প্রাকৃতিকী/গ্রহদিগের কক্ষা

গ্রহদিগের কক্ষা

কি প্রকারে অনন্ত মহাকাশে সহস্র সূর্য্যের সমান অসংখ্য জ্যোতিষ্কের সৃষ্টি হইল এবং এক একটি জ্যোতিষ্ককে ঘেরিয়া যে-সকল গ্রহ-উপগ্রহ ধূমকেতু অবিরাম ছুটাছুটি করিতেছে তাহারাই বা কি প্রকারে উৎপন্ন হইল, এই মহাপ্রশ্ন প্রথম জ্ঞানোন্মেষের সহিত মানবের মনে উদিত হইয়াছিল। অনৈতিহাসিক যুগ হইতে যে, কত কিম্বদন্তী কত অনুমান এই ব্যাপারের সহিত জড়িত হইয়া আছে, সত্যই তাহার ইয়ত্তা হয় না। জড়ের নব নব ধর্ম্ম আবিষ্কার করিয়া এবং জড়কে নব নব মূর্ত্তিতে দেখিয়া যে বিজ্ঞান এখন উন্নতির পথে প্রতিদিনই অগ্রসর হইতেছে, তাহাও প্রাচীন মানবের মনের সেই প্রাচীন প্রশ্নটির উত্তর দিবার জন্ম সচেষ্ট রহিয়াছে। এই চেষ্টা কতদিনে সার্থকতা লাভ করিবে জানি না। যুগে যুগেই সৃষ্টিতত্ত্বের নূতন নূতন কথা শুনা যাইতেছে; আমাদের পিতামহগণ, যে সিদ্ধান্তের পরিচয় পাইয়া সৃষ্টিতত্ত্বের একটা কিনারা হইল ভাবিয়াছিলেন, বর্ত্তমান যুগে আমরা তাহাকে ভ্রমপূর্ণ বলিয়া পরিত্যাগ করিতেছি এবং কোন নূতন সিদ্ধান্ত দ্বারা সৃষ্টি-রহস্যের মীমাংসার চেষ্টা করিতেছি। কিন্তু এই প্রকারে অবিরাম পুরাতনের বর্জ্জন এবং নূতনের প্রতিষ্ঠা চলিতেছে বলিয়া আমাদের খেদ করিবার কিছুই নাই; প্রত্যেক সিদ্ধান্তই আমাদের জ্ঞানের ভাণ্ডারে নূতন নূতন সম্পদ প্রদান করিতেছে, এবং সিদ্ধান্তগুলিকে বাস্তুবিক ঘটনার সহিত মিলাইতে গিয়া আমরা নব নব প্রাকৃতিক তত্ত্বের সন্ধান পাইতেছি। প্রকৃতির কার্য্যের কারণনির্দ্দেশ করিতে গিয়া আমরা এই প্রকারে যাহা লাভ করিতেছি তাহা বাস্তবিক অতুলনীয়।

নীহারিকাবাদের প্রতিষ্ঠাতা ইমানুয়েল কাণ্ট

  জর্ম্মান্ পণ্ডিত কাণ্ট সৃষ্টিতত্ত্বের প্রসঙ্গে আভাস দিয়াছিলেন, এই যে বুধ বৃহস্পতি মঙ্গল, প্রভৃতি গ্রহ পরিবৃত হইয়া সূর্য্য মহাকাশে বিরাজ করিতেছে তাহা কোন জ্বলন্ত বাষ্পাকার নীহারিকা-রাশি হইতেই উৎপন্ন। ফরাসী গণিতবিৎ লাপ্‌লস্ (Laplace) সাহেব কাণ্টের ঐকথারই সমর্থন করিয়া তাঁহার নীহারিকাবাদের প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। সম্প্রতি ইংলণ্ডের বিখ্যাত পণ্ডিত জর্জ্জ ডারুইন্ প্রভৃতি মনীষিগণ নীহারিকাবাদের সত্যতায় সন্দিহান হইয়া পড়িয়াছেন। নীহারিকাবাদের মূল অবলম্বন করিয়া যে-সকল জ্যোতিষিক ব্যাপারের ব্যাখ্যান পাওয়া যায় না, এখন সেগুলিই তাঁহাদের নজরে পড়িতেছে এবং অব্যাখ্যাত তত্ত্বের ব্যাখ্যা দিয়া কোন নূতন সিদ্ধান্ত দাঁড় করানো তাঁহাদের জীবনের ব্রত হইয়া দাঁড়াইয়াছে। ইঁহারা সৃষ্টিতত্ত্ব-সম্বন্ধে যে নুতন সিদ্ধান্তের আভাস দিতেছেন, তাহার আলোচনা বর্ত্তমান প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নহে। অধ্যাপক জর্জ্জ ডারুইন্ তাঁহার সিদ্ধান্ত অবলম্বন করিয়া যে এক অব্যাখ্যাত জ্যোতিষিক ব্যাপারের ব্যাখ্যা দিবার চেষ্টা করিয়াছেন, আমরা এখানে তাহারই আভাস দিব।

