মঙ্গলগ্রহ

মঙ্গলগ্রহ পৃথিবীর নিকটবর্ত্তী বলিয়া জ্যোতিষিগণ ইহাকে অনেকদিন হইতে ভাল করিয়া পর্য্যবেক্ষণ করিয়া আসিতেছেন। ইহার ফলে গ্রহটির গতিবিধি ও প্রাকৃতিক অবস্থাসম্বন্ধে অনেক কথা জানা গিয়াছে। গত ১৮৯২ খৃষ্টাব্দে মঙ্গলগ্রহ পৃথিবীর খুব নিকটবর্ত্তী হইয়াছিল। বলা বাহুল্য, জ্যোতিষিগণ এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করিয়াছিলেন। নানা দেশের শত শত জ্যোতিষী দূরবীক্ষণ সাহায্যে মঙ্গলকে পর্য্যবেক্ষণ করিয়াছিলেন। ইহার পর সে প্রকার সুযোগ বহুকাল পাওয়া যায় নাই। আজ মাস হইল, আবার সেই শুভ মুহূর্ত্ত উপস্থিত হইয়াছিল। দেশবিদেশের জ্যোতিষিগণ সেই দুর্লভ সময়ে বড় বড় দূরবীক্ষণ দ্বারা আবার নূতন করিয়া মঙ্গলকে পর্য্যবেক্ষণ করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। ১৮৯২ সালে যে-সকল যন্ত্র দ্বারা পর্য্যবেক্ষণ করা হইয়াছিল, এই ১৬ বৎসরে তাহাদের অনেক উন্নতি হইয়াছে; সুতরাং এই সকল উন্নত যন্ত্রাদি-সাহায্যে যে পর্যবেক্ষণ হইয়াছে, তাহা দ্বারা মঙ্গললোকের অনেক নূতন খবর পাওয়া যাইবে বলিয়। আশা হইতেছে।

 পাঠক অবশ্যই অবগত আছেন, প্রত্যেক গ্রহ এক একটি নির্দিষ্ট পথ অবলম্বন করিয়া সূর্য্যকে প্রদক্ষিণ করে। পৃথিবী, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি প্রভৃতি ছোট বড় সকল গ্রহই সূর্য্যকে মাঝে রাখিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। গ্রহগণের ভ্রমণপথ ঠিক বৃত্তাকার নয়। এককেন্দ্র (Concentric) বৃত্তদ্বয়ের পরিধির মধ্যেকার ব্যবধান যেমন অপরিবর্ত্তত থাকে, পথগুলি' বৃত্তাকার হইলে প্রত্যেক দুই গ্রহের ভ্রমণপথের মধ্যেকার ব্যবধানকেও ঠিক সেই প্রকার অপরিবর্তূগত দেখা যাইত। গ্রহমাত্রেই এক একটি বৃত্তাভাস, অর্থাৎ ডিম্বাকার (Elliptical) পথ অবলম্বন করিয়া সূর্য্যকে প্রদক্ষিণ করে, এবং সূর্য্য সেই বৃত্তাভাস ক্ষেত্রেরই একটি অধিশ্রয় (Focus) অবলম্বন করিয়া স্থির থাকে। কাজেই পরিভ্রমণপথগুলির পরস্পর ব্যবধান কখনই এক দেখা যায় না। মঙ্গলের তুলনায় পৃথিবী সূর্য্যের নিকটতর। এজন্য পৃথিবী যে বৃত্তাভাসপথে সূর্য্যকে প্রদক্ষিণ করে, তাহা মঙ্গলের পথের ভিতরে থাকিয়া যায়। তা’ছাড়া পথ দুইটির অবস্থান এরূপ বিচিত্র যে, যখন মঙ্গল সূর্য্যের নিকটতম স্থান অধিকার করে, তখন পৃথিবী সূর্য্য হইতে অনেক দূরে পড়িয়া থাকে।

