ফুলমণি ও করুণার বিবরণ/তৃতীয় অধ্যায়
তৃতীয় অধ্যায়।
পর দিবস প্রত্যূষে আয়া আসিয়া আমাকে এই সমাচার দিল; মেম সাহেব, খ্রীষ্টিয়ানদের পল্লীহইতে এক জন স্ত্রীলোক আসিয়া বলিতেছে, মেমের নিকটে আমার একটি নিবেদন আছে। কিন্তু মেম সাহেব যে খ্রীষ্টিয়ান লোকদিগকে কল্য দেখিয়াছিলেন, এ ব্যক্তি তাহাদের মত নয়। এতো বড় ময়লা ছেঁড়া কাপড় পরিয়া আসিয়াছে, এই জন্যে তাহাকে ভিতরে না অনিয়া বারাণ্ডায় বসিতে বলিয়াছি। আমি আয়াকে কহিলাম, ভাল করিলা, আমি তথায় গিয়া তাহার সহিত কথা কহিব। পরে বারাণ্ডায় উপস্থিত হইয়া দেখিলাম, যে স্ত্রীলোকের সঙ্গে ফুলমণির গৃহে প্রথমবার সাক্ষাৎ হইয়াছিল, সেই বসিয়া আছে।
করুণা আমাকে অন্বেষণ করিতেছে ইহা দেখিয়া আমি প্রথমে আশ্চর্য্য জ্ঞান করিলাম, কিন্তু শেষে শুনিলাম যে সাধু ও সত্যবতী আহ্লাদ প্রযুক্ত আমার দত্ত দুই সিকি পাড়ার মধ্যে সকল লোককে দেখাইয়াছিল, তাহাতে করুণা মনে করিল, আমি যদি মেম সাহেবের নিকটে গিয়া দুঃখ জানাই, তবে অবশ্য কিছু পাইব। এমত মনে ভাবিয়া সে আমাকে দেখিবামাত্র বড় কাঁদিয়া কহিতে লাগিল, মেম সাহেব, আপনি দুঃখি লোকদের মা বাপ, আপনি আমাদের আশ্রয়, আপনি ব্যতিরেকে জগতে আমাদের আর কেহ নাই। দেখুন আপনি কল্য ধনি লোকের ছেল্যাদের প্রতি দয়া করিলেন; আমি দীন দুঃখি লোক অতএব আমার প্রতিও কিছু মনোযোগ করিতে হইবে।
করুণার এই সকল দুঃখের কথা শুনিয়া আমিও দুঃখিতা হইলাম; কিন্তু ফুলমণির সহিত পূর্ব্বে তাহার যে কথা হইয়াছিল, তাহা স্মরণ করিয়া অনুমান করিলাম, করুণা অবশ্য অলসা স্ত্রী, এবং আপন দোষ প্রযুক্ত সে এরূপ দুর্দশাতে পতিত হইয়াছে। আরও ভাবিলাম, যদি আমি এখন বিবেচনা না করিয়া এবং বিশেষ না জানিয়া এই খ্রীষ্টিয়ান লোকদের টাকা দিতে আরম্ভ করি, তবে তাহাদের উপকার না হইয়া বরং ক্ষতি হইবে; কারণ তদ্দ্বারা তাহাদের মধ্যে হিংসা ও লোভ অবশ্য জন্মিতে পারিবে।
ইহা বুঝিয়া আমি করুণাকে বলিলাম, দেখ করুণা, তুমি যে এই স্থানে রবিবারে এমত মলিন কাপড় পরিয়া আসিয়াছ, ইহাতে আমি বড় অসন্তুষ্টা হইলাম, কারণ এখন গীর্জা যাইবার জন্যে প্রস্তুত হওয়া তোমার উচিত ছিল। আরও বলি, প্রতিবাসিদের নিকটে তোমার আচার ব্যবহারের বিষয়ে তত্ত্ব না করিলে আমি তোমাকে কিছু ভিক্ষা দিতে পারিব না।
করুণা এই কথা শুনিয়া আর একবার কাঁদিয়া বলিতে লাগিল; ও মেম সাহেব, আমি বড় দুঃখি লোক, আমার স্বামী আছে বটে, কিন্তু সে দুষ্ট ও মাতাল। যদ্যপি সে ছুতার মিস্ত্রির কর্ম্মেতে বড় নিপুণ, এবং কর্ম্ম করিলে প্রতিদিন স্বচ্ছন্দে চারি আনা পয়সা উপায় করিতে পারে, তথাপি সে এমত অলস যে আমাকে কখন কিছু আনিয়া দেয় না। আর দেখ, মেম সাহেব, আপনি যদি ময়লা কাপড়ের বিষয়ে দোষ দেন, তবে বলিতে হয়, এই বস্ত্র ব্যতিরেকে আমার কেবল একখান মোটা শাড়ি আছে, সেখানি পয়সা না থাকাতে প্রায় এক মাস পর্য্যন্ত ধোপার ঘরে পড়িয়া আছে।
তখন আমি এই কথা শুনিয়া বলিলাম, করুণা, তুমি যদি একটি পয়সার অভাব প্রযুক্ত পরিষ্কার কাপড় পরিতে পাও না, তবে আমি সে পয়সাটি তোমাকে দিই। তুমি ধোপার নিকটে গিয়া ধৌত শাড়ি পরিয়া শীঘ্র গীর্জায় যাও। কিন্তু করুণার মুখ দেখিয়া বোধ করিলাম, তাহার গীর্জায় যাইবার ইচ্ছা ছিল না। সে পয়সাটি হাতে করিয়া বলিতে লাগিল, ও বিবি সাহেব, দয়া করিয়া আমাকে আর কিছু দেও। ঘরেতে আমার একটি সন্তান বড় পীড়িত আছে, এবং তাহাকে কোন খাদ্যদ্রব্য আনিয়া দি, এমত আমার কিছু সঙ্গতি নাই।
পরে আমি বলিলাম, এ বড় দুঃখের বিষয় বটে। এ কথা আমাকে পূর্ব্বে জানাইলা না কেন? তখন আমি একটি রুটী ও কিছু মিসরী ও সাগুদানা তাহার হাতে দিয়া কহিলাম, এখন শীঘ্র গৃহে যাইয়া এই সকল তোমার ছেল্যাকে খাইতে দেও; এবং কল্য সন্ধ্যাকালে আমি আপনি পাড়ায় গিয়া কি প্রকারে তোমার উপকার করিতে পারি, তাহা বিবেচনা করিব।
ইহা শুনিয়া করুণা অসন্তুষ্ট চিত্তে চলিয়া গেল; তাহাতে আমি বোধ করিলাম রুটী ও মিসরীর পরিবর্ত্তে যদি তাহাকে কিছু পয়সা দিতাম, তবে সে অধিক আহ্লাদিতা হইত। কিন্তু বিশ্রামদিবসে যেন তাহাকে কোন দ্রব্য ক্রয় করিতে না হয়, এই জন্যে আমি তাহাকে পয়সা না দিয়া উক্ত দ্রব্য সকল দিলাম।
