ফুলমণি ও করুণার বিবরণ/পঞ্চম অধ্যায়

পঞ্চম অধ্যায়।

 উক্ত ঘটনার কিছু কাল পরে আমি এক দিন করুণার বাটীতে পুনর্ব্বার যাইতে মানস করিলাম। ইহার মধ্যে তাহার বিষয়ে নিতান্ত বিস্মৃতা ছিলাম এমত নয়, বরং তাহার ভাঙ্গা ঘর ও মলিন বস্ত্রাদি প্রায় প্রতি দিবস আমার মনে পড়িলে আমি নিত্য২ দয়ার সিংহাসনের সম্মুখে তাহাকে স্মরণ করিয়া প্রার্থনা করিতাম, যেন ঈশ্বর তাহার মন ফিরাইয়া তাহাকে সুপথে আনেন। করুণার দুঃখ যাহাতে শেষ হয়, আমি এমত একটি উপায় চেষ্টা করিতেছিলাম, এই নিমিত্তে আমি তাহার নিকটে হঠাৎ না গিয়া কিঞ্চিৎ বিলম্ব করিলাম। তাহার ছোট পু্ত্ত্র নবীনের যে প্রকার আচার ব্যবহার দেখিয়াছিলাম, তদ্দ্বারা আমি বোধ করিলাম, যদি কেহ তাহাকে সুশিক্ষা দিয়া বাধ্য রাখে, তবে কি জানি সে চতুর ও উত্তম বালক হইয়া উঠিতে পারে। আমি লোকদের মুখে শুনিয়াছিলাম করুণার এক জন বড় সন্তানও আছে, অতএব মনে করিলাম, যদ্যপি এই দুই জন বালককে কোন কর্ম্ম দিয়া উদ্যোগী ও পরিশ্রমী করাইতে পারি, তবে তদ্দ্বারা তাহাদের কিছু লাভ হইতে পারে, এবং তাহাদের দুঃখিনি মাতারও উপকার সম্ভাবনা হয়। এই জন্যে আমি মনে স্থির করিলাম, করুণা ইহাতে স্বীকৃতা হইলে আমি তাহার দুই পুত্ত্রকে নিজ বাটীতে আনিয়া বেহারার এবং খানসামার কর্ম্ম শিক্ষা করিতে দিব।

 এমত অভিপ্রায়ে আমি এক দিবস করুণার গৃহে যাইয়া উপস্থিত হইলাম। হায়২! সেখানে কেমন খেদজনক ব্যাপার দৃশ্য হইল। করুণা আপন দ্বারের শিড়ীর উপরে বসিয়া অতিশয় ক্রন্দন করিতেছিল, এবং তাহার মস্তকের একটা বড় ক্ষতহইতে দুই গাল বহিয়া রক্ত পড়িতেছিল। সে আমাকে দেখিবা মাত্র বলিতে লাগিল, আ! মেম সাহেব, আজি আপনি ভাল সময়ে আসিয়াছেন। আমার এই দুর্দশা আপনি স্বচক্ষে দেখিলেন। বিবেচনা করুন আমি অতি দুর্ভগা, আমি কোথাহইতে সুন্দর ঘর ও পরিষ্কার বস্ত্র পাইতে পারি? ও মেম সাহেব, যদি ঘরের মধ্যে মিষ্ট বাক্য বলে, তবে দুই দিন অনাহারে থাকিলেও থাকা যায়; কিন্তু এই রূপ নিত্য ঝকড়া মারামারি ইত্যাদি আমি আর সহ্য করিতে পারি না। হায়! আমার মৃত্যু হইলে ভাল হয়।

 আমি উঠানের মধ্যে এক গামলা শীতল জল দেখিতে পাইয়া তৎক্ষণাৎ তাহাতে আপন রূমাল ডুবাইয়া করুণার মাথার ক্ষতস্থানে দিলাম, এবং পুনঃ২ এই রূপ করিলে ক্রমে২ রক্ত স্রোত নিবারণ হইল। পরে আমি প্রেমভাবে তাহাকে জিজ্ঞাসিলাম, করুণা, তুমি কি প্রকারে এমত ক্ষত বিক্ষতা হইলা?

 করুণা উত্তর করিল, মেম সাহেব বলি, শুনুন। আজি আমি তাবৎ দিন কিছু খাইতে না পাইয়া তিনটা বেলার সময়ে ফুলমণির নিকটে দুইটি পয়সা চাহিয়া আনিলাম; পরে তদ্দ্বারা কতক গুলিন ছোট২ মাছ কিনিয়া রাত্রিতে ইহা রান্ধিব এমত মনে করিয়া সেই মাছ কুটিয়া ধুইয়া রাখিতেছি, এমত সময়ে আমার স্বামী আর দুই জন পুরুষকে সঙ্গে লইয়া ঘরে আইল। তাহারা সকলে কিঞ্চিৎ মত্ত ছিল, তাহাতে আমার স্বামী বড় রাগান্বিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল, ও গো, ভাত তৈয়ারি আছে কি না? আমি উত্তর দিলাম, চারিটার সময়ে কি ভাত হয়? মাতাল হইয়া কি বলিতেছ, তুমি তাহা জান না; আর তুমি কে, যে তুমি ভাত চাহিতে আসিয়াছ? খরচের নিমিত্তে তুমি কি পয়সা দিয়াছিলা? সে এই কথা শুনিয়া কোটা মাছের চুপ্‌ড়িকে মাছ সুদ্ধ লাথি মারিয়া নর্দমাতে ফেলিয়া কহিল, তুই এমত কথা বলিস? আমি যদি পয়সা না দিই, তবে এই মাছ কি প্রকারে আপনার জন্যে যোগাইয়া রাখিয়াছিলি? আমাকে এই রূপে ভর্ৎসনা করিয়া সে আপন মাতওয়ালা সঙ্গিদের প্রতি ফিরিয়া কহিল, চল ভাই, আজি আমাদের পয়সার অভাব নাই; অতএব এ বেটী যদ্যপি খাইতে না দিল, ভাবনা কি? অন্য স্ত্রীলোকদের সহিত আমাদের পরিচয় আছে কি না? এই কথা কহিয়া সে আমাকে অত্যন্ত মারিল, পরে তাহারা সকলে চলিয়া গেল।

