ফুলমণি ও করুণার বিবরণ/দশম অধ্যায়
দশম অধ্যায়।
সুন্দরীর সহিত প্রথমবার সাক্ষাৎ হইলে পর আমি অনেক বার তাহার দেখা পাইতাম। কখন আমি তাহার গৃহে যাইতাম, কখন বা সে আমার বাটীতে আসিয়া আমার আয়াকে মোজা বুনিতে শিক্ষা দিত। এমত সময়ে তাহার সহিত আমার বিস্তর কথা হওয়াতে ধর্ম্মের বিষয়ে তাহার জ্ঞান ও বুদ্ধি দেখিয়া আমি বড় চমৎকৃতা হইলাম, তাহাতে যখন তাহার কলিকাতায় যাইবার সময় সন্নিকট হইল, তখন আমি অতিশয় দুঃখিতা হইলাম। ডাক্তর সাহেবের মেম সুন্দরীকে যে বেতন দিতেন, আমি তাহার দ্বিগুণ বেতন দিয়া তাহাকে আপনার নিকটে রাখিতে বড় সন্তুষ্টা হইতাম, কিন্তু তাহার পুরাতন কর্ত্রীর প্রতি এমত অন্যায় করিতে পারিলাম না; এবং বোধ হয় সুন্দরীও তাঁহাকে কখন ছাড়িত না, কেননা তাহার মনে অকৃতজ্ঞতার লেশমাত্র ছিল না। সুন্দরীর কর্ত্রী বড় জ্ঞানী ও ধার্ম্মিকা বিবি ছিলেন, এবং ঐ নগরে আমার ইংরাজ বন্ধু অল্প থাকাতে তিনি যত দিন আমাদের নিকটে বাস করিলেন, তত দিন আমি অনেকবার পাদরি সাহেবের গৃহে গিয়া তাঁহার সহিত আলাপ করিতাম।
এক দিবস আমি এই রূপে তাঁহাদের গৃহে যাওয়াতে পাদরি সাহেব আমাকে দেখিবামাত্র কহিলেন, বিবি সাহেব, আপনকার সুখশালা[১] নিবাসি বন্ধুরা কিছু দুঃখিত আছে, তাহাদের কন্যা সুন্দরী তাহাদিগকে বড় লেটায় ফেলিয়াছে।
আমি সাহেবের হাস্যমুখ দেখিয়া জানিলাম, যে ফুলমণির পরিবারের কোন ভারি দুর্ঘটনা হয় নাই; তথাপি আমি চমৎকৃতা হইয়া বলিলাম, মহাশয়, সুন্দরী যে আপন পিতা মাতাকে ঝঞ্ঝাটে ফেলিয়াছে, ইহা নিতান্ত অসম্ভব কথা।
সাহেব উত্তর করিলেন, ও! তাহার বিবাহের বিষয়ে একটি গোল উপস্থিত হইয়াছে। আমাদের যুবতি কন্যাগণ যেরূপ কথন২ বোধ করে, আমরা বিবাহের বিষয় পিতা মাতা অপেক্ষা ভাল জানি, সুন্দরীও সেইরূপ বুঝিয়া প্রেমচাঁদ ও ফুলমণি তাহার নিমিত্তে যে বরকে মনোনীত করিয়াছে, তাঁহাকে সে কোনরূপে বিবাহ করিতে চাহে না। কিন্তু এই সকল বৃত্তান্ত প্রথম অবধি আপনাকে না বলিলে আপনি কিছু বুঝিতে পারিবেন না, অতএব শুনুন। গত বুধবারে এক জন সুশ্রী যুব বাবু বিবাহার্থে কন্যা অন্বেষণ করিতে কলিকাতাহইতে এই স্থানে আসিয়াছিলেন। তিনি আপন পাদরি সাহেবের নিকটহইতে একখান অনুরোধ পত্র আনিয়াছিলেন, তাহাতে লেখা আছে, এই যুব পুরুষ পূর্ব্বে ব্রাহ্মণ ছিলেন, কিন্তু তিন বৎসর হইল তিনি খ্রীষ্ট ধর্ম্ম গ্রহণ করিয়া আছেন, সে অবধি বড় সদ্ব্যবহার পূর্ব্বক চলিতেছেন। তিনি ইংরাজি স্কুলের প্রধান শিক্ষক, এবং মাসে২ পঁচিশ টাকা বেতন পান। এই অনুরোধ পত্র পড়িয়া আমি আপন ভগিনীর প্রতি ফিরিয়া বলিলাম, ও লুসি! এই ব্যক্তি বুঝি সুন্দরীর যোগ্যপাত্র হইবে, তুমি কি তাহাকে ছাড়িয়া দিতে সম্মতা হও? তিনি বলিলেন, যাহাতে সুন্দরীর মঙ্গল হইবে আমি তাহা করিতে অবশ্য সম্মতা আছি। ইহা শুনিয়া আমি প্রেমচাঁদ ও ফুলমণিকে ডাকাইয়া ঐ যুব পুরুষ যে অনুরোধ পত্র আনিয়াছিল, তাহার অর্থ তাহাদিগকে জানাইলাম। পরে তিনি আসিলে তাহারা অনেক ক্ষণ পর্য্যন্ত তাঁহার সহিত বিশেষ রূপে ধর্ম্মের বিষয়ে কথোপকথন করিয়া দেখিল, তিনি প্রভুর সত্য শিষ্য বটে, তথাপি প্রেমচাঁদ আমাকে বলিল, পাদরি সাহেব তাঁহার ধর্ম্মের বিষয়ে পত্রেতে কি লিখিয়াছেন, তাহা অনুগ্রহ করিয়া পুনর্ব্বার পড়ুন। তখন আমি সেই পত্রে পড়িলাম,যথা; ‘আমি দৃঢ় বিশ্বাস করিতেছি যে এই যুব পুরুষ নিতান্ত যীশু খ্রীষ্টের একজন মনোনীত পাত্র; ইহার একটি প্রত্যক্ষ প্রমাণ আছে, অর্থাৎ তিনি পরের পরিত্রাণের বিষয়ে অতিশয় চেষ্টান্বিত হন।’ প্রেমচাঁদ ও ফুলমণি ইহা শুনিয়া বড় আহ্লাদিত হইল, কারণ তাহারা অনেক দিন অবধি সুন্দরীর নিমিত্তে এক জন ধার্ম্মিক এবং উপযুক্ত বর অন্বেষণ করিতেছে। পরে আমার পরামর্শানুসারে তাহারা ঐ বাবুকে কল্য তাহাদের গৃহে সুন্দরীকে দেখাইবার কারণ ভোজনের নিমন্ত্রণ করিল। তাহাতে কল্য সন্ধ্যার সময়ে তিনি অত্যুত্তম পরিচ্ছদ পরিধান করিয়া এখানহইতে প্রেমচাঁদের বাটীতে গমন করিলেন। যাইবার পূর্ব্বে আমি তাঁহাকে সুন্দরীর ধার্ম্মিক চরিত্রের বিষয় জ্ঞাত করিলাম। তিনি কি কারণে প্রেমচাঁদের ঘরে যাইবেন, তাহা ফুলমণি আপন মেয়্যাকে না জানাইয়া কেবল এই কথা কহিল, যে বাবু কলিকাতাহইতে আসিয়া পাদরি সাহেবের গৃহে রহিয়াছেন, আমরা তাহাকে অদ্য নিমন্ত্রণ করিয়াছি। বাবু সেখানে উপস্থিত হইয়া সুন্দরীর সৌন্দর্য্য দেখিবামাত্র তাহাতে অতিশয় আসক্ত হইয়া ফুলমণিকে কহিলেন, আমি গেলে পর এবিষয়ে তোমার মেয়্যার কি ইচ্ছা হয়, তাহা তুমি জিজ্ঞাসা করিও; সে যদি আমাকে বিবাহ করিতে সম্মতা হয়, তবে আমি সন্তুষ্ট হইয়া এই কর্ম্ম করিব। কিন্তু অদ্য প্রাতঃকালে সুন্দরীর পিতা মাতা তাহাকে সেই কথা জানাইলে সে একেবারে ঐ বাবুকে বিবাহ করিতে অস্বীকার করিয়া আর কোন কারণ না দিয়া কেবল ইহাই কহিল; আমি তাঁহাকে চিনি না, এবং তিনিও আমার মনকে জানেন না, অতএব বিবাহ করিলে পশ্চাতে আমাদের সুখ কি দুঃখ হইবে তাহা নিশ্চয় নাই। ফুলমণি এমত কথা বুঝিতে না পারিয়া বলে, আমি তো বিবাহের পূর্ব্বে সুন্দরীর পিতাকে চিনিতাম না, তবে আমার কেন এত সুখ হইয়াছে? সকলে যাহাকে ধার্ম্মিক বলে এমত স্বামিকে পাইলে হয়, তাহাকে চিনিবার কোন আবশ্যক নাই।
তখন আমি পাদরি সাহেবকে কহিলাম, বোধ হয়, এ বার আমাদের বন্ধু ফুলমণি বড় ভালরূপে বিবেচনা করে নাই; আপনি কি বুঝেন, মহাশয়?
পাদরি সাহেব বলিলেন, মেম সাহেব, ইংরাজদের মধ্যে ধর্ম্মভিন্ন স্ত্রী ও স্বামিতে আর অনেক গুণ অন্বেষণ করা যায় বটে। যে স্ত্রীপুরুষের মনের রুচি ও স্বভাব ও বাঞ্ছা এবং রীতি সকল এক হয়, সেই স্ত্রী পুরুষ অবশ্য অন্যদের অপেক্ষা সুখে কাল যাপন করিয়া থাকে, এবং বিবাহ করিতে গেলে এমত ঐক্যতা আমাদের অন্বেষণ করা উচিত বটে। কিন্তু বিবেচনা করিয়া দেখুন, বাঙ্গালি মেয়্যারা ইংরাজদের মত বিবাহের পূর্ব্বে পুরুষদের সহিত আলাপ করিতে পায় না, এবং আলাপ না করিলে তাহাদের মনের ভাব কেমন তাহা তাহারা কি প্রকারে জ্ঞাত হইতে পারিবে? এই জন্যে বলি, যে পর্য্যন্ত বাঙ্গালি মেয়্যারা আপনাদের স্বামিকে আপনারা মনোনীত করিতে না পারে, সেই পর্য্যন্ত তাহারা বিবাহের বিষয়ে স্ব২ পিতা মাতাদের ও মণ্ডলীর অধ্যক্ষগণের পরামর্শানুসারে চলুক।
আমি বলিলাম, হাঁ মহাশয়, একথা সত্য হইতে পারে বটে, তথাপি আমি স্বীকার করিতেছি, যে এই দেশীয় মেয়্যারা যখন বিবাহের বিষয়ে কিঞ্চিৎ স্বাধীনতা প্রকাশ করিতে আরম্ভ করিবে, তখন আমি বড় আহ্লাদিতা হইব; কিন্তু সে যাহা হউক, উক্ত বিষয় কিছু স্থির হইয়াছে কি না?