 পৃথিবী, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি প্রভৃতি ছোট বড় গ্রহগুলি, যে পথে সূর্য্যের চারিদিকে পরিভ্রমণ করিতেছে, সহস্র সহস্র বৎসরের পর্য্যবেক্ষণে গ্রহগণকে সেই সকল পথ হইতে একটুও বিচলিত হইতে দেখা যায় নাই। এই ব্যাপারটি আমাদের খুব সুপরিচিত হইলেও বড়ই বিস্ময়কর। কেবল ইহাই নয়, সূর্য্য হইতে বুধ, শুক্র, পৃথিবী, মঙ্গল প্রভৃতি গ্রহের দূরত্ব পরিমাপ করিলে, দূরত্বগুলির মধ্যে যে এক অদ্ভুত শৃঙ্খলা দেখা যায়, তাহা আরো বিস্ময়কর। ১২, ২৪, ৪৮, ৯৬, এই সংখ্যাগুলির মধ্যে বেশ একটা শৃঙ্খলা আছে। ছয় তিনের দ্বিগুণ, বারো আবার ছয়ের দ্বিগুণ ইত্যাদি। কাজেই শূন্যকে ছাড়িয়া দিলে, পূর্ব্বোক্ত প্রত্যেক রাশিকে পূর্ব্ববর্ত্তী রাশির দ্বিগুণ হইতে দেখা যায়। এখন যদি প্রত্যেকের সহিত চারি যোগ করা যায়, তবে সংখ্যাগুলি-৪, ৭, ১০, ১৬, ২৮, ৫২, এবং ১০০ হইয়া দাঁড়ায়। বড়ই, আশ্চর্যের বিষয়, সূর্য্য হইতে বুধ, শুক্র, পৃথিবী ইত্যাদি গ্রহের দূরত্বের অনুপাত প্রায় ৪, ৭, ১০ ইত্যাদিরই অনুরূপ।

 গ্রহগণের দূরত্বের এই অদ্ভুত নিয়মটি জর্ম্মান জ্যোতিষী বোড্ (Bode) সাহেব হঠাৎ আবিষ্কার করিয়াছিলেন, কিন্তু তিনি বা তাঁহার পরবর্ত্তী কোন জ্যোতিষীই ইহার কারণ নির্দ্দেশ করিতে পারেন নাই। সৌরজগতের সীমান্তবর্ত্তী নেপচুন গ্রহটিকে ও তাহার উপগ্রহগণকে পূর্ব্বোক্ত নিয়ম মানিয়া চলিতে দেখা যায় না সত্য, কিন্তু তাই বলিয়া গ্রহ-বিন্যাসের নিয়মটি যে, প্রকৃতির একটা খেয়াল এ কথা কখনই বলা যায় না। গ্রহগণের কক্ষার (অর্থাৎ পরিভ্রমণ-পথের) স্থিরতা এবং সূর্য্য হইতে তাহাদের দূরত্বের শৃঙ্খলা যে, সৃষ্টির সময়কার কোন বিশেষ অবস্থা দ্বারা উৎপন্ন হইয়াছে ইহা স্বীকার করিতেই হয়।

