ফুলমণি ও করুণার বিবরণ/নবম অধ্যায়

নবম অধ্যায়।

 পূর্ব্বোক্ত পরিবারগণের বিবরণ বাহুল্যরূপে লেখা অনাবশ্যক; কিন্তু তাহা সমাপ্ত করিবার পূর্ব্বে ফুলমণির জ্যেষ্ঠ কন্যার চরিত্রের বিষয় পাঠকদিগকে কিঞ্চিৎ জ্ঞাত করিতে আমার বড় ইচ্ছা হয়। তাঁহাদের অবশ্য স্মরণ থাকিবে যে এই ইতিহাসের আরম্ভে ঐ কন্যার বৃত্তান্ত কিছু লিখিত আছে; ভরসা করি সুন্দরীর নিষ্কপট ধর্ম্মের ও পিতামাতার প্রতি অত্যন্ত প্রেমের বিষয় পড়িয়া তাঁহারা তাহার বিষয়ে আরও কিঞ্চিৎ শুনিতে ইচ্ছুক হইবেন।

 সুন্দরীর আসিবার বিষয়ে ফুলমণির সহিত কথা হইলে পর রবিবারে আমি গীর্জাতে পাদরি সাহেবের পরিবারের সহিত এক জন নূতন মেমকে দেখিলাম, এবং দেখিয়া তৎক্ষণাৎ বোধ করিলাম, ইনি অবশ্য সুন্দরীর কর্ত্রী হইবেন। এমত হইলে আমি ফুলমণির গৃহে শীঘ্র যাইতে মনস্থ করিলাম, কেননা তাহাকে সন্তুষ্টা করিতে ও তাহার কন্যাকে দেখিতে আমার বড় ইচ্ছা ছিল।অতএব পর দিন সন্ধ্যাকালে আমি তথায় গিয়া উপস্থিতা হইলাম। ফুলমণি আমাকে গাড়ীহইতে নামিতে দেখিবা মাত্র বাহিরে আসিয়া আমার সহিত সাক্ষাৎ করিল। আমি তাহার প্রফুল্ল বদন দেখিয়া কহিলাম, ফুলমণি, কেমন? তোমার মেয়্যাকে কুশলে পাইলা?

 সে উত্তর করিল, হাঁ মেম সাহেব, ঈশ্বরের অনুগ্রহেতে পাইয়াছি বটে, এবং আমার দৃষ্টিতে বোধ হয়, তাহার শরীরের সৌন্দর্য্য ও তাহাহইতে অধিক মূল্যবান যে মনের সৌন্দর্য্য এই উভয়েতে আমার মেয়্যা পূর্ব্বাপেক্ষা বিস্তর বাড়িয়াছে।

 আমি বলিলাম, ফুলমণি, ঈশ্বর কহিয়াছেন, “হে ধার্ম্মিকগণ, তোমাদের মঙ্গল হইবে, ও তোমরা আপন২ ক্রিয়ার ফল ভোগ করিবা। আমি আপন মর্য্যাদাকারিদিগকে মর্য্যাদা করিব, কিন্তু আমার তুচ্ছকারিগণ তুচ্ছীকৃত হইবে”। তুমি আপন মেয়্যাকে প্রভুর শিক্ষা ও উপদেশ দিয়া ঈশ্বরের মর্য্যাদা করিলা, তাহাতে তিনি এখন ঐ কন্যাকে ধার্ম্মিকা ও সুশীলা করিয়া সকলের সাক্ষাতে তোমার মর্য্যাদা করিতেছেন।

 এই কথা বলিয়া আমি উঠানে প্রবেশ করিলাম। সুন্দরী দাবাতে একটা মাজুর বিছাইয়া ঘরের প্রতি মুখ ফিরাইয়া বসিয়াছিল, তাহাতে সে প্রথমে আমাকে দেখিতে পাইল না। সাধু তাহার পার্শ্বে বসিয়াছে, এবং সত্যবতী আপন ভগিনীর গালে হাত বুলাইয়া বলিতেছে, ও দিদি! তুমি পূর্ব্বে যেমন সুন্দর গল্প বলিতা, তেমন একটি গল্প এখন আমাদিগকে বল। পরে সে আমাকে টের পাইয়া শীঘ্র উঠিয়া কহিল, ওগো দিদি! সেই মেম সাহেব আসিয়াছেন।

 ইহাতে সুন্দরী উঠিয়া আমাকে সেলাম করিল। আমি তাহার সৌন্দর্য্যের বিষয়ে যাহা শুনিয়াছিলাম, তাহা যথার্থ বোধ হইল। সে অতিশয় রূপবতী ছিল বটে; বিশেষতঃ তাহার বর্ণ গৌর, এবং তাহার যেমন সুন্দর ও বড় চক্ষুঃ তেমন আমি আর কাহারো দেখি নাই। তাহার বদন লাবণ্যযুক্ত, এবং সে সুন্দররূপে গমন করিত। সুন্দরী কিছু মাত্র অসভ্য না হইয়া বড় লজ্জাবতী ছিল, কিন্তু কোন কপট লজ্জা প্রকাশ করিত না, কারণ মেম সাহেবদের সহিত আলাপ করা তাহার অভ্যাস ছিল।

 আমি তাহাকে বলিলাম, সুন্দরি, আমি তোমাকে দেখিয়া সন্তুষ্টা হইলাম; আমি অনেক দিন পর্য্যন্ত তোমার আগমনের অপেক্ষাতে আছি। বোধ হয়, আমি কে তাহা তুমি শুনিয়া থাকিবা।

 সুন্দরী উত্তর করিল, হাঁ মেম সাহেব, আমার পিতা মাতার প্রতি আপনকার সকল অনুগ্রহের বিষয় আমার ছোট ভাই ও ভগিনী আমাকে বলিয়াছে। মেম সাহেব, এই জন্যে ঈশ্বর আপনাকে আশীর্ব্বাদ করুন! ইহা বলিয়া তাহার চক্ষুঃ জলেতে পরিপূর্ণ হইল। সত্যবতী ইহা দেখিয়া অঞ্চল লইয়া তাহার ভগিনীর চক্ষুঃ শীঘ্র মুছাইয়া কহিল, না না দিদি! এখন তোমার কাঁদা উচিত নয়, কেননা এই আমাদের আনন্দের সময়। পরে ঐ কথা যেন সকলে ভুলিয়া যায়, এই অভিপ্রায়ে সে আমার প্রতি ফিরিয়া কহিল, মেম সাহেব, দিদি কলিকাতাহইতে আমাদের জন্যে যে সকল সুন্দর দ্রব্যাদি আনিয়াছে তাহা কি আপনি দেখিতে চাহেন?

