প্রাচীন ভারতে নারী/বিবাহবন্ধন

বিবাহ-বন্ধন

 স্বামীর মৃত্যুর পর অনুগমনের কথাও দেখা যায়: এই নারী পতিলোক- প্রার্থনায় পরলোকগত তোমার অনুসরণ করিতে প্রবৃত্ত—

ইয়ং নারী পতিলোকং বৃণানা
নিপদ্যতে উপ ত্বা মর্ত্য প্রেতম্। অথর্ব ১৮.৩.১

 ঋগ্বেদে পতির অনুগমনের কথা দেখা যায় না। বরং মৃত পতির পাশে শয়ান পত্নীকে সম্বোধন করিয়া বলা হইয়াছে—

নারি অভি জীবলো কম্ এহি। ঋগ্বেদ ১০.১৮.৮

হে নারি, জীবনলোকে ফিরিয়া আইস।[১]

 আশ্বলায়ন বলেন, নারীর দেবর এই কথা বলিয়া নারীকে মৃতপতির পার্শ্ব হইতে উঠাইয়া আনিবেন—

তামুত্থাপয়েদ্ দেবরঃ। অশ্বলায়ন-গৃহ্যস্থত্র ৪. ২. ১৫-১৮

ইহাতে অনুমিত হয়, দেবরই বিধবাকে লইয়া ঘর করিত। ‘দেবর’ কথার মধ্যেও দ্বিতীয় বরত্ব সূচিত হয়। যাস্কই বলিয়াছেন—

দেবরঃ কস্মাদ দ্বিতীয়ো বরঃ। নিরুক্ত ৩.১৫

 ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের এই মন্ত্রটি দেখিলে এই কথাটা আরও স্পষ্ট বুঝা যায়। বিধবা যেমন করিয়া দেবরকে, নারী যেমন পুরুষকে শয়নের দিকে টানিয়া আনে, তেমন করিয়া কে তোমাকে ঘরে ফিরাইয়া আনিবে?

কো বাং শযুত্রা বিধবের দেবরং
মর্যং ন ঘোষা কৃণুতে সধস্থ আ। ঋগ্বেদ ১০.৪.২

 দেবরের সঙ্গে পুত্রার্থ বাগদত্তা বিধবার সমাগম মনুও (৯.৬৯-৭০) ব্যবস্থা করিয়াছেন, তবে তাহা বিবাহ নহে; গুরুজনের বা তদভাবে রাজাজ্ঞায় দেবরের দ্বারা সুতোৎপত্তির বিধান নারদীয়-মনুসংহিতায় (১২.৮০; ১২. ৮৭) আছে।

 দেবর ছাড়াও অন্যলোকের সহিতও বিধবার বিবাহ দেওয়া হইত। তবে দেবরের বেশি দাবি ছিল। তাহাতে সংসারটা বিচ্ছিন্ন হইতে পারিত না। রামায়ণে বালির পত্নী তারার এবং রাবণ-পত্নী মন্দোদরীর দেবরের সঙ্গে বিবাহের কথা আমাদের দেশে লোক প্রচলিত। বালি শাস্ত্রনিষ্ঠ ধার্মিক ছিলেন। ব্রহ্মর্ষি-পুত্র রাবণও বেদযজ্ঞাদিপারগ ছিলেন। রাক্ষসীগর্ভোৎপন্ন হইলেও রাবণ কুম্ভকর্ণাদি ব্রাহ্মণপুত্র বলিয়া ব্রাহ্মণই ছিলেন, তাঁহাদের বধ করায় রামের ব্রহ্মহত্যা পাতক ঘটিয়াছিল। তবু বানর ও রাক্ষস নামে পরিচিত হওয়ায় তাঁহাদের নজির উল্লেখ করা হইল না।

