। সুতরাং এই পাহাড়পর্ব্বত, নদী-সমুদ্র বুকে লইয়া আমাদের এই পৃথিবী যখন ছয়মাসে আঠারো কোটি ষাইট্ লক্ষ মাইল পথ অতিক্রম করে, তখন পথিপার্শ্বস্থ বৃক্ষের ন্যায় আকাশের নক্ষত্রগুলিকেও একটু আগাইতে বা পিছাইতে দেখারই সম্ভাবনা। নক্ষত্রগুলি পৃথিবীর গতিতে প্রকৃতই এই প্রকার নড়াচড়া করে কি না, জ্যোতিষিগণ বহু দিন হইতে ইহার অনুসন্ধান করিতেছেন এবং কতকগুলি স্থির নক্ষত্রের এই প্রকার স্থানচ্যুতিও লক্ষ্য করিয়াছেন। এখন এই শ্রেণীর নিকট নক্ষত্রের সংখ্যা বহু জ্যোতির্ব্বিদের চেষ্টায় প্রায় চারি শত হইয়া দাঁড়াইয়াছে। কাজেই বলিতে হয়, আকাশের অসংখ্য নক্ষত্রের মধ্যে কেবল চারি শতটিই সৌরজগতের নিকটবর্ত্তী এবং তাহাদেরই কেবল দূরত্ব পরিমাপের উপায় আছে, তদ্ব্যতীত সকল নক্ষত্র এত দূরে অবস্থিত যে, আমরা সাড়ে আঠারো কোটি মাইল পরিভ্রমণ করিয়াও তাহাদের একটুও বিচলন লক্ষ্য করিতে পারি না। সূক্ষ্ম পর্য্যবেক্ষণের ফলে জ্যোতিষিগণ অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডের এই যে একটু আভাস প্রদান করিতে সক্ষম হইয়াছেন, তাহা জনসাধারণকে কম লাভবান করে নাই।

 পূর্ব্বোক্ত প্রকারে অতি দূরবর্ত্তী নক্ষত্রদিগের সংবাদ জানিতে না পারিয়া জোতিষিগণ হতাশ হন নাই। উপায়ান্তর অবলম্বন করিয়া আরো সূক্ষ্মতর হিসাবের সাহায্যে দূর নক্ষত্রের সংবাদ আনিবার চেষ্টা চলিতেছে। আমরা পূর্ব্বেই বলিয়াছি, প্রত্যেক নক্ষত্রই এক একটি মহাসূর্য্য, এবং তাহাদের প্রত্যেকেরই এক একটি স্বকীয় গতি আছে। যেগুলি অতি দূরে অবস্থিত, সূক্ষ্ম পর্য্যবেক্ষণে তাহাদের গতি দুই চারি শত বৎসরেও ধরা পড়ে না; কেবল নিকটবর্ত্তী নক্ষত্রেরাই একটু দীর্ঘকালে একটুমাত্র বিচলন দেখাইয়া স্বকীয় গতির পরিচয় প্রদান করে। নক্ষত্রদিগের এই গতির পরিচয় পাইয়া হার্সেল্ সাহেবের মনে হইয়াছিল, আমাদের সূর্য্যটি যখন নক্ষত্রজাতীয় জ্যোতিষ্ক, তখন ইহারও একটা গতি থাকার সম্ভাবনা। হার্সেল্ দীর্ঘকাল ধরিয়া এই বিষয়টি লইয়া পর্য্যবেক্ষণ ও গণনা আরম্ভ করিয়াছিলেন। এবং শেষে দেখাইয়াছিলেন, বুধ, বৃহস্পতি, শনি, পৃথিবী প্রভৃতি গ্রহ-উপগ্রহে পরিবৃত হইয়া আমাদের সূর্য্যটি সতাই হারকিউলিস্ রাশির দিকে প্রচণ্ড বেগে ছুটিয়া চলিয়াছে। আধুনিক জ্যোতিষিগণ হার্সেল সাহেবের প্রদর্শিত পন্থায় নানা প্রকার উন্নত যন্ত্রাদি-সাহায্যে সৌরজগতের গতির পর্য্যবেক্ষণে নিযুক্ত আছেন এবং এই গতির পরিমাণ বৎসরে অন্ততঃ চল্লিশ কোটি মাইল বলিয়া স্থির করিয়াছেন। কাজেই পৃথিবীর ষাণ্মাসিক সাড়ে আঠারো কোটি মাইল পরিভ্রমণেও যে-সকল নক্ষত্র বিচলন দেখাইয়া আত্মপরিচয় দেয় নাই, সৌরজগতে বার্ষিক চল্লিশ কোটি মাইল ভ্রমণে তাহাদেরই পরিচয়-গ্রহণের সম্ভাবনা দেখা যাইতেছে। দূর নক্ষত্রদিগের পরিচয় সংগ্রহের জন্য জ্যোতিষিগণের এই যে অক্লান্ত শ্রম ইহার কি সার্থকতা নাই? অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডের রহস্য বুঝিয়া মানবজাতি কি ইহাতে জ্ঞানলাভ করিতে পারিবে না?

