ফুলমণি ও করুণার বিবরণ/প্রথম অধ্যায়

ফুলমণি ও করুণার

বিবরণ।

প্রথম অধ্যায়।

 কএক বৎসর হইল আমি বঙ্গদেশের মফঃশলে নদী তীরবর্ত্তি এক নগরে বাস করিতাম। সেই নগরের নাম এই স্থানে লিখিবার আবশ্যক নাই। তথাহইতে প্রায় অর্দ্ধ ক্রোশ দূরে এদেশীয় খ্রীষ্টিয়ান লোকদের এক গ্রাম আছে; ঐ গ্রামস্থ ভ্রাতা ও ভগিনীদের সহিত আমার যে সুখজনক আলাপ এবং ধর্ম্মের বিষয়ে কথোপকথন হইত, তাহা আমি অদ্যাবধি স্মরণে রাখিয়া স্বর্গস্থ পিতার ধন্যবাদ করিয়া থাকি; কারণ তৎকালে তাহাদের চরিত্র দেখিয়া ও কথা শুনিয়া আমার বিশ্বাসের বৃদ্ধি হইল, এবং খ্রীষ্টের শিষ্যদের কি২ করা কর্ত্তব্য এবিষয়ে আমি পূর্ব্বাপেক্ষা সুশিক্ষিত হইলাম।

 ধর্ম্মপুস্তক পাঠ করিলে আমরা দেখিতে পাই যে পরমেশ্বর প্রাচীন ধার্ম্মিক লোকদের চরিত্র বর্ণনা করণদ্বারা আপন মণ্ডলীস্থ লোকদিগকে বিশেষরপে শিক্ষা দেন, তাহাতে যেন তাহারা ঐ ধার্ম্মিক ব্যক্তিদিগকে নিদর্শন স্বরূপ জানিয়া তাহাদের ন্যায় সদাচারী হইতে চেষ্টা করে। ইহা জ্ঞাত হইয়া আমি বিবেচনা করিলাম, যদি উক্ত খ্রীষ্টিয়ানদের চরিত্রের বিষয়ে কিঞ্চিৎ২ লিখি, তবে ঈশ্বরের আশীর্ব্বাদে বঙ্গদেশস্থ ভগিনীরা তাহা পাঠ করিয়া পারমার্থিক লাভ ও সন্তোষ পাইতে পারিবে। এই অভিপ্রায়ে আমি এ ক্ষুদ্র পুস্তক রচনা করিতেছি।

 আপন পরিবারের সহিত উক্ত নগরে পৌঁছিবামাত্র আমি প্রথমে সেই স্থান নিবাসি মিশনরি পাদরি সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করিতে গেলাম। পরে অন্যান্য বিষয়ে নানা প্রকার কথা কহিয়া আমি সাহেবকে বলিলাম; মহাশয় এই নগরের মধ্যে আমি নূতন আসিয়াছি, এখানে কাহাকেও চিনি না। অনুগ্রহ করিয়া বলুন, আপনার বিবেচনাতে কোন্২ সাহেব ও বিবিরা ধার্ম্মিক বোধ হয়, কারণ আমি এমত লোকদের সহিত মিত্রতা করিতে চেষ্টা করিব। অন্যের সহিত বড় একটা আলাপ করিতে চাহি না!

 পাদরি সাহেব উত্তর করিলেন; হায়! এই স্থানে যে ইংরাজ লোকেরা আছে তাহাদের মধ্যে দুই এক জন মাত্র ঈশ্বরকে ভয় করিয়া তাঁহার আদেশ পালন করে, অন্য সকলে সাংসারিক কার্য্যেতে ও নানা প্রকার কৌতুকাদিতে মত্ত আছে। কিন্তু অতি নিকটবর্ত্তি বাঙ্গালি থ্রীষ্টিয়ানদের যে গ্রাম আছে, তাহাতে কএক জন এমত ধার্ম্মিক লোক বাস করে যে তাহাদের বিষয়ে যথার্থ বলিতে পারি, তাহারা খ্রীষ্টের মণ্ডলীর অলঙ্কার স্বরূপ হইয়াছে।

 ইহা শুনিয়া আমি ঐ খ্রীষ্টিয়ান লোকদের বিষয়ে অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিয়া মনে স্থির করিলাম, যে অবকাশ পাইবামাত্র আমি তাহাদের নিকটে গিয়া তাহাদের সহিত আলাপাদি করিব।

 পর দিবসে দৈবাৎ আমার স্বামিকে কোন ডাকাইতের দলের বিষয়ে তত্ত্ব করিবার কারণ গৃহ ত্যাগ করিয়া পল্লীগ্রামে যাইতে হইল, তাহাতে সন্ধ্যাকালে আমার মনে বড় ঔদাস্য হইলে খ্রীষ্টিয়ান গ্রামে গিয়া তথাকার লোকদের সহিত পরিচয় ও কথোপকথন করিতে মনে স্থির করিলাম। আমার বাটীহইতে উক্তগ্রাম প্রায় অর্দ্ধ ক্রোশ দূর; কিন্তু সে দিন বড় উত্তম এবং শীতল বায়ু বহিতেছিল, এই কারণ আমি গাড়ীতে না চড়িয়া এক জন চাপরাসিকে সঙ্গে লইয়া পদব্রজে চলিলাম।

 গ্রামে প্রবেশ করিয়া প্রথমে চারি পাঁচখানা কুঁড়ে ঘর দেখিতে পাইলাম। তাহাদের উঠান অপরিষ্কার এবং তাহাদের সম্মুখে উলঙ্গ বালকেরা কাদা ও ধূলা দিয়া খেলা করত পুত্তলাদি গড়িতেছিল। সেই সকল ঘর যে খ্রীষ্টিয়ান লোকদের বাসস্থান তাহার একটিও চিহ্ণ দেখিলাম না, বরং হিন্দু লোকদের বাটী তাহাদের অপেক্ষা পরিষ্কার ও শোভিত ছিল। এই কারণ আমি তাহাদের মধ্যে প্রবেশ না করিয়া অগ্রে চলিয়া গেলাম।

