ফুলমণি ও করুণার বিবরণ/দ্বিতীয় অধ্যায়

দ্বিতীয় অধ্যায়।

 পূর্ব্ব অধ্যায়ের লিখিত ঘটনার দশ বার দিন পরে আমি পুনর্ব্বার ফুলমণির গৃহে যাইতে বাসনা করিলাম। সে দিবস শনিবার, অতএব মনে ভাবিলাম, অদ্য যদি যাই, তবে বোধ হয় আমি ফুলমণির ছেল্যাদের দেখা পাইব; কারণ ফুলমণি আমাকে বলিয়াছিল যে শনিবারে ছেল্যারা বেলা থাকিতে বাটীতে আইসে। ইহা স্মরণ করিয়া আমি আয়াকে ও চাপ্‌রাসিকে সঙ্গে করিয়া চলিলাম। চাপ্‌রাসির হাতে একটি টবে অতি সুন্দর লালবর্ণ বিলাতি ফুলগাচ ছিল; তাহা চিন গোলাপ চারার পরিবর্ত্তে ফুলমণিকে দিতে মানস করিলাম, কেননা সে ফুলসকলকে কেমন ভাল বাসে এবং তাহাদ্বারা কিরূপ উত্তম২ উপদেশ প্রাপ্তা হয়, ইহা দেখিয়া আমি বড় সন্তুষ্টা হইয়াছিলাম।

 ইহা আশ্চর্য্যের বিষয় বটে, যে কোন২ খ্রীষ্টিয়ান লোক পৃথিবীর সৌন্দর্য্য দেখিয়াও তদ্বারা সৃষ্টিকর্ত্তার বিষয়ে কিছু শিক্ষা করে না, এবং তাঁহার হস্তকৃত কার্য্যের সহিত পারমার্থিক বিষয়ের কিরূপ তুলনা হয়, তাহাও বুঝিতে পারে না। এই কথা দেশস্থ স্ত্রীলোকদের প্রতি বিশেষরূপে খাটিতে পারে, যেহেতুক তাহাদের মধ্যে ঈশ্বরের কর্ম্মের বিষয়ে যাহারা ভালরূপে মনোনিবেশ করে এমত লোক অত্যল্প পাওয়া যায়। বস্তুতঃ আমি ফুলমণি বিনা এরূপ সৎবিবেচিক এতদ্দেশীয়া স্ত্রীলোকদের মধ্যে আর কাহাকেও দেখি নাই। সে যাহা হউক, ফুলমণির এইরূপ স্বভাব দেখিয়া বুঝিলাম যে তাহার সহিত আমার উত্তম প্রণয় হইবে, কারণ আমি যে সকল বিষয়ে মনোনিবেশ করিয়া থাকি, সে সকলেতে তাহারও মনঃসংযোগ হইয়া থাকে।

 অনেক বৎসর অবধি আমি মনের মধ্যে একটি রীতি স্থাপন করিয়াছি, যথা; যে সময়ে আমি ক্ষেত্রেতে কিম্বা নদীতীরে অথবা বাগানে একাকিনী ভ্রমণ করি, সেই সময়ে কোন দৃষ্ট বস্তু অর্থাৎ বন্যঘাস কি ফুল কিম্বা প্রস্তর ইত্যাদি ইহার মধ্যে কোন একটাকে মনোনীত করিয়া, সে কি প্রকার কার্য্যে লাগে, এবং সে কেমন সুন্দর, কিম্বা তাহার কি২ গুণ, এই সকলেতে মনোনিবেশ করিয়া তদ্দ্বারা ঈশ্বরের শক্তি ও জ্ঞান ও দয়ার বিষয়ে সুশিক্ষিতা হই। কখন২ বা সাংসারিক বস্তুর বিষয় ধ্যান করিতে২ পারমার্থিক বিষয়ে জ্ঞান প্রাপ্ত হই; ইহার উদাহরণ বলি। আমি যখন বাগানের মধ্যে মালীকে বৃক্ষের ডাল ছাঁটিয়া পরিষ্কার করিতে দেখি, তখন ধর্ম্ম পুস্তকে লিখিত এই কথার ভাব ভালরূপে বুঝিতে পারি, যথা; “পরমেশ্বর যাহাকে প্রেম করেন তাহাকেই শাস্তি প্রদান করেন, এবং যে প্রত্যেক পুত্ত্রকে গ্রাহ্য করেন তাহাকেই প্রহার করেন।” ইব্রীয় ১২।৬। কিম্বা “যে সকল শাখাতে ফল ধরে না তাহা পিতা ছেদন করিয়া ফেলেন, এবং ফলবতী শাখা সকলেতে যেন আরো ফল ধরে এই জন্যে পরিষ্কার করেন।” যোহন ১৫।২।

