ফুলমণি ও করুণার বিবরণ/চতুর্থ অধ্যায়

চতুর্থ অধ্যায়।

 মধুর কবর দেওনের দুই দিবস পরে আমি আপন প্রতিজ্ঞানুসারে পুনর্ব্বার তাহার মাতার গৃহে উপস্থিতা হইলাম। এই বার আমি ঈশ্বরের আশীর্ব্বাদদ্বারা ঐ দুর্ভাগ্য লোকেরদের কিঞ্চিৎ উপকার করিতে পারিয়া বড় সন্তুষ্টা হইলাম। বিশেষতঃ সেথায় গিয়া আমি দেখিতে পাইলাম, যে রাণি প্রসব বেদনায় অতিশয় ব্যাকুল হইতেছে। তাহার শাশুড়ী আমাকে দেখিয়া বলিল, বউ এক দিন এক রাত্রি পর্য্যন্ত এই রূপ অত্যন্ত যাতনা ভোগ করিতেছে, তথাপি যে খালাস হয় এমত কোন লক্ষণ দেখিতে পাই না।

 রাণির স্বামির মৃত্যুর সময়ে যে রূপ গোলমাল হইয়াছিল, এখনও স্ত্রীলোকেরা সেই রূপ গোলমাল পুনর্ব্বার করিতেছে; বিশেষতঃ দশ বারো জন মেয়্যা আসিয়া রাণির চারিদিগে দাঁড়াইতেছিল। যদি এক জন কথা কহে, তবে অন্য জন আর একটা কথা কহে; এক জন তাহাকে বসিয়া থাকিতে কহে, আর এক জন বলে, না না, তুমি হাঁটিয়া বেড়াও; এবং তৃতীয় জন কোন অজ্ঞান বুড়ির ঔষধ আনিয়া তাহাকে খাওইয়া দেয়। এই সকল বৃথা উপায়দ্বারা ছেল্যা শীঘ্র না জন্মিয়া বরং অনেক বিলম্ব হইতে লাগিল, তাহাতে রাণির যন্ত্রণা অতিশয় বৃদ্ধি হইল।

 এতদ্ব্যতিরেকে আমি আর এক বিষয়ে বড় দুঃখিতা হইলাম, অর্থাৎ যদ্যপি এই সকল লোকেরা নামে খ্রীষ্টিয়ান তথাপি ইহাদের মধ্যে এক অমূলক ধর্ম্ম দেখিতে পাইলাম। অমূলক ধর্ম্ম ইহাকে বলা যায়, যথা; কোন কর্ম্ম করিবার সময়ে যদি কেহ হাঁচে, তবে লোকেরা সে কর্ম্মে প্রবর্ত্ত হয় না; যদি যাত্রা কালীন টিক্‌টিকীর রব শুনিতে পায়, তবে সে দিবস যাত্রা করে না; প্রত্যূষে উঠিয়া বানরের মুখ দেখে না, ও তাহার নাম উচ্চারণ করে না; চন্দ্রগ্রহণ কালীন কোন দ্রব্যাদি কাটে না; রোগ হইলে গলায় একটি মন্ত্রযুক্ত মাদুলি বাঁধে, ইত্যাদি। এইরূপ অনর্থক ব্যবহার কেবল মধুর পরিবারের মধ্যে দেখিলাম তাহা নহে, অনেক খ্রীষ্টিয়ানদের মধ্যে এই প্রকার ব্যবহার চলিত আছে। হে ধর্ম্মাত্মা! এমত অজ্ঞান লোকদের মনের চক্ষুঃ প্রসন্ন কর, যেন তাহারা উক্ত অমূলক ও হাস্যজনক আদেশ সকলকে শয়তানের বিধি বোধ করিয়া একেবারে ত্যাগ করে।

রাণি দুই তিন মাস পূর্ব্বে আপন শাশুড়ীর সাক্ষাতে এমত কথা বলিয়াছিল, যে গত রাত্রিতে

একটা পেচা কিম্বা তূতল পক্ষী ডাকিতে২ আমার মাথার উপর দিয়া উড়িয়া গেল। এই কথা এখন তাহার শাশুড়ীর মনে পড়াতে সে বলিতে লাগিল, যদি এমত হয়, তবে সে পক্ষী ফিরিয়া না আইলে পোয়াতি প্রসব হইতে পারিবে না। এ কথাতে অন্য সকল স্ত্রীলোকেরা স্বীকার করিল, কেবল এক জন বুড়ি ইহাতে সম্মতা না হইয়া বলিল, আমার বোধ হয় পেচাতে কোন ক্ষতি হয় না, কেননা এক বার আমি পাঁচ সাত জন স্ত্রীলোকের সহিত উঠানে বসিয়াছিলাম, এমত সময়ে একটা পেচা আমাদের মাথার উপর দিয়া উড়িয়া গেল; তখন আমার ছোট ভগিনীর প্রায় নয় মাস গর্ভ ছিল, এই জন্যে তাহার নিমিত্তে আমরা সকলে বড় ভাবিতা হইয়াছিলাম, কিন্তু তাহার কোন প্রকার ক্ষতি না হইয়া অল্পদিন পরে সে এক ঘণ্টা মাত্র দুঃখ পাইয়া এক পুত্ত্র সন্তান প্রসব করিল।

 ইহা শুনিয়া আর এক জন স্ত্রীলোক বলিল, ও কথা আমি কখন বিশ্বাস করিব না। সকল লোকেরা জানে যে ঐ পক্ষী ফিরিয়া না আইলে পোয়াতি প্রসব হয় না; হয় তো সে ফিরিয়া আসিয়াছিল, কিন্তু তোমরা তাহাতে মনোযোগ করিলা না।

 প্রথম বক্তা উত্তর করিল, না গো, না, কখন ফিরিয়া আইসে নাই; আমাদের কি চক্ষু ছিল না? এবং দিনের বেলা দুই প্রহরের সময়ে ছেল্যা হইল, তখন কি পেচা থাকে? কিন্তু রাণির কি হইয়াছে, তাহা আমি সুন্দর রূপে বলিতে পারি। অল্প দিন হইল সে পলাইয়া কালীপুরের কোন বুড়ির ঘরে ছিল, ঐ বুড়ি কোন মন্ত্রদ্বারা তাহাকে নিদ্রিতা করাইয়া তাহার গহনা সকল খুলিয়া লইয়াছিল; তাহার মন্ত্র না থাকিলে রাণি অবশ্য জাগিয়া উঠিত। অতএব আমার বোধ হয় সে ব্যক্তি ডাইনী, এবং রাণি যেন প্রসব হইতে না পারে, এই জন্যে সে তাহার প্রতি কোন কিছু করিয়া থাকিবে। পূর্ব্ব কথাহইতে এ কথা আশ্চর্য্য হওয়াতে সকল স্ত্রীলোকেরা একত্র হইয়া বলিতে লাগিল, হাঁ২, ইহা হইয়া থাকিবে বটে।

