ফুলমণি ও করুণার বিবরণ/ষষ্ঠ অধ্যায়

ষষ্ঠ অধ্যায়।

 পর দিবস অতি প্রত্যূষে ছোট নবীন ও তাহার মাতা আমার ঘরে উপস্থিত হইল। আমি তখনি আমার দরজীকে বলিলাম, এই বালকের জন্যে শীঘ্র চারি যোড়া চাপ্‌কান ও পাজামা সিলাই কর। যখন দরজী চাপ্‌কান বানাইবার কারণ নবীনের গায়ের মাপ লইতে লাগিল, তখন আমি তাহার অহঙ্কার দেখিয়া হাস্য সম্বরণ করিতে পারিলাম না; কেননা সে দীনহীন বালক এক ছেঁড়া নেকড়া ব্যতিরেকে আর কোন বস্ত্র কখন পরে নাই, অতএব সে দরজীর হাতে সরু কাপড় এবং লাল সালু দেখিয়া বোধ করিল যে ইহা পরিয়া আমি একেবারে বাবু হইব।

 করুণা ভাবিতা ও মনোদুঃখিনী হইয়া নিরব থাকিল; কিন্তু খাটের চাদর গুলিন যখন ভাঁজ করিয়া ঘরে লইয়া যাইতেছিল, তখন সে বলিল, ও মেম সাহেব, আমি নবীনকে একেবারে আপনাকে দিলাম; সে আর আমার সন্তান নহে, এখন সে আপনকার হইল। তাহার বিষয়ে আমার আর কোন ভাবনা নাই; কেবল এই নিবেদন করি, যে আপনি আমার নিমিত্তে কখন২ ঈশ্বরের নিকটে প্রার্থনা করিবেন।

 আমি উত্তর করিলাম, করুণা, যে দিবস তুমি ফুলমণির বাটীতে থাকিয়া তাহার গোলাপ চারা নষ্ট করিয়াছিলা, সেই দিবস অবধি আমি ঈশ্বরের স্থানে তোমার জন্যে প্রার্থনা করিতেছি; এবং আমার দৃঢ় বিশ্বাস আছে যে তুমি ইহার পরে সত্য খ্রীষ্টিয়ান হইয়া আপন স্বামির সহিত সুখে বাস করিবা। এখন ভাল মনে পড়িল, সে কি কল্য রাত্রিতে ঘরে আসিয়াছিল?

 করুণা বলিল, মেম সাহেব, কল্য কি সে আর আইসে? কিন্তু আজি সন্ধ্যার সময়ে সে আসিয়া পুনর্ব্বার ভোজনের নিমিত্তে ঝকড়া করিবে, তাহাতে ভাত যদি থাকে তবে ভাল, নতুবা আরবার আমাকে মার খাইতে হইবে।

 আমি কহিলাম, অদ্য তোমার মার খাইবার কোন আবশ্যক নাই; তোমার কাছে তো একটা টাকা আছে, তাহাতে ভাল মাছ কিনিয়া সুন্দররূপে ব্যঞ্জন রাঁধিয়া রাখ। এখন আমার নিকটে এই প্রতিজ্ঞা কর যে এবার তুমি বাটী পরিষ্কার ও পরিপাটি করিবা, ও তোমার স্বামী ফিরিয়া আসিলে তাহার সহিত মিষ্ট কথা কহিয়া হাস্য মুখে সাক্ষাৎ করিবা; এমত করিলে সেও অবশ্য তোমার সহিত কোমল ব্যবহার করিবে। আমার এই কথা সত্য হয় কি না, তাহা দেখিও।

 করুণা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, ভাল মেম সাহেব, আপনাকে সন্তুষ্ট করিবার জন্যে আমি আপনকার পরামর্শ মতে চলিব; কিন্তু আমার স্বামী কখন ভাল হইবে না, তাহা আমি নিশ্চয় জানি।

 আমি কহিলাম, এমত কথা বলিও না, চেষ্টাদ্বারা প্রায় সমস্ত কর্ম্মই সিদ্ধ হয়। আর ইহাও স্মরণে রাখিও, ঈশ্বরের অসাধ্য কিছুই নাই।

 করুণা বিদায় লইয়া গেল, কিন্তু সে পুনর্ব্বার ফিরিয়া আসিয়া বলিল, মেম সাহেব আমি বড় ভুলিয়াছি, প্যারীর ভারি ব্যামোহ হইয়াছে, এবং সে আমাকে বলিয়াছিল, যে তুমি ইহা মেম সাহেবকে জানাইয়া এমত নিবেদন করিও, যেন তিনি আমাকে দেখিতে একবার আইসেন।

 ইহা শুনিয়া আমি বলিলাম, আহা! এই বিষয় পূর্ব্বে সম্বাদ পাইলে ভাল হইত। সে যাহা হউক, আজি সন্ধ্যাকালে আমি তাহাকে অবশ্য দেখিতে যাইব।

 যে অবধি প্যারীর সহিত আমার জানা শুনা হইয়াছিল, সেই অবধি আমি বার২ তাহার ঘরে যাইতাম, এবং তাহার সহিত অনেক কথোপকথন করিতাম, তদ্দ্বারাই কেবল তাহার প্রতি আমার প্রেমের বৃদ্ধি হইত। অতএব সন্ধ্যাকাল উপস্থিত হইলে আমি প্যারীর নিমিত্তে কএকটি ডালিম আয়ার হাতে দিয়া তাহাকে সঙ্গে করিয়া খ্রীষ্টিয়ানদের গ্রামে গেলাম।

 আয়ার বিষয়ে কিছু লিখিতে হইল। সে পূর্ব্বে খ্রীষ্টীয় ধর্ম্মের মধ্যে অনেক দোষ দেখাইত, কিন্তু যে অবধি ফুলমণির সহিত আমাদের পরিচয় হইয়াছিল, সেই অবধি দেখিলাম, যে ক্রমে২ সে কোন মিথ্যা আপত্তি না করিয়া অতিশয় নম্র হইয়াছে। আরও শুনিতে পাইলাম, যে সে আমার অজ্ঞাতসারে অনেকবার ফুলমণির গৃহে যাইয়া থাকে, এবং সাধু ও সত্যবতী যে তাহার বাসাতে নিত্য২ আসিয়া হালুয়া ও রুটী লইয়া যাইত, তাহা আমি স্বচক্ষে দেখিতাম। উক্ত সুলক্ষণদ্বারা এবং সকলের প্রতি আয়ার কোমল আচার ব্যবহার দেখিয়া আমি বোধ করিলাম, যে ঈশ্বরের আত্মা তাহার মনেতে আপন বাক্যরূপ বীজ ক্রমে২ অঙ্কুরিত করিতেছেন। কিন্তু এমত দেখিলেও আমি সে বিষয়ে আয়াকে তখন কিছু বলিলাম না; কেননা পূর্ব্বে যখন তাহাকে খ্রীষ্টীয় ধর্ম্মের বিষয়ে কোন কথা কহিতাম, তখন সে আমাকে আপন কর্ত্রী জানিয়া ভয় প্রযুক্ত কখন২ সকল কথায় মৌখিক স্বীকার করিত, কিন্তু বাস্তবিক তাহার মনেতে অনেক প্রকার আপত্তি থাকিত। ইহা জানিয়া আমি বোধ করিলাম, যে আমা অপেক্ষা ফুলমণি ও তাহার ছেল্যারা আয়ার পক্ষে উত্তম শিক্ষক হইবে। কিন্তু সে যেন খ্রীষ্টীয় ধর্ম্ম মনোনীত করে, এই অভিপ্রায়ে আমি সর্ব্বদা তাহাকে প্যারীর ন্যায় প্রকৃত ধার্ম্মিক খ্রীষ্টিয়ানদের নিকটে লইয়া যাইতে চেষ্টা করিতাম; কারণ আমি ভালরূপে জ্ঞাতা আছি যে লোকেরা আমাদের কথাদ্বারা নয়, বরং ভাল কর্ম্মদ্বারা ধর্ম্মের বিষয়ে সত্য শিক্ষা প্রাপ্ত হয়।

 পরে আমি প্যারীর ঘরে উপস্থিতা হইয়া দেখিলাম, ফুলমণি দাবায় বসিয়া আপন বৃদ্ধা বন্ধুর জন্যে কিছু সাগুদানা পাক করিতেছে। বৃদ্ধা প্যারী পীড়া প্রযুক্ত অতিশয় দুর্বলা হইয়াছিল, তথাপি সে আমাকে দেখিবামাত্র প্রফুল্ল বদনে কহিতে লাগিল, মেম সাহেব, আমার এই পীড়া কখন ভাল হইবে না; বোধ হয়, এই বার আমি আপন স্বর্গস্থ পিতার বাটীতে যাইব।

 তখন আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, প্যারি, যদি ঈশ্বরের এমত ইচ্ছা হয়, তবে তুমি যাইতে আহ্লাদিতা হও কি না?