 মহাভারতে দেখা যায়, নাগরাজ হৃতপুত্র ঐরাবতের স্নুযাতে (পুত্রবধূতে) অর্জুনের এক পুত্র জন্মে। সেই মেয়েটির স্বামী সুপর্ণের দ্বারা হৃত হইলে সন্তানহীন ঐরাবত সেই দুখিনী স্নুষাকে অর্জুনের কাছে সম্প্রদান করেন। কামবশানুগ অর্জুন সেই ঐরাবত-স্নুষাকে ভার্যারূপে গ্রহণ করেন। তাহাতেই বীর্যবান ইরাবানের জন্ম (মহাভারত ভীষ্ম ৯০. ৭-৯)। অর্জুন যখন ইন্দ্রলোকে যান তখন ইরাবান তাহা শুনিয়া অর্জুনের কাছে গিয়া বলেন, আমি ইরাবান্, তোমার পুত্র (ঐ ১২-১৩)। অর্জুন তখন গতবৃত্তান্ত স্মরণ করিয়া দেবলোকে পুত্রকে বলিলেন, যুদ্ধকালে আমাদের সাহায্য করিতে হইবে। সেই সন্তানও গুণে অর্জুনবৎ ছিলেন। অর্জুন তাহাকে আলিঙ্গন করিয়আ প্রীত হইলেন (ঐ ১৫-১৭)। পরে মহাভারত-যুদ্ধকালে ইরাবান পাণ্ডবদের সহায়তা করিয়াছিলেন (ঐ ১৭)।

 ইহাতেই বুঝা যায়, কেহ কেহ স্বামীর অনুমৃতা হইলেও অনেকে অনুমৃতা হইতেন না। ইহাদের মধ্যে অনেকে পুনরায় বিবাহও করিতেন। কাজেই বসিষ্ঠাদি ধর্মসূত্রে তাহার ব্যবস্থা দেখা যায়। বোধায়ন ধর্মসূত্র বলেন, যে কন্যা উদকপূর্বপ্রদত্তা যাহার বিবাহ-হোমাদি সম্পন্ন হইয়া গিয়াছে, এমন কন্যার স্বামী যদি মরিয়া যায় এবং যদি সে স্বামীর সঙ্গে ঘর না করিয়া থাকে তবে পৌনর্ভব-বিধিতে তাহার পুনরায় বিবাহ দিবে—

নিসৃষ্টায়াং হুতে বাপি যসৈ ভর্তা মৃয়েত সঃ।
সা চেদক্ষতযোনিঃ স্যাদ গতপ্রত্যাগতা সতী।
পৌনর্ভবেন বিধিনা পুনঃ সংস্কারমর্হতি। বোধায়ন ধর্মসূত্র, ৪. ১. ১৮

 তৈত্তিরীয়-সংহিতায় (৩. ২. ৪. ৪) ‘দৈধিষব্য’ কথা আছে। এই বিষয়ে কাত্যায়ন-শ্রৌতসূত্র (২.১.২২) এবং কৌশিক-সূত্রও (৩. ৫; ১৩৭. ৩৭) দ্রষ্টব্য। এই কথার অর্থে ‘সেণ্টপিটারস্‌বর্গ ডিক্‌সানারী’ বলেন, ‘দিধিষু’ অর্থাৎ বিধবার পুত্র। মনিয়র উইলিয়মস্‌ও তাঁহার ‘অভিধানে’ বলেন “সম্ভবত নারীর দ্বিতীয় পতির ঔরসজাত পুত্র”। কিন্তু ম্যাকডোনেল ও কীথ্ তাঁহাদের ‘বৈদিককোষে’ মনে করেন, বড় ভগ্নীর পূর্বে ছোট ভগ্নীর বিবাহ হইলে তাহার সন্তানকে ‘দৈধিষব্য’ বলে।

 মহাভারতে তো পাণ্ডু এবং ধৃতরাষ্ট্র পিতার ঔরসজাত নহেন। কুন্তীর ও মাদ্রীর সন্তানলাভের কথাও সর্বজনবিদিত। দ্রৌপদীর কথা উল্লেখ না-ই করিলাম। মনু তো অনেক পরে লিখিত এবং মনুস্মৃতি খুব রক্ষণশীল, তবু তাহাতেও আছে—