 মধুর মাতা বার২ বলিতেছিল, হায়! আমার পুত্ত্রের ছেল্যাকে আমি কখন্ কোলে করিব? কিন্তু তাহার বউর কি গতি হয়, তাহাতে সে কিছু মাত্র ভাবিতা হইল না; শেষে প্রতিবাসিদের কথাদ্বারা সে বোধ করিল, যদ্যপি আমি বউর তত্ত্ব না করি, তবে ছেল্যা শুদ্ধ নষ্ট হইবে। এই জন্যে সে ডাইনীর বিষয় শুনিয়া কহিল, তবে আমি এক জন মানুষকে কালীপুরে পাঠাইয়া দিই, সে ঐ বুড়ির পায়ে পড়িয়া প্রার্থনা করুক, যেন আমার বউর গর্ভের বন্ধন মুক্ত করিয়া দেয়।

 এই কথাতে রাণি কাতর হইয়া আমার প্রতি ফিরিয়া বলিল, ও মেম সাহেব, আপনি কি আমার এ বিষয়ের কোন ঔষধ জানেন না? কালীপুর এখানহইতে দুই দিবসের পথ; অতএব সেথাহইতে মানুষ ফিরিয়া না আসিতে২ আমি মারা পড়িব। ও মেম সাহেব, আপনি অনুগ্রহ করিয়া ইহাদিগকে বলুন, যেন ইহারা আমাকে আর জলপড়া ও তৈলপড়া না দেয়, কারণ তাহাতে আমার বমি হইতেছে, আর খাইতে পারিব না। এ কথা শুনিয়া এক জন স্ত্রীলোক বলিল, না গো, তোমাকে আর পড়াতৈলাদি দেওয়া যাইবে না, কেননা দেখিলাম তাহাতে কোন উপকার হইল না।

 তখন আমি কহিলাম, এমত অনর্থক উপায়দ্বারা কাহারো কি কখন উপকার হইয়া থাকে? ইহা না করিয়া রাণিকে যদি কিছু খাইতে দেও, তবে বোধ করি ভাল হইতে পারে। এই কথাতে তাহার শাশুড়ী উত্তর করিল, ভাল২! তাহার খাওয়ার বিষয় পশ্চাৎ হইবে, প্রথমে আমাকে ছেল্যা দিউক। বুড়ির এমত বাক্য শুনিয়া আমি বড় রাগান্বিতা হইয়া বলিলাম, তুমি অতিশয় দুষ্টা ও নির্বোধ স্ত্রী, তোমার বউর মুখের প্রতি চাহিয়া দেখ, সে এখনি মূর্চ্ছা যাইবে, তাহা হইলে তুমি কোথাহইতে ছেল্যা পাইবা?

 পরে আমি প্রতিবাসিদের প্রতি ফিরিয়া বলিলাম, তোমাদের মধ্যে যদি কেহ একটু মাছের ঝোল আনিয়া দিতে পার, তবে বড় উপকার হয়। এই কথাতে একটি যুবতী স্ত্রী ঝোল আনিতে আপন গৃহে দৌড়িয়া গেল; কিন্তু সকল বুড়িরা মাথা লাড়িয়া বলিতে লাগিল, এই প্রকার রীতি ইংরাজ বিবিদের পক্ষে ভাল হইতে পারে, কিন্তু বাঙ্গালিদের নিমিত্তে বাঙ্গালিদের রীতি ভাল। পোয়াতিকে ঝোল্‌টোল খাওয়াইলে সে অবশ্য মারা পড়িবে।

 এমত সময়ে ঐ যুবতী স্ত্রীলোক ঝোল লইয়া ফিরিয়া আইল, তাহাতে আমি সে ঝোলের বাটি ধরিয়া রাণিকে পান করিতে দিলাম। রাণি ব্যগ্রতাপূর্ব্বক তাহা সকল খাইয়া বলিল, মেম সাহেব, ইহাতে আমার বিস্তর শক্তি হইল; এখন যদি উহারা কেবল আমাকে শুইতে দেয়, তবে বোধ করি আমি ভালরূপে ব্যথা খাইতে পারিব।

 ঐ নির্বোধ স্ত্রীলোকেরা তাহাকে তিন ঘণ্টা পর্যন্ত হাঁটু গাড়িয়া রাখিয়াছিল, তাহাতে সে সুতরাং শ্রান্তা হইয়া একেবারে বলহীনা হইয়াছিল; ইহা দেখিয়া আমি ধাইকে বলিলাম, ওগো, ইহাকে কিঞ্চিৎ কাল শুইতে দিলে কি ক্ষতি আছে? বিলাতে তো সকল স্ত্রীলোকেরা শুইয়া প্রসব হয়। এই কথাতে ধাই কিছু অসন্তুষ্টা হইয়া বলিল, বিলাতীয় বিবিদের এবং বাঙ্গালি স্ত্রীলোকদের মধ্যে অনেক বিশেষ আছে; আপনি যদি ইংরাজি ধারামতে ইহাকে প্রসব করাইতে আসিয়াছেন, তবে তাহাই করুন; আমি তাহার ভাল মন্দ কিছুই জানি না। আমি উত্তর করিলাম, তাহাই হউক। এমত সময়ে কি করা কর্ত্তব্য, এ বিষয়ে আমি সুন্দররূপে সুশিক্ষিতা আছি, অতএব ঈশ্বরের আশীর্ব্বাদ দ্বারা ইহার কোন ক্ষতি হইবে না।

 এই কথা বলিয়া আমি রাণিকে বাম পার্শ্বে শোয়াইয়া এক ঘণ্টার মধ্যে তিন চারি বার তাহাকে কিছু তপ্ত দুগ্ধ পান করিতে দিলাম। পরে দেখিলাম যে ধাই তাহার গর্ভের উপরে এক খানা কাপড় অতিশয় শক্তরপে বাঁধিয়া রাখিয়াছিল, ইহা দেখিবা মাত্র আমি সে বন্ধন খুলিয়া দিলাম, তাহাতে সকল স্ত্রীলোকেরা আমাকে বলিতে লাগিল, এমত করিলে ছেল্যা পুনর্ব্বার উপরে সরিয়া যাইবে। কিন্তু রাণি কহিল, না না, মেম সাহেব এ বিষয় ভাল জানেন, তিনি আপন ইচ্ছামত করুন।

