প্রাচীন ভারতে নারী/নানা সংস্কৃতির মিলন

নানা সংস্কৃতির মিলন

 পূর্বেই বলা হইয়াছে, আর্যদের মধ্যে নারীদের যতটা অধিকার ছিল দ্রবিড়দের মধ্যে ছিল তাহা অপেক্ষা অনেক বেশি। দ্রবিড়দের মধ্যে নারীদেরই প্রভুত্ব ও কর্তৃত্ব ছিল। সংসারে ও পরিবারে মাতৃতন্ত্রতাই ছিল দ্রবিড়দের নিয়ম। নারীরা স্বেচ্ছাপূর্বক পুরুষ-নির্বাচন করিয়া ঘর করিতেন। এইসব কারণে পুত্রগত বংশ ও অধিকার না হইয়া তাঁহাদের মধ্যে চলে কন্যাগত বংশ ও অধিকার। মহাভারতের (সভা, ৩১ অধ্যায়) মধ্যে সহদেব-দিগ্বিজয় প্রসঙ্গে মাহিষ্মতী পুরীর বিবরণ দেখিলে বুঝা যায়, নারীদের সেখানে কতখানি স্বাধীনতা ছিল। অগ্নি নাকি তাঁহাদের স্বৈরিণী হইবারও অধিকার দেন, তাই মাহিষ্মতীর নারীরা শাস্ত্রাদির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নহেন, তাঁহারা অপ্রবারিতা (সভা ৩১. ৩৮)।

 যখন সেখানে আর্যদের যাগযজ্ঞ গেল তখন অগ্নি জ্বালাইবার ভার পড়িল সেই দেশে মেয়েদেরই উপর (সভা ৩১. ২৯)। অথচ আর্যদের মধ্যে যজ্ঞাগ্নি পুরুষ পুরোহিতেরই জ্বালাইবার কথা। হয়তো সেই দেশে দেবমন্দিরে তখন নারীরাই পুরুষের কাজ করিতেন। পুরুষেরা নহে। দেবমন্দিরে নৃত্যগীতের দ্বারা পূজা হইত। ক্রমে আর্যসভ্যতা সেই দেশে গেলে ব্রাহ্মণেরা দেবারাধনার কাজ ধীরে ধীরে অধিকার করিলেন, ক্রমে ক্রমে শুধু নৃত্যগীতটুকু এখন দেবদাসীদের উপর রহিয়া গিয়াছে। একটা বড় অধিকার হইতে ভ্রষ্ট হইয়া তাই সেখানে নারীদের স্থিতি অত্যন্ত সংকীর্ণ ও ঘৃণিত হইয়া উঠিয়াছে। সমুদ্র বিরাট বলিয়াই সদা শুচি, ডোবা সংকীর্ণ বলিয়াই পচিয়া ওঠে। এইজন্য সব দেশেই বৃহৎ ক্ষেত্র ও অধিকার হইতে বঞ্চিত পুরুষ বা নারী গভীরতর দুর্গতির দিকে চলিতে থাকে। সেই কারণেই উদার স্বাধীনতার জন্য যুগে যুগে প্রাণ দিয়া নরনারীগণ বীরের সদ্‌গতি বরণ করিতে চাহিয়াছেন।

 দ্রাবিড়-কন্যাদের যেসব অধিকার পূর্বকালে ছিল তাহা হারাইয়া আজ তাঁহারা পূর্বতন মাহাত্ম্য হইতে ভ্রষ্ট। তবু তাঁহাদের সামাজিক রীতিনীতি আমাদিগকে শ্রদ্ধার সহিতই আলোচনা করিতে হইবে।

 আর্যেতর জাতির মধ্যেও নানা ভাগ ও ভালোমন্দ নানারকমের সংস্কৃতি ছিল। আর্যদের বৈদিক প্রাচীন যাগযজ্ঞ ছিল কামনামূলক। “স্বর্গকামো যজেত” অর্থাৎ স্বর্গ-কামনা করিয়া যজ্ঞ করিবে। যজ্ঞের জন্য চাই হিংসা। তাই বৈদিক কর্মকাণ্ড কামনায় ও জীবহিংসায় কলুষিত ছিল।