 জর্জ্জ ডারুইন্ ও তাঁহার শিষ্যবর্গ নীহারিকাবাদে অবিশ্বাসী হইয়া বলেন, এই যে নানা গ্রহ-উপগ্রহাকীর্ণ সৌরজগৎ দেখা যাইতেছে, তাহার মূলে এক সূর্য্যই বর্ত্তমান ছিল। সূর্য্য হয় ত কোন নীহারিকা হইতে উৎপন্ন হইয়া থাকিবে, কিন্তু পৃথিবী, শুক্র, শনি প্রভৃতি গ্রহগণ প্রথমে সেই নীহারিকার অঙ্গীভূত ছিল না। বৃহদাকার সূর্য্যই মহাশূন্য হইতে উল্কাপিণ্ডাকার বহু জ্যোতিষ্ক টানিয়া লইয়া নানা গ্রহাদির উৎপত্তি করিয়াছে। জর্জ্জ ডারুইন্ তাঁহার নব সিদ্ধান্তে এই মূল কথাটিকে ধরিয়াই গ্রহ-উপগ্রহাদির কক্ষার স্থিরতার কারণ নির্দ্দেশ করিতে চেষ্টা করিয়াছেন। এ সম্বন্ধে ডারুইন্‌ যে গবেষণা করিয়াছেন তাহার আমূল উচ্চ অঙ্গের গণিতে পূর্ণ, আমরা গণিতের কথা যতদূর সম্ভব বর্জ্জন করিয়া বিষয়টি মোটামুটি লিপিবদ্ধ করিবার চেষ্টা করিব।

 জ্যোতির্ব্বিদ্যার যে-সকল নূতন তত্ত্ব আবিষ্কৃত হইয়াছে, তাহার অধিকাংশই জ্যোতিষ্ক-লোকের অতীত জীবন আলোচনার ফলেই সুলভ হইয়াছে। দূর ভবিষ্যতে গ্রহনক্ষত্রাদির অবস্থা কি প্রকার দাঁড়াইবে তাহার আভাস বর্ত্তমান অবস্থায় পাওয়া যায় না; ইহারা অভিব্যক্তির পথে অগ্রসর হইবার সময়ে যে সকল পদচিহ্ন রাখিয়া যায়, তাহাই জীবনের ধারা দেখাইয়া দেয়। এই কারণে কোন সিদ্ধান্তের প্রতিষ্ঠা করিতে হইলে গ্রহনক্ষত্রের জটিলতা-বর্জ্জিত প্রথম অবস্থার কথা স্মরণ করিতে হয় এবং সেই অবস্থাটাই ক্রমে আকর্ষণ-বিকর্ষণের মধ্যে কি প্রকারে অভিব্যক্ত হইয়া বর্ত্তমানকালে জটিল হইয়া দাঁড়াইয়াছে তাহা দেখিতে হয়। জর্জ ডারুইন্ এই প্রকারেই ধীরে ধীরে অগ্রসর হইয়া তাঁহার সিদ্ধান্তের প্রতিষ্ঠা করিতে চেষ্টা করিতেছেন।

 মনে করা যাউক, যেন সৌরজগতে সূর্য্য এবং আর একটি

জ্যোতিষ্ক ব্যতীত আর কিছুই নাই। এই জ্যোতিষ্কটিকে বৃহস্পতিই বলা যাউক; ইহা যেন কোন চক্রাকার পথে সূর্য্যের চারিদিকে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। তা’র পরে মনে করা যাউক, একটি উল্কাপিণ্ড বা ক্ষুদ্র গ্রহ সৌরজগতে প্রবেশ করিল এবং যে সমতলে বৃহস্পতি সূর্য্য প্রদক্ষিণ করিতেছে, নূতন জ্যোতিষ্কটি সেই তল অবলম্বন করিয়া কোন নির্দ্দিষ্ট দিকে ছুটিয়া চলিল। এই প্রকার অবস্থায় এই তৃতীয় জ্যোতিষ্কটির গতিবিধি কি হইবে জিজ্ঞাসা করিলে আমরা সহজ বুদ্ধিতে হয় ত একটা উত্তর দিয়া ফেলি। কিন্তু ইহার উত্তর দেওয়া এত সহজ নয়। নিপুণ গণিতবিদ্‌গণকেও পূর্ব্বোক্ত অবস্থাপন্ন তিনটি জ্যোতিষ্কের গতিবিধি-নির্দ্ধারণে পরাভবস্বীকার করিতে হইয়াছে। গণিতের চুল-চেরা গণনার ভিতরে প্রবেশ না করিয়া আমরা ইহা সুস্পষ্ট বুঝিতে পারি যে, সূর্য্য ও বৃহস্পতির ন্যায় দুইটা বৃহৎ জ্যোতিষ্কের আকর্ষণের মধ্যে পড়িয়া ক্ষুদ্র গ্রহটির গতি অত্যন্ত জটিল হইয়া পড়িবে। নিজের গন্তব্যপথে ঘুরিতে ঘুরিতে সূর্য্য বা বৃহস্পতির নিকটবর্ত্তী হইলে তাহা অতি দ্রুতবেগে উক্ত গ্রহদের নিকটে ছুটিয়া যাইবে এবং কোন প্রকারে যদি উহাদের কবল হইতে রক্ষা পায়, তবে সে অতি মন্থর গতিতে দূরে চলিয়া যাইবে। কিন্তু সূর্য্য ও বৃহস্পতির ন্যায় দুইটা প্রকাণ্ড জ্যোতিষ্ককে ফাঁকি দেওয়া অধিক দিন কখনই চলিবে না; সূর্য্যের চারিদিকে ঘুরিতে গিয়া এমন একটি সময় নিশ্চয়ই আসিবে, যখন তাহা ভীম গতিতে সূর্য্য বা বৃহস্পতির ক্রোড়ে আশ্রয় গ্রহণ করিবে। কাজেই সূর্য্য ও বৃহস্পতির রাজ্যে নবাগত ক্ষুদ্র অতিথিটির আর অস্তিত্বই থাকিবে না।

