প্রাচীন ভারতে নারী/বিবাহবন্ধন-ছেদনে রাজবিধি

বিবাহবন্ধন-ছেদনে রাজবিধি

 ধর্মশাস্ত্র লইয়াই এতদূর আলোচনা চলিল। এখন দেখা যাউক, প্রাচীন রাজ-ব্যবহারে বা আইনে কিরূপ ব্যবস্থা দেখা যায়। এইরূপ আইনের মধ্যে বোধ হয় কৌটিল্যকৃত অর্থশাস্ত্রই বেশ প্রাচীন এবং প্রামাণিক গ্রন্থ। কৌটিল্য নামের জন্য কেহ কেহ ইহা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সমকালীন, অর্থাৎ খৃস্টপূর্ব ৩২১-৩০০ অব্দের, মনে করিয়াছেন। কামন্দকীয়-নীতিসারে এই গ্রন্থ আখ্যাত। মহামহোপাধ্যায় শাম শাস্ত্রী মনে করেন, মনু, যাজ্ঞবল্ক্য প্রভৃতি স্মৃতির যে সংহিতা এখন প্রচলিত, অর্থশাস্ত্র তাহাদের বহু পূর্বে রচিত।[১] আচার্য Winternitz মনে করেন, এই অর্থশাস্ত্র খ্রীস্টীয় দ্বিতীয় শতকের রচনা। তবু তাহা বর্তমান বহু স্মৃতি গ্রন্থেরই পূর্ববর্তী কালের রচিত।

 গ্রন্থখানিতে সাংসারিক যুক্তি-বিচারের দিকেই ঝোঁক দেখা যায়। ধর্মশাস্ত্রে দেখা যায়, ধর্মের প্রমাণের দিকে ঝোঁক। গণপতি শাস্ত্রীর সম্পাদিত কৌটলীয়ের অর্থশাস্ত্র ‘বিদ্যাসমুদ্দেশে’ (১.২.১) সর্বপ্রথমে নাম করিয়াছেন আন্বীক্ষিকী বিদ্যার। আন্বীক্ষিকী বলিতে সাংখ্যযোগ ও লোকায়ত ধরিয়াছেন (পৃ ২৭)। এই বিদ্যা জগতের সর্বাপেক্ষা উপকারিকা (পৃ ২৮)। অথচ এই লোকায়ত মতকে অনেকে নাস্তিক বা হেতুশাস্ত্র বলিয়া খুবই নিন্দা করিয়াছেন। যাজ্ঞবল্ক্য সংহিতা (১. ৩০৮) বলেন, রাজাদের উন্নতি ও পতন হইল গ্রহাধীন, তাই গ্রহগণ পূজ্য। অর্থশাস্ত্র বলেন, যেসব লোক নক্ষত্রের উপরই অতিশয় নির্ভর করে তাহারা ছেলেমানুষ অর্থাৎ মূর্খ, কাজেই তাহারা অর্থ বা অভীষ্ট লাভ হইতে বঞ্চিত হয়। অর্থই হইল অর্থের নক্ষত্র, অর্থাৎ প্রাপ্তির হেতু; তারকাগুলা আর করিবে কি?

নক্ষত্রমতিপৃচ্ছন্তং বালমর্থোঽতিবর্ততে।
অর্থো হ্যর্থস্য নক্ষত্রং কিং করিষ্যন্তি তারকাঃ। অর্থশাস্ত্র-শামশাস্ত্রী, ৯. ৪. ১৪২

 ইহাতেও বুঝা যায়, গ্রীকদের নিকট হইতে প্রাপ্ত গ্রহের ফলাফল-গত সংস্কার আমাদের দেশে ভালো করিয়া প্রতিষ্ঠিত হইবার পূর্বেই অর্থশাস্ত্র লিখিত।