 আমি উত্তর করিলাম, হাঁ, অবশ্য দেখিতে চাহি। তখন সত্যবতী শীঘ্র ঘরের ভিতরে গিয়া ঐ সকল দ্রব্য বাহির করিয়া আনিল, তাহাতে আমি দেখিলাম সুন্দরী সত্যবতীর জন্যে ইংরাজ বিবিদের মত পোষাক পরা একটি কাষ্ঠের পুত্তলিকা, আর এক যোড়া পুতি বসান চুড়ি আনিয়াছে; ও সাধুকে বিদ্যার্থি বালক জানিয়া সে তাহার নিমিত্তে পুস্তক রাখিবার সিন্দুক আর একখান খ্রীষ্টীয় মণ্ডলীর ইতিহাস পুস্তক, এবং পিতার জন্যে একটি মের্জাই আনিয়াছে। সুন্দরী আপন মনিবের তিনটি শাটিন কাপড়ের পুরাতন জামা পাইয়া তাহাতে যোড় দিয়া অতি নিপুণতা প্রকাশ করত সেই মের্জাইটিকে বড় সুন্দররূপে সিলাই করিয়াছিল।

 সত্যবতী তাহা আমাকে দেখাইয়া বলিল, মেম সাহেব, বাবা এই জামাটি পরিলে ঠিক বাবুর মত দেখায়। তাহার বড় ভগিনী কহিল, সত্যবতি, বাবা কি বাবু নয়? তাঁহাকে অবশ্য বাবু বলিতে হইবে; কেননা কলিকাতায় আমি অনেক বাবু দেখিয়াছি, কিন্তু আমাদের পিতা যেমন সেই নাম পাইবার যোগ্যপাত্র, তেমনি আর এক জনকেও দেখি নাই। আমার বোধ হয়, যিনি ধার্ম্মিক ও শিষ্টাচারী হইয়া ধনি ও দরিদ্র সকলের প্রতি দয়া করেন, এমত ব্যক্তিকেই প্রকৃত বাবু বলা যায়। তোমরা বল দেখি, আমাদের পিতা এই প্রকার বাবু আছেন কি না? সাধু ও সত্যবতী উভয়ে উত্তর করিল, হাঁ অবশ্য২, আমাদের পিতা যেমন ভাল, তেমন আর কোন মানুষকে দেখি না।

 উক্ত কথোপকথনের সময়ে ফুলমণি কিছু বলিল না বটে, কিন্তু আপন সন্তানদের ঐ সকল বাক্য শুনিয়া সে অতিশয় সন্তুষ্টা হইয়াছে, ইহা আমি তাহার প্রফুল্ল বদনের প্রতি দৃষ্টি করিয়া টের পাইলাম। পরে তাহার মেয়্যা তাহার নিমিত্তে যে বিলাতীয় শাড়ি আনিয়াছিল, তাহা সে আমাকে দেখাইয়া বলিল, মেম সাহেব, আমার সুন্দরী যে বাবার কর্ম্ম করে, তাহার জন্ম দিন হইলে মেম তাহাকে তিনটি টাকা পারিতোষিক দিয়াছিলেন, সে ঐ টাকা লইয়া আমার নিমিত্তে এই শাড়িখানি কিনিয়া আনিয়াছে; এমন উত্তম শাড়ি এ স্থানে পাওয়া যায় না।

 অতঃপর সত্যবতী কহিল, আর দেখুন মেম সাহেব! দিদি আমাদের ছোট প্রিয়নাথকে কখন দেখে নাই, তথাপি তাহার জন্যে সে দুইটি ছিটের কোর্ত্তা ও একটি গরম টুপি সিলাই করিয়া আনিয়াছে, এবং সেই কোর্ত্তা ও টুপি তাহার গায়ে ঠিক হইয়াছে। আমি ঐ সকল বস্ত্রাদি দেখিয়া বড় প্রশংসা করিলাম, কেননা সকলই সুন্দর ছিল বটে; কিন্তু তদ্দ্বারা সুন্দরীর মনের যে ভাব (অর্থাৎ পিতা মাতার প্রতি তাহার অত্যন্ত প্রেম) প্রকাশ হইল, সে সকল অপেক্ষা উত্তম; কেননা দ্রব্য গুলিন ক্ষয়ণীয়, কিন্তু সুন্দরী যে অভিপ্রায়ে তাহা প্রস্তুত করিয়াছিল সেই অভিপ্রায় ঈশ্বরের সিংহাসনের নিকটে ঊর্দ্ধ্বে গমন করিয়া সুগন্ধি নৈবেদ্য ও বলিরূপে তৎকর্ত্তৃক অবশ্য গৃহীত হইল।

পরে আমি সুন্দরীর সহিত কথোপকথন আরম্ভ করিতে চাহিয়া বলিলাম, সুন্দরি, বোধ হয় এই মের্জাই সিলাই করিতে তোমাকে অনেক দিন লাগিয়া থাকিবে; কারণ দেখিতেছি যে তাহাতে আস্তর দেওয়া গিয়াছে, এবং ঐ সকল শাটিনের মগ্‌জি ঠিক রাখিতে অবশ্য বড় ক্লেশ পাইয়া থাকিবা।