 কখন২ বা সূর্য্যকে অস্ত হইতে দেখিয়া এই বোধ করি, যে সূর্য্যের সহিত সত্য খ্রীষ্টিয়ান লোকের মৃত্যুর তুলনা দেওয়া যায়; ফলতঃ যেমন নির্ম্মল দিবসে সূর্য্য সমস্ত দিন অতিশয় তেজঃ প্রকাশ করিলে অস্ত হওনের সময়ে তাহাতে প্রায় কেহই মনোযোগ করে না; তেমনি কোন খ্রীষ্টিয়ান লোকের যাবৎ জীবন ঈশ্বরের সেবাতে ও মনুষ্যদের হিতার্থে কাল ক্ষেপণ করিয়া মৃত্যুর সময়ে বড় একটা সাহস ও জয় প্রকাশ করিতে না পারিয়া কেবল সুস্থিররূপে আপন২ আত্মা প্রভুর হস্তে সমর্পণ করে। তাহারা

“সান্ত্বনাতে কাল ক্ষেপে, সান্ত্বনাতে মরে,”

সুতরাং নির্ম্মল দিনের সূর্য্যাস্তের ন্যায় অনেকেই তাহাদের মরণেতে বড় মনোযোগ করে না। আর সূর্য্য কখন২ দিনের মধ্যে অনেকবার মেঘদ্বারা আচ্ছাদিত হইলেও সন্ধ্যার সময়ে মেঘহইতে বাহির হইয়া অতিশয় উজ্জ্বল রূপে অস্তগত হয়, তদ্রূপেই কোন২ খ্রীষ্টিয়ানেরা অনেকবার পরীক্ষাতে পতিত হয়, এবং ধর্ম্মেতে বড় একটা সান্ত্বনা না পাইয়া মনের দুঃখ প্রযুক্ত চিন্তাতে কাল যাপন করে; কিন্তু নিদান সময়ে তাহাদের মেঘরূপ দুঃখ সকল উচ্ছিন্ন হইলে তাহার অতিশয় সাহস ও আহ্লাদযুক্ত হইয়া দেহ ত্যাগ করে। পুনশ্চ বর্ষাকালে যেমন সূর্য্য সমস্ত দিবস মেঘদ্বারা ঢাকা থাকে, এবং মেঘাচ্ছন্ন হইয়া অস্তগতও হয়; তেমনি কতকগুলিন খ্রীষ্টিয়ান লোক আছে, তাহারা ঈশ্বরের গুপ্ত সন্তান হইয়াও স্বভাবিক ভীরু প্রযুক্ত কিম্বা আর কোন কারণ বশতঃ জীবনাবস্থায় আপন ধর্ম্ম বড় প্রকাশ করে না বটে, কিন্তু সর্ব্বান্তর্যামি প্রভু তাহাদের মনের অভিপ্রায় জানেন ও তাহাদের নাম জীবন পুস্তকে লিখিয়া রাখেন। ফলতঃ সূর্য্য যে রূপে অস্ত হউক না কেন, সে যেমন পুনর্ব্বার অবশ্য উদিত হয়, সেইরূপে উক্ত প্রকার খ্রীষ্টাশ্রিত লোকসকলের যে পুনরুত্থান হইবে, ইহাতে সন্দেহ নাই।

 ফুলমণির গৃহে গমন কালে নদীর তীর দিয়া যাইতে হইল, তাহাতে আমি সেই নদীর বিষয় উক্ত রূপে ধ্যান করিতে২ চলিলাম। মনোমধ্যে এই প্রকার ভাবিলাম, যেমন গঙ্গা অত্যুচ্চ হিমালয় পর্ব্বতহইতে নামিয়া আসিতেছে, তেমনি ধর্ম্মাত্মা স্বর্গহইতে নামিয়া মনুষ্যদের মনে অবস্থিতি করেন। নদীর উনুই যেমন কখন শুষ্ক হয় না, সেই মত ঐ আত্মা মানুষের অন্তঃকরণে উনুই স্বরূপ হইয়া অনন্ত পরমায়ু পর্য্যন্ত উথলিয়া উঠেন। নদীর জলদ্বারা শরীর পরিষ্কার হয়