 অর্থশাস্ত্রে তখনকার দিনের সামাজিক অবস্থা ও ব্যবস্থার সুন্দর একটি চিত্র পাওয়া যায়। কাজেই তখন ভারতে নারীদের অধিকার, দায়প্রাপ্তি বিষয়ে অনেক খবর এই গ্রন্থে পাওয়া যায়। অর্থশাস্ত্র নারীদের কোথাও দেবীও বলেন নাই, দানবী বা পিশাচীও বলেন নাই। তখনকার আইনের দৃষ্টিতে নারীদের ভালোমন্দ সবই অর্থশাস্ত্র নিষ্কপটে বলিয়াছেন। আইন যে তখন নারীদের খুব অনুকূল ছিল তাহা নয়। অন্ততঃ অর্থশাস্ত্র তো নারীদের বিশেষ কোনো সুবিধা দেয় নাই। অর্থশাস্ত্র (৩. ২. পৃ ১৫৩) বলেন, নারীদের প্রয়োজন পুত্রের জন্য—

পুত্রার্থা হি স্ত্রিয়ঃ।

 নারী যদি অপুত্রা বন্ধ্যা হয় তবে পতি আট বৎসর প্রতীক্ষা করিবে (পরে অন্য বিবাহ করিতে পারে), যদি স্ত্রী মৃতবৎসা বা কন্যামাত্রপ্রসবিনী হয় তবে দশ বৎসর প্রতীক্ষা করিয়া তার পর অন্য বিবাহ করা চলে (ঐ ৩. ২.)। এই নিয়ম লঙ্ঘনে পূর্বপত্নীকে শুল্ক, স্ত্রীধন এবং অর্ধ আধিবেদনিক দিবে (ঐ)। দ্বিতীয় পত্নী গ্রহণে পূর্বপত্নীকে যে ধনের দ্বারা ক্ষতিপূরণ করা হয় তাহার নাম আধিবেদনিক। তাহা ছাড়া চব্বিশ পণ হইবে রাজদণ্ড। এই ক্ষতিপূরণ দিয়া পুরুষ বহু বিবাহ করিতে পারে (ঐ)। স্ত্রী প্রতিকূল আচরণ করিলে স্বামী তাহাকে তিরস্কার ও দৈহিক দণ্ডও দিবার অধিকারী (ঐ ৩. ৩. পৃ ১৫৫)।

 তবু এই অর্থশাস্ত্রই বিবাহাতিরিক্ত নারীগমন প্রসঙ্গে অর্থাৎ ব্যভিচার বিষয়ে বারবার বলিয়াছেন, ‘অকামা’ অর্থাৎ অনিচ্ছুক নারীকে গমন করিবে না—

ন চ প্রাকাম্যমকামায়াং লভেত। ঐ ৪. ১২. পৃ ২২৯; ঐ, পৃ ২৩০

সবর্ণা হইলে উভয়ের সম্মতি থাকিলে এবং যৌবন প্রাপ্তির পরে তিন বৎসরের পর অভিমত-পুরুষের সহিত নারী চলিয়া যাইতে পারে (ঐ পৃ ২২৯)। নারী যদি অলংকার সঙ্গে না নেয় তবে তিন বৎসরের পর অসবর্ণ পুরুষের সঙ্গেও গেলে আইনত দোষ নাই (ঐ)। কন্যার পিতৃদত্ত কিছু সঙ্গে লইয়া গেলে তাহা চুরি বলিয়া গণ্য হইবে (ঐ)। গণিকার কন্যাকে নষ্ট করিলেও পুরুষ দণ্ডনীয় (ঐ পৃ ২৩৩)। দাসদাসীর কন্যাকে নষ্ট করিলে পুরুষ দণ্ডার্হ এবং সেই কন্যার বিবাহের শুল্ক ও স্ত্রীধন দিতে বাধ্য (ঐ)। নিষ্ক্রয়ানুরূপ দাসীগমনে পুরুষ দণ্ড্য ও ভরণপোষণ করিতে বাধ্য থাকিবে (ঐ)। স্বামী বিদেশে থাকিতে যদি পতিবন্ধু বা পরিজন নারীকে নষ্ট করে, তবে পতি আসিয়া যদি তাহাতে আপত্তি না করে তবে দণ্ড হইবে না, নচেৎ কঠিন দণ্ড হইবে (ঐ)।

 যদি নারীকে অরণ্যে, বন্যায়, দুর্ভিক্ষে বা শ্মশানে কেহ রক্ষা করে অথবা শত্রুহস্ত হইতে কেহ উদ্ধার করে, তবে নারীর সম্মতি থাকিলে সেই পুরুষ নারীকে উপভোগ করিতে পারে (ঐ পৃ ২৩১)। তবে নারী উচ্চজাতীয়া, পুত্রযুক্তা এবং অনিচ্ছুক হইলে এই উপকারের জন্য সে কিছু অর্থমাত্র পাইতে পারে (ঐ)।