 সুন্দরী উত্তর করিল,মেম সাহেব, তাহা সিলাই করিতে অনেক দিন লাগিয়াছিল বটে, কারণ রাত্রিতে বাবারা শয়ন না করিলে আমার অবকাশ হইত না; বোধ হয় প্রায় দেড় মাস হইয়া থাকিবে। কিন্তু তাহা সিলাই করিতে যে ক্লেশ পাইলাম, এমত বলিতে পারি না। সিলাই করিবার সময়ে আমি কেবল ঘরের কথা মনে করিয়া বলিতাম, আমার পিতা যে দিবসে এই মের্জাইটি গায়ে দিবেন, সে আমার পক্ষে কেমন আমোদের দিবস হইবে! ইহা মনে করিয়া আমার কিছু ক্লেশ বোধ হইত না। যাহা হউক, কল্য যখন আমার পিতা গীর্জায় যাইবার সময়ে ঐ মের্জাই পরিয়া আমার মস্তকে হাত দিয়া কহিলেন, ঈশ্বর আমার প্রিয়া কন্যাকে আশীর্ব্বাদ করুন! তখন আমি তাবৎ পরিশ্রমের প্রচুর ফল প্রাপ্তা হইলাম।

এই কথা শুনিয়া আমি মনে২ ভাবিলাম, আহা সুন্দরি! তোমার মত আর অনেক মেয়্যা যদি আমাদের মণ্ডলীগণের অলঙ্কারস্বরূপ হইয়া এই দুষ্ট জাতিদের মধ্যে ঈশ্বরের সেবা করিত, তবে কেমন আনন্দের বিষয় হইত।

 পরে আমি সুন্দরীকে জিজ্ঞাসিলাম, তুমি কি একাকিনী রাত্রে বসিয়া সিলাই করিতা? সুন্দরী কহিল, হাঁ মেম সাহেব, প্রথমে আমার সঙ্গে এক মুসলমানী আয়া থাকিত, কিন্তু প্রায় আট মাস হইল সে বাবাদের সাক্ষাতে অনেক অপবিত্র কথা কহাতে আমার মেম তাহাকে ছাড়াইয়া দিয়াছেন।

 আমি কহিলাম, সুন্দরি, ভাল মনে পড়িল; আমি এই বিষয় তোমাকে জিজ্ঞাসা করিতে চাহি, অন্য চাকরদের সহিত তোমার কেমন ঐক্য আছে? তাহারা সকলে হিন্দু ও মুসলমান না কি?

 সুন্দরী কহিল, হাঁ মেম সাহেব, কেবল এক জন বৃদ্ধ মালী খ্রীষ্টিয়ান আছে; সেই ব্যক্তি ও তাহার স্ত্রী বড় ভাল লোক, এবং তাহারা আমার প্রতি অতিশয় দয়া প্রকাশ করিত। আমি যখন প্রথমে ঐ গৃহে গেলাম, তখন সকল চাকরেরা বড় অসন্তুষ্ট হইল; কেননা তাহারা বোধ করিল, যখন এক জন খ্রীষ্টিয়ান আসিয়াছে, তখন আরো অনেকে আসিয়া আমাদের উপায়ের স্থান নষ্ট করিতে পারিবে। কিন্তু এখন তাহারা ঐ সকল মনে করে না, তাহাতে তাহাদের সহিত আমার ভালরূপে মেল হইয়াছে। আমি যত দুঃখ পাইলাম তাহা প্রথমেই পাইলাম। এক জন যুব খিদ্‌মৎগার আমাকে ভ্রষ্টা করিতে অনেক চেষ্টা করিয়াছিল, তাহাতে আমি তাহার কথা আর সহ্য করিতে না পারিয়া মেম সাহেবকে জ্ঞাত করিলাম। তখন সাহেব অন্য সকল দাসদের সাক্ষাতে তাহাকে বিস্তর ধম্‌কাইয়া ও লজ্জা দিয়া ছাড়াইয়া দিলেন। সেই দিন অবধি সকলে ভয় পাইয়া আমাকে আর একটিও মন্দ কথা কখন কহে নাই; কিন্তু আমি অন্য প্রকারে দুই তিন বার বড় পরীক্ষিতা হইয়াছি।

 এক জন সরদার বেহারা ছিল, সে ব্যক্তি বড় চোর, মেম সাহেবকে অতিশয় ঠকাইত। ছুরি কাঁচি পয়সা অঙ্গুরী, এই সকল ছোট দ্রব্য কোন স্থানে ফেলিয়া রাখিলে তখনি অদৃশ্য হইত। ঐ সরদারের প্রতি সন্দেহ হইত বটে, কিন্তু কেহ তাহাকে ধরিতে পারিত না। পরে এক দিবস সে তিন মোন নারিকেল তৈল বাজারহইতে আনিল; তাহাতে মেম সাহেব আমাকে কহিলেন, সুন্দরি, আজি তুমি গুদামে গিয়া ঐ তৈল ওজন করিয়া লও, কেননা অল্প দিন হইল সরদার আর তিন মোন তৈল আনিয়াছিল, তাহা যে ইহারি মধ্যে ফুরাইয়া গেল, ইহাতে আমার বড় সন্দেহ হইতেছে। সরদার এই কথা শুনিয়া বড় অসন্তুষ্ট হইল, এবং আমি গুদামে গেলে সে বলিল, তৈল ওজন করিতে অনেক ক্ষণ লাগিবে, ইহা ঠিক তিন মোন আছে, তাহাতে তোমার কেবল বৃথা পরিশ্রম হইবে; তুমি যদি ওজন না করিয়াও মেম সাহেবকে বল, আমি তৈল ওজন করিয়া ঠিক পাইলাম, তবে আমি তোমাকে মিঠাই খাইবার জন্যে আট আনা পয়সা দিব। কিন্তু আমি এই কর্ম্ম করিতে স্বীকার করিলাম না; কেননা আমি ভাবিলাম, ইহাতে ঈশ্বরের আজ্ঞা লঙ্ঘন হইবে, এবং এই দেবপূজক বেহারার সাক্ষাতে খ্রীষ্টীয় ধর্ম্ম অপমানিত হইবে। আরও আমি সুন্দররূপে জানিতাম, যে ঐ আট আনা লইলে তদ্দ্বারা আমার সন্তোষ কখন জন্মিবে না, কেবল দুঃখই জন্মিবে; এমত বুঝিয়া আমি তৈল ওজন করিয়া দেখিলাম, যে তিন মোনের মধ্যে অর্দ্ধ মোন কম আছে। তৈলের দর তখন দশ টাকা মোন, অতএব সরদার একেবারে পাঁচ টাকা চুরি করিয়াছে। আমি মেম সাহেবকে এই কথা বলাতে সরদার ওজর করিয়া বলিল, আমি সুন্দরীকে অর্দ্ধেক দস্তুরি দিতে চাহিলাম না, এই জন্যে সে আমার প্রতি মিথ্যা অপবাদ দিতেছে। মেম সাহেব যে পুনর্ব্বার আপন সাক্ষাতে তৈল ওজন করাইবেন, সরদার এমত মনে করিল না; ফলতঃ মেম সর্ব্বদা ন্যায় বিচার করেন, বিনা প্রমাণে কাহাকেও দোষি জ্ঞান করেন না, কিন্তু একবার প্রমাণ পাইলে তিনি দোষি ব্যক্তির প্রতি যথার্থ শাসন করেন। তাহাতে মেম সাহেব আপনি তৈল ওজন করিয়া দেখিলেন যে অর্দ্ধমোন কম আছে, তখনি ঐ দুষ্ট সরদার বেহারা জবাব পাইল।