 আর্যেতর প্রভাবের ফলে ক্রমে আর্যেরা যে হিংসা ছাড়িয়া অহিংসার মহিমা ঘোষণা করিতে লাগিলেন সে কথা পূর্বে একটু বলা হইয়াছে। কামনামূলক স্বর্গাদি ছাড়িয়া ক্রমে আর্যেরা নিষ্কামধর্মের ও বৈরাগ্যের জয়গান করিতে লাগিলেন। হিংসাময় যজ্ঞের স্থলে ভক্তি ও প্রেমের ধর্ম প্রচার করিতেই অবতারেরা আসিলেন। আর অবতারবাদের ফলে দেবতাদের স্থান ক্রমে অধিকার করিলেন মানুষ। মধ্যযুগের সন্তদের বাণীতে দেখা যায়, ‘ভক্তি দ্রবিড় দেশে উৎপন্ন’। পদ্মপুরাণেও (উত্তরখণ্ড ৫০. ৫১) দেখি, ভক্তি দ্রাবিড়দেশে উৎপন্না। কাজেই আর্যেরা ক্রমে ক্রমে আর্যেতর নানাবিধ উত্তম উত্তম সংস্কৃতির দ্বারাই পূর্ণ হইয়া উঠিলেন। আর্যেতর সংস্কৃতির একদল যেমন নারীদের স্বেচ্ছাচার ও অপ্রতিবারণ-বিধি মানিত (মহাভারত, সভা ৩১ অধ্যায়, তেমনি আর-একটা উচ্চতর সংস্কৃতি ছিল বৈরাগ্য, নিষ্কামধর্ম, সন্ন্যাস, কামনাজয় প্রভৃতির উপাসক। আর্যেরা কিন্তু প্রথমে বৈরাগ্যবাদী ছিলেন না। তাঁহাদের ঋষিরা ছিলেন বিবাহিত, অনেকের বহু পত্নীও ছিলেন। স্বয়ং মনুর দশটি পত্নীর কথা আগেই বলা হইয়াছে। কিন্তু জৈন-বৌদ্ধ আদর্শ ও বৈষ্ণব-ভাগবত আদর্শ হইল সন্ন্যাসের অনুকূল। আর্যেরা প্রাণপণ চেষ্টা করিলেন যেন বংশ-বিস্তার-বিরোধী এই সন্ন্যাসধর্ম তাঁদের না পাইয়া বসে। তাই তাঁহারা সন্ততিরক্ষার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করিতে লাগিলেন।

 জরৎকারু ছিলেন তপঃপরায়ণ। বিবাহ না করায় তাঁহার সন্তান হয় নাই, তাই তাঁহার পিতৃগণ অধোগামী হইলেন। অবশেষে তপস্যা ছাড়িয়া জরৎকারু নাগকন্যাকে বিবাহ করিয়া বংশরক্ষা করিলেন। পিতৃগণ আর অধোগামী হইলেন না (আদি ৪৫)। মন্দপাল ঋষি তপস্যার দ্বারা গতিলাভ করিতে না পারিয়া অগত্যা তির্যক-কন্যাকে বিবাহ করিয়া নিরয় হইতে রক্ষা পাইলেন (আদি ২২৯)।

 কাজেই দেখা যাইতেছে, বংশরক্ষা করার দিকে আর্যেরা অত্যন্ত সাবধান রহিলেন। ব্রহ্মনিষ্ঠ হইলেও যাহাতে সকলে গৃহধর্ম পালন করেন তাহার জন্য অনুশাসন রহিল। ক্রমে সবদিক বজায় রাখিবার জন্য চতুরাশ্রমের ব্যবস্থা হইল। তাহার প্রথমটা হইল গৃহস্থজীবনের, তাহার জন্য শিক্ষার কাল হইল ব্রহ্মচর্য। আর শেষটা হইল সন্ন্যাসের, তাহার জন্য প্রস্তুত হইবার কাল হইল বানপ্রস্থ। মোট কথা, জীবনের বারো আনা অর্থাৎ চার আশ্রমের তিনটি আশ্রমই তপস্যা হইয়া উঠিল। শুধু দ্বিতীয় আশ্রমটি গৃহস্থাশ্রম রহিল। যাগযজ্ঞের স্থলে প্রবর্তিত হইল অহিংসা, ভক্তি, যোগ, সাধনা, শম, দম, ভিতিক্ষা, বৈরাগ্যাদির সাধন।

 কিন্তু ক্রমে চতুরাশ্রমের এই আদর্শও শক্তিহীন হইয়া আসিল। ব্রাহ্মণাদি সকলেই এখন চারি আশ্রমের স্থলে একমাত্র গৃহস্থাশ্রমই পালন করেন। দক্ষিণভারতে নম্বুদ্রী ব্রাহ্মণদের মধ্যে শুধু কতক লোক এখনও ব্রহ্মচর্য পালন করেন। উত্তরভারতে আর্যসমাজ গুরুকুল স্থাপন করিয়া বিরাট দেশের মধ্যে জনকয়েককে মাত্র ব্রহ্মচর্যে প্রতিষ্ঠিত রাখার চেষ্টা করেন। আরও দুই-একটি প্রতিষ্ঠান এখন ব্রহ্মচর্যের দিক্ষা দিতে চাহেন। সে ব্রহ্মচর্যও প্রাচীনকালের তুলনায় কি, তাহা দেখিলেই সকলে বুঝেন। পুরুষগণ এখন চারি আশ্রম ঘুচাইয়া গৃহী হইয়াই সারাজীবন কাটাইতেছেন।