 আমি ইহা শুনিয়া জিজ্ঞাসিলাম, করুণা, তোমার স্বামী মাছ ফেলিয়া দিলে তুমি কি তাহাকে কিছু কহিলা না? করুণা উত্তর করিল, হাঁ মেম সাহেব, কহিব না কেন? আমি তাহাকে যথেষ্ট গালি দিলাম। এমত কর্ম্ম ও এমত কথা কি সহ্য করা যায়? যে দিনে তাহার কাছে কিছু টাকা কড়ি না থাকে, সে দিনে আমি যাহা দিই তাহা সে চুপ্ করিয়া খায়; কিন্তু যখনি চারি পাঁচ আনা উপায় করে, তখনই আমার এই প্রকার দশা হয়। কল্য প্রাতে তাহার নিকটে একটিও পয়সা থাকিবে না, রাত্রের মধ্যেই মদ্যপান ও বেশ্যাগমনাদি দ্বারা সকলি ব্যয় করিবে।

 পরে আমি বলিলাম, দেখ করুণা, তোমার স্বামী মাতওয়ালা ছিল, অতএব কি করিল, কি বলিল, সে সময়ে তাহার কিছু জ্ঞান ছিল না; এমত কালে তাহার প্রতি অনুযোগ করা কেবল অনর্থক, এবং গালি দেওয়া সর্ব্বদা মন্দ, তদ্দ্বারা কখনও ভাল ফল হয় না। তুমি যদি তাহাকে গালি দিয়া তাহার রাগ বৃদ্ধি না করিতা, তবে, তোমাকে এত মার খাইতে হইত না।

 করুণা কহিল, মেম সাহেব, ফুলমণিও আমাকে এ কথা বলিয়া থাকে, তাহাতে আমি কখন২ মনে স্থির করি, যে আমি স্বামির প্রতি মিষ্ট বাক্য বলিলে তদ্দ্বারা সে নম্র হয় কি না, তাহা দেখিব; কিন্তু সে যখন বড় মাতওয়ালা হইয়া ঘরে আইসে, তখন মিষ্ট বাক্য সকল আমার মনে আর পড়ে না, কেবল রাগের কথা মনে উঠে। লোকেরা এই সকল বিবেচনা না করিয়া কেবল আমাকেই দোষ দেয়, এবং আমার স্বামিকে উত্তম পুরুষ বোধ করে, ইহাতে আমার মনে বড় দুঃখ হয়। আজি কেবল দুই দিন হইল ফুলমণি আমাকে বলিল, ও গো করুণা! তোমার স্বামির স্বভাব কোমল ও প্রেমিক, অতএব তুমি যদি তাহাকে কিঞ্চিৎ আদর করিতা, তবে সে অবশ্যই তোমাকে ভাল বাসিত। ফুলমণি কি দেখিয়া এমত কথা বলিল, তাহা আমি বুঝিতে পারি নাই, কেননা আমার প্রতি স্বামী কোনো দিন কোমল ব্যবহার করে নাই। আর ফুলমণি আমার দুঃখের বিষয় কি জানে? তাহার স্বামির অতিশয় সৎস্বভাব, আপনার স্ত্রী যাহা চাহে তাহাই আনিয়া দেয়; কিন্তু ফুলমণি যদি আমার মত আপদগ্রস্তা হইত, তবে সে অন্য প্রকার কথা কহিত।

 তাহাতে আমি কহিলাম; করুণা! তোমার স্বামী যে দুষ্ট ব্যক্তি তাহা স্পষ্ট দৃশ্য হইতেছে; তথাপি তোমাকে এই রূপ স্থির বিবেচনা করিতে হয়, যে সে তোমার বিবাহিত স্বামী, অতএব তাহাহইতে তুমি কোন প্রকারেই পৃথক হইতে পারিবা না; ইহা নিশ্চয় জানিয়া সে যাহাতে ক্রমে২ ভাল হয়, এমত একটি উপায় চেষ্টা করা তোমার কর্ত্তব্য। কিন্তু করুণা, যাহারা আমাদের প্রতি কদাচার করে তাহাদের প্রতি প্রেম করা অতিশয় দুষ্কর, ইহা আমি জানি। যিনি শত্রুদের হস্তে আপন প্রাণ সমর্পণ করিলেন, তাঁহার স্বভাব অর্থাৎ খ্রীষ্টের স্বভাব প্রাপ্ত না হইলে আমরা কখন এমত প্রেম প্রকাশ করিতে পারিব না। হায় করুণা! তুমি যদি সত্য খ্রীষ্টিয়ান হইতা, তবে আমার মনে কিঞ্চিৎ ভরসা জন্মিত, যে তোমার স্বামী দুষ্টতা ত্যাগ করিয়া ক্রমে২ ভাল হইবে; কেননা এই সকল ঈশ্বরীয় বচন অবশ্য সত্য, যথা “কোমল উত্তর ক্রোধ সম্বরণ করায়,” হিতোপদেশ ১৫।১। “ধার্ম্মিক ব্যক্তির একান্ত প্রার্থনা অতি সফল হয়,” যাকুবের পত্র ৫।১৬। “স্বামী অবিশ্বাসী হইলেও বিশ্বাসিনী স্ত্রীর দ্বারা শুচি হয়,” ১ করিন্থীয় ৭।১৪। দেখ, তুমি যদি নিতান্ত খ্রীষ্টের লোক হইতা, তবে তুমি উত্তম ক্রিয়াতে আপন স্বামির কুক্রিয়াকে পরাজয় করিতা; এবং তুমি অবশ্যই তাহার জন্যে প্রার্থনা করিতা, তাহাতে ঈশ্বর তোমার প্রার্থনাতে প্রসন্ন হইয়া তাহার মন ফিরাইয়া দিতে পারিতেন; কিম্বা এমত সুঘটনা যদিও না হইত, তবে কি জানি তোমার অনুরোধে ঈশ্বর তাহাকে এই সকল মহৎ দোষহইতে ক্ষান্ত করাইতেন।

 এই কথাতে করুণা কাঁদিতে২ বলিতে লাগিল, না না, মেম সাহেব, সে যে দোষহইতে ক্ষান্ত হইবে আমার এমত কিছু মাত্র বোধ হয় না। তাহার কথা দূরে থাকুক, কিন্তু সত্য খ্রীষ্টিয়ান হইতে আমার একান্ত ইচ্ছা আছে, কেননা ইহকালে আমি যত দুঃখ পাইতেছি তাহা কেবল ঈশ্বর জানেন; অতএব যদি পরকালে সুখ পাইবার ভরসা থাকিত, তবে আমি কিঞ্চিৎ সান্ত্বনা পাইয়া স্থির থাকিতাম। কিন্তু খ্রীষ্টের সেবা অতিশয় কঠিন, তাঁহার সকল আজ্ঞা যে আমি পালন করিতে পারিব, এমত আমার ক্ষমতা নাই।