 সে উত্তর করিল, আহা! স্বর্গে যাইতে অবশ্য আহ্লাদিতা আছি। মেম সাহেব দেখুন, আমি হেথায় এই ক্ষুদ্র কুঁড়ে ঘরে বাস করি, সেথায় যীশুর সহিত রাজত্ব করিব; হেথায় আমি দুর্বল শরীর প্রাপ্তা হইয়া পাপিষ্ঠ স্বভাব প্রযুক্ত নিত্য২ ঈশ্বরের বিরুদ্ধে অপরাধ করি, সেথায় এই নশ্বর শরীর অনশ্বরতারূপ বস্ত্র পরিধান করিলে আমি ঈশ্বরের সিংহাসনের সম্মুখে নির্দোষী হইয়া দাঁড়াইব। আহা মেম সাহেব! স্বর্গেতে পাপ নাই, অতএব যে স্থানে পাপ নাই সে কেমন সুখের স্থান হইবে!

 আমি বলিলাম, হাঁ প্যারি, এ কথা সত্য বটে, কেননা এই পৃথিবীতে পাপ তাবৎ দুঃখের মূল; কিন্তু একটি কথা জিজ্ঞাসা করি, তুমি মৃত্যুছায়ারূপ উপত্যকার মধ্য দিয়া গমন করিতেছ, অতএব যে প্রভু তোমাকে পাপের বশহইতে রক্ষা করিয়া স্বর্গ লাভের আশা দিয়াছেন, তুমি কি এখন তাঁহাকে অতিশয় প্রিয়জ্ঞান কর?

 প্যারী বলিল, আহা! মেম সাহেব, আমার ত্রাণকর্ত্তা দশ সহস্র জনের মধ্যে অগ্রগণ্য। তিনি সর্ব্বতোভাবে মনোহর; তিনি আমার সহিত থাকিয়া আমাকে সান্ত্বনা করিতেছেন, ও তাঁহার মৃত্যু ব্যতিরেকে আমার আর কোন ভরসা নাই। হে যীশু! ধন্য২ তোমার নাম, যে হেতুক তুমি আপন বহুমূল্য রক্তদ্বারা আমাকে শয়তানের হস্তহইতে ক্রয় করিয়াছ। হে যীশু! তোমার কেমন আশ্চর্য্য প্রেম; সেই প্রেমের কি পর্য্যন্ত দীর্ঘতা ও প্রশস্ততা ও গভীরতা এবং উচ্চতা, তাহা কে বর্ণনা করিতে পারে?

 প্যারী অতিশয় উৎসাহ পূর্ব্বক এই সকল কথা কহাতে বলহীনা হইয়া বালিশে পড়িল, ইহা দেখিয়া আমার আয়া তাহার জন্যে একটি ডালিমের দানা খুলিয়া দিতে লাগিল। প্যারী আয়ার হাতহইতে সেই ডালিম লইল, পরে তাহার মুখের প্রতি তাকাইয়া অতিশয় চিন্তিতা হইয়া বলিল, আয়া গো! তুমি বুঝি খ্রীষ্টিয়ান নও? আয়া বলিল, না, আমি মুসলমান।

 ইহা শুনিয়া ঐ বৃদ্ধা স্ত্রী উঠিয়া বসিয়া বলিল, ও গো আয়া! তুমি যদি খ্রীষ্টিয়ান নও, তবে আমার কথা শুন। আমার অবশিষ্ট যৎকিঞ্চিৎ বল আছে, তদ্দ্বারা আমি এই সাক্ষ্য দিব, যে প্রভু যীশু খ্রীষ্ট সত্য ত্রাণকর্ত্তা, আর আমি যে তোমার সাক্ষাতে ইহা বলিতে সুযোগ পাইলাম তাহার নিমিত্তে ঈশ্বরের ধন্যবাদ করিব। আয়া আমার প্রতি দৃষ্টি কর, দুই তিন দিনের মধ্যে লোকেরা আমাকে কবর দিতে লইয়া যাইবে, কিন্তু তাহাতে আমার কোন ভয় জন্মিতেছে না; বরং আমাকে যদি কেহ এই জগতে থাকিবার হেতু লোভ দেখাইয়া সহস্র২ টাকা দেয়, তথাপি আমি মরিতে ইচ্ছা করি। কি জন্যে আমার এমন ইচ্ছা আছে, তাহাও বলি। আমি যে কোন ধর্ম্ম কর্ম্ম করিয়া স্বর্গ লাভ করিয়াছি তাহা নয়। ও আয়া! তোমাদের কোরাণে এই রূপ লেখা আছে, তোমরা ধর্ম্ম কর্ম্ম করিও তাহাতে স্বর্গ প্রাপ্ত হইবা; কিন্তু যদি পাপ কর, তবে নরকে নিক্ষিপ্ত হইবা। এই উপায় ভিন্ন মুসলমানদের মধ্যে ত্রাণ পাইবার আর কোন উপায় নাই। অতএব আয়া, তুমি বুঝিয়া দেখ, এমত কঠিন আদেশ ধরিয়া ঈশ্বর যদি আমাদের বিচার করেন, তবে কে তাঁহার সম্মুখে নির্দোষী হইবে? তুমি এবং আমি সে বিচারস্থানে কখন দাঁড়াইতে পারিব না, কেননা সকলেই পাপ করাতে ঈশ্বরের নিকটে দোষী হইয়াছে। আমরা আপনাআপনি কোন ভাল কর্ম্ম করিতে পারি না, অতএব মনুষ্যেরা যাহা করিতে অক্ষম এমত কর্ম্ম না করিলে তোমাদের পয়গম্বর তাহাদিগকে স্বর্গ দিতে পারেন না। যদি কেহ এক জন খোঁড়া ব্যক্তিকে বলে, তুমি এখনি লম্ফ দিয়া বেড়াও, না বেড়াইলে তোমাকে কাটিয়া ফেলিব; কিম্বা এক জন অন্ধকে যদি বলে, তুমি নিকটস্থ অট্টালিকা দেখিয়া তাহার একটি অবিকল নক্সা তুলিয়া দেও, না দিলে তোমার প্রাণ নষ্ট করিব; বিবেচনা কর, ঐ মনুষ্যেরা প্রাণের ভয়ে কি লম্ফ দিতে কিম্বা নক্সা তুলিতে পারিবে? কখন না; সুতরাং তাহারা উক্ত কর্ম্ম করিতে আপনাদিগকে অশক্ত জানিয়া মরিতে প্রস্তুত হইবে। সেই রূপে মহম্মদ পয়গম্বর ভাল কর্ম্ম বিনা তোমাদিগকে আর কোন ত্রাণের উপায় দেখাইতে পারেন নাই, অতএব যদি তোমাহইতে নিশ্চিদ্র ধর্ম্মকর্ম্ম না হয়, তবে নরকযন্ত্রণা ভুগিতে প্রস্তুত থাকিও। কিন্তু আর একটি কথাও আছে; কোন২ মুসলমানেরা বলিয়া থাকে, পরমেশ্বর অতিশয় দয়ালু, অতএব তিনি আমাদের পাপ সকল ক্ষমা করিবেন। ইহাতে আমি বলি, পরমেশ্বর যদি প্রায়শ্চিত্ত বিনা একটিও পাপ ক্ষমা করেন, তবে তাঁহার এক প্রধান গুণ নষ্ট হয়। সেই গুণ কি? ন্যায় বিচার। ইহার দৃষ্টান্ত বলি, শুন; এই জেলার জজ সাহেব চোর ডাকাইতদের ক্রন্দন ও বিলাপ শুনিয়া যদি এক জনকেও ছাড়িয়া দিতেন, তবে কি লোকেরা তাঁহার প্রশংসা করিত? না, কোন প্রকারেই নয়। বরং তাঁহাকে অকর্মণ্য বিচারকর্ত্তা বুঝিয়া কোম্পানির নিকটে এই আবেদন করিত, আমাদের গ্রামে এক জন ভাল জজ সাহেবকে পাঠাইয়া দিউন, নতুবা দস্যুদের দল ক্রমে২ বৃদ্ধি হইবে। ইহাতে সুন্দররূপে বোধ হইতেছে যে স্বর্গের ও পৃথিবীর মহৎ বিচারকর্ত্তা অন্যায় পূর্ব্বক কখনও কাহার পাপ ক্ষমা করিবেন না।