পাদরি সাহেব উত্তর করিলেন, মেম সাহেব, সন্ধ্যাকালে ফুলমণি আপন মেয়্যাকে লইয়া এখানে আসিবে, তখন বোধ হয় এবিষয় কিছু স্থির করিতে পারিব। ফুলমণির অভিলাষ এই যে আমি সুন্দরীকে বুঝাইয়া কোনরূপে সম্মত করাই; কিন্তু আমি তাহা কখন করিব না, কেননা বিবাহের কথাবার্ত্তাতে হাত দেওয়া বড় কঠিন বিষয়। যাহা হউক, সুন্দরী কি জন্যে এই ব্যক্তিতে সম্মত হয় না, তাহা আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিব; বোধ হয় তাহার মনে কোন বিশেষ কারণ থাকিবে।
পরে এই বিষয়ে কি হইবে, তাহা শুনিতে অতিশয় ইচ্ছুক হইয়া আমি ফুলমণির অপেক্ষায় পাদরি সাহেবের বাটীতে রহিলাম।
প্রায় এক ঘণ্টা গত হইলে ফুলমণি সুন্দরীকে লইয়া আইল। অন্য বিষয়ের কিছু কথাবার্ত্তা হইলে পর সাহেব সুন্দরীকে কহিলেন, দেখ সুন্দরি, তুমি এই বাবুকে বিবাহ করিতে অসম্মতা হইয়া আপন মাতাকে বলিয়াছ, যে আমি তাঁহাকে চিনি না। ভাল, তুমি কিছু দিন তাঁহার সহিত আলাপ করিয়া পরে এবিষয়ে যথার্থ উত্তর দিও। কিন্তু ইহা যদি করিতে না চাহ, তবে তুমি কি নিমিত্তে তাঁহাকে বিবাহ করিবা না, তাহা সত্য করিয়া আমাকে বল।
বাবুর সহিত যে আলাপ হয়, সুন্দরীর এমত ইচ্ছা ছিল না; বরং সে মাথা হেট করিয়া কহিল, মহাশয়! আপনি যদি এমত স্পষ্টরূপে জিজ্ঞাসা করেন, তবে আমাকে বলিতে হইল। এ ব্যক্তিকে যে বিবাহ করিতে চাহি না, আমার মনে ইহার একটি বিশেষ কারণ আছে বটে; কিন্তু তাহা প্রকাশ করিলে আমি স্বদেশীয় লোকদের নিকটে অবশ্য নিন্দিতা হইব, তথাচ আমি নিশ্চয় জানি যে এবিষয়েতে আমার কোন দোষ নাই।
এই কথা শুনিয়া ফুলমণি কহিল, সুন্দরি, তোমার মনে যাহা আছে তাহা নির্ভয়ে বল। তুমি যদি ঈশ্বরের ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কোন কর্ম্ম না করিয়া থাক, তবে তোমার পিতা মাতা তোমাকে কখন দোষ দিবে না; অন্য লোকেরা যাহা বলে বলুক, তাহাতে তোমার কিছু আইসে যায় না।
আমি কহিলাম, সুন্দরি, একথা সত্য, তোমার পিতা মাতার নিকটে কোন কথা গোপন রাখা বিহিত নয়; অতএব তুমি এ ব্যক্তিকে কেন বিবাহ করিতে চাহ না, ইহার কারণ স্পষ্ট করিয়া বল।
সুন্দরী অধোদৃষ্টি করিয়া কহিল, তাহার কারণ এই, আমি অন্য এক জনকে প্রেম করিতেছি। আমার মেম তাঁহাকে চিনেন, সে যুবা তাঁহার বৃদ্ধ মালির পুত্ত্র।
ডাক্তর সাহেবের বিবি একথা শুনিয়া কহিলেন, আহা! আমি কতবার মনে করিয়াছি যে চন্দ্রকান্ত সুন্দরীর উপযুক্ত স্বামী হইত বটে, কিন্তু ডাক্তর কহিতেন আর দুই তিন বৎসর পর্য্যন্ত চন্দ্রকান্তকে শিক্ষা করিতে হইবে, তাহার পর সে কোন লাভজনক পদে নিযুক্ত হইতে পারিবে। ইহা শুনিয়া আমি ভাবিতাম, সুন্দরীর বয়ঃক্রম এখন প্রায় পোনের বৎসর হইয়াছে, অতএব তাহার পিতা মাতা তাহাকে বিবাহ না দিয়া আর দুই তিন বৎসর কখন রাখিবে না।
আমি জিজ্ঞাসিলাম, মেম সাহেব, এই চন্দ্রকান্ত কি প্রকার লোক? বিবি উত্তর করিলেন, সে আমাদের মালির পুত্ত্র বটে, ও তাহার সহিত থাকিয়া প্রথমতঃ বাগানের কর্ম্ম শিখিত, কিন্তু এখন সে আপন পিতা অপেক্ষা বড় জ্ঞানী হইয়া উঠিয়াছে। বৎসর তিনেক হইল, আমার স্বামী ছবিযুক্ত একখান ইংরাজী পুষ্প বৃতান্ত পুস্তক বৃদ্ধ মালিকে দিয়া কহিয়াছিলেন, শুন মালি, যে সকল বিলাতীয় ফুল এদেশে জন্মিতে পারে তাহা আমি আপন বাগানে আনিয়া রাখিতে ইচ্ছা করি। অতএব তুমি এই সকল ফুলের ছবি ভাল করিয়া দেখ; পরে ইহার মধ্যে যত ফুল এদেশীয় ফুলের সমান হয়, তাহা আমাকে বলিও। চন্দ্রকান্ত সর্ব্বদা নানা প্রকার বৃক্ষের নামাদি ও বিশেষ২ গুণ তত্ত্ব করিত, তাহাতে ঐ পুস্তক পাইয়া সে ঘরে বসিয়া পুষ্পের ছবি সকল আপনা আপনি তুলিতে লাগিল, পরে সাহেবের কাছে আনিয়া দেখাইল। সাহেব তাহা দেখিয়া আশ্চর্য্য জ্ঞান করিলেন, কারণ ঐ বালক নক্সা তুলিতে কখন কিছু শিক্ষা পায় নাই, আর সে কেবল নীল ও আলতা দিয়া ঐ সকল ছবি লিখিয়াছিল, তথাপি সে দেখিতে মন্দ হয় নাই। ইহাতে সাহেব সন্তুষ্ট হইয়া চন্দ্রকান্তকে উদ্ভিদ্বিদ্যা শিক্ষা করাইতে মনস্থ করিলেন। চন্দ্রকান্ত