 পৃথিবীর ভ্রমণপথ মঙ্গলের ভ্রমণপথের মধ্যবর্ত্তী হওয়ায়, মঙ্গলের পথের তুলনায় পৃথিবীর পথ কিছু ছোট হইয়া পড়িয়াছে, এবং তা’র উপর আবার পৃথিবীর পরিভ্রমণ বেগ মঙ্গলের বেগের তুলনায় কিঞ্চিৎ দ্রুততর। এই সকল কারণে পৃথিবী যে সময়ে একবার সূর্য্যকে প্রদক্ষিণ করে, মঙ্গলের পূর্ণ প্রদক্ষিণ সে সময়ে শেষ হয় না। কাজেই নিকটবর্ত্তী হইয়া দেখা সাক্ষাৎ করা প্রতি বৎসর ইহাদের ভাগ্যে ঘটিয়া উঠে না। হিসাব করিয়া দেখা গিয়াছে, মঙ্গল ও পৃথিবী তাহাদের নির্দ্দিষ্ট পথে ভ্রমণ করিতে করিতে প্রায় দুই বৎসরে এক একবার পাশাপাশি আসিয়া দাঁড়ায়। আমরা পূর্ব্বেই বলিয়াছি, পৃথিবী ও মঙ্গলের ভ্রমণপথের ব্যবধান সকল স্থানে সমান নয়; সুতরাং উভয়ের মিলনকালে ব্যবধানটা যদি খুব ছোট না হয়, তবে পর্য্যবেক্ষণের অত্যন্ত অসুবিধা আসিয়া পড়ে। গ্রহদ্বয়ের ভ্রমণপথের যে দুইটি স্থানের দূরত্ব সর্ব্বাপেক্ষা অল্প, ১৮৯২ সালে এবং গত বৎসরে মঙ্গল ও পৃথিবী সেইস্থানে আসিয়া মিলিয়াছিল। জ্যোতিষিগণ এই দুই বৎসরে মঙ্গললোকের অনেক নূতন তথ্য সংগ্রহ করিবার সুযোগ পাইয়াছিলেন।

 ভ্রমণপথ যে সমতলে অবস্থিত, পৃথিবী তাহার উপর খাড়া হইয়া দাঁড়াইয়া চলা-ফেরা করে না। ইহার অক্ষরেখা (Axis) সেই সমতলের সহিত প্রায় ২৩° অংশ পরিমিত কোণ করিয়া হেলিয়া রহিয়াছে। পাঠক অবশ্যই অবগত আছেন, অক্ষরেখার এই বক্রতাই ভূপৃষ্ঠের শীতগ্রীষ্মাদি নানা ঋতুকে ডাকিয়া আনে। মঙ্গল পৃথিবীর নিকটবর্ত্তী হইলে, তাহার অক্ষরেখা পরীক্ষা করিয়া তাহাতেও ঠিক ঐ পরিমাণ বক্রতা দেখা গিয়াছে, এবং মাঙ্গলিক দিন ও পার্থিব দিনের মধ্যেও একতা ধরা পড়িয়াছে। হিসাব করিলে দেখা যায়, মাঙ্গলিক দিন পার্থিব দিন অপেক্ষা চল্লিশ মিনিটের অধিক দীর্ঘ নয়; সুতরাং শীত গ্রীষ্মাদি নানা ঋতু যে, কেবল পৃথিবীতেই বিরাজ করিতেছে, এখন আর সে কথা বলা যায় না। মঙ্গললোকেও ষড়ঋতু নিয়মিতভাবে যাওয়া-আসা করে।