 এই সকল কথা বলিবার সময়ে আয়া প্যারীর প্রতি তাকাইয়া অতি মনোযোগ পূর্ব্বক শুনিল; কিন্তু আমি দেখিলাম যে প্যারী বড় দুর্বলা হইতেছে, এই জন্যে তাহাকে ক্ষান্তা হইতে বলিলাম। কিন্তু সে বলিল, না মেম সাহেব, ক্ষান্তা হইব না। আমি আয়াকে কেবল মুসলমান ধর্ম্মের দোষ দেখাইয়াছি, অতএব এখন আমাকে খ্রীষ্টীয় ধর্ম্মের মহৎ গুণ প্রকাশ করিতে দিউন।

 সে সময়ে ফুলমণি সাগু রাঁধিয়া ভিতরে আনিলে প্যারী তাহা কিছু খাইয়া সবল হইল। পরে সে বলিতে লাগিল, শুন আয়া, শুন! যীশু খ্রীষ্ট ঈশ্বরের পুত্ত্র, তিনি স্বয়ং ঈশ্বর, এবং দয়ার সাগর; অতএব তিনি জানিলেন যে সকল মনুষ্যেরা পাপিষ্ঠ স্বভাব প্রযুক্ত ঈশ্বরের আজ্ঞা পালন করিতে না পারিয়া নরকে পতিত হইবে; অতএব তিনি যেন আপন প্রাণ দিয়া পাপি লোকদের প্রায়শ্চিত্ত করিতে পারেন, এই অভিপ্রায়ে তিনি স্বর্গহইতে নামিয়া মনুষ্যদেহ ধারণ করিলেন। তিনি স্বয়ং ধার্ম্মিক হইয়া অধার্ম্মিকদের পরিবর্ত্তে প্রাণদণ্ড ভোগ করিলেন। আরো কহি, খ্রীষ্ট ভিন্ন এমত মহৎ প্রায়শ্চিত্ত কোন মনুষ্য করিতে পারে না, কারণ প্রত্যেক মনুষ্যকে আপন২ পাপের হিসাব দিতে হইবেক। স্বর্গের দূতেরাও পাপের প্রায়শ্চিত্ত করিতে পারে না, কেননা দূতেরা ঈশ্বরের সৃষ্ট প্রাণী মাত্র। কিন্তু যীশু খ্রীষ্ট জগতের তাবৎ দেশীয় লোকদিগকে রক্ষা করিতে চাহিলেন, এই জন্যে তাঁহার যে প্রাণ কোটি২ লোকদের প্রাণহইতেও বহুমূল্য তাহা তিনি উৎসর্গ করিয়া ঈশ্বরের নিকটে আমাদিগের সকল পাপরূপ ঋণ আদায় করিলেন। ও আয়া! এমত আশ্চর্য্য প্রেম কোথা পাইবা?

যীশুর প্রেমের তুলনা দিব কিসে?
খুজিলে এমন মিলিবে না কোনো দেশে!

যীশু আপন শত্রুদের নিমিত্তে মরিলেন; যে কোন ব্যক্তি ইহা স্বীকার করিয়া এমত প্রার্থনা করে, হে ঈশ্বর! আমি দীনহীন ও পাপী, কেবল যীশুতে আমার বিশ্বাস আছে, তিনি আমার ধার পরিশোধ করিয়াছেন, অতএব এখন তাঁহার গুণের নিমিত্তে আমার পাপ মার্জনা কর; ঈশ্বর সেই ব্যক্তির পাপ সকল ক্ষমা করত তাহাকে পুণ্যবান জ্ঞান করিয়া গ্রাহ্য করেন।

 পরে প্যারী আয়াকে উৎসাহ পূর্ব্বক বলিল, ও আয়া, তুমি খ্রীষ্টিয়ান হও! যীশুর উপরে বিশ্বাস কর; তিনি যে তোমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করিয়াছেন তাহা স্বীকার কর। তিনি তো আমারই পাপের ভার লইয়াছেন, তাহা আমি নিশ্চয় জানি, এই জন্যে আপন বিচারকর্ত্তার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আমার কিছু ভয় নাই। তিনি আমাকে দোষি করিবেন না, কেননা তিনি আমার ত্রাণকর্ত্তা, ও আমার দোষের নিমিত্তে পূর্ব্বে দণ্ড ভোগ করিয়াছেন। না আয়া, আমি ভয় করি না, বরং উল্লাসিতা হই, কারণ যীশু অবশ্য আমাকে এই কথা কহিবেন, আইস হে আমার পিতার অনুগ্রহের পাত্র, তোমার জন্যে জগতের পত্তন অবধি যে রাজ্য প্রস্তুত করা গিয়াছে তাহার অধিকারিণী হও। ও আয়া, স্বর্গেতে তোমার সহিত যেন আমার সাক্ষাৎ হয়, ইহা আমি অতিশয় অভিলাষ করিতেছি।

আয়া এই কথা শুনিয়া বড় ক্রন্দন করিতে২ বলিল, ওগো মা, তুমি ও ফুলমণি ও ফুলমণির ছোট ছেল্যারা পর্য্যন্ত সকলে মিলিয়া আমাকে প্রায় খ্রীষ্টিয়ান করিলা; কিন্তু আমি খ্রীষ্টিয়ান হইব কি না, তাহা এখন বলিতে পারি না। সে যাহা হউক, তোমার মৃত্যুর ন্যায় যদি আমারও মৃত্যু হয়, তবে আমার বড় সৌভাগ্য।

 প্যারী বলিল, ও গো আয়া! যদি ধার্ম্মিক লোকদের ন্যায় সুস্থির মনা হইয়া মরিতে বাঞ্ছা কর, তবে বিশ্বাস কর। এই কথা বলিয়া সে অচৈতন্য হইয়া বালিশের উপরে পড়িল।

 তখন আমি প্যারীর ব্যামোহের বিষয় ফুলমণিকে জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলাম, তাহাতে সে বলিল; মেম সাহেব, আপনি কল্য ঘরে গেলে পর প্যারী আমাকে ডাকিয়া পাঠাইল। আমি এখানে আসিয়া দেখিলাম, সে সমস্ত দিন জ্বর ভোগ করিয়াছে, তথাপি কাহাকে কিছু বলে নাই। তাহাতে আমি পাদরি সাহেবের নিকটে সমাচার দিবার জন্যে তখনি সাধুর বাপকে পাঠাইয়া দিলাম। সাহেব প্যারীর ধার্ম্মিক আচরণের বিষয় এখানকার ইংরাজ ডাক্তর সাহেবকে বলাতে তিনি অদ্য প্রাতঃকালে আসিয়া তাহাকে অনেক প্রকার ঔষধাদি দিয়াছিলেন বটে; কিন্তু তিনি পাদরি সাহেবকে বলিলেন, প্যারী অতিশয় বৃদ্ধা হইয়াছে, বোধ হয় সে এই পীড়াহইতে সুস্থ হইতে পারিবে না। ফুলমণি আরো বলিল, পাড়ার প্রায় সকল স্ত্রীলোকেরা অদ্য এখানে আসিয়া প্যারীর কিছু কর্ম্ম করিয়া দিয়াছে, তাহাতে সে এক মুহূর্ত্তও একাকী থাকে নাই; কল্য আমি সমস্ত রাত্রি তাহার নিকটে ছিলাম, এবং অদ্য রাত্রিতে রাণী আসিয়া এখানে থাকিবে, ইহা সে আমাকে বলিয়াছে।