স্বভাবতঃ অতি গুণশীল ব্যক্তি। সে প্রথমে সপ্তাহের মধ্যে দুইবার আমার স্বামির নিকটে গিয়া উদ্ভিদ্বিদ্যা এবং নক্সার বিদ্যা শিক্ষা করিত; পরে ডাক্তর সাহেবদের গৃহে যে প্রকার ছবি থাকে, (অর্থাৎ মানুষের অস্থি ও কলিজা ইত্যাদির ছবি) তাহা দেখিয়া চন্দ্রকান্ত আপনা আপনি সেইরূপ ছবি তুলিতে লাগিল, এবং মনুষ্যের শরীরের মধ্যে কি২ আছে, তাহাও শিক্ষা করিত। সাহেব তাহার এই প্রকার অনুশীলন দেখিয়া তাহাকে ডাক্তরের কর্ম্ম শিখাইতে আরম্ভ করিলেন, তাহাতে সে ঐ বিদ্যাতে এমত নিপুণ হইয়া উঠিয়াছে, যে সাহেব অনুমান করেন দুই তিন বৎসরের মধ্যে সে কোম্পানির কোন ডাক্তর খানায় প্রধান চিকিৎসক হইয়া মাসে২ দেড়শত টাকা উপার্জ্জন করিতে পারিবে। চন্দ্রকান্ত বিদ্যাতে নিপুণ তাহা কেবল নয়, ধর্ম্মের বিষয়েও তাহার বড় অনুরাগ আছে, এবং সে আপন বৃদ্ধ পিতা মাতার প্রতি অতিশয় প্রেম ও ভক্তি করে।
পরে বিবি সুন্দরীর প্রতি ফিরিয়া বলিলেন, সে যাহা হউক, সুন্দরি, চন্দ্রকান্তের সদ্গুণের বিষয় তুমি কি প্রকারে জ্ঞাত হইলা, ইহা আমি বুঝিতে পারিলাম না; কারণ আমি তোমার সাক্ষাতে তাহার প্রশংসা কখন করি নাই, এবং তাহার সহিত কথোপকথন করিতে তোমাকে নিষেধ করিয়াছি। অতএব তাহার প্রতি তোমার প্রেম কি প্রকারে জন্মিল, তাহা তুমি বল।
সুন্দরী কহিল, মেম সাহেব, আমি তাঁহার সহিত কথোপকথন কখন করি নাই, কিন্তু তাঁহার মাতা আমাকে অনেকবার বলিয়াছে, যে আমার পুত্ত্র তোমা বিনা আর কাহাকেও বিবাহ করিবে না; এবং তাহার এই ইচ্ছা ছিল, যেন আমি প্রতিজ্ঞা করি, তিন বৎসর পরে চন্দ্রকান্তকে বিবাহ করিব। কিন্তু আমি কহিলাম, পিতা মাতাকে জিজ্ঞাসা না করিলে কোন প্রতিজ্ঞা করিব না। আমি কলিকাতায় ফিরিয়া যাওনের অগ্রে মাকে এই কথা বলিতে মানস করিয়াছিলাম, কিন্তু এত দিন ভয় প্রযুক্ত বলিতে পারি নাই, পাছে তিনি বলেন, তোমার বিবাহ দিতে আমরা এত বিলম্ব করিব না।
পাদরি সাহেব ইহা শুনিয়া কহিলেন, তবে সুন্দরি, তোমার নিজ কথাদ্বারা জানা যাইতেছে যে তুমি এই বাবু অপেক্ষা চন্দ্রকান্তকে ভালরূপে চিন না।
সুন্দরী কহিল, না মহাশয়, এমত নয়। আমি চন্দ্রকান্তকে প্রত্যহ দেখি, ও তাঁহার পিতা মাতার প্রতি তাঁহার প্রেমিক ব্যবহার জানি; এবং ধর্ম্মের বিষয়ে তাঁহার যেরূপ অনুরাগ আছে, তাহাও আমি জ্ঞাতা আছি, কারণ তিনি প্রতিদিবস সন্ধ্যাকালে তেঁতুল গাছতলায় বসিয়া হিন্দু ও মুসলমান দাসদিগকে যীশু খ্রীষ্টের বিষয় বলিয়া সদুপদেশ দিয়া থাকেন। তিনি কেবল এক বার আমাকে একটি কথা মাত্র বলিয়াছিলেন। যে দিবস মেম সাহেবের ছোট বাবা মরিল, সেই দিবস আমি কবর সিন্দুকের নিকটে দাঁড়াইয়া কাঁদিতেছিলাম, এমত সময়ে চন্দ্রকান্ত ভিতরে আসিয়া এক পার্শ্বে দাঁড়াইয়া মৃদুরবে কহিলেন, সুন্দরি, তুমি কাঁদিও না; ঈশ্বর তোমার ছোট কোমল চারাকে আপন উদ্যানে তুলিয়া লইয়াছেন, যেন সেথায় সে বৃদ্ধি পাইয়া ফুলেতে ও ফলেতে পরিপূর্ণ হয়। আমাদের বাটীর উত্তরে যে বড় বাগান আছে, তাহাতে সাহেব যদি কোন অত্যুত্তম কিম্বা কোমল ফুলগাছ দেখেন, তবে তিনি আমার পিতাকে বলেন, মালি, এই চারাটি আমার দক্ষিণদিক্স্থ ছোট বাগানে রাখিতে হইবে, তাহাতে আমি আপনি তাহার তত্ত্বাবধারণ করিয়া তাহার সৌরভে আমোদিত হইব। সেই রূপে ঈশ্বর আমাদের ছোট মিসিবাবাকে লইয়া ইহা অপেক্ষা ভাল স্থানে রাখিয়াছেন।
এই কথা শুনিয়া ডাক্তর সাহেবের মেম কহিলেন,আহা! এ কেমন সুন্দর দৃষ্টান্ত! ইহা কহিয়া তাঁহার চক্ষুঃ জলেতে পূর্ণ হইল, কারণ তিনি ইহার আট মাস পূর্ব্বে সেই প্রিয় সন্ততিকে কবরে রাখিয়াছিলেন, তখন ইহা তাঁহার মনে পড়িল।
সুন্দরী কহিল, হাঁ মেম সাহেব, ঐ দৃষ্টান্ত অতি সুন্দর বটে। আমি সেই দিন অবধি চন্দ্রকান্তকে পূর্ব্বাপেক্ষা ভাল বোধ করিলাম; আর ঐ কথা শুনিবা মাত্র আমার প্রিয় মাতাকে স্মরণ হইল, কারণ তিনি সর্ব্বদা আপন ফুলগাছের সহিত পারমার্থিক বিষয়ের তুলনা দিয়া থাকেন।
তখন পাদরি সাহেব জিজ্ঞাসিলেন, ফুলমণি, তুমি এবিষয় শুনিলা, এখন কি বল?