 এই রূপে কিছুকাল যাপন হইলে সকলেই জানিতে পারিল রাণির প্রসবের সময় নিকট হইয়াছে; তাহাতে ধাই কিঞ্চিৎ প্রশংসা পাইবার আশা করিয়া বলিল, ও মেম সাহেব, আপনি যদি আমাকে অনুমতি দেন, তবে আমি এই দণ্ডে পোয়াতিকে খালাস করিয়া দিতে পারি। কিন্তু আমি বলিলাম, না না, তুমি তিন বার এইরূপ ঘাঁটিয়া রাণিকে কেবল অধিক যন্ত্রণা দিয়াছ; থাকিতে দেও, ঈশ্বর আপনি ইহাকে উদ্ধার করিবেন। আমি ইহা বলিবা মাত্র রাণির একটি জীবৎ কন্যা জন্মিল, তাহাতে আমার বড় আশ্চর্য্য বোধ হইল, কারণ সকল স্ত্রীলোকেরা মিলিয়া রাণির যে রূপ অবস্থা করিয়াছিল, তাহা দেখিয়া আমি অনুমান করিয়াছিলাম, যে অবশ্য তাহার মৃত সন্তান জন্মিবে। বাঙ্গালি স্ত্রীলোকদের ছেল্যারা অনেকবার ধাইদের অজ্ঞানতা প্রযুক্ত গর্ভে নষ্ট হয়, তাহা আমি স্বচক্ষে দেখিয়াছি। কিন্তু সে যাহা হউক, ঈশ্বর রাণির প্রতি প্রসন্ন হইয়া তাহাকে জীবৎ সন্ততি দান করিলেন।

 রাণি প্রসব হইলে পর সকলে আমাকে অতিশয় প্রশংসা করত আশীর্ব্বাদ করিতে লাগিল, এবং রাণির শাশুড়ী আপন পুত্ত্রের ছোট কন্যাকে ক্রোড়ে করিয়া তাহার পিতাকে স্মরণ করত ক্রন্দন করিতে লাগিল। তথাচ সেও আমাকে বলিল, ও মেম সাহেব, আপনি আমাদের মা বাপ, আপনি আমাদের রক্ষাকর্ত্তা। কিন্তু আমি তাহাকে বলিলাম, এমত নয়, ঈশ্বর মহৎ অনুগ্রহ করিয়া তোমার বউকে যাতনাহইতে উদ্ধার করিয়া এই সন্ততি দান করিলেন, অতএব তাঁহারই নামের ধন্যবাদ কর।

 পরে আমি মনের মধ্যে ভাবিলাম, অনেক স্ত্রীলোক এখানে উপস্থিতা আছে, যদি ইহাদের সাক্ষাতে উক্ত অমূলক ধর্ম্মের অর্থাৎ কুলক্ষণ ও সুলক্ষণ মান্য করণের বিষয়ে এখন কিছু উপদেশ দিই, তবে ভাল হইতে পারিবে; কারণ এই সকল ভ্রান্তিমূলক নির্বোধ কথা বিশেষরূপে স্ত্রীলোকদের মধ্যে চলিত আছে। তাহাতে আমি তাহাদিগকে বিনয়পূর্ব্বক বলিলাম; দেখ, তোমরা খ্রীষ্টিয়ান ধর্ম্ম গ্রহণ করিয়াছ, অতএব দেবপূজকেরা যাহা মান্য করে, তাহা তোমাদিগের মান্য করা কর্ত্তব্য নহে। বিশেষতঃ, এই সকল কুলক্ষণ ও সুলক্ষণাদি মান্য করাতে ঈশ্বরের অপমান হয়। তোমরা যদি স্বীকার কর, যে পরমেশ্বর সর্ব্বশক্তিমান্, ও তাঁহার হস্তে আমাদের প্রাণ আছে, তাহাতে তাঁহার অনুমতি ব্যতিরেকে কেহই নষ্ট হইতে পারে না; তবে একটি সামান্য পক্ষী গর্ভবতি স্ত্রীর মাথার উপর দিয়া উড়িয়া গেলে, তাহাতে তোমাদের এত ভয় জন্মে কেন? তোমরা বলিলা, পেচা ইহার উপর দিয়া উড়িয়া গিয়াছে, এই জন্যে পোয়াতি প্রসব হইতে না পারিয়া প্রসূতি ও ছেল্যা দুই জনেই মারা পড়িবে। তবে পেচা তোমাদের ঈশ্বর হইল, যেহেতু সে এক দিগে উড়িয়া গেলে মানুষের প্রাণ নষ্ট করে, এবং পুনর্ব্বার ফিরিয়া আইলে প্রাণ রক্ষাও করিতে পারে। আর তোমাদের মধ্যে কেহ২ বলিল, পোয়াতি কালীপুরের ডাইনীদ্বারা মারা পড়িবে। হায়২! পরমেশ্বর কি ঐ দুষ্টা ব্যক্তির হস্তে আপন প্রজাদের প্রাণ সমর্পণ করিয়াছেন? এমত কুচিন্তা দূরে থাকুক। পরমেশ্বর জাজ্বল্যমান ঈশ্বর, অতএব যে ব্যক্তি বলে ভূত কি প্রেত কি মনুষ্য কি পশু কি পক্ষী পরমেশ্বরের গৌরব ও পরাক্রম ও গুণবিশিষ্ট হয়, সেই ব্যক্তির ভারি শাস্তি হইবে। ঈশ্বর বিশেষরূপে খ্রীষ্টাশ্রিত লোকদের পিতা হন, অতএব যেমন সন্তানের কোন দুঃখ উপস্থিত হইলে সে যদি আপন দয়ালু পিতার নিকটে দুঃখ না জানাইয়া পরের নিকটে রক্ষা যাচ্ঞা করে, তবে পিতার অপমান ও দুঃখ অবশ্য জন্মিতে পারে, তেমনি তোমরা পরমেশ্বরকে সর্ব্বাপেক্ষা উত্তম পিতা জানিয়া তাঁহাকে ত্যাগ করিয়া যদি কোন সৃষ্ট বস্তুকে ভয় কিম্বা মান্য কর, তবে তোমাদের প্রতি ঈশ্বরের ক্রোধ প্রজ্বলিত হইবে, ইহাতে সন্দেহ নাই। আরও একটি কথা বলিতে হয়, যাহারা এই সকল লক্ষণাদি মানে তাহারা সহস্র২ বার ভ্রান্তিতে পতিত হয়। দেখ, অদ্য এই বিষয়ে তোমরা দুইটি প্রমাণ পাইলা। তোমাদের এক জন প্রতিবাসিনী বলিল, যে আমার ভগিনীর উপর দিয়া পেচা উড়িয়া গেলেও তাহার সন্তান স্বচ্ছন্দে জন্মিল। তদ্রূপ রাণিও মন্ত্রাদি ব্যতিরেকে খালাস হইয়াছে। ফলতঃ আমি আপনার বিষয়ে তোমাদের সাক্ষাতে একটি প্রমাণ দিতে পারি। আমি যখন প্রথমে গর্ভবতী হইয়াছিলাম, তখন অতিশয় গ্রীষ্মকাল, এ প্রযুক্ত রাত্রে প্রায় নিদ্রা যাইতে পারিতাম না, অতএব আমি খড়খড়িয়ার নিকটে একখান খাট পাতিয়া তাহার উপরে শয়ন করিতাম, তথাপি প্রায় সমস্ত রাত্রি জাগিয়া থাকিতাম। এমন সময়ে প্রত্যেক রাত্রিতে একটা পেচা আসিয়া খড়খড়িয়ার উপরে বসিত, তাহাতে যদি খড়খড়িয়া বদ্ধ থাকিত, তবে যত ক্ষণ পর্য্যন্ত আমি তাহা খুলিয়া না দিতাম তত ক্ষণ ঐ পক্ষী বাহিরে ছট্‌ফট্ করিত। কিন্তু এই রূপ হইলেও আমার কিম্বা আমার সন্ততির প্রতি কোন প্রকারে আপদ ঘটিল না। এই কথা যে সম্পূর্ণ রূপে সত্য, ইহা আমি সাহসপূর্ব্বক বলিতে পারি। অতএব যাহারা এই সকল জানিয়াও পেচাকে কিম্বা অন্য কোন কুলক্ষণকে ভয় করে, তাহারা অতিশয় নির্বোধ ও অজ্ঞান হয়। এই জন্যে আমি তোমাদিগকে বিনতি করিয়া বলি, তোমরা এমত নির্বোধ না হইয়া এই সকল ভ্রান্তি ত্যাগ করিয়া কেবল পরমেশ্বরের প্রতি ভয় ও বিশ্বাস রাখ।