 আমি বলিলাম, হায়২ করুণা! খ্রীষ্টের সেবা যে কঠিন তাহা তুমি কি বুঝিয়া কহিলা? ধর্ম্মপুস্তকে এই লেখা আছে, “প্রভু যীশু খ্রীষ্টেতে বিশ্বাস কর, তাহাতেই তুমি ত্রাণ পাইবা।” এবং তিনি আপনি কহিয়াছেন, “আমার যোঁয়ালি অনায়স ও আমার ভার লঘু।”

 করুণা উত্তর করিল, মেম সাহেব, একথা তো সত্য বটে; বিশ্বাস করা অতি সহজ, আমি কি বিশ্বাস করি না? কিন্তু খ্রীষ্টের যে আজ্ঞা পালন তাহা আমাহইতে হয় না।

 তাহাতে আমি বলিলাম, হায় করুণা! তুমি ঐহিক ব্যক্তির ন্যায় কথা কহিতেছ। আমার এই প্রার্থনা, যেন সত্যময় আত্মা খ্রীষ্টের বিষয়ে কথা লইয়া তোমাকে বুঝাইয়া দেন। তুমি বলিতেছ, আমি বিশ্বাস করি; কিন্তু কি বিশ্বাস কর? তুমি যে পাপী ও দীনহীন ও নরকযোগ্য হইলেও খ্রীষ্ট যীশু আপন অমূল্য রক্তদ্বারা তোমাকে ক্রয় করিয়া বাঁচাইয়াছেন, এই সকল যদি বিশ্বাস করিতা তবে বিশ্বাসের সহিত তোমার প্রেমও জন্মিত; এবং খ্রীষ্টের প্রতি প্রেম জন্মিলে তাঁহার আজ্ঞা যে কঠিন নয় তাহা তোমার বোধ হইত। হে করুণা! আমার ভয় হয় যে তোমার বিশ্বাস প্রকৃত বিশ্বাস নহে। বিশ্বাস দুই প্রকার আছে, তাহার দৃষ্টান্ত বলি। কোন গ্রামে এক জনের ভয়ানক রোগ হইয়াছিল, কিন্তু তাহার সে রোগ বোধ হইত না; তাহাতে বন্ধু বান্ধবেরা তাহার ম্লান বদন দেখিয়া তাহাকে কহিল, ওগো, আমাদের এই গ্রামে এক জন প্রসিদ্ধ কবিরাজ আছেন, তাহা তুমি জ্ঞাত আছ; অতএব তুমি শীঘ্র তাহার নিকটে গিয়া ঔষধ খাও, না খাইলে তুমি শীঘ্র মারা পড়িব। ইহা শুনিয়া ঐ রোগী হাসিয়া উত্তর করিল, কবিরাজ যে আছেন, তাহা আমি জানি, এবং তিনি যে উত্তম কবিরাজ তাহাও বিশ্বাস করি; কিন্তু আমার কোন পীড়া হয় নাই, আমি তাঁহার নিকটে কেন যাইব? দেখ করুণা! সে গ্রামে কবিরাজ থাকিলেও আর ঐ নির্বোধ মনুষ্য ইহা বিশ্বাস করিলেও তাহার পক্ষে কবিরাজ না থাকার মত হইল, সুতরাং সে অল্প দিনের মধ্যে ঐ রোগদ্বারা নষ্ট হইল। সে গ্রামে আর এক জন পীড়িত ব্যক্তি অন্য কবিরাজদের নানা প্রকার ঔষধাদি খাইলেও দিনে২ ক্ষীণ হইতেছে, এবং অত্যন্ত ক্লেশ পাইয়া মৃতপ্রায় হইয়াছে, এমত সময়ে এক জন আসিয়া তাহাকে উক্ত প্রসিদ্ধ কবিরাজের গুণ সকল জ্ঞাত করিলে ঐ রোগগ্রস্ত ব্যক্তি বড় আহ্লাদপূর্ব্বক এই সমাচারে বিশ্বাস করিয়া তৎক্ষণাৎ কবিরাজকে ডাকাইয়া পাঠাইল; এবং তিনি তাহাকে ঔষধাদি দিয়া তাহার পীড়া শান্তি করিলে, সে পীড়িত ব্যক্তি কবিরাজের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করিয়া যত্নপূর্ব্বক তাঁহাকে যাবৎ জীবন প্রেম করিল।

 দেখ করুণা, সেই গ্রামে ভাল কবিরাজ আছেন, উক্ত দুই পীড়িত লোকের এমত বিশ্বাস ছিল, কিন্তু প্রথম রোগির কোন প্রকারে প্রেম জন্মিল না, কারণ সে তাহার নিকটে না যাওয়াতে কোন প্রতিকার পাইল না; তাহাতে ঐ ব্যক্তির বিশ্বাস নিতান্ত নিষ্ফল হইল। কিন্তু অন্য রোগির বিশ্বাস তদ্রূপ নহে, বরং সে আপন বিশ্বাস প্রযুক্ত কবিরাজকে ডাকাইয়া রক্ষা পাইল; পরে আপন রক্ষাকর্ত্তার প্রতি তাহার এমত প্রেম জন্মিল যে তিনি যাহা আজ্ঞা করিতেন সে তাহাতেই আহ্লাদপূর্ব্বক সম্মত হইত, ইহা কেবল নয়, অন্য লোকের

নিকটেও সে কবিরাজের গুণকীর্ত্তন করিত। কবিরাজের প্রতি এই দ্বিতীয় জনের যদ্রূপ বিশ্বাস ছিল, খ্রীষ্টের উপরে আমাদের তদ্রূপ বিশ্বাস না হইলে আমরা কোন রূপে ঈশ্বরের রাজ্যে প্রবেশ করিতে পারিব না। ও গো করুণা! তুমি ও আমি এবং পৃথিবীস্থ সকল লোকই পাপরূপ পীড়াতে পীড়িত আছে; অতএব আমার এই পরামর্শ শুন, তুমি পবিত্র আত্মার নিকটে প্রার্থনা কর যেন তিনি তোমাকে আপন পীড়ার বোধ জন্মাইয়া দেন। পীড়ার বোধ হইলে তুমি অবশ্য মহৎ চিকিৎসকের নিকটে গিয়া ত্রাণ যাচ্ঞা করিবা, এবং তিনি যখন তোমাকে পাপরূপ যন্ত্রণাহইতে রক্ষা করিবেন, তখন তাঁহার আজ্ঞা পালন করিবার কারণ তিনি তোমাকে অনুগ্রহ ও বল ও কৃতজ্ঞতা প্রদান করিবেন।

 করুণা অধোবদন হইয়া এই সকল কথাতে কিছু উত্তর করিল না। পরমেশ্বর তাহার প্রতি দয়া করিবার মানস করিয়াছিলেন, অতএব সে যেন নির্ম্মল রূপার ন্যায় পরিষ্কৃতা হয়, এই হেতুক প্রথমে দুঃখরূপ অগ্নিতে তাহার পরীক্ষা করণ আবশ্যক হইল।