·······বিধবা বা স্বয়েচ্ছয়া।
উৎপাদয়েৎ পুনর্ভূত্বা স পৌনর্ভব উচ্যতে॥ ৯. ১৭৫

বসিষ্ঠ-স্মৃতি মতেও, যে কৌমার-পতি ত্যাগ করিয়া অন্য পতি ও পতিকুল আশ্রয় করে বা পতি মৃতে যদি পত্যন্তর গ্রহণ করে তবে সে নারী পুনর্ভূ, তাহার সন্তান পৌনর্ভব (বসিষ্ঠ-স্মৃতি, আনন্দাশ্রম স্মৃতিসমুচ্চয়, ১৭. ২০-২১)। বসিষ্ঠ-স্মৃতিতে ক্লীব পতিত বা উন্মত্ত প্রথম স্বামীকে ত্যাগ করিয়া পত্যন্তর গ্রহণ করিলেও সেই নারীকে পুনর্ভূ বলা হইয়াছে (ঐ ১৭.২০)। যাজ্ঞবল্ক্যও বলেন, স্বামীর সঙ্গে ঘর করিয়াও স্বেচ্ছায় যে স্বামীকে ত্যাগ করিয়া আবার বিবাহ করে সে পুনর্ভূ, তবে সজাতীয় কাহাকেও বিবাহ করিতে হইবে, অন্য জাতি হইলে চলিবে না—

অক্ষতা বা ক্ষতা চৈব পুনর্ভূঃ সংস্কৃতা পুনঃ।
স্বৈরিণী যা পতিং হিত্বা সবর্ণং কামতঃ শ্রয়ে‍ৎ। ১.৬৭

এইরূপ বিবাহ যে যাজ্ঞবল্ক্যের মনঃপুত নহে তাহা বুঝাই যাইতেছে। তবে ইচ্ছা না থাকিলেও বিরক্তির সহিত তিনি যে এইরূপ প্রথার উল্লেখ করিয়াছেন, ইহাতে বুঝা যায় তাহা সমাজে যে চলিতেছিল তাহা অস্বীকার করিবার উপায় ছিল না। নারদীয়-মনুসংহিতায়ও তিন প্রকারের পুনর্ভূর (১২. ৪৫-৪৮) এবং চারি প্রকারের স্বৈরিণীর (১২. ৪৯-৫২) লক্ষণ দেওয়া হইয়াছে।

 ক্রমে স্মৃতির যুগে বিবাহের কড়াকড়ি বাড়িয়াছে। নারীদের অধিকার সংকুচিত হইয়াছে তবু পুরাতন এইসব প্রথা তখনও যে লুপ্ত হয় নাই, তাহা বুঝা যায় তাঁহাদের বিরক্তিসহ, এমন কি অনেকস্থলে তিরস্কারসহ, এইসব ব্যবস্থার উল্লেখের দ্বারা।

 তবে বৈদিক যুগে স্বামী মারা গেলে বা স্বামী বাঁচিয়া থাকিতেও যদি পতিপত্নীর মধ্যে কোনো কারণে বিদ্বেষ ও বিচ্ছেদ ঘটিত, তবে সেই স্ত্রী যদি পুনরায় অন্য কাহাকেও বিবাহ করিত, তবে অজ-পঞ্চৌদন অনুষ্ঠান করা হইলে সকলে মনে করিতেন যে সেই স্ত্রীর এবং তাহার এই দ্বিতীয় পতির মধ্যে আর কখনও বিচ্ছেদ ঘটিবে না। অথর্ব বেদে ঋষি ভৃগু বলিতেছেন—

যা পূর্বং পতিং বিত্ত্বা অথান্যং বিন্দতে পরম্।
পঞ্চৌদনং চ তাবজং দদাতো ন বি ঘোষতঃ॥ ৯.৫.২৭