 রাণীর কথা শুনিয়া আমি জিজ্ঞাসিলাম, ফুলমণি, রাণী এখন কি রূপ ব্যবহার করিতেছে? আমি প্রায় তাহাকে দুই মাস পর্য্যন্ত দেখি নাই।

 ফুলমণি বলিল, মেম সাহেব, রাণী এখন অতি উত্তম আচার ব্যবহার করিতেছে; বোধ হয় সে নূতন জন্ম প্রাপ্ত হইয়া সত্য খ্রীষ্টিয়ান হইল। সে আমাকে অনেক বার বলে, মেম সাহেবের শিক্ষাদ্বারা আমার বিস্তর উপকার হইয়াছে। এবং মেম সাহেব, কেবল রাণীর উপকার হইয়াছে তাহা নয়, এই গ্রামের মধ্যে অনেক লোক আপনকার উপদেশ শুনিয়া পূর্ব্বাপেক্ষা এখন ধর্ম্মের বিষয়ে কিছু২ মনোযোগ করিতেছে।

 আমি উত্তর করিলাম, আমাদের নয়, কিন্তু পরমেশ্বরের অনুগ্রহ ও সত্যতার নিমিত্তে তাঁহার নামের মহিমা বৃদ্ধি হউক! তথাপি ফুলমণি, তোমাকে খোশামদ করিতে না চাহিলেও আমি এই কথা বলিব; যে স্থানে আমি ধর্ম্মরূপ বীজ বপন করিয়াছি, সে স্থানে তুমি যদি উত্তম পরামর্শ ও প্রার্থনারূপ জল সেচনদ্বারা তাহা সিক্ত না করিতা, তবে বোধ হয় সে বীজ অঙ্কুরিত না হইয়া নষ্ট হইত। হায়! আমাদের বাঙ্গালা দেশস্থ মণ্ডলীগণের মধ্যে যদি অনেক থার্ম্মিকা স্ত্রীলোক থাকিত, তবে তাহাদের দ্বারা খ্রীষ্টিয়ান লোকদের সংখ্যা কেমন শীঘ্র বৃদ্ধি হইত! যে স্ত্রীলোকেরা অজ্ঞান ব্যক্তিদের শিক্ষা দিতে ও দুর্বল শিষ্যগণের সাহায্য করিতে পারে, মণ্ডলীর মধ্যে এমত স্ত্রীলোকদের অভাব আছে। হিন্দুদের সহিত আমাদের প্রতিদিন সাক্ষাৎ হয়, অতএব তাহাদিগকে কিছু শিক্ষা দেওয়া খ্রীষ্টিয়ান স্ত্রীলোকদের উচিত। তাহারা যদি এমত করিত, তবে বোধ হয় হিন্দুরা ইংরাজদের কথা অপেক্ষা স্বদেশীয় লোকদের কথা উত্তমরূপে শুনিত; সুতরাং তাহারা মনে২ করিবে, পূর্ব্বে ইহারা আমাদের ন্যায় হিন্দু ছিল, এখন বুঝি পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছে যে নূতন ধর্ম্ম পুরাতন ধর্ম্মহইতে উত্তম।

 ফুলমণি বলিল, মেম সাহেব, একথা সত্য। কিন্তু এই দুঃখের বিষয় যে মণ্ডলীর মধ্যে অনেক স্ত্রীলোকেরা ধর্ম্মকে প্রিয়জ্ঞান করে না, তবে তাহারা পরকে কি প্রকারে শিক্ষা দিবে? খ্রীষ্টধর্ম্ম কেমন সুমিষ্ট ইহা যদি আপনারা আস্বাদন করিয়া দেখিত, তবে তাহারা অবশ্য অন্য লোকদিগকে সেই পথে আনিতে চেষ্টা করিত। আ মেম সাহেব! চিকিৎসকদ্বারা ভয়ানক রোগহইতে মুক্ত হইয়া পরের নিকটে তাহার প্রসংশা না করে, এমত কোন্ ব্যক্তি আছে? তেমনি যে মনুষ্য মহাচিকিৎসক কর্ত্তৃক পাপ রূপ রোগহইতে উদ্ধার হইয়া মনের সান্ত্বনা পাইয়াছে, সেই মনুষ্য অন্য পাপি লোকদের নিকটে তাঁহার গুণ অবশ্য কীর্ত্তন করিবে। অতএব যদি শুনিতে পাই যে অমুক খ্রীষ্টিয়ান ধর্ম্মের বিষয়ে কাহাকে কিছু বলে না, তবে আমি মনে২ ভাবি সে ব্যক্তি কোন প্রকারে প্রকৃত খ্রীষ্টিয়ান নহে।

 আমি কহিলাম, ফুলমণি, তুমি ভাল বলিয়াছ; কেননা যদ্যপিও কোন২ খ্রীষ্টিয়ানেরা ভীরু স্বভাবপ্রযুক্ত ধর্ম্মের বিষয়ে কথা কহিতে কিছু ভয় করে, তথাপি যখন পাপিরা প্রকাশ রূপে ঈশ্বরের আজ্ঞা লঙ্ঘন করে, তখন এমত ভীরু ব্যক্তিগণও চুপ করিয়া থাকিতে পারে না।

 আমাদের কথোপকথনের সময়ে বৃদ্ধা প্যারী ঘোরতর নিদ্রা গিয়াছিল; অতএব তাহার ভাল সেবা হইতেছে, ইহা দেখিয়া আমি কেবল তাহার সুখাদ্য সামগ্রী কিনিবার কারণ ফুলমণির হাতে দুইটি টাকা দিয়া বিদায় হইলাম। পথের মধ্যে যাইতে২ আমি ইহা ভাবিলাম, যীশু আপন লোকদিগের প্রতি যে অঙ্গীকার করিয়াছেন, “আমি তোমাদের স্থানে শান্তি রাখিয়া যাইতেছি, আমি নিজের শান্তি তোমাদিগকে প্রদান করিতেছি, জগতের লোক যেমন দান করে আমি তদ্রূপ দান করি না; তোমরা মনোদুঃখী ও ভীত হইও না,” যোহন ১৪।২৭। এই অঙ্গীকার তাঁহার দাসীর প্রতি কেমন আশ্চর্য্যরূপে সফল হইতেছে।

 পরে করুণার ঘর দিয়া আমাকে যাইতে হইল, অতএব তাহার স্বামী ফিরিয়া আসিয়াছে কি না, ইহা দেখিতে আমি ভিতরে গেলাম। তথায় গিয়া দেখিলাম, বংশির পিতা দাবায় ভোজন করিতেছে, এবং তাহার স্ত্রী তাহার নিকটে বসিয়া নবীনের কর্ম্মের বিষয়ে এবং আমার বড় কোঠা ঘরের বিষয়ে তাবৎ বৃত্তান্ত কহিতেছে। আমাকে দেখিবা মাত্র করুণা শীঘ্র উঠিয়া একটা নূতন মোড়া বাহিরে আনিয়া বলিল, মেম সাহেব, আপনি যে টাকাটি দিয়াছিলেন, তাহা ভাঙ্গাইয়া চারি পয়সা দিয়া প্রথমে এই মোড়াটি কিনিলাম, যেন আপনি এখানে আইলে বসিবার স্থান পান।