 কিঞ্চিৎ দূরে গিয়া একটি অতি পরিষ্কার ও পরিপাটী খোলার ঘর দেখিয়া বড় সন্তুষ্ট হইলাম, এবং ঐ ঘর নিবাসিদের পরিচয় লইতে উত্তম সুযোগ পাইলাম; অর্থাৎ আমি দেখিলাম যে ঐ ঘরের নিকটবর্ত্তী কোন বৃক্ষের ডালের উপরে এক লোহার ডাঁড় ঝুলিতেছে, তাহাতে একটি হরিদ্বর্ণ টিয়াপার্থী শিকল দ্বারা বাঁধা থাকাতে কাক সকল তাহাকে চঞ্চুদ্বারা অতিশয় ক্লেশ দিতেছে। ইহা দেখিবামাত্র আমি পাখিকে ডাঁড় সহিত নামাইয়া উঠানের মধ্যে উপস্থিতা হইলাম। আমার আগমনের শব্দ শুনিয়া এক জন অর্দ্ধবয়স্কা স্ত্রীলোক বাহিরে আইল। তাহার মাথার চুল সুন্দররূপে বাঁধা ও তাহার পরিধেয় শাড়ি অতিশয় পরিষ্কার ছিল।

 আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, ওগো এটা কি তোমার পাখী? কাক সকল ইহাকে বড় দুঃখ দিতেছিল, এজন্যে আমি ইহাকে বাটীর ভিতরে আনিয়াছি। স্ত্রীলোক উত্তর করিল, বিবি সাহেব, আপনকার বড় অনুগ্রহ। এ আমার পাখী বটে, আমার পুত্ত্র ভুলিয়া বাহিরে ফেলিয়া গিয়াছে। ইহা বলিয়া সে পক্ষির সকল এলোমেলো পালখ গুলিতে হাত বুলাইয়া সমান করিল, এবং বোধ হইল যে পক্ষী তাহার কর্ত্রীকে ভালরূপে চিনিত, কারণ সে তাহাকে না কাম্‌ড়াইয়া তাহার বস্ত্রের মধ্যে লুকাইতে চেষ্টা করিল।

 পরে ঐ স্ত্রী আমার প্রতি ফিরিয়া জিজ্ঞাসিল, মেম সাহেব, আপনি আমাদিগের পাড়ার মধ্যে কি দেখিতে আসিয়াছেন? পাদরি সাহেবের মেম ভিন্ন আর কেহ এখানে আইসেন না। তাহাতে আমি উত্তর করিলাম, এ বড় দুঃখের বিষয়, কারণ বাঙ্গালি থ্রীষ্টিয়ানদের হিত চেষ্টা করা বিলাতীয় লোকদের অবশ্য কর্ত্তব্য। আমি নূতন মেজিষ্ট্রেট সাহেবের বিবি, যিনি গত মাসে আম্রতলায় বড় দোতালা বাটী ভাড়া লইয়াছেন। কল্য আমি তোমাদের পাদরি সাহেবের নিকটে এই থ্রীষ্টিয়ানদের গ্রামের বিষয় শুনিয়া অদ্য তোমাদের সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছি। ইহা শুনিয়া সেই স্ত্রীলোক বলিল, বোধ হয় বিবি সাহেব, আপনি গাড়ী চড়িয়া আসিয়াছেন?

 আমি উত্তর করিলাম, না, আমি নদীর শীতল বায়ু সেবন করিতে ইচ্ছা করিয়া চাপ্‌রাসিকে সঙ্গে লইয়া হাঁটিয়া আসিয়াছি; কিন্তু তোমাদের গ্রাম যে এতদূরস্থ তাহা আমি জানিতাম না, এই কারণ চলিতে২ বড় শ্রান্তা হইয়াছি। তুমি যদি আমাকে একটি আসন খুঁজিয়া দিতে পার,তবে আমি কিঞ্চিৎকাল বসিয়া বিশ্রাম করি। তাহাতে সে ঘরের ভিতরে শীঘ্র গিয়া একখান পুরাতন চৌকি বাহির করিয়া আনিল। বোধ হয় ঐ চৌকি কেবল মান্য লোকদের নিমিত্তে তোলা থাকিত, কারণ তাহার উপরে কিঞ্চিৎ ধূলা ছিল; কিন্তু এক নিমিষের মধ্যে ঐ স্ত্রী সকল ধূলা অঞ্চলদ্বারা ঝাড়িয়া অতি সুশীলতা পূর্ব্বক আমাকে বলিল, মেম সাহেব, আপনি অনুগ্রহ করিয়া বসুন, আমি আপনাকে আগেই চৌকি দিতাম, কিন্তু মেজিষ্ট্রেট সাহেবের বিবি এমত দরিদ্রের গৃহে কখন বসিবেন না; এই অনুমান করিয়া পূর্ব্বে কিছু বলিতে সাহস করিলাম না।

 আমি তখনি দাবাতে চৌকি লইয়া বসিতেছি, এমত সময়ে সেই স্ত্রীর একটি ছোট বালক গৃহের মধ্যে কান্দিয়া উঠিল। তখন সে তাহাকে আনিবার নিমিত্তে ঘরের ভিতরে যাওয়াতে আমি কিঞ্চিৎ কাল একা থাকিয়া উঠানের মধ্যে যাহা২ ছিল তাহা দৃষ্টি করিতে সুযোগ পাইলাম। তাহার চতুর্দিগের বেড়া নূতন দরমা ও নূতন বাঁশ দিয়া বাঁধা ছিল, এবং তদুপরি একটি সুন্দর ঝিঙা লতা উঠিয়াছিল। উঠানের এক পার্শ্বে গোরুর একখানি ঘর দেখা গেল, তাহার মধ্যে একটি গাভি ও বৎস ধীরে২ জাওনা খাইতেছে। গোশালার ছাতের উপরে অনেক পাকা লাউ দেখিলাম। উঠানের অন্য দিগে পাকশালা ছিল, এবং তাহার দ্বার খোলা থাকাতে আমি দেখিতে পাইলাম তন্মধ্যে তিন চারিটি সুমার্জিত থালা ও ঘটি এবং কএকখান পরিষ্কার পাথরও রাশীকৃত আছে। উঠান সুন্দররূপে পরিষ্কৃত ছিল, তাহাতে যেমন প্রায় সকল ঘরে রীতি আছে তেমন কোন কোণে জঞ্জালের রাশি দেখিতে পাইলাম না; সকল সমান পরিষ্কার ছিল। দাবার সম্মুখে ঘরের ছাঁচির নীচে দশ বারটি চারা গাছ গাম্‌লাতে সাজান দেখিলাম; তাহার মধ্যে তিন চারিটি ঔষধের গাছ ছিল, অন্য সকল গ্যাঁদা তুলসী গন্ধরাজ ইত্যাদি। একটি অতি সুন্দর চীন গোলাপের চারাও ছিল, তাহাতে কুঁড়ি ও ফুল ধরিয়াছিল।