 এখন মনে করা যাউক, যেন সূর্য্য ও বৃহস্পতির রাজ্যে একটি গ্রহাকার অতিথির পরিবর্ত্তে শত শত ছোট উল্কাপিণ্ড প্রবেশ করিয়া বিচিত্র পথে বিচিত্র গতিতে ছুটিয়া চলিয়াছে। ছোট হওয়া বড় বিপদ; বড় ছোটকে নিজের অধীনে রাথৈ; তার পরে ছোটরা যে দল পাকাইয়া পরস্পরকে আকর্ষণ করিবে, তাহারও উপায় থাকে না, কারণ ছোটদের শক্তি অল্প। কাজেই এই শত শত অতিথির দশা পূর্ব্ব উদাহরণের একক অতিথির অনুরূপই হইবে। রাজ্যে প্রবেশলাভ করিবামাত্র কতকগুলিকে সূর্য্য এবং আর কতকগুলিকে বৃহস্পতি গ্রাস করিয়া ফেলিবে। অবশিষ্ট অতিথিরা হয়ত দুই চারবার সূর্য্য বা বৃহস্পতির অতি নিকটে আসিয়া পলাইতে পারিবে, কিন্তু একেবারে মুক্তিলাভ কাহারও অদৃষ্টে ঘটিবে না। ইহাদের অধিকাংশই সূর্য্য গ্রাস করিয়া ফেলিবে। অবশিষ্টগুলি বৃহস্পতির ভাগে পড়িবে। কোন্ উল্কাপিণ্ড সৌররাজ্যে প্রবেশ করিয়া কতদিন পরে সূর্য্য বা বৃহস্পতির ক্রোড়ে নির্ব্বাণ লাভ করিবে তাহা বলা কঠিন। যে দিক্ ধরিয়া এবং যে গতিতে উল্কাপিণ্ডগুলি সৌরজগতে প্রবেশ করে, তাহাদের প্রাত্যকের নির্ব্বাণলাভের কাল সেই দিক্ ও গতির উপরেই নির্ভর করে। সুতরাং দেখা যাইতেছে, যেটি খুব অনুকূল গতি ও দিক্ লইয়া বৃহস্পতি ও সূর্য্যের অধিকারে প্রবেশ করিবে, তাহার জীবনও দীর্ঘ হইবে। সহস্র সহস্র উল্কাপিণ্ড বা ক্ষুদ্র গ্রহের মধ্যে অন্ততঃ দু’চারিটির এইপ্রকার অনুকূল পথে অনুকূল গতি লইয়া প্রবেশ করা একটুও আশ্চর্য্য নয়। কাজেই সূর্য্য বা বৃহস্পতির ক্রোড়ে আশ্রয় গ্রহণ না করিয়া আমাদের সুপরিচিত গ্রহদের ন্যায় ইহাদের নিরাপদে পরিভ্রমণ করাই স্বাভাবিক। জর্জ্জ ডারুইন্‌ বলিতে চাহিতেছেন, সৌরজগতে বুধ, শুক্র, পৃথিবী, মঙ্গল প্রভৃতি যে-সকল গ্রহ নির্দ্দিষ্ট কক্ষায় পরিভ্রমণ করিতেছে, তাহারা সকলেই অনুকূল গতি ও দিক্ লইয়া সৌর অধিকারে প্রবেশ করিয়াছিল, এই কারণেই তাহাদের কক্ষা স্থির রহিয়াছে; যাহারা প্রতিকূল অবস্থায় আসিয়াছিল, তাহারা সূর্য্য বা অপর কোন প্রতাপশালী গ্রহের টানে ঐ সকল জ্যোতিষ্কে পড়িয়া নিজেদের অস্তিত্ব লোপ করিয়াছে; ইহারা এখন সূর্য্য বা অপর কোন বৃহৎ গ্রহের অঙ্গীভূত।