ফুলমণি উত্তর করিল, মহাশয়, আমার মেয়্যা যদি দুই তিন বৎসর পর্য্যন্ত এমত ধার্ম্মিক স্বামির অপেক্ষাতে থাকে, তবে তাহাতে আমি সম্মতা আছি; কিন্তু তখন সুন্দরীর আঠারো বৎসর বয়স হইবে, অতএব চন্দ্রকান্তের সহিত তাহার বিবাহের বিষয় সকল যদি স্থির করিয়া রাখা যায়, তবে কিছু বিলম্ব হইলে ক্ষতি নাই।
ডাক্তর সাহেবের বিবি কহিলেন, দেখ ফুলমণি, তোমার মেয়্যা আপনি বলিতেছে যে চন্দ্রকান্ত তাহাকে বিবাহ করিতে চাহে; এমত যদি হয়, তবে আমি তোমার সাক্ষাতে বলিয়া যাইতেছি, আমি ঘরে পৌঁছিবা মাত্র চন্দ্রকান্ত ও তাহার পিতা মাতার সহিত এ বিষয় স্থির করিব; এবং ঐ যুব পুরুষের বিষয় আমি সাহসপূর্ব্বক বলিতে পারি, সে যদি বাঁচিয়া থাকে, তবে যাহা অঙ্গীকার করিবে তাহা সাধ্য পর্য্যন্ত সিদ্ধ করিবে।
তখন সুন্দরী প্রফুল্ল বদন হইয়া ফুলমণিকে কহিল, দেখ মা, এবিষয়েও বিবেচনা করিও, যুবতী স্ত্রীলোকেরা আপন শ্বশুর শাশুড়ী কর্ত্তৃক অনেকবার বিরক্তা হয়, কারণ তাহারা বধূর প্রতি প্রায় ক্রূর ব্যবহার করিয়া থাকে, কিন্তু চন্দ্রকান্তের পিতা মাতা ধার্ম্মিক লোক, এবং যে অবধি আমি কলিকাতায় গিয়াছিলাম, সেই অবধি তাঁহারা আমার প্রতি অতিশয় প্রেমিক ব্যবহার করিয়াছেন, অতএব তাঁহারা পশ্চাতে যে আমাকে দুঃখ দিবেন, এমত কখন বোধ হয় না। ও মা! কলিকাতার বাবু অপেক্ষা চন্দ্রকান্তকে বিবাহ্ করা ভাল, ইহার আর একটি কারণ দেখাইতে পারি; ঐ বাবু কেবল আমার মুখ দেখিয়া আমাকে বিবাহ করিতে চাহেন, কিন্তু ইহা করা বিহিত নয়, কারণ এ এক প্রকার স্ত্রীর নিমিত্তে গুলিবাঁট করা হইল। গুলিতে ভাল কি মন্দ স্ত্রী উঠিবে তাহা তো জানা যায় না, অতএব কন্যাদের মনের গুণ সকল তত্ত্ব করিয়া পরে তাহাদিগকে বিবাহ করিলে ভাল হয়। দেখ, মালির পুত্ত্র এমত করিয়াছে; এক বৎসর পর্য্যন্ত প্রত্যহ তিনি আমার ব্যবহার দেখিয়া আমাকে বিবাহ করিতে ইচ্ছা করিয়াছেন। এখন আমি ভাল হই কি মন্দ হই তাহা যদি জানিয়া বিবাহ করেন, তবে পশ্চাতে তাঁহার আশা ভঙ্গ হইবে না।
এই কথা শুনিয়া আমরা সকলে কহিলাম, সুন্দরি, তুমি এ বিষয় উত্তমরূপে বিবেচনা করিয়াছ। পরে ফুলমণি আপন মেয়্যাকে সঙ্গে করিয়া বিদায় লইল।
তাহারা প্রস্থান করিলে পর আমি পাদরি সাহেবকে জিজ্ঞাসা করিলাম, মহাশয়, আপনি কি সুন্দরীকে দোষ দিতে পারেন? তিনি বলিলেন, না, তাহাকে দোষ দেওয়া যায় না, কারণ সে অকপট রূপে সাধু ব্যবহার করিয়াছে। বঙ্গদেশস্থ সকল খ্রীষ্টিয়ান মেয়্যারা যদি সুন্দরীর ন্যায় হইত, তবে তাহারা প্রায় ইংরাজদের মত বিবাহের পূর্ব্বে আপনাদের স্বামিদিগকে মনোনীত করিয়া লইতে পারিত।
ডাক্তর সাহেবের বিবি কহিলেন, আহা! আমি কেমন আহ্লাদিতা হইলাম, যে ঐ প্রিয়া কন্যা আমার নিকটে নিত্য থাকিতে পারিবে। চন্দ্রকান্তের সহিত তাহার বিবাহ হইলে পর আমি আপন বাটীর সীমার মধ্যে তাহাদের জন্যে এক খানা ঘর বাঁধাইয়া সর্ব্বদা তাহাদিগকে সেই খানে রাখিব।
পরে পাদরি সাহেব পুনর্ব্বার বলিলেন, ভাল, এখন দেখিতেছি যে সকলে আহ্লাদিত হইয়াছে, কেবল আমার যুব বন্ধুর বিষয়ে কেহ কিছু মনোযোগ করে নাই। তিনি স্ত্রী খুজিতে এত দূর আসিয়াছেন, এখন আমি কি বলিয়া তাঁহাকে রিক্ত হস্তে ফিরাইয়া দিব?
আমি কহিলাম, মহাশয়, আমি ইহার একটি উপায় দেখাইতে পারি। যদি সে বাবু বিধবা স্ত্রীকে বিবাহ করিতে সম্মত হন, তবে রাণীকে বিবাহ করুন; সুন্দরী ছাড়া তেমন মেয়্যা আর কোন স্থানে পাইবেন না।
পাদরি সাহেব ঐ কথাতে বড় সন্তুষ্ট হইয়া কহিলেন, হা মেম সাহেব, আপনি ভাল বলিয়াছেন। রাণীর বিষয় এতক্ষণ স্মরণ হয় নাই, সে বাবুর পক্ষে উত্তম স্ত্রী হইবে বটে, কারণ রাণী জ্ঞানী মেয়্যা, এবং এখন দেখিতেছি যে সে সম্পূর্ণরূপে খ্রীষ্টের লোক হইয়াছে। তাহার পূর্ব্ব স্বামির মূর্খতা ও দুষ্টতা প্রযুক্ত সে তাহার সহিত সুখে বাস করিতে পারিত না বটে; কিন্তু যদ্যপি উপযুক্ত স্বামিকে পাইত, তবে ঐ সকল গোলমাল কখন হইত না। বোধ হয়, যদি বাবু তাহাকে বিবাহ করেন, তবে তাঁহারা উভয়ে বড় সুখে কালযাপন করিবেন।
অতঃপর রাণীর বিষয় বাবুকে জ্ঞাত করা গেল, তাহাতে তিনি দুই তিন বার তাহার সহিত কথোপকথন করিয়া তাহাকে বিবাহ করিতে ইচ্ছা প্রকাশ করিলেন; এবং রাণীও তাহাতে আহ্লাদ পূর্ব্বক সম্মতা হইল, কারণ তাহার দুষ্টা শাশুড়ী তাহাকে বড় ক্লেশ দিত। বাবুর আগমনের প্রায় এক মাস পরে রাণীর সহিত তাহার বিবাহের কথা গীর্জা ঘরে তিন রবিবার পর্য্যন্ত প্রচার হইলে কেহ তাহাতে বাধা না দেওয়াতে, আগত বৃহস্পতিবারে তাহাদিগের বিবাহ দিতে স্থির করা গেল। কেবল এক বিষয়ে একটি গোল উপস্থিত হইল। রাণী আপনার ছোট মেয়্যা সুমতিকে সঙ্গে লইয়া কলিকাতায় যাইতে চাহিল, কিন্তু ঐ মেয়্যার পিতা মধু মৃত্যুকালে বলিয়া গিয়াছিল, যে আমার ছেল্যাকে এস্থানের পাদরি সাহেবের মেমের স্কুলে দিও; এবং রাণীর শাশুড়ী বড় রাগ প্রকাশ করিয়া কহিল, ঐ মেয়্যা আমার, তুমি তাহাকে কখন লইয়া যাইতে পারিবা না। রাণী ইহাতে অতিশয় দুঃখিতা হইয়া কাঁদিতে লাগিল।