 এই সকল দেখিতেছি এমত সময়ে বাটীর গৃহিণী পুনর্ব্বার বাহিরে আসিয়া আমার চৌকির নিকটে দাঁড়াইল; পরে আমি তাহাকে বসিতে বলিলে সে আপন দ্বারের চৌকাঠের উপরে বসিয়া ছেল্যাকে দুগ্ধ পান করাইতে লাগিল। সেই পুত্ত্রসন্তান দেখিতে সুন্দর; এবং অনুমান হইল তৎকালে তাহার বয়ঃক্রম প্রায় এক বৎসর হইবে। তাহার গায়ে গরম কাপড়ের কুর্তী ছিল, এবং তাহার মাতাও একটা কোর্ত্তা পরিয়াছিল। বোধ হয় যদ্যপি সকল খ্রীষ্টিয়ান স্ত্রীলোক এইরূপ উপযুক্ত বস্ত্র ব্যবহার করে তবে ভাল হয়; দুই আনা পয়সাতে একটা কোর্ত্তার কাপড় ক্রয় করা যায়, তাহার মূল্য অধিক নয়, এবং কিঞ্চিৎ শিল্প বিদ্যা শিক্ষা করিলেই তাহা অনায়াসে ঘরে প্রস্তুত করা যায়।

 সে যাহা হউক, ঐ স্ত্রীলোক বসিলে আমি তাহার সহিত কথোপকথন করিতে২ জিজ্ঞাসা করিলাম, তোমার নাম কি? তোমার স্বামী কি কর্ম্ম করে? ও তোমার কয়টি সন্তান? সে উত্তর করিল, আমার স্বামী পাদরি সাহেবের নিকটে হরকরার কর্ম্মে নিযুক্ত থাকিয়া চিঠী লইয়া বেড়ান, এবং সাহেবেরা স্কুলের কার্য্য নির্ব্বাহ করিবার কারণ যে২ দান করিয়া থাকেন, সে টাকা তাঁহাকে মাসে২ সংগ্রহ করিতে হয়; এবং কখন২ বা পাদরি সাহেবের নিমিত্তে নানা প্রকার দ্রব্য ক্রয় করিতে কলিকাতায় যাইতে হয়। আমার নাম ফুলমণি, আমার দুই পুত্ত্র ও দুই কন্যা আছে।

 ফুলমণি আরো কথা বলিত, কিন্তু এমন সময়ে আর এক জন স্ত্রীলোক বহির্দ্বারে শক্তরপে আঘাত করিয়া ভিতরে আইল। তাহার কাপড় বড় ময়লা, এবং চুল বাঁধা না থাকাতে মস্তকের চতুর্দিগে পড়িয়াছিল। সে আমার মুখপানে কিঞ্চিৎকাল অসভ্যরূপে তাকাইয়া ফুলমণির প্রতি ফিরিয়া ফুস্‌ফাস্ করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, উনি কে? ফুলমণি বলিল, ইনি নূতন মেজিষ্ট্রেট সাহেবের বিবি।

 এই কথা শুনিয়া ঐ স্ত্রীলোক কিঞ্চিৎ ভয় পাইয়া আমাকে অতি নম্রতা পূর্ব্বক সেলাম করিল; পরে সে ফুলমণিকে ধীরে২ বলিতে লাগিল, ফুলমণি, তোমার কপাল বড় ভাল। সকল সাহেব লোকেরা তোমাকেই ভাল বাসেন, আমার প্রতি কেহই দয়া করেন না। তাহাতে ফুলমণি কোন উত্তর না দিয়া বলিল, সে যাহা হউক, করুণা তুমি এই স্থানে এমত ব্যস্ত হইয়া কেন আইলা? করুণা বলিল, চড়চড়ি রন্ধন করিবার নিমিত্তে কিছু তৈল তোমার নিকটে চাহিতে আসিয়াছি, ঘরে একটিও পয়সা নাই, আমার পুত্ত্র এখনি কতকগুলিন চুনা মাছ ধরিয়া আনিয়া দিল, সেই গুলিন এই বেলার মত রন্ধন করিব। আমার স্বামিকে তো জান; সে আমাকে কিছু খরচ দেয় না, তথাপি খাইতে না পাইলে সমস্ত রাত্রি তিরস্কার করিতে থাকে।

 ফুলমণি বলিল, এ বড় মন্দ বটে, কিন্তু তোমার পয়সা নাই এই বা কেমন কথা? আমি প্রাতঃকালে শুনিলাম যে রমানাথ উপদেশক তোমাকে ডাকিয়া বলিলেন, আজি আমি পল্লীগ্রামে ঘোষণা করিতে যাইব; তুমি যদি আমার পীড়িতা স্ত্রীর নিকটে থাকিয়া তাহাকে সাগুদানা ইত্যাদি রন্ধন করিয়া দেও, তবে আমি তোমাকে ছয়টি পয়সা বেতন দিব।

 করুণা হাসিতে২ উত্তর করিল, আমাকে যে ডাকিয়াছিল সে সত্য বটে, কিন্তু আমি যাই নাই। মধুর স্ত্রী যে পলাইয়া গিয়াছিল, তাহার সকল কথা শুনিতে২ সময় গেল; তাহাতে বাবু আপন স্ত্রীর কাছে প্যারীকে রাখিয়া চলিয়া গেলেন। মধুর স্ত্রীকে কালীপুরে পাওয়া গেল; সেখানে সে কাঠ কুড়াইয়া বেচিতেছিল, এবং তাহার যত গহনা ছিল তাহা একটিও তাহার নিকটে নাই। সে এই কথা বলে, যে একটি বৃদ্ধা স্ত্রীলোক প্রথমে আমার প্রতি বড় দয়া প্রকাশ করিয়া পাঁচ সাত দিন আমাকে ঘরে রাখিয়া খাইতে দিল। পরে এক রাত্রিতে আমি যখন ঘোরতর নিদ্রা গিয়াছিলাম, তখন কে আসিয়া আমার সমুদয় গহনা গাত্রহইতে খুলিয়া লইল। প্রাতঃকালে উঠিয়া গহনা না দেখিয়া আমি কান্দিতে২ ঐ বুড়া স্ত্রীকে কহিলাম, তুমিই অবশ্য আমার গহনা লইয়াছ; তাহাতে সে আমাকে গালি দিয়া ঘরহইতে বাহির করিয়া দিল। তখন আমি বলিলাম, তবে আমি কি ক্ষুধায় মরিব? আমি নালিশ করিতে যাই। এই কথা শুনিয়া বুড়ি বলিল, তোর সাক্ষী নাই, তোর টাকা নাই, তুই কি প্রকারে নালিশ করিবি? এই লও, আমি দয়া করিয়া তোকে দুইটি টাকা দিলাম, কিন্তু তুই যদি এই বিষয় প্রকাশ করিস্ তবে আমি তোর নামে নালিশ করিব।