বটে, কিন্তু তাহা অন্তঃকরণেতে কিছুমাত্র সংলগ্ন হয় না, অতএব তাহাতে স্নান করিলে মনুষ্যদের পাপরূপ মলিনত্ব ধৌত হয় না; কিন্তু অন্তর্যামি পবিত্র আত্মা সর্ব্ব প্রকার পাপ মনুষ্যদের অন্তঃকরণহইতে পরিষ্কৃত করেন। পুনশ্চ নদীর জলদ্বারা যেমন ভূমি উর্ব্বরা হয়, তেমনি ধর্ম্মাত্মাদ্বারা খ্রীষ্টিয়ান লোকদের ধর্ম্মক্ষেত্র উর্ব্বরা হইয়া সৎকর্ম্মরূপ ফল উৎপন্ন করে। আরো যাহার ইচ্ছা হয় সে যেমন আসিয়া নদীর জল স্বচ্ছন্দে পান করিতে পারে, তদ্রূপে যে জন তৃষার্ত্ত হয় এবং যে কেহ ইচ্ছা করে সে আসিয়া বিনামূল্যে অমৃত জল গ্রহণ করুক। কোটি২ মনুষ্যের ও পশ্বাদির জীবন গঙ্গাজলদ্বারা যেমন রক্ষা পায়, তেমনি পাপেতে মৃতপ্রায় যে আমরা, আমরা ধর্ম্মাত্মাদ্বারা পরমায়ু প্রাপ্ত হই। গঙ্গার শ্রোত যেমন বাধা সকল উল্লঙ্ঘন করিয়া বেগবান্ হয়, তেমনি মনুষ্যদের অন্তঃকরণে যে মহা বাধা (অর্থাৎ পাপের প্রতি অনুরাগ) তাহা ধর্ম্মাত্মা দমন করিয়া মনকে ঈশ্বরের বশীভূত করান। অবশেষে, যেমন নদীর শ্রোত কিছুতে বাধিত না হইয়া মহাসাগরে গিয়া মিলিত হয়, তেমনি ধর্ম্মাত্মা মনুষ্যদের অন্তঃকরণে ধর্ম্ম সিদ্ধি করিয়া অনন্ত পরমায়ুরূপ সুখসাগরে তাহাদিগকে পৌঁহুছিয়া দেন।

 উক্ত বিষয় আন্দোলন করত চলিতে২ আমার পথশ্রম কিছুই বোধ হইল না, তাহাতে আমি প্রায় অজ্ঞাতসারে ফুলমণির গৃহে উপস্থিত হইলাম। পৌঁছিবামাত্র দুইটি ছেল্যা দৌড়িয়া আসিয়া আমাকে দ্বার খুলিয়া দিল। পরে তাহারা সেলাম করিয়া গৃহের মধ্যে শীঘ্র গিয়া আপন মাতাকে ডাকিতে লাগিল। ফুলমণি পূর্ব্বে যেরূপ আমাকে চৌকি আনিয়া দিয়াছিল, সেইরূপে তাহার কন্যাও চৌকি আনিয়া দিয়া আমার নিকটে দাঁড়াইল। বোধ হইল তৎকালে ঐ মেয়ার বয়ক্রম সাত বৎসর মাত্র। তাহার মুখ গোল আর অতিশয় প্রফুল্ল ও হৃষ্ট ছিল, এবং তাহার সুন্দর লম্বা কেশ উত্তমরূপে বাঁধা ছিল। আমি তাহার সুশীল ব্যবহার দেখিয়া বড় সন্তুষ্টা হইলাম; কারণ সে অন্য গ্রামস্থ বাঙ্গালি বালিকাদের ন্যায় পলায়ন না করিয়া আমার আয়াকে একটি পিঁড়া আনিয়া দিয়া শিষ্ট রূপে আমাদের সহিত আলাপ করিতে লাগিল।

 আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, তোমার নাম কি? তাহাতে সে বলিল, আমার নাম সত্যবতী, এবং আমি সর্ব্বদা সত্য কথা কহিতে চেষ্টা করি। ইহা শুনিয়া আমি বলিলাম, সত্যবতী অতিশয় সুন্দর নাম বটে, কিন্তু তোমার নামের সহিত যেন তোমার কথা মিলে, কেবল এই জন্যে কি তুমি সত্য কথা কহিয়া থাক? সে হাসিতে২ বলিল, না না, মেম সাহেব, এমত নয়। ঈশ্বর আমাদিগকে সত্য কথা কহিতে আজ্ঞা দিয়াছেন, এই জন্যে আমি সত্য কথা কহিয়া থাকি। তিনি বলিয়াছেন, “তাবৎ মিথ্যাবাদিরা অগ্নি ও গন্ধকের প্রজ্জ্বলিত হ্রদে নিক্ষিপ্ত হইবে।” প্রকাশিত ভবিষ্যদ্বাক্য। ২১।৮।

 আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, ধর্ম্মপুস্তকের ঐ কথাটি তোমাকে কে শিখাইল? সত্যবতী উত্তর করিল, পিতা শিখাইয়াছেন। রাত্রিকালে আমাদের আহার হইলে তিনি নিত্য২ আমাদিগকে ধর্ম্মপুস্তকের দুই একটি পদ শিখাইয়া স্পষ্টরূপে বুঝাইয়া দেন। বোধ হয়, সত্যতার বিষয়ে যত পদ আছে, সে সকল আমি মুখস্থ বলিতে পারি; এবং ঐ সকলের মধ্যে এই পদটি বড় ভাল বাসি, “আমিই পথ ও সত্যতা ও জীবন”। যীশু খ্রীষ্ট ইহা বলিলেন; এবং তাহার অর্থ পিতা আমাকে গত রবিবারে বুঝাইয়া দিয়াছেন। মেম সাহেব, আমরা যদি খ্রীষ্টকে ছাড়িয়া অন্য পথে চলি, তবে স্বর্গে না পৌঁছিয়া নরকে পড়িব।

 ঐ ছোট বালিকা এই কথা বলাতে তাহার ভাই ঘরের ভিতরহইতে বাহিরে আসিয়া কহিল, মেম সাহেব, মা ঘর লেপন করিতেছেন, তাহা সমাপন করিয়া এখনই আসিবেন, কেবল একটি কুঠারী লেপন করিতে বাকী আছে। আমি বলিলাম, তোমার মাতা সকল কর্ম্ম সাঙ্গ করিয়া আইলে উত্তম হয়; কিন্তু তোমার নাম কি? তাহা আমাকে বল।

 বালক উত্তর করিল, আমার নাম সাধু। সাধু আপন ভগিনীহইতে দুই তিন বৎসরের বড়, এবং তাহার মুখাবলোকন করিয়া অনুমান হইল সে বুদ্ধিমান্ বালক বটে।

 তখন সত্যবতী বলিতে লাগিল, মেম সাহেব, আমি যেরূপে সত্যতার বিষয়ে ধর্ম্ম পুস্তকের সকল প্রমাণ অভ্যাস করিয়াছি, সেইরূপে দাদা সাধুতার বিষয়ে সকল কথা শিক্ষিত হইয়াছেন। পাদরি সাহেবের মেম আমাদিগকে অদ্য বলিলেন, সাধুতা ও সত্যতা সর্বদা ভাই ও ভগিনীস্বরূপ বিখ্যাত হয়, তাহাদিগকে কোন মতে পৃথক করা যায় না। আহা, আমরা দুই জনে অত্যুত্তম নাম পাইয়াছি। ইহা বলিয়া সে উঠানের মধ্যে লম্ফ দিয়া বেড়াইতে লাগিল।

 ইহার পূর্ব্বে আমি অনেক বাঙ্গালির ছেল্যাদিগকে দেখিয়াছিলাম বটে, কিন্তু এমত সুমতি ও মিষ্টভাষী কাহাকেও দেখি নাই। তাহাতে আমার চক্ষু জলেতে পরিপূর্ণ হইল, এবং “হে পিতঃ, তুমি বালক ও দুগ্ধপোষ্য শিশুদের মুখদ্বারা আপন স্তব প্রকাশ করিয়াছ, এই জন্যে তোমার ধন্যবাদ করিতেছি,” এই শাস্ত্রীয় কথা আমার মনে তৎক্ষণাৎ উদয় হইল। কিন্তু সাধু ও সত্যবতী আমার অশ্রুজল না দেখিয়া যে পর্য্যন্ত তাহাদের মাতা না আইসে সেই পর্য্যন্ত আমি যাহাতে সন্তুষ্টা থাকি, কেবল এই চেষ্টা করিতে লাগিল।

 সাধু আমাকে বলিল, মেম সাহেব, ঐ দুষ্টা করুণা যে দিনে দিদির গাচটি নষ্ট করিল, বোধ করি সেই দিনে আপনি আসিয়াছিলেন। মাতা আপনকার বিষয়ে আমাদিগের নিকটে অনেক কথা বলিয়াছেন, এবং আপনিও আমার দিদির সমুদায় বৃত্তান্ত শুনিয়া থাকিবেন।

 আমি বলিলাম, হাঁ, আমি তাহা শুনিয়া অতিশয় সন্তুষ্টা হইয়াছিলাম, এই জন্যে তাহার গাচটির পরিবর্ত্তে আর একটি বিলাতীয় ফুলের চারা তোমার মাকে দিবার নিমিত্তে আনিয়াছি। এই কথা বলিয়া আমি চাপ্‌রাসিকে ভিতরে ডাকিয়া তাহার হাতহইতে ফুলের চারা লইয়া তাহাদিগকে দেখাইলাম, তাহাতে দুই জনে বড় সন্তুষ্ট হইয়া ফুলের অতিশয় প্রশংসা করিল।

 পরে সাধু বলিল, আইস সত্যবতি, আমরা দিদির শুষ্ক গাচটি ফেলিয়া দিয়া তাহার স্থানে এই টবটি রাখি, তাহা হইলে ইহা কোথাহইতে আইল তাহা সবিশেষ না জানিয়া মাতা বড় আশ্চর্য্যান্বিতা হইবেন।