 আমি স্ত্রীলোকদিগকে এই রূপ উপদেশ দিয়া বিদায় হইলাম, কিন্তু যাইবার পূর্ব্বে ঈষৎ হাস্য করিয়া বলিলাম, সাবধান! আমি যেন পুনর্ব্বার এই স্থানে আইলে প্রসব গৃহে লোহা কিম্বা জুতা কিম্বা ঝাঁটা ইত্যাদি টাঙ্গান না দেখিতে পাই। আর ভূতের ভয় ত্যাগ করিয়া রাণিকে ও তাহার মেয়্যাটিকে অতিশয় যত্নপূর্ব্বক রাখিবা।

 পরে আমি বাটী যাইবার সময়ে একটি ক্ষুদ্র পরিপাটি খড়ুয়া ঘরের নিকট দিয়া যাইতে২ স্পষ্টরূপে শুনিতে পাইলাম, যে এক জন ছেল্যা ধর্ম্মপুস্তকের মধ্যে যোহনের ছয় অধ্যায় পড়িতেছে। আমি ঈশ্বরের বাক্য সর্ব্বদা প্রিয় জ্ঞান করি, বিশেষতঃ ঐ ছোট ছেল্যার মৃদু রব আমার কর্ণে তখন এমত মিষ্ট বোধ হইল, যে আমি তৎক্ষণাৎ ঘরের দ্বার কিঞ্চিৎ খুলিয়া জিজ্ঞাসিলাম, ও গো, আমি কি ভিতরে যাইতে পারি? কোন ব্যক্তি ভিতরহইতে উত্তর করিল, আসুন! তাহাতে আমি গৃহের মধ্যে প্রবেশ করিয়া এক জন অতিবৃদ্ধা স্ত্রীলোককে দেখিলাম; তাহার চুল নিতান্ত পাকা, এবং তাহাকে বড় দুর্বল বোধ হইল। সে আমাকে দেখিবা মাত্র উঠিয়া দাঁড়াইল, পরে সেলাম করিয়া বলিল, মেম সাহেব, আমার নিকটে কি আপনকার কোন প্রয়োজন আছে?

 আমি উত্তর করিলাম, না, এমত কোন প্রয়োজন নাই; কিন্তু বাহিরহইতে ধর্ম্মপুস্তকের কথা শুনিয়া আমি বোধ করিলাম, যদ্যপি এই গৃহে প্রবেশ করি তবে ঈশ্বর ভয়কারী কোন লোকদের সাক্ষাৎ পাইব, এবং আমার প্রিয়তম ত্রাণকর্ত্তার বিষয়ে অবশ্য কিছু কথোপকথন করিতে পারিব।

 ইহা শুনিয়া ঐ বৃদ্ধা স্ত্রী কহিল, যদি এমত হয় তবে মেম সাহেব আপনি বসুন; কেননা ধর্ম্মপুস্তকে লেখা আছে, “আতিথ্য ব্যবহারেতে কেহ২ না জানিয়া দিব্য দূতগণকেও অতিথি করিয়াছে।” ইব্রীয় ১৩।৩।

 এই দিনহীনা বাঙ্গালি স্ত্রীলোকের মুখে এরূপ উত্তম সভ্যতার কথা শুনিয়া আমি মনের মধ্যে ভাবিলাম, এমত শিষ্টাচার নিতান্তই খ্রীষ্টধর্ম্মের ফল; কেননা সে ধর্ম্মের এমত এক গুণ আছে, যে তদ্দ্বারা যে কোন দেশে হউক যাহারা তাহা সত্যরূপে অবলম্বন করে, তাহারা পূর্ব্বে অসভ্য ও অজ্ঞান হইলেও তৎপরে প্রেমী ও দয়ালু ও সদ্ভাবী হইয়া উঠে।

 আমি গৃহে প্রবেশ করিবামাত্র উক্ত ছোট পাঠক ধর্ম্মপুস্তক রাখিয়া শীঘ্র পলায়ন করিল, তাহাতে আমি প্রথমে তাহাকে চিনিতে পারিলাম না বটে; কিন্তু সে যখন একখানি চৌকি হাতে করিয়া ফিরিয়া আইল, তখন দেখিলাম যে সে ফুলমণির কন্যা সত্যবতী। বুড়ির গৃহে চৌকি নাই, ইহা জানিয়া সে দৌড়িয়া আমার নিমিত্তে আপন বাটীহইতে পূর্ব্বোক্ত পুরাতন চৌকি আনিল।

 তাহাতে আমি তাহাকে বলিলাম, সত্যবতি, তুমি যে এই বৃদ্ধা স্ত্রীলোকের নিকটে ধর্ম্মপুস্তক পাঠ কর, সে বড় ভাল কর্ম্ম, আমি তাহাতে বড় সন্তুষ্টা আছি। কিন্তু সত্যবতী এই প্রশংসা শুনিয়াও কিছু মাত্র অহংকার না করিয়া কহিল, মেম সাহেব, প্যারী দিদি চক্ষে আর ভাল দেখিতে পায় না, এই জন্যে আমি কখন২ ইহার নিকটে ধর্ম্মপুস্তক পড়ি। খেলা অপেক্ষা আমি পড়া বড় ভাল বাসি।

 তখন প্যারী কহিল, হাঁ মেম সাহেব, সত্যবতী বড় ভাল মেয়্যা; এ আমার অনেক কর্ম্ম করিয়া দেয়, এই সকলের জন্যে ঈশ্বর ইহাকে অবশ্য পুরস্কার দিবেন। মেম সাহেব, ইহার মাতা ইলীশেবার ন্যায় নির্দোষকাপে পরমেশ্বরের সমস্ত আজ্ঞা ও বিধি পালন করিয়া ঈশ্বরের দৃষ্টিতে ধার্ম্মিকা আছে। সে আপন মেয়্যাকে এই সুশিক্ষা দিয়াছে, যে জন দরিদ্রের নিমিত্তে ভাবনা করে সেই ধন্য।