 যখন আমাদের পরস্পর আলাপ হইতেছিল, তখন আমরা গৃহের মধ্যে কেবল দুই জন ছিলাম, কিন্তু কথা সাঙ্গ হইলে করুণার পুত্ত্রেরা দৌড়িয়া আসিয়া উপস্থিত হইল। নবীন আমাকে দেখিয়া সেলাম করিল। তাহার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা মাচানহইতে একটা খালি বোতল লইয়া শীঘ্র পলায়ন করিতেছিল, এমত সময়ে তাহার মাতা তাহার হাত ধরিয়া বলিল, ও বংশী! তোমার কাছে যদি কিছু পয়সা থাকে তবে আমাকে দেও, আমি তাহাতে তোমাদের খাদ্য সামগ্রী কিনি, কেননা আমাদের আজি কিছুই খাইবার নাই; এবং যাহা কর বাছা, তোমার বাপের মত কোন রূপে মদ কিনিয়া খাইও না।

 ঐ দুষ্ট বালক উত্তর করিল, তোমার তো বড় ভাল কথা শুনিতে পাই; বুঝি তোমাকে দিবার জন্যে আমি সন্‌গরসন খেলা করিয়া দুই আনা লাভ করিলাম? আমি তো এখন মদ খাইব, পরে আমার ভাত না হইলে কিছু ক্ষতি নাই; তুমি আপনার জন্যে চেষ্টা কর। ইহা বলিয়া বংশী আপন মায়ের হাত ছাড়াইয়া পলায়ন করিল। তাহার বয়স পোনের কিম্বা ষোল বৎসরের অধিক ছিল না, তথাচ সে কেমন দুষ্ট ও লম্পট বালক, ইহা তাহার মুখ ও আচার ব্যবহার দ্বারা অতি স্পষ্ট বোধ হইল।

 নবীন আপন ভ্রাতার এই রূপ কর্ম্ম দেখিয়া তাহার পশ্চাৎ যাইতেছিল, কিন্তু আমি তাহাকে ডাকিয়া বলিলাম, নবীন, তোমার ভাই অতিশয় দুষ্ট বালক। দেখ, তাহার কথা শুনিয়া তোমার মাতা কেমন কাঁদিতেছে; অতএব তুমিও যদি তাহার মত ব্যবহার কর, তবে তোমার মায়ের কি দশা হইবে?

 নবীন বলিল, যদি আমার পয়সা থাকিত, তবে আমি মাকে দিতাম। মধুর ঘর দেখাইবার কারণ তুমি যে এক বার আমাকে চারিটি পয়সা দিয়াছিলা, তাহার মধ্যে আমি তাহাকে দুইটি দিয়াছি। এখন আমার কাছে একটীও পয়সা নাই, কেননা সন্‌গরসন খেলা করিতে গেলে আমার কেবল হারি হয়, কখন জিত হয় না।

 ইহা শুনিয়া আমি বলিলাম, এ কথাতে আমি বড় সন্তুষ্টা হইয়াছি, কেননা ইহাতে তুমি এই জানিতে পারিবা যে জুয়া খেলা অপেক্ষা টাকা উপার্জন করিবার অন্যান্য ভাল উপায় আছে।

 নবীন কহিল, মেম সাহেব, আমি কি কর্ম্ম করিয়া টাকা লাভ করিব? কখন২ সাহেবদের বাজার মাথায় করিয়া তাঁহাদের ঘরে পৌঁছিয়া দিই; কিন্তু তাহাতে কিছু লাভ নাই, কেননা খানসামারা আমাকে তিন পয়সা দিতে স্বীকার করিয়াও শেষে একটি পয়সা দিয়া আমাকে তাড়াইয়া দেয়।

 পরে আমি জিজ্ঞাসিলাম, ভাল নবীন, তোমাকে আর মুটিয়ার কর্ম্ম করিতে না বলিয়া যদি কেহ ছোট খানসামার পদে নিযুক্ত করে, ও তোমাকে একটি পাগ্‌ড়ি ও চাপ্‌কান্ ও পাজামা দেয়, তবে কি তুমি সন্তুষ্ট হও?

 ইহা শুনিয়া নবীনের মুখ প্রফুল্ল হইল, এবং সে হাস্য করিতে২ বলিল, হাঁ, আমি তাহাতে অবশ্য বড় সন্তুষ্ট হই। মেম সাহেব, তুমি যদি আমাকে খানসামার কর্ম্ম দেও, তবে আমি এখনি তোমার সঙ্গে যাই। তাহাতে তাহার মাতাও কহিল, হাঁ মেম সাহেব, আপনি যদি এই কর্ম্মটি অনুগ্রহ করিয়া দেন, তবে আমাদের বড় উপকার হয়।

 নবীনের হিতার্থে আমি যে মানস করিয়াছিলাম, তাহা যে এমত সহজে সফল হইল, ইহা দেখিয়া আমি বড় আহ্লাদিতা হইলাম; তাহাতে তখনি বলিলাম, ভাল! নবীন আমার বাটীতে আইসুক, আমি উহাকে খাওয়া পরা দিয়া খানসামার কর্ম্ম শিক্ষা করাইব; এবং সে যদি ভাল রূপে চলে, ও জুয়া খেলা একেবারে ত্যাগ করে, তবে তিন মাস পরে আমি উহাকে প্রত্যেক মাসে এক টাকা করিয়া দিব।

 নবীন উক্ত কথাতে আহ্লাদপূর্ব্বক স্বীকৃত হইয়া কহিল, এক টাকা প্রতি মাসে পাইলে আমি আর কেন জুয়া খেলিব? তাহাতে আমি করুণাকে বলিলাম, তবে করুণা, কল্য তোমার পুত্ত্রকে আমার নিকটে আনিও। এবং বংশী যদি কর্ম্ম করিতে চাহিয়া আমার আজ্ঞানুসারে চলিতে স্বীকৃত হয়, তবে আমি তাহাকেও তিন মাসের নিমিত্তে পরীক্ষা করিতে প্রস্তুতা আছি; কিন্তু তাহার ব্যবহার দেখিয়া ভয় হয়, পাছে সে আমাকে বড় দুঃখ দেয়।

 তাহাতে করুণা নিশ্বাস ছাড়িয়া কহিল, হায় মেম সাহেব! বংশী কখনই কর্ম্ম করিবে না। সে স্বাভাবিক দুষ্ট বালক, কেননা যত দিন আমার শাশুড়ি জীবিতা ছিলেন, তত দিন বংশীর বাপ তাঁহাকে ভালরূপে খাওয়া পরা দিতেন, কিন্তু আমার ছেল্যা আমার প্রতি কিছু মাত্র প্রেম করে না। তাহাকে একেবারে দূর করিয়া দিলে তাহার উপযুক্ত শাস্তি হইত বটে; কিন্তু সে তো আমার গর্ভজাত সন্তান, অতএব আমি এমত শাস্তি তাহাকে কি প্রকারে দিই?