 পূর্ব্বোক্ত কথাগুলি হইতে বুঝা যাইতেছে, মানুষ যেমন স্বাস্থ্যহিসাবে অল্পায়ু বা দীর্ঘজীবী হয়, নক্ষত্র-জগতের গ্রহ উপগ্রহগণও ঠিক সেই প্রকারে তাহাদের গৃহ-প্রবেশকালের গতিবিধির অবস্থা অনুসারে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখে। পার্থক্যের মধ্যে এই যে, মানুষের জীবন এক দুই দশ বা শত বৎসরব্যাপী, জ্যোতিষ্কের জীবন দুই চারি দিন হইতে আরম্ভ করিয়া কোটি কোটি বৎসরব্যাপী। কোন-গতিকে সূর্য্যের আকর্ষণ হইতে মুক্তি লাভ করিবার মত অবস্থা লইয়া যে গ্রহটি সৌর জগতে প্রবেশ করিয়াছে সেটি হয় ত দু’চার লক্ষ বৎসর বাঁচিবে, এবং যাহারা আরও অনুকূল অবস্থায় প্রবেশ করিয়াছে তাহাদের জীবন সম্ভবতঃ কোটি কোটি বৎসরেও অবসান হইবে না। কিন্তু মৃত্যুমুখ হইতে কাহারও নিস্তার নাই, চিরস্থির কক্ষায় ঘুরিতে পারে এ প্রকার হিসাব-পত্র করিয়া এবং তদনুসারে গতিসম্পন্ন হইয়া হয় ত কোন গ্রহ গৃহ প্রবেশ করে নাই।

 মানুষের জীবনটা যেমন ক্ষুদ্র, তাহাদের অভিজ্ঞতাও তেমনি অল্প। অধিক কি, আমরা দশ হাজার বৎসর পূর্ব্বেকারও খবর লিপিবদ্ধ রাখি নাই। সুতরাং যে জ্যোতিষ্ক দশ কোটি বৎসর ধরিয়া নিরাপদে সূর্য্য প্রদক্ষিণ করিয়া সূর্য্যের কবলিত হইবে, আমরা যদি তাহাকে স্থির-কক্ষা গ্রহ বলি, ইহাতে বোধ হয় ভুল হয় না। জর্জ্জ ডারুইন্ ও তাঁহার শিষ্যগণ এই শ্রেণীর দীর্ঘজীবী গ্রহগণকেই স্থিরকক্ষা-সম্পন্ন বলিতে চাহিতেছেন।

 এখন জিজ্ঞাসা করা যাইতে পারে, সৌর-জগৎ বা অপর কোন নক্ষত্র-জগতের অতিথি গ্রহগুলির মধ্যে কতকগুলি যেন মোটামুটি স্থিরকক্ষা হইল; কিন্তু তাই বলিয়া কি তাহাদের সুদীর্ঘ বা অনন্ত জীবনের মধ্যে আর কোন বিপদ নাই? জর্জ্জ ডারুইন্ এই প্রশ্নের একটা বড় অশুভ উত্তর দিয়াছেন। তিনি বলেন, এই যে আমাদের পৃথিবী একটা নির্দ্দিষ্টপথ অবলম্বন করিয়া নির্দ্দিষ্টকালে সূর্য্য প্রদক্ষিণ করিতেছে, কোন কারণে যদি সে তাহার কক্ষা হইতে একটু বিচলিত হয়, তাহা হইলে আর রক্ষা নাই! এই যে, একটু অকল্যাণ হইল, তাহা কালে কালে বৃদ্ধি পাইয়া এক সময়ে এমন হইয়া দাঁড়াইবে যে, তখন আর পৃথিবীর নিস্তার থাকিবে না; অল্পায়ুঃ ভ্রাতৃগণের ন্যায় তাহাকেও সূর্য্যের গ্রাসে পড়িতে হইবে।