 সত্যবতী উত্তর করিল, না না, সাধু, বিবি সাহেব যে চারা আনিয়াছেন তাহা অন্য টবের নিকটে রাখ; কিন্তু দিদির চারাটি কখন ফেলিয়া দেওয়া হইবেক না, কারণ মা তাহাকে বাঁচাইবার নিমিত্তে বড় চেষ্টা করিতেছেন, এবং আজি আমাদের পিতাকে বলিলেন, যদ্যপি এইটি শুষ্ক হইয়া থাকে, তথাপি আমি তাহাকে চিরকাল রাখিব, কেননা ইহার শুষ্ক শাখাদ্বারা আমার মনের চেতনা হইবে।

 সাধু জিজ্ঞাসা করিল, সে কি প্রকারে হইবে, মা কি তাহা বলিয়াছিলেন?

 সত্যবতী কহিল, হাঁ, মাতা বলিলেন, ঐ শুষ্ক গাচটিকে দেখিয়া পাপ করিতে আমার মনে ভয় জন্মিবে, পাছে আমি শুষ্ক শাখাস্বরূপ হইয়া অনির্ব্বাণ অগ্নিতে দগ্ধ হই। ইহা শুনিয়া সাধু অতি গভীর হইয়া বলিল, তবে সত্যবতি, দিদির চারাটি থাকুক; এই ভয়ানক উপদেশ আমাদেরও মনে রাখা কর্ত্তব্য, কারণ তুমি এবং আমি অনেকবার দোষ করিয়া থাকি।

 অতঃপর সত্যবতী উঠিয়া আয়াকে ডাকিয়া রন্ধনঘরে লইয়া গেল। পরে আমি সাধুকে বলিলাম, গতবারে এমত সন্ধ্যার সময়ে আমি আসিয়াছিলাম, তাহাতে দেখিলাম যে তোমার মাতার সকল কর্ম্ম সারা হইয়াছিল। অদ্য সে কি নিমিত্তে এত ব্যস্তা আছে?

 সাধু উত্তর করিল, মেম সাহেব, আজি শনিবার, এই নিমিত্তে মাতা ব্যস্তা আছেন। সপ্তাহের শেষ দিনে তাঁহাকে সর্ব্বদাই অনেক কর্ম্ম করিতে হয়, কারণ রবিবারে প্রায় কোন কর্ম্মই করেন না। আজি আমরা দুই প্রহরের সময়ে স্কুলহইতে ফিরিয়া আসিয়াছিলাম; ইহারি মধ্যে মাতা কি২ কর্ম্ম করিয়াছেন, তাহা আমি বলি। প্রথমে তিনি সত্যবতীকে পুষ্করিণীতে লইয়া বেসনদ্বারা মাথা ঘসিয়া দিলেন; পরে গৃহে আসিবার সময়ে আমাদের ধৌত বস্ত্র আনিবার জন্যে ধোপার নিকটে গেলেন। অনন্তর গৃহে আসিয়া মাতা দেখিলেন, পিতার চাদর ও আমার জামা ছিঁড়িয়া গিয়াছে, অতএব পরদিনে গীর্জায় যাইতে হইবে, এই নিমিত্তে তিনি সেই কাপড়গুলিকে তৎক্ষণাৎ সেলাই করিলেন। তাহা হইলে পর মাতা সত্যবতীর মাথায় তৈল দিয়া চুল সকল উত্তমরূপে বাঁধিয়া দিলেন। পরে উঠান ঝাঁটি দিয়া গৃহ লেপন করিতে আরম্ভ করিলেন, সে কর্ম্ম এখনও শেষ হয় নাই। পিতা কখন২ মাতাকে বলেন, শনিবারে অনেক কর্ম্ম হয়, এই জন্যে আর কোন দিনে গৃহ লেপন করাই ভাল; কিন্তু মাতা শনিবারে তাহা করিতে চাহেন, কেননা রবিবারে গীর্জার পরে কতকগুলিন পুরুষ এখানে আসিয়া দাবায় বসিয়া

পাদরি সাহেবের উপদেশ কথার ভাব পরস্পর বিবেচনা করে, ও দুই একটি গান গায়, পরে জলপানাদি করিয়া বিদায় হয়। ঐ লোকেরা যেন সকলি পরিষ্কার ও পরিপাটি দেখিতে পায়, এই অভিপ্রায়ে মাতা শনিবারে তাবৎ ঘর লেপন করেন; কেননা তিনি বলিয়া থাকেন, ভাল গৃহিণী হওয়া খ্রীষ্টিয়ান স্ত্রীলোকদের অবশ্য কর্ত্তব্য।