পর দিবসে আমি প্রতিজ্ঞানুসারে খ্রীষ্টিয়ান গ্রামে উপস্থিতা হইলাম, এবং কিঞ্চিৎ কাল অনুসন্ধান করিয়া করুণার বাটীর উদ্দেশ পাইলাম। হায়২! ফুলমণির গৃহ এবং করুাণার গৃহ এ দুইয়ের কত বিশেষ দেখিলাম। করুণার উঠানের মধ্যে একটি ছোট রান্না ঘর ছিল বটে, কিন্তু তাহার চাল সমস্ত ভাঙ্গিয়া পড়াতে উনুন ও রন্ধন করিবার দ্রব্য সকল বড় গৃহের দাবায় রাখিয়াছিল। আমার আগমনের পূর্ব্বে করুণা অন্ন পাক করিতেছিল, তাহাতে ধূঁয়া প্রযুক্ত আমি গৃহের মধ্যে প্রবেশ করিতে না পারিয়া দেখিলাম সে গৃহও ভগ্নপ্রায় হইয়াছে। তাহার উঠান্টি বড় অপরিষ্কার ছিল, তথাপি আমাকে সেইখানে দাঁড়াইয়া থাকিতে হইল; কেননা করুণা বলিল, মেম সাহেব, আমার যে মোড়াটি ছিল, তাহা আজি ছেল্যারা ভাঙ্গিয়া ফেলিয়াছে।
যদ্যপি করুণা এমত দুঃখিতা ছিল, যে প্রায় আপনার পরিবারের আহারাদি যোগাইতে পারিত না, তথাপি তাহাদের ঘরে একটি নেড়ি কুকুর পোষা ছিল। সে আমাকে দেখিয়া উচ্চৈঃস্বরে ডাকিতে লাগিল, তাহাতে কিছু কাল পর্য্যন্ত কুকুরের শব্দ বিনা আর কিছু শুনা গেল না। শেষে করুণা তাহাকে বিস্তর ধম্কাইয়া চুপ করাইলে পর আমি বলিলাম; করুণা, তুমি আজি আমার অপেক্ষাতে ছিলা, ইহাতে বোধ করিয়াছিলাম যে তুমি আপন ঘরটিকে কিছু পরিষ্কার করিয়া রাখিবা। আরো জিজ্ঞাসিলাম, তোমার ধৌত শাড়ি কোথায়? তুমি যে ময়লা কাপড় পরিয়া আমার গৃহে গিয়াছিলে, এখন সেই কাপড় তোমার গায়ে দেখিতেছি।
করুণা উত্তর করিল, মেম সাহেব, আপনি যে পয়সাটি দিয়াছিলেন, তাহাতে পান তামাকু কিনিয়া আনিলাম। কাপড়ের দুই এক দিন বিলম্ব হইলে ক্ষতি নাই; কিন্তু আমরা তামাক্ না খাইলে মারা পড়ি।
আমি কহিলাম, তোমাদের তামাক্ খাওয়াটা বড় মন্দ; কিন্তু সে এক প্রকার ক্ষুদ্র বিষয়। তুমি যে বিশ্রামবারে ঈশ্বরের আজ্ঞা লঙ্ঘন করিয়া বাজারে গিয়াছিলা, ইহা শুনিয়া আমি বড় দুঃখিতা হইলাম।
করুণা বলিল, মেম সাহেব, আমরা দুঃখি লোক, পেটে খাইতে পাই না; তাহাতে ধর্ম্মকর্ম্ম কি প্রকারে করিব? এবং আমি যে একালা রবিবার দিনে হাট বাজার করি, তাহা তো নয়; এমত আর দশ জন খ্রীষ্টিয়ান লোককে দেখাইয়া দিতে পারি।
আমি বলিলাম, হইতে পারে; তথাপি দশ জন যাহা করে তাহাই করা উচিত নহে। তুমি যদি ঐ দশ জনের মতে না চলিয়া তোমার প্রতিবাসিনী ফুলমণির মতে চলিতা, তবে ভাল হইত।
করুণা বলিল, ও মেম সাহেব, ফুলমণিতে ও আমাতে অনেক বিশেষ আছে, তাহার মত মানুষ পাওয়া ভার। এবং আর একটি কথা আছে; তাহারা ধনি লোক, তাহাদের কাপড়ের ও টাকা কড়ির অভাব নাই, তাহাতে তাহারা স্বচ্ছন্দে শনিবারে সকল দ্রব্য কিনিয়া রাখিয়া রবিবারে পরিষ্কার কাপড় পরিয়া গীর্জায় যাইতে পারে।
আমি কহিলাম, দেখ করুণা, এখন তুমি দুইবার আমার সাক্ষাতে ফুলমণিকে ধনি লোক বলিলা। তাহার স্বামী কেবল সাত টাকা মাহিনা পাইয়া থাকে; তবে তাহারা কি প্রকারে ধনী হইল? কিন্তু সে পরিবার কেমন করিয়া এমত সুখে কাল কাটায়, তাহা আমি সুন্দররূপে জ্ঞাতা আছি; অর্থাৎ সে ফুলমণির পরিশ্রম ও পরিমিত ব্যায়ের দ্বারা হয়, বিশেষতঃ স্পষ্টরূপে বোধ হইতেছে যে ঈশ্বরের আশীর্ব্বাদ তাহার উপরে বর্ত্তিয়াছে। ঈশ্বর আপন আজ্ঞা পালনকারি ইস্রায়েল লোকের প্রতি যে অঙ্গীকার করিয়াছিলেন, সেই অঙ্গীকার ফুলমণির প্রতি সফল হইয়াছে; যথা “তোমরা চুপড়িতে ও রুটীর পাত্রে আশীর্ব্বাদ পাইবা।” দ্বিতীয় বিবরণ ২৮।৫। ফুলমণি ঈশ্বরের আজ্ঞা সকল পালন করিয়া তাঁহার বাকেতে অতি যত্নপূর্ব্বক মনোযোগ করে, এই জন্যে সে আশীর্ব্বাদ পায়। যীশু খ্রীষ্ট সত্য বলিয়াছেন, যথা “প্রথমে ঈশ্বরের রাজ্য ও ধর্ম্মের বিষয়ে সচেষ্ট হও, তাহা হইলে আর সকল দ্রব্য তোমাদিগকে দত্ত হইবে।” মথি ৬।৩৩।
করুণা কহিল, হাঁ মেম সাহেব, এমত হইতে পারে বটে, কিন্তু আমার দশাপেক্ষা ফুলমণির দশা সর্ব্বপ্রকারে ভাল। দেখুন, তাহার স্বামী কেমন ধার্ম্মিক লোক, কিন্তু আমার স্বামী দুষ্ট ও বড় মাতাল! ও মেম, সে আমাকে যে দুঃখ দেয়, তাহা যদি আপনি দেখিতেন, তবে আমার প্রতি আপনকার মনে কিছু দয়া হইত।