 পূর্ব্বোক্ত প্রকারে আমাদের সৌরজগতের গ্রহ-উপগ্রহগণের ধ্বংসের সম্ভাবনা আছে কি না জানিবার জন্য কৌতূহল হওয়া স্বাভাবিক। পণ্ডিতগণ এই প্রসঙ্গের যে মীমাংসায় উপনীত হইয়াছেন, তাহাতে ধ্বংসের সম্ভাবনাই দেখা যায়। জর্জ্জ ডারুইন্ যখন সূর্য্য এবং বৃহস্পতি বা অপর কোন জ্যোতিষ্কের অস্তিত্ব স্বীকার করিয়া গণনা করিয়াছিলেন, তখন নবাগত উল্কাপিণ্ডদিগকে গুরুত্বহীন বলিয়াই ধরিয়াছিলেন এবং আরও স্বীকার করিয়াছিলেন যে, মহাকাশে পরিভ্রমণকলে তাহারা বাহির হইতে কোন প্রকার বাধা প্রাপ্ত হয় না। বলা বাহুল্য, হিসাবের জটিলতা-বর্জ্জনের জন্যই তিনি এই প্রকার স্বীকার করিয়া লইয়াছিলেন। কিন্তু প্রকৃত ব্যাপারের কথা মনে করিলে বুঝা যায়, উল্কাপিওগুলি আকারে যতই ক্ষুদ্র হউক না কেন, তাহাদের ভার আছে এবং ভ্রমণপথেও তাহারা বাধাপ্রাপ্ত হয়। কাজেই আমাদের গ্রহ-উপগ্রহগণ এখন যে কক্ষায় সূর্য্য প্রদক্ষিণ করিতেছে, তাহা হইতে কালক্রমে উহাদিগকে অত্যল্প বিচলিত হইতেই হইবে এবং বিচলিত হইলে নিশ্চয়ই ধ্বংসমুখে পড়িতে হইবে। কাজেই দেখা যাইতেছে, গ্রহ-উপগ্রহের মৃত্যুবীজ তাহাদের সঙ্গেই আছে। কিন্তু এই অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুভয়ে মানবজাতির বিচলিত হইবার কারণ নাই। আমাদের গ্রহ-উপগ্রহগণের মৃত্যুর আরও শত শত বীজ প্রোথিত হইয়াছে এবং সেগুলি অঙ্কুরিত হইতেও আরম্ভ করিয়াছে, স্বাভাবিক মৃত্যুর অনেক পূর্ব্বে এগুলির কুফলেই সৃষ্টিলোপের সম্ভাবনা আছে।

 পূর্ব্বের কথাগুলি হইতে বুঝা যাইতেছে, সৌরজগতের গ্রহগুলির মধ্যে কতকগুলির মোটামুটি হিসাবে স্থির-কক্ষা আছে, এবং কতকগুলির নাই। যাহাদের নাই, তাহারা জীবন-সংগ্রামে কিছুদিন যুঝিয়া বৈরিহস্তে আত্মসমর্পণ করে। যাহাদের আছে, তাহারা বাহিরের প্রবল শত্রুর সহিত আপোস করিয়া এবং বাহিরের সহিত নিজের চালচলন মিলাইয়া বর্ত্তিয়া থাকে। এখানেও সেই বৃদ্ধ ডারুইনের অভিব্যক্তিবাদের সূত্র তলায় তলায় কাজ করিতেছে।