 এমন সময়ে ফুলমণি আপনি উপস্থিতা হইল, তাহাতে সাধু সত্যবতীর নিকটে রন্ধনশালায় গেল। ফুলমণির শাড়ি পূর্ব্বাপেক্ষা কিছু মলিন ছিল, এবং বোধ হইল সে তখন বড় শ্রান্তা হইয়াছে, তথাপি সে আমাকে সেলাম করিয়া হৃষ্টচিত্তে বলিল; মেম সাহেব, আজি যদি শনিবার না হইত, তবে আমি সকল কর্ম্ম ছাড়িয়া আপনকার নিকটে আসিতাম; কিন্তু আপনি জানেন যে শনিবারে কর্ম্ম সমাপ্ত না করিলেই নয়।

 আমি বলিলাম, হাঁ ফুলমণি, এ অতিশয় ভাল রীতি বটে, এই রীতি পালন করিলে রবিবারে ঈশ্বরের আজ্ঞানুসারে বিশ্রাম করা যায়। এখন সত্য করিয়া বল, তোমার সমস্ত কার্য্য শেষ হইয়াছে কি না? যদি না হইয়া থাকে, তবে আমি অন্য দিন আসিয়া তোমার সহিত কথোপকথন করিব। এখন তুমি যাইয়া কর্ম্ম কর, এবং তোমার সন্তানদিগকে আমার নিকটে পুনর্ব্বার পাঠাইয়া দেও। আমি তাহাদের কথা শুনিয়া অতিশয় সন্তুষ্টা হইয়াছি।

 ফুলমণি বলিল, আপনি যদি অনুমতি দিলেন, তবে তাহাই করি; কারণ কল্যের নিমিত্তে এখন ব্যঞ্জন রন্ধন হয় নাই।

 আমি জিজ্ঞাসিলাম, তুমি কল্যের জন্যে কি ব্যঞ্জন পর্য্যন্ত আজি রাঁধিয়া রাখিবা?

 ফুলমণি বলিল, হাঁ মেম সাহেব, যে কর্ম্ম শনিবারে করা যায়, তাহা ফেলিয়া রাখিব কেন? আমরা প্রত্যেক শনিবারে কিছু মাংস বা মৎস্য কিনিয়া রাখি, এবং এখন শীতকাল প্রযুক্ত তাহা এক দিন রন্ধন করিলে পর দিবস পর্য্যন্ত ভাল থাকে। গ্রীষ্মকালে তাহা করা যায় না; অতএব সে সময়ে কেবল শাক ডালাদি শনিবারে কিনিয়া রাখিতে হয়। আর কি করিব? রবিবারে রাঁধিয়া দিই, কিন্তু সে দিনে বাজার হাট আমরা কোন রূপে করি না।

 ইহা বলিয়া ফুলমণি রন্ধন গৃহে যাইতেছিল, এমন সময়ে তাহার দৃষ্টি আমার বিলাতীয় ফুলচারাটির উপরে পড়িল; তাহাতে সে আমার প্রতি ফিরিয়া বলিল, সেলাম মেম সাহেব, বোধ করি আপনি এই সুন্দর ফুলগাচটি আমাকে আনিয়া দিয়াছেন। আহা! সুলেমান এত ঐশ্বর্য্যবান্ হইলেও ইহার ন্যায় বিভূষিত ছিলেন না। ইহা বলিয়া সে যাইয়া আয়াকে ও ছেল্যাদিগকে আমার নিকটে পাঠাইয়া দিল।

 তাহারা আসিবা মাত্র আয়া বলিতে লাগিল, মেম সাহেব, এই ছেল্যারা আমাকে খ্রীষ্টিয়ান করিতে চেষ্টা করিতেছিল। তাহাতে আমি ছেল্যাদের প্রতি ফিরিয়া হাসিয়া বলিলাম, তোমরা আমার আয়াকে কি করিলা? বোধ করি ইহাকে তোমাদের কিঞ্চিৎ সুব্যঞ্জন জোর করিয়া খাওয়াইতে চাহিয়াছিলা?

 আয়া বলিল, না না, মেম সাহেব, ইহারা সেরূপ ব্যবহার করে নাই; বরং একটি নূতন হুকা আনিয়া তাহাতে তামাক সাজিয়া আমাকে খাইতে দিল, আর খ্রীষ্টিয়ানদের শাস্ত্রহইতে অত্যুত্তম কথা বলিয়া তাহা আমাকে স্পষ্টরূপে বুঝাইয়া দিয়াছে।

 তখন আয়া সত্যবতীর প্রতি ফিরিয়া বলিল, সত্যবতি, তুমি যে কথা আমার সাক্ষাতে বলিলা, তাহা আমার মেম সাহেবকে বল দেখি, তিনি একবার শুনুন।