 ইহার পর কেবল এক জন বৃদ্ধা আয়ার কথা বাকী আছে। মেম সাহেব তাহাকে বড় ভাল বাসিতেন, কারণ সে অনেক দিনের চাকর, এবং বাবাদিগকে অতিশয় প্রেম করিত। কিন্তু তাহার এই একটি দোষ ছিল, মেম সাহেব বাহিরে গেলে সে বাবাদিগকে বাঙ্গালা মিঠাই আনিয়া খাওয়াইত। মেম সাহেব তাহাকে এমত কর্ম্ম করিতে অনেকবার বারণ করিয়াছিলেন, কিন্তু সে কিছু না মানিয়া গোপনে মিঠাই আনিয়া দিয়া বাবালোককে কহিত, তোমরা এ কথা মামাকে বলিও না। এই রূপে বাবারা ক্রমে২ প্রবঞ্চনা শিখিতে লাগিল, এবং আমার নিকটে গোপনে মিঠাই না পাওয়াতে তাহারা আমাকে কিছু ভাল বাসিত না। বুড়ি আয়ার বিষয়ে আমার কি করা কর্ত্তব্য, তাহা আমি মনে স্থির করিতে পারিলাম না, তাহাতে ঈশ্বর যেন গন্তব্য পথে চালান্ আমি তাঁহার নিকটে এই প্রার্থনা বার২ করিতাম। আয়ার প্রবঞ্চনার বিষয় আমি মেমকে জ্ঞাত করিতে অনিচ্ছুক ছিলাম, কেননা আয়া আমাকে বড় ভাল বাসিয়া অনেক কর্ম্ম শিখাইয়াছিল; কিন্তু শেষে মেম সাহেব আপনি তাহার কুক্রিয়ার উদ্দেশ পাইলেন। যে দিনে দুর্গা প্রতিমা গঙ্গায় ভাসান যায়, সে দিনে তিনি বাবাদিগকে ঘরে রাখিয়া বাহিরে গেলেন। আয়া বুড়ি আমাকে বলিল, চল, বাবালোককে লইয়া আমরা তামাসা দেখিতে যাই। আমি এই কথাতে চমৎকৃতা হইয়া উত্তর করিলাম, ও আয়া দিদি! মেম সাহেব যদি এই কথা শুনেন, তবে তিনি কেমন রাগান্বিতা হইবেন। আয়া কহিল, তুমি যদি তাঁহাকে না বল, তবে তিনি কাহারো মুখে শুনিতে পাইবেন না; আর আপত্তি করিও না, চল, আমরা যাই। আমি কহিলাম, না আয়া, এমত হইবে না; তুমি যদি যাইতে চাহ তবে বাবাদিগকে আমার নিকটে রাখিয়া আপনি যাও। তখন আয়া কহিল, সুন্দরি, তুমি যদি না যাও, তবে তুমি আমার নামে বলিয়া দিবা। আমি কহিলাম, না আয়া, বাবারা গেলে আমার বলা উচিত হইত বটে; কিন্তু তাহারা যদি আমার নিকটে থাকে, তবে আমার বলিবার কোন প্রয়োজন নাই; এই কথাতে আয়া চলিয়া গেল। আমরা বোধ করিয়াছিলাম যে ছোট মেরি বাবা আমাদের কথা সকল বুঝিবে না। কিন্তু সে এই মাত্র বুঝিয়াছিল, আয়া আমাকে দুর্গা বলিয়া কোন সুন্দর বস্তু দেখাইতে চাহিয়াছিল, কিন্তু সুন্দরী তাহা আমাকে দেখাইতে দিল না; এই হেতু সে বড় কাঁদিয়া উচ্চৈঃস্বরে আয়াকে ডাকিতে লাগিল। এমন সময়ে মেম সাহেব ফিরিয়া আইলেন, তাহাতে মেরি বাবা তাঁহার নিকটে গিয়া কান্দিতে২ বলিল, মামা! সুন্দরী বড় দুষ্টা, বুড়ি আয়া বড় ভাল মানুষ, সে আমাকে সুন্দর দুর্গা দেখাইতে চাহিল, কিন্তু সুন্দরী বলিল, না না, যাইও না; আমি সুন্দরীকে কিছু প্রেম করি না। ইহা শুনিয়া মেম সাহেব আমার প্রতি ফিরিয়া জিজ্ঞাসিলেন, সুন্দরি, এই কথার ভাব কি? আমি কহিলাম, মেম সাহেব, এ বিষয়ে আমি কিছু বলিতে পারিব না, কেননা আমি একটা প্রতিজ্ঞা করিয়াছি। কিন্তু সেখানে দরওয়ান্ দাঁড়াইয়াছিল, আয়ার সহিত সে আমার সকল কথা শুনিয়া মেম সাহেবকে সন্তুষ্টা করিবার জন্যে তাবৎ বৃত্তান্ত জানাইল। ইহা শুনিয়া মেম সাহেব পর দিবস আয়াকে ছাড়াইয়া দিলেন বটে; কিন্তু সে পুরাতন চাকর, এই হেতু তিনি তাহার জন্যে একটি ঘর বাঁধিলেন, ও মাসে২ তাহাকে দুই টাকা করিয়া দেন। যখনি বুড়ি সেই টাকা লইতে আইসে, তখন বাবাদিগকে দেখিয়া যায়, এবং আমার সহিত এখনও তাহার বড় সদ্ভাব আছে। নূতন আয়া কিছু দিন ভাল ব্যবহার করিয়াছিল, কিন্তু শেষে আমি শুনিতে পাইলাম, সে মেরি বাবাকে মন্দ গল্প বলিয়া তাহার মনকে অপবিত্র করিতেছে; অতএব আমি মেমকে বলিলাম, ইহা অপেক্ষা আমার একাকি কর্ম্ম করা ভাল, তাহাতে আয়া বিদায় পাইল। সেই সময় অবধি ঐ ঘরে থাকিতে আমার মন কিঞ্চিৎ উদাস হয় বটে, কিন্তু মেম সাহেব অনুগ্রহ করিয়া বলিয়াছেন, যে আমি ফিরিয়া যাইবার সময়ে তোমার সঙ্গিনী হইবার জন্যে এক জন খ্রীষ্টিয়ান মেয়্যাকে লইয়া যাইব।