 আমি কহিলাম, করুণা, এই সকল শুনিয়া তোমার নিমিত্তে বড় দুঃখিতা আছি, কিন্তু ইহা তোমার নিজ দোষ প্রযুক্ত ঘটিয়াছে। আমি প্রথমবার যখন তোমার গৃহে আইলাম, তখন আমার বিলক্ষণরূপে স্মরণ হয় যে নবীন সত্য কথা কহিল, সেই প্রযুক্ত তুমি তাহাকে চড় মারিয়া মিথ্যাবাদী বলিলা। পিতা মাতা যদি এমত কর্ম্ম করে, তবে সন্তানেরা কি প্রকারে ভাল হইয়া উঠিতে পারে?

 এই কথাতে করুণা দীর্ঘ নিশ্বাস ত্যাগ পূর্ব্বক কহিল, হাঁ! কি জানি আমারি দোষ হইয়া থাকিবে। কিন্তু ঐ বংশী আমার জ্যেষ্ঠ পুত্ত্র, এবং পাঁচ বৎসর পর্য্যন্ত আমার আর ছেল্যা হইল না, অতএব আমি স্নেহপ্রযুক্ত তাহাকে কখন শাসন করিতে পারিতাম না, এই নিমিত্তে সে এমত অবাধ্য বালক হইয়াছে।

 আমি বলিলাম, করুণা, আমরা যখনি ঈশ্বরের আজ্ঞা লঙ্ঘন করি, তখনি আমাদের দুর্দশা ঘটে। ঈশ্বর কহিয়াছেন, “বালককে শাসন করিতে নিবৃত্ত হইও না; তুমি দণ্ডদ্বারা তাহাকে প্রহার কর, তাহাতে তুমি তাহার প্রাণকে নরক হইতে রক্ষা করিবা।” হিতোপদেশ ২৩।১৩,১৪। কিন্তু তুমি অন্য প্রকার বুঝিয়া তাঁহার আদেশানুসারে চল নাই, তাহাতে যাহাকে তুমি প্রিয়পাত্র জ্ঞান করিয়া আদরের পুত্ত্র করিয়াছ, সে পুত্ত্র এখন তোমার বিরুদ্ধে উঠিয়া তোমাকে তুচ্ছ করে, এবং দুষ্টতাতে এমত প্রবল হইয়াছে যে তাহাকে দেখিলে ভয় হয়। অতএব তুমি আর তাহাকে দমন করিতে পারিবা না; তথাচ আমার সাহেবকে আমি তাহার বিষয় জ্ঞাত করিব, তিনি যদি তাহার মঙ্গলার্থে কিছু করিতে পারেন তবে অবশ্য করিবেন।

 বিদায় হইবার কাল উপস্থিত হইলে আমি বিবেচনা করিতে লাগিলাম, অদ্য করুণাকে কিছু টাকা দিলে ভাল হইবে কি না; এমত সময়ে সে আপনি ভয়পূর্ব্বক জিজ্ঞাসিল, মেম সাহেব, আপনি যে ঝাড়ন গুলিন আমাকে একবার সিলাই করিতে দিতে চাহিয়াছিলেন, সে সকল কি এখন আপনার নিকটে আছে? আমি কহিলাম, না, অনেক দিন হইল তাহা সিলাই করা গিয়াছে; কিন্তু তুমি সে বিষয় জিজ্ঞাসা কর কেন? করুণা বলিল, এখন যদি সে ঝাড়ন আপনার নিকটে থাকিত, তবে আমি লইয়া সিলাই করিতাম; কেননা আমার স্বামী এবং পুত্ত্র আমার উপকার করিবে না, তাহা স্পষ্ট দেখিতেছি, অতএব আপনি কর্ম্ম না করিলে সকলে মারা পড়িব।

 করুণার এই প্রকার নূতন কথা শুনিয়া আমি বড় আহ্লাদিতা হইলাম, এবং তদ্দ্বারা পূর্ব্বাপেক্ষা সুন্দররূপে জানিতে পারিলাম, যে অবিবেচনা পূর্ব্বক টাকা দান করিলে দরিদ্রের পক্ষে অতিশয় ক্ষতি জন্মে। ইহার দৃষ্টান্ত এই, আমি যখন প্রথমবার করুণার দুঃখ দেখিয়াছিলাম, তখনই যদি তাহাকে টাকা কি পয়সা দিতাম, তবে এখন সে আমার নিকটে কর্ম্ম যাচ্ঞা না করিয়া পুনর্ব্বার তদ্রূপ ভিক্ষাই চাহিত। দরিদ্রেরা যাহাতে কোন কর্ম্ম করিয়া আপনাদের সাহায্য করিতে পারে, এমত শিক্ষা তাহাদিগকে দিলে তাহাদের পক্ষে সর্ব্বাপেক্ষা উত্তম সাহায্য হয়।

 ইহা জানিয়া আমি করুণাকে আশ্বাস দিতে চাহিয়া বলিলাম, ঝাড়ন সকল সিলাই হইয়াছে বটে, কিন্তু এখন আমার নিকটে একথান কোরা কাপড় আছে, তাহা ছিঁড়িয়া খাটের চাদর বানাইব। অতএব কল্য তুমি যখন নবীনকে আমার বাটীতে লইয়া যাইবা, তখন আমি সেই চাদর সকল তোমাকে সিলাই করিতে দিব। তুমি যে আপনি কর্ম্ম করিতে মানস করিয়াছ, তাহাতে আমি বড় সন্তুষ্টা হইয়াছি; এবং অদ্য তোমার ঘরে কিছু নাই তাহা দেখিতেছি, অতএব এখন এক টাকা লও, পশ্চাৎ আমার কাপড় সিলাই করিয়া তাহা পরিশোধ করিও। তাহাতে করুণা টাকাটি দেখিয়া হৃষ্টচিত্ত হইয়া সেলাম করিয়া লইল।