 করুণা আরো বলিল, এই সকল রাণীর কথা; কিন্তু আমার বোধ হয় তাহা সকলি মিথ্যা। মধু তো বলে, যদি সে আমার গহনা আনিয়া না দেয়, তবে আমি তাহাকে চোরের ন্যায় কয়েদ করাইব।

 ফুলমণি বলিল, মধু তাহা কখন করিতে পারিবে না। বিবাহের সময়ে ঐ গহনা রাণীকে দান করিয়াছিল কি না? আর সকল গহনা কিছু মধুর দত্ত নয়, কতকগুলি গহনা রাণীর মাতা মৃত্যুকালে তাহাকে দিয়া গিয়াছিল। আমার বোধ হয় রাণী সত্য কথা বলিয়াছে। ঐ বুড়ি গহনার লালসায় তাহাকে স্থান দিয়া থাকিবে, তাহা না হইলে এমত দয়ালু কে আছে যে খ্রীষ্টিয়ানীকে আপন ঘরের ভিতরে আনিয়া আহারাদি দেয়? রাণী পলাইয়া যাওয়াতে বড় অজ্ঞানের কর্ম্ম করিল বটে, তথাপি তাহারই সম্পূর্ণ দোষ নয়; তাহার স্বামী এবং শাশুড়ী তাহাকে যে বড় দুঃখ দেয়, তাহা আমি ভালরূপে জ্ঞাত আছি।

 করুণা উত্তর করিল, তুমি তো রাণীর পক্ষে অবশ্য বলিবা, কারণ সে স্কুলের মেয়া ছিল, আর সে তোমার সুন্দরীর বন্ধু। কিন্তু ফুলমণি, আমি তোমাকে যথার্থ বলি, লোকেরা আর স্কুলের মেয়াদের সহিত আপন পুত্ত্রদিগকে বিবাহ দিবে না। স্কুলের মেয়াদের দ্বারা বার২ এইরূপ গোলমাল উপস্থিত হইয়া থাকে।

 ফুলমণি বলিল, সে অনর্থক কথামাত্র; মেয়াদের তো চৌদ্দ বৎসর বয়স না হইতে২ সর্ব্বদা বিবাহ হইতেছে; এবং পাদরি সাহেব যে বর অন্বেষণ করেন তাহাও নয়, লোক সকল আপনারা আসিয়া কন্যা যাচ্ঞিয়া বিবাহ করে। আর শুন, এই গ্রামের মধ্যে ঐ স্কুলের মেয়ারা প্রায় সকলে ভদ্র২ ঘরে দত্তা হইয়াছে। আমাদের রমানাথ বাবুর স্ত্রীকে দেখ; এবং কোমল সরকারের স্ত্রী ও শশিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের দুই বউ, ইহারা সকলেই স্কুলের মেয়া, তথাপি তাহাদের বিরুদ্ধে একটিও কথা কেহ বলিতে পারে না। যদি রাণীর বিষয়ে বল, তবে আমার কিছু কথা আছে। সাহেব প্রথমাবধি তাহার বিবাহ দিতে অনিচ্ছুক ছিলেন, আমরাও তাহাতে অনেক বাধা দিয়াছিলাম; কিন্তু রাণীর মাতা বড় অজ্ঞান ছিল। ঐ তিন খান সোনার গহনার জাঁকজমকদ্বারা তাহার দৃষ্টি এমত রোধ হইয়াছিল, যে মধুর একটিও দোষ তাহার চক্ষে পড়িল না। তুমি তো উত্তমরূপে জান যে মধু অতিশয় মূর্খ লোক, ক খ পর্য্যন্ত জানে না; কিন্তু রাণী সকল মেয়াদের মধ্যে লেখা পড়াতে বড় নিপূণা, কেবল ঘরের কর্ম্ম করিতে বড় একটা ভাল বাসে না। এমত বিপরীত স্বভাব বিশিষ্ট লোকদের বিবাহেতে কি কখন সুখ উৎপন্ন হইতে পারে? কিন্তু সে যাহা হউক, পরের কর্ম্মে আমাদের হাত দেওয়া অকর্ত্তব্য। আইস, আমি তোমাকে চড়চড়ির নিমিত্তে কিছু তৈল দিই।

 অনন্তর করুণা ফুলমণির পশ্চাতে ঘরের মধ্যে যাইতেছিল, এমত সময়ে তাহার আঁচলে একটি বড় ছিদ্র থাকাতে সেই উক্ত চীন গোলাপের গাছে জড়িয়া ধরিল; তাহা করুণা না দেখিয়া অঞ্চলটিকে বলপূর্ব্বক টানিয়া লওয়াতে চারাটি প্রায় মূল পর্য্যন্ত ভাঙ্গিয়া গেল। তখন আপন কৃত ঐ ক্ষতি দেখিয়া করুণার বদন বড় বিষণ্ণ হইল, তাহাতে সেখানে বসিয়া সে ফুল পত্রাদিকে সংগ্রহ করিতে লাগিল। এমত কালে ফুলমণি কিছু না জানিয়া তৈলের ভাঁড় হাতে করিয়া বাহিরে আইল, কিন্তু আপন প্রিয়তম গাছটির অবস্থা দেখিয়া সে অতিশয় দুঃখিত হইয়া বলিতে লাগিল, হায় করুণা! তুমি কি করিলা? আমার সুন্দরীর চারাটি গেল। করুণা বলিল, আমাকে ক্ষমা কর। ফুলমণি, আমি এই বিষয়ে বড় দুঃখিত হইয়াছি। তুমি ঐ গাছটিকে তোমার সুন্দরীর নিশান স্বরূপ জ্ঞান করিয়া অত্যন্ত ভাল বাসিতা, তাহা আমি জানি।

 ইহা শুনিয়া ফুলমণির ক্রোধ নিবৃত্তি হইল, পরে সে হাস্য মুখে বলিল, ক্ষতি নাই। ইহাতে ধর্ম্মপুস্তকের একটি অতি সান্ত্বনাদায়ক পদ আমার স্মরণ হইতেছে। হায় করুণা! তুমি যদি আপন মনে ঐ কথার বহুমূল্যতা জ্ঞাত হইতা, তবে তোমার দুঃখ অনেক ন্যূন হইত। সে কথা এই, “তৃণ শুষ্ক হয়, ও পুষ্প ম্লান হয়, কিন্তু আমাদের ঈশ্বরের বাক্য নিত্যস্থায়ী।” য়িশয়িয় ৪০।৮।