ইহা শুনিয়া আমি করুণার প্রতি বড় দুঃখিতা হইয়া বলিলাম, দেখ করুণা, তোমার স্বামী যদি তোমাকে দুই একটি কঠিন বাক্য কহে, তবে কোন প্রকারে তাহা সহ্য করিতে হইবে; কেননা বিবাহিত স্বামীহইতে তোমাকে কেহ পৃথক করিয়া দিতে পারিবে না। কিন্তু সে যাহা হউক, তোমার পীড়িত সন্তান কেমন আছে? তাহা আমাকে বল।
এই কথাতে করুণা কিছু ভয় পাইল, পরে সে কহিল, মেম সাহেব, আজি সে কিঞ্চিৎ ভাল আছে; এজন্যে আমি তাহাকে অনেকবার বারণ করিলেও সে বাহিরে খেলা করিতে গিয়াছে। মেম সাহেব, সে বড় চঞ্চল বালক, কাহারো কথা মানে না।
আমি বলিলাম, কল্য সে অতিশয় পীড়িত ছিল, আজি খেলা করিতে বাহিরে গিয়াছে, এই কথাতে আমার বড় আশ্চর্য্য বোধ হইতেছে। হায় করুণা! বোধ হয় তুমি এই বিষয়ে আমার নিকটে সম্পূর্ণরূপে সত্য কথা কহ নাই।
করুণা লজ্জিতা হইয়া উত্তর করিল, মেম সাহেব, গত মাসে তাহার কেমন শক্ত ব্যামোহ হইয়াছিল, তাহা সকলেই জানে; কিন্তু এখন ঈশ্বরের অনুগ্রহেতে সে কিঞ্চিৎ ভাল আছে বটে।
করুণা এই কথা কহিতেছে, এমত সময়ে একটি ছোট বালক গৃহের ভিতরে দৌড়িয়া আইল। তাহার বর্ণ অতিশয় কাল, এবং ধূলা ও কাদাতে খেলা করিয়া আসিয়াছিল, এই জন্যে তাহাকে আরও মলিন বোধ হইল। সে প্রায় উলঙ্গ, কেবল তাহার কোমরে এক খানি ছেঁড়া কানি বাঁধা ছিল। ঐ ছেল্যাকে দেখিয়া তাহার মা তাহাকে হঠাৎ বলিল, নবীন এখানে আসিয়া মেম সাহেবকে সেলাম কর। এই মেম সাহেব অতিশয় দয়ালু; ইনি কল্য তোমাকে রুটী ও মিসরী পাঠাইয়া দিয়াছিলেন। কিন্তু নবীন আপন মাতাকে উত্তর করিল, আমি মেম সাহেবকে কেন সেলাম করিব? তুমি তো তাঁহার রুটী ও মিসরী আমাকে খাইতে দিলা না।
তাহাতে আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, এই কেমন কথা! তবে সে রুটী কি হইল? নবীন তাড়াতাড়ি করিয়া কহিল, মেম সাহেব, আমার নিকটে শুন, আমি তোমাকে বলি। বকুল নামে এক জন স্ত্রী এই পাড়াতে থাকে, তাহার মেয়ার ব্যামোহ হইয়াছে, এই জন্যে সে দুই পয়সা দিয়া মায়ের নিকটে ঐ রুটী কিনিয়া লইল; এবং মা সেই পয়সাতে তখনই তামাক্ কিনিয়া আনিল। ও মেম সাহেব, তুমি যদি তাহার তামাক্ খাওয়া দেখ, তবে আশ্চর্য্য জ্ঞান করিবা। সমস্ত দিন তাহার আর কোন কর্ম্ম নাই, এবং রাত্রির মধ্যে সে আমাকে এক শত বার জাগাইয়া বলে, তামাক্ সাজ্২, এই কারণে পিতার নিকটে কত বার মার খাইয়াছে, তবু তাহার জ্ঞান হয় না।
বালকের এই সকল কথাতে তাহার মাতা বড় রাগান্বিতা হইয়া তাহার গালে শক্তরূপে একটা চড় মারিয়া বলিল, নবীন, তুই বড় মিথ্যা কহিস্। কিন্তু আমি ভালরূপে মনে২ জানিলাম, যে নবীন সত্য কথা বলিল, করুণা কেবল আপন দোষ লুকাইবার নিমিত্তে আমার সাক্ষাতে তাহাকে শাস্তি দিল।
মায়ের এবং সন্তানের পরস্পর এমত অনুচিত ব্যবহার দেখিয়া আমি প্রায় নিরাশ হইয়া বোধ করিলাম, এই ব্যক্তিরা বুঝি কখন ধর্ম্ম পথে চলিবে না; কিন্তু তখন পরমেশ্বরের এই বাক্য আমার স্মরণে হইল, “আমি লোকদের প্রস্তরময় অন্তঃকরণ দূর করিয়া তাহাদিগকে নম্র অন্তঃকরণ দিব, তাহাতে তাহারা আমার লোক হইবে।” যিহিষ্কেল ১১।১৯। এই দয়ালু অঙ্গীকারদ্বারা কিঞ্চিৎ আশ্বাস পাইয়া স্থির করিলাম যে আমি করুণাকে এখন কোন প্রকারে ত্যাগ করিব না, বরং উপদেশ ও প্রার্থনাদ্বারা তাহাকে ধর্ম্মের পথ অবলম্বন করাইতে সাধ্য পর্য্যন্ত যত্ন করিব।
এমত মনে করিয়া আমি প্রথমে তাহাকে জিজ্ঞাসিলাম, করুণা, তুমি কোন কর্ম্ম করিতে পার কি না? সে উত্তর করিল, মেম সাহেব, আমরা গৃহস্থ লোক, কি কর্ম্ম করিব? আমি পুনর্ব্বার জিজ্ঞাসিলাম, তুমি কি বস্ত্রাদি সিলাই করিতে পার? করুণা কহিল, হাঁ, মোটা সিলাই কিছু২ করিতে পারি।
আমি কহিলাম, যদি এমত হয় তবে এখনি তোমাকে কর্ম্ম দিতে পারি। শনিবারে আমি ৭২ খানা ঝাড়ন কিনিয়াছি, দরজীকে তাহা দিলে সে সিলাই করিতে প্রত্যেকে এক পয়সা করিয়া লইবে; কিন্তু তুমি যদি তাহা সিলাই কর, তবে আমি তোমাকে প্রত্যেক ঝাড়নেতে দুই পয়সা করিয়া দিব, সর্ব্বশুদ্ধ ২৷৷৹ নয় সিকা হইবে, তাহা লইয়া তুমি দুইখান উত্তম শাড়ি কিনিতে পারিবা।