 স্বামী ও স্ত্রী উভয়ে উভয়কে যখন না চাহে তখন বিবাহবন্ধন ছিন্ন হইতে পারে। একপক্ষ শুধু বিবাহবিচ্ছেদ চাহিলেই চলিবে না (ঐ ৩. ৩. পৃ ১৫৫)। স্ত্রীর হাতে সে বিপন্ন হইতে পারে মনে করিয়া যদি পুরুষ বিবাহবন্ধন ছিন্ন করিতে চাহে তবে তাহাকে স্ত্রীর কাছে গৃহীত ধন ফিরাইয়া দিতে হইবে (ঐ)। নারীও এইরূপ বিবাহে বিবাহবন্ধন ছিন্ন করিতে চাহিলে স্বামীর দত্তধন ফিরাইয়া দিবে (ঐ)। এইসব ব্যবস্থা দিয়া সঙ্গে সঙ্গেই অর্থশাস্ত্র বলেন, ধর্মবিবাহে পরস্পরে ছাড়াছাড়ি নাই। একই সঙ্গে এই দুই কথা বলায় মনে হয়, ধর্মবিবাহকে আদর্শের দিক দিয়া অর্থশাস্ত্রকার অচ্ছেদ্য বন্ধন মনে করিতেন। তবে সংসারে ও সমাজে তো ধর্মই একমাত্র নিয়ন্তা নহে, অন্য নানা রকম অবস্থা দেখিয়া এবং সামাজিক রীতিনীতি আলোচনা করিয়া শাস্ত্রকারকে সমাজব্যবস্থা বা আইন করিতে হইয়াছে। এই কারণেই তিনি কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে বিবাহবন্ধনও ছিন্ন করা যায় তাহা বলিতে বাধ্য হইয়াছেন। তাঁহাকে স্বীকার করিতে হইয়াছে, কেহ কাহাকেও না চাহিলে তখন বিবাহবন্ধন-ছেদন না করিয়া উপায় কি?—

পরস্পরং দ্বেষান্মোক্ষঃ। ঐ

দুই জনের মধ্যে একজনেরও যদি বিবাহবন্ধন-ছেদনে অনিচ্ছা থাকে তবে এই বন্ধন ছিন্ন করা চলিবে না (ঐ)। আইনের চক্ষে ষোলো বছরের ছেলে আর বারো বছরের মেয়ে হইলেই তাহারা আইনের সহায়তা পাইতে পারে (ঐ পৃ ১৫৪)। তৃতীয় অধিকরণের তৃতীয় এবং চতুর্থ অধ্যায়ে অর্থশাস্ত্র ছেলে ও মেয়ের পরস্পর সম্বন্ধের মধ্যে যতগুলি অপরাধ আইনের চক্ষে দণ্ডনীয়, তাহা দেখাইয়াছেন।

 অর্থশাস্ত্র বলেন, বিবাহ অনুষ্ঠান না হইয়া থাকিলে বিবাহ সম্পর্কীয় আইন খাটিবে না। এবং মেয়ের বারো বৎসর ও ছেলের ষোলো বৎসর হইয়া থাকিলেও বিবাহ না হইয়া থাকিলে তাহারা নাবালকমাত্র। এইসব বিষয়ে তাহাদের কোনো কথা চলিবে না (ঐ ৩. ২. পৃ ১৫১)। অর্থশাস্ত্রের মতে আট প্রকার বিবাহের মধ্যে কন্যাকে অলংকৃত করিয়া দান করিলে তাহা ব্রাহ্মবিবাহ (ঐ)। সহধর্মচর্যা হইল প্রাজাপত্য বিবাহ (ঐ)। গো-মিথুন গ্রহণ করিয়া কন্যাদান হইল আর্য (ঐ)। যজ্ঞে ঋত্বিক, পুরোহিতকে কন্যাদান হইল দৈব (ঐ)। স্ত্রীপুরুষের অনুরাগবশতঃ পরস্পরের মিলন হইল গান্ধর্ব (ঐ)। পণ লইয়া কন্যাদান হইল আসুর (ঐ)। বলপূর্বক কন্যা হরণ করিয়া লইয়া যাওয়া হইল রাক্ষস (ঐ)। এবং সুপ্তা প্রমত্তা কন্যা লইয়া যাওয়া হইল পৈশাচ (ঐ)। ইহার মধ্যে প্রথম চারিপ্রকার বিবাহ হইল সর্বসম্মত ও ধর্মসংগত। ইহাতেও পিতার সম্মতি চাই—