 ধর্ম্মপুস্তকের বাক্যের বিষয়ে এই বৃদ্ধা স্ত্রীলোকের জ্ঞান দেখিয়া আমি চমৎকৃতা হইলাম; কিন্তু পশ্চাৎ তাহার সহিত বার২ আলাপ করিয়া জানিতে পারিলাম, যে প্যারী সেই বাক্য আপন আহার স্বরূপ জ্ঞান করিয়া দিবা রাত্রি কেবল সে সকল বিষয় চিন্তা করিত।

 হায়২! এতদ্দেশীয় খ্রীষ্টিয়ান স্ত্রীলোকদের মধ্যে অনেকেই ধর্ম্মপুস্তক না পড়িয়া অবহেলা করে; এ বড় দুঃখের বিষয় বটে। তাহারা যদি ধর্ম্মশাস্ত্রের মনোরঞ্জক ইতিহাস পড়িত, তবে তাহাদের বিস্তর আমোদ ও ধর্ম্মজ্ঞান জন্মিত; এবং তাহারা যদি ঐ সকল ইতিহাস ভাল রূপে জানিত, তবে আপন সন্তানদিগকে ভূত ও রাক্ষসাদির বিষয়ে অনর্থক গল্প না বলিয়া ঐ সুন্দর হিতজনক বিবরণ বর্ণনা করিতে পারিত। আর তাহারা দায়ূদের গীত ও ভবিষ্যদ্বক্তৃগণের লিপিদ্বারা দুঃখের সময়েও সান্ত্বনা প্রাপ্তা হইত; বিশেষতঃ যীশু খ্রীষ্ট্রের চরিত্র ও প্রেরিতদের পত্র পড়িয়া অতি হিতজনক নিদর্শন ও শিক্ষা পাইত।

 অতঃপর প্যারী আমাকে বলিল, মেম সাহেব, আপনি যখন গৃহে আসিয়া উপস্থিতা হইয়াছিলেন, তখন আমরা ধর্ম্মপুস্তকের যে পদটি পড়িতেছিলাম, তাহা ভালরূপে বুঝিতে পারি নাই; অতএব আপনি যদি অনুগ্রহ করিয়া তাহা আমাকে বুঝাইয়া দেন, তবে আমার বড় উপকার হয়। সে বাক্য এই, যথা “যে ব্যক্তি আমার মাংস ভোজন করে এবং আমার রক্ত পান করে, সে আমাতে বাস করে, এবং আমিও তাহাতে বাস করি।” যোহন ৬।৫৬। দেখ, মেম সাহেব, যিহুদীয়েরা যেমন বচসা করিয়া বলিল, এ ব্যক্তি ভোজনের জন্যে আপন মাংস আমাদিগকে কেমন করিয়া দিবে? আমি তেমনি বলি না; কেননা আমি জানি যে যীশু এ কথাই দৃষ্টান্তভাবে বলিলেন; তথাচ তাহার যথার্থ অর্থ কি, তাহা আমি ভালরূপে বুঝিতে পারি নাই।

 এই কথা শুনিয়া আমি মনের মধ্যে ঈশ্বরের নিকটে এই প্রার্থনা করিলাম, হে ঈশ্বর! উক্ত বাক্য সাংসারিক ব্যক্তির বোধগম্য নয়, কিন্তু তোমার বৃদ্ধ দাসীকে যেন তাহা স্পষ্টরূপে বুঝাইয়া দিতে পারি, এমত জ্ঞান ও শক্তি আমাকে প্রদান কর। তাহার পর আমি বুড়িকে বলিলাম, দেখ, আত্মার মধ্যে যদি ধর্ম্মকে বাঁচাইয়া রাখিতে চাহি, তবে তাহাকে আহার দিতে হইবে, এবং যে আত্মার পুনর্জন্ম হইয়াছে, তাহার কেবল এক আহার মাত্র আছে, সেই আহার যীশু খ্রীষ্ট। ঈশ্বরের সন্তানদের এই রূপ খাদ্য না হইলেই নয়, তাহা পাইতে তাহাদের লালসা আছে, এবং যদি তাহারা তাহা খাইতে না পায়, তবে দুর্বল ও দুঃখিত হইয়া নিরাশ হয়। কিন্তু এমত দুর্ঘটনাহইতে উত্তীর্ণ হইবার নিমিত্তে যীশুর নিকটে গিয়া বিশ্বাসদ্বারা তাঁহাকে সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করা আবশ্যক। আত্মা শরীরের মত নয়, ফলতঃ শরীর মুখদন্তাদিদ্বারা ভোজন করে, কিন্তু আত্মা প্রার্থনা ও নম্রতা ও ধ্যান ও বিশ্বাস ও কৃতজ্ঞতা এবং প্রেমদ্বারা খ্রীষ্টকে গ্রহণ করিয়া তৃপ্ত হয়। যদি কোন মনুষ্য আসিয়া আমাদিগকে বলে, অমুক স্থানে অদ্য বড় একটি ভোজ প্রস্তুত হইয়াছে, এবং আমরা যদি গিয়া সেই ভোজ আহার না করিয়া কেবল তাহার প্রতি দৃষ্টি করি, তবে আমরা তাহাতে কোন রূপে তৃপ্ত হইব না। খাদ্য দ্রব্য ভোজন না করিলে ও তাহা পরিপাক না হইলে, তদ্দ্বারা শরীরের কিছু মাত্র পুষ্টি হয় না; সেই মত খ্রীষ্টকে ভক্তিপূর্ব্বক অন্তঃকরণের মধ্যে গ্রহণ এবং বিশ্বাসদ্বারা তাঁহার মাংস ও রক্তকে নিত্য২ ভোজন ও পান না করিলে আমাদের আত্মা ধর্মে বৃদ্ধি পাইতে কিম্বা স্থির থাকিতে পারে না।

 এই সকল কথা শুনিয়া প্যারী বলিল, মেম সাহেব, এখন আমি যীশু খ্রীষ্টের ঐ বাক্যের অর্থ ভালরূপে বুঝিতে পারিয়াছি, এবং তদ্দ্বারা আমার মন বড় আহ্লাদিত হইতেছে; কারণ আমি নিশ্চয় জানিলাম, যে আমি কেবল বুদ্ধির সহিত খ্রীষ্টের উপর বিশ্বাস করিয়াছি তাহা নয়, কিন্তু তাঁহাকে অন্তঃকরণের মধ্যে গ্রহণ করিয়া তাঁহার বাক্যদ্বারা নিত্য২ প্রতিপালিত হইতেছি। প্যারী আরও বলিল, ও মেম সাহেব, আমি কখন২ সমস্ত দিন এই ক্ষুদ্র গৃহে একা বসিয়া থাকি; সে সময়ে আমার প্রিয় ত্রাণকর্ত্তা যদি আমার নিকটে না থাকিতেন, তবে আমার কেমন ভারি দুঃখ হইত। কিন্তু তিনি আমাকে কখন ত্যাগ করেন না, বরং আমি সর্ব্বদা তাঁহার সহিত আলাপ করিতে পারি; এই জন্যে সুদশা বা দুর্দশা হউক, আমি নিরন্তর মনের সুখ ও সান্ত্বনা ভোগ করি।