ইহা শুনিয়া করুণা কহিল, আপনি ধনবান্ লোক, দীনহিনকে একটা টাকা অমনি ফেলিয়া দিলে আপনকার কিছু ক্ষতি হইবে না। আমি যে সিলাই করিয়া পয়সা রোজগার করিব, এমত আমার অবকাশ নাই, এখন যদি ঘরের কর্ম্ম সকল সামলাইতে পারি না, তবে সিলাই করিতে গেলে খাওয়া দাওয়া একেবারে ত্যাগ করিতে হইবে।
তাহাতে আমি বলিলাম, ভাল করুণা, যেমন তোমার ইচ্ছা হয় তেমনি কর; কিন্তু ধর্ম্মপুস্তকে লেখা আছে, “যে কেহ্ কার্য্য করিবে না সে ভোজন না করুক।” থিষলনীকীয় মণ্ডলীর প্রতি পত্র ৩।১০। এই জন্যে আমি যে তোমাকে ভিক্ষা দিব এমত ভরসা করিও না; সেলাম, এখন আমি যাই।
এই কথাতে করুণার মুখ বড় ম্লান হইয়া গেল, ইহা দেখিয়া আমি পুনর্ব্বার বলিলাম, করুণা, ঝাড়ন গুলিন যদি চাও তবে আমি বেহারার হাতে পাঠাইয়া দিব। তথাপি সে অলসা স্ত্রী উত্তর করিল, না না, তাহা করিতে পারিব না; ঈশ্বর যেমন আমাদিগকে বরাবর এক মুটা ভাত দিয়া আসিতেছেন তেমনি দিবেন, তোমার সিলাই না করিলে আমরা কিছু মারা পড়িব না।
আমি এই কথা শুনিয়া কহিলাম, আমি তোমার সাহায্য করিতে চাহিয়াছিলাম বটে, কিন্তু তুমি যদি এমন কথা কহ, তবে আমি আর কি করিতে পারি? পরে আমি নবীনের প্রতি ফিরিয়া বলিলাম, আমার এই স্থানে আসা অদ্য বিফল হইল, কিন্তু এখন বেলা আছে, এই জন্যে মধুর বাটীতে যাইতে ইচ্ছা করি; অতএব তুমি যদি আলস্য না করিয়া আমার সঙ্গে গিয়া পথ দেখাইয়া দিতে পার, তবে আমি তোমাকে চারিটি পয়সা দিব।
নবীন এই কথাতে বড় সন্তুষ্ট হইয়া আমার অগ্রে২ লম্ফ দিয়া গমন করিতে লাগিল। কিঞ্চিৎ পরে আমরা একটা বড় উচ্চ খোলার ঘরের নিকটে পৌঁছিলে নবীন বলিল, মেম সাহেব, এই বাটী মধুর। তাহাতে আমি তাহাকে বিদায় করিলে, সে পয়সা পাইয়া আনন্দ প্রযুক্ত দৌড়িয়া বেড়াইতে লাগিল; আমি তাহা দেখিয়া বোধ করিলাম, এই বালক যে কল্য পীড়িত ছিল ইহা নিতান্তই মিথ্যা।
পরে আমি উক্ত গৃহের উঠানের নিকটে দাঁড়াইয়া এক জন স্ত্রী লোকের ক্রন্দন এবং কোন পীড়িত ব্যক্তির বড় কোঁকানি শব্দ শুনিতে পাইলাম। যদ্যপিও তাহাদের সহিত আমার পূর্ব্বে পরিচয় ছিল না, তথাপি আমি নিঃশব্দে বহির্দ্বার খুলিয়া ভিতরে গেলাম, কারণ আমি জানিতাম, যে বাঙ্গালা দেশস্থ লোকদের পীড়া হইলে যদি বাহিরের কোন মানুষ আসিয়া তাহাদের নিকটে বৈসে, ও তাহাদের দুঃখে দুঃখিত হয়, তবে তাহারা বড় সন্তুষ্ট হয়। বিলাতে এমত নয় বটে, বরং সেখানে যদি কোন অপরিচিত ব্যক্তি হঠাৎ গিয়া রোগগ্রস্থ মানুষের নিকটে উপস্থিত হয়, তবে সেই পীড়িত ব্যক্তির বন্ধু বান্ধবেরা তাহাকে অশিষ্ট লোক জ্ঞান করে।
সে যাহা হউক, আমি ভিতরে গিয়া দেখিলাম, উঠান ও দাবা লোকেতে প্রায় পরিপূর্ণ আছে। আমাকে দেখিয়া কেহই আশ্চর্য্য জ্ঞান করিল না, কারণ আমি পাড়াতে যাতায়াত করিতাম, তাহা সকলে জ্ঞাত ছিল।
পরে যে বৃদ্ধা স্ত্রীর ক্রন্দনের শব্দ আমি শুনিয়াছিলাম, সে উপস্থিত হইয়া বলিল, মেম সাহেব, বোধ করি আপনি আমার ছেল্যার পীড়ার বিষয় শুনিয়া আসিয়া থাকিবেন? আমি কহিলাম, না, তাহা শুনি নাই, কেবল তোমাদের সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছি। কিন্তু তোমার পুত্ত্র কোথায়? আমি যদি কোন প্রকারে তাহার উপকার করিতে পারি, তবে অবশ্য করিব।
এই কথাতে প্রতিবাসি লোক সকল আমার জন্যে পথ ছাড়িয়া দিল, এবং বুড়ি আপন পুত্ত্রের খাটের নিকটে এক খানা চৌকি আনিয়া বলিল, মেম সাহেব, আপনি ইহাতে বসুন। হায়২! যে মাতাল ও দুষ্ট যুবপুরুষের বিষয় আমি ফুলমণির নিকটে শুনিয়াছিলাম, সেই মধুকে এখন মৃতপ্রায় দেখিতে পাইলাম। সেই দিবস প্রত্যূষে তাহার ভয়ানক উলাউঠা রোগ হইয়াছিল, আমি তাহাকে দেখিবা মাত্র জানিতে পারিলাম, তাহার বাঁচিবার কোন ভরসা নাই। পরে আমি বুড়িকে জিজ্ঞাসিলাম, তোমরা উহারে কি ঔষধ দিয়াছ? সে উত্তর করিল, মেম সাহেব, অনেক প্রকার ঔষধ দিয়াছি, যে যাহা বলিয়াছিল তাহা সকলই দিয়াছি। আমি বলিলাম, এ বড় অনুচিত কর্ম্ম করিয়াছ, কারণ এক ঔষধ অন্য ঔষধের গুণ নষ্ট করে, তাহা কি তুমি জান না?