তখন ফুলমণি বলিল, মধু আমাকে আপনার সন্তানের ভার দিয়া ইহা কহিল, সে যেন ধর্ম্মের বিষয় শিক্ষা পায় এই জন্যে তাহাকে পাদরি সাহেবের মেমের স্কুলে দিও; ইহাতে স্পষ্ট বোধ হয় যে মধুর কেবল এই বাঞ্ছা ছিল, যেন আমার ছেল্যা ধার্ম্মিক হয়। অতএব সুমতি কাহার নিকটে থাকে কিম্বা কোন্ স্কুলে যায়, ইহা অতিক্ষুদ্র বিষয়, মেয়্যাটি ধার্ম্মিক হইলে হয়। আমি বোধ করি, ইহাই সাধন করণার্থে তাহাকে আপন মাতার কাছে রাখিলে ভাল হয়, কেননা যে সময়ে মধু মরিল, সে সময়ে রাণী ধর্ম্মের বিষয়ে বড় একটা মনোযোগ করিত না; কিন্তু এখন সে ধর্ম্মকে অতিশয় প্রিয়জ্ঞান করে, অতএব সে আপন মেয়্যাকে সুপথে লওয়াইতে অবশ্য চেষ্টা করিবে।
ফুলমণির এই কথাতে আমরা সকলে সম্মত হইলে ইহা স্থির হইল যে ছোট সুমতি আপন মায়ের সহিত কলিকাতায় যাইবে। রাণীর শাশুড়ী ইহাতে বড় রাগান্বিতা হইল, কিন্তু তাহার সান্ত্বনার্থে রাণী আপন পূর্ব্ব স্বামির ঘর জমী ইত্যাদি যাহা ছিল, সকলি তাহাকে দিয়া কহিল, ওগো! যত দিন তুমি বাঁচিয়া থাক তত দিন তুমি জমী আদির খাজনা ভোগ করিও; এবং যখন মরিবা তখন তোমার নাতনীকে সকলি দিয়া যাইও; আমি ঐ ধনের লেশ মাত্র স্পর্শ করিব না। রাণীর এই সুশীল ব্যবহার প্রযুক্ত তাহার শাশুড়ীর যাবজ্জীবন কোন দ্রব্যের অভাব ছিল না।
পাঠকবর্গেরা অনেক্ষণ পর্য্যন্ত আমার আয়ার বিষয়ে কিছু কথা শ্রবণ করেন নাই, কিন্তু এখন লিখিতে হইল, আয়া অনেক কাল ধার্ম্মিক আচরণ করিয়া সম্প্রতি বাপ্টাইজ[২] হইতে অতিশয় ইচ্ছুক হইল। তাহাতে পাদরি সাহেব স্থির করিলেন, যে দিবসে রাণীর বিবাহ দেওয়া যাইবে, সেই দিবসে আয়া বাপ্টাইজিতা হইবে।
আহা! ঐ দিবস আমার পক্ষে কেমন আনন্দের দিন হইল; কেবল আমার পক্ষে হইল তাহা নয়, বরং সমুদয় খ্রীষ্টিয়ান পাড়ার লোক সকল সেই দিনে উল্লাসিত হইল।
রাণীর পিতা মাতা না থাকাতে আমি তাহার জন্যে বিবাহের ভোজ প্রস্তুত করিতে চাহিয়া পাদরি সাহেবকে জিজ্ঞাসিলাম, মহাশয়, আপনার মণ্ডলীর লোকেরা যদি সেই দিবসে কিঞ্চিৎ উৎসব করে, তবে আপনি কি তাহাতে অসন্তুষ্ট হইবেন? তিনি কহিলেন, না, আমি অসন্তুষ্ট হইব কেন? আমাদের প্রভু আপনি বিবাহের ভোজে উপস্থিত হইয়া তাহা সম্ভ্রান্ত করিলেন। অতএব আপনি আমার লোকদের জন্যে যদি ভোজ প্রস্তুত করেন, তবে ভাল; আমিও তাহাদের আমোদ দেখিয়া আমোদিত হইব। কিন্তু যাহারা অতিশয় দরিদ্র কিম্বা যাহারা ঋণে বদ্ধ আছে, এমত ব্যক্তিরা যদি বিবাহের সময়ে অন্যের টাকা লইয়া উৎসব করে, কিম্বা স্ত্রীর নিমিত্তে গহনা ক্রয় করে, তবে আমি তাহাদের ব্যবহারে অসন্তুষ্ট হই বটে।
এই কথা শুনিয়া আমি প্রেমচাঁদকে টাকা দিয়া তাবৎ আবশ্যক দ্রব্যসামগ্রী ক্রয় করিতে বলিলাম। পরে বিবাহের দিন উপস্থিত হইলে পাড়ার মধ্যে কোন পরিষ্কার স্থানে একটি বৃহৎ লাল ও শাদা কাপড়ের চন্দ্রাতপ টাঙ্গান গেল, এবং ভূমিতে বিছাইবার জন্যে আমি কএকটি শপ পাঠাইয়া দিলাম। ফুলমণির সন্তানেরা ছোট নবীনকে সঙ্গে করিয়া সুদৃশ্য ফুল ও পাতার হার গাঁথিয়া ঐ চন্দ্রাতপের চতুষ্পার্শ্বে টাঙ্গাইয়া দিল। নবীনের বিষয়ে এস্থানে বলিতে হয়, যদ্যপি সে লেখা পড়াতে বড় নিপুণ ছিলনা, তথাপি ক্রমে২ অত্যুত্তম বালক হইয়া খানসামার কর্ম্ম উত্তম রূপে শিখিয়াছিল। ফুলমণি এবং আর চারি জন স্ত্রীলোক বিবাহে না গিয়া ভোর অবধি ঐ ভোজ প্রস্তুত করিতে লাগিল। এগার ঘণ্টা হইলে আমি আয়াকে আপন গাড়ীতে লইয়া রাণীকে গীর্জায় লইবার নিমিত্তে খ্রীষ্টিয়ান পাড়াতে গেলাম। রাণী অতি সুন্দর গোলাপি রঙ্গের একখানা রেসমের শাড়ি পরিয়া প্রস্তুতা হইয়া আমার অপেক্ষায় ফুলমণির ঘরে বসিয়া ছিল; তাহাতে আমার গাড়ী দেখিবামাত্র সে প্রফুল্ল বদন হইয়া বাহিরে আইল। রাণী যদ্যপি সুন্দরীর সমান রূপবতী ছিলনা, তথাপি সে দিবসে যাহারা তাহাকে দেখিল, সকলে অতি সুরূপা বলিয়া সর্ব্ব প্রকারে তাহার প্রশংসা করিল। আমার বিশ্বস্থা আয়া প্রায় তাবৎ পথ কাঁদিতে২ গেল; কিন্তু ঐ অশ্রুপাত দুঃখপ্রযুক্ত নয়, কেবল ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞতাদ্বারা হইল। সে একবার আপনা আপনি উচ্চৈঃস্বরে বলিল, হে পরমেশ্বর! দীনহীন পাপিষ্ঠা যে আমি, আমার প্রতি তুমি কেমন দয়া প্রকাশ করিয়াছ; এবং যাইতে২ সে আর দুই তিন বার কহিল, হে পিতঃ, তোমার ধন্যবাদ করি!