 এ ক্ষুদ্র বিষয় ছিল বটে, তথাপি ইহা শুনিয়া আমি বড় সন্তুষ্টা হইলাম, কেননা তদ্দ্বারা জানা গেল যে করুণা আমাকে দেখিতে অতিশয় ইচ্ছুক আছে। কিন্তু তাহার স্বামির সহিত অদ্য মিলন হইয়াছে, অতএব তাহাদের কাছে থাকা এখন আমার উচিত নয়, ইহা ভাবিয়া আমি সেই দিনে তাহার ঘরে বসিতে স্বীকৃতা হইলাম না। আমি করুণাকে বলিলাম, তোমার নবীন আমার ঘরে থাকিতে সন্তুষ্ট আছে; আমি যখন বাহিরে আইসি তখন দেখিলাম সে মসাল্‌চির নিকটে ছুরি কাঁটা পরিষ্কার করিতে শিখিতেছে। ইহা বলিয়া আমি ঘরে ফিরিয়া গেলাম।

 করুণার ব্যবহার পূর্ব্বাপেক্ষা কিঞ্চিৎ ভাল হইয়াছে, ইহা দেখিয়া আমার মন অতিশয় আনন্দযুক্ত হইল, এবং তাহার নিমিত্তে আমি ঈশ্বরের স্থানে এই প্রার্থনা করিলাম, হে পরমেশ্বর, আপন দাসীর প্রতি তোমার কর্ম্ম সিদ্ধ কর, তুমি আপন হস্তকৃত কর্ম্ম পরিত্যাগ করিও না। কিন্তু ঈশ্বর কিরূপ ভয়ানক এবং দুঃখজনক ঘটনাদ্বারা করুণার প্রতি আমার এই প্রার্থনা সফল করিবেন, তাহা আমি তখন জানিলাম না।

 পর দিবস প্রত্যূষে উঠিয়া আমি আপন রীত্যনুসারে ঘরহইতে বাহিরে আসিয়া বায়ু সেবনার্থে গাড়ীতে আরোহণ করিতেছি, এমন সময়ে ছোট নবীন অতিশয় ক্রন্দন করিতে২ আমার নিকটে আসিয়া বলিল; ও মেম সাহেব, আমাকে ঘরে যাইতে ছুটি দেও। আমাদের পাড়ার এক জন ছেল্যা আমাকে এখনই বলিল, কাল রাত্রির মধ্যে দাদা জলে ডুবিয়া মরিয়াছে। ইহা শুনিয়া আমি ঐ অধার্ম্মিক ও দুষ্ট বালকের ব্যবহার স্মরণ করিয়া পরকালে তাহার কি দুর্গতি হইবে ইহা ভাবিয়া অতিশয় কম্পান্বিতা হইলাম; কিন্তু সে বিষয় নবীনকে কিছু না বলিয়া আমি তাহাকে গাড়ীতে চড়িয়া কোচ্‌মানের নিকটে বসিতে কহিলাম, এবং কোচ্‌মানকে খ্রীষ্টিয়ান পাড়াতে শীঘ্র গাড়ী চালাইতে আজ্ঞা করিলাম।

 পরে আমি করুণার বাটীতে পৌঁছিয়া দেখিলাম তথায় বড় জনতা হইয়াছে, আর তাহাদের সহিত কএক জন চৌকিদার ও বরকন্দাজ দাঁড়াইয়া আছে। সকলে অতিশয় গোল করিয়া ডাকাইতি, খুন ও চৌর্য্যের বিষয়ে কথোপকথন করিতেছিল। এক জন বলিল, বা! খ্রীষ্টিয়ানদের মধ্যে না কি ধর্ম্ম আছে, তবে তাহারা এমত কর্ম্ম কেন করে?

 নবীন পৌঁছিবা মাত্র একেবারে দৌড়িয়া ঘরের ভিতরে গেল; কিন্তু আমি জনতার মধ্যে প্রবেশ করিতে অনিচ্ছুক ছিলাম, এই জন্যে এক পার্শ্বে দাঁড়াইয়া ঐ গোলমালের কারণ জ্ঞাত হইবার নিমিত্তে এক জন বরকন্দাজকে ডাকাইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, এই খ্রীষ্টিয়ানদের পুত্ত্র কি ডুবিয়া মরিয়াছে?

 তাহাতে বরকন্দাজ কহিল, হাঁ মেম সাহেব, তাহার মৃত দেহ আজি প্রাতঃকালে ঘরে আনা গিয়াছে। কাল রাত্রিতে এক জন হিন্দুলোক ঐ ছেল্যাকে সঙ্গে লইয়া মহেন্দ্র বাবুর ঘরে সিঁধ কাটিয়া প্রবেশ করিয়াছিল। বোধ হয় বংশী তাহাকে পথ দেখাইবার জন্যে গিয়াছিল, কেননা সে বাবুর এক জাতি হওয়াতে তাঁহার গৃহের সমুদয় সন্ধান জানিত। সে যাহা হউক, তাহারা দুই জনে প্রবেশ করিয়া বাবুর স্ত্রীর সকল গহনা খুলিতে লাগিল। সে তখন নিদ্রিতা ছিল, কিন্তু চেতনা পাইয়া চীৎকার শব্দ করিয়া উঠিল, তাহাতে এক জন চোর তাহার কুক্ষিদেশে আঘাত করিল; এমত সময়ে বাবুও জাগিয়া উঠিয়া চোরদিগকে ধরিতে চেষ্টা করিলে তাহারা পলাইয়া গেল, কিন্তু বাবুও বাহির হইয়া তাহাদের পশ্চাৎ২ দৌড়িলেন। কল্য রাত্রিতে ঘোরতর কুজ্ঝটিকা হইয়াছিল, অতএব মাঠের মধ্যে কিছুই দৃশ্য হয় নাই; কেবল সে স্থানে চোরদের গমনের শব্দ শুনিয়া বাবু তাহা লক্ষ্য করিয়া তাহাদের পশ্চাৎ২ যাইতে লাগিলেন। দৌড়িতে২ এক জন অকস্মাৎ জলে পড়িল, এমত শব্দ হওয়াতে বাবু জানিতে পারিলেন, মাঠের বড় পুষ্করিণীর ধারে আসিয়াছি। অন্য চোরও পাকা ঘাটের শিঁড়িতে আছাড় খাইয়া পড়িল, তাহাতে বাবু তখনি তাহাকে ধরিলেন; এমত সময়ে আমরা উপস্থিত হইয়া তাহাকে থানায় লইয়া গেলাম। কল্য রাত্রিতে আমরা বোধ করিয়াছিলাম, যে ব্যক্তি জলে পড়িল সে অবশ্য সাঁতার দিয়া পলায়ন করিয়াছে; কিন্তু আজি প্রাতঃকালে তাহার মৃত দেহ উক্ত পুষ্করিণীতে ভাসিয়া উঠিল, এবং তাহার বাপ আসিয়া তাহাকে আপন পুত্ত্র বলিয়া ঘরে আনিল। সে বলে, আমার ছেল্যা যে চুরি করিতে গিয়াছিল, তাহা আমি কিছু জানি না; সে যাহা হউক, তাহাকে একবার মাজিষ্ট্রেট সাহেবের সাক্ষাতে লইয়া যাইতে হইবে। আমরা যে চোরকে থানায় রাখিয়াছি, যদি সাহেব তাহাকে একেবারে ফাঁসি দিতে আজ্ঞা দেন তবে বড় ভাল হয়; কেননা সে একবার পাঁচ বৎসর পর্য্যন্ত কয়েদ ছিল, তথাপি সে কোন প্রকারে শিক্ষা পায় নাই। বাবুর স্ত্রী এমত আঘাতিতা হইয়াছে যে তাহার বাঁচা ভার, তাহাতে প্রাণের ভয়ে ঐ দুষ্ট বলে, আমি তো তাহাকে কাটি নাই, বংশী তাহা করিয়াছে। কিন্তু এ কথা নিতান্ত মিথ্যা বোধ হয়, কেননা বংশী ছেল্যা বই তো না, মানুষকে খুন করিতে কখন তাহার সাহস হয় না। অতএব স্পষ্ট বোধ হইতেছে যে তাহার সঙ্গি লোক ঐ কর্ম্ম করিয়াছে।