 ইহা শুনিয়া আমি বলিলাম, প্যারি, যদি এমত হয়, তবে আমি অনেকবার তোমার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিব, কারণ আমি নিশ্চয় জ্ঞাত হইলাম, যে খ্রীষ্টেতে আমরা দুই জনে ভগিনী স্বরূপ হইয়াছি, এবং দুই জনে মৃত্যুর পরে এক স্বর্গের অধিকারিণী হইব। পরে আমি তাহাকে জিজ্ঞাসিলাম, হে প্যারি, তোমার কি কোন কুটম্বাদি নাই? বোধ হয়, দরিদ্রতা প্রযুক্ত তুমি বড় ক্লেশ পাইয়া থাক।

 তাহাতে সে উত্তর করিল, না মেম সাহেব, এমত নয়। আমার আত্মীয় কুটম্ব কেহ নাই বটে, কিন্তু কলিকাতায় এক জন সাহেব আছেন, তিনি আমাকে এই ক্ষুদ্র গৃহখানি বাঁধিয়া দিয়াছেন, এবং প্রতিমাসে তিন টাকা করিয়া পাঠাইয়া দেন। আমি তাহাকে শিশু কালে দুগ্ধ পান করাইয়াছিলাম। আমার নিজ গ্রাম এখানহইতে অনেক দূর, কিন্তু এই স্থানে কি রূপে আইলাম তাহা আপনি শুনুন।

 এখন প্রায় বাওয়ান্ন বৎসর হইল আমি আপন দেশহইতে আসিয়া কলিকাতায় এক ইংরাজের বাটীতে ধাইর কর্ম্ম করিতে লাগিলাম। সে পরিবারের মধ্যে এক জন বড় ধার্ম্মিকা মিস বাবা ছিলেন। তিনি আমাকে খ্রীষ্ট ধর্ম্মের বিষয়ে অনেক সুশিক্ষা দিতেন, তাহাতে আমি ক্রমে২ বোধ করিলাম যে খ্রীষ্ট ধর্ম্ম সত্য বটে; তথাচ হিন্দু লোকদের সাক্ষাতে ইহা স্বীকার করিতে এবং জাতি ত্যাগ করিতে আমার বড় লজ্জা হইল। যে শিশু বাবাকে আমি দুগ্ধ দিতাম, সে দেড় বৎসরের হইলে আমার মেম সাহেব আমাকে বলিলেন, ও ধাই, আমার পুত্ত্র বড় হইয়াছে, অতএব আগত মাসে আমি তোমাকে বিদায় করিব।

 আমাকে যাইতে হইবে, ইহা শুনিয়া আমি বড় দুখিতা হইলাম, কারণ আমার জনি বাবাকে আমি অতিশয় প্রেম করিতাম। সেই সময় অবধি আমি সমস্ত দিন তাহার নিকটে থাকিয়া তাহাকে নানা প্রকার খেলা করাইতাম ও ছবি দেখাইতাম, তাহাতে সে পূর্ব্বাপেক্ষাও আমার প্রিয় হইল। আর আমি ভাবিতে লাগিলাম, গৃহে গেলে আমাকে পুনর্ব্বার প্রতিমাপূজা করিতে হইবে; কিন্তু প্রতিমাপূজা নিতান্ত অনর্থক তাহা আমি জানিতে পারিয়াছিলাম, অতএব আমার ভয় হইল তাহা করিলে কি জানি ঈশ্বর আমাকে একেবারে নষ্ট করিবেন। এই সকল মনের মধ্যে বিচার করিয়া আমার বড় ভাবনা জন্মিতে লাগিল।

 এমত সময়ে, এক দিবস আমার শিশুবাবার উলাউঠা রোগ হইল, তাহাতে তাহাকে অনেক প্রকার ঔষধাদি দেওয়া গেল, তথাপি রোগের প্রতিকার হইল না, এবং সন্ধ্যাকালে ডাক্তর সাহেব বলিলেন, ছেল্যার বাঁচিবার কিছু মাত্র ভরসা নাই। ও মেম সাহেব, এই কথা শুনিয়া আমার হৃদয় বিদীর্ণ প্রায় হইল। সে সময়ে আমি হিন্দু দেবতাগণের নাম উচ্চারণ না করিয়া কেবল খ্রীষ্টিয়ানদের ঈশ্বরের নিকটে উচ্চৈঃস্বরে প্রার্থনা করিলাম, যেন তিনি আমার প্রিয়তম বাবাকে রক্ষা করেন।

 পূর্ব্বোক্ত মিসি বাবা ইহা শুনিয়া আমাকে বলিলেন, ধাই, তুমি যদি কিছু তাড়নার জন্যে মানুষের সাক্ষাতে যীশু খ্রীষ্টের ধর্ম্ম স্বীকার করিতে ভয় কর, তবে এখন দুঃখের সময়ে ঈশ্বর যে তোমার প্রার্থনা শুনিবেন, ইহা কি প্রকারে ভরসা করিলা? এই কথা সেই সময়ে উপযুক্ত হওয়াতে ধর্ম্মাত্মার পরাক্রমদ্বারা আমার শোকাকুল মনে শক্তরূপে লাগিল, তাহাতে আমি সেই দণ্ডে হিন্দু আয়া এবং বেহারার সাক্ষাতে উচ্চৈঃস্বরে বলিলাম, হে আমার ঈশ্বর! আমি তোমাকে বিশ্বাস করিয়া খ্রীষ্টিয়ান হইলাম, অতএব এখন আমার প্রার্থনা শুন, কারণ তুমি আপন সন্তানদের প্রার্থনা শুনিতে অঙ্গীকার করিয়াছ। সেই সময় অবধি আমার বাবা সুস্থ হইতে লাগিল, এবং আমিও সেই অবধি আপনার অঙ্গীকার পালন করিলাম।

 এই কথাতে ঐ বৃদ্ধা স্ত্রীলোকের চক্ষু জলেতে পরিপূর্ণ হইলে সে আরও কহিল, হাঁ! মেম সাহেব, সে কাল অবধি আমি পঞ্চাশ বৎসর পর্য্যন্ত খ্রীষ্টের সেবা করিয়া আসিতেছি। তাঁহার নামের জন্যে আমি আপন পিতা ও মাতা ও স্বামী এবং তিন জন প্রিয়তম সন্তানকে ত্যাগ করিয়াছি; কিন্তু তাহাদের বিরহে অদ্যাবধি আমি কখন খেদ করি নাই, কেননা যীশু পরিবারহইতেও ভাল; তিনিই আমার সকল প্রয়োজনীয় দ্রব্য যোগাইয়াছেন।

