প্রাচীন ভারতে নারী/নারীর বিশুদ্ধি

নারীর বিশুদ্ধি

 স্বেচ্ছায়-ব্যভিচারের কথার সঙ্গে-সঙ্গে অনিচ্ছায় দূষিত নারীদের শুদ্ধির ব্যবস্থার বিষয়ও বলা প্রয়োজন। যদি স্বয়ং বিপ্রতিপন্না নারী বলপূর্বক প্রভুক্তা বা চৌরভুক্তা হয় তবে সেই দূষিতা নারীকে ত্যাগ করিবে না—

ন ত্যাজ্যা দূষিতা নারী।

শুধু ঋতুকাল পর্যন্ত প্রতীক্ষা করিবে, তাহাতেই সে শুদ্ধ হইবে (অত্রিসংহিতা, ১৯৭-১৯৮)। রজক, চামার, নট, বুরুড়, কৈবর্ত, মেদ ও ভিল্ল এই সপ্ত অন্ত্যজ। যদি ইহাদের সঙ্গে মোহবশতঃ নারীর ব্যভিচার ঘটে তবে জ্ঞানকৃত হইলে এক বৎসর, অজ্ঞানকৃত হইলে বর্ষদ্বয় চান্দ্রায়ণ-ব্রত আচরণ করিবে (ঐ ১৯৯-২০০)। ম্লেচ্ছদের দ্বারা সকৃদ্‌ভুক্তা নারী প্রাজাপত্যব্রত এবং ঋতুস্রাবের দ্বারা শুদ্ধ হয় (ঐ ২০১)। বলাৎ হৃতা নারী সকৃদ্‌-ভুক্তা হইলে প্রাজাপত্যের দ্বারা শুদ্ধি হয় (ঐ ২০২)।

 এইসব বিষয়ে দেবলের স্মৃতি আরও সহজ ব্যবস্থা দিয়াছেন। দেবল বোধ হয় সিন্ধুদেশের স্মৃতিকার। তখন পশ্চিম হইতে সিন্ধুদেশে যেসব বৈদেশিক আক্রমণ আসিত তাহাতে বহু নারী দূষিত হইত। তাহাদের সম্বন্ধে সামাজিকভাবে কিরূপ ব্যবস্থা হওয়া উচিত তাহাই দেবলস্মৃতিতে দেখা যায়। আনন্দাশ্রম হইতে প্রকাশিত স্মৃতিসমুচ্চয় গ্রন্থে দেবলস্মৃতিও দেওয়া আছে। তাহা হইতেই আলোচনা করা যাউক। দেবল বলেন, ম্লেচ্ছের দ্বারা বলপূর্বক নারী হৃতা হইলে, ব্রাহ্মণী-ক্ষত্রিয়া-বৈশ্য ও শূদ্রা নারী অন্ত্যজদের দ্বারা হৃতা হইলে, ম্লেচ্ছান্ন খাইয়া থাকিলে, দ্বাদশদিনব্যাপী পরাক প্রায়শ্চিত্তের দ্বারা ব্রাহ্মণী শুদ্ধা হয়, অন্যেরা আরও অল্পে শুদ্ধা হয়। অভক্ষ্য না খাইলে এবং মৈথুন না হইয়া থাকিলে তিন রাত্রিতে নারীর শুদ্ধি হয় (দেবলস্মৃতি ৩৬-৩৯)। ম্লেচ্ছান্ন, ম্লেচ্ছসংস্পর্শ ও এক বৎসর বা বৎসরের বেশি তাহাদের সহ সংস্থিতিতে তিন রাত্রিতে শুদ্ধি হয় (ঐ ৪৪)। পুরুষও কেহ যদি ম্লেচ্ছহৃত বা চৌরহৃত হইয়া ভয়ে বা ক্ষুধায় ভক্ষ্যাভক্ষ্য খাইয়া দেশে ফিরে, তবে ব্রাহ্মণ হইলে একটি কৃচ্ছব্রত আচরণ করিবেন, ক্ষত্রিয় তাহার অর্ধ, বৈশ্য তাহার পাদোন এবং শূদ্র তাহার পাদমাত্র আচরণ করিলে শুদ্ধ হন (ঐ ৪৪-৪৬)। ম্লেচ্ছের দ্বারা বলপূর্বক গৃহীতা নারী গর্ভবতী না হইলে তিন রাত্রিতে শুদ্ধি; যদি গর্ভ হয়, তবে শুদ্ধি হইবে কৃচ্ছ্রসাংতপন এবং ঘৃতলেপের দ্বারা (ঐ, ৪৭-৪৯)। অসবর্ণ পুরুষের দ্বারা গর্ভ হইলে গর্ভমুক্তির পর রজোদর্শন হইলেই তপ্তকাঞ্চনের মত নারীর শুদ্ধি হয় (ঐ ৫০-৫১)। সেই সময়ে ম্লেচ্ছদের দ্বারা হৃতা হইয়া দীর্ঘকাল যেসব নারীর ম্লেচ্ছদের সঙ্গে থাকিতে হইত তাঁহাদের প্রায়শ্চিত্তের কথাও দেবল ইহার পর বিচার করিয়াছেন। এই বিষয়ে যাঁহার জানিবার ইচ্ছা তিনি মূলগ্রন্থে তাহা দেখিতে পারেন।