 কি প্রকারে বুধ, শুক্র, পৃথিবী ও মঙ্গলাদি-গ্রহযুক্ত এই বিশাল সৌরজগতের সৃষ্টি হইল এখন বোধ হয় বুঝা কঠিন হইবে না। প্রথমে সূর্য্য এবং বৃহস্পতিই সৌরজগতে রাজত্ব করিত; তার পর দলে দলে উল্কাপিণ্ড বা ক্ষুদ্র গ্রহাকার নূতন অতিথির আগমন হইল। এগুলি যথেচ্ছ প্রকারে যথেচ্ছ পথে ছুটিয়া চলিত। সূর্য্য এবং বৃহস্পতি সুবিধা বুঝিয়া অধিকাংশকে গ্রাস করিয়া পুষ্টাঙ্গ হইল; সৌরজগতে ছোটখাট উল্কাপিণ্ড বা ধূলিকণাও রহিল না; যাহারা সৌরাধিকারে প্রবেশকালে অনুকূল গতিবিধি লইয়া আসিয়াছিল, কেবল তাহারাই টিকিয়া থাকিল। এই টিকিয়া-থাকা অতিথিগণই এখন এক এক নির্দ্দিষ্ট পথে, নির্দ্দিষ্ট দূরে থাকিয়া সূর্য্যপ্রদক্ষিণ করিতেছে। ইহাদিগকে লইয়াই সৌরজগৎ।

 আধুনিক বৈজ্ঞানিকগণ যে-সকল প্রাকৃতিক ব্যাপারের মুলে গিয়া পৌঁছিয়াছেন, প্রায়ই তাহাদের গোড়ার একটি নিয়মের সন্ধান পাইয়াছেন। জর্জ্জ ডারুইন্ সৃষ্টিতত্ত্বের যে ব্যাখ্যান দিতেছেন, তাহাতে তিনি এখনো কোন নির্দ্দিষ্ট নিয়মের সন্ধান পান নাই। ঠিক কোন্ অবস্থায় সৌরজগতে প্রবেশ করিলে নবাগত গ্রহগণ চিরনির্দ্দিষ্ট কক্ষায় ভ্রমণ করিতে পারে, তাহার সূত্র আজও আবিষ্কৃত হয় নাই; তা’ছাড়া কোন্ গ্রহের কক্ষা স্থির এবং কোন্‌টির কক্ষা বিচলনশীল তাহা নির্ণয় করিবার নিয়ম আজও ধরা পড়ে নাই। কিন্তু এই সকল মূল সূত্রগুলি যে শীঘ্রই আবিষ্কৃত হইবে তাহার লক্ষণ দেখা যাইতেছে;—বোড্ সাহেব গ্রহগণের দূরত্বের মধ্যে যে সুশৃঙ্খলা দেখিয়া অবাক্ হইয়াছিলেন, তাহারও কারণ নির্দ্দেশ করা যাইবে বলিয়া আশা হইতেছে।

 সমগ্র বিশ্ব যে গোড়ায় এক মহানিয়মের অধীন হইয়া মূর্ত্তিমান্ হইয়া পড়িয়াছে, আজকালকার নানা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারে তাহার আভাস পাওয়া যায়। সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ণ পরমাণুর গঠনের সহিত বিরাট্ সৌরজগতের সংগঠনের তুলনা করিলেও ইহার লক্ষণ দেখা যায়। জর্জ্জ ডারুইন্‌ যেমন একটি বৃহৎ জ্যোতিষ্কের চারিদিকে শত শত ক্ষুদ্র উল্কাপিণ্ডের অস্তিত্ব মানিয়া জগতের অভিব্যক্তি দেখাইতে চেষ্টা করিয়াছেন অতিসূক্ষ্ম পরমাণুর গর্ভে অপর বৈজ্ঞানিকগণ ঠিক্ সেই প্রকার শত শত অতি-পরমাণুকে (Corpuselcs) নিয়ত ভ্রাম্যমাণ দেখিতে পাইয়াছেন। জ্যোতিষ্কদিগের ন্যায় অতি-পরমাণুদিগের মধ্যে ঘাত-প্রতিঘাত, সংযোগবিয়োগ এবং এক এক নির্দ্দিষ্ট কক্ষায় ভ্রমণ নাই, এ কথা কেহই বলিতে পারেন না, বরং তাহারই লক্ষণ দেখা যাইতেছে। সুতরাং যদি বলা যায়, কোন এক শুভদিনে বিরাট্ জ্যোতিষ্ক-জগতের অভিব্যক্তির সূত্র আবিষ্কৃত হইলে, অতি-সূক্ষ্ম পরমাণুর মধ্যে যে সূক্ষ্মতম ক্ষুদ্র-ব্রহ্মাণ্ডগুলি রহিয়াছে, তাহারও মূল তত্ত্ব জানা যাইবে, তাহা হইলে বোধ হয় অধিক কিছুই বলা হয় না।