 তাহাতে সত্যবতী কহিল, মেম সাহেব, আয়া এই কথাটি শুনিয়া বড় সন্তুষ্টা হইল, যথা, “মিত্রদের নিমিত্তে আপনার প্রাণ দান পর্য্যন্ত যে প্রেম তদপেক্ষা আর বড় প্রেম কাহারো নাই;” আর “যে২ আজ্ঞা আমি দিতেছি তাহা যদি পালন কর, তবে তোমরাই আমার মিত্রগণ।”

 যীশু খ্রীষ্ট কি প্রকারে পাপি লোকদের প্রায়শ্চিত্ত করিলেন, আয়া তাহা আমার নিকটে অনেকবার শুনিয়াছিল, তথাপি তাহাতে বড় একটা মনোযোগ করে নাই; কিন্তু এখন ঐ কথা শিশুদের মুখে শুনিয়া সে চিন্তিত ও গম্ভীর হইয়া বসিল, তাহাতে বোধ হইল যে খ্রীষ্টের উক্ত বচন তাহার মনে দৃঢ়রূপে লাগিয়াছিল। আমি দেখিলাম তাহার চক্ষু জলেতে ছল্২ করিতেছে, কিন্তু সে আপনার কোন কথা বলিতে না পারিয়া আমাকে কহিল, মেম সাহেব, আপনি এই ছেল্যাদের সহিত ধর্ম্ম বিষয়ে কথোপকথন করুন।

 সপ্তাহের শেষ দিনে এই ধার্ম্মিক পরিবার যেরূপ ব্যবহার করিত, তাহা জ্ঞাত হইয়া আমি বড় সন্তুষ্টা হইয়াছিলাম, অতএব তাহারা কি প্রকারে রবিবার পালন করে, ইহাও শুনিতে বড় ইচ্ছুক হইলাম। এই জন্যে আমি সাধুকে বলিলাম, সাধু, বিশ্রামদিনে প্রাতঃকালাবধি সন্ধ্যা পর্য্যন্ত তোমরা কি করিয়া থাক, তাহা আমাকে বল।

 সাধু উত্তর করিল, মেম সাহেব, যদি প্রথম অবধি শুনিতে চাহেন, তবে অগ্রে শনিবারের রাত্রির কথা বলিতে হয়; কেননা পিতা কহিয়া থাকেন, শনিবার রাত্রিতে আমাদের বিশ্রাম দিবসের আরম্ভ হয়। শনিবারে সন্ধ্যাকালে মাতার তাবৎ কর্ম্ম সাঙ্গ হইলে পর, আমরা সকলে বসিয়া কএকটি গান গাই। পরে পিতা ঈশ্বরের স্থানে এইরূপ প্রার্থনা করেন, হে পরমেশ্বর, তুমি আপন বাক্য ফলবান্ কর, ও লোকেরা কল্য যে২ উপদেশ কথা শুনিবে, তাহা তাহাদের মনে দৃঢ়রূপে রোপিত করিয়া দেও। এবং বিশেষরূপে আমাদের পাদরি সাহেবের প্রতি প্রসন্ন হও, ও আমাদের মণ্ডলীর প্রতি আশীর্ব্বাদ কর।

 মাতা রবিবারে অতি প্রত্যূষে ভাত রাঁধিয়া দেন, পরে আমাদের খাওয়া হইলে পর পিতা পুনর্ব্বার প্রার্থনা করেন। তখন আমরা সকলে পরিষ্কার কাপড় পরিয়া দ্বারে চাবি দিয়া গীর্জাতে যাই। গীর্জা সাঙ্গ হইলে পর, যেমন পূর্ব্বে বলিয়াছিলাম, কএক জন পুরুষ হেথায় উপদেশের বিষয়ে কথোপকথন করিতে আইসে। এমত সময়ে সত্যবতী এবং আমি ধর্ম্মপুস্তকের একটি পদ আর একটি গান অভ্যাস করি। সকল লোক গৃহে গেলে পরে, পিতা আমাদের পড়া শুনেন, ও ধর্ম্মপুস্তকের কথা বড় স্পষ্টরূপে বুঝাইয়া দেন; অথবা যূষফ বা দানিয়েল কিম্বা শিমুয়েল ইত্যাদির ইতিহাস বলেন। এই জন্যে আমরা রবিবারকে অন্য সকল দিবসহইতে অতিশয় প্রিয় জ্ঞান করি।

 তখন আমি এই কথা শুনিয়া মনের মধ্যে ভাবিলাম, হায়! বাঙ্গালাদেশে যদ্যপি এই পরিবারের মত সকল খ্রীষ্টিয়ান লোক ধার্ম্মিক হইত, তবে দেব পূজকদের মধ্যে আমাদের ধর্ম্ম অবশ্য সুগ্রাহ্য হইতে পারিত। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই, যে অনেক ভাক্ত খ্রীষ্টিয়ান লোকেরা হিন্দু ও মুসলমানদের ন্যায় মন্দ আচার ব্যবহার করিয়া খ্রীষ্টের নামে কলঙ্ক দেয়।