 এই স্মৃতিসমুচ্চয়ে বৃহদ্-যমসংহিতায় দেখা যায়, নারীদের ব্যভিচার হইলে ঋতুস্রাব হইলেই শুদ্ধি হয়। তবে গর্ভ হইলে স্ত্রীত্যাগ করা যায়, অন্যথা স্ত্রীত্যাগ যুক্ত নহে—

ব্যভিচারাদ্ ঋতৌ শুদ্ধিঃ স্ত্রীণাং চৈব ন সংশয়ঃ।
গর্ভে জাতে পরিত্যাগো নান্যথা মম ভাষিতম্॥ বৃহদ্-যম. ৪. ৩৬

 জার-দোষে নারীরা দূষিত হয় না, এই কথা বসিষ্ঠ যে বলিয়াছেন তাহা আগেই দেখানো হইয়াছে (বসিষ্ঠ, ২৮. ১)। নারীরা দেবতার প্রসাদে সর্বকল্মষের অতীত (বসিষ্ঠ, ২৮.৬)। তবে এই তিনটি পাপ হইলে নারী পতিত হয়— পতিবধ, ভ্রূণহত্যা ও নিজের গর্ভপাত (বসিষ্ঠ, ২৮. ৭)। নারদীয় মনুতে (১২. ৯৪-৯৬) অনুরূপ কয়েক স্থলে স্ত্রীকে নির্বাসন দণ্ড দিবার ব্যবস্থা আছে।

 নারদীয় মনু অতি প্রাচীন শাস্ত্র। ইহাতে পাণিগ্রহণ সংস্কারের ফল সারাজীবন থাকে (১২.৩)। পতিপত্নীর বিবাহবিচ্ছেদ বিহিত হয় না। তবে ব্যভিচার-দোষে বন্ধনছেদন হইতে পারে (১২.৯২)। বিনাদোষে স্ত্রী-ত্যাগে পতি দণ্ডার্হ (ঐ ১২. ৯৭)। কাজেই দেখা যায়, সহজে স্ত্রীত্যাগের উপদেশ সকলে দেন নাই। বৌধায়ন-স্মৃতি (২. ২.৬৫) দেবতার প্রসাদে নারীকে নিষ্কলঙ্কা বলিয়াছেন, কিন্তু বন্ধ্যা স্ত্রীকে দশম বৎসরে, কন্যামাত্রপ্রসবিনীকে দ্বাদশে, মৃতপ্রজাকে পঞ্চদশে এবং অপ্রিয়বাদিনীকে সদ্য ত্যাগ করিতে বিধান দিয়াছেন।

 প্রাচীন ঋষিদের মতে বিবাহ পতিপত্নীর একটা সম্বন্ধ যাহা পবিত্র। তাহা সহজে ছেদ্য নয়। তবে কারণ-বিশেষে ছেদন করিবার ব্যবস্থা পুরুষকে কেহ কেহ দিয়া থাকেন, অথচ অনেক সময় অনেকেই সেই অধিকার নারীকে দেন নাই।