পরে আমরা গীর্জায় উপস্থিত হইয়া দেখিলাম, পাদরি সাহেব বরকে লইয়া আমাদের অপেক্ষায় বসিয়া আছেন, অতএব তিনি প্রথমে আয়াকে বাপ্টাইজ করিয়া পরে রাণীর বিবাহ দিলেন। বিবাহ হইলে পর আমরা পুনরায় সকলে খ্রীষ্টিয়ান পাড়ায় ফিরিয়া গেলাম। বিবাহের ভোজ প্রস্তুত হইবামাত্র পাড়ার তাবৎ লোক উক্ত চন্দ্রাতপের নীচে বসিয়া ভোজন করিতে লাগিল। সকল নিমন্ত্রিত লোকদের মুখ প্রফুল্লিত ছিল, এক জনেরও বিষণ্ণ বদন দৃশ্য হইল না।
ভোজন সাঙ্গ হইলে লোকেরা বিবাহের গীত গাইল, পরে পাদরি সাহেব গাত্রোত্থান করিয়া নূতন খ্রীষ্টিয়ানীর এবং বর কন্যার অনুরোধে ঈশ্বরের স্থানে প্রার্থনা করিলেন। তখন রাণী ও তাহার স্বামী ফুলমণির বাটীতে গমন করিল। ফুলমণি রাণীর প্রতি মাতাস্বরূপ ব্যবহার করিয়াছিল, অতএব সে এখন তাহাদিগকে রাখিতে চাহিলে তাহারা কলিকাতায় যাইবার পূর্ব্বে তাহার গৃহে দুই তিন দিন থাকিতে স্থির করিল। রাণীর নিকটে বিদায় হইবার সময়ে আমি তাহাকে একাকিনী কিছু সদুপদেশ দিতে চাহিয়া তাহার সঙ্গে২ ফুলমণির গৃহে গেলাম। কুঠরীর মধ্যে আমরা উভয়ে বিস্তর অশ্রুপাত করিলাম; শেষে তাহাকে অনেক প্রেমের কথা কহিয়া আমি বাহিরে আসিয়া শীঘ্র গাড়ীতে উঠিতেছিলাম, এমন সময়ে করুণা একখানা উত্তম তসর শাড়ি পরিয়া উপস্থিত হইল।
করুণা আমাকে দেখিয়া বলিতে লাগিল, ও মেম সাহেব, একটু বিলম্ব করিয়া আমার সৌভাগ্যের কথা শুনুন! ও ফুলমণি দেখ, নবীনের বাপ আমাকে এই শাড়ি খানি কিনিয়া দিয়াছে। ইহার মূল্য চারি টাকা, কিন্তু সে টাকা তাহার ধার করিতে হয় নাই, কেননা আমার স্বামী এখন প্রত্যহ কর্ম্মে যাইয়া আট দশ টাকা মাসে উপার্জন করে। অদ্য গীর্জায় যাইবার সময়ে সে এই শাড়ি খানি বাহির করিয়া বলিল, এই লও করুণা, সকলের স্ত্রী অদ্য ভাল কাপড় পরিবে, অতএব তুমি কেন মোটা কাপড় পরিয়া যাইবা? আমার যদি শক্তি থাকিত, তবে আমি তোমাকে দশ টাকার শাড়ি আনিয়া দিতাম, কেননা তুমি তাহার যোগ্যপাত্র বটে। পরে করুণা আরো উল্লাসিতা হইয়া বলিতে লাগিল, মেম সাহেব, দশ টাকার শাড়ি আমার কি আবশ্যক? তাহার নিকটে যে এমত প্রেমিক কথা শুনিলাম, সেই আমার যথেষ্ট হইল। এবং এই শাড়ি খানি যে মন্দ তাহাও নয়; আমার বিবাহের দিবস অবধি আজি পর্য্যন্ত আমি রেসমের কাপড় কখন পরি নাই, কিন্তু অদ্য আমার এই সৌভাগ্য হইল।
এই ক্ষুদ্র ঘটনাতে প্রকাশ হইল যে করুণা মৃদু ব্যবহার ও শিষ্ট কথাদ্বারা আপন দুষ্ট স্বামিকে নিতান্ত বশীভূত করিয়াছিল। হে পাঠক বর্গেরা! তোমাদের মধ্যে কাহারও পতি যদি অশিষ্ট থাকে, তবে সে করুণার অনুকারিণী হউক।
ফুলমণি আপন বন্ধুর কথা শুনিয়া আহ্লাদপূর্ব্বক স্বর্গের প্রতি দৃষ্টি করিয়া কহিল, পরমেশ্বরের নাম ধন্য হউক, কারণ তিনিই মনুষ্যদের মনকে পরিবর্ত্ত করেন। আমি আনন্দ প্রযুক্ত কান্দিতে২ কিছুই বলিতে পারিলাম না, কিন্তু করুণার এমত কথা শুনিয়া আমার মন প্রভুর প্রতি কৃতজ্ঞতাতে পরিপূর্ণ হইল। পরে গাড়ীতে আরোহণ করিয়া আমি ঐ দিবসের সকল ঘটনার নিমিত্তে ঈশ্বরের ধন্যবাদ করিতে২ আপন বাটীতে গেলাম।
উক্ত খ্রীষ্টিয়ান পরিবারগণের সহিত আমার প্রায় আরও দুই বৎসর পর্য্যন্ত নিত্য২ আলাপ হইত, কিন্তু তাহার পর আমাকে সপরিবারে সে নগর ছাড়িয়া অন্য স্থানে যাইতে হইল। তাহাতে আমরা পৃথক হইলে পরস্পর দুঃখিত হইলাম বটে, কিন্তু সাংসারিক লোকদের মত বিলাপ করিলাম না; কেননা এই দৃঢ় ভরসা ছিল, যে আমরা পুনর্ব্বার ঈশ্বরের সিংহাসনের সম্মুখে মিলিত হইয়া অনন্তকাল পর্য্যন্ত প্রভুর উদ্দেশে স্তব স্তুতির গীত গাইব।