 পরে আমি সত্যবতীর প্রতি ফিরিয়া বলিলাম, ভাল সত্যবতী, পড়া সাঙ্গ হইলে তোমরা রবিবারে আর কি২ কর, তাহা তুমি আমাকে বল।

 সে উত্তর করিল, পাঁচ ঘণ্টার সময়ে পিতা ও ভ্রাতা পুনর্ব্বার গীর্জায় যান, কিন্তু মাতা গৃহে থাকিয়া অন্ন পাক করেন। পরে আমি আপন ছোট ভাই প্রিয়নাথকে লইয়া বেড়াই; সে আমাকে বড় ভালবাসে, এবং আমাকে দেখিয়া করতালি দেয়। পিতা গীর্জাহইতে সাত ঘণ্টার সময়ে আইসেন, পরে ভোজনাদি সাঙ্গ হইলে আমরা আরবার গান গাই, কিম্বা দাদা যাত্রিকের যাত্রাপুস্তক পড়েন, আমরা সকলে বসিয়া শুনি। শেষে প্রার্থনা করিয়া শয়ন করিতে যাই।

 ইহা শুনিয়া আমি বলিলাম, ভাল, তোমাদের পিতা তোমাদিগকে ধর্ম্মের বিষয়ে কিরূপে শিক্ষা দেন, আমি তাহা জানিতে বড় ইচ্ছুক আছি; অতএব এই স্থানে যদি কোন রবিবারে তাহা শুনিতে আইসি, তবে কি তিনি অসন্তুষ্ট হইবেন?

 সাধু বলিল, না মেম সাহেব, পিতা তাহাতে বড় আহ্লাদিত হইবেন; কিন্তু বোধ হয়, আপনার সাক্ষাতে আমাদিগকে পড়াইবেন না। আপনি যেন আমাদিগকে শিক্ষা দেন, তিনি এমত প্রার্থনা করিবেন, আমি তাহা নিশ্চয় জানি।

 সত্যবতী বলিল, ও দাদা! তাহা হইলে বড় উত্তম হয়। পরে সে আমার প্রতি চাহিয়া কহিল, আপনি বড় ভাল বিবি; আমি আপনার নিকটে একবার পড়া দিতে চাহি, কিন্তু তাহা কি প্রকারে হইবে? আপনি তো বাঙ্গালা পড়িতে পারেন না।

 তাহাতে আমি হাসিয়া জিজ্ঞাসিলাম, হা সত্যবতী, এমত কথা তোমাকে কে বলিল? যদি তোমা অপেক্ষা আমি ভাল পড়িতে পারি, তবে কি হয়?

 সত্যবতী এই কথাতে কিঞ্চিৎ লজ্জিতা হইয়া উত্তর দিল, আমি মনে করিয়াছিলাম যে কেবল পাদরিদের বিবিরাই বাঙ্গালা পড়া শিক্ষা করেন, কিন্তু আপনি তো পাদরির বিবি নহেন।

 আমি বলিলাম, একথা সত্য বটে, কিন্তু যদ্যপি পাদরির মেম নহি, তথাপি আমি বাঙ্গালিদিগকে বড় দয়া করি, এবং যেন তাহাদিগকে শিক্ষা দিতে পারি এই জন্যে অতিশ্রমপূর্ব্বক বাঙ্গালি ভাষা শিক্ষা করিয়াছি। অতএব তুমি যেমন ইচ্ছা করিলা, তেমনি আমি এক দিন আসিয়া তোমার পাঠ শুনিব। তখন আমি কেমন পণ্ডিত, তাহা তুমি জানিতে পারিবা। কিন্তু বড় বিলম্ব হইল, এখন আমাকে গৃহে যাইতে হইবে; ইহা বলিয়া আমি শিশুদের হাতে একটি২ সিকি দিলাম, তাহাতে তাহারা বড় সন্তুষ্ট হইয়া গ্রামের সকল কুকুর তাড়াইয়া দিতে২ প্রান্তভাগ পর্য্যন্ত আমাকে রাখিয়া গেল।

 সেই রাত্রিতে আমি শয়নকালে এমত প্রার্থনা করিলাম; ওহে পরমেশ্বর! প্রভুর দিনেতে আমি আত্মাতে আবিষ্ট হইয়া যেন উঠি, আমার প্রতি এই অনুগ্রহ কর। এবং যত দিন পর্য্যন্ত স্বর্গের অক্ষয় সুখ ভোগ করিতে না পাই, তত দিন পর্য্যন্ত এই সংসারে বিশ্রাম দিবস উত্তমরূপে পালন করিতে আমাকে শক্তি দেও।