 দ্রাবিড়-সমাজের মত আর্যদের সমাজ ও সামাজিক ব্যবস্থা মাতৃতন্ত্র না হইলেও আর্যদের মধ্যে বৈদিকযুগে নারীদের বেশ প্রতিষ্ঠা ও সম্মান ছিল, কাজেই তাঁহাদের অধিকারও অনেকটা বিস্তৃত ছিল। আদর্শ হিসাবেও তাঁহাদের স্থান বেশ উচ্চ ছিল। তাই নারীদিগকে ‘নিষ্কল্মষা’ ‘মেধ্যা’ প্রভৃতি বলা হইয়াছে। এবং সহজে কোনো দোষে তাঁহাদের পরিত্যাগ করা অনেকেই পছন্দ করেন নাই, তাহা এইমাত্র দেখানো হইল। নারী হইলেন পত্নী, পতিকুলে তিনি সম্রাজ্ঞী, পত্নী-বিনা যজ্ঞ অসাধ্য— এই সবই জানা কথা। শ্রীরামচন্দ্র সীতাকে লোকাপবাদভয়ে ত্যাগ করিলেও স্বর্ণসীতাকে পাশে রাখিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। অর্থাৎ ক্রমে এমন একটা যুগ আসিল যখন আসল নারীকে নির্বাসন দিয়া তাঁহাদের সম্বন্ধে বড় বড় কথা স্বর্ণসীতার মত বামে রাখিয়া সমাজ চলিতে লাগিল।

 বাৎস্যায়ন বলিয়াছেন—

কুসুমধর্মাণো হি ঘোষিতঃ সুকুমারোপক্রমাঃ। কামসূত্র, ১৭ অধ্যায়, পৃ ১৯৯

অর্থাৎ নারীরা কুসুমবৎ সুকুমার, কাজেই তাহাদের প্রতি ব্যবহারও সুকুমার হওয়া চাই। সহৃদয়তার সহিত নারীদের সহিত ব্যবহার করা চাই। বাৎস্যায়ন লিখিতেছেন কামশাস্ত্র। কাজেই এখানে তাঁহার বাক্য উদ্ধৃত করিয়া লাভ নাই। তবে এই বিষয়ে সৌভাগ্যক্রমে আমাদের ধর্মশাস্ত্র-ব্যবস্থাপকেরাও একমত। যেসব কর্কশ ও পরুষ দণ্ড পুরুষের প্রতি তাঁহারা বিধান করিয়াছেন, তাহা তাঁহারা অনেকেই নারীদের প্রতি ব্যবহার করিতে দেন নাই। ঐ বিষয়ে প্রাচীন শাস্ত্রকারেরা সকলেই নারীদের প্রতি সহৃদয়তার কথা বলিলেও দায় ও সামাজিক ব্যবহার প্রকরণে সকলে সমান উদার মত দেখাইতে পারেন নাই। স্মৃতিকারেরা নারীদের স্থানবিশেষে নিন্দা করিলেও নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন যে কর্তব্য সে কথা প্রায় সকলেই বলিয়াছেন। মনু (২. ১২৩) প্রভৃতি সমাজপতিরা নারীদের প্রতি সশ্রদ্ধ ব্যবহারের ব্যবস্থা দিয়াছেন। এখানে মেধাতিথি ও কুল্লুকভট্টও সমর্থন করিয়াছেন। মনু (২. ১৩১-১৩৩) নারীদের প্রতি সম্পর্ক ও বয়সের প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া এবং উচ্চজাতীয়াদের প্রতি সম্মান দেখানো উচিত, যেন সেই ভাবেই বেশি বলিয়াছেন। নিঃসম্পর্ক নারীকে ভগিনী বা সুভগা বলিয়া সম্বোধন করিবে (২. ১২৯)। আপস্তম্ব-ধর্মসূত্র (১. ৪. ১৪. ১৮) বলেন, পতির বয়স অনুসারেই নারীদের সম্মান দেখানো উচিত—