পূর্বে এক পতিকে বিবাহ করিয়া যদি নারী পরে আর-এক পতিকে বিবাহ করেন তবে অজ এবং পঞ্চোদন দান করিলে আর তাঁহাদের (এই নূতন বিবাহে) বিচ্ছেদ ঘটিবে না।

 এই দানের ফলে তাঁহারা, অর্থাৎ সেই স্ত্রী এবং পুনর্ভূ-পতি, মৃত্যুর পর সমান লোকবাস লাভ করিবেন (ঐ ৯. ৫. ২৮)।

 ময়োভূ ঋষি বলেন, কোনো নারীর যদি অব্রাহ্মণ দশ জন পতিও থাকেন, তবু যদি কোনো ব্রাহ্মণ তাহার পাণি গ্রহণ করেন তবে ব্রাহ্মণই সেই নারীর একমাত্র পতি হইবেন—

উত যৎ পতয়ো দশ স্ত্রিয়াঃ পূর্বে অব্রাহ্মণাঃ।
ব্রহ্মা চেদ হস্তমগ্রহীৎ স এব পতিরেকধা। অথর্ব ৫. ১৭, ৮

তখন ব্রাহ্মণই একমাত্র পতি হইবেন, ক্ষত্রিয় নহে, বৈশ্যও নহে।

ব্রাহ্মণ এব পতির্ন রাজন্যো বৈশ্যঃ। ঐ ৫, ১৭, ৯

 কেবল যে বিধবারই পত্যন্তর গ্রহণ করিতে হয় তাহা তো নয়। পতি জীবিত থাকিলেও যদি কোনো কারণে পত্নী বিধবারই সমান হইয়া পড়েন তবে পত্যন্তর-গ্রহণ-ব্যবস্থার প্রয়োজন হয়। সেইরূপ ব্যবস্থা পুরাতন ধর্মশাস্ত্রাদিতে বারবারই দেখা যায়।

 এই কারণেই নল যখন দময়ন্তীকে ছাড়িয়া চলিয়া গেলেন তখন দীর্ঘকাল নলের কোনো সন্ধান না পাইয়া দময়ন্তী নলকেই পাইবার উদ্দেশ্যে যে দ্বিতীয়বার স্বয়ম্বরের আয়োজন করিলেন সে কথা মহাভারতেই বলা হইয়াছে। এই বার্তাই সুদেব-ব্রাহ্মণমুখে দময়ন্তী প্রচার করিলেন, বীর নল আছে কি নাই বুঝা যাইতেছে না, তাই কাল দময়ন্তী দ্বিতীয় পতি বরণ করিবেন (মহাভারত, বন, ৭০. ২৬)। দময়ন্তীর এই দ্বিতীয় স্বয়ম্বর যে অদ্ভুত কিছু ছিল না তাহা বুঝি সেই সভায় রাজারা সবাই আসিলেন।

 মনুর সময়ে নারীদের প্রাচীন অধিকার অনেকটা সংকুচিত হইয়া আসিতেছিল। পূর্বে দোষ থাকিলে পতি পত্নীকে, এবং পত্নী পতিকে যে ত্যাগ করিতে পারিতেন তাহাতেও পতি হইতে পত্নীর অধিকার কম ছিল। মনুর সময়ে ততটুকু অধিকারও আর রহিল না। নিয়ম ছিল, পতি বিদেশে যাইবার সময় স্ত্রীর বৃত্তিব্যবস্থা করিয়া যাইবেন (মনু ৯.৭৪)। যদি বৃত্তি না থাকে তবে সুতা কাটিয়া বা অনিন্দিত শিল্পের দ্বারা স্ত্রী জীবিকা সংগ্রহ করিবেন (ঐ ৯.৭৫)। ধর্মার্থ বিদেশগত পতির জন্য স্ত্রী আট বৎসর, বিদ্যা বা যশোলাভার্থ-গত পতির জন্য ছয় বৎসর, কামার্থগত পতির জন্য তিন বৎসর প্রতীক্ষা করিবেন (ঐ ৭.৯. ৭৬)। তার পর স্ত্রী যে কি করিবেন তাহা মনু লেখেন নাই। তাহার পর স্ত্রীর কর্তব্য কি তৎসম্বন্ধে মনুর টীকাকারদের মধ্যে সর্বজ্ঞ নারায়ণ, কুল্লূক ও রাঘবানন্দ, বসিষ্ঠ-স্মৃতির অনুসারে স্বামীর কাছে স্ত্রী যাইবেন এইরূপ বলিয়াছেন। শুধু নন্দন ব্যবস্থা করিয়াছেন—