কবিরাজ বুড়ির নিকটে চারি টাকা লইয়া মধুকে এক পান ঔষধ দিয়া দাবাতে তামাক্ খাইতেছিল, সে আমার কথা শুনিয়া ভিতরে আসিয়া বলিতে লাগিল, মেম সাহেব, আপনি যথার্থ কহিলেন। আমি ইহাদিগকে পূর্ব্বেই বলিয়াছিলাম, তিন চারি প্রকার ঔষধ একেবারে খাওয়াইও না, কিন্তু ইহারা আমার কথা মানিল না। মেম সাহেব, বাঙ্গালি স্ত্রীলোকদিগের জ্ঞান নাই, আপনারা যেমন বিবেচনা করেন, তেমন তাহারা পারে না। দেখুন, রোগী যদি মারা পড়ে, তবে ইহাদেরি দোষ হইবে, আমার কোন দোষ নাই। যদি আর কোন ঔষধ উহাকে না দিত, তবে অবশ্য আমার ঔষধে ভাল হইত, কারণ এই ঔষধদ্বারা পীড়িত মানুষ সর্ব্বদাই সুস্থ হয়। অল্পদিন হইল এক ব্যক্তি আপন স্ত্রীকে দেখাইবার জন্যে আমাকে ডাকিয়া লইয়া গিয়াছিল, আমি তাহার গৃহে গিয়া দেখিলাম, সে রোগির ধাতু নাই, এবং কথা কহিতে পারে না, এমত ব্যক্তিকেও আমি সুস্থ করিলাম।
আমি কহিলাম, না না, কবিরাজ মহাশয়, এমত কথা বলিও না, তুমি তাহাকে সুস্থ কর নাই, কিন্তু পরমেশ্বর তোমার ঔষধে আশীর্ব্বাদ দেওয়াতে তদ্দ্বারা সে আরোগ্য হইয়াছিল।
কবিরাজ উত্তর করিল, হাঁ মেম সাহেব, তাহাই বটে; পরমেশ্বরের অনুগ্রহ ব্যতিরেকে আমরা কি করিতে পারি?
এই কথাতে আমি মধুর হস্ত ধরিয়া বলিলাম, ওগো! তুমি কি এ ব্যক্তির কথা শুনিতেছ? ইনি হিন্দুলোক হইয়াও বলেন, পরমেশ্বরের কৃপা ব্যতিরেকে আমরা কি করিতে পারি? অতএব আমি ভরসা করি, যে এই ভয়ানক সময়ে পরমেশ্বর তোমার সহিত থাকিয়া তোমাকে সান্ত্বনা করিতেছেন।
মধু উত্তর করিল, না না, ঈশ্বর আমার সহিত নাই। হায়২! তিনি যদি আমার সহিত থাকিতেন তবে আমার সকল ভয় দূর হইত; কিন্তু তিনি এখানে নাই। বোধ হয় যেন শয়তান আমার কর্ণের নিকটে বসিয়া ফুস২ করিয়া বলিতেছে, এখন তোকে সকল দুষ্ট ক্রিয়ার ফল ভোগ করিতে হইবে।
এই কথা শুনিয়া প্রতিবাসি লোকেরা বড় ভয় পাইল, এবং দুই তিন জনে বলিল, জাঁতি কিম্বা ছুরি কোনো একখান লোহার দ্রব্য শীঘ্র করিয়া উহার মাথার নিকটে রাখিয়া দেও।
কিন্তু মধু আপন চক্ষু খুলিয়া বলিল, হায়২ বন্ধুরা! তোমরা খ্রীষ্টিয়ান হইয়াও কি এই সকল মিথ্যা গল্প মান? লৌহদ্বারা আমার কোন উপকার হইবে না। পরে সে আপন বক্ষঃস্থলে করাঘাত করত বলিতে লাগিল, শয়তান এখানে আছে, এখানে আছে, সে আমার মনের মধ্যেই আছে। হায়২ দুর্ভাগ্য মনুষ্য যে আমি! আমি যদি ভূতরাজকে সেবা না করিয়া পরমেশ্বরের সেবা করিতাম, তবে এখন আহ্লাদ পূর্ব্বক মরিতে পারিতাম।
মধু মনের অতিশয় যন্ত্রণা প্রযুক্ত উক্ত কথা উচ্চৈঃস্বরে কহিয়াছিল, তাহাতে তাহার যে যৎকিঞ্চিৎ বল ছিল, তাহা হ্রাস হইলে সে বালিশের উপরে মাথা রাখিয়া বার২ জল চাহিতে লাগিল; কিন্তু তাহার বন্ধুরা বলিল, না না, জল দিলে ব্যামোহ বাড়িবে। এ কথা যথার্থ নহে, ইহা আমি ভালরূপে জ্ঞাতা ছিলাম, তথাপি আমাকে যেন পশ্চাতে কেহ দোষ না দেয় এই জন্যে কবিরাজের প্রতি ফিরিয়া জিজ্ঞাসিলাম, ইহাকে কিঞ্চিৎ জল দিলে কি কোন ক্ষতি হইবে? তাহাতে কবিরাজ আমাকে ধীরে২ বলিল, এ কোন প্রকারে বাঁচিবে না, অতএব যাহা খাইতে চাহে তাহা দেও।
এই কথা শুনিয়া আমি এক বাটি জল মধুর মুখের কাছে ধরিলাম, তাহাতে সে তাবৎ জল খাইয়া কিঞ্চিৎ আরাম বোধ হইল, পরে অতি ক্ষীণ স্বরে জিজ্ঞাসা করিল, রাণি কোথায়? গোলমাল প্রযুক্ত আমিও রাণির বিষয় নিতান্ত বিস্মৃতা হইয়াছিলাম, কিন্তু মধুর কথা শুনিয়া আমি তাহার মাতাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, হাঁ গো, তোমার বউ কোথায়? সে যে এখানে নাই, ইহা বড় আশ্চর্য্য। এমন সময়ে আপন স্বামির নিকটে থাকা তাহার কর্ত্তব্য ছিল বটে।