পতিবয়সঃ স্ত্রিয়ঃ।

গুরুপত্নীকে ও গুরুর পুত্রবধূদের প্রতিও সম্মান দেখানো বিহিত ছিল।[১] সম্পর্কের কথা ছাড়িয়াও নারীকে সম্মান করা উচিত। তাই মনু (৩. ৫৫) বলেন, পিতা পতি দেবর ভ্রাতা সকলেই নারীকে সম্মান দেখাইবেন। মনু নারীকে সম্মান দিতে বলিলেও স্বাধীনতা দিতে বলিতে পারেন নাই। বাল্যকালে নারী পিতার অধীন, যৌবনে পতির অধীন, বৃদ্ধকালে পুত্রের অধীন। স্বাধীন সে কখনই নয় (মনু ৯.৩)। কারণ নারীরা সহজেই নষ্ট হয় (ঐ ৯, ৫-২০)। দক্ষস্মৃতির (৪. ৮-৯) কথা আরও সাঙ্ঘাতিক।

 বৈদিক যুগে কিন্তু নারীরা সকলের সঙ্গে সভা প্রভৃতিতে যোগদান করিতে পারিতেন। ঋগ্বেদে (১.১৬৭.৩) দেখি—

যোষো সভাবতী বিদথ্যেব সং বাক্।

সেই বাণী সভা ও বিদ্বজ্জনের উপযুক্তা নারীর মত।

 ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলে (৮৫. ২৬-২৭) নববধূকে ‘বিদথম্ আ বদাসি’ এবং ‘বিদথম্ আ বদাথঃ’ বলায় বুঝা যায়, যজ্ঞের ও উচ্চ জ্ঞানের উপযুক্ত ভাষা নারীদের ছিল। বিবাহকালে নিকটে আসিয়া সুমঙ্গলী বধূকে দেখিয়া আশীর্বাদ দিবার প্রার্থনা দেখিতে পাই (ঐ ৮৫. ৩৩)। পরবর্তীযুগে রাজবধুরা হয়ত ক্রমে সভা হইতে অন্তঃপুরে আশ্রয় লইলেন, তাহা বুঝা যায় পাণিনির গ্রন্থে (৩.২.৩৬)। এইখানে মহাভাষ্যও দেখা যাইতে পারে।[২] কাত্যায়ন-শ্রৌতসূত্রে (৩.৭.১১) ও শতপথ-ব্রাহ্মণে (১.৭.৩.১২) যে ‘অন্তর্ধান’ আছে, তাহা পত্নী সংযাজ যাগের একটি আচার বিশেষ।

 বৌদ্ধদের গ্রন্থেও নারীদের অবরোধের কথা মাঝে মাঝে সূচিত হয় (ধম্মপদত্থ কথা), কিন্তু তাহা রাজরাজড়াদের ঘরের নারীদের বিষয়ে। রাজপথ দিয়া খোলা রথে বিশাখা পতিগৃহে যান

 রামায়ণেও আছে, যজ্ঞে বিবাহে স্বয়ংবরে যুদ্ধে ও ব্যসনে নারীদের দর্শন দূষ্য নহে। মহাভারতে নারীদের সভা প্রভৃতিতে যোগদানের কথা অন্যত্র আলোচিত হইয়াছে।

 মনুর সময়ে যথার্থ জীবনের ক্ষেত্রে নারীর সামাজিক অধিকার যতই সংকুচিত হউক না কেন, তবু বার বার আদর্শ হিসাবে নারীদের সম্মানের কথাও শুনিতে পাওয়া যায়। এ যেন সেই জীবন্ত সীতাকে সংসার হইতে বনবাস দিয়া মহাসভায় সর্বজনসমক্ষে স্বর্ণসীতার পূজা করা। এখনও যে দেখা যায় যে যাঁহারা আসলে সকলের স্বাধীনতা হরণে তৎপর তাঁহারাই জগৎসমক্ষে ঘন ঘন গণস্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জয় ঘোষণা করেন। মনুতেও দেখি—

যত্র নার্য্যস্ত পূজ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবতাঃ। যত্রৈতাস্তু ন পূজ্যন্তে সর্বাস্তত্রাফলাঃ ক্রিয়াঃ। ৩,৫৬

 যেখানে নারীরা পূজিত সেখানে দেবতারা প্রসন্ন, যেখানে নারীরা অপূজিত সেখানে সব ক্রিয়াই অফলা। মহাভারতেও এই কথা আছে (অনুশাসন, ৪৬. ৫-৬)। স্ত্রীলোকের মুখ সদাই শুচি—

নিত্যমাস্যং শুচি স্ত্রীণাম্। মনু ৫.১৩.