পিতৃপ্রমাণাশ্চত্বারঃ পূর্বে ধর্মাঃ। ঐ

বাকি চাররকম বিবাহে পিতামাতা উভয়ের সম্মতি চাই—

মাতৃপিতৃপ্রমাণাঃ শেষাঃ। ঐ পৃঃ ১৫২

ইহার পরই অর্থশাস্ত্র স্ত্রীধনের কথা বলেন, তাহা পরে আলোচিত হইবে।

 বিবাহবন্ধন স্বামী-স্ত্রী উভয়ের পক্ষেই মান্য, একথা সত্য। তবু যদি দেখা যায় স্বামী দুশ্চরিত্র, পতিত, স্ত্রীকে বধ করিতে উদ্যত, রাজার বিরুদ্ধে অপরাধী, ক্লীব বা বিদেশপ্রস্থিত হয় তবে কন্যাকে আবার বিবাহের অধিকার দিতে হইবে (ঐ ৫৯, পৃ ১৫৪)। এখানে রাজা মানে দেশ বা রাষ্ট্র। কারণ তখন ভালোমন্দ কল্যাণ-অকল্যাণের প্রত্যক্ষ বিগ্রহই ছিলেন রাজা।

 যদি পতি হ্রস্বপ্রবাসী হয় অর্থাৎ অল্পকালের জন্য বিদেশ যাত্রা করিয়াও না ফেরেন তবে শূদ্র বৈশ্য ক্ষত্রিয় ব্রাহ্মণের ভার্যাগণ প্রজাতা অর্থাৎ সন্তানবতী না হইয়া থাকিলে বৎসরেক কাল প্রতীক্ষা করিবেন। প্রজাতা অর্থাৎ সন্তানবতীগণ সম্বৎসরের অধিককাল প্রতীক্ষা করিবেন—

হ্রস্বপ্রবাসিনাং শূদ্রবৈশ্যক্ষত্রিয়ব্রাহ্মণানাং
ভার্যাস্‌সংবৎসরোত্তরং কালমাকাঙ্ক্ষেরন্ অপ্রজাতাঃ

সংবৎসরাধিকং প্রজাতাঃ। ঐ পৃ ১৫৮

 যদি পতিরা স্ত্রীদের ভরণপোষণের প্রতিবিধান করিয়া বিদেশে গিয়া থাকেন তবে তাঁহারা ইহার দ্বিগুণ কাল প্রতীক্ষা করিবেন—

প্রতিবিহিতাঃ দ্বিগুণং কালম্। ঐ

ভরণপোষণের ব্যবস্থা না করিয়া গিয়া থাকিলে সম্পন্ন জ্ঞাতিগণ চার বা আট বৎসর সেই প্রোষিতার স্ত্রীদের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করিবেন—

অপ্রতিবিহিতাঃ সুখাবস্থা বিভূয়ুঃ পরং চত্বারি বর্ষাণাষ্টৌ বা জ্ঞাতয়ঃ। ঐ, ২৮

তাহার পর পতিকুল হইতে প্রাপ্ত ধন স্ত্রীগণের নিকট আদায় করিয়া জ্ঞাতিগণ তাহাদিগকে পুনরায় বিবাহ করিবার জন্য মুক্তি দিবেন—

ততো যথাদত্তমাদায় প্রমুঞ্চেয়ুঃ। ঐ ২৯

 অধ্যয়নার্থ বিদেশগত ব্রাহ্মণের অপ্রজাতা পত্নী দশ বৎসর এবং প্রজাতা পত্নী দ্বাদশ বৎসর প্রতীক্ষা করিবেন। স্বামী যদি রাজপুরুষ হন এবং রাজকার্যে বিদেশে গিয়া থাকেন তবে আয়ুক্ষয় পর্যন্ত পত্নী প্রতীক্ষা করিবেন—