বুড়ি উত্তর করিল, বউ এখানে ছিল, কিন্তু অল্পক্ষণ হইল সে ফুলমণিকে ডাকিতে গিয়াছে; কারণ সে বলিল, ফুলমণি যদি আসিয়া আমার স্বামির সহিত কিছু ধর্ম্মের কথা কহে তবে তাহার মঙ্গল অবশ্য হইতে পারিবে। বুড়ি এই কথা বলিবা মাত্র ফুলমণি ও রাণি উভয়ে আসিয়া উপস্থিত হইল।
ফুলমণি একেবারে মধুর খাটের নিকটে গিয়া কাঁদিতে লাগিল। পূর্ব্বে তাহাদের পরস্পর যে কিছু বিচ্ছেদ ছিল, তখন তাহার চিহ্ণ মাত্র দৃশ্য হইল না; বরং ফুলমণি আপন হাত তাহার মাথার নীচে দিয়া তাহাকে কিঞ্চিৎ তুলিয়া বলিতে লাগিল, হায়২ মধু! তুমি যখন শিশুকালে আমাকে মা বলিয়া আমার গৃহে মিঠাই খাইতে আসিতা, তখন আমি কতবার তোমাকে ক্রোড়ে করিয়া বেড়াইয়াছিলাম। হায়২ বাছা! এখন তোমার কি অবস্থা হইল। ও মধু, তুমি সম্পূর্ণরূপে প্রভু যীশু খ্রীষ্টের উপরে বিশ্বাস রাখ। তুমি পাপরূপ সাগরে ডুবিতেছ বটে, কিন্তু যীশু তোমাকে রক্ষা করিবার নিমিত্তে আপন হস্ত বিস্তার করিতেছেন। ও মধু, তুমি যীশুর হাত ধর, তিনি তোমাকে তুলিয়া লইবেন। হে বাছা, তুমি তাঁহার নিকটে একটি ক্ষুদ্র প্রার্থনা কর।
এই সকল কথা শুনিয়া মধু আপনার মনের যাতনা আর সহ্য করিতে পারিল না, তাহাতে সে অতিশয় ব্যাকুল হইয়া উচ্চৈঃস্বরে বলিতে
লাগিল, হায়২ ফুলমণি মা! আমার পরিত্রাণের দিবস বহিয়া গিয়াছে। শয়তান কাল সর্পের মত আমাকে দংশন করিয়াছে, তাহাতে আমার মরণ অতি নিকট, ইহা আমি বিলক্ষণ জানিতেছি। ওগো ফুলমণি মা, ধর্ম্মপুস্তকে কি শয়তানকে বৃহ্ৎ সর্প বলা যায় না?
তাহাতে ফুলমণি বলিল, হাঁ, শয়তানকে পুরাতন ও বৃহৎ সর্প বলা যায় বটে, কেননা সে সর্পরূপে আমাদের আদি মাতার ভ্রান্তি জন্মাইয়া তাহার বংশ সকল নষ্ট করিতে চেষ্টা করে। কিন্তু ওহে মধু, তাহাতে তুমি নৈরাশ হইও না,
পিত্তলের সর্পের কথা স্মরণ করিয়া প্রভু যীশুর আশ্রয় লও। তিনি আপনি কহিয়াছেন, “মুসা যেরূপ প্রান্তরে সর্পকে ঊর্দ্ধ্বে উঠাইল, মনুষ্য পুত্ত্রকেও তদ্রূপ উত্থাপিত হইতে হইবে; তাহাতে যে কেহ তাঁহাতে বিশ্বাস করিবে, সে বিনষ্ট না হইয়া অনন্ত পরমায়ুঃ পাইবে।”
মধু বলিল, যীশু আমার প্রার্থনা শুনিবেন না, এবং আমিও তাঁহার কাছে প্রার্থনা করিতে পারি না; কিন্তু আমি রাণির নিকটে ক্ষমা চাহিব। হে প্রিয়ে রাণি, আমি তোমার বিরুদ্ধে অনেক বার বড় দোষ করিয়াছি, কিন্তু এখন আমি মরিতেছি, আমাকে ক্ষমা করিতে হইবে। আমার ঘর ও ভূমি ইত্যাদি যে কিছু আছে সে সকলি তোমার, কিন্তু আমার মাতা যত দিন বাঁচিবেন, তত দিন তুমি তাঁহাকে খাইতে পরিতে দিও। তিনি তোমার প্রতি কখন২ অন্যায় ব্যবহার করিলেও তুমি তাঁহাকে ত্যাগ করিও না, তিনি তোমার স্বামির মাতা হন, ইহা স্মরণে রাখিও।
পরে মধু ফুলমণির প্রতি ফিরিয়া বলিল, মা! আমি রাণিকে তোমার হাতে সমর্পণ করিলাম। তুমি যেমন সত্য খ্রীষ্টিয়ান তেমনি তাহাকেও সত্য খ্রীষ্টিয়ান করিও, এবং তুমি যেমন অদ্য আপন শত্রুদের প্রতি প্রেম প্রকাশ করিয়াছ, তেমনি তাহাকেও আপন শত্রুর প্রতি প্রেম করিতে শিক্ষা দিও।
আর কিঞ্চিৎ কাল পরে মধু পুনর্ব্বার বলিতে লাগিল, ও মা ফুলমণি! রাণি প্রসব হইলে পর তুমি অনুগ্রহ করিয়া তাহার প্রতি ভাল চেষ্টা করিও; আর আমার ছেল্যাটি কিছু বড় হইলে যাহাতে সে ধর্ম্মের বিষয়ে শিক্ষা পায়, তজ্জন্যে তাহাকে পাদরি সাহেবের মেমের স্কুলে দিও।
এই কথা বলিয়া তাহার বড় জল পিপাসা হইল, তাহাতে সে কাঁদিতে২ কহিতে লাগিল, হায়২! আমি যদি এখন এই জল তৃষ্ণা সহ্য করিতে না পারি, তবে নরকের জ্বালা অনন্তকাল পর্য্যন্ত কি প্রকারে সহিতে পারিব? আমি আপন সাংসারিক বিষয় সকল নির্ধার্য্য করিলাম, কিন্তু ধিক২! পারমার্থিক বিষয়ে কি করিব? হায়! আমাকে নরকে যাইতে হইবে।