স্ত্রিয়ঃ শ্রিয়শ্চ গেহেষু ন বিশেষোঽস্তি কশ্চন, এই বাক্যও মনুরই (৯.২৬)।[৩]

নারী প্রসন্ন না থাকিলে কুল রক্ষা হয় না (ঐ ৩. ৬১; ৯. ৮)। গৃহের ও পরিবারের শোভা এবং কল্যাণও হয় না (৩. ৬০—৬২)। কোথাও কোথাও কুলরক্ষার্থ নারীর আদর দেখা যায়। যেমন চলিত কথাতেও দেখা যায়— ‘ফলের লোভে গাছকে সেবা’।

 যাজ্ঞবল্ক্য বলিলেন, সোম দেবতা নারীকে দিলেন শুচিতা, গন্ধর্ব দিলেন মধুর বাণী, অগ্নি দিলেন সর্বমেধ্যত্ব, তাই নারীরা সদাই মেধ্যা—

মেধ্যা বৈ ঘোষিতো হ্যতঃ। ১,৭১

অত্রি সংহিতাও (১৪১) এই কথাই বলেন, এবং পরেও (১৯৪) এই কথার তিনি আবার সমর্থন করেন। বৌধায়ন-স্মৃতিতেও এই কথাই দেখি, তবে তিনি ‘মেধ্যা' না বলিয়া স্ত্রীদিগকে 'নিষ্কল্মষা' অর্থাৎ নিষ্পাপা বলিয়াছেন।[৪]

 মহাভারতে বিবাহ (৪৪ অধ্যায়), স্ত্রীধন, যৌতক (৪৫ অধ্যায়), স্ত্রীপ্রশংসা (৪৬ অধ্যায়), রিক্‌থ-ভাগ (৪৭ অধ্যায়), বর্ণসংকর কথন (৪৮ অধ্যায়), দানধর্ম (৪৯ অধ্যায়) প্রভৃতির আলোচনা অনুশাসন পর্বে আছে (৪৪-৪৯ অধ্যায়)। তবে তাহা প্রায় মনুর মতেরই সঙ্গে মিলে।

 পূর্বেই বলা হইয়াছে, প্রাচীন কালে নারী আপন পতি আপনিই বরণ করিতেন। বৈদিক সাহিত্য আলোচনা করিলে এবং তখনকার বিবাহঅনুষ্ঠানগুলির রীতিনীতি দেখিলে তাহাই বুঝা যায়। ক্রমে জাতিভেদ প্রতিষ্ঠিত হইল। তখন ছেলেমেয়েদের স্বাধীন মতামত দেওয়া আর চলিল না। কারণ বিবাহের দুইটি দেবতা। প্রাচীন দেবতা হইলেন প্রজাপতি; তিনি দেখিয়া শুনিয়া ধীরে সুস্থে শাস্ত্রবিধি সমাজবিধি সব বাঁচাইয়া অগ্রসর হন। আর বিবাহের নবীন দেবতা হইলেন, ‘মন্মথো দুর্নিবারঃ’। তিনি সব ভাঙিয়া চুরিয়া একাকার করিয়া অগ্রসর হন। কালিদাস-কৃত শকুন্তলার চরিতেও এই নবীন দেবতার কিছু প্রভাব দেখা যায়। তাই যখন দেখা গেল ‘ধূমাকুলিতদৃষ্টি হইলেও যজমানের আহুতি অগ্নিতেই পড়িয়াছে’, অর্থাৎ দুষ্মন্ত-শকুন্তলার প্রেম জাতিপংক্তিবিরোধী হয় নাই, তখন গুরুজনেরা হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিলেন।

 পরবর্তী যুগে কন্যাদের স্বামী-নির্বাচনের অধিকার গুরুজনের হাতেই গিয়া পড়িল। কিন্তু গুরুরা যদি কেহ সময়মত কন্যাদের বিবাহে উদ্যোগ না করেন, তবে সেই স্থলে কন্যা নিজেই পতি সংগ্রহ করিতে পারে। বৌধায়নস্মৃতি (৪. ১. ১৫) বলেন, ঋতুমতী হইয়া তিন বৎসর কন্যা পিতৃশাসনের প্রতীক্ষা করিবে; তারপর চতুর্থ বর্ষে নিজেই উপযুক্ত পতি গ্রহণ করিবে—

