ফুলমণি ও করুণার বিবরণ/অষ্টম অধ্যায়

অষ্টম অধ্যায়।

 করুণা উক্ত সকল উপদেশ পাইয়া কিরূপ ব্যবহার করিবে, তাহা দেখিতে আমি এমত ইচ্ছুক ছিলাম, যে দুই দিন পরে পুনর্ব্বার তাহার গৃহে যাইয়া উপস্থিত হইলাম। ফুলমণির এবং করুণার ঘরের মধ্যে বিস্তর বিশেষ ছিল বটে, তথাপি দেখিলাম যে করুণা ঘরের সকল বস্তু পূর্ব্বাপেক্ষা কিছু পরিপাটি করিয়া রাখিয়াছে। উঠানে ঝাঁটি দেওয়া গিয়াছিল, কিন্তু ফুলমণি যেমন তাবৎ জঞ্জাল বাহিরে ফেলিয়া দিত, করুণা তেমন না করিয়া উঠানের এক কোণে তাহা ঢিপী করিয়া রাখিয়াছিল। সেও ঘরটি লেপন করিয়াছিল বটে, কিন্তু ফুলমণি যেমন লেপন করিয়া গোলা হাঁড়ি ঘরের পিছনে রাখিত, করুণা তেমন না করিয়া তাহা সম্মুখে ফেলিয়া রাখিয়াছিল।

 করুণা আমাকে দেখিবা মাত্র যে মোটা শাড়িখানি ফুলমণি তাহাকে দিয়াছিল, সে তাহা পরিয়া হাস্যমুখে বাহিরে আইল, এবং তাহার মাথাও সুন্দররূপে বাঁধা ছিল। আমি ঘরের মধ্যে গিয়া দেখিলাম যে করুণা কিছু পুরাতন কাপড় লইয়া একটি কোর্ত্তা সিলাই করিতেছিল। যদ্যপি সেই কোর্ত্তা ভাল কাটা হয় নাই, এবং সিলাই বড় মোটা, তথাপি তাহা দেখিয়া আমি অতিশয় সন্তুষ্টা হইয়া হাসিয়া বলিলাম, করুণা, তুমি তো বড় নিপুণ দরজী হইতেছ। ইহাতে করুণাও হাসিয়া উত্তর করিল, মেম সাহেব, যেমন পারি তেমনি করিতেছি। আগত রবিবারে গীর্জায় যাইব, অতএব ভাবিলাম, যে সেথায় যাইবার জন্যে একটি কোর্ত্তা তৈয়ার করিলে ভাল হয়।

 আমি কহিলাম, তুমি উত্তম বুঝিয়াছ, এবং বোধ হয় কোন কর্ম্ম চেষ্টা করিলে অল্প দিনের মধ্যে এক খান ভাল শাড়িও কিনিতে পারিবা। ইংলণ্ডদেশে আমাদের একটি চলিত কথা আছে, যথা,

যেখানে যাইবার ইচ্ছা হয়।
সেখানে যাইবার পথ করয়॥

 করুণা কহিল, হাঁ মেম সাহেব, আপনি সত্য বলিয়াছেন। ফুলমণি আমাকে এক উপায় দেখাইয়াছে, যাহাতে আমি এক মাসের মধ্যে একটি টাকা সঞ্চয় করিয়া গীর্জায় যাইবার নিমিত্তে একখান শাড়ি কিনিতে পারিব।

 এমত কথা শুনিয়া আমি সন্তুষ্টা হইয়া জিজ্ঞাসিলাম, সে কেমন উপায় বল দেখি?

 করুণা কহিল, আমাদের পাড়াতে কোন২ ধনি স্ত্রীলোকেরা সপ্তাহের মধ্যে একবার চারিটি পয়সা দিয়া পরের দ্বারা ঘর লেপিয়া লন। ফুলমণি বলিয়াছে যে আমি মহেন্দ্র বাবুর স্ত্রীকে এবং আর দুই তিন জনকে তোমার দুঃখের বিষয় জানাইব, তাহাতে তাঁহারা অবশ্য তোমাকে প্রতি সপ্তাহে ঐ কর্ম্ম করিতে ডাকিবেন। এমত হইলে আমার ভাবনা কি? সপ্তাহ গেলে চারি ঘরে যদি ৷৹ চারি আনা পাই, তবে স্বচ্ছন্দে মাসে এক টাকা উপার্জন করিতে পারিব। করুণা আরো জিজ্ঞাসিল, মেম সাহেব, আপনি কি শুনিয়াছেন যে মহেন্দ্র বাবুর স্ত্রী সম্পূর্ণরূপে সুস্থ হইয়াছেন, এবং তিনি সকলের সাক্ষাতে বলিয়াছেন যে আমার বংশী তাঁহাকে মারে নাই, কিন্তু যে ব্যক্তির সঙ্গে বংশী গিয়াছিল সেই লোক ছুরিদ্বারা তাঁহার কুক্ষিদেশে আঘাত করিয়াছিল?

 আমি কহিলাম, হাঁ করুণা, আমি কল্য তাহা শুনিয়া বড় সন্তুষ্টা হইলাম, কারণ যদ্যপি সে স্ত্রীলোকের সঙ্গে আমার পরিচয় নাই, তথাপি সকলের মুখে তাঁহার প্রশংসা শুনিয়া থাকি।

 করুণা বলিল, হাঁ মেম সাহেব, তাঁহার প্রশংসা আমাকেও করিতে হইবে, কেননা তিনি দরিদ্রদের প্রতি বড় দয়ালু।

 তাহাতে আমি হাস্য করত কহিলাম, করুণা, তুমি যদি মাসে এক টাকা উপার্জন কর, তবে আপনাকে আর দরিদ্রা বলিও না, তুমি ক্রমে২ ধনী হইয়া উঠিবা।

 করুণা বলিল, আ মেম সাহেব! এ কর্ম্ম করা যে সে কেবল পেটের জ্বালায়। ঘর লেপন করা বড় কঠিন কর্ম্ম, তাহা করিবার ভয়ে আমি আপনার ঘরটি ফেলিয়া রাখিতাম। এখন পরের ঘর লেপন করিতে হইল; তাহা পারি কি না, সে আগে দেখা যাউক।

 আমি বলিলাম, করুণা, পারিবা না কেন? তুমি অবশ্য পারিবা। ঘর লেপিবার সময়ে ইহা মনে রাখিও, এখন আমি কর্ত্তব্য কর্ম্ম করিতেছি, তাহাতে তোমার পরিশ্রম লঘুতর বোধ হইবে; এবং কর্ম্ম করাতে আর একটি লাভ আছে, তদ্দ্বারা তুমি নিজ মনের দুঃখ বিস্মৃতা হইবা।