ঊর্ধ্বং ভর্ত্রন্তরপরিগ্রহে ন দোষোঽস্তি ইতি অভিপ্রায়ঃ।

অর্থাৎ ইহার পর স্ত্রীর পক্ষে পত্যন্তর গ্রহণ ছাড়া আর কি উপায় আছে? কিন্তু মেধাতিথি তাহাও সমর্থন করেন নাই।

 দ্বেষ-পরায়ণা স্ত্রীকে মনু (৯.৭৭) এক বৎসরের পরই পরিত্যাগ করিবার বিধান দেন। মদ্যরতা, দুশ্চরিত্রা, ব্যাধিতা, পতিবিদ্বেষিণী স্ত্রীকে ত্যাগ করিয়া পতি পত্ন্যন্তর গ্রহণ করিবেন (৯. ৮০)। বন্ধ্যা, মৃতবৎসা, কন্যামাত্রপ্রসবিনী, অপ্রিয়ভাষিণী হইলেও মনুর মতে (৯. ৮১) স্ত্রী ত্যাজ্যা। তবে পীড়িতা সুশীলা স্ত্রীর কাছে অনুমতি লইয়া স্বামী বিবাহ করিবে (৯.৮২)। স্ত্রী যদি রোষবশতঃ চলিয়া যাইতে চাহে তবে তাহাকে তৎক্ষণাৎ বর্জন করিবে (৯. ৮৩)। ব্যাধিতা, বিগর্হিতা, বিপ্রদুষ্টা এবং প্রতারণা পূর্বক গছাইয়া দেওয়া কন্যাও বর্জন করিবে (৯, ৭২)। কাজেই পতির পক্ষে স্ত্রীত্যাগ মনুর হিসাবে খুবই সহজ। পত্নীদের পক্ষে পতিত্যাগ প্রায় অসাধ্য। পুরাতন যেসব অধিকার নারীদের ছিল, মনুর সময়ে তাহা প্রায় লুপ্ত হইয়া আসিয়াছিল। যাজ্ঞবল্ক্য (১. ৭২) বিধান করেন, ব্যভিচারে গর্ভ হইলে এবং ভর্তৃবধ-প্রবৃত্তি থাকিলে স্ত্রীকে ত্যাগ করিবে। নারদও তাহাই বলেন (নারদীয়-মনু ১২.৯৪)।

 কিন্তু একসময়ে বিবাহবন্ধন পুরুষ ও নারী উভয়ের পক্ষেই রীতিমত বন্ধন ছিল। অতিপ্রাচীন আইনগ্রন্থ কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্র (৩. ৩. ২২) বলেন, অষ্টপ্রকার বিবাহের মধ্যে ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য ও প্রাজাপত্য এই চারিপ্রকার বিবাহবন্ধন ইচ্ছা করিলেই ছিন্ন করা যায় না—