ত্রীণি বর্ষাণ্যুতুমতী কাংক্ষেত পিতৃশাসনম্।
ততশ্চতুর্থে বর্ষে তু বিন্দেত সদৃশং পতিম্॥

বোধায়ন-ধর্মসূত্র-বিবরণকার গোবিন্দ স্বামী ইহাকে স্বয়ম্বর-অধিকার বলিতেও সংকুচিত হন নাই—

এবং স্বয়ম্বরং পরিসমাপ্য ইত্যাদি। ৪. ১, ১৭ বিবরণ

 মনুও (৯.৯০) এই নীতি সমর্থন করিয়া সেই স্থলে কন্যাকে পতিসংগ্রহের অধিকার দিয়াছেন। সর্বস্মৃতিই এইরূপ স্থলে কন্যার অধিকারকে স্বীকার করিয়াছেন। এমন স্থলে যদি অসবর্ণ বিবাহ হয় তাহা হইলেও অনুলোমক্রমে হইলে সন্তান পিতার সবর্ণ হইবে, এই পুরাতন বিধিও তাঁহাদের স্বীকার করিতে হইয়াছে। তাই ব্যাস-স্মৃতি (২.১০) বলিলেন, সবর্ণা বা কামতঃ অন্যজাতীয়া বিবাহিত পত্নীতে সন্তান সবর্ণা-জাত স্ববর্ণ সন্তানেরই সমান হইবে, তাহা হইতে হীন হইবে না।

 যেখানে গুরুজন কন্যাকে বিবাহ দিতে যত্নশীল নহেন সেখানে বোধায়ন ধর্মসূত্র কন্যাকে শুধু পতি-বরণ করিবার অধিকারই দেন নাই, ভালো সদৃশ বর পাওয়া না গেলে অপেক্ষাকৃত অল্পগুণ বা গুণহীন বরকেও বরণ করিবার অধিকার দিয়াছেন (৪. ১. ১৫-১৬)। অথচ এই বোধায়ন ধর্মসূত্রই (২. ২. ৪৬) কৌমারে পিতাকে, যৌবনে স্বামীকে, বৃদ্ধাবস্থায় পুত্রকে নারীর অভিভাবকত্ব দিয়াছেন, তাহাকে স্বাধীনতা দেওয়া যে যায় না এই বিষয়ে মনুর সঙ্গে তিনিও সহমত।

 এই বোধায়ন ধর্মসূত্রই পতি ক্লীব ও পতিত হইলে নারী যে পত্যন্তর গ্রহণ করিতে পারে, সেই কথা বলিয়াছেন। এই পুনর্ভুর গর্ভজাত সন্তানই পৌনর্ভর (২. ২. ২৭)। এইখানে বিবরণকার গোবিন্দ স্বামী বসিষ্ঠের সম্মতি উদ্ধৃত করিয়াছেন। কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে বিবাহিতা কন্যাও আবার বিবাহ করিতে অধিকারিণী তাহা বোধায়ন ধর্মসূত্র ধরিয়াছেন। বলপূর্বক অপহৃতা কন্যা যদি মন্ত্রসংস্কৃতা না হইয়া থাকে তবে সে অবিবাহিতা কন্যারই মত, তাহার বিবাহ হওয়া উচিত (৪. ১. ১৭)। কন্যাদান এবং বিবাহ-হোমের পর স্বামী মরিলেও সে কন্যা যদি অক্ষতযোনি হয়, তবে সে গতপ্রত্যাগতা; তাহাকে পৌনর্ভব বিধিতে পুনরায় বিবাহ দেওয়া উচিত (৪. ১. ১৮)। এখানে বুঝা যায় পৌনর্ভব বিবাহবিধি তখনও ছিল। এই বিষয়ে ধর্মসূত্রকার বোধায়নের বচন পূর্বেই উদ্ধৃত হইয়াছে।