 আমি সাধু ও সত্যবতীর জন্যে কতক গুলিন মিঠাই আনিয়াছিলাম, তাহাতে আপন বাটী যাইবার পূর্ব্বে তাহাদিগকে সেই মিঠাই দিতে গেলাম। সাধুর পিতা প্রেমচাঁদ ঘরে ছিল; তখন সে আপন স্ত্রীর নিকটে বসিয়া তাহারা দুই জনে কতক গুলিন টাকা ও পয়সা গণিতেছিল। তাহাতে তাহাদের মন এমত নিমগ্ন হইয়াছিল যে আমি ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিলেও তাহারা প্রথমে জানিতে পারিল না। কিন্তু আমাকে দেখিবামাত্র ফুলমণি শীঘ্র উঠিয়া সেলাম করিল, পরে টাকা ও পয়সা একত্র করিয়া এক পার্শ্বে রাখিয়া কহিল, মেম সাহেব, আমার স্বামী আজি মাহিনা পাইয়াছেন, অতএব আগত মাসে আমরা কি প্রকারে তাহা ভালরূপে খরচ করিতে পারি, ইহাই বিবেচনা করিতেছিলাম।

 আমি বলিলাম, যদি এমত হয়, তবে অনুগ্রহ করিয়া সে সকল হিসাব সাঙ্গ কর; কেননা আমি তোমাদের ঘরের কর্ম্মেতে ব্যাঘাত করিতে চাহি না, আর তোমাদের প্রতিবাসিনী করুণাকে যেন পরিমিত ব্যয় বিষয়ে কিছু উপদেশ দিতে পারি, এই কারণ আমি বঙ্গালিদের সাংসারিক খরচের বিষয়ে কিছু শিক্ষা করিতে বড় ইচ্ছা করি।

 এই কথা শুনিলেও প্রেমচাঁদ এবং ফুলমণি আমার সাক্ষাতে আপনাদের হিসাব করিতে বড় অনিচ্ছুক হইল, কিন্তু তাহাদিগকে বিস্তর সাধ্যসাধনা করিলে তাহারা পুনর্ব্বার লেখাযোখা করিতে লাগিল।

 প্রেমচাঁদ আপন স্ত্রীকে বলিল, আমার সাত টাকা মাহিনার মধ্যে এক টাকা সাহেবের নিকটে জমা করিয়া রাখিয়াছি; তাহার স্থানে আমাদের এখন চৌদ্দ টাকা হইয়াছে। আর এই লও, ছয়টি টাকা আনিয়াছি; এখন তোমার কাছে কত আছে, তাহা দেখি।

 ফুলমণি বলিল, আমি দুধ বেচিয়া ৩৸৹ তিন টাকা বারো আনা পাইয়াছিলাম, তাহার মধ্যে গোরুর খোরাকের নিমিত্তে ১৸৹ এক টাকা বারো আনা ব্যয় হইয়াছে; অতএব তাহা ধরিবার কোন আবশ্যক নাই, এই ২ দুই টাকা মাত্র আছে।

 প্রেমচাঁদ কহিল, ও গো, তবে ঐ পয়সাগুলিন কোথাহইতে আইল?

 ফুলমণি বলিল, করুণার জন্যে এক খানা মোটা শাড়ি কিনিতে তিন মাস পর্য্যন্ত দশ আনা পয়সা জড় করিতেছি। সে দুঃখিনী কাপড় ব্যতিরেকে যে ক্লেশ ভোগ করিতেছে তাহা আর দেখা যায় না। মহেন্দ্র বাবুর স্ত্রীর তিনটা কোর্ত্তা সিলাই করিয়া দিয়াছিলাম, তাহাতে ছয় আনা পাইলাম; এবং এই মেম সাহেব অনুগ্রহ করিয়া এক বার সাধুকে ও সত্যবতীকে এক২ সিকি দিয়াছিলেন, তাহার মধ্যে এই শাড়ি কিনিবার জন্যে তাহারা আমাকে দুই২ আনা করিয়া দিল, তাহাতে দশ আনা হইয়াছে।

 প্রেমচাঁদ বলিল, ভাল করিয়াছ ফুলমণি। আমি কল্য এক খান কাপড় কিনিয়া আনিব, এবং তুমি করুণাকে তাহা দিবার সময়ে বলিও, যে এই শাড়ি পরিয়া তোমাকে প্রত্যেক রবিবারে গীর্জায় যাইতে হইবেক; কেননা আমি যখনি গীর্জায় যাইবার কথা তাহার সাক্ষাতে বলি, তখনি সে কাপড়ের ছল করিয়া উত্তর করে, আমার বস্ত্র নাই, আমি কি প্রকারে গীর্জায় যাইব? কিন্তু সে যাহা হউক, এখন আমি হিসাব লিখিতে আরম্ভ করি।

 সর্ব্বসুদ্ধ আমাদের আয় ৯॥৵৹ নয় টাকা দশ আনা আছে, তাহার মধ্যে সাহেবের নিকটে এক টাকা জমা করিয়াছি, করুণার শাড়ির জন্যে দশ আনা, প্রভুর ভোজনের নিমিত্তে দুই আনা, মিশনরি সোসাইটির মাসিক চাঁদার নিমিত্তে দুই আনা, ইহাতে ১৸৵৹ এক টাকা চৌদ্দ আনা হইল, বাকি থাকে ৭৸৹ সাত টাকা বারো আনা, না গো ফুলমণি?

 ফুলমণি কিঞ্চিৎকাল হিসাব করিয়া কহিল, হাঁ, তাহা ঠিক হইয়াছে; কিন্তু সাধুর নিমিত্তে বড় ধর্ম্মপুস্তক কিনিবার কারণ যে দুই আনা মাসে আমরা জমা করিয়া রাখি, তাহা লিখিতে ভুলিয়াছেন।

 প্রেমচাঁদ বলিল, হাঁ গো, সে কথা তো সত্য। আরো আমি এক জন হিন্দু স্ত্রীলোকের নিমিত্তে চারি আনা পয়সা লইব। আজি সাহেবের কর্ম্মে আমাকে তেঘরি গ্রামে যাইতে হইয়াছিল, তথায় গিয়া দেখিলাম এক গাছ তলায় এক জন বিধবা স্ত্রী প্রসব হইয়াছে, এবং তাহাকে একটু জল দেয় এমত ব্যক্তি সেখানে নাই, তাহাতে আমি সেখানকার এক জন দোকানির নিকটে আটটি পয়সা কর্জ করিয়া তাহাকে দিয়া আইলাম। অতএব কল্য যাইয়া সেই কর্জ পরিশোধ করিতে হইবেক, এবং ঐ অনাথা স্ত্রীলোককে আর দুই আনা পয়সা দিয়া আসিব।