অমোক্ষো ধর্মবিবাহানাম্ ইতি।

—কাহারও পক্ষে তাহা সহজে ছিন্ন করার উপায় ছিল না। কিন্তু স্ত্রী যদি সাধ্বী না হয় তবে বর্ণান্তরের সংস্পর্শ হইতে পারে, এই মনে করিয়া জাতিভেদ যখন প্রবল হইল তখন এই বিষয়ে আইন একটু কড়া হইল, অর্থাৎ স্ত্রীর চরিত্র বিষয়ে সন্দেহ থাকিলে ত্যাগ করা চলিবে এইরূপ বিধান সহজতর হইল। ব্যভিচারেও সবর্ণার সঙ্গে কিংবা নিম্নতর বর্ণার সঙ্গে ব্যভিচার ঘটিলে দোষ কম হইত।[২]

 আসলে পতিপত্নীসম্বন্ধ সহজে ছেদ্য নয় (নারদ ১২. ৯২)। এক সময়ে নারীদের নৈতিক বিষয়ে সামাজিক কড়াকড়ি কম ছিল। বসিষ্ঠ-স্মৃতি তো স্পষ্টই বলেন, ব্যভিচারে নারী দূষিত হয় না (২৮. ১)।

 এই কথায় চমকাইলে চলিবে না। এমন সময়ও ছিল যখন বিবাহ প্রথাই প্রবর্তিত হয় নাই। তখন নরনারী যথেচ্ছ বিহারের দ্বারা সন্তানলাভ করিত—

অনাবৃতাঃ কিল পুরা স্ত্রিয় আসন্ বরাননে।
কামচারবিহারিন্যঃ স্বতন্ত্রাশ্চারুহাসিনি। মহাভারত, আদি, ১২২, ৪

তাহাদের এই ব্যভিচারে তখন অধর্ম হইত না, ইহাই পূর্বে ধর্ম ছিল—

নাধর্মোঽভুদ বরারোহে স হি ধর্মঃ পুরাভবৎ। ঐ ১২২, ৫

 রাজা পাণ্ডুর সময়েও এই ধর্ম উত্তরকুরুতে চলিত ছিল (ঐ ১২২. ৭)। এই সনাতনধর্মই স্ত্রীগণের প্রতি অনুগ্রহকর—

স্ত্রীণামনুগ্রহকরঃ স হি ধর্মঃ সনাতনঃ। ঐ ১২২. ৮

 এখানে টীকাকার নীলকণ্ঠ (ঐ টীকা) বলেন, বেদমতে বামদেব্যব্রতচারিণী নারী সঙ্গম প্রার্থনা করিলে তাহা পূরণ করাই ধর্ম।

 উদ্দালক-পত্নীকে এক ব্রাহ্মণ সঙ্গমার্থ হঠাৎ ‘চল যাই’ বলিয়া লইয়া গেলে পুত্র শ্বেতকেতু ক্রোধে অগ্নিমূর্তি হইলেন (ঐ ১২২. ১০-১২)। উদ্দালক বলিলেন, বাছা, রাগ করিও না, ইহাই সনাতন ধর্ম। সর্ব বর্ণের নারীরাই অনাবৃতা—



মা তাত কোপং কার্ষীস্ত্বমেষ ধর্মঃ সনাতনঃ।
অনাবৃতা হি সর্বেষাং বর্ণানামঙ্গনা ভুবি। ঐ ১২২, ১৪

 তখন শ্বেতকেতু বলিলেন, এই ধর্ম সনাতন হইলেও ভালো ধর্ম নহে; আজ হইতে ইহা চলিবে না; লোকে আপন আপন পত্নী ছাড়া অন্যত্র গমন করা অধর্ম হইবে (ঐ ১২২. ১৭-২০)।

 এই ভাবে শ্বেতকেতু সনাতনধর্ম নিষেধ করিয়া বলপূর্বক এই মর্যাদা স্থাপন করিলেন—

মর্যাদা স্থাপিতা বলাৎ। ঐ ২০

শ্বেতকেতুর কথা পূর্বেও একটু বলা হইয়াছে।

 বনপর্বেও দেখা যায়, নরনারী সকলেই অনাবৃত; ইহাই স্বাভাবিক ধর্ম; বিবাহাদি বিধি হইল এই স্বাভাবিক নিয়মের বিকারমাত্র—