মধুর স্ত্রী এই কথা শুনিয়া তাহার বক্ষঃস্থলে পড়িয়া অতিশয় উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিয়া বলিল, আপনি কি জন্যে নরকে যাইবেন? না না, ঈশ্বর তোমাকে নরকে ফেলিয়া দিবেন না। ফুলমণি মাতা যাহা বলে তাহাই কর, যীশুর হস্ত শক্তরূপে ধর, তিনি তোমাকে অবশ্য রক্ষা করিবেন। কিন্তু মধু আপন মাথা লাড়িয়া বলিল, না রাণি, না, যীশু আমাকে গ্রাহ্য করিবেন না, আমার পরিত্রাণের দিবস বহিয়া গিয়াছে। হায়! আমি কি করিব? ইহা বলিয়া সে অচৈতন্য হইল, এবং কিঞ্চিৎ কাল পরে তাহার অপ্রস্তুত আত্মাকে পৃথিবীর বিচারকর্ত্তার বিচারস্থানে দাঁড়াইতে হইল।
হায়! আমি যখন আপন বাটীহইতে সে দিবসে বাহির হইয়াছিলাম, তখন এমত ভয়ানক ও দুঃখজনক ঘটনা দেখিতে পাইব, তাহা আমি কিছুমাত্র বোধ করি নাই, ফলতঃ তদ্দ্বারা আমার মন অত্যন্ত শোকাকুল হইল।
রাণি ও তাহার শাশুড়ী মধুর মৃত দেহে পড়িয়া বাঙ্গালি স্ত্রীলোকদের যেমত রীতি আছে তদ্রূপ উচ্চৈঃস্বরে ক্রন্দন করিয়া আপনারদের মস্তকে আঘাত করিতে লাগিল, এবং যে২ উত্তম গুণ বাস্তবিক মধুর কখন ছিল না, এমত গুণের বর্ণনা করত তাহার প্রসংশা করিতে লাগিল। ফুলমণি দাবাতে বসিয়া আঁচল দিয়া আপন মুখ আচ্ছাদন করিয়া কাঁদিতে ছিল। এমত সময়ে এক জন পুরুষ উঠানের মধ্যে উপস্থিত হইল; তাহার মস্তকে দুই একটি পক্ব কেশ দেখা গেল, এবং তাহার মুখ অতিশয় দয়াশীল বোধ হইল। পূর্ব্বে আমি তাহাকে দেখি নাই, তথাচ দেখিবা মাত্র তাহার প্রতি আমার মনে সম্ভ্রম জন্মিল। ঐ পুরুষ ফুলমণির নিকটে গিয়া তাহার সহিত মৃদুস্বরে কথা কহিতে লাগিল, এবং ইহাও দেখিলাম, সে আপন বস্ত্রদ্বারা তাহার চক্ষের জল মুচাইয়া ফেলিল। ইহাতে আমার বোধ হইল এ ব্যক্তি ফুলমণির স্বামী হইবে।
প্রতিবাসি লোকেরা গৃহের মধ্যে পরস্পর কথা কহিয়া বড় কোলাহল করিতেছিল, এই জন্যে সেই পুরুষ তাহাদিগকে শিষ্টরূপে বলিল, হে ভাই ভগিনীরা, এখন তোমরা এখানহইতে প্রস্থান করিলে ভাল হয়, কারণ তোমরা মধুকে আর কোন প্রকারে উপকার করিতে পারিবা না। এই কথা শুনিয়া লোকেরা বাহিরে যাইতে লাগিল।
তাহাদের যাওন কালে আমি নানা জনের নানা প্রকার কথা শুনিতে পাইলাম। এক জন বলিল, মধু কেবল মদ্যপানদ্বারা নষ্ট হইল; আর এক জন কহিল, এমত নয়, তাহার ব্যামোহ হইলে পর সে এক ভাঁড় দধি কিনিয়া খাইয়াছিল, তাহাতেই তাহার মৃত্যু হইল। পরে এক জন বুড়ি কহিল, তোরা কি জানিস্? কবিরাজ রোগ তো দমন করিয়াছিল, কিন্তু মেম সাহেব সেথায় থাকাতে ঝাড় ফোঁক কিছু করা গেল না, এই জন্যে ভূত তাহাকে চাপিয়া মারিল।
আমি এই সকল কথা শুনিয়া মনের মধ্যে ভাবিলাম, হায়২! এই লোকেরা কত অনর্থক চিন্তা করে। কিন্তু তাহাদের মৃত বন্ধুর মনস্তাপ শুনিয়াও পরলোকে তাহার কি গতি হইবে? এ বিষয়ে কেহই ভাবিত হইল না।
যে পুরুষ এমত সুশীলরূপে লোক সকলকে বিদায় করিয়াছিল, তাহার বিষয়ে শুনিলাম, সে ফুলমণির স্বামী বটে। কিছুকাল পরে সে মধুর দুই জন পিস্তুত ভাইকে লইয়া তাহার কবর দেওনার্থে সকল প্রস্তুত করিতে লাগিল। তখন আমি বিবেচনা করিয়া দেখিলাম, যে মধুর মায়ের টাকা কড়ির কোন অভাব নাই, অতএব আর কোনরূপে তাহাদের উপকার করিতে না পারিয়া, আমি পুনর্ব্বার আসিব, এই কথা বলিয়া বিদায় হইলাম।
আমি আপন গৃহে পৌঁছিয়া উক্ত ঘটনা সকল মনে আন্দোলন করত মৃত্যুর এবং পরলোকের বিষয়ে এইরূপ চিন্তা করিতে লাগিলাম; যথা, আমার সাক্ষাতে এক জন বলবান্ যুব পুরুষ যৌবনাবস্থায় প্রাণ ত্যাগ করিয়াছে, ফলতঃ সে পাপগ্রস্ত হইয়াও ঈশ্বরের নিকটে ক্ষমা না চাহিয়া পরলোকে গমন করিয়াছে; তাহাতে আমি ভাবিলাম, হায়! তাহার আত্মার সর্ব্বনাশ হইয়া থাকিবে।