 করুণা নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া কিছু উত্তর করিল না, কিন্তু আমি তাহার মুখপানে চাহিয়া অনুমান করিলাম, সে ফুলমণির স্বভাব প্রাপ্তা হইতে ইচ্ছা করিতেছিল। অবশেষ করুণা আপন সুশীলা বন্ধুর নিকটে বিদায় লইয়া আমাকে সেলাম দিয়া তৈলপাত্র হাতে করিয়া চলিয়া গেল।

 উক্ত কথোপকথন শুনিয়া আমি অনুমান করিলাম, ফুলমণি অতি ধার্ম্মিকা ও নম্রমনা বটে, সেই হেতুক আমি পুনর্ব্বার তাহাকে বসিতে বলিয়া তাহার আত্ম বিবরণ কহিতে অনুমতি দিলাম। তাহাতে সে বলিল, মেম সাহেব, আমার বিষয় আপনাকে আর কি জানাইব? সকলি তো জ্ঞাত করিয়াছি। তাহাতে আমি বলিলাম, ঐ সুন্দরী যাহার বিষয়ে এখন করুণার সহিত কথা হইল, সে কে? তাহা আমাকে বল; কেননা তাহার দত্ত ফুলগাছটিকে যদি তুমি এমন প্রিয় জ্ঞান কর, তবে বোধ করি সে তোমার কোন আত্মীয় ব্যক্তি হইবে।

 ফুলমণি উত্তর করিল, মেম সাহেব ভাল বুঝিয়াছেন। সুন্দরী আমার জ্যেষ্ঠা কন্যা; তাহার বয়স প্রায় পোনের বৎসর হইয়াছে। দুই বৎসর গত হইল তাহার পিতা ছয় মাস পর্য্যন্ত অতিশয় পীড়িত ছিলেন, তজ্জন্য আমাদের বড় দুঃখ ঘটিয়াছিল। সত্যরূপে বলিতেছি, আমরা ঐ ছয় মাসের মধ্যে কেবল অন্ন ও শাক বিনা আর কোন ভাল দ্রব্য এক দিবসও খাইতে পাইতাম না; তথাপি আমি এক পয়সা মাত্র কখন কর্জ্জ করি নাই, কারণ আমি কর্জ্জকে সর্পের ন্যায় ভয় করি। ইহাতে আমাদের আহারের বড় ক্লেশ হইয়াছিল বটে, কিন্তু এক দিবস এলিয় ভবিষ্যদ্বক্তার বিবরণ পাঠ করিয়া দেখিলাম যে পরমেশ্বর আপন আশ্রিত লোকদিগকে আকালের কালেও ক্ষুধায় মরিতে দেন না, বরং তাহাদের প্রাণ বাঁচাইবার কারণ আকাশের পক্ষিগণকেই আহারাদি আনিতে

আজ্ঞা করেন। ১ রাজাবলি ১৭।১—৭। ইহা পড়িয়া দুঃখ ভোগের সময়েও আমাদের মনোমধ্যে যথেষ্ট সান্ত্বনা জন্মিল।

 তৎপরে আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, ফুলমণি, তবে তোমাদের দিন নির্ব্বাহ কিরূপে হইত? ফুলমণি বলিল, ইংরাজি স্কুলের প্রধান শিক্ষক মহেন্দ্র বাবুর ঘরে এক রন্ধনের কর্ম্ম উপস্থিত ছিল; আমি ভাবিলাম, কর্জ্জ করা অপেক্ষা পরের সেবা করা ভাল। অতএব সেই স্থানে গিয়া ঐ কর্ম্মে নিযুক্ত হইলাম। তাহাতে আমাকে প্রতিদিন প্রাতঃকালে যাইতে হইত, কিন্তু সায়ংকালে ঘরে আসিবার অবকাশ পাইতাম। সুন্দরী সে সময়ে স্কুলে ছিল, ফলতঃ ঐ বিপদ কালে তাহাকে ঘরে আনিতে হইল, কারণ আমি কর্ম্মে গেলে তাহাকেই আপন পিতার সেবাদি করিতে হইত। বাবুর নিকটে প্রতিমাসে তিন টাকা বেতন পাইতাম, এবং দুগ্ধ বিক্রয়দ্বারা গোরুর খাদ্যাদির খরচ বাদে প্রায় প্রতিমাসে আর দুই টাকা লাভ করিতাম। এইরূপে মোটা ভাত খাইয়া মোটা কাপড় পরিয়া ছয় মাস পর্য্যন্ত দিনপাত করিলাম। সুন্দরীর পিতার পীড়া হওনের পূর্ব্বে আমরা ষোলটি টাকা জমা করিয়াছিলাম, তাহাতে পাঁচ টাকায় গোরুর ঘর বানাইলাম, আর এগার টাকা দিয়া গোরু বাছুর কিনিলাম। আমাদের এমত দুঃখ হইবে, তাহা যদি পূর্ব্বে জানিতাম, তবে বোধ হয় ঐ টাকা খরচ করিতাম না। তথাপি এক প্রকার ভাল হইয়াছে, কারণ সেই অবধি আমি সর্ব্বদা দুগ্ধ বিক্রয় করিয়া কিছু লাভ করিয়া আসিতেছি।

 ফুলমণি আরো বলিল, ছয় মাস গত হইলে ঈশ্বরের প্রসাদ হেতুক সুন্দরীর পিতা কিঞ্চিৎ সুস্থ হইয়া পুনর্ব্বার কর্ম্মেতে গেলেন, কিন্তু তখন কবিরাজ মহাশয়কে বিদায় করিতে হইল। তিনি বলিলেন, ছয় মাস পর্য্যন্ত আসা যাওয়া করিয়াছি, সেই হেতুক চব্বিশ টাকার কম লইব না। ইহা শুনিয়া আমাদিগের বড় ভাবনা হইল, কারণ তাঁহাকে পাঁচটি টাকা দি, তৎকালে আমাদের এমত সঙ্গতি ছিল না। কিন্তু ঈশ্বর যখন আপন সেবকদিগকে নিরুপায় দেখেন, তখন তিনি সর্ব্বদা তাহাদিগকে রক্ষা করেন, এ কথা যে সত্য তাহা আমরা পরে ভালরূপে বুঝিতে পারিলাম।