 অতঃপর সুন্দরী আরও কহিল, মেম সাহেব, এ দেশীয় লোকেরা কন্যাদিগকে বাটীর বাহিরে যাইতে দেয় না। তাহারা বলে, মেয়্যারা সর্ব্বদা পরদার ভিতরে তালা চাবি দিয়া থাকিবে; কিন্তু মনের যে তালা চাবি, তাহার মত ভাল তালা চাবি কোন স্থানে পাওয়া যাইবে না। আমরা মনকে যদি খ্রীষ্টের হস্তে সমর্পণ করিয়া তাঁহার সজ্জাতে সজ্জীভূতা হই, তবে শয়তান আমাদিগকে কখন আক্রমণ করিতে পারিবে না।

 আমি কহিলাম, সুন্দরি, একথা যথার্থ বটে। আমি বোধ করি যদ্যপি খ্রীষ্টিয়ান স্ত্রীলোকেরা অন্য খ্রীষ্টিয়ান স্ত্রী ও পুরুষদের সহিত আরও আলাপ করিত, তবে তাহাদের বিস্তর উপকার হইতে পারিত। বিবেচনা করিয়া দেখ, এখন পুরুষেরা যত সতী ও অসতী স্ত্রী সকলকেই বদ্ধ করিয়া রাখে, তাহাতে সতী স্ত্রীরা অবশ্য মনে নৈরাশ হইয়া বলিতে পারে, আমাদের সতী হইবার ফল কি? আমাদের স্বামী তো আমাদিগকে বিশ্বাস করে না, অতএব আমাদের যাহা ইচ্ছা হইবে তাহাই করিব। কিন্তু যদ্যপি স্বামী আপন স্ত্রীকে সতী জানিয়া তাহাকে নিঃসন্দেহে স্থানে২ যাইবার অনুমতি দিত, তবে সে অবশ্য মনে আহ্লাদিতা হইয়া আপন স্বামিকে আরও সন্তুষ্ট করিতে চেষ্টান্বিতা হইত। আরও বলি, পুরুষদের সহিত আলাপ করাতে তাহাদের কথোপকথনদ্বারা স্ত্রীরা কিছু বুদ্ধিমতী হইতে পারিত। ঈশ্বর যখন আদমের নিমিত্তে হবাকে সৃষ্টি করিতে চাহিলেন, তখন তিনি এমত বলিলেন না, আমি আদমের গৃহ কর্ম্ম চালাইবার কারণ এক জন দাসী সৃষ্টি করিব, কিম্বা তাহার পক্ষে সন্তান উৎপত্তি করিতে এক স্ত্রীকে সৃষ্টি করিব। তিনি এমন কথা না বলিয়া ইহা কহিলেন, আমি আদমের নিমিত্তে এক জন উপযুক্ত সহকারিণীকে নির্ম্মাণ করিব। এখন বিবেচনা করিয়া দেখ, স্ত্রী কিছু জ্ঞানিনী না হইলে এবং জগতের বিষয় কিছু না জানিলে কেমন করিয়া স্বামির উপযুক্ত সহকারিণী হইতে পারে? পাঁচ প্রকার ভাল লোকদের সহিত আলাপ করাতে অবশ্য জ্ঞান উৎপন্ন হয়, অতএব স্ত্রীরা যাহাতে জ্ঞানবতী হয়, স্বামিদের ইহা চেষ্টা করা কর্ত্তব্য। কোন২ বাঙ্গালি থ্রীষ্টিয়ানেরা এমত নির্ব্বোধ আছে যে তাহাদের স্ত্রীরা পাছে গৃহের কর্ম্ম ত্যাগ করে এই ভয়ে তাহাদিগকে ধর্ম্মপুস্তকও পাঠ করিতে দিতে চাহে না; কিন্তু এমত লোকদিগকে মানুষ না বলিয়া বরং পশু বলিতে হয়। তাহারা আপনারা স্বর্গে যাইতে অপেক্ষা করে, কিন্তু পাছে তাহাদের গৃহের কর্ম্মেতে কিছু ব্যাঘাত হয়, এই হেতু তাহারা আপন স্ত্রীদিগকে ধর্ম্মের বিষয়ে শিক্ষা না দিয়া নরকে যাইতে দেয়। আমি ভরসা করি যে খ্রীষ্টিয়ান মণ্ডলীগণের মধ্যে এমত ব্যক্তিদের সংখ্যা দিনে২ হ্রাস হইতেছে।

 পরে আমি ফুলমণির প্রতি ফিরিয়া জিজ্ঞাসিলাম, ফুলমণি, তুমি এ বিষয়ে কিছু বল না কেন? তোমার বিবেচনাতে আমার কথা কি ভাল বোধ হয় না?