 যাঁহারা আধুনিক জ্যোতিষিক আবিষ্কারের সংবাদ রাখেন

তাঁহাদের নিকটে গ্রনিন্‌জেন্‌ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসিদ্ধ অধ্যাপক ক্যাপ্তেন্ (Kaptyen) সাহেবের পরিচয় নিষ্প্রয়োজন। ইনি সম্প্রতি নাক্ষত্রিক-জগৎসম্বন্ধে এমন কতকগুলি কথা প্রচার করিয়াছেন যে, তাহা শুনিলে প্রকৃতই বিস্মিত না হইয়া থাকা যায় না। কাপ্তেন সাহেব বলিতেছেন, মহাকাশে এই যে অসংখ্য তারকাগুলি কোটি কোটি মাইল বিচ্ছিন্ন থাকিয়া মিটি-মিটি জ্বলিতেছে, তাহাদের পরস্পরের মধ্যে একটা অতি গূঢ় সম্বন্ধ বর্ত্তমান আছে। ইঁহার মতে সমগ্র বিশ্বের নক্ষত্রগুলির মধ্যে দুইটি সম্পূর্ণ পৃথক ভাগ রহিয়াছে; বিশৃঙ্খলভাবে আকাশে সজ্জিত থাকিয়াও ইহাদের প্রত্যেকটি ঐ দুই দলের মধ্যে কোন একটির অন্তর্ভূক্ত হইয়া আকাশে পরিভ্রমণ করিতেছে। একটা উদাহরণ দিলে ক্যাপ্তেন সাহেবের এই আবিষ্কারটি সহজে বুঝিবার সুবিধা হইবে। মনে করা যাউক, যেন আকাশে দুই ঝাঁক পাখী উড়িয়া চলিয়াছে; এক ঝাঁক পূর্ব্ব হইতে পশ্চিমে ছুটিতেছে, আর এক ঝাঁক যেন দক্ষিণ হইতে উত্তরে চলিয়াছে। দুই ঝাঁকের কোন পাখীরই বিশ্রাম নাই, সকলেই উড়িয়া চলিয়াছে। আকাশের নক্ষত্রগণ এই পাখীর ঝাঁকের মতই দুই দলে বিভক্ত হইয়া ছুটিতেছে বলিয়া ক্যাপ্টেন সাহেবের সম্পূর্ণ বিশ্বাস হইয়াছে। তাহারা কোন্ দিক্ অবলম্বন করিয়া চলিয়াছে, তাহাও পর্য্যবেক্ষণ ও গণনা দ্বারা স্থির হইয়াছে। যে-সকল নক্ষত্রকে প্রাচীন জ্যোতিষিগণ চিরস্থির বলিয়া অনুমান করিতেন, তাহাদেরই এই প্রকার সুশৃঙ্খলিত গতি আবিষ্কার করা আধুনিক জ্যোতিঃশাস্ত্রের কম গৌরবের কথা নয়। কিন্তু আধুনিক যুগের এই বৃহৎ আবিষ্কারটির ইতিহাস আলোচনা করিলে দেখা যায়, প্রাচীন ও আধুনিক পণ্ডিতদিগের চুল-চেরা সূক্ষ্মগণনাই ইহাকে পূর্ণতা প্রদান করিয়াছে। সুপ্রসিদ্ধ ইংরাজ জ্যোতির্বিদ ব্রাড্‌লি (Bradley) সাহেব প্রায় দেড় শত বৎসর পূর্ব্বে গ্রীন্‌উইচ্ মানমন্দিরে বসিয়া যখন আকাশের নক্ষত্রদের মানচিত্র অঙ্কনে ব্যাপৃত ছিলেন, তখন এই নক্ষত্রগণনাকে নদীতীরে বসিয়া জলস্রোতের গণনার ন্যায় একটা অনাবশ্যক কার্য্য বলিয়াই অনেকে মনে করিতেন। কিন্তু আজ ক্যাপ্তেন্ সাহেব এবং তাঁহার সহকর্ম্মিগণ নক্ষত্র জগতের যে-সকল সংবাদ প্রচার করিয়া সকলকে বিস্মিত করিতেছেন, তাহা সেই ব্রাড্‌লি সাহেবেরই নক্ষত্র-পরিচয়ের সহিত বর্ত্তমানকালে নক্ষত্রদিগের অবস্থানাদি মিলাইয়া জানা যাইতেছে।

 সূক্ষ্মগণনায় জ্যোতিঃশাস্ত্র কত উন্নত হইয়াছে এবং মানবের জ্ঞানও ইহাতে কত বৃদ্ধি পাইয়াছে, বর্ত্তমান প্রবন্ধে তাহার অতি অল্পই পরিচয় প্রদান করা হইল। দূর জ্যোতিষ্কদিগের ক্ষীণ আলোকরশ্মি বিশ্লেষণ করিয়া আজকাল নক্ষত্রলোকের যে সকল সংবাদ পাওয়া যাইতেছে, সেগুলির কথাও আলোচনা করিলে দেখা যায়, বৈজ্ঞানিকদিগের সূক্ষ্মগণনাই এখানে জয়যুক্ত হইয়াছে। কেবল জ্যোতিঃশাস্ত্রের নয়, রসায়নীবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, ভূ-তত্ত্ব প্রভৃতি সকল শাস্ত্রেরই ইতিহাস অনুসন্ধান করিলে, প্রাচীন ও আধুনিক বৈজ্ঞানিকদিগের চুল-চেরা সূক্ষ্মগণনাকেই সেগুলির উন্নতির মূলকারণস্বরূপ দেখা গিয়া থাকে।