 পৃথিবীর সহিত মঙ্গলগ্রহের ইহাই একমাত্র ঐক্য নয়। পুনঃপুনঃ মঙ্গলকে পর্য্যবেক্ষণ করিয়া উভয়ের মধ্যে আরো অনেক একতা দেখা গিয়াছে। মঙ্গলের ব্যাস ৪২০০ মাইল। কাজেই আয়তনে মঙ্গল, পৃথিবী অপেক্ষা অনেক ছোট, এবং গুরুত্বেও অনেক লঘু। হিসাব করিলে দেখা যায়, পৃথিবী তাহার পৃষ্ঠস্থ বস্তুগুলিকে যে বলে টানে, মঙ্গল তাহার পাঁচভাগের দুইভাগ মাত্র বলে টানিতে পারে। এক মণ পঁইত্রিশ সের ওজনের মানুষ পৃথিবী হইতে সহসা মঙ্গললোকে নীত হইলে, সেখানে তাহার ওজন আধমণের অধিক হইবে না; সুতরাং পার্থিব মানব মঙ্গললোকে গিয়া মৃত্তিকা হইতে বহু ঊর্দ্ধে লাফাইতে পারিবে, এবং তাহার হস্তনিক্ষিপ্ত লোষ্ট্র পৃথিবীর তুলনায় আড়াইগুণ উচ্চে উঠিয়া, ধীরে ধীরে নামিয়া মাটিতে পড়িবে।

 গ্রহের লঘুতা তাহার উপরিস্থিত পদার্থগুলিকে লঘু করিয়াই ক্ষান্ত হয় না। লঘুতার সঙ্গে সঙ্গে তাহার আকর্ষণের পরিমাণ কমিয়া আসে বলিয়া, সকল প্রাকৃতিক ব্যাপারই ভিন্ন লক্ষণাক্রান্ত হইয়া পড়ে। গ্রহাদির গুরুত্বের তুলনায় সূর্য্য নক্ষত্র প্রভৃতি বৃহৎ জ্যোতিষ্কগুলির গুরুত্ব অনেক অধিক; সুতরাং ইহাদের আকর্ষণও অত্যন্ত প্রবল। পরীক্ষা করিয়া দেখা গিয়াছে, এই শ্রেণীর বড় জ্যোতিষ্কগুলি হাইড্রোজেন্, হেলিয়ম্ প্রভৃতি অতি লঘু বাষ্পগুলিকেও তাহাদের আকাশ হইতে যাইতে দেয় নাই। নক্ষত্রদিগের আকাশ সর্ব্বদাই লঘু-গুরু নানাজাতীয় বাষ্পে পূর্ণ থাকে। পৃথিবীর গুরুত্ব মঙ্গলের তুলনায় অধিক হইলেও, সূর্য্য ও নক্ষত্রাদির তুলনায় অতি অল্প। কাজেই পৃথিবী তাহার দুর্ব্বল আকর্ষণে হাইড্রোজেন্, হেলিয়ম্ প্রভৃতি লঘু-বাষ্পগুলিকে আকাশে আবদ্ধ রাখিতে পারে নাই। এগুলি বহুকাল পৃথিবীকে ত্যাগ করিয়া মহাকাশে চলিয়া গিয়াছে। এখন কেবল অক্সিজেন্, নাইট্রোজেন্ প্রভৃতি গুরুতর বাষ্পগুলিই আমাদের আকাশকে আচ্ছন্ন করিয়া রাখিয়াছে। চন্দ্রের গুরুত্ব ও আয়তন উভয়ই পৃথিবী অপেক্ষা অনেক অল্প। এইজন্য ইহার আকাশের অবস্থা আরও শোচনীয় হইয়া দাঁড়াইয়াছে। অক্সিজেন্ ও নাইট্রোজেনের ন্যায় গুরু বাষ্পকেও চন্দ্র টানিয়া রাখিতে পারে নাই। কাজেই চন্দ্রের দেশে আকাশ একপ্রকার শূন্য হইয়াই রহিয়াছে। চন্দ্রগর্ভ হইতে যে জলীয় ও অঙ্গারক বাষ্প উত্থিত হয়, তাহাই ক্ষণকালের জন্য আকাশে বিচরণ করিয়া ক্রমে চিরকালের জন্য মহাকাশে অন্তর্হিত হইয়া যায়। মঙ্গলের গুরুত্ব, চন্দ্রের ন্যায় নিতান্ত অল্প নয়; সুতরাং ইহাতে নাইট্রোজেন্ বা অক্সিজেনের ন্যায় গুরু বাষ্প থাকারই সম্ভাবনা অধিক।