 ফুলমণি উত্তর করিল, মেম সাহেব, ভাল বোধ হইবে না কেন? কেবল এই একটা কথা বলিতে হয়, কোন বাঙ্গালি স্ত্রী যদি একেবারে ইংরাজ বিবির মত ব্যবহার করে, তবে অন্য লোকেরা তাহাকে কখন সতী স্ত্রী জ্ঞান করিবে না। মেম সাহেব, আপনি বিবেচনা করিয়া দেখুন, আপনারা সাহেবদের সহিত বেড়াইয়া থাকেন ও একাকিনী বসিয়া তাহাদের সহিত কথোপকথন করিতে পারেন; কিন্তু বাঙ্গালি স্ত্রী যদি এমত করিত, তবে সে কি আপনার দৃষ্টিতে ভাল বোধ হইত?

 আমি কহিলাম, না ফুলমণি, বাঙ্গালি স্ত্রীলোকেরা যে একেবারে ইংরাজ বিবির ন্যায় হয় আমার তো এমত বাঞ্ছা নাই; কেননা তাহারা পুরুষদের সহিত হিতজনক আলাপ করিতে চাহিলে এক প্রকার লজ্জার আবশ্যক আছে, কিন্তু সেই লজ্জা ঘোম্‌টাদ্বারা নয়, বরং মনের শুদ্ধতাদ্বারা প্রকাশ পায়। যে স্ত্রীর এমত লজ্জা থাকে, সে কখন কোন পুরুষের সাক্ষাতে অপবিত্র বাক্য ও মন্দ কৌতুকের কথা কহিবে না; এবং যদ্দ্বারা ঐ পুরুষের মন তাহাতে আসক্ত হইতে পারে, সে এমত ক্রিয়া কখন করিবে না। এই প্রকারে স্ত্রীলোকেরা পুরুষদের সহিত স্বচ্ছন্দে আলাপ করিয়া নির্দোষী থাকিতে পারে। কিন্তু যদ্যপি বাঙ্গালি মেয়্যারা ঘোম্‌টাদি দিয়া অন্তঃপুরে থাকে, তথাপি যত লজ্জা ইংরাজ বিবিদের মধ্যে পাওয়া যায়, তত অন্তঃপুরের মেয়্যাদের মধ্যে পাওয়া যাইবে না। বাঙ্গালি স্ত্রীলোকেরা অন্য পুরুষদের সাক্ষাতে অনায়াসে গর্ভ হওয়া ইত্যাদি বিষয় বলিতে পারে; কিন্তু ইংরাজদের মধ্যে যদি স্বামী ছাড়া পুরুষের নিকটে স্ত্রীলোক এমত বাক্য মুখে লয়, তবে সকলে তাহাকে বড় অসভ্য বলিয়া তুচ্ছজ্ঞান করে। এই সকল বিষয়ে খ্রীষ্টিয়ান স্ত্রীলোকেরা হিন্দুদের অপেক্ষা অনেক ভাল হইয়াছে বটে, তথাপি তাহাদের কিছু ত্রুটি আছে; এবং যত দিন ঐ ত্রুটি থাকে, তত দিন পর্য্যন্ত পুরুষদের সহিত তাহাদের বড় আলাপ করা আবশ্যক নাই। ক্রমে২ তাহারা যখন ইংরাজদের বিদ্যাদি শিক্ষা করিবে, তখন তাহারাও আমাদের মত হইয়া উঠিবে; কিন্তু বোধ হয়, ইহা সম্পূর্ণ রূপে সাধন করিতে আর এক শত বৎসর লাগিবে। এখন আমার বাঞ্ছা এই যেন খ্রীষ্টিয়ান স্ত্রীগণ লোক দেখান মিথ্যা লজ্জা সকল ত্যাগ করিয়া সৎক্রিয়া করে।