 তদনন্তর আমি বলিলাম, করুণা, কল্য প্রাতঃকালে তোমার স্বামী জাগৃত হইলে কি ঘটিল, তাহাই বিশেষরূপে শুনিতে আসিয়াছি।

 তাহাতে করুণা কহিল, ও মেম সাহেব, তাহার বিষয়ে অনেক কথা আছে। সে যখন সন্ধ্যাকালে মাতাল হয়, তখন পরদিবসে সর্ব্বদা তাহার মাথা বড় ভারী হয়, ও সে উঠিয়া বসিলেও ঝিমাইতে থাকে। তেমনি কল্য সে উঠিয়া কাহাকেও কিছু না বলিয়া ঝিমাইতে২ দাবায় তামাক খাইতে লাগিল; এমত সময়ে আমি তাহাকে গামছা ও তৈল আনিয়া দিয়া কহিলাম, ও গো, যদি তোমার মাথার ব্যথা হইয়া থাকে, তবে পুষ্করিণীতে স্নান করিয়া আাইস, বোধ হয়, তাহাতে ভাল হইবে; তুমি ফিরিয়া না আসিতে২ তোমার জন্যে ভাত রাঁধিয়া রাখিব। নবীনের বাপ উত্তর করিল, কি ভাগ্য করুণা! আজি তোমার কি হইয়াছে? আমার সুখ জন্মাইতে কেন এত যত্ন করিতেছ? বোধ হয়, তুমি আমাকে ফুসলাইয়া আমার কাছে পয়সা লইতে চাও; কিন্তু তাহা কথনও হইবে না, সে আগে থাকিতে বলি। যাহা হউক, আমি তোমার কথা শুনিয়া স্নান করিতে যাই, পরে আসিয়া ভাত খাইব। মেম সাহেব, আমি ভোরে উঠিয়া ঘর ঝাঁটি দিয়া সকল দ্রব্য সুন্দররূপে পরিষ্কার করিয়া রাখিয়াছিলাম, তাহাতে বোধ করিলাম, যে নবীনের বাপ তদ্দ্বারা সন্তুষ্ট হইবে; কিন্তু তাহার এইরূপ কঠিন বাক্য শুনিয়া আমি কিছু রাগান্বিতা হইয়া তাহাকে ভর্ৎসনা করিবার মানস করিতেছিলাম, এমত সময়ে আপনকার উপদেশ আমার স্মরণ হইল, তাহাতে আমি কিছু না বলিয়া চুপ করিয়া রহিলাম। পরে সে পুষ্করিণীহইতে ফিরিয়া আইলে আমি একটা মাজুর দাবায় বিছাইয়া তাহাকে ইলিস মাছের ব্যঞ্জন ও ভাল অম্ল ও ভাত আনিয়া দিলাম। সে তাহা দেখিয়া বড় আশ্চর্য্য জ্ঞান করিয়া কহিল, করুণা, আজি কি হইয়াছে, তাহা কিছু বুঝিতে পারিতেছি না। এমত ভাল খাওয়া তিন মাস পর্য্যন্ত পাই নাই; এই সকল আয়োজন কেন করিলা? এবং কোথায় বা পাইলা? তখন আমি কহিলাম, কেবল তোমাকে সন্তুষ্ট করিবার জন্যে এই সকল প্রস্তুত করিয়াছি। এই কথাতে সে আমার মুখ পানে চাহিয়া আরো চমৎকৃত হইয়া কহিল, তুমি তো একেবারে নূতন মানুষ হইয়াছ! এমন স্বভাব যদি তোমার বরাবর থাকে, তবে আমার বড় ভাগ্য। পরে কোমরহইতে গেঁজিয়া বাহির করিয়া সে তাহা আমার সম্মুখে ফেলিয়া হাসিয়া কহিল, যাহা হউক করুণা, আজি তুমি ভুলাইয়া আমার পয়সা গুলিন লইলা; অতএব যাহা উহাতে থাকে তাহা বাহির করিয়া লও। গেঁজিয়াতে কেবল চারিটি পয়সা ছিল, তথাপি তাহা লইয়া নবীনের বাপকে বলিলাম, তোমার নিকটে এই যে চারিটি পয়সা পাইলাম, ইহাতে আমার বিস্তর বোধ হইল। পরে সে কহিল, আমার মাথা বড় বেদনা করিতেছে, অতএব তুমি যদি ওবেলাও আমাকে এইরূপ খাওয়াইতে পার, তবে আমি আজি কর্ম্মে না গিয়া ঘরে থাকি। মেম সাহেব, আপনি যে দুই টাকা দিয়াছিলেন, আমি তাহার বিষয় তাহাকে বলিতে ভয় করিলাম, পাছে যত দিন ঘরে কড়ি থাকে তত দিন সে কর্ম্মেতে না যায়; এই জন্যে কহিলাম, ভাল, আজি গৃহে থাক, আর কিছু ইলিস মাছ আছে, তাহাই সন্ধ্যাকালে রাঁধিয়া দিব।

 ইহাতে আমি কহিলাম, করুণা, তুমি জ্ঞানির মত কর্ম্ম করিলা বটে। সে কথা শুনিয়া তোমার স্বামী কি সমস্ত দিন ঘরে রহিল?

 করুণা উত্তর করিল, হাঁ মেম সাহেব, আর কি জানি কিসে তাহার মনে প্রবৃত্তি হইল, সে গোটা কতক বাঁস আনিয়া ঘরের বেড়া মেরামত করিতে লাগিল, তাহাতেই সকল আজি এমত শোভা দেখাইতেছে।

 আমি কহিলাম, করুণা, তোমার বড় সৌভাগ্য দেখিতে পাই; ধর্ম্মপথে চলিতে তোমার স্বামী বাধা না দিয়া বরং তোমার উপকার করিতেছে।

 করুণা কহিল, না মেম সাহেব, সম্পূর্ণরূপে এমত বলা যায় না; কিন্তু তাহার কথা আরও কিছু শুনুন। সন্ধ্যার সময়ে তাহার দুই তিন জন দুষ্ট সঙ্গিরা আসিয়া তাহাকে লইয়া যাইবার নিমিত্তে বিনতি করিতে লাগিল। প্রথমে সে যাইতে চাহিল না, কিন্তু ক্ষণেক পরে তাহারা সাধ্য সাধনা করাতে সে গেল। তথাপি সে যে তাহাদের সহিত গিয়া নিতান্ত মাতওয়ালা হইল এমত নয়, কিঞ্চিৎ মদ খাইয়া সে নয়টা বাজিলে ঘরে ফিরিয়া আইল।

 তাহাতে আমি জিজ্ঞাসিলাম, আজি সে কোথায়? করুণা কহিল, মেম সাহেব, আহারাদি করিয়া আমি কর্ম্মেতে যাই বলিয়া সে প্রাতঃকালে বাহিরে গিয়াছে; এখন সে কি করে তাহা দেখা যাইবে।

 আমি জিজ্ঞাসিলাম, তবে পরশু অবধি সে কি তোমাকে আর কোন প্রকারে কঠিন কথা কহে নাই? করুণা মাথা হেট করিয়া বলিল, না মেম। আমি আপন স্বামির নম্র ব্যবহার দেখিয়া টের পাইয়াছি, যদি পূর্ব্বাবধি তাহার প্রতি কোমল আচরণ করিয়া আসিতাম, তবে আমাদের এত দুঃখ কখন হইত না। করুণা এমত ভাবিয়া সে বিষয়ে কিঞ্চিৎ লজ্জিতা হইল।

 অনন্তর আমি জিজ্ঞাসিলাম, এই দুই দিনের মধ্যে কি ফুলমণি তোমার গৃহে আসিয়াছিল?