অনাবৃতাঃ স্ত্রিয়ঃ সর্বা নরাশ্চ বরবর্ণিনি।
স্বভাব এষ লোকানাং বিকারোঽন্য ইতি স্মৃতঃ। বন ৩০৬. ১৫

হয়ত এই কথাতে এখনকার দিনের যৌনবিজ্ঞানের পণ্ডিতগণ খুব খুশি হইবেন।

 দীর্ঘতমা ঋষি ছিলেন বৃহস্পতির পুত্র। তিনি গোরুর মত নারীদের সঙ্গে যথেচ্ছ বিহার করায় তাঁহার স্ত্রী বিরক্ত হন। দীর্ঘতমা তাহাতে ক্রুদ্ধ হইলেন। ঋষিপত্নী বলিলেন, তোমার সেবা না করিয়া পত্যন্তর গ্রহণ করিব (আদি ১০৪. ২২-৩৪)। দীর্ঘতমাও ক্রোধ করিয়া বলিলেন, আজ হইতে আমিও নিয়ম করিলাম যে নারী যাবজ্জীবন এক পতি লইয়াই থাকিবে—

অদ্য প্রভৃতি মর্যাদা ময়া লোকে প্রতিষ্ঠিতা।
এক এব পতির্নার্য্যা যাবজ্জীবং পরায়ণম্।
মৃতে জীবতি বা তস্মিন্ নাপরং প্রাপ্নুয়ান্নরম্। আদি ১০৪, ৩৪-৩৫

 শ্বেতকেতুর দ্বারা মর্যাদা স্থাপিত হইল বটে কিন্তু দীর্ঘকাল পর্যন্ত সমাজে তাহা স্বীকৃত বা পালিত হয় নাই। নারীরা ঋতুস্নাতা হইয়া স্বামীর সহিত সঙ্গতা হইলেও অন্য সময়ে যে-কোনো পুরুষের সঙ্গে বিহার করিতে পারিতেন। ধর্মবিদেরাও এই কথাই বলিতেন—

ঋতাবৃতৌ রাজপুত্রি স্ত্রিয়া ভর্তা পতিব্রতে।
নাতিবর্তব্য বা ইত্যেবং ধর্মং ধর্মবিদো বিদুঃ।
শেষেষ্বন্যেষু কালেষু স্বাতন্ত্র্যং স্ত্রী কিলার্হতি। আদি ১২২, ২৫-২৬

 মহাভারতে শান্তিপর্বে তাই দেখা যায়, বাস্তবিক কে কাহার ঔরসে জন্ম লইয়াছে সেই তথ্য মাতা ছাড়া আর কেহই জানে না (শান্তি ২৬৫.৩৫)।

 এইজন্যই মনু (৯. ২০) পুরাতন শ্রুতির উল্লেখ করিয়া লিখিয়াছেন—

ষন্মে মাতা প্রলুলুভে। ইত্যাদি

অন্যত্র এই মন্ত্রের আলোচনা করা গিয়াছে।

 বসিষ্ঠ-স্মৃতিতেও দেখা যায়—

ন স্ত্রী দুষ্যতি জারেণ। স্মৃতি-সমুচ্চয়, ২৮.১

তাহাতে বিস্মিত হইবার কিছুই নাই। অত্রি-সংহিতায়ও (১৯৩, স্মৃতিসমুচ্চয়) এই বচনটি দেখা যায়। অত্রি আরও বলেন, যদি অসবর্ণ পুরুষের দ্বারা নারীতে গর্ভনিষিক্ত হইয়া থাকে তবে গর্ভমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত নারী অশুদ্ধ। তাহার পরই তাহার শুদ্ধি ঘটে। যখন পুনরায় রজোদর্শন হয় তখন সেই নারী বিমল কাঞ্চনের মত বিশুদ্ধি প্রাপ্ত হয়—