 মঙ্গলপৃষ্ঠে যে জলীয় বাষ্প আছে, গত ১৮৯২ সাল এবং তৎপূর্ব্বকার পর্য্যবেক্ষণে তাহার অনেক প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে। পৃথিবীর মেরুসন্নিহিত প্রদেশ যেমন শীতকালে বরফে আচ্ছন্ন হইয়া পড়ে, মঙ্গলগ্রহে শীতকাল উপস্থিত হইলে, তাহার মেরুপ্রদেশকেও ঠিক সেই প্রকারে তুষারাচ্ছন্ন হইতে দেখা যায়। গ্রীষ্মকাল উপস্থিত হইলে পৃথিবীরই মত সেই মাঙ্গলিক তুষাররাশি গলিয়া মেরুপ্রদেশের শুভ্রতা নষ্ট করিয়া ফেলে।

 মেরুপ্রদেশের পূর্ব্বোক্ত শুভ্রমুকুটকে কয়েকজন পণ্ডিত কঠিন অঙ্গারক-বাষ্প বলিয়া স্থির করিয়াছিলেন। আমেরিকার লিক্ মানমন্দিরের প্রধান-জ্যোতিষী জগদ্বিখ্যাত পণ্ডিত পিকারিঙ্ সাহেব ইহার প্রতিবাদ করিয়া দেখাইয়াছেন,—যতই শীতল করা যাউক না কেন, আমাদের বায়ুমণ্ডলের চাপের অন্ততঃ পাঁচগুণ চাপ না পাইলে অঙ্গারক বাষ্প জমাট বাঁধিতে পারে না; কিন্তু মঙ্গলের আকাশের চাপ ভূ-বায়ুর চাপ অপেক্ষা অনেক কম; সুতরাং জলীয় বাষ্পই যে জমাট বাঁধিয়া মঙ্গলে শ্বেতমুকুটের রচনা করে, তাহাতে আর সন্দেহ করিবার কারণ নাই; কিন্তু পৃথিবীর মত মঙ্গলে প্রচুর জল নাই, এবং মাঙ্গলিক সমুদ্রগুলিও পৃথিবীর সমুদ্রের ন্যায় গভীর নয়। পৃথিবীর জলাভূমিগুলি যেমন অগভীর, মাঙ্গলিক সমুদ্রগুলিও প্রায় তদ্রূপ। শীতের পর বসন্ত উপস্থিত হইলে মেরুপ্রদেশের তুষাররাশি গলিয়া এই নিম্ন ভূমিগুলিকে জলপ্লাবিত করে।

 আমরা পূর্ব্বেই বলিয়াছি, মঙ্গলের তুলনায় পৃথিবীর গুরুত্ব অত্যন্ত অধিক, কাজেই ইহার আকর্ষণের পরিমাণও মঙ্গল অপেক্ষা অনেক অধিক। এই আকর্ষণে পৃথিবী খুব লঘু বাষ্পগুলিকে টানিয়া রাখিতে পারে নাই বটে, কিন্তু জলীয় বাষ্পকে সে সহজে ছাড়িতেছে না। এই কারণে ইহা নানা আকার পরিগ্রহ করিয়া সর্ব্বদা ভূপৃষ্ঠে ও আকাশে বিচরণ করিতেছে; কিন্তু মঙ্গল তাহার দুর্ব্বল টানে জলীয় বাষ্পকে আবদ্ধ রাখিতে পারে না। কাজেই এই বাষ্পগুলি ধীরে ধীরে গ্রহত্যাগ করিয়া পলাইয়া যায়। পিকারিঙ্ সাহেব বলিতেছেন, গ্রহের গর্ভ হইতে যে-সকল জলীয় বাষ্প সদ্য উত্থিত হইতেছে, তাহা

জমিয়াই মেরুপ্রদেশের তুষারাবরণ উৎপন্ন করে, এবং বসন্তাগমে গলিয়া জল ও বাষ্পাদির আকার প্রাপ্ত হইলে তাহার সমস্তই গ্রহত্যাগ করিয় চলিয়া যায়; সুতরাং দেখা যাইতেছে, বর্ত্তমান অবস্থায় মঙ্গলে জল থাকিলেও, যখন গর্ভস্থ জলভাণ্ডার সম্পূর্ণ শূন্য হইয়া যাইবে, তখন আর একবিন্দু জলও মঙ্গলপৃষ্ঠে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।

 পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের চাপ ত্রিশ ইঞ্চি উচ্চ পারদের ভারকে অনায়াসে উপরে উঠাইয়া রাখিতে পারে। হিসাব করিয়া দেখা গিয়াছে, মঙ্গলের আকাশের চাপ সাত ইঞ্চির অধিক উচ্চ পারদকে ঠেলিয়া রাখিতে পারে না। মানুষ কত তরল বায়ুর মধ্যে থাকিয়া প্রাণধারণ করিতে পারে, তাহার পরীক্ষা হইয়া গিয়াছে। ইহাতে দেখা গিয়াছিল, বায়ুকে তরল করিতে করিতে যখন তাহার চাপ পাঁচ ইঞ্চি উচ্চ পারদের ভারের অনুরূপ হয় তখন সেই বায়ু দ্বারা আর শ্বাসপ্রশ্বাসের কাজ চলে না। মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলের চাপ প্রায় সাত ইঞ্চি পারদের ভারের তুল্য সুতরাং এই বায়ু শ্বাসপ্রশ্বাস করিয়া, এবং গ্রহপৃষ্ঠস্থ জল ব্যবহার করিয়া, কোন জীবের প্রাণধারণ করা অসম্ভব নয়; কিন্তু এইপ্রকার প্রতিকূল অবস্থায় পড়িয়া ঠিক আমাদিগের মত বুদ্ধিমান প্রাণী মঙ্গলগ্রহে জন্মিতে পারিয়াছে কি না, সে বিষয়ে ঘোর সন্দেহ আছে।

 দূরবীক্ষণসাহায্যে মঙ্গল পর্য্যবেক্ষণ করিলে তাহার উপরে কতকগুলি সুবিন্যস্ত রেখা দেখিতে পাওয়া যায়। এইগুলিকে লইয়া আজ কয়েক বৎসর জ্যোতির্ব্বিদ্‌গণের মধ্যে খুব আলোচনা চলিতেছে। একদল জ্যোতিষী বলিতেছেন, এই রেখাগুলি মঙ্গলপৃষ্ঠস্থ বড় বড় খাল ব্যতীত আর কিছুই নয়। বরফগলা জলকে মেরুপ্রদেশ হইতে দূরদেশে লইয়া আসিবার জন্য মাঙ্গলিক প্রাণিগণ এই খালগুলিকে কাটিয়া রাখিয়াছে। ইহারা কোনক্রমে এগুলিকে স্বাভাবিক খাল বলিয়া স্বীকার করিতে চাহিতেছেন না। দূরবীক্ষণে এগুলিকে যে প্রকার সরল ও সুবিন্যস্ত দেখা যায়, কোন নদনদীকে স্বাভাবিক অবস্থায় সে প্রকার দেখা যায় না। এই সকল যুক্তির উপর নির্ভর করিয়া ইহারা বলিতেছেন, মানুষ অপেক্ষা সহস্রগুণে বুদ্ধিমান কোন প্রাণী নিশ্চয়ই মঙ্গলে বাস করিতেছে, এবং ইহারাই বুদ্ধিকৌশলে ঐসকল বৃহৎ খাল খনন করিয়া গ্রহের সর্ব্বাংশে জল যোগাইতেছে।

মঙ্গলগোলকস্থ কৃষ্ণরেখাগুলি সত্যই জলপ্রণালী, তাহাতে আর সন্দেহ নাই। মেরুপ্রদেশের বরফ গলিতে আরম্ভ করিলে, ঐ রেখাগুলিকে সুস্পষ্ট দেখা যায়। জ্যোতির্ব্বিদ্‌গণ বলেন, বরফের জলে খালগুলি পূর্ণ হইলে, তাহার উভয় তীরের সিক্ত মৃত্তিকায় যে-সকল উদ্ভিদ জন্মে, তাহাই খালগুলিকে স্পষ্ট করিয়া দেয়।