 পূর্বকালে বিধবা নারীদের মধ্যেও অনেকেই আবার বিবাহ করিতেন। আর্যদের মধ্যে তপস্যা ও বৈরাগ্য প্রচারের পর, পুরুষদের চতুরাশ্রমের প্রথা চলিল। উচ্চজাতীয় নারীদের মধ্যেও এক বিবাহের পর আর পত্যন্তর গ্রহণপ্রথা রহিল না। বিধবা হইলেই নারীরা ব্রহ্মচারিণী হইতেন ও ব্রহ্মচারিণীর মত মাথা মুণ্ডিত করিয়া থাকিতেন। ইহাতে কতকটা জৈন সাধ্বী এবং বৌদ্ধ ভিক্ষুণীর ভাব দেখা যায়। বাংলাদেশ ছাড়া উত্তরভারতে বিধবার এতটা কৃচ্ছ্রাচার নাই। বাংলাদেশে অনেকটা দক্ষিণভারতের মত বিধবার আচার। নঞ্জুনদায়্যা এবং অনন্তকৄষ্ণ আইয়ার বলেন, পতির মৃত্যুর একাদশ দিনে নারীকে মাথা মুণ্ডন করাইয়া এক বৎসর নির্জনে বাস করিতে হয়। তার পর শ্বেতবসনা তপস্বিনী হইয়া থাকিতে হয়। বিবাহাদি মঙ্গলকর্মে বিধবারা যোগ দিতে পারেন না। খাটে শোওয়া, থালায় খাওয়া, তাম্বুল-গন্ধপুষ্পাদি ব্যবহার ত্যাগ করিয়া বিধবাগণের যতিধর্ম পালন করিতে হয়। বেদে তো বিধবার মুণ্ডনের কথা নাই। প্রাচীন স্মৃতিগুলিতেও নাই। আপস্তম্ব, বসিষ্ঠ, গৌতম, যাজ্ঞবল্ক্য ও মহাভারতেও নাই। কেশমুণ্ডন সমর্থনে স্কন্দপুরাণ ও ব্যাসস্মৃতি মাত্র প্রমাণরূপে ব্যবহৃত হয়।[১]

 পুরুষেরা এখন চতুরাশ্রম ছাড়িয়া আরামে সংসারে থাকিতে পারেন, কিন্তু বিধবাদের মধ্যে যে যতিব্রত আসিয়াছিল তাহার আর পরিবর্তন ঘটিল না। শাস্ত্রানুসারে উপনীত পুরুষমাত্রেরই একাদশী ব্রত পালনীয়। নারীর মধ্যে তাহা শুধু বিধবাদের করণীয়। সধবারা উপবাসে বাদ পড়িয়াছেন, কারণ গর্ভে বা কোলে শিশু থাকিতে পারে। এখন পুরুষেরাও সরিয়া গিয়াছেন, মাত্র বিধবাদেরই একাদশী পালনীয়।

 অম্বুবাচী ব্রত তো ‘যতিব্রতী বিধবা’ অর্থাৎ সব পুরুষ ও বিধবার পালনীয়। কিন্তু পালন করিতে দেখা যায় একমাত্র বিধবাদেরই।

 যেসব ব্যবস্থা আর্যেতর সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসিয়া আর্যগণ করিয়াছিলেন, সেইসব তপস্যা ও কৃচ্ছ্রাচারের ব্যবস্থা পুরুষেরা ধীরে ধীরে ছাড়িয়াছেন। সবই আছে এখন বিধবার উপরে চাপিয়া।

 এইসব আচার ও যতিধর্ম উচ্চবর্ণের বিধবারাই পালন করিতেন। সংখ্যায় উচ্চবর্ণের লোক কম। বাংলাদেশের সাধারণ লোকের মধ্যে এতকাল বিধবারা মাছ খাইতেন; দুই বেলা খাইতেন। অনেকে পুনরায় বিবাহও করিতেন। এখন সকলেরই চেষ্টা উচ্চতর বর্ণের শামিল হইবার জন্য। কাজেই যাঁহাদের মধ্যে বিধবাবিবাহ ছিল তাঁহারাও তাহা ছাড়িতেছেন। এদিকে বিদ্যাসাগর মহাশয় প্রাণপণ করিয়া দুই-চারিজন উচ্চবর্ণের বিধবাদের মধ্যে বিবাহ চালাইতে পারিলেন কি না বলা সন্দেহ, অথচ নিম্নতর শ্রেণীর বিধবারা দলে দলে পত্যন্তরগ্রহণ ছাড়িয়া পুরুষান্তর আশ্রয় করিয়া রক্ষিতা হইয়া রহিল। যদি তাহারা সেইরূপ যতিধর্ম পালন করিতে পারিত তবু একটা সান্ত্বনা ছিল। কিন্তু বিধবাবিবাহ বাদ দিবার ফলে নানা অনাচার ভ্রূণহত্যা এবং সমাজক্ষয় হইয়াই চলিয়াছে। হয়তো ক্রমে এইভাবেই হিন্দুসমাজ লুপ্ত হইয়া যাইবে।

 সতীদাহ বন্ধ করিতে তো কম হাঙ্গামা হয় নাই। অবশেষে আইন করিয়া তাহা বন্ধ করিতে হয়। আকবরের সময় অনেক বিধবা পুড়িয়া মরিবার ভয়ে হিন্দুধর্ম ত্যাগ করিয়া মুসলমানধর্ম গ্রহণ করিয়াছেন।

  1. Mysore Tribes and Castes, vol. II. পৃ ৪৮৬-৪৮৭