 করুণা বলিল, হাঁ মেম সাহেব, আজি প্রাতঃকালে সে প্রায় দুই ঘণ্টা পর্য্যন্ত এখানে ছিল। আমার পরিষ্কার কাপড় ও ঘরের পারিপাট্য দেখিয়া প্রথমে সে আশ্চর্য্য জ্ঞান করিয়া কহিল, করুণা, তুমি কি এত দিনের পর ভাল গৃহিণী হইলা? আপনকার সহিত পরশু যে সকল কথা হইয়াছিল, আমি সে সকল তাহাকে জ্ঞাত করিয়া কহিলাম; ফুলমণি, এই অবধি আমি তোমাকে নিদর্শন স্বরূপ জ্ঞান করিয়া ঈশ্বরের আদেশ পালন করিতে চেষ্টা করিব। ফুলমণি এই কথা শুনিয়া বড় আহ্লাদ পূর্ব্বক বলিল, আহা করুণা! তুমি আমার মনকে কেমন প্রফুল্ল করিলা। আমি সাধুর পিতার নিকটে প্রিয়নাথকে রাখিয়া আসিয়াছি, অতএব এক দণ্ড স্বচ্ছন্দে বসিয়া তোমার সহিত কথা কহিতে পারিব। তাহাতে সে আমাকে ধর্ম্ম পুস্তকের অনেক বচন কহিয়া এই পদটি মুখস্থ করাইল, যথা; “কঠিন বাক্য ও কোপ ও রাগ ও কলহ ও নিন্দা এবং তাবৎ জিঘাংসা, এই সকল তোমাদেরহইতে দূর হউক। আর খ্রীষ্টের অনুরোধে ঈশ্বর তোমাদিগকে যেমন ক্ষমা করিয়াছেন, তোমরা তেমনি দয়ালু ও কোমল অন্তঃকরণ হইয়া পরস্পর ক্ষমা কর।” পরে ফুলমণি আমার নিকটে অনেক ক্ষণ বসিয়া যীশু খ্রীষ্টের প্রেমের বিষয় কহিতে লাগিল, তাহাতে সে সকল মিষ্ট কথা আমি পূর্ব্বাপেক্ষা ভালরূপে বুঝিতে পারিয়া বোধ করিলাম, কি জানি যীশু আমাকেও ক্ষমা করিয়া স্বর্গে লইয়া যাইবেন। কিন্তু ফুলমণি গেলে পর আর এক জন স্ত্রীলোক আমাকে বংশির মা বলিয়া উচ্চেঃস্বরে ডাকিল। সে সময়ে আমি পরিত্রাণের বিষয়ে ভাবিতেছিলাম, এই জন্যে ঐ কথাতে আমার মনে বড় ভয় হইল; তাহাতে আমি কাঁদিতে২ বলিলাম, হায়! আমি বংশির মা বটে, কিন্তু আপন ছেল্যাকে নষ্ট করিয়াছি, অতএব এখন যে স্বর্গ পাইবার ভরসা করিতেছি, ইহা আমার নিতান্ত ভ্রম।

 আমি কহিলাম, না করুণা, ভ্রম কেন হইবে? তোমার পাপ ভারী হইয়াছে বটে, অতএব পাপকে যে ক্ষুদ্র বিষয় বোধ কর, ইহা আমার কোন প্রকারে ইচ্ছা নয়; তথাপি একটি সান্ত্বনার কথা কহিতে হয়, যে সময়ে তুমি আপন ছেল্যার পরিত্রাণের বিষয়ে নিশ্চিন্তা ছিলা, সে সময়ে তুমি আপনি ধর্ম্মের বিষয়ে এক প্রকার অজ্ঞান ছিলা; কিন্তু যে খ্রীষ্টিয়ান লোক প্রভুর মহানুগ্রহের আস্বাদন করিয়াও আপন শিশুদিগকে সুশিক্ষা না দেয়, ও ভালরূপে শাসন না করে, তাহাদের দোষ তোমার দোষ অপেক্ষা শত গুণে বড়। হায়! ঈশ্বরের বিচার স্থানে দাঁড়াইয়া এমত ব্যক্তিগণকে কেমন ভয়ানক হিসাব দিতে হইবে। কিন্তু করুণা, তুমি ভয় না করিয়া এই২ কর্ম্ম কর; মন ফিরাইয়া প্রভু যীশু খ্রীষ্টের প্রতি বিশ্বাস কর, এবং আগত কালে পাপ ত্যাগ করিয়া সৎক্রিয়া কর। তোমার এখন একটি সন্তান আছে, তাহাকেই ধর্ম্মের পথে লওয়াও। এই সকল করিলে ঈশ্বর তোমার পূর্ব্বদোষ মুচিয়া ফেলিয়া খ্রীষ্টের অনুরোধে তোমাকে অবশ্য গ্রাহ্য করিবেন।

 করুণা উক্ত কথা শুনিয়া আপন চক্ষের জল মুচিয়া কহিল, ও মেম সাহেব! সন্তানদিগকে শিক্ষা দি নাই, ইহাতে যে আমার ভারি দোষ হইয়াছে, তাহা আমি নবীনকে বলিয়াছি; আর যীশু খ্রীষ্ট কে, ও তিনি বা কি করিলেন, তাহা সাধ্য পর্য্যন্ত তাহাকে বুঝাইয়া দিয়া তাঁহার প্রতি বিশ্বাস করিতে বিনয় করিয়াছি।

 আমি কহিলাম, করুণা, তুমি ভাল করিয়াছ। এমত কর্ম্মদ্বারা যে আমরা স্বর্গ লাভ করি, ইহা নয়; তথাপি কর্ণীলিয়ের প্রার্থনা ও দানাদি যে রূপ ঈশ্বরের গোচরে সাক্ষী স্বরূপ হইল, সেইরূপ তুমি যে প্রভু যীশু খ্রীষ্টের সেবা করিতে বাঞ্ছা কর তোমার এই কর্ম্ম তাহারি সাক্ষী হইয়াছে।

 পরে আমি করুণাকে জিজ্ঞাসিলাম, ফুলমণি কি আর কিছু বলিয়া যায় নাই?