অসবর্ণৈস্তু যো গর্ভঃ স্ত্রীণাং যোনৌ নিষিচ্যতে।
অশুদ্ধা সা ভবেন্নারী যাবদ্ গর্ভং ন মুঞ্চতি॥
বিমুক্তে তু ততঃ শল্যে রজশ্চাপি প্রদৃশ্যতে।
তদা সা শুধ্যতে নারী বিমলং কাঞ্চনং যথা। অত্রি, ১৯৫-১৯৬

 দেবল-স্মৃতিতেও (৫০. ৫১) ঠিক এই দুইটি শ্লোক দেখা যায়। জাতি- ভেদের কড়াকড়ি যতই বাড়িতে লাগিল ততই পুরুষদের পক্ষে স্ত্রীত্যাগ সহজ হইয়া আসিতে লাগিল। তাহার পূর্বে নারীদের প্রতিও সামাজিক বিধি রীতিমত উদার ও বন্ধনমুক্ত ছিল।

 নারীদের এই স্বাধীনতা ক্রমে যে সংযত হইয়া আসিল এবং সমাজব্যবস্থার অধীন হইল, ইহাতে নারীদেরও সম্মতি ছিল বলিয়াই মনে হয়। কামনার বেগ যতই দুর্বার হউক নারীদের মধ্যে যে মাতৃত্বের একটি দায় আছে এবং অন্তর্নিহিত কল্যাণের একটি আদর্শ আছে, তাহাতে মনে হয় ক্রমে নারীরাই আপনাদের এই উদ্দাম স্বাধীনতাকে সংযত করিয়া আনিলেন। নহিলে শুধু বাহির হইতে সামাজিক অনুশাসনে এইরূপ হওয়া সহজ হইত না। পৃথিবীর আদিযুগে ক্রমাগত ভূগর্ভস্থ অগ্নির তাণ্ডবলীলা ভূমিকম্প প্রভৃতিরই যুগ ছিল। ক্রমে তাহা সংযত হইয়া এই পৃথিবী ধীরে ধীরে জীবধাত্রী হইয়া উঠিল। নারীদেরও ইতিহাস মনে হয় অনেকটা এইরূপ। আপন মাতৃত্বের খাতিরে এবং অন্তরস্থিত কল্যাণ-আদর্শের তাগিদে ক্রমে ক্রমে আপনা হইতেই তাঁহারা নিজেদের স্বেচ্ছাচারকে সংযত করিলেন।

 এখনও নারীদের মধ্যে দুইটি ধারা দেখা যায়। একটি ধারা ভোগসুখময়ী উর্বশীর সহিত আর-একটি ধারা স্নেহসেবাময়ী লক্ষ্মীর সহিত তুলনীয়। ধীরে ধীরে নারীরা আপনা হইতেই আপন মাতৃত্বসুলভ মাহাত্ম্যে সেই লক্ষ্মী-স্বরূপের দ্বারা উর্বশী-স্বরূপকে ক্রমে ক্রমে এত কাল জয় করিয়া আসিতেছেন। ইহাই সর্বদেশে নারীদের ইতিহাস, সকল কালেরও ইহাই মহাসত্য। তাই যোগতত্ত্ব উপনিষদে (৪) আছে। এই নারীই এক দিকে প্রেয়সী ভার্যা, অন্য দিকে তিনিই কল্যাণময়ী মাতৃস্বরূপ—

যা মাতা সা পুনর্ভার্যা যা ভার্যা জননী হি সা।

  1. বরং ঋগ্বেদে বলা হইয়াছে পতিহীনা হইলেও এইসব নারীরা অবিধবা হইয়া সংসারে প্রবেশ করিয়া ‘সুপত্নী’ হইয়া গৃহধর্ম চারিণী হউন (১০. ১৮.৭)। পূর্বেও এই বিষয়ে কিছু বলা হইয়াছে।
  2. বৃহদ্-যম, ৪.৪৬-৪৮; বসিষ্ঠ-স্মৃতি ২১ অধ্যায়; বৃদ্ধহারীত ৯, ৩১৬