ব্রাহ্মণমধীয়ানং দশবর্ষাণ্যপ্রজাতাঃ দ্বাদশ প্রজাতাঃ। রাজপুরুষমায়ুঃক্ষয়াদাকাংক্ষেত। ঐ পৃ ১৫৯

তবে ইতিমধ্যে স্বজাতি কোনো পুরুষের ঔরসে যদি তাহার সন্তান হয় তবে সেই স্ত্রী অপবাদভাগিনী হইবে না—

সবর্ণতশ্চ প্রজাতা নাপবাদং লভেত। ঐ

কারণ, হয়তো বংশলোপভয়েই সেই স্ত্রী স্বজাতির দ্বারা সন্তান উৎপাদন করাইয়া থাকিবেন। কিন্তু যদি প্রোষিতার পত্নীর জ্ঞাতিকুটুম্ব না থাকেন, অথবা সম্পন্ন জ্ঞাতিরা ভরণপোষণ না দিয়া ছাড়িয়া দেন অথবা ভরণপোষণের উপযুক্ত সম্পদও যদি তাঁহার না থাকে, তবে তিনি ভরণপোষণসমর্থ পত্যন্তর গ্রহণ করিতে পারেন,

কুটুম্বর্ধিলোপে বা সুখাবস্থৈর্বিমুক্তা যথেষ্টং বিন্দেত। ঐ

 অর্থশাস্ত্র যদিও পূর্ব-অধ্যায়েই সাধারণভাবে বলিয়াছেন, ধর্মবিবাহে বন্ধন ছেদন হয় না, তবু এখন বিশেষস্থলে বলিতেছেন, ধর্মবিবাহে পরিগৃহীতা কুমারী যদি আপদ্‌গতা এবং তাঁহার পতি কিছু না বলিয়া কহিয়া, কোনো ব্যবস্থা না করিয়া, বিদেশগত হন তবে পতির খবর-বার্তা পাওয়া গেলে সেই স্ত্রী পতির জন্য সপ্তঋতুকাল প্রতীক্ষা করিবেন। আর যদি পতি বলিয়া কহিয়া গিয়া থাকেন এবং তাঁহার খবরাখবর পাওয়া যায় তবে সম্বৎসর প্রতীক্ষা করিবেন—

জীবিতার্থমাপদ্‌গতা বা ধর্মবিবাহাৎ কুমারী পরিগৃহীতারমনাখ্যায় প্রোষিতং শ্রূয়মাণং সপ্ততীর্থা্যাকাংঙ্ক্ষেত। সংবৎসরং শ্রূয়মাণম্। ঐ

বিদেশগত পতির খবরবার্তা না পাইলে পঞ্চঋতুকাল প্রতীক্ষা করিবে, খবরবার্তা পাওয়া গেলে দশঋতুকাল—

আখ্যায় প্রোষিতমশ্রূয়মাণং পঞ্চতীর্থান্যাকাঙ্ক্ষেত। দশ শ্রূয়মাণম্। ঐ

বিবাহশুল্কের যদি অংশমাত্র দিয়া পতি বিদেশে গিয়া থাকেন এবং খবর না পাওয়া যায়, তবে তিনঋতুকাল, আর খবর পাইলে সপ্তঋতুকাল প্রতীক্ষা করিবে—

একদেশদত্তশুল্কং ত্রীণিতীর্থ্যান্যশ্রূয়মাণম্।
শ্রূয়মাণং সপ্ততীর্থান্যাকাংঙ্ক্ষেত। ঐ ৩৭-৩৮

 পুরাপুরি শুল্ক দিয়া থাকিলে খবর বার্তা-না-পাওয়া বিদেশগত পতির জন্য পঞ্চঋতুকাল, খবর পাওয়া গেলে দশঋতুকাল প্রতীক্ষা করিবে—