 করুণা উত্তর করিল, হাঁ মেম, সে আমাকে অনেক সুপরামর্শ দিয়া শেষে আমার সহিত প্রার্থনা করিল, যেন ঈশ্বর আমাকে সৎক্রিয়া করিতে শক্তি দেন, ও আমি যেন তাঁহাকে পূর্ব্বাপেক্ষা ভালরূপে সেবা করিতে পারি। পরে সে বিদায় লওনের সময়ে বলিল, করুণা, তোমার প্রতিদিনের সামান্য আচার ব্যবহার যাহাতে ঈশ্বরের ইচ্ছানুসারে হইতে পারে, এই অভিপ্রায়ে ধর্ম্ম পুস্তকের কএকটি নিয়ম তোমাকে লিখিয়া দিতে সাধুর বাপকে বলিব; এবং এই দেখ, মেম সাহেব, দুই ঘণ্টা হইল সাধু এই তক্তিখানি আমাকে দিয়া গিয়াছে।

 আমি সে তক্তি হাতে করিয়া দেখিলাম, যে প্রেমচাঁদ তাহাতে এক খান শাদা কাগজ বসাইয়া অতি স্পষ্ট রূপে বড়২ অক্ষরে ধর্ম্মপুস্তকহইতে তেরটা পদ লিখিয়াছে। ঐ বাক্য সকল বাঙ্গালা দেশস্থ খ্রীষ্টিয়ান স্ত্রীলোকদের প্রতি অতি সুন্দররূপে খাটে, ইহা বুঝিয়া ধর্ম্মপুস্তকের কোন্ স্থানে সেই পদ পাওয়া যায় তাহা সে সময়ে লিখিয়া লইলাম, এবং এখন পাঠকবর্গের হিতার্থে বিস্তারিত রূপে ব্যাখ্যা করি। যথা,

খ্রীষ্টিয়ান স্ত্রীলোকদের ব্যবহার্য্যের ধারা।
১ ঈশ্বরের প্রতি যাহা কর্ত্তব্য।

  1. “তুমি সর্ব্বদাই পরমেশ্বরকে সম্মুখে রাখ।” দায়ূদের গীত। ১৬।৮।
  2. “নিরন্তর প্রার্থনা কর।” থিষলনীকীয়দের প্রতি প্রথম পত্র। ৫।১৭।
  1. “তুমি সমস্ত অন্তঃকরণের সহিত পরমেশ্বরেতে বিশ্বাস কর; এবং আপন বুদ্ধিতে নির্ভর দিও না। আপন তাবৎ গতিতে তাঁহাকে স্বীকার কর; তাহাতে তিনি তোমার পথ সরল করিবেন।” হিতোপদেশ। ৩।৫, ৬।
  2. স্মরণে রাখিও যে “তোমরা খ্রীষ্টের।” করিন্থীয় মণ্ডলীর প্রতি প্রথম পত্র। ৩।২৩।
  3. “তোমরা ভোজন পান প্রভৃতি যে কোন কর্ম্ম কর, সে সকলি ঈশ্বরের মহিমা প্রকাশের নিমিত্তে কর।” ১ করিন্থীয়। ১০।৩১।

২ পরিবারের প্রতি যাহা কর্ত্তব্য।

  1. “তোমরা আপন২ পরিবারের প্রতি মনোযোগ কর, ও আলস্যের খাদ্য খাইও না।” হিতোপদেশ। ৩১।২৭।
  2. “কার্য্যেতে নিরালস্য ও আত্মাতে উদ্যোগী হইয়া প্রভুর সেবা কর।” রোমীয়। ১২।১১।
  3. “হে নারি সকল, তোমরা যেমন প্রভুর বশীভূতা তেমনি নিজ২ স্বামিরও বশতাপন্না হও।” ইফিষীয়। ৫।২২।
  4. “তোমরা আপন২ সন্তানদিগকে প্রভুর শিক্ষা ও উপদেশ দিয়া প্রতিপালন কর।” ইফিষীয়। ৬।৪।

৩ প্রতিবাসির প্রতি যাহা কর্ত্তব্য।

  1. “তুমি মুখ খুলিয়া জ্ঞানের কথা কহ, এবং তোমার জিহ্বাগ্রে অনুগ্রহের ব্যবস্থা থাকুক।” হিতোপদেশ। ৩১।২৬।
  2. “তোমরা এক জন অন্যের প্রতি মিথ্যা কথা কহিও না; কেননা তোমরা কর্ম্মের সহিত পুরাতন স্বভাব পরিত্যাগ করিয়া সৃষ্টি কর্ত্তার প্রতিমূর্ত্তি অনুসারে জ্ঞানেতে পুনর্নির্ম্মিত যে নূতন স্বভাব তাহা গ্রহণ করিয়াছ।” কলসীয়। ৩।৯, ১০।
  3. “তোমরা পরস্পর প্রেম বিনা আর কিছুতে কাহার ঋণী হইও না; এবং কেবল আত্মবিষয়ে নহে, কিন্তু পরের বিষয়েও মনোযোগ কর।” রোমীয়। ১৩।৮। ফিলীপীয়। ২।৪।
  4. “তোমরা সুযোগ পাইলে সকল লোকের বিশেষতঃ বিশ্বাসকারি পরিবারের মঙ্গল করিও।” গলাতীয়। ৬।১০।

 উক্ত বাক্য পড়িয়া আমি করুণাকে কহিলাম, করুণা, তুমি যদি এই নিয়মানুসারে চল, তবে তুমি ধন্যা বট; এবং ফুলমণি যে তোমার বন্ধু, এও বড় আহ্লাদের বিষয়। কিন্তু ইহা স্মরণে রাখিও, যদ্যপি তুমি তাহার পরামর্শে না চল ও তাহার সদ্ব্যবহার দেখিয়া আপনার ব্যবহার পরিবর্ত্তন না কর, তবে ঈশ্বরের নিকটে ভয়ঙ্কর হিসাব দিতে হইবে।