 বরকন্দাজের নিকটে এই রূপ খেদজনক সমাচার পাইয়া করুণার অসহ্য দুঃখ আমি কি প্রকারে দেখিব, ইহা ভাবিতে লাগিলাম। ঘরের ভিতরহইতে তাহার ক্রন্দন ও বিলাপের শব্দ স্পষ্ট রূপে আমার কর্ণগোচর হুইল, অতএব সে দিন অমনি বাটী ফিরিয়া যাইতে ইচ্ছা করিলাম, কিন্তু শেষে আমি মনে ভাবিলাম, এমত করা অকর্ত্তব্য, কারণ এখন করুণা দুঃখে পড়িয়াছে; এই জন্যে যদ্যপিও তাহার নিকটে যাওয়াতে আমার ক্লেশ হয়, তথাপি তাহাকে সান্ত্বনা করা উচিত হইয়াছে।

 এই দুর্ঘটনা যদি এক বৎসর পূর্ব্বে হইত, তবে করুণার মনে এত দুঃখ জন্মিত না; কেবল সাধারণ পুত্ত্রশোকের মত তাহার শোক হইত, এবং তাহার ছেল্যা চোররূপে ধরা পড়াতে তাহার অখ্যাতি হইল, কি জানি ইহাতেও তাহার দুঃখ জন্মিত; কিন্তু পরলোকে তাহার দুর্গতির বিষয়ে সে তখনই কোন চিন্তা করিত না। এখন তাহার মনরূপ চক্ষু কিছু প্রসন্ন হইয়াছিল, ইহাতে সে ধর্ম্মজ্ঞান প্রাপ্ত হইয়া আপন পুত্ত্রকে যে শিক্ষা দেয় নাই, এ বিষয়ে বড় ভাবিতা হইল।

 আমি করুণাকে দেখিবা মাত্র বোধ করিলাম, সে অবশ্য হতজ্ঞান হইয়াছে, কেননা মনের অসহ্য যন্ত্রণাদ্বারা সে আপন কেশ ছিঁড়িয়া বলিতে লাগিল, কে বলে যে আমার ছেল্যা হত্যাকারী? না না, সে হত্যাকারী নয়, আমিই হত্যাকারী; আমাকে মাজিষ্ট্রেট সাহেবের নিকটে লইয়া যাও, তিনি আমাকেই ফাঁসি দিউন। পরমেশ্বরের সাক্ষাতে আমি নরহত্যা করিয়াছি, অতএব তিনি যদি আমাকে একেবারে নরকে ফেলিয়া দেন, তবে তাহা আমার উপযুক্ত শাস্তি হয় বটে। হায়! আমি মা হইয়া আপন ছেল্যার শরীর ও আত্মা উভয় নষ্ট করিয়াছি। আমি তাহাকে গন্তব্য পথে চলিতে শিক্ষা দিই নাই, ঈশ্বরের আজ্ঞা লঙ্ঘন করিতে নিষেধ করি নাই; প্রথমে তাহার মনেতে রাগ, দ্বেষ, লোভাদি প্রবল হইতে দিয়াছিলাম, শেষে তাহাকে কোন প্রকারে উগরাইয়া ফেলাইতে পারিলাম না। সে আমার নিকটে পয়সা চুরি করিত, ও আপন ছোট ভাইয়ের প্রতি অন্যায় করিত, তথাপি আমি স্নেহ প্রযুক্ত তাহাকে একবারও বলি নাই, যে এ সকল করিলে তোমাকে নরকে যাইতে হইবে! হায়! ইহাকে কি প্রেম বলা যায়? ধিক্ এমত মিথ্যা প্রেম! তদ্দ্বারা আমার ছেল্যা নষ্ট হইল। হায়২! আমি কি কিরব? লোকদের প্রতি চক্ষুঃ তুলিয়া আর দেখিতে পারিব না; এবং ঈশ্বরের নিকটে প্রার্থনা করিতে সাহস হইবে না। এই জগতে আমার সুখ নাই, আর পরলোকেও যাইতে আমার ভয় হইতেছে, কেননা সেখানে আমার ছেল্যা আমাকে দেখিবে, আর তাহাকে শিক্ষা দিই নাই বলিয়া সে আমাকে দোষ দিবে। হে পরমেশ্বর, তোমার আত্মাহইতে কোথায় যাইব, ও তোমার সাক্ষাৎহইতে কোথায় পলায়ন করিব? নবীন গো, আমি তোমার ভাইয়ের আত্মাকে নষ্ট করিয়াছি, কিন্তু তোমারই আত্মাকে হত্যা করিব না; মেম সাহেবের হস্তে তোমাকে সমর্পণ করিলাম, তিনি তোমাকে উত্তম শিক্ষা দিবেন, আমি তাহা দিতে অক্ষম। হায়! আমার যে ছেল্যা থাকে আমি এমত যোগ্যপাত্র নহি।

 বংশির মৃত দেহ সকলের সাক্ষাতে ঘৃণার্হ বস্তু ছিল বটে, তথাপি তাহার মা উক্ত কথা বলিয়া ঐ শবের মাথা আপন কোলে রাখিয়া তাহার মুখে চুম্বন করত অধিক ক্রন্দন করিয়া বলিতে লাগিল, যে মায়ের নিষ্পাপি শিশু তাহার বক্ষঃস্থলে পড়িয়া প্রাণ ত্যাগ করে, সেই মা উল্লাস করুক! সে যখন ছোট শবকে ধুইয়া তৈল মাখায় ও তাহার কবর সিন্দুকে ফুল ছড়ায়, তখন সে এমত জ্ঞান করুক, আমার ছেল্যা বিবাহের বাটীতে যাইতেছে; ও যে সময়ে তাহার বন্ধু বান্ধবেরা তাহার বাছাকে লইয়া কবরে রাখে, সেই সময়ে তাহার মাও কবরস্থানে যাইয়া আনন্দযুক্ত হউক, কারণ তাহার সন্তানের দুঃখের শেষ হইল! সেই ছেল্যা আপন স্বর্গস্থ পিতার স্বর্ণময় অট্টালিকাতে থাকিয়া প্রতিপালিত হইবে; অতএব তাহার মা ক্রন্দন না করুক। কিন্তু হায়! আমার যেপ্রকার পুত্ত্রশোক, তেমন পুত্ত্রশোক জগতে খুজিয়া পাইব না। হায় আমার বংশি! তুমি এখন কোথায় আছ? হায় আমার বাছা! কে তোমার আত্মাকে নষ্ট করিল? আমি তাহা করিলাম। আমাকে ধিক্, আমি মা হইয়া আপন ছেল্যার শরীর ও আত্মা উভয়কে নষ্ট করিলাম।

 এ কথা কহিয়া দুঃখিনি করুণা আপন মনের যন্ত্রণা আর সহ্য করিতে না পারিয়া একেবারে অচৈতন্য হইয়া ভূমিতে পড়িল। সেই সময়ে একটিও শব্দ শুনা গেল না, বরং প্রত্যেক স্ত্রীলোকের চক্ষে জল ছল২ করিতেছিল, ও প্রত্যেক পুরুষ স্বর্গের প্রতি দৃষ্টি করিয়া মনে২ প্রার্থনা করিল, হে ঈশ্বর! আমাদের পরিবারের মধ্যে যেন এমত দুর্ঘটনা না হয়। সেই সময়ে অধর্ম্মের ফল স্পষ্টরূপে প্রকাশ পাইল।