দত্তশুল্কং প্রঞ্চতীর্থান্যশ্রূয়মাণম্। দশ শ্রূয়মাণম্॥ ঐ

 তাহার পরে ধর্মাধিকারিগণের অনুমতি লইয়া ইচ্ছানুসারে বিবাহ করিবে—

অন্ততঃ পরং ধর্মস্থৈর্বিসৃষ্টা যথেষ্টং বিন্দেত। ঐ

তথাপি ঋতুকালকে উপেক্ষা করা চলিবে না। কারণ সন্তান হওয়াই হইল সমাজ-ব্যবস্থার কাম্য। এখানে পূর্বে উক্ত ‘নাবীজী ক্ষেত্রমর্হতি’ এই চিরাগত সামাজিক সত্যটি স্মরণীয়। তাই অর্থশাস্ত্রকার বলেন, ‘তীর্থোপরোধ’ অর্থাৎ ঋতুস্নানকে উপেক্ষা করাই হইল ধর্মবধ— তীর্থোপরোধো হি ধর্মবধ ইতি কৌটিল্যঃ। ঐ পতি দীর্ঘকাল বিদেশগত, প্রব্রজিত বা মৃত হইলে ভার্যা সপ্তঋতুকাল প্রতীক্ষা করিবে। পুত্রবতী ভার্যা সম্বৎসর প্রতীক্ষা করিবে। তাহার পর পতির সহোদরকে বিবাহ করিবে। পতির যদি বহু ভ্রাতা থাকে তবে যে প্রত্যাসন্ন (নিকটতম), ধার্মিক এবং ভরণে সক্ষম, অথবা যে কনিষ্ঠ ও ভার্যাহীন তাহাকেই বিবাহ করিবে। পতির এমন ভাই না থাকিলে সপিণ্ডকে বিবাহ করিবে বা স্বামীর কুলজাত আসন্নকে (সর্বাপেক্ষা ঘনিষ্ঠ আত্মীয়কে) বিবাহ করিবে। ইহাই হইল বিহিতক্রম—

 দীর্ঘপ্রবাসিনঃ প্রব্রজিতস্য প্রেতস্য বা ভার্যা সপ্ততীর্থান্যাকাংক্ষেত। সংবৎসরং প্রজাতা। ততঃ পতিসোদর্যং গচ্ছেৎ। বহুষু প্রত্যাসন্নং ধার্মিকং ভর্মসমর্থং কনিষ্ঠমভার্যং বা। তদভাবেপ্যসোদর্যং সপিণ্ডং কুলাং আসন্নম্। এতেষাং এষ এব ক্রমঃ।

 পতির এইসব দায়াদগণকে (আত্মীয়গণকে) লঙ্ঘন করিয়া যদি কোনো নারী বিবাহ করে তবে সে ক্রম ও বিধি লঙ্ঘন করে। এমন স্থলে বিবাহকারী বরকন্যা, বিবাহদাতা ও যাহারা তাহাতে সম্মতি দেয় তাহারা সকলেই অবৈধ স্ত্রীপুরুষ-মিলনের অপরাধে দণ্ডনীয়—

এতানুৎক্রম্য দায়াদান্ বেদনে জারকর্মণি।
জারস্ত্রী-দাতৃবেত্তারঃ সংপ্রাপ্তাঃ সংগ্রহাত্যয়ম্॥ গণপতি শাস্ত্রীর কৌটলীয় অর্থশাস্ত্র, II, ৬১অ, পৃ ৩০

 ঋগ্বেদে ও অথর্ববেদেও বিধবার পুনর্বিবাহের প্রথা দৃষ্ট হয়। অথর্বে ‘পুনর্ভূ’ বিবাহব্যবস্থা দৃষ্ট হয়। সেই দ্বিতীয় পতির সঙ্গে বিয়োগ না ঘটে সেজন্য অথর্বে ‘অজপঞ্চৌদন’দান ব্যবস্থাও দেখা যায়। বোধায়ন ধর্মসূত্রে (২. ২. ২৭) পতিত ও ক্লীবকে ত্যাগ করিয়া পত্যন্তর-বেদনের ব্যবস্থা আছে। বসিষ্ঠের ব্যবস্থাও দেখানো গেল। নারদীয় মনু প্রাচীন সংগ্রহ, তাহারও ব্যবস্থা দেখানো গেল। তার পর অর্থশাস্ত্রের সব ব্যবস্থাও দেখানো গেল। অর্থশাস্ত্রও ধর্মবিবাহকে একটা জীবনব্যাপী সংস্কার মনে করেন। তথাপি তীর্থোপরোধ অর্থাৎ ঋতুকালের উপেক্ষাকে ধর্মবধ মনে করা উচিত, ইহাই তাঁহার মূল কথা। তাই যেখানে যেখানে বিশেষ বিশেষ স্থলে পত্যন্তর গ্রহণ বিধেয় তাহা তিনি স্পষ্ট করিয়া বুঝাইয়া বলিয়াছেন।