 এই কথাতে করুণা চিন্তিতা ও মৌনী হইয়া থাকিল। পরে আমি তাহাকে জিজ্ঞাসিলাম, তুমি কি এই সকল ঈশ্বরীয় বচন ভালরূপে বুঝিয়াছ? করুণা বলিল, মেম সাহেব, যে অবধি সাধু ঐ তক্তি খানি আমাকে দিয়া গিয়াছে, সেই অবধি আমি ঐ বাক্যের মর্ম্ম মনেতে আন্দোলন করিতেছি; কিন্তু তাহার মধ্যে দুইটি পদ আমাকে কিছু কঠিন বোধ হইতেছে। আমি জিজ্ঞাসিলাম, কোন্২ পদ, তাহা আমাকে বল; আমি আহ্লাদপূর্ব্বক তাহা বুঝাইয়া দিব, এবং ঈশ্বরের নিকটে প্রার্থনা করিব যেন তিনি আপন নিগূঢ় বাক্য তোমার বোধগম্য করিয়া দেন।

 করুণা বলিল, মেম সাহেব, চতুর্থ নিয়ম এই, “তোমরা খ্রীষ্টের,” ইহা স্মরণে রাখিও; কিন্তু এই কথা কি নিমিত্তে স্মরণে রাখিতে হয়, তাহা ভালরূপে বুঝিলাম না।

 আমি কহিলাম, করুণা, তোমাকে একটি দৃষ্টান্ত বলি শুন। অন্য দেশীয় একজন রাজা তোমাকে ধরিয়া কারাগারে রাখিয়া যদি এই কথা বলে, তুমি আমাকে ১০০০০ দশ সহস্র টাকা আনিয়া না দিলে আমি তোমাকে মারিয়া ফেলিব। এমত হইলে তুমি কি করিবা? তোমার কাছে টাকা নাই, এবং তোমার দরিদ্র বন্ধুবান্ধবেরা যে দশ সহস্র টাকা দিতে পারিবে, ইহা নিতান্ত অসম্ভব কথা। তাহারা তোমাকে রক্ষা করিতে চাহিলেও কি জানি সকলে একত্র হইয়া এক শত ১০০ টাকা পর্য্যন্ত যোগাইতে পারিবে না, সুতরাং তোমার আর কোন উপায় না থাকাতে তোমাকে মরিতে হইবে। প্রাণদণ্ড কারক হাতে খড়্গ লইয়া তোমাকে ধরিয়াছে, এমত সময়ে যদি এক জন ধনি ব্যক্তি আসিয়া উপস্থিত হন, এবং তিনি অসীম দয়া প্রকাশ করিয়া প্রেমিক ও মৃদু রবে বলেন, ও দুর্ভাগ্যা স্ত্রি! তোমার যদি বাঁচিবার ইচ্ছা থাকে, তবে আমার কথা শুন। আমি তোমার শত্রুকে দশ সহস্র টাকা দিয়া তোমাকে রক্ষা করি, কিন্তু এমত করিলে তুমি চিরকাল আমার দাসী হইবা; আমি তোমাকে কিনিয়া লওয়াতে তুমি আর কোন কর্ত্তার সেবা করিতে পারিবা না। আমার নিকটে যদি এই স্বীকার কর, তবে আমি তোমাকে রক্ষা করি; কিন্তু আমার আজ্ঞা যে কঠিন হইবে, এমত বোধ করিও না, কেননা যাহাতে তোমারই হিত জন্মে কেবল এমত আজ্ঞা করিব। করুণা, এখন জিজ্ঞাসা করি, তুমি এমত দয়ালু ব্যক্তিকে কি উত্তর দিবা?

 করুণা বলিল, ও মেম সাহেব, আমি তখনি তাঁহার নিয়মে স্বীকৃতা হইয়া সর্ব্বদা তাঁহার নিকটে বাধ্য হইয়া থাকিতাম।

 আমি কহিলাম, হাঁ করুণা, ঐ প্রকার কর্ম্ম করা তোমার উচিত হইত বটে; কিন্তু কিছু দিন পরে তুমি যদি ঐ ব্যক্তির সেবা ছাড়িয়া তাঁহার এক জন শত্রুর নিকটে কর্ম্ম করিতে যাইতা, তবে তোমার বিষয়ে কি বলা যাইত? করুণা কহিল, মেম সাহেব, এমত যদি করিতাম, তবে আমাকে অবশ্য দুষ্টা ও অকৃতজ্ঞা স্ত্রী বলিত। আমি কহিলাম, করুণা, তবে বল দেখি, এমত অকৃতজ্ঞের মত কর্ম্ম যেন তোমাহইতে না হয়, এই অভিপ্রায়ে আপন মনকে কি প্রকারে রক্ষা করিতা? করুণা উত্তর করিল, মেম সাহেব, আমি সর্ব্বদা ইহা মনে রাখিতাম, যে আমি মৃতপ্রায় হইয়াছিলাম, এমত সময়ে আমার দয়ালু কর্ত্তা টাকা দিয়া আমাকে মৃত্যুহইতে বাঁচাইলেন, তাহাতে আমি এক প্রকার তাঁহার ক্রীতা দাসী হইয়াছি, অতএব এখন যদি তাঁহাকে ছাড়িয়া পরের সেবা করি, তবে ইহাতে বড় অধর্ম্ম হইবে।

 আমি বলিলাম, ভাল কহিয়াছ করুণা, তুমি আমার দৃষ্টান্তের তাৎপর্য্য সুন্দররূপে বুঝিয়াছ। এখন বোধ করি, “তোমরা খ্রীষ্টের, ইহা স্মরণে রাখিও,” এই কথা সাধুর বাপ কি অভিপ্রায়ে লিখিল তাহাও বুঝিতে পরিবা

 করুণা প্রফুল্ল বদন হইয়া কহিল, হাঁ২, এখন আমি বুঝিয়াছি বটে। আমি পাপ রোগে মৃতপ্রায় হইয়া নরকের পথে যাইতেছিলাম, এমত সময়ে খ্রীষ্ট দশ সহস্র টাকা না দিয়া আপন বহুমূল্য রক্ত ব্যয় করিয়া আমাকে রক্ষা করিলেন; অতএব এখন আমি তাঁহারি হইয়াছি, ইহা সর্ব্বদা স্মরণে রাখিলে আমি শয়তানের সেবা কোন প্রকারে না করিয়া কেবল আপন দয়ালু ত্রাণকর্ত্তার নিকটে বাধ্য হইয়া থাকিব।

 করুণার এইরূপ বাক্য শুনিয়া আমি অতিশয় আহ্লাদিতা হইলাম, যেহেতুক তদ্দ্বারা বোধ করিলাম, এ ব্যক্তি যদি ধর্ম্মাত্মাহইতে শিক্ষিতা না হইত, তবে সে এমত কথা কহিতে পারিত না।

 ঈশ্বর যে আমার প্রার্থনা শুনিয়া করুণাকে এরূপ শিক্ষা দিলেন, এই জন্যে আমি মনে২ তাঁহার ধন্যবাদ করিয়া কহিলাম, এখন করুণা, তুমি আর কোন্ কথা বুঝিতে পার নাই, তাহা আমাকে বল।

 করুণা কহিল, মেম সাহেব, পঞ্চম নিয়ম এই, “তোমরা ভোজন পান প্রভৃতি যে কোন কর্ম্ম কর, সে সকলি ঈশ্বরের মহিমা প্রকাশের নিমিত্তে কর;” কিন্তু আমাদিগকে দিনে২ আপন সন্তোষের নিমিত্তে অনেক প্রকার ক্ষুদ্র২ কর্ম্ম করিতে হয়, তবে সে সকল কর্ম্মদ্বারা ঈশ্বরের মহিমা কিরূপে প্রকাশ হইবে?