 ফুলমণি বলিল, ভাল, তাহাই করিও। তবে আমাদের ঘর খরচের নিমিত্তে ৭।৵৹ সাত টাকা ছয় আনা রহিল। প্রেমচাঁদ উত্তর করিল, হাঁ গো তাহাতে কি কুলাইবে না? তাহার স্ত্রী হাসিয়া বলিল, বিবেচনা করিয়া খরচ করিলে কুলাইবে না কেন? কেবল কঠিন হইয়াছে এই, যে প্রিয়নাথের জন্যে দুইটা জামার কাপড় এই মাসে না কিনিলে নয়; কিন্তু ক্ষতি নাই, উহার কাপড় কিনিবার কারণ আমি সিলাই আদি করিয়া অবশ্য কোন প্রকারে চারি গণ্ডা পয়সা উপায় করিতে পারিব।

 এমত কথা হইলে প্রেমচাঁদ দানাদির সকল টাকা পয়সা আপনি তুলিয়া রাখিল, এবং ঘর খরচের টাকা গুলিন ফুলমণিকে দিয়া কহিল, পরমেশ্বর আমাদের প্রতিপালক, আমাদের কিছুরই অভাব হইবে না; তিনি আমাদের প্রয়োজনীয় আহার অদ্য দিয়াছেন।

 এই ধার্ম্মিক পরিবারের সদ্ব্যবহার ও সুখ দেখিয়া করুণার দুঃখের অবস্থা আমার স্মরণ হইল, তাহাতে আমি মনোমধ্যে বিবেচনা করিলাম, ঈশ্বরের সেবকেরা নিতান্ত সুখদায়ক পথে ভ্রমণ করে, এবং তাহাদের সকল গতি শান্তিকর; কিন্তু “যে সমুদ্র কখন স্থির হইতে পারে না, ও যাহার জলেতে মল ও কর্দ্দম উঠে, দুষ্ট লোকেরা এমত আলোড়িত সমুদ্রের ন্যায় হয়। ঈশ্বর যথার্থ কহিয়াছেন, পাপিদের কিছুই মঙ্গল নাই।” যিশয়িয় ৫৭।২০, ২১।

 তদনন্তর ফুলমণি কিঞ্চিৎ ভাবিতা হইয়া বলিতে লাগিল, বেলা গেল, আজি ছেল্যারা পাঠশালাহইতে ফিরিয়া আইসে না কেন? এই কথা শুনিয়া প্রেমচাঁদ দ্বারের বাহিরে গিয়া তাহাদের অপেক্ষায় দাঁড়াইয়া রহিল। কিছুকাল পরে সে অতিশয় বিষণ্ণ বদন হইয়া ভিতরে আসিয়া হঠাৎ মঞ্চহইতে এক গাচা বেত্র নামাইল, এবং তাহা হাতে করিয়া শীঘ্র দৌড়িয়া বাহিরে গেল। ইহাতে আমরা জ্ঞাতা হইলাম, যে সে অবশ্য কোন অসন্তোষক ঘটনা দেখিতে পাইয়াছে, কেননা ইহার পূর্ব্বে প্রেমচাঁদের সুশীল বদনে এত রাগ আমি কখন দেখি নাই। তখন ফুলমণি জানালা খুলিয়া দেখিবা মাত্র উচ্চৈঃস্বরে বলিতে লাগিল, হে পরমেশ্বর! আমার ছেল্যাকে শয়তানের হস্তহইতে উদ্ধার কর।

 এই স্ত্রীপুরুষের মনের অস্থিরতা দেখিয়া আমি অতিশয় ভীতা হইলাম, এবং কি হইয়াছে, ইহা জ্ঞাত হইবার জন্যে শীঘ্র বাহিরে গেলাম। পরে দেখিলাম যে সাধু ও সত্যবতী গ্রামের মধ্যে প্রবেশ করিয়াছে, এবং করুণার পুত্ত্র বংশী তাহাদের সঙ্গে২ চলিয়া কএক পয়সা ঊর্দ্ধ্বে ফেলিয়া লুফিতেছে, তাহাতে সাধু ঐ পয়সা ধরিবার জন্যে যত্ন করিতেছে। প্রেমচাঁদ দৌড়িয়া তাহাদের নিকটে গেল, এবং বেত দিয়া সাধুকে দুই তিন ঘা মারিল, পরে তাহার হাত ধরিয়া টানিয়া ঘরে আনিল।

 সাধু বলিতে লাগিল, বাবা, বিরক্ত হইও না২! আমি সত্য বলিতেছি ইহাতে আমার কোন দোষ নাই। তাহার পিতা গভীর স্বরে কহিল, চুপ কর সাধু, তুমি আপন দোষ লুকাইতে চেষ্টা করিয়া কেবল পাপের বৃদ্ধি করিতেছ। তুমি দুষ্ট বালকের সহিত আলাপ করিয়া জুয়া খেলা শিখিতেছিলা, ইহাতে কি তোমার দোষ নাই?

 এই কথাতে সত্যবতী কাঁদিতে২ তাহার ভ্রাতার গলা ধরিয়া বলিল, হায় দাদা! ঐ দুষ্ট বংশী যদি তোমার পয়সা কাড়িয়া না লইত, তবে এই সকল দুর্ঘটনা হইত না। বেত্রাঘাত বেদনা প্রযুক্ত সাধু কিছু মাত্র কাঁদে নাই, কিন্তু এখন তাহার ছোট ভগিনীর প্রেমিক ব্যবহার দেখিয়া সেও উচ্চৈঃস্বরে ক্রন্দন করিতে লাগিল।

 তখন প্রেমচাঁদ কহিল, সত্যবতি, তুমি এক পার্শ্বে বৈস, সাধুর সহিত আমার কিছু কথা আছে। ইহাতে সত্যবতী পিতার আজ্ঞা পালন করিয়া ফুলমণির বক্ষঃস্থলে হেলান দিয়া কাঁদিতে থাকিল। প্রেমচাঁদ সাধুকে জিজ্ঞাসিল, ঐ দুষ্ট বালকের সহিত কি জন্যে বেড়াইতেছিলা?