 বিধি যাহাই থাকুক, নারীর স্বাভাবিক প্রবৃত্তি হইল এক পতি লইয়া ঘর করা। বহুবিবাহ পুরুষ বা নারীর উভয়েরই হইতে পারে। পুরুষের বহুবিবাহকে ইংরেজিতে পলিগ্যামি বলে। নারীর বহুবিবাহকে পলিআণ্ড্রি বলে। পলিগ্যামি বহুদেশেই ছিল এখনও আছে, তবে এই বিষয়ের ব্যভিচার চলে কোথাও প্রকাশ্যভাবে, কোথাও প্রচ্ছন্নভাবে, আর কোথাও নানা ছদ্মবেশের মধ্য দিয়া। এরূপ স্থলে পুরুষকে বিধাতা কোনো দায় দেন নাই। পূর্বেই বলা হইয়াছে, নারীকে ভগবান মাতৃত্ব দিয়া সংযত করিয়া দিয়াছেন। বিধাতার এই দানের সম্মান প্রায়ই নারীরা রক্ষা করিয়াছেন। তবে তাহার ব্যতিক্রম যে হয় না তাহাও নহে।

 দক্ষিণভারতের নায়ার-নারীরা সামাজিক বিধানের বলে এবং তাঁহাদের নিজেদের সনাতন রীতি অনুসারে জীবনের সঙ্গী নির্বাচন বিষয়ে স্বাধীন। একটা নামমাত্র আনুষ্ঠানিক বিবাহ তাঁহাদের জীবনের প্রথম দিকে হয়। তাহার পর সেই কন্যা সবর্ণ বা উচ্চতরজাতীয় যাহার সহিত ইচ্ছা বাস করিতে পারেন। তবে সেই পুরুষ হীনজাতীয় হইলে লজ্জার কথা। এতটা স্বাধীনতা পাইয়াও নায়ার-কন্যারা একবার-নির্বাচিত একজনকে লইয়াই ঘর করেন[২]। একই সঙ্গে বহুজনকে লইয়া থাকিলেও তাহা তাঁহাদের সামাজিক ও সনাতনরীতিতে হয়তো বাধে না। কিন্তু তাহা ঘটিতে দেখা যায় না।

 সেখানে যাঁহার সঙ্গে বিবাহ অনুষ্ঠান করা হয় তাঁহার সঙ্গে বসন ছিন্ন করিয়া বিবাহবিচ্ছেদ সাধিত হয়।[৩]

 নম্বুদ্রী-ব্রাহ্মণদের মধ্যে এতকাল বড় ভাই মাত্র বিবাহ করিতে পারিতেন। অন্য ভাইয়েরা নায়ার কন্যাদের লইয়াই থাকিতেন। নায়ার কন্যারা নামেমাত্র বিবাহিত হইতেন নায়ারদের সঙ্গে, কিন্তু বাস করিতেন অবিবাহিত নম্বুদ্রী ব্রাহ্মণদের সঙ্গে। ইহাতে নায়ার পুরুষরা পাইতেন না স্ত্রী, এবং নম্বুদ্রী ব্রাহ্মণকন্যারা পাইতেন না পতি। এই প্রথা দেশকে দূষিত করিতে লাগিল। তবু যাঁহারা এই প্রথা দূর করিয়া নায়ার পুরুষের সঙ্গে নায়ার কন্যার, এবং নম্বুদ্রী পুরুষের সঙ্গে নম্বুদ্রী কন্যার যথাশাস্ত্র বিবাহ ও একত্র ঘরকরার প্রস্তাব করিলেন, তাঁহারা সেই দেশের সনাতনীদের দ্বারা খুবই তিরস্কৃত ও অপমানিত হইলেন। কারণ সেই দেশে এইরূপ ব্যভিচারই সনাতনী অর্থাৎ চিরাচরিত প্রথা। জস্টিস্ শঙ্কর নায়ারকে এজন্য কম নিগ্রহ ভোগ করিতে হয় নাই। ব্যভিচারও যদি পুরাতন হয় তবে তাহাই পূজ্য, এবং শুচিতা ও সংযম যদি নূতন হয় তবে তাহাও অগ্রাহ্য। এইরূপ সংস্কারই আমাদের অস্থি-মজ্জায় বিরাজমান। আসলে দেখা যায় আমরা শাস্ত্র মানি না, প্রথাই আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ বিধান।