 আমি কহিলাম, করুণা, বোধ করি পৌল প্রেরিত ঐ বিধি দৃঢ়রূপে স্থাপন করিবার জন্যে এই প্রকার কথা লিখিলেন। সেই কথার অভিপ্রায় এই, কেবল মহৎ কর্ম্মে নয় বরং ক্ষুদ্র কর্ম্মেও ঈশ্বরের মহিমা প্রকাশ করা উচিত; তাহাতে বোধ হয়, তিনি দৃষ্টান্তভাবে ভোজন পান করিবার বিষয় কহিলেন। ভোজন পানদ্বারা যে ঈশ্বরের মহিমা প্রকাশ করা যায় না, এমত অনুমান করিও না। অনেক খ্রীষ্টিয়ান লোকেরা এই বাক্যেতে মনোযোগ না করিয়া কেবল আত্মসুখের জন্যে আহারাদি করে, কিন্তু এমত করা উচিত নয়। ইন্দ্রিয়গণের বশীভূত ব্যক্তি পেটুক হইয়া অপরিমিত ভোজন পান করে, তাহাতে তাহার শরীর ক্রমে২ নিস্তেজ ও স্থূল হইলে সে ঈশ্বরের সেবা করিতে অক্ষম হয়। কিন্তু সত্য খ্রীষ্টিয়ান ব্যক্তি সেইরূপ না করিয়া পরিমিত আচরণ করে; ফলতঃ সে ঈশ্বরের দত্ত বস্তু ভোজন পান করিবার সময়ে ইহা মনে রাখে, যে আমার শরীর পরমেশ্বরের খাদ্য দ্রব্যদ্বারা প্রতিপালিত ও সবল হইতেছে, অতএব সে শরীর তাঁহারি হইল, এবং তাঁহারি কার্য্যে তাহা ব্যয় করা কর্ত্তব্য। পেয় দ্রব্যের বিষয়েও এইরূপ বলা যায়। পরমেশ্বর মনুষ্যদের পান করিবার জন্যে জল ও দুগ্ধ আদি নানা প্রকার সদ্‌গুণযুক্ত উত্তম দ্রব্য দান করিয়াছেন, এবং যতকাল মনুষ্যেরা কেবল ঐ সকল দ্রব্য পান করে, তত দিন তাহাদের জ্ঞানচক্ষুঃ নির্ম্মল থাকে, ও তাহারা সেই জ্ঞান ও বুদ্ধিদ্বারা ঈশ্বরের মহিমা প্রকাশ করিতে পারে; কিন্তু যখন তাহারা মদ্যাদি পান করিতে আরম্ভ করে, ও তদ্দ্বারা মাতওয়ালা হয়, তখন তাহারা শয়তানের বশীভূত হইয়া তাহারই মহিমা প্রকাশ করিবার হেতু পান করে, ও আপনার শরীর ও আত্মা উভয়কে নষ্ট করে। আরো বলি, করুণা, যাহাতে ঈশ্বরের মহিমা প্রকাশ হয়, এমত আর২ অনেক ক্ষুদ্র কর্ম্ম আছে। দেখ, আমি তোমার ঘরে আসিয়া দেখিলাম, তুমি একটা কোর্ত্তা সিলাই করিতেছ, তাহাতে তুমি আমাকে কহিলা, গীর্জায় যাওয়া আমার কর্ত্তব্য, এবং যাহারা গীর্জায় যায়, তাহাদিগকে উপযুক্ত বস্ত্র পরিয়া যাইতে হয়, কারণ ঈশ্বর কহিয়াছেন, বিহিতরূপে সকল কর্ম্ম কর; তুমি এই আজ্ঞা পালন করিতে চাহিয়া ঐ কোর্ত্তাটি সিলাই করিতে লাগিয়াছ। অতএব বোধ হয়, এই ক্ষুদ্র কর্ম্মের বিষয়ে বলা যায় যে তদ্দ্বারা ঈশ্বরের মহিমা প্রকাশ হইতেছে। এই প্রকার আরো অনেক দৃষ্টান্ত দেখাইতে পারি। তুমি আপন স্বামির বশীভূতা হও, কেননা ঈশ্বর এমত আজ্ঞা করিয়াছেন; এবং সন্তানদিগকে সুশিক্ষা দেও, যেন তাহারা ঈশ্বরের সেবা করিতে পারে; ও আত্মসুখের নিমিত্তে কিম্বা মান্য হইবার জন্যে নয়, কিন্তু ঈশ্বরের সন্তোষ জন্মাইবার জন্যে দরিদ্রদের প্রতি দয়া কর; এবং বিশেষরূপে খ্রীষ্টিয়ানদের প্রতি প্রেমিক ব্যবহার কর, কারণ তাহারা প্রভুর পরিবার; সকলের প্রতি সরল আচরণ কর, মনুষ্যের ভয়ে তাহা নয়, কিন্তু ঈশ্বর এমত আদেশ করিয়াছেন, এই নিমিত্তে তাহা কর। এই২ সকল করিলে তদ্দ্বারা ঈশ্বরের মহিমা অবশ্য প্রকাশ হইবে। এখন করুণা, তুমি ঐ পঞ্চম নিয়ম বুঝিয়াছ কি না?