 বংশির পিতা গত রাত্রিতে গৃহে থাকিয়া মদ্য পানাদি করে নাই, অতএব কি২ ঘটিয়াছে তাহা সে ভালরূপে জ্ঞাত ছিল; তথাচ সে আপন স্ত্রীর ন্যায় মনোদুঃখী হইল না, কারণ যদ্যপি সে ছেল্যার নিমিত্তে বিস্তর কাঁদিল, তথাপি আপনাকে কোন প্রকারে দোষ না দিয়া এই মাত্র বলিল, আমরা কি করিব? ঈশ্বরের যাহা ইচ্ছা তাহাই তিনি করেন। পরে করুণার অবস্থা দেখিয়া সে দীর্ঘ নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া তাহাকে ভূমিহইতে তুলিল; এবং আমি তাহার মুখে সুশীতল জল দিয়া বিলাতীয় নস্য সুঙাইয়া তাহাকে চেতন করিতে চেষ্টা করিলাম।

 কিঞ্চিৎকাল পরে সে চক্ষুঃ খুলিয়া চতুর্দিগে দেখিতে লাগিল। তখন তাহার স্বামী বলিল, ও গো! তুমি বড় নির্বোধ ব্যক্তির ন্যায় কথা কহিয়াছ। আমাদের কেবল নয়, অন্য লোকদের ছেল্যাও ডুবিয়া মরিয়া থাকে, অতএব তাহাতে আমাদের দোষ কি? তাহা পরমেশ্বরের ইচ্ছা। কিন্তু করুণা বলিল, না গো! আমি নির্বোধ নই। কল্য আমি ধর্ম্মপুস্তকে পড়িয়াছিলাম, যে ঈশ্বর ধার্ম্মিক এলির তাবৎ বংশ একেবারে উচ্ছিন্ন করিলেন; কারণ তাহার পুত্ত্রগণ দুষ্টামি করিত, এবং সে তাহা জ্ঞাত হইয়াও তাহাদিগকে নিষেধ করিত না। তুমি যদি সেই কথা পাঠ করিতা, তবে আমাকে কখন নির্বোধ বলিতা না। সে যাহা হউক, আমি আপন অন্তঃকরণের মধ্যে এই অগ্নি আপনি জ্বালাইয়াছি, অতএব সে এখন চিরকাল জ্বলিতে থাকিবে।

 সেই সময়ে ফুলমণি ঘরের মধ্যে আসিয়া আমার কানে২ বলিল, মেম সাহেব, দুখিঃনি করুণার দুর্গতির বিষয় আমি জ্ঞাতা আছি বটে, কিন্তু এতক্ষণ প্যারীকে ছাড়িয়া আসিতে পারিলাম না, কারণ তাহার বাঁচিবার আর বিস্তর সময় নাই, অতএব সে আপনাকে ডাকাইবার জন্যে আমাকে পাঠাইয়াছে। আর মেম সাহেব, যদি করুণাকে সেখানে লইয়া যাইতে পারেন, তবে প্যারীর নিকটে সুন্দর সান্ত্বনার বাক্য শুনিয়া বোধ হয় তাহারও মন কিছু সুস্থির হইতে পারিবে। কিন্তু যে কোন রূপে আমাদিগকে শীঘ্র ফিরিয়া যাইতে হইবে, কেননা আপনকার আয়া ব্যতিরেকে প্যারীর কাছে আর কেহ নাই; পাড়ার সমস্ত লোক বংশির গোলমালেতে মত্ত হইয়াছে।

 আয়ার বিষয় শুনিয়া আমি আশ্চর্য্য জ্ঞান করিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, আমি আয়াকে ঘরে রাখিয়া আসিয়াছিলাম, সে এখানে কখন আইল? ফুলমণি কহিল, বোধ হয় প্রায় অর্দ্ধঘণ্টা হইল, এবং যেমন শুষ্ক ভূমি আকাশের জল চূষিয়া লয়, তেমনি আয়া সেই অবধি প্যারীর মুখহইতে জীবনদায়ক বাক্য অতি যত্ন পূর্ব্বক গ্রহণ করিতেছে।

 ফুলমণি এই কথা কহিতে২ তাহার স্বামী প্রেমচাঁদ আসিয়া উপস্থিত হইল। সে তিন দিন পূর্ব্বে পাদরি সাহেবের কোন কর্ম্মের উপলক্ষে কলিকাতায় গিয়া এই মাত্র ঘরে পৌঁছিল, তাহাতে সে বংশির মৃত্যুর সংবাদ শুনিয়া অতিশয় দুঃখিত হইয়া তাহাদের বাটীতে তৎক্ষণাৎ আইল। পরে ফুলমণির নিকটে প্যারীর বিষয় জ্ঞাত হইয়া প্রেমচাঁদ তাহাকে পুনরায় দেখিবার নিমিত্তে আমাদের সহিত যাইতে স্থির করিল। তাহাতে আমি কহিলাম, ভাল প্রেমচাঁদ, তুমি ও ফুলমণি দুঃখিনি করুণাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া যাও। আমরা তখনই করুণার নিকটে গিয়া তাহার হাত ধরিয়া সকলেই প্যারীর গৃহে গেলাম। করুণা নিরাশ হইয়া আপন মৃত সন্তানের মুখের প্রতি এক দৃষ্টিতে চাহিয়া বসিয়াছিল, তাহাতে আমরা যখন সেখানহইতে তাহাকে তুলিলাম, তখন আমাকে কোথায় লইয়া যাইবে, এ কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া সে নিরব হইয়া আমাদের সঙ্গে২ চলিল। বংশির বাপও কিছু না বলিয়া ঘরে বসিয়া রহিল, কিন্তু নবীন আমাদের সহিত প্যারীর বাটীতে গেল।

 অনন্তর আমাদের বৃদ্ধা বন্ধুর গৃহে পৌঁছিলে প্যারী চক্ষুঃ খুলিয়া মৃদু স্বরে বলিল, আ মেম সাহেব! আপনি আমার মৃত্যু দেখিতে আসিয়াছেন। আমি বলিলাম, হাঁ প্যারি, যে পর্য্যন্ত আমাদের স্বর্গস্থ পিতার বাটীতে তোমার সহিত সাক্ষাৎ না হয়, সেই পর্য্যন্ত তোমার নিকটে বিদায় লইতে আসিয়াছি। তখন স্পষ্ট বোধ হইল যে প্যারীর গমন কাল সন্নিকট, কেননা সে এক কালীন মৃদুস্বরে চারি পাঁচটি কথা ব্যতিরেকে আর বলিতে পারিল না।·

 ফুলমণি ভালরূপে বিবেচনা করিয়াছিল, যে এমত সময়ে বংশির ভয়ানক মৃত্যুর বিষয় বলিয়া প্যারীর মনকে অস্থির করা কর্ত্তব্য নয়, এই কারণ প্রাতঃকালের তাবৎ ঘটনার বিষয়ে সে নিতান্ত অজ্ঞাতা ছিল। তথাপি আমি বড় ইচ্ছুক হইলাম, যে প্যারী করুণাকে এই সময়ে একটি সান্ত্বনার বাক্য কহে; এই জন্যে তাহার হাত ধরিয়া বলিলাম, প্যারি, এই স্থানে এক জন আছে, যে আপনাকে অতিশয় পাপিষ্ঠ জানিয়া বোধ করে, পরমেশ্বর আমাকেই ক্ষমা করিবেন না; এমত ব্যক্তিকে তুমি কি পরামর্শ দিয়া যাইবা?