 এ দিকে নম্বুদ্রী ব্রাহ্মণকন্যারা পতিলাভে বঞ্চিতা, তবু তাঁহাদের মধ্যে যতটা ব্যভিচার ঘটিতে পারিত ততটা দেখা যায় না। তবু এইরূপ বিসদৃশ ব্যবস্থায় অনেক ব্রাহ্মণকন্যা যে বিপথগামিনী হইতে বাধ্য হন তাহাতে আর বিস্ময়ের কি আছে? সকলেই যে নষ্ট হন না ইহাই বিস্ময়কর।

 যেসব নম্বুদ্রী ব্রাহ্মণকন্যা এইভাবে পথভ্রষ্ট হন তাঁহারা আর নম্বুদ্রীদের শুদ্ধান্তঃপুরে স্থান পান না। তাঁহাদের দুঃখদুর্গতির আর অবধি ছিল না। অবশেষে চেরাক্‌কলের রাজা ইঁহাদের জন্য একটা ব্যবস্থা করিলেন। তিনি তাল্লিপরম্ব নামে একজন লোককে এইজন্য অনেক ভূসম্পত্তি দান করিয়া এইসব ব্রাহ্মণকন্যাকে আশ্রয় দিবার ভার দিলেন। অবশ্য তাঁহার আশ্রয়ে থাকা না থাকা কন্যাদের ইচ্ছা। এইজন্য সেই লোকটি ‘মান্নানার’ উপাধি ও সম্মান পাইল। মান্নানারের বাড়ির চারিদিকে তাহার এতদর্থে প্রাপ্ত বিরাট ভূসম্পত্তি। লোকেরা পথভ্রষ্টা ব্রাহ্মণকন্যাকে মান্নানারের বাড়ির কাছে রাখিয়া আসে। তাহার বাড়ির চারিদিকে প্রাচীর। একটি তোরণ পূর্ব দিকে, একটি উত্তর দিকে। যদি কন্যা ইচ্ছা করিয়া পূর্ব তোরণ দিয়া প্রবেশ করে তবে সে মান্নানারের পত্নীদের মধ্যে গণিত হয়, আর যদি সে উত্তরের তোরণ দিয়া প্রবেশ করে তবে সে মান্নানারের ভগ্নীশ্রেণীর মধ্যে গৃহীত হয়। অবশ্য এই নিয়ম এখন আর পূর্বের মত ঠিকভাবে চলে না।[৪]

 এই মান্নানারেরা জাতিতে তিয়া। তিয়ারা অন্ত্যজ ও অস্পৃশ্য জাতি। তাড়ি প্রস্তুত করাই তাহাদের ব্যবসা। ইহাদের মেয়েরা অনেকে য়ুরোপীয়দের সঙ্গে এতকাল ঘর করিত। এখন ক্রমশঃ তাহা বন্ধ হইয়া আসিতেছে।[৫] তিয়ারা নায়ারদের ধোপার কাজও করে। নায়ার-নারীরা ঋতুমতী হইলে তিয়ার কাছে সেই বস্ত্র না দিলে এবং তিয়াদের দ্বারা ধৌত বস্ত্র না পরিলে শুচি হন না। এই অস্পৃশ্য তিয়াজাতির লোক ছাড়া বিপথগামিনী ব্রাহ্মণকন্যাদের স্থান দিতে আর কেহই রাজি হয় নাই।

  1. Kautilya’s Arthasastra, Intro. pp. xvii-xviii; Arthasastra of Kautilya by Jolly, Intro. p. 46
  2. Thurston and Rangachari, Castes and Tribes of Southern India, Vol. V, পৃ ৩০৮
  3. ঐ p. 315
  4. Castes and Tribes of Southern India, Vol. V, পৃ ২২৪-২২৫
  5. ঐ Vol. VII. পৃ ৩৬.।