 আমাদিগের পাদরি সাহেবের ভগিনী সেই সময়ে আপন ভাইয়ের ঘরে কিছু দিনের নিমিত্তে আসিয়াছিলেন। তিনি অতিশয় ধার্ম্মিকা; তাঁহার সাহেব কলিকাতায় ডাক্তরের কর্ম্ম করেন। ঐ বিবি আমার কন্যাকে স্কুলে দেখিয়া তাহাকে বড় ভাল বাসিতেন, তাহাতে তিনি আমাদের দুঃখের কথা শুনিয়া আমাকে ডাকাইয়া এই কথা কহিলেন; ফুলমণি, তুমি সুন্দরীকে আমার সহিত কলিকাতায় যাইতে দেও। আমি তাহাকে আয়ার কর্ম্ম শিখাইব। বোধ করি সে ধার্ম্মিকা মেয়া, এবং এমত ব্যক্তি আমার বাবাদিগের নিকটে থাকে, ইহা আমি বড় অভিলাষ করি। যদ্যপি সুন্দরী এখন কোন কর্ম্ম না জানে, তথাপি আমি তাহাকে খাদ্য বস্ত্রাদি ও প্রতিমাসে দুই টাকা বেতন দিতে স্বীকার করিতেছি; পরে কর্ম্মে পারক হইলে আরো বৃদ্ধি করিয়া দিব। এই কথাতে যদি সম্মতা হও, তবে আমি এখনি সুন্দরীর এক বৎসরের বেতন অর্থাৎ চব্বিশ টাকা তোমার হাতে দিই; তুমি টাকা লইয়া কবিরাজকে দিলে তোমাদের সকল দুঃখের শেষ হইবে।

 তদনন্তর ফুলমণি আমাকে বলিল, মেম সাহেব, আমি ঘরে আসিয়া এই সকল কথা সুন্দরীর পিতাকে জানাইলাম, কিন্তু তিনি কন্যাকে ছাড়িয়া দিতে অনিচ্ছুক হইলে আমি পাঁচ সাত দিন পর্য্যন্ত কিছু স্থির করিতে না পারিয়া ডাক্তর সাহেবের বিবির নিকটে গেলাম না। আমাদের প্রতিবাসি সকলে কহিল, এমত কর্ম্ম কখন করিও না। কেহ২ বলিল, ছি ছি! লোকে লজ্জা দিবে; কেহ২ বলিল, না না, মেয়া ভ্রষ্টা হইবে; কেহ বা বলিল, তোমরা অতিশয় টাকার লোভী; টাকার লালসায় কন্যাকে বিদেশে চাকরি করিতে পাঠাইতে চাও; টাকা ধার কর, আপন মেয়াকে কখন ছাড়িয়া দিও না।

 ফুলমণি বলিল, মেম সাহেব, প্রতিবাসিদের এইরূপ কথা শুনিয়া আমিও ভাবিতে লাগিলাম, যে একবার মাত্র ধার করিলে কিছু ক্ষতি নাই, চেষ্টা করিলে টাকা শীঘ্র পরিশোধ করিতে পারিব। কিন্তু সুন্দরী বলিল, না মা! কোথা হইতে পরিশোধ করিবা? কারণ কবিরাজ বলেন, যদ্যপি পিতা এখন উত্তম২ তেজস্কর দ্রব্যাদি না খান, তবে তাহার পূর্ব্বমত বল হইবে না। এবং মা, তুমি দুঃখদায়ক কর্ম্ম করিয়া অতিশয় শীর্ণা হইয়াছ। তোমরা এখন ভাল খাও ও ভাল পর, এবং আমাকে কলিকাতায় যাইতে দেও। লোকদের কথা শুনিও না, কারণ আমি ঈশ্বরকে ভয় করি; তিনি সকল আপদহইতে আমাকে রক্ষা করিবেন।

 ফুলমণি আরও বলিল, সুন্দরীর যাওনের বিষয় স্থির হইবার পূর্ব্বে একজন বৃদ্ধা স্ত্রীলোক অহঙ্কার করত আমার নিকটে আসিয়া এই কথা কহিল; ভাল, ফুলমণি, গত বৎসরে তুমি আমার মধুর সহিত তোমার কন্যাকে বিবাহ দিতে সম্মত ছিলা না। এখন তোমাদের দুঃখ উপস্থিত হইয়াছে; তুমি আমাদের পায়ে ধরিয়া ঐ কর্ম্ম যেন হয় এমত নিবেদন করিবা। ভাল, তাহাই হউক, আমি সকল ক্ষমা করিলাম। সুন্দরীকে কলিকাতায় না পাঠাইয়া আমার পুত্ত্রের সহিত বিবাহ দেও, দিলে তোমার জামাতা কবিরাজের টাকা গুলিন পরিশোধ করিবেন। আমি বলিলাম, না গো, সে কখন হইবে না। আমি তোমার পুত্ত্রকে শিশুকালাবধি চিনি বটে,এবং সে আমাকে মা বলিয়া থাকে; কিন্তু দুই তিন বৎসরাবধি আমি স্বচক্ষে দেখিতেছি সে বার২ শুঁড়ির দোকানে গিয়া মদ্য পান করে। অতএব সুখাবস্থায় যে রূপ বলিয়াছিলাম, সেই রূপ এখনও বলিতেছি, যে মদ্যপায়ী ব্যক্তির সহিত আমার কন্যাকে কখন বিবাহ দিব না। এমত বিবাহ অপেক্ষা আয়াগিরি চাকরি করা সহস্রগুণে ভাল। এই কথা শুনিয়া ঐ বুড়ি মহা ক্রোধান্বিত হইয়া আমাদের বিষয়ে নানা প্রকার হিংসার কথা কহিতে লাগিল। সে প্রতিবাসিদিগের নিকটে বলিল, যে সুন্দরীর গর্ভ হইয়াছে; অতএব তাহা গোপনে নষ্ট করিবার কারণ ফুলমণি তাহাকে কলিকাতায় পাঠাইতেছে। সুন্দরীর পিতা এবং আমি এই রূপ মিথ্যা অপবাদ শুনিয়া দুঃখিত হইলাম বটে, কিন্তু “যে জিহ্বা তোমার সহিত বিবাদ করে, তাহাকে তুমি বিচারে দোষী করিবা,” ঈশ্বরের এই অঙ্গীকার আমাদের প্রতি তখন সফল হইল; কারণ সুন্দরী যে দুষ্টা, তাহা কেহ্ বিশ্বাস না করিয়া প্রতিবাসি সকলে বুড়িকেই দোষ দিতে লাগিল।

 তদনন্তর আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, যে যুব পুরুষ তোমার কন্যাকে বিবাহ করিতে অভিলাষ করিয়াছিল, শেষে তাহার কি ঘটিল?