 আর একদল পণ্ডিত পূর্ব্বোক্ত সিদ্ধান্তে প্রতিবাদ করিয়া বলিতেছেন, মাঙ্গলিক খালের ন্যায় সুবিন্যস্ত ছোট ছোট খাল চন্দ্রমণ্ডলের স্থানে স্থানে দেখা যায়। চন্দ্র যে সম্পূর্ণ নির্জীব, তাহাতে আর এখন মতদ্বৈধ নাই; সুতরাং যে প্রাকৃতিক শক্তিতে চন্দ্রে খালের উৎপত্তি হইয়াছে, মঙ্গলের খালগুলি সেই শক্তি দ্বারাই উৎপন্ন হইয়াছে বলিয়া স্বীকার করা অযৌক্তিক নয়। তা’ছাড়া মঙ্গলের যে-সকল অংশকে জ্যোতিষিগণ সমুদ্র বলিয়া স্থির করিয়াছেন, অনেক খালকে সেই সকল সমুদ্রের উপরেই অবস্থিত দেখা যায়; সুতরাং জল-চালনাই যদি খালখননের প্রধান উদ্দেশ্য হয়, তবে ঐ সকল খালের কোনই সার্থকতা খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। যে মাঙ্গলিক জীব সমুদ্রগর্ভে খাল খনন করিতে পারে, তাহাকে কখনই সুবুদ্ধি প্রাণী বলা যাইতে পারে না।

 মঙ্গলগ্রহ, বুদ্ধিমান প্রাণী দ্বারা অধ্যুষিত কি না, এই প্রশ্নটি লইয়া যে তর্ককোলাহলের সৃষ্টি হইয়াছে, তাহার আজও নিবৃত্তি হয় নাই। জ্যোতির্ব্বিদ্‌মাত্রেই কোন এক পক্ষ অবলম্বন করিয়া বিচারে প্রবৃত্ত রহিয়াছেন। বলা বাহুল্য, প্রশ্নটির মীমাংসাচেষ্টায় যে-সকল তথ্য সংগৃহীত হইতেছে, তাহাতে মঙ্গলসম্বন্ধে অনেক নূতন সংবাদ আবিষ্কৃত হইয়া পড়িতেছে; কিন্তু তথাপি এখনো এসম্বন্ধে অনেক জানিতে বাকি। এগুলি নিশ্চিতরূপে আবিষ্কৃত না হইলে, মঙ্গলের প্রাকৃতিক অবস্থাসম্বন্ধে কোন সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব হইবে। প্রসিদ্ধ জ্যোতিষী সিয়াপারেলি (Schiaparelly) সাহেব বহুপূর্ব্বে মঙ্গলে যেসকল রেখা দেখিতে পাইয়াছিলেন, গত ১৮৯৯ সালের পর্য্যবেক্ষণে সেগুলিকে দেখা যায় নাই; কিন্তু ১৯০৩ সালের পর্য্যবেক্ষণে সেগুলি আবার যথাস্থানে আবির্ভূত হইয়াছিল। মঙ্গলগ্রহের এই প্রকার অনেক খুঁটিনাটি ব্যাপারের কোন ব্যাখ্যানই এ পর্য্যন্ত পাওয়া যায় নাই।

 মধ্যে মধ্যে মঙ্গলগ্রহ এক একবার পৃথিবীর নিকটবর্ত্তী হইয়া আত্মপরিচয় প্রদানের সুযোগ উপস্থিত করিবে। দেশবিদেশের জ্যোতির্ব্বিদ্‌গণ এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করিবেন; সুতরাং আশা করা যাইতে পারে, এই সকল পর্য্যবেক্ষণের ফলে বিশ্বের বিচিত্র সৃষ্টির এক অতি ক্ষুদ্র অংশ হইতে রহস্য-যবনিকা উদ্ঘাটিত হইয়া পড়িবে, এবং সঙ্গে সঙ্গে আমরা বিশ্বনাথের সৃষ্টিমহিমাকে আরো প্রত্যক্ষভাবে উপলব্ধি করিবার সুযোগ প্রাপ্ত হইব।