বঙ্গ সাহিত্য পরিচয় (প্রথম খণ্ড)/বৌদ্ধযুগ/খনা
খনার বচন।
বৌদ্ধযুগ—খনা—খৃঃ ৮ম-১২শ শতাব্দী।
ডাকের ন্যায় খনার সম্বন্ধেও অনেক প্রবাদ প্রচলিত আছে। সেই সকল প্রবাদ বিশ্বাসযোগ্য বলিয়া মনে হয় না। খনা মিহিরের স্ত্রী ছিলেন বলিয়া উক্ত আছে। যখন শাক-দ্বীপি-ব্রাহ্মণগণের এক শাখার উপাধিই মিহির ছিল, তখন ঐ উপাধিবিশিষ্ট ব্যক্তি পাইলেই প্রসিদ্ধ জ্যোতির্ব্বিদ্ বরাহমিহিরের সঙ্গে তাঁহাকে সংশ্লিষ্ট করা যুক্তিযুক্ত নহে। খনা-সংক্রান্ত উপাখ্যানসমূহ হইতে আমরা এই কয়েকটি তত্ত্ব পাইতেছি:—খনার পিতার নাম অটনাচার্য্য ছিল;—এ সম্বন্ধে খনার নিজেরই বচন আছে—
“আমি অটনাচার্য্যের বেটি।
গণতে গাঁথতে কারে বা আঁটি[১]॥
খনার জন্মস্থান রাক্ষস-দেশ বলিয়া কথিত আছে। রাজ-তরঙ্গিণীতে “বঙ্গ-রাক্ষসৈঃ” পদ দ্বারা প্রমাণিত হয়, বঙ্গদেশেরই এক সময়ে সেই প্রসিদ্ধি ছিল। খনার বচন বঙ্গভাষায় প্রাপ্ত হওয়ায় খনার মাতৃ-ভাষা যে বঙ্গভাষা ছিল, তৎসম্বন্ধে আপত্তির কারণ দেখা যায় না। তাঁহার জন্মস্থান বঙ্গের যে কোন পল্লীতেই থাকুক না কেন, তিনি ও তাঁহার স্বামী মিহির যে এক সময়ে চন্দ্রকেতু রাজার আশ্রয়ে চন্দ্রপুর নামক স্থানে বহুদিন বাস করিয়াছিলেন, তৎসম্বন্ধে সন্দেহের বিশেষ কারণ নাই। এই চন্দ্রপুর গ্রাম এখন বিলুপ্ত-সংজ্ঞ হইয়া বৃহৎ ভগ্নাবশেষে পরিণত। বারাশত হইতে ৭ ক্রোশ পূর্ব্বে দেউলি নামক পল্লী বিদ্যমান আছে। এই গ্রাম রাজা চন্দ্রকেতুর গড়ের মধ্যেই অবস্থিত। এই স্থানে বহুদূর ব্যাপিয়া রাজা চন্দ্রকেতুর জাঙ্গাল দৃষ্ট হয়;—ইহাই পূর্ব্বে চন্দ্রপুর নামে অভিহিত ছিল। রাজ-নিকেতনের ভগ্নাবশেষ হইতে পশ্চিমে একটু দূরে ৩০।৩৫ হাত উচ্চ একটা মৃত্তিকা-স্তূপ দৃষ্ট হয়। এই স্থানে মিহির ও খনার আবাস-বাটী ছিল বলিয়া এতদ্দেশীয় সকলের ধারণা। খনা ও মিহির সম্বন্ধে নানারূপ উপাখ্যান ও প্রবাদ এই অঞ্চলে প্রচলিত আছে। চন্দ্রকেতুর গড়ে প্রাপ্ত তাম্রনির্ম্মিত বলয়ের দুই খণ্ড সম্প্রতি সাহিত্য-পরিষৎ-মন্দিরে রক্ষিত হইয়াছে। [সাহিত্য-পরিষৎ-পঞ্জিকা—১৩১৮ সন—১৪ পৃঃ দ্রষ্টব্য] ডাক ও খনার বচনে কৃষকদিগের সম্বন্ধে উপদেশই অধিক। বঙ্গীয় কৃষকদিগের এইগুলিই প্রাচীনতম ছড়া এবং ইহা তাহাদের নিজস্ব। আমরা উহাদিগকে সামসময়িক ও ৮০০—১২০০ খৃষ্টাব্দের মধ্যে রচিত বলিয়া অনুমান করিয়াছি[২]। কিন্তু আদি-যুগের ভাষার চিহ্ন এই সকল প্রবচনে বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও মোটের উপরে যে ইহাদের ভাষা অনেকাংশে পরিবর্ত্তিত হইয়াছে, তাহাও আমরা পূর্ব্বেই উল্লেখ করিয়াছি। প্রাচীন রচনার চিহ্ন যে এই সব বচনে এখনও আছে, তাহার উদাহরণস্বরূপ নিম্নে দুটি অংশ উদ্ধৃত করিলাম।
[ ১ ]
“আষাঢ়ে কাড়ান নাম্কে।
শ্রাবণে কাড়ান ধান্কে॥
ভাদরে কাড়ান