 ফুলমণি বলিল, মেম সাহেব ঐ স্ত্রীলোক যে ব্যক্তির কথা এক্ষণে এই স্থানে কহিতেছিল, সেই বুড়ির পুত্ত্র মধু আমার সুন্দরীকে বিবাহ করিতে চাহিয়াছিল। এক বৎসর পরে সে রাণীকে বিবাহ করিল; কিন্তু রাণী এই প্রকারে তাহার নিকটহইতে দুইবার পালায়ন করিয়াছে। রাণী আমার সুন্দরীর সঙ্গে এক স্কুলে পাঠ করিত, তাহাতে উভয়ের অত্যন্ত প্রণয় হইয়াছিল। এই কারণ সুন্দরী গেলে পরে রাণী আমার নিকটে কখন২ আসিয়া কিছু কাল বসিয়া সকল দুখের কথা বলিত; কিন্তু প্রায় তিন মাস হইল সে আমাকে বলিয়াছিল, আমি যখন তোমার নিকটহইতে ঘরে যাই তখন স্বামী কিম্বা শাশুড়ী বড় মারেন। এই কথা শুনিয়া আমি তাহাকে আসিতে বারণ করিলাম, কেননা পরিবারের মধ্যে যাহাতে বিবাদ জন্মে, এমত কর্ম্ম করা অনুচিত।

 আমি বলিলাম, তুমি ভাল বুঝিয়াছিলা, ফুলমণি। এই মধু ও রাণীর বিষয়ে পশ্চাতে আরো কথা জিজ্ঞাসা করিব; এখন সুন্দরীর কি গতি হইল, তাহা বল।

 ফুলমণি হাসিয়া কহিল, মেম সাহেব, আপনকার বড় অনুগ্রহ যে আপনি আমার কন্যার বিষয় শুনিতে এমত ইচ্ছুক আছেন। তাহাকে ছাড়িয়া দিব কি না, এ বিষয় আমরা কোন প্রকারে মনে স্থির করিতে না পারিয়া আমি পাদরি সাহেবের নিকটে পরামর্শ লইতে গেলাম।

সে সময়ে তিনি বাজারে সুসমাচার প্রচার ও বহি বিতরণ করিতে গিয়াছিলেন, কিন্তু মেম সাহেব আপনার কুঠরীতে বসিতে অনুমতি দিলে আমি সাহেবের আগমন পর্য্যন্ত অপেক্ষা করিলাম। পরে তিনি বাটীতে আসিবা মাত্র আমি তাঁহাকে সুন্দরীর কথা কহিয়া নিবেদন করিলাম, হে মহাশয়, এ বিষয়ে আপনি কি পরামর্শ দেন? তাহাতে তিনি বলিলেন, বাঙ্গালিদের মধ্যে যুবতি মেয়া যে আপন পিতা মাতাকে ত্যাগ করিয়া দূর দেশে যায়, তাহা প্রায় ভাল বুঝি না। কারণ যুবতীরা অতিশয় চঞ্চল এবং নির্বোধ হইয়া থাকে, ও দুষ্ট লোকেরা তাহাদিগকে যে পরামর্শ দেয় সেই পরামর্শ মতে চলে। কিন্তু সুন্দরীর প্রতি এই কথা অত্যন্ত অনুপযুক্ত। আমি দুই বৎসর পর্য্যন্ত তাহার ব্যবহার দেখিতেছি, তাহাতে সম্পূর্ণকপে জ্ঞাত আছি যে সে ঈশ্বরকে ভয় করিয়া আপনার শক্তির উপরে নির্ভর না দিয়া বার২ যীশু খ্রীষ্টের নিকটে বল ও শিক্ষা যাচ্ঞা করে; এই জন্যে বলি তাহাকে যাইতে দেও, তাহার প্রতি কেহই কিছু ক্ষতি করিতে পারিবে না। পাদরি সাহেব আরও বলিলেন, দেখ সুন্দরীর মা, তোমরা দুরবস্থায় আছ, এবং তোমাদের রক্ষার্থে পরমেশ্বর এই উপায় দর্শাইয়াছেন। তুমি কন্যার নিমিত্তে চাকরি অন্বেষণ কর নাই, এবং আমিও আপনার ভগিনীকে এবিষয়ে কিছু বলি নাই। অতএব ঈশ্বর আপনি যখন উপযুক্ত দ্বার খুলিয়া দেন, তখন সে দ্বারে প্রবেশ করা তাঁহার ভক্তদের অবশ্য কর্ত্তব্য।

 ফুলমণি বলিল, মেম সাহেব,পাদরি সাহেবের এই কথা শুনিয়া আমরা সুন্দরীকে কলিকাতায় পাঠাইতে স্থির করিলাম। পর দিবসে ডাক্তর সাহেবের মেম অঙ্গীকার অনুসারে সুন্দরীর এক বৎসরের বেতন অগ্রে দিলেন, তদ্দ্বারা আমরা কবিরাজকে বিদায় করিয়া আট দিন পর্য্যন্ত বড় সুখে কালযাপন করিলাম। কিন্তু সুন্দরী কলিকাতায় গেলে পর আমি অত্যন্ত দুঃখিত হইলাম, তাহাতে সুন্দরীর পিতা আমাকে বার২ বলিতেন, ফুলমণি কান্দিও না, তুমি ঈশ্বরের অভিমত ক্রিয়া করিলা, ইহাতেই তোমার সান্ত্বনা হউক।

 যাওনের আট দশ মাস পরে সুন্দরী আপন মেমের সঙ্গে এক বার ঘরে আসিয়াছিল, তাহাতে দেখিলাম সে সর্ব্বপ্রকারে ভাল আছে। তাহার পিতাও এক বার কলিকাতায় তাহাকে দেখিতে গিয়াছিলেন, এবং পৌষ মাসে ডাক্তর সাহেবের মেমের এই স্থানে পুনর্ব্বার আসিবার কথা আছে। হায় মেম সাহেব! যদ্যপি আপনি সুন্দরীকে দেখেন, তবে অবশ্য তাহাকে ভাল বাসিবেন।