 তখন প্যারী করুণাকে আর চিনিতে পারিল না, কিন্তু এই কথাতে সে মস্তক তুলিল, এবং তাহার অবশিষ্ট যৎকিঞ্চিৎ বল ছিল, তদ্দ্বারা সে বলিতে লাগিল, ও গো! যীশু খ্রীষ্টের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস কর, তাহা করিলে ঈশ্বরের স্মরণ পুস্তকের মধ্যে যে পৃষ্ঠায় তোমার সকল পাপ লেখা আছে, সেই পৃষ্ঠ যীশু খ্রীষ্ট ক্রুশে বিদ্ধ রক্তময় আপন হস্তদ্বারা মুচাইয়া ফেলিবেন; তাহাতে যে স্থানে তোমার দোষ লেখা ছিল, সে স্থানে খ্রীষ্টের রক্ত ব্যতিরেকে আর কিছু দেখিতে না পাইয়া ঈশ্বর তোমাকে পুণ্যবান্ জ্ঞান করিবেন।

 করুণা ইহাতেও নিরাশ হইয়া বলিল, না না, আমার পাপ অতি ভারী হইয়াছে, তিনি আমাকে কখন পুণ্যবান্ জ্ঞান করিবেন না; আমাকে নরকে যাইতে হইবে, ইহা আমি নিশ্চয় জানিতেছি। প্যারী পুনর্ব্বার কহিল, কোন প্রকারেই নয়। ঈশ্বর আপনি বলিয়াছেন, “তোমাদের পাপ রক্তবর্ণ হইলেও হিমের ন্যায় শুক্লবর্ণ হইবে, ও সিন্দূরের ন্যায় রাঙ্গা হইলেও মেষ লোমের ন্যায় শাদা হইবে।” যিশয়িয় ১।১৮।

 ইহা বলিয়া প্যারী চক্ষুঃ মুদ্রিত করিয়া কিছু কাল স্থির হইয়া রহিল, পরে আমরা শুনিতে পাইলাম, সে অতি ক্ষীণ রবে ধীরে২ বলিতেছে, হে যীশু, তুমি কেমন প্রিয়! আহা, স্বর্গ কেমন সুখের স্থান! যীশু, তোমার পুণ্য রক্ত আমার সুন্দর পরিধান; সকল জগৎ লুপ্ত হইলে সেই আমার ভরসা থাকিবে। হে মৃত্যু, তোমার হুল কোথায়? হে পরলোক, তোমার জয় কোথায়? যীশু খ্রীষ্টদ্বারা আমিই জয়যুক্ত হইয়াছি।

 আয়া এমত সময়ে বসিয়া২ অতিশয় কাঁদিতেছিল, পরে সে প্যারীর হাত ধরিয়া বলিল, ও গো মা! আমার কথা শুন, আমার কথা শুন। তুমি কেমন সুস্থিররূপে মরিতেছ, ইহা দেখিয়া আমি খ্রীষ্টিয়ান হইলাম।

 বোধ হইল প্যারী এই কথা বুঝিতে পারিয়াছিল, কারণ তখনি তাহার ম্লান বদন প্রফুল্ল হইয়া উঠিল, এবং সে স্বর্গের প্রতি দৃষ্টি করিয়া কহিল, যদি এমত হয়, তবে হে পিতঃ, আমি তোমার ধন্যবাদ করি। ও আয়া! আমি স্বর্গে তোমার সহিত সাক্ষাৎ করিব। পরে সে ফুলমণির প্রতি ফিরিয়া বলিল, এই বার যাইতেছি। ফুলমণি গো! আমি তোমার বক্ষঃস্থলে মাথা রাখিয়া মরিতে চাহি; তুমি সপরিবারে আশীর্ব্বাদ প্রাপ্ত হও। ও মেম সাহেব, ঈশ্বর আপনাকে আশীর্ব্বাদ করুন। হে প্রভো যীশু, আইস! তাঁহার বাম হস্ত আমার মস্তকের নীচে আছে, ও তাঁহার দক্ষিণ হস্ত আমাকে আলিঙ্গন করিতেছে। আহা! ঈশ্বরের প্রিয় লোকদের কেমন শান্তি! কেমন সুখ!

 এই বৃদ্ধা প্যারীর শেষ কথা, ফলতঃ ঐ বিশ্বস্ত দাসী এই সকল কথা বলিয়া আপন প্রভুর সুখের ভাগিনী হইতে লাগিল।

 আমি তাহার মৃত দেহের সুস্থির মুখ পানে চাহিয়া ক্রন্দন করিতে পারিলাম না, বরং যে আত্মা ঐ দেহ ত্যাগ করিয়া পলায়ন করিয়াছে, সেই আত্মার সুখ ও শান্তি ও গৌরবের অবস্থা মনে করিয়া উল্লাসিতা হইলাম। এই ক্ষণে সহস্র২ দূতগণ প্যারীকে স্বর্গের দ্বারে অভ্যর্থনা করিতেছে, যীশু তাহাকে স্বর্ণময় মুকুট পরাইতেছেন, এবং ঈশ্বর আপনি তাহার চক্ষের জল মুচাইয়া ফেলিতেছেন; ইহা নিশ্চয় জানিয়া আমি আহ্লাদ পূর্ব্বক উচ্চৈঃস্বরে কহিলাম, ধার্ম্মিকের ন্যায় আমার মৃত্যু হউক! ও তাহার শেষ অবস্থার তুল্য আমার শেষ অবস্থা হউক!

 পরে আমরা সকলে আপন মৃত বন্ধুর খাটের নিকটে হাঁটু পাতিয়া এই ক্ষুদ্র প্রার্থনা করিলাম, হে পিতঃ ঈশ্বর! এই দিবসের দুই প্রকার ঘটনা আমরা যেন কোনরূপে ভুলিয়া না যাই। বিশেষতঃ যে দুই ব্যক্তি এখন তোমাকে অন্বেষণ করিতেছে, তাহাদের মনকে শান্ত ও আনন্দযুক্ত কর, যেন তাহারা তোমার মৃত দাসীর ন্যায় বলিতে পারে, আহা! ঈশ্বরের প্রিয় লোকদের কেমন শান্তি ও কেমন সুখ!

 এমন সময়ে পাদরি সাহেব গৃহে আইলেন। তিনি প্যারীর ব্যামোহ হওয়া অবধি প্রতিদিবস দুই বার তাহাকে দেখিয়া যাইতেন, ও তাহার সহিত প্রার্থনা করিতেন; কিন্তু সেই দিন বংশির মৃত্যুর বিষয় শুনিয়া তাহাদের ঘরে গিয়াছিলেন, তাহাতে প্যারীর নিকটে আসিতে তাঁহার কিছু বিলম্ব হইয়াছিল। প্যারীর শেষ কথার বিষয় আমার নিকটে শুনিয়া তাঁহার চক্ষুঃ জলেতে পরিপূর্ণ হইল; পরে তিনি তাহার মৃত দেহের প্রতি চাহিয়া কহিলেন, আ প্যারি! তুমি এক জন প্রকৃত খ্রীষ্টিয়ান লোক ছিলা বটে।

 পরে সন্ধ্যাকালে প্যারীকে কবর দেওয়া গেল। খ্রীষ্টিয়ান লোকদের মধ্যে চারি জন পুরুষ তাহার কাল সিন্দুক কাঁধে করিয়া কবর স্থানে লইয়া গেল। পাদরি সাহেবের পরিবার এবং আমি ও পাড়ার প্রায় সমস্ত লোক তাহার পশ্চাৎ ক্রন্দন করিতে২ গেলাম। কিছু কাল পরে আমার স্বামী প্যারীর নিমিত্তে একটি পাকা গোর নির্ম্মাণ করিয়া তাহার উপরে একখানা শ্বেতবর্ণ প্রস্তর স্থাপন করিলেন। ঐ প্রস্তরে প্যারীর নাম ও প্রভু যীশু খ্রীষ্টের এই বাক্য খোদিত করা গেল, যথা, “আমি তোমাদিগকে যথার্থ কহিতেছি, ইস্রায়েল লোকদের মধ্যেও এমন বিশ্বাস পাই নাই। আর অনেকে পূর্ব্ব ও পশ্চিমহইতে আসিয়া ইব্রাহীম ও ইস্‌হাক ও যাকূবের সহিত স্বর্গরাজ্যে একত্র বসিবে; কিন্তু যে স্থানে ক্রন্দন ও দন্তের ঘর্ষণ হয়, সেই বহির্ভূত অন্ধকারে রাজ্যের সন্তানেরা নিক্ষিপ্ত হইবে।” মথি ৮।১০,১১।