কোন ব্যক্তির আত্মার সর্ব্বনাশ হওয়া কেমন ভয়ানক ও গুরুতর বিষয়, তাহা বলা অসাধ্য; কিন্তু ধিক২! মনুষ্যেরা ঈশ্বরের নিয়ম জানিয়াও মনে করে, যদ্যপি আমরা পাপ করি, তথাপি তিনি দয়ালু হইয়া পরলোকে আমাদিগকে অবশ্য ভাল স্থান দিবেন। পরমেশ্বর দয়ার সাগর বটেন, এই জন্যে তিনি আপনার পুত্ত্রকে রক্ষা না করিয়া আমাদের সকলের জন্যে তাঁহাকে প্রদান করিলেন; কিন্তু যে ব্যক্তি তাঁহার অসীম অনুগ্রহ তুচ্ছ করিয়া ইহকালে আপন মন্দাভিলাষ পূর্ণ করে, এমত ব্যক্তির প্রতি ঈশ্বর কোন প্রকারে পরকালে দয়া প্রকাশ করিবেন না। এই বিষয়ে তিনি আপনি স্পষ্টরূপে এই নিয়ম করিয়াছেন, যথা “পাপি লোকেরা ও ঈশ্বর বিস্মৃত সর্ব্ব দেশীয় লোকেরা নরকে নিক্ষিপ্ত হইবেক।” দায়ূদের ৯ গীত ১৭। আর “যে কেহ পুত্ত্রকে না মানে, সে পরমায়ুর দর্শন পায় না, কিন্তু ঈশ্বরের ক্রোধপাত্র হইয়া থাকে।” যোহন ৩।৩৬। পরমেশ্বর পাপকে ঘৃণা করেন, এই জন্যে মনুষ্যদের পাপহইতে উদ্ধার হইবার উপায় করিয়াছেন, কিন্তু যে মনুষ্য তাঁহার প্রেমিক নিমন্ত্রণ অগ্রাহ্য করে, সেই তাঁহার ক্রোধের পাত্র হয়।
হায়! যে ব্যক্তি ঈশ্বরের এবং তাঁহার অভিষিক্ত পুত্ত্রের ক্রোধপাত্র হয়, সে পরকালে কেমন দুর্দশান্বিত হইবে; তথাচ খ্রীষ্টিয়ান নামধারী অনেক লোক আছে, যাহারা এই ভারি বিষয়ে কিছু মাত্র মনোযোগ করে না। সুস্থ লোকদের চিকিৎসা করার প্রয়োজন নাই, কিন্তু অসুস্থ লোকদের প্রয়োজন আছে; তথাপি সহস্র২ মনুষ্য পাপরোগগ্রস্ত হইয়াও আপনাদিগকে সুস্থ বোধ করে, এবং যে মহাচিকিৎসক তাহাদিগকে ঐ রোগহইতে মুক্ত করিতে পারেন, তাহারা তাহার নিকটে যাইতে অসম্মত হয়।
কোন২ লোক কেবল আলস্য প্রযুক্ত এমত করে। তাহারা বলে, আমরা পৃথিবীতে অনেক দিন বাঁচিব, অতএব সম্প্রতি মন ফিরাইবার আবশ্যক নাই। তাহারা ফীলিক্সের ন্যায় স্থির করে, আমরা অবকাশ পাইলে ধর্ম্মের বিষয়ে মনোযোগ করিব; কিন্তু অবকাশের সময় উপস্থিত হইবার পূর্ব্বে তাহাদের মৃত্যু উপস্থিত হয়। আহা! এই রূপ বিলম্ব করা কেমন নির্বোধের কর্ম্ম।
সাংসারিক বিষয়ে এমত অজ্ঞানতা কেহই প্রকাশ করে না। বৈশাখ মাস উপস্থিত হইলে, চাষারা ভূমিতে চাষ করে, ও বীজ বপন করে;
এবং যে জন বীজ বপন না করিয়া ঐ শুভ সময় বহিয়া যাইতে দেয়, এমত নির্বোধ ব্যক্তি এই জগতের মধ্যে প্রায় দৃষ্ট হয় না। কিন্তু পরিত্রাণের দিবস যে বহিয়া যায়, তাহাতে মনুষ্যেরা কিছু মাত্র ভয় না করিয়া অমনোযোগ প্রযুক্ত আপন২ অমূল্য আত্মাকে নষ্ট করে।
আরও এমত কোন লোক আছে, যাহারা উক্ত মধুর ন্যায় ঈশ্বরের মঙ্গল সমাচার উত্তমরূপে জানীয়াও তাহা গ্রাহ্য করে না। পাপ যে বড় মন্দ ইহা তাহারা সুজ্ঞাত আছে, তথাপি তাহারা পাপ করে। তাহারা জানে যে খ্রীষ্টের নিকটে গেলে আমরা ক্ষমা পাইব, তথাপি তাহারা খ্রীষ্টের নিকটে যায় না। তাহাদের সম্মুখে নরক আছে, তাহার প্রতি তাহারা চক্ষুঃ মুদিয়া থাকে, এরূপে তাহারা শেষে আচম্বিতে আপনাদের সর্ব্বনাশ ঘটায়। যীশু খ্রীষ্টের মঙ্গল সম্বাদ তুচ্ছ করণাপেক্ষা আর ভারি দোষ নাই, কিন্তু হায়! কত জন এই রূপ পাপ প্রতিদিন করিয়া থাকে। “যে ব্যক্তি প্রভুর আজ্ঞা না জানিয়া প্রহারের যোগ্য কর্ম্ম করে, সে অল্প প্রহার পাইবে; কিন্তু যে দাস প্রভুর আজ্ঞা জ্ঞাত হইয়াও প্রস্তুত থাকে না, এবং তাঁহার আজ্ঞানুসারে কর্ম্ম করে না, সে অনেক প্রহার পাইবে। কেননা যাহাকে বাহুল্যরূপে দত্ত হইয়াছে, তাহার নিকটহইতে বাহুল্যরূপে লইতে হইবে।” লুক ১২।৪৭, ৪৮। আহা! যদি লোকেরা জ্ঞানবান্ হইয়া এই সকল কথা বুঝিত, ও আপনাদের শেষ দশা বিবেচনা করিত, তবে তাহাদের ইহকালে ও পরকালে পরম লাভ হইত।