 ঐ ফুল গাচটি যে নষ্ট হইল, তজ্জন্যে এত খেদ কেন করিলাম, তাহাও বলি। সুন্দরী যখন কলিকাতাহইতে ফিরিয়া আসিয়াছিল, তখন সেই চারাটি হাতে করিয়া আনিয়া আমাকে বলিল, এই লও মা। মেম সাহেবের মালী এই চারাটি আমাকে দিয়াছে; সে এখন ছোট চারা বটে, কিন্তু তুমি যদি ইহাকে ভাল করিয়া রাখ, তবে ইহাতে ফুল ও পত্রাদি ধরিবে; তাহা হইলে তুমি যীশু খ্রীষ্টের এই দয়ালু কথা স্মরণ করিও, “অদ্য বর্ত্তমান ও কল্য চুলাতে নিক্ষিপ্ত হইবে এমন যে ক্ষেত্রের তৃণ, তাহাকে যদি ঈশ্বর এতাদৃশ বিভূষিত করেন, তবে হে অল্পপ্রত্যয়িরা, তোমাদিগকে কি বস্ত্র দিবেন না?” ফুলমণি বলিল, এই জন্যে মেম সাহেব, আমি ঐ গাচটিকে বড় প্রিয় জ্ঞান করিতাম, কারণ সে আমার কন্যার নিশানস্বরূপ ছিল; এবং দুঃখের সময়ে তাহা দেখিয়া আমার অনেক বার সান্ত্বনা হইয়াছে, কেননা আমি ভালরূপে জানি যে বৃক্ষ ও পুষ্পাদিহইতে ঈশ্বরের লোকেরা তাঁহার সাক্ষাতে বহুমূল্য হয়।

 পাঠকবর্গেরা উক্ত কথা পাঠ করত অবগত হইবে, যে আমি এই ধার্ম্মিকা স্ত্রীর চরিত্র সকল শুনিয়া অতিশয় আহ্লাদিত হইলাম, এবং সময় থাকিলে আমাদের অধিক আলাপ হইত; কিন্তু তখন বেলা গিয়াছিল, তাহাতে চাপ্‌রাসি আমার আরামের নিমিত্তে ভাবিত হইয়া আসিয়া বলিল; মেম সাহেব আপনকার বিলম্ব দেখিয়া আমি কুঠিতে শীঘ্র গিয়া গাড়ি সঙ্গে করিয়া আনিয়াছি, কারণ আপনি অন্ধকারে হাঁটিয়া যাইতে পারিবেন না, এবং এখন ঘোড়া যাইবার নিমিত্তে বড় ব্যস্ত হইতেছে, আর স্থির হয় না। ইহা শুনিয়া ফুলমণির নিকটে কিছু খেদ করিয়া বিদায় হইলাম। আমি যে দুই ঘণ্টা তাহার বাটীতে ছিলাম, তাহা অতিশয় আমোদে যাপন করিলাম; তাহাতে আমি পুনর্ব্বার শীঘ্র আসিব, এই কথা বলিয়া গাড়িতে চড়িলাম।

 পথে যাইতে২ মনের মধ্যে অনেক চিন্তা উপস্থিত হইতে লাগিল। ফুলমণি বিরক্ত প্রতিবাসিদের প্রতি কিরূপ কোমল আচরণ করিয়াছিল, তাহা স্মরণ করত আমি ভাবিলাম, হায়! এই দরিদ্রা স্ত্রী অপেক্ষা আমার অধিক জ্ঞান আছে বটে, তথাপি আমি সর্ব্বদা তাহার ন্যায় প্রেম ও সহিষ্ণুতা প্রকাশ করিয়া থাকি কি না, তাহা কহিতে পারি না। আর যখন ঈশ্বরের প্রতি ফুলমণির দৃঢ় বিশ্বাস ও ভরসা স্মরণ করিলাম, তখন আমার নিজ অবিশ্বাস ও অনর্থক ভাবনা সকল অতিশয় নিষ্প্রয়োজন ও দোষযুক্ত বোধ হইল, তাহাতে আমি লজ্জিত হইয়া এই প্রার্থনা করিতে লাগিলাম, “হে প্রভো, প্রত্যয় করি, আমার অপ্রত্যয়ের প্রতিকার করুন!” এতদ্ভিন্ন আর একটি চিন্তা মনে উপস্থিত হইল, যথা; আমি খ্রীষ্টিয়ান পল্লীতে অল্পকাল ছিলাম বটে, তথাপি ইহার মধ্যে স্পষ্টরূপে বুঝিলাম যে সকল ঘর ফুলমণির ঘরের মত নয়, এবং সকল স্ত্রীলোক তাহার ন্যায় সদ্ব্যবহারিণী নহে। ইহাতে আমি ঈশ্বরের স্থানে অতিশয় বিনয় পূর্ব্বক এই প্রার্থনা করিলাম, হে স্বর্গস্থ পিতঃ! আমাকে ধর্ম্মাত্মাতে পূর্ণ করিয়া আমার মনে পাপি লোকদের প্রতি দয়া জন্মাইয়া দেও, তাহাতে এই পল্লীর মধ্যে যত দিন পর্য্যন্ত একটি অধার্ম্মিক পরিবার বাস করিবে, তত দিন পর্য্যন্ত তোমার বিষয়ে যেন শিক্ষা দিতে ক্ষান্তা না হই।

 ঘরে উপস্থিত হইয়া আমি আপন মুসলমানী আয়াকে ডাকিয়া খ্রীষ্টিয়ানদের মধ্যে যাহা২ দেখিয়াছিলাম, তাহা তাহাকে বিস্তারিত রূপে কহিলাম। তাহাতে আয়া সন্তুষ্ট হইয়া কহিল, আপনি যখন পুনর্ব্বার সেই স্থানে যাইবেন, তখন আমাকে অনুগ্রহ করিয়া লইয়া যাইবেন। আমি তাহাতে স্বীকৃতা হইয়া আপন শয়নাগারে প্রবেশ করিলাম। কিঞ্চিৎকাল পরে অতিশয় ঝড় ও তুফান আরম্ভ হইল। তৎকালে আমার স্বামী পল্লীগ্রামে তাম্বুতে আছেন, ইহা জানিয়া আমি শোকাকুল ও ভাবিতা হইতে লাগিলাম, কিন্তু ঈশ্বরীয় যে বাক্য সুন্দরী আপন মাতাকে স্মরণ করিতে বলিয়াছিল, তাহা আমার মনে পড়িলে আমি তদ্দ্বারা সান্ত্বনা পাইয়া স্বচ্ছন্দে শয়ন করিলাম।