 এখন আমি যাহা বলিতেছি, তাহা স্বচক্ষে দেখিয়াছিলাম। এক জন খ্রীষ্টিয়ান শিক্ষক আপন যুবতি স্ত্রীকে ঘরে রাখিয়া কোন কর্ম্মের নিমিত্তে বাহিরে গিয়াছিল, এমত সময়ে তাহার বন্ধু ইহা না জানিয়া তাহাকে দেখিবার কারণ শিক্ষকের ঘরে গেল। সেই স্ত্রী আপন স্বামির বন্ধুকে ব্যাঘ্রের মত দেখিয়া শীঘ্র আপন অন্তঃপুরে দৌড়িয়া গিয়া দ্বার বন্ধ করিল; তাহাতে ঐ বন্ধু লজ্জিত হইয়া ধীরে২ আপন গৃহে ফিরিয়া গেল। পরে স্বামী ঘরে আইলে ঐ স্ত্রী আপন সতীত্বের বিষয় তাহাকে জানাইয়া আপনাকে বড় সাধু বোধ করিল; এবং তাহার স্বামী বন্ধুর সহিত বিবাদ করিয়া তাহাকে আপন ঘরে আসিতে নিষেধ করিল। ফুলমণি, এমত হাস্যজনক লজ্জা ভাল কি মন্দ, তাহা তুমিই বুঝ। তুমি কহিতেছ, বাঙ্গালি স্ত্রীগণ যদি ইংরাজ বিবিদের ন্যায় ব্যবহার করে, তবে লোকেরা তাহাদিগকে তুচ্ছজ্ঞান করিবে। কোন ইংরাজ বিবির ঘরে যদি আপন স্বামির বন্ধু যান, তবে তিনি তাহার সহিত অতিশয় সমাদর পূর্ব্বক কথোপকথন করেন, এবং যাহাতে ঐ সময় তাহার পক্ষে আমোদে যাপন হয়, এমত চেষ্টা করেন; আর কথা সাঙ্গ হইলে কি জানি সে বিবি এক দণ্ড বসিয়া বাদ্য করেন, কিম্বা যদি সাহেবের পড়িবার ইচ্ছা হয়, তবে তাহার হস্তে একখান পুস্তক দিয়া আপনি শিল্পকর্মের দ্রব্যাদি আনিয়া তথায় বসিয়া সিলাই করেন। বাঙ্গালি স্ত্রীর এমত করিবার প্রয়োজন নাই বটে, তথাপি তাহার গৃহে যদি কোন পুরুষ আইসে, তবে সে শিষ্টরূপে তাহাকে এই কথা বলুক, এখন কর্ত্তা ঘরে নাই, অতএব আপনি যদি অন্য সময়ে আসিতে পারেন, তবে ভাল হয়। কিন্তু সে ব্যক্তি পথ শ্রান্ত প্রযুক্ত তাহার ঘরে যদি বিশ্রাম করিতে চাহে, তবে সে দাবাতে তাহার জন্যে একখান আসন রাখুক, পরে তাহাকে তামাক ও জলাদি দিয়া আপন অন্তঃপুরে যাউক। এই প্রকার ব্যবহার না করিলে খ্রীষ্টীয় ধর্ম্ম প্রায় পালন করা যায় না, কেননা ঈশ্বর কহেন, “সুযোগ পাইলে সকল লোকের বিশেষতঃ বিশ্বাসকারি পরিবারের মঙ্গল কর।” গলাতীয় ৬।১০। কিন্তু এ দেশীয় লোকেরা আপন২ স্ত্রীদিগকে বদ্ধ করিলে তাহারা এমত সুযোগ পায় না; অতএব বঙ্গদেশীয় লোক আপন২ ব্যবহারেতে ঈশ্বরের আজ্ঞা লঙ্ঘন করে।

 আরও বলি, এদেশীয় খ্রীষ্টিয়ানেরা ইংরাজ বিবিদের রীতিকে নিন্দা করে, করুক; কিন্তু যে ধার্ম্মিকা স্ত্রীলোকদিগকে ঈশ্বর আপনি প্রশংসা করিয়াছেন, তাহারা কি তাহাদিগকেও নিন্দা করিবে? শিমূয়েলের মাতা হন্নাকে স্মরণ কর; সে আপন পরিবারের সহিত ঈশ্বরের মন্দিরে যাত্রা করিত, এবং তৎকালের লোকেরা পদব্রজেই গমনাদি করিত, অতএব হন্না অন্তঃপুরে বদ্ধ থাকিত না, তথাপি সে ঈশ্বরের কেমন প্রিয়পাত্র ছিল। আরও যীশুর মাতা মরিয়ম যিনি সকল স্ত্রীলোকদের মধ্যে ধন্যা, তিনি বিবাহের অগ্রে এবং পশ্চাতে স্থানে২ বেড়াইতেন, এবং যীশুর শিষ্যদের সহিত তাঁহার বন্ধুতা ছিল। ইলিয়াসর মরিলে পর যিহদীয়েরা তাহার দুই ভগিনীকে সান্ত্বনা দিতে গেল, এবং তাহারা ঐ যিহদীয়দিগকে আপন বাটীতে গ্রহণ করিল। আক্বিলা ও তাহার স্ত্রী প্রিস্কিল্লা একজন যুব উপদেশককে আপন বাটীতে আনিয়া বিশেষরূপে ঈশ্বরের পথ তাহাকে বুঝাইয়া দিল। আর পৌল রোমীয় খ্রীষ্টিয়ানদের প্রতি লেখেন, “কিংক্রিয়া নগরীয় মণ্ডলীর সেবিকা ফৈবী নাম্নী আমাদের ধর্ম্মভগিনীর বিষয়ে তোমাদের নিকটে এই উপরোধ করিতেছি, সে তোমাদের নিকটে উপস্থিত হইলে তোমরা তাহাকে প্রভুর আশ্রিতা জ্ঞান করিয়া ভক্ত লোকদের বিহিত মতে অতিথি করিবা, এবং তাহার প্রয়োজনানুসারে তোমাদেরহইতে যে উপকার হইতে পারে তাহা করিবা; কেননা তাহাহইতে অনেকের বিশেষতঃ আমার উপকার হইয়াছে।” তদ্রূপে মরিয়মের এবং অন্যান্য কত স্ত্রীলোকের প্রশংসাও লিখিয়াছেন। রোমীয় ১৬।১, ২। আরও লেখা আছে যে পিতর কারাগারহইতে রক্ষা পাইয়া মার্কের মাতা মরিয়মের বাটীতে চলিয়া গেল; এবং তথায় অনেকে একত্র হইয়া প্রার্থনা করিতেছিল। প্রেরিতদের ক্রিয়া ১২।১২। এখন বুঝিয়া দেখ, এই সকল ধার্ম্মিকা স্ত্রীলোকেরা যদি অন্তঃপুরের বিবি হইতেন, তবে উক্ত তাবৎ ধর্ম্ম কর্ম্ম তাঁহারা কখন সাধন করিতে পারিতেন না। অতএব ঈশ্বর যাহার প্রশংসা করিয়াছেন তাহা মনুষ্যেরা নিন্দা না করুক।