করুণা শেষে সত্য খ্রীষ্টিয়ান হইল, কিন্তু সে ধর্ম্মেতে কখন প্রফুল্লিতা হইতে পারিল না; কেননা তাহার জ্যেষ্ঠ পুত্ত্রের মৃত্যু অনেকবার মনে পড়িত, তাহাতে সে কখন২ ভাবিত, ঈশ্বর আমাকে গ্রাহ্য করিবেন না। এমত সময়ে সে কেবল প্রভুর বাক্য পাঠ করিয়া সান্ত্বনা পাইত। ফুলমণি আমাকে বলিয়াছে, করুণা কখন২ পাঁচ সাত ঘণ্টা পর্য্যন্ত বসিয়া ধর্ম্মপুস্তক পাঠ করিয়া থাকে। অল্প দিন হইল আমি কোন ব্যক্তির প্রমুখাৎ শুনিলাম, যে সুন্দরী আপন মনোনীত স্বামিকে বিবাহ করিয়া এক্ষণে বড় সুখে কাল যাপন করিতেছে; আর সে ব্যক্তি কহিল, যে সুন্দরীর দুই পুত্ত্র এক কন্যা হইয়াছে, এবং সে আপন মাতার মত তাহাদিগকে ঈশ্বরের বিষয় শিক্ষা দিয়া ধর্ম্মপথে লওয়াইতেছে।
এক্ষণে পাঠকবর্গের প্রতি আমার একটি নিবেদন আছে। তোমরা যে সকল লোকদের ইতিহাস পড়িয়াছ, তাহারা তোমাদেরই দেশের লোক; তোমাদের ন্যায় তাহারাও পূর্ব্বে হিন্দু ছিল, এবং তোমাদের আচার ব্যবহার ও রীতি মত তাহাদের আচার ব্যবহার ও রীতি ছিল, কিন্তু পশ্চাৎ তাহারা খ্রীষ্টীয় ধর্ম্ম গ্রহণ করিল। চেষ্টা করিলে তোমরা অনায়াসে ফুলমণির অনুগামী হইতে পার, কেননা সে কোন আশ্চর্য্য কর্ম্ম করিল না; অতএব যে কোন ব্যক্তির মন খ্রীষ্টের প্রতি নিতান্ত আসক্ত আছে, সে অবশ্য তাহার মত সদ্ব্যবহার করিতে পারিবে। এই হেতু আমি তোমাদিগকে বিনয় করিয়া বলি, ফুলমণি যেমন খ্রীষ্টের অনুকারী ছিল, তেমনি তোমরাও তাহার অনুকারী হও। সে দরিদ্রদের প্রতি কিরূপ দয়া করিত, ও অন্য লোকদের পারমার্থিক মঙ্গল কেমন চেষ্টা করিত, তাহা তোমরা বিবেচনা করিয়া তাহার পশ্চাদ্গামী হও। বিশেষতঃ, হে স্ত্রীগণ! সে যেরূপ আপন স্বামিকে প্রেম করিয়া তাহার গৃহ পরিষ্কার রাখিত, ও সকলের প্রতি সরল আচরণ করিয়া কেবল মিষ্ট বাক্য কহিত, তেমনি তোমরাও করিও। হে মাতাগণ! ফুলমণি যেরূপ আপন সন্তানদিগকে সুশিক্ষা দিয়া তাহাদের নিমিত্তে নিত্য২ প্রার্থনা করিত, ও তাহাদের সাক্ষাতে সর্ব্বদা সদ্ব্যবহার করিত, তেমনি তোমরাও করিও। আর বৃদ্ধা প্যারীর ইতিহাস বিস্মৃত হইও না। সে নিত্য২ ধর্ম্মপুস্তক পাঠ ও প্রার্থনা করিত, ইহাতে তোমরা তাহার অনুকারিণী হও। মধুর ভয়ানক মৃত্যু স্মরণ করিয়া তোমরা সাবধান ও সতর্কা হইয়া থাক, কেননা কোন্ দণ্ডে মৃত্যু আসিবে তাহা তোমরা জান না। আর করুণা যে সন্তানকে শিক্ষা দেয় নাই, তাহার মৃত দেহের উপর পড়িয়া সে যে রূপ বিলাপ করিল, তাহাও তোমাদের মনে থাকুক; এবং তোমরা যদি করুণার মত দোষী হইয়া এপর্য্যন্ত আপন সন্তানদিগকে ধর্ম্মোপদেশ না দিয়া থাক, তবে আমি বিনয় করি, তোমরা ঐ কুপথহইতে শীঘ্র ফির, এবং করুণা যেমন শেষে করিল, তেমনি তোমরাও যীশু খ্রীষ্টের চরণ ধরিয়া তাঁহার সত্য শিষ্য হও। তিনি কহেন, “হে পরিশ্রান্ত ও ভারাক্রান্ত লোক সকল! তোমরা আমার নিকটে আইস, আমি তোমাদিগকে বিশ্রাম দিব।”
উক্ত পরামর্শানুসারে যদি চল, তবে এই ক্ষুদ্র পুস্তক রচনা করণ তোমাদের পক্ষে বৃথা হইবে না, এবং রচনা কালে যে সকল প্রার্থনা পাঠকবর্গের নিমিত্তে ঈশ্বরের সিংহাসনের সম্মুখে করা গিয়াছে, তাহা সফলা হইবে। ইতি।
ফুলমণি ও করুণার বৃত্তান্ত সমাপ্ত।