 পরে জনি বাবা সম্পূর্ণরপে সুস্থ হইলে আমি মেম সাহেবের নিকটে বলিলাম, আপনি অনুগ্রহ করিয়া আমার স্বামিকে ডাকাইয়া বলুন, তোমার স্ত্রী খ্রীষ্টধর্ম্ম অবলম্বন করিতে নিতান্ত মানস করিয়াছে। অনন্তর মেম সাহেব সেইরূপ করিলেন, কিন্তু আমার স্বামী তাহা শুনিয়া বিশ্বাস না করিয়া বলিল, আমার স্ত্রী কোথায়? এ কথা সত্য কি মিথ্যা, তাহা আমি তাহার নিজ মুখে শুনিব। তখন আমি বড় ভয় পাইয়া তাহার সম্মুখে গেলাম, কিন্তু কিঞ্চিৎ পরে ঈশ্বর আমাকে সাহস ও অনুগ্রহ প্রদান করিলেন, তাহাতে আমি স্পষ্টই কহিলাম, হাঁ গো, আমি বিবেচনা করিয়া দেখিয়াছি যে খ্রীষ্ট ধর্ম্ম সত্য, অতএব আমি সেই ধর্ম্ম গ্রহণ করিব।

 হায়! এই কথা শুনিয়া তাঁহার অতিশয় রাগ হইল, তাহাতে তিনি বলিলেন, তোর ধর্ম্ম বিষয়ে কিছুই চেষ্টা নাই, কেবল তুই বিলাতি ভাতার করিতে চাস্! এই কথা বলিয়া তিনি আমাকে কত শাপ ও গালাগালি দিতে লাগিলেন, পরে আমার মুখে থুথু দিতে আমার সন্তানদিগকে বলিয়া দিলেন; কিন্তু তাহারা তাহাদের পিতা অপেক্ষা কিঞ্চিৎ নম্রমনা হইয়া আমার গলা ধরিয়া কাঁদিতে লাগিল। এক জন বলিল, ও মা! খ্রীষ্টিয়ান হইও না, তোমার জাতি গেলে কেহ তোমার সঙ্গে বসিয়া খাইবে না। আর এক জন বলিল, মা, আজি তোমার জন্যে আয়ি বড় উত্তম পিঠা গড়িয়া রাখিবেন; কেননা তিনি কহিলেন, মেম সাহেব যখন তোমাদিগকে ডাকিয়া পাঠাইয়াছেন, তখন তিনি অবশ্য তোমাদের মাতাকে বিদায় দিবেন। ও মা, সে পিঠা তোমাকে খাইতে হইবে; আমাদের সঙ্গে চল মা! চল।

 স্বামির সকল শক্ত কথা ও নিন্দা আমি স্বচ্ছন্দে সহ্য করিতে পারিয়াছিলাম, কিন্তু সন্তানদের এ রূপ প্রেমিক ব্যবহার দেখিয়া আমার মন অতি ব্যাকুল হইল। আমি এক বার মনে করিলাম, যদি ঘরে যাইয়া স্বামির সাক্ষাতে ঠাকুর পূজা করি, ও সন্তানদিগকে গোপনে খ্রীষ্টের বিষয়ে শিক্ষা দিই, তবে তাহারা বয়ঃপ্রাপ্ত হইলে আমি সন্তান সুদ্ধ খ্রীষ্টিয়ান হইতে পারিব। কিন্তু ধর্ম্মাত্মা দয়ালু হইয়া শয়তানের এই কুমন্ত্রণা আমার মনহইতে দূর করিলেন, তাহাতে আমি সাহসপূর্ব্বক সন্তানদিগকে বলিলাম, আমি তোমাদের সহিত যাইতে প্রস্তুত আছি, কিন্তু আমি ঠাকুর পূজা

করিতে পারিব না। আমি খ্রীষ্টিয়ান হইব, তাহা হইলে বোধ হয় তোমাদের পিতা আমাকে কখন গৃহে লইয়া যাইবেন না।

 আমার স্বামী এই কথা শুনিয়া আরও রাগান্বিত হইয়া বলিলেন, তোকে আর কে লইয়া যাইবে? তোর মৃত্যু হইলেই আমার প্রাণ জুড়ায়। পরে তিনি ছেল্যাদের হাত ধরিয়া তাহাদিগকে টানিয়া লইয়া গেলেন। মেয়্যাটি আমার নিকটে থাকিতে বড় ইচ্ছা করিয়া আমার গলা ধরিয়া কাঁদিতে লাগিল, কিন্তু তাহার পিতা আমাকে ঠেলে ফেলিয়া আমার কোলহইতে তাহাকে কাড়িয়া লইলেন। সেই দিন অবধি আজি পর্য্যন্ত তাহাদের মধ্যে আমি কোন এক জনের দর্শন পাই নাই।

 ও মেম সাহেব, আমি আর কি বলিব? দশ বারো দিন পর্য্যন্ত আমি প্রায় হতজ্ঞান হইয়া আহারাদি ত্যাগ করিয়াছিলাম, তাহাতে সে সময়ে যদি মেম সাহেবের পরিবার আমার প্রতি প্রেমিক ব্যবহার না করিতেন, তবে বোধ হয় আমি শয়তানের ফাঁদে পতিতা হইয়া আপন ছেল্যাদের নিকটে ফিরিয়া যাইতাম। কিন্তু আমার মেম সাহেব ও মিসি বাবা অনেক প্রবোধ দিয়া আমাকে সান্ত্বনা করিলেন, তাহাতে কিছু দিন পরে প্রভুর মহা অনুগ্রহদ্বারা আমার মন সুস্থির হইলে আমি খ্রীষ্টিয়ান মণ্ডলীতে গৃহীতা হইলাম।

 পরে আমাদের মিসি বাবা এক জন পাদরি সাহেবকে বিবাহ করিলে আমি তাঁহার নিকটে প্রায় পঁচিশ বৎসর পর্য্যন্ত আয়ার কর্ম্ম করিলাম। তাহার পর আমি যে শিশুবাবাকে দুগ্ধ পান করাইয়াছিলাম, তিনি যুবা হইয়া বিলাতহইতে ফিরিয়া আসিয়া এক উচ্চ পদে নিযুক্ত হইলেন; তথাচ তিনি আপন ধাইকে ভুলিয়া গেলেন না, বরং তাঁহার বিবাহ হইলে তিনি আমাকে আপন গৃহে লইয়া গেলেন, এবং আমার সাক্ষাতে তাঁহার সাতটি সন্তান জন্মিল।