 শ্বশুর ও ভাসুরদের প্রতি যে অত্যন্ত লজ্জা করা, ইহাও বাঙ্গালি স্ত্রীদের একটি বড় মন্দ রীতি আছে; কেননা কোন স্ত্রী পুরুষকে বিবাহ করিলে স্বামির পিতা তাহার পিতা হয়, এবং স্বামির ভ্রাতা তাহার ভ্রাতা হয়। কিন্তু সে যদি তাহাদের সহিত কোন কথা না কহিয়া মুখ আচ্ছাদন দিয়া বেড়ায়, তবে পিতার ও ভ্রাতার প্রতি যেরূপ প্রেম করা কর্ত্তব্য, ইহা কি তাহাদের প্রতি জন্মিতে পারিবে? কখন না। আমি এবিষয়ে ভালরূপে বিবেচনা করিয়া দেখিয়াছি, স্ত্রীলোকদের মধ্যে অনেকের কপট লজ্জা আছে, কেননা তাহার স্বামির ঘরে এক প্রকার ও পিতা মাতার ঘরে অন্য প্রকার ব্যবহার করে। একবার আমি কোন যুবতী খ্রীষ্টিয়ান স্ত্রীর বাটীতে গিয়া তাহার শ্বশুরের ও স্বামির এক জন বন্ধুর প্রতি অত্যন্ত লজ্জা দেখিয়া বড় দুঃখিতা হইলাম; কিন্তু সে স্ত্রী অল্প দিন পরে আপন মাতার ঘরে আইলে আমি স্বচক্ষে দেখিলাম, সে মাথার কাপড় খুলিয়া এক জন হিন্দু পুরুষের নিকটে দাঁড়াইয়া তাহার সহিত অনেক ক্ষণ পর্য্যন্ত হাস্য করত কথা কহিতেছিল। আর ফুলমণি, ইহাতে জানা যায়, স্ত্রীলোকদিগকে তালা চাবি দিয়া রাখিবার কোন ফল নাই, কেননা তদ্দ্বারা তাহাদের মন শুচি থাকে না, এবং তাহাদের মনকে রক্ষা করিতে না পারিলে তাহাতে কি লাভ? এদেশীয় স্ত্রীদের অন্তঃপুরে যে প্রকার অপবিত্র কৌতুকাদি হয়, ও যে প্রকার গালাগালি করে, সেই সকল ইংরাজ বিবিরা কখন মুখেতেও আনেন না। আমি এক মেমকে চিনি, যিনি বঙ্গদেশীয় ভাষাতে অতিনিপুণা ও বাঙ্গালিদের গালাগালির অর্থ অনেক জানিতেন; কিন্তু তাঁহার স্বামী সে অর্থ তাঁহাকে বলিতে অনেকবার সাধ্যসাধনা করিলেও তিনি অস্বীকৃতা হইয়া বলিতেন, ক্ষমা করুন, আমি ঐ কথা মুখে আনিতে পারিব না। ফুলমণি, যাহাতে মন শুচি থাকে, বাঙ্গালি থ্রীষ্টিয়ানেরা এমত উপায় চেষ্টা করুক; সে উপায় অন্তঃপুরে পাওয়া যায় না, কিন্তু সদুপদেশ ও ধার্ম্মিক লোকদের সহিত আলাপন দ্বারা পাওয়া যাইতে পারে। আইস, আমরা প্রেরিতের আদেশানুসারে ব্যবহার করি, তাহাতে কখন ভ্রান্তিতে পতিতা হইব না। তিনি বলিতেছেন, “হে নারীগণ, তোমরা কেশবেশ ও স্বর্ণ মুক্তাদি অভরণ ও বহুমূল্য পরিছদদ্বারা আপনাদিগকে ভূষিতা না করিয়া লজ্জা ও সতর্কতা পূর্ব্বক উপযুক্ত বস্ত্র পরিধান করিয়া ঈশ্বরসেবিকা স্ত্রীগণের ন্যায় সৎক্রিয়ারূপ ভূষণে ভূষিতা হইও।” ১ তীমথিয়ের ২।৯।

 ফুলমণি কহিল, মেম সাহেব, আমি যেন সেই আজ্ঞামতে চলিতে পারি এমত চেষ্টা আছে, এবং সুন্দরীকেও সেইরূপ শিক্ষা দিয়াছি।

 তাহাতে আমি কহিলাম, ও আমার প্রিয়া বন্ধু, তুমি যে ইহা করিয়াছ তাহা আমি সুন্দর রূপে জ্ঞাতা আছি। আর আমি যে২ শক্ত কথা কহিয়াছি তাহা তোমারই প্রতি কহিলাম, এমত অনুমান করিও না; কেননা তুমি যে লৌকিক রীত্যনুসারে না চলিয়া ঈশ্বরের আজ্ঞা পালন করিতেছ, তাহা সুন্দরীর কলিকাতায় যাওয়াতেই সপ্রমাণ হইয়াছে। বিশেষতঃ সে ঈশ্বরের সজ্জাতে সুসজ্জীভূতা হইয়া শয়তানের নানাবিধ খলতা নিবারণ করিতে সক্ষম হইবে, ইহা তোমরা দৃঢ় বিশ্বাস করিয়া আপনাদিগকে ঋণহইতে উদ্ধার করিবার জন্যে তাহাকে দূরে পাঠাইয়া দিয়াছিলা। দেখ, ঈশ্বর তোমার আশা ভঙ্গ করেন নাই, কেননা তোমার মেয়্যা যাওয়াতে তাহার কোন ক্ষতি হয় নাই, বরং হিতমাত্র জন্মিয়াছে।

 ফুলমণি প্রফুল্ল বদনে কহিল, হাঁ মেম সাহেব, ঈশ্বর অনুগ্রহ করিয়া আমাদের হস্তকৃত কর্ম্ম সফল করিয়াছেন বটে।

 সেই দিবস আমি সুন্দরীর সহিত আলাপকরত ফুলমণির গৃহে অতি আমোদে আরও অনেক কাল যাপন করিতাম, কিন্তু উক্ত সকল কথা সাঙ্গ হইলে পর দেখিলাম, আমার আগমনেতে যে গল্পের ব্যাঘাত হইয়াছিল, সেই গল্প সুন্দরীর নিকটে শুনিতে সত্যবর্তী বড় ব্যস্তা আছে, এই হেতু আমি তখন বিদায় হইলাম।