প্রাচীন ভারতে নারী/নারীদের স্থান
নারীদের স্থান
ঋগ্বেদ প্রভৃতির সময়ে, অর্থাৎ প্রাচীনতর বৈদিকযুগে, আর্যদের মধ্যে নারীদের বেশ একটি গৌরব ও প্রতিষ্ঠা ছিল। সামাজিক হিসাবে নারী স্বামীর দ্বারা চালিত হইলেও পরিবারের মধ্যে, যাগযজ্ঞে, উৎসবাদিতে নারীর একটি বিশেষ মর্যাদা ছিল। গৃহে তিনি ‘পত্নী’ অর্থাৎ স্বামিনী। বিবাহকালে তিনি শ্বশুর দেবর প্রভৃতি পরিজনের কাছে ‘সম্রাজ্ঞী’ হউন ইহাই ছিল প্রার্থিত (ঋগ্বেদ ১০. ৮৫. ৪৬ ইত্যাদি)।
যখন ভারতে আর্যেরা আসেন তখন তাঁহাদের নারীর সংখ্যা কম ছিল। এ দেশে আসিয়া তাঁহারা আর্যেতর জাতির কন্যাদের বিবাহ করিতে লাগিলেন। ক্রমে কন্যা সুলভ হইল। অনেক কন্যার, বিশেষ করিয়া কুরূপা ও ভ্রাতৃহীনা কন্যাদের, বিবাহ হওয়া কঠিন হইল। ক্রমেই নারীর মহত্ত্ব কমিতে লাগিল। আবার যাগযজ্ঞ ও ক্রিয়াকাণ্ডের বিপুলতার সঙ্গে ব্রাহ্মণের গৌরববৃদ্ধির সঙ্গে-সঙ্গেও নারীদের গৌরব কমিতে লাগিল। অনেক শূদ্র-কন্যা আর্যদের পত্নী হওয়ায় ক্রমে সব নারীদেরই শূদ্রার সমান ধরিয়া লওয়া হইল। অথচ পূর্বে বহু নারী বৈদিক মন্ত্রের রচনাও করিয়াছেন। কিন্তু পরে তাঁহারা বেদ উচ্চারণেরও অধিকারী হইলেন না। মৈত্রায়ণী-সংহিতা বলিলেন, নারীরা ঝুঠা, নারীরা দুর্ভাগ্য; সুরা, জুয়াখেলার মত তাহারাও নেশামাত্র (১. ১০. ১১; ৩. ৬.৩)।
তৈত্তিরীয়-সংহিতা (৬. ৫. ৮. ২) বলিলেন, নারী যতই ভালো হউক না কেন তবু সে অধম পুরুষেরও নিকৃষ্ট। রাত্রিতে স্বামীকে ভুলাইয়া কাজ আদায় করাই নারীর সাধনা (কাঠক-সংহিতা ৩১.১)। রাজনীতিতে নারীর স্থান নাই, যজ্ঞে ও বৈদিক স্তোত্ররচনাতে তাহার কাজ ক্রমেই কমিতে লাগিল। তখনও দুই একজন ব্রহ্মবাদিনী নারীর উল্লেখ পাই। তখন পর্যন্ত/ নারীদের পক্ষে ঐ রাস্তাটাই একমাত্র খোলা ছিল।[১] অথচ পূর্বে বেদে বহু স্থানে নারীদের মহত্ত্ব উল্লিখিত হইয়াছে, এবং আদর্শের দিক দিয়া নারীদের সম্মানের কথা বারবার ঘোষিত হইয়াছে। নারী পতির অর্ধাঙ্গ (শতপথ-ব্রাহ্মণ ৫. ২. ১. ১০)। বৃহদারণ্যকে (১. ৪.৩) আদি-পুরুষ যে আপনাকে দ্বিভাগে বিভক্ত করিয়া পতি এবং পত্নী হইলেন, সে কথা পূর্বেই বলা হইয়াছে।
নারীর নিন্দার কথা প্রাচীন বৈদিক যুগে যে নাই তাহাও নয় (ঋগ্বেদ ৮. ৩৩. ১৭)। তবে মোটের উপর বেদের আদিযুগে আর্য-নারীদের অবস্থা ভালোই ছিল। ক্রমে কিন্তু নারীদের স্থান একটু-একটু করিয়া নামিতে আরম্ভ হইল। এ দেশে আসিয়া সুলভ শূদ্রা-পত্নী গ্রহণই কি তাহার একমাত্র হেতু?
ব্রাহ্মণভাগে দেখি, নারীরা স্বামীর পরে খাইবেন (শতপথ ১. ৯. ২. ১২)। যে নারী মুখে মুখে কথার জবাব দেয় না সেই অপ্রবাদিনী নারীই ভালো (ঐতরেয়-ব্রাহ্মণ ৩. ২৪.৭)। তবে সন্তানের জন্মদাত্রীরূপে নারীর একটা সম্মান চিরদিনই ছিল। আর্যেরা সংখ্যায় অল্প, কাজেই সন্তান ও বংশ-রক্ষা আর্যদের একটা বড় কাম্য বস্তু ছিল। এই কারণেই কন্যার জন্ম অপেক্ষা পুত্রের জন্ম লোকে বেশি চাহিত। পুত্র যে পরম ব্যোমে জ্যোতির মত এবং কন্যা যে দুঃখের হেতু, তাহাও দেখা যায়। তবু প্রাচীনতর কালে নারীদের সামাজিক যে সম্মান ও অধিকার ছিল পরবর্তীকালে তাহা ক্রমে ক্রমে সংকুচিত হইয়াছে। হয়ত বা দ্রাবিড় জাতির মধ্যে কুমারীদের চরিত্রগত শৈথিল্য দেখিয়াও আর্যেরা কিছু সাবধান হইয়াছেন।[২]