 দুই বৎসর হইল তিনি আমাকে বলিলেন, ধাই, এখন তুমি অতিশয় বৃদ্ধা হইয়াছ, তোমাকে আর কর্ম্ম করিতে হইবে না। অতএব বোধ হয় তোমাকে কোন খ্রীষ্টিয়ান লোকদের নিকটে বসতি করিতে দিলে ভাল হয়, কেননা তোমার পীড়াদি হইলে তাহারা তোমার প্রতি প্রেমিক ব্যবহার করিয়া তোমার সেবা করিবে। আমি এই কথায় স্বীকৃতা হইলাম, তাহাতে আমার বাবা সাহেব আমাকে এস্থানে আনিয়া এই ঘরখানি বাঁধাইয়া দিলেন, এবং পাদরি সাহেবের নিকটে সবিশেষ জানাইয়া তাঁহার সমীপে আমাকে সমর্পণ করিয়া গেলেন।

 পাদরি সাহেবের মেম আমার প্রতি বড় দয়া প্রকাশ করেন। বাবা সাহেব যে তিনটি টাকা আমার জন্যে পাঠাইয়া দেন, তাহা তিনি মাসে২ আপনি আমাকে দিতে আইসেন, এবং আমাকে অনেক প্রবোধ ও সান্ত্বনার কথা কহেন। আর ফুলমণি ও তাহার স্বামী ও ছেল্যারা আমার প্রতি যেরূপ প্রেমিক ব্যবহার করে, তাহা আমি প্রায় বর্ণনা করিতে পারি না। সত্যবতীর পিতা আমাকে মা বলে, ও ছেল্যারা আমাকে দিদি বলে; ইহা যে নামমাত্র তাহাও নয়, বরং তাহারা গর্ভজাত পুত্ত্র ও কন্যার ন্যায় আমার প্রতি স্নেহ করে।

 আমার বাবা সাহেব বায়ু সেবনার্থে একবার পশ্চিম দেশে যাইতেছিলেন, তাহাতে তিনি আমাকে দেখিতে আইলেন, এবং এই ক্ষুদ্র ঘরে

অনেক ক্ষণ বসিয়া আমার সহিত ধর্ম্মের বিষয়ে কথোপকথন করিলেন, ও বিদায় হইবার সময়ে তিনি প্রার্থনা করিয়া গেলেন।

 এই সকল কথা শেষ হইলে প্যারী আরোও আমাকে বলিল, মেম সাহেব, আপনি যদি আজি যাইবার পূর্ব্বে একটি ক্ষুদ্র প্রার্থনা করেন, তবে আমি বড় আহ্লাদিতা হই। আমি এই কথাতে একেবারে সম্মতা হইলাম, তাহাতে আমরা দুই জনে ঈশ্বরের সম্মুখে হাঁটু পাতিয়া প্রার্থনা করিলাম। প্রার্থনার মধ্যে আমি এই নিবেদন করিলাম, হে প্রভো! ইহার পরে আমাদের দুই জনের পরস্পর যে আলাপ হইবে, তাহাতে তুমি আশীর্ব্বাদ দেও, যেন তদ্দ্বারা আমাদের উভয়ের ধর্ম্মবৃদ্ধি হয়।

 প্রার্থনা হইলে পর প্যারী উক্ত কথা মনে করিয়া বলিল, হে মেম সাহেব, এ দরিদ্রা বুড়ির গৃহে কখন২ আসিয়া ইহার সহিত ধর্ম্মের বিষয়ে কথা কহিবেন, ও ইহাকে শাস্ত্র বুঝাইয়া দিবেন, আপনি যদি এমত মানস করিয়াছেন, তবে আমার কত বড় সৌভাগ্য! এমন হইলে আমি দায়ূদ রাজার ন্যায় বলিতে পারিব, “আমার আশীর্ব্বাদরূপ পানপাত্র উথলিয়া পড়িতেছে।” ২৩ গীত।

 খ্রীষ্টের এই বৃদ্ধা সেবিকা আপনার মনোরঞ্জক ইতিহাস আমাকে যেরূপে কহিয়াছিল, সেইরূপে আমি লিখিয়াছি, এবং আমার এ বিষয়ে আর কিছু বলিবার কোন আবশ্যক নাই। আমি সে দিবসে তাহার নিকটে যে প্রকার প্রেমভাবে বিদায় হইলাম, তাহা পাঠকবর্গেরা স্বচ্ছন্দে অনুমান করিতে পারিবেন। বালুকাময় অরণ্যেতে তৃষিত ও পথশ্রান্ত পথিক জন যেমন জলস্রোত পাইয়া তৃপ্ত হয়, তদ্রূপ আমিও এই মিথ্যা দেবগণের অন্ধকারময় রাজ্যের মধ্যে এমত ধর্ম্মরূপ উজ্জ্বল দীপ্তি দেখিয়া অতিশয় আনন্দিতা হইলাম, এবং তৎক্ষণাৎ আমার মন তাহার প্রতি আসক্ত হইয়া প্রেমরজ্জুদ্বারা বদ্ধ হইল। আহা! আমরা যদি খ্রীষ্টীয় লোকদের প্রতি এই রূপ আকর্ষিত হই, এবং যে ব্যক্তিতে আমাদের স্বর্গস্থ পিতার সাদৃশ্য দেখিতে পাই তাহাকে যদি স্নেহ করি, তবে তদ্দ্বারা সুন্দররূপে জানা যায় যে আমরাও খ্রীষ্টের লোক বটি। কিন্তু যদি খ্রীষ্টের সেবকদের প্রতি আমাদের ক্রোধ, দ্বেষ ও হিংসা থাকে, তবে আমরা কোন প্রকারে ঈশ্বরের লোক নহি। সংসারের মধ্যে ভাই ভগিনীরা আপনাদিগকে এক পিতার সন্তান সন্ততি জানিয়া পরস্পর প্রেম করে, তদ্রূপ সত্য খ্রীষ্টিয়ানেরা এক ঈশ্বরকেই পিতা বলিয়া এক ত্রাণকর্ত্তাকেই জ্যেষ্ঠ ভ্রাতারূপ জ্ঞান করিয়া প্রেম করুক।

 খ্রীষ্টিয়ান লোকদের পরস্পর যে বন্ধুতা জন্মে, সকল সাংসারিক প্রীতিহইতে সে বন্ধুতা শ্রেষ্ঠ, কেননা সেই প্রীতি কেবল ইহকালের জন্যে না হইয়া পরকালে স্বর্গেতে আরও দৃঢ় হইবে। বৃদ্ধা প্যারীর প্রতি আমার এই রূপ প্রেম জন্মিয়াছিল, এবং অল্প দিনের মধ্যে আমরা দুই জনে স্বর্গরাজ্যে একত্র বসিয়া আপন ত্রাণকর্ত্তার উদ্দেশে গান গাইব, ইহা নিশ্চয় বোধ করিয়া আমার মন অতিশয় আহ্লাদযুক্ত হইল।