 এই পুনর্ভূসংস্কার অক্ষত বা ক্ষতযোনি উভয়বিধ কন্যারই হইতে পারে (যাজ্ঞবল্ক্য ১. ৬৭)।

 পরাশরের পত্যন্তরগ্রহণব্যবস্থা সকলেই শুনিয়াছেন। পতি যদি নষ্ট মৄত প্রব্রজিত ক্লীব বা পতিত হয়, তবে এই পঞ্চবিধ আপদে পত্যন্তর বিধান করা যায়—

নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে ক্লীবে চ পতিতে পতৌ।
পঞ্চস্বাপৎসু নারীণাং পতিরন্যো বিধীয়তে। ৪. ২৮

এই পঞ্চস্থলে নারদীয় মনুতেও (১২. ১৯) পত্যন্তরগ্রহণব্যবস্থা আছে। বসিষ্ঠও বলেন, উদকপূর্বদত্তা বা বাগদত্তা কন্যা যদি মন্ত্রোপনীতা না হইয়া থাকে তবে সে কুমারীই বলিতে হইবে এবং সে পিতারই অধিকারস্থা (বসিষ্ঠ, ১৭. ৬৪)। বলাপ্রহৃতা কন্যা যদি মন্ত্রসংস্কৃতা না হয় তবে সে অবিবাহিতা। কন্যারই মত তাহাকে অন্য পতির কাছে দান করিতে হইবে (ঐ ৬৫)। পাণিগ্রহণের পরেও মন্ত্রসংস্কৃতা বালা যদি অক্ষতযোনি হয় তবে তাহার পুনরায় বিবাহ হওয়া উচিত (ঐ ৬৬)।

 কাজেই দেখা যায়, শাস্ত্রকারেরা যেমন পুরুষকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্ত্রীত্যাগের ও পত্ন্যন্তর গ্রহণের অনুমতি দিয়াছেন, তেমনি কোনো কোনো ক্ষেত্রে নারীকেও পত্যন্তরগ্রহণ ব্যবস্থা দিয়াছেন। তবে নারীদের অধিকারক্ষেত্র পুরুষদের ক্ষেত্র অপেক্ষা সংকীর্ণ।

 অর্থশাস্ত্রকার কৌটিল্য তাঁহার অর্থশাস্ত্রে (৩. ২. ৫৯) বলেন, নীচত্বপ্রাপ্ত, পরদেশপ্রস্থিত, রাজকিল্বিষী, প্রাণাভিহন্তা, পতিত বা ক্লীব পতি ত্যাজ্য। পতি বা পত্নী উভয়ের বিবাহবন্ধন ছেদনের ইচ্ছা না থাকিলে বিবাহ রদ হয় না, তবে উভয়েই যদি তাহা চাহে অথবা উভয়েরই যদি পরস্পরে বিদ্বেষ জন্মিয়া থাকে তবে (পরস্পরং দ্বেষান্মোক্ষঃ) বিবাহ বিচ্ছেদ হইতে পারে (ঐ ৩. ৩. ৫৯)।

 এইসব যে শুধু আইনের কথা তাহা নহে। ইতিহাসেও তাহার প্রমাণ আছে। সমুদ্রগুপ্তের জ্যেষ্ঠ পুত্র ছিলেন রামগুপ্ত। তাঁহার পত্নী ধ্রুবস্বামিনী রামগুপ্তের মৃত্যুর পর তাঁহার কনিষ্ঠ দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তকে বিবাহ করেন।[৫]

  1. গৌতম ও হরদত্ত, আপস্তম্ব ধর্মসূত্র ১.৪.১৪, ২০-২২
  2. ১.১.৪৩,১০১; ২.১.১.৩৬১; ৩.২.৮০,১০৯
  3. তুলনীয়: মহাভারত উদ্যোগ, ৩৮.১১। দুষ্কুলাগত হইলেও স্ত্রী হইলেন অমুল্য রত্ন, মনু। (২.২৩৮)
  4. আনন্দাশ্রম সংস্করণ ২,২, ৬৪
  5. দ্র° বাসুদেব অগ্রবাল রচিত ‘গুপ্ত সাম্রাজ্যের ইতিহাস’