 করুণা বলিল, হাঁ মেম সাহেব, বুঝিয়াছি।

 আমি তাহার সহিত আরো কথোপকথন করিতে ইচ্ছুক ছিলাম, কিন্তু সেই সময়ে দূরে দেখিলাম, যে নবীনের বাপ ক্ষেত্রের উপর দিয়া ঘরে আসিতেছে। তাহাতে করুণা শীঘ্র উঠিয়া দ্বারের নিকটে গেল, এবং তাহার স্বামিকে দেখিবা মাত্র সে প্রফুল্ল বদনে কহিল,ও মেম সাহেব, তাহার সঙ্গে কোন দুষ্ট লোক নাই, এবং সে টল্‌মল্ না করিয়া ভাল মানুষের মত আসিতেছে। আজি সে মাতওয়ালা হয় নাই। হায়! সে যদি মদ্যপান ত্যাগ করে, তবে আমার ভাবনা কি? আমি তাহার সহিত অতি সুখে বাস করিতে পারিব, কেননা মাতওয়ালা না হইলে নবীনের বাপ আমার প্রতি কোন দৌরাত্ম্য করে না।

 স্বামিকে ভাল হইবার লক্ষণ দেখিবা মাত্র তাহার স্ত্রী যে এইরূপ প্রেমের কথা কহিল, তাহাতে আমি উল্লাসিতা হইলেও আশ্চর্য্যজ্ঞান করিলাম না, কারণ যৌবন কালে বিবাহিত স্বামি অপেক্ষা এই জগতের মধ্যে এমত প্রিয়তম সম্বন্ধ আর কাহারও সহিত হয় না। আমি করুণার নিকটে এই কথা বলিয়া বিদায় হইলাম, করুণা, তুমি শীঘ্র তোমার স্বামির জন্যে তামাক সাজিয়া রাখ; সে প্রায় এক ক্রোশ পথ হাঁটিয়া আসিতেছে, অতএব বোধ হয় আসিবা মাত্র তামাক খাইতে চাহিবে। পরে ঘরের বাহির হইলে নবীনের পিতার সহিত আমার সাক্ষাৎ হইল, সে আমাকে অতি নম্রতা পূর্ব্বক সেলাম করিয়া বাটীর ভিতরে প্রবেশ করিল। করুণা যেমত বলিয়াছিল, আমি সেই মত দেখিলাম, সে এখন মাতওয়ালা হয় নাই বটে। হে স্ত্রীগণ, তোমরা মন দিয়া শুন; যে ব্যক্তি প্রতিদিবস মাতাল হইয়া অর্দ্ধ রাত্রি পর্য্যন্ত পথে পড়িয়া থাকিত, এখন সে ব্যক্তি কিছু মদ্যাদি পান না করিয়া বেলা থাকিতে২ ঘরে ফিরিয়া আইল। কি জন্যে এমত করিল তাহা বলি, শুন; তাহার স্ত্রী তিন দিবস পর্য্যন্ত তাহার গৃহ পরিপাটি করিয়া তাহাকে প্রেমের বাক্য কহিয়াছিল।

 পরে গাড়ীতে উঠিবার সময়ে ফুলমণি শীঘ্র আসিয়া আমাকে আপন ঘরে ডাকিল, তাহাতে আমি নামিয়া তাহার নিকটে গেলাম। তাহার চক্ষে জল ছল্২ করিতেছিল বটে, তথাপি আমি টের পাইলাম, যে সে জল দুঃখ প্রযুক্ত নয়, কিন্তু অত্যন্ত আনন্দদ্বারা জন্মিয়াছে। ফুলমণি অতিশয় প্রফুল্ল বদনে কহিল, ও মেম সাহেব! এত দিন পরে আপনি আমার সুন্দরীকে দেখিতে পাইবেন; আজি পাদরি সাহেব আমাকে বলিলেন, আমার ভগিনী এই সপ্তাহের মধ্যে আসিবেন, এবং বোধ করি তিনি তিন মাস পর্য্যন্ত এখানে থাকিবেন। মেম সাহেব, আপনি আমাসকলের প্রতি বড় প্রেম করেন, এই জন্যে আমার মেয়্যাকে আপনাকে দেখাইতে অতিশয় বাঞ্ছা আছে। লোকে তাহাকে পরম সুন্দরী কহে, কিন্তু আপনি তাহাকে দেখিলে সে বিষয় বিচার করিবেন। সুন্দরী আইলে পর আপনাকে সেলাম করিবার জন্যে আমি কি তাহাকে আপনার বাটীতে লইয়া যাইব, কি আপনি অনুগ্রহ করিয়া আমাদের ঘরে আসিবেন?

 আমি কহিলাম, ফুলমণি, তোমার মেয়্যাকে আমার বাটীতে লইয়া যাইও না; আমি তোমাদের ঘরে আসিব, কারণ আমি সুন্দরীকে তাহার ভাই ভগিনীর সহিত দেখিতে চাহি। বোধ হয়, সাধু ও সত্যবতী বড় আহ্লাদিত হইয়াছে।

 ফুলমণি কহিল, ও মেম সাহেব, তাহাদের আমোদের সীমা নাই; আজি সমস্ত দিন সত্যবর্তী নাচিতে২ দিদি আসিতেছে২ এই কথা সকলকে বলিয়াছে।

 আমি কহিলাম, ফুলমণি, আমিও তোমার সহিত আনন্দ করি। যে দিন তোমার সহিত প্রথমে আমার সাক্ষাৎ হইল, সেই দিন অবধি আমি সুন্দরীকে দেখিতে ইচ্ছুক আছি; তাহার ভাঙ্গা গোলাপ চারার বিষয় আমি অদ্যাবধি ভুলি নাই।

 ফুলমণি বলিল, ও মেম সাহেব, সে অনেক দিনের কথা, বোধ করিতেছিলাম যে সে আপনকার মনে পড়িবে না।

 আমি বলিলাম, হাঁ ফুলমণি, সে এক বৎসরের কথা হইল বটে, তথাপি ঐ গোলাপ চারার বিষয় তোমার মেয়্যার যে সুন্দর উপদেশ, তাহা আমি কখন ভুলিব না। ফুলমণি, ইহাও তোমাকে বলি, যদ্যপিও আমি ইংরাজি বিবি এবং তুমি বাঙ্গালি স্ত্রীলোক, তথাপি তোমার সহিত যে আমার সাক্ষাৎ হইল, এই জন্যে আমি অনেকবার ঈশ্বরের ধন্যবাদ করিয়াছি। তোমার সহিত আলাপ করিয়া আমার মন বিস্তর সান্ত্বনা পাইয়াছে, এবং সকল ধর্ম্মকর্ম্মে তুমি আমাকে সর্ব্বদা সাহায্য করিয়াছ।

 এই কথা শুনিয়া ফুলমণির চক্ষুহইতে জল পড়িতে লাগিল। পরে সে কহিল, মেম সাহেব, আপনি আমাদিগকে বড় প্রেম করেন, তাহা আমি জানি, কিন্তু আমরা তাহার যোগ্যপাত্র নহি। আমি আপনকার সাহায্যার্থে কি করিয়াছি? যাহারা ভাল হইয়াছে তাহারা আপনারই শিক্ষাদ্বারা হইয়াছে।