 সাধু উত্তর করিল, আমি তাহার নিকটে যাই নাই বাবা; সে আমাদের নিকটে আসিয়া আমাদের সঙ্গে বেড়াইতে লাগিল। প্রেমচাঁদ বলিল, তবে তুমি তাহাকে একেবারে ছাড়িয়া কেন ঘরে দৌড়িয়া আইলা না? সাধু বলিল, ও পিতা, আমার পয়সা গুলিন তাহার নিকটে ছিল; আজি আমি পাঠশালায় পুরস্কারার্থে চারিটি পয়সা পাইলাম, সে পয়সা আমার হাতহইতে বংশী কাড়িয়া লইল। প্রেমচাঁদ কহিল, সাবধান হও সাধু, আমি না স্বচক্ষে দেখিলাম যে তুমি পয়সা লইয়া জুয়া খেলা করিতেছিলা? সাধু বলিল, না বাবা, আমি তাহা কখন করি নাই; বংশী তো বলিয়াছিল, আইস, আমরা সন্‌গরসন খেলা করি, তাহাতে তোমার কপালে যদি থাকে, তবে তুমি আপনার চারিটি সুদ্ধ আমার চারিটি পয়সাও লাভ করিতে পারিবা; কিন্তু আমি তাহা না করিয়া কেবল আপনার পয়সা পুনর্ব্বার তাহার হাত হইতে কাড়িয়া লইতে চেষ্টা করিতেছিলাম।

 এই কথা শুনিয়া প্রেমচাঁদ বলিল, ভাল সাধু, আমি তোমাকে যেরূপ দোষী বোধ করিয়াছিলাম, তাহা তুমি নও, এই জন্যে ঈশ্বরের ধন্যবাদ হউক। তথাপি তুমি যে কোন কারণে ঐ দুষ্ট বালকের সহিত এক নিমেষ পর্য্যন্ত ছিলা ইহাতেই অবশ্য তোমার অপরাধ হইয়াছে, কেননা লেখা আছে; “পাপের ছায়াহ্ইতেও দূরে থাক।” এবং পয়সা পাইবার জন্যে যদি তোমাকে ঈশ্বরের আজ্ঞা লঙ্ঘন করিতে হয়, তবে সে পয়সা তখনি ছাড়িয়া দেওয়া উচিত; আরও দেখ, বংশী তোমাহইতে দ্বিগুণ বড় ও বলবান, অতএব তাহার নিকটহইতে তুমি বল করিয়া আপনার পয়সা পুনর্ব্বার লইতে কি প্রকারে আশা করিয়াছিলা? আমি তো বলি, পয়সা গিয়াছে, ভাল হইয়াছে।

 সাধুর মাতাও সেই রূপ ভাবিয়া বলিল, ও সাধু, তুমি যদি একেবারে সে পয়সা ত্যাগ করিয়া ঘরে আসিতা, তবে ভালই হইত। তোমার পিতা তোমাকে কতবার বলিয়াছেন, যে বংশির সহিত কোন রূপে আলাপ করিও না। তুমি সুন্দররূপে জান, তাবৎ মন্দের মূল ধনাশা, তাহাতেও আমার ভয় হয়, তুমি ঐ পয়সা গুলিন অতিশয় প্রিয়জ্ঞান কর।

 সাধু উত্তর করিল, না মা, আমি পয়সাকে প্রিয়জ্ঞান করি না, কিন্তু বংশী যে তাহা বলপূর্ব্বক আমার নিকটহইতে লইল, এই জন্যে আমি রাগ করিয়া পুনর্ব্বার আপনার পয়সা লইতে চেষ্টা করিলাম। মা, ইহাতে বল দেখি, বংশির ভারি দোষ হইয়াছে কি না?

 ফুলমণি বলিল, তাহার দোষ অবশ্য থাকিবে, কিন্তু তদ্দ্বারা তুমি যে একেবারে নির্দোষী এমত বলা যায় না। তুমি আজি প্রাতঃকালে এই প্রার্থনা করিয়াছিলা, হে পরমেশ্বর, আমাকে পরীক্ষায় আনিও না; তথাপি তুমি আপনি পরীক্ষাস্থলে গেলা, এবং তোমার পিতা তোমাকে দেখিয়া যদি সেস্থানহইতে টানিয়া না আনিতেন, তবে কি জানি শেষে তুমি জুয়া খেলা করিতে আরম্ভ করিতা, এবং তাহার পরে অন্যান্য ভারি পাপে পতিত হইতা।

 মাতার এই রূপ কথা শুনিয়া সাধু আর আপনাকে নির্দোষি করিতে চেষ্টা না করিয়া বলিল, ও বাবা, এবার আমাকে ক্ষমা করুন, আমি এমত কর্ম্ম আর করিব না।

 তখন প্রেমচাঁদ ও ফুলমণি সাধুর হাত ধরিয়া তাহাকে ভিতরের কুঠরীতে লইয়া গেল। ইহাতে সত্যবতী সান্ত্বনা পাইয়া চক্ষের জল মুছিয়া আমাকে কহিল, মেম সাহেব, এখন বাপ মা সাধুর সহিত প্রার্থনা করিবেন, এবং ঈশ্বর যেন তাহাকে ক্ষমা করেন এই যাচ্ঞা করিবেন, তাহার পর তাঁহারা সকল চুকাইয়া দিয়া পুনর্ব্বার তাহাকে প্রেম করিবেন। আমরা যখনি কোন দোষ করি, তখনি বাপ মা এই রূপে আমাদের সহিত প্রার্থনা করেন।

 হে বঙ্গদেশীয় খ্রীষ্টিয়ান পিতা মাতা সকল! তোমরাও যাইয়া তদ্রূপ কর।

 আমি দেখিলাম, যে উক্ত ঘটনাদ্বারা প্রেমচাঁদ ও ফুলমণির মন কিছু অস্থির হইয়াছে, অতএব এখন বিদায় হওয়া ভাল বুঝিয়া আমি মিঠাই গুলিন সত্যবতীর হাতে দিয়া কহিলাম, তোমার পিতা মাতাকে আমার সেলাম দিও। ইহা বলিয়া আমি বাটীতে ফিরিয়া গেলাম।

 ছেল্যাদের অমর আত্মাকে সুপথে লওয়ান, এই যে গুরুতর ভার ঈশ্বর পিতা মাতাগণের হস্তে অর্পণ করিয়াছেন, ইহা যদি তাহারা ভাল রূপে নির্বাহ করিত তবে কেমন আনন্দজনক হইত! হে পিতা ও মাতা সকল! তোমাদের সন্তানদের ভাল মন্দ শিক্ষার বিষয়ে তোমরা ঈশ্বরের সাক্ষাতে দায়ী হইবা, ইহা নিশ্চয় জ্ঞাত হও। অতএব আমি বিনতি করি, তোমরা আপনাদের প্রিয় ছেল্যাদিগকে শাসন কর, তাহাদের নিমিত্তে প্রার্থনা কর, তাহাদিগকে সাধ্য পর্য্যন্ত মন্দহইতে রক্ষা কর, কি২ পাপ ও কি২ পুণ্য ইহা তাহাদিগকে জ্ঞাত করাও, এবং বিশেষরূপে আপনারা এমত সদ্ব্যবহারী হও, যে তাহারা তোমাদের সৎক্রিয়া দেখিয়া তোমাদের অনুকারী হইতে সতত চেষ্টা করে।