 আমি কহিলাম, না না ফুলমণি, এমত কথা বলিও না। আমি নয়, কিন্তু ধর্ম্মাত্মা তাহাদের মনে আপন বাক্যরূপ বীজ ফলবান্ করিয়াছেন; ফলতঃ আমরা সে বীজ বপন করিতে পারিয়াছিলাম, এই হেতুক পরমেশ্বরের ধন্যবাদ করা আমাদের কর্ত্তব্য। আমি যেরূপ পূর্ব্বে একবার বলিয়াছিলাম, সেইরূপ আরবার বলি, আমি যে স্থানে বীজ বপন করিয়াছি, সেই স্থানে তুমি প্রার্থনা ও সদুপদেশরূপ জল সেচন করিয়াছ; তাহাতে যদি কোন ফল উৎপন্ন হইয়া থাকে, তবে আমরা উভয়ে মিলিয়া উল্লাসিতা হইতে পারি। গত বৎসরের মধ্যে ঈশ্বর আমাদিগকে কেমন ধর্ম্মরূপ ফসল দিয়াছেন, তাহা আমরা বিবেচনা করিয়া দেখি; কেননা তাঁহার অনুগ্রহ চিন্তা করণদ্বারা আমাদের মনে তাঁহার প্রতি কৃতজ্ঞতা জন্মে। প্রথমে আয়ার কথা বলিতে হয়। আমি যখন এই স্থানে আইলাম, তখন সে মিথ্যা পয়গম্বরের মতালম্বী ছিল; এখন সে যীশুর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রাখিতেছে। আয়া আমাকে অনেকবার বলিয়াছে, আমি প্রথমে ফুলমণির ছেল্যাদের ব্যবহার দেখিয়া ও তাহাদের কথাবার্ত্তা শুনিয়া ধর্ম্মের বিষয়ে ভাবিতে লাগিলাম।

 ইহা শুনিয়া ফুলমণি স্বর্গের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া মৃদুস্বরে বলিল, হে দয়ালু পিতঃ! আমি তোমার ধন্যবাদ করি।

 পরে আমি কহিলাম, রাণীর বিষয়েও মনযোগ কর। সে এখন কিরূপ সদাচারণ করিতেছে, ও তাহার দুষ্টা ঝকড়াটে শাশুড়ীর প্রতি কেমন সহিষ্ণুতা প্রকাশ করিয়া তাহার সকল আজ্ঞা পালন করিতেছে। ফুলমণি, রাণী তোমারই ধর্ম্ম মেয়্যা; তাহার সহিত ধর্ম্মের বিষয়ে আমার তো প্রায় কথা হয় নাই।

 ফুলমণি কহিল, মেম সাহেব, সে আপনার স্বামী মধুর ভয়ানক মৃতু্য দেখিয়া আপন আত্মার বিষয়ে প্রথমে চিন্তা করিতে লাগিল; এবং দুই দিবস পরে তাহার প্রসব হওনের সময়ে ঈশ্বর তাহার প্রতি অতি দয়া প্রকাশ করিলেন, তদ্দ্বারা তাহার মন বিশেষরূপে নম্র হইল, ইহা সে আপনি আমাকে বলিয়াছে। সে যাহা হউক, মেম সাহেব, রাণী যদ্যপি আমার ধর্ম্ম মেয়্যা হয়, তবে আমাদের প্রিয়া করুণাকে আপনকার শিষ্য অবশ্য বলিতে হইবে। ও মেম সাহেব, শেষ দিবসে সে আপনকার পক্ষে আনন্দরূপ মুকুট হইবে; কারণ করুণার মন অতিশয় প্রেমিক, এবং সে যদি সত্য খ্রীষ্টিয়ান হয়, তবে বোধ হয় অনেকের ন্যায় খ্রীষ্টের প্রতি তাহার প্রেম কখন শীতল হইবে না।

 আমি কহিলাম, ফুলমণি, করুণার শিক্ষাতে তুমি আমাকে কিপর্য্যন্ত সাহায্য করিয়াছ, তাহা আমি কখন ভুলিব না। কিন্তু তোমার মনে এখন কেমন লয়? করুণা যে সত্য খ্রীষ্টিয়ান হইবে, এমত কি তোমার ভরসা আছে?

 ফুলমণি উত্তর করিল, মেম সাহেব, অবশ্য আছে। করুণা আমাদের প্রভুর উপর নির্ভর দিয়া অসৎকর্ম্ম ত্যাগ করিতে ও সৎকর্ম্ম করিতে চেষ্টান্বিতা আছে; এবং সে যে কৃতকার্য্য হইবে ইহার কোন সন্দেহ নাই, কারণ প্রভু আপনি কহিয়াছেন, “আমি তোমাদিগকে এক নূতন অন্তঃকরণ দিব, ও তোমাদের অন্তরে এক নূতন আত্মা স্থাপন করিব।” যিহিষ্কেল ৩৬।২৬।

 আমি কহিলাম, হাঁ ফুলমণি, সে সত্য বটে, কেননা প্রভু আপন বাক্য সফল করণার্থে তাহার মনকে দুঃখদ্বারা এখন অনেক নম্র করিয়াছেন।

 ফুলমণি বলিল, আ মেম সাহেব! এ কেমন খেদের বিষয়, যে পর্য্যন্ত আমরা দুঃখরূপ দণ্ড ভোগ না করি, সেই পর্য্যন্ত আমরা খ্রীষ্টের যোঁয়ালি বহিতে অসম্মত হই; কিন্তু দুঃখদ্বারা যদি তিনি আপনার প্রতি আমাদের মনকে আকর্ষণ করেন, তবে সেই দুঃখের নিমিত্তে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ করিতে হয়। তিনি করুণার প্রতি এমত করিয়াছেন; আর সে যদি সত্য খ্রীষ্টিয়ান হয়, তবে তাহার স্বামীও ধর্ম্মের বিষয়ে মনোযোগ করিবে, আমার এমত ভরসা আছে।

 আমি কহিলাম, হাঁ ফুলমণি, আমিও এইরূপ ভাবিয়াছিলাম; অতএব আইস, আমাদের বাঞ্ছা সফল করণার্থে আমরা দুই জনে আজি অবধি নবীনের পিতার নিমিত্তে প্রার্থনা করিতে আরম্ভ করি। তাহার সহিত আমাদের বড় একটা আলাপ নাই বটে, কিন্তু প্রভু বলিয়াছেন, পৃথিবীতে তোমাদের মধ্যে দুই জন যদি এক পরামর্শ হইয়া কিছু প্রার্থনা করে, তবে আমার স্বর্গস্থ পিতাদ্বারা তাহা তাহাদের জন্যে সম্পন্ন হইবে। এমত অঙ্গীকার পাইয়া আমরা যেন কিছু ভয় না করি, কারণ ঈশ্বরের বাক্যানুসারে আমাদের প্রার্থনা অবশ্য সফল হইবে। এই কথা বলিয়া আমি বিদায় হইলাম, এবং নিশ্চয় বলিতে পারি যে সে রাত্রিতে ফুলমণি ও আমি দয়ার সিংহাসনের নিকটে ঐ দুষ্ট ব্যক্তির পরিত্রাণ চাহিতে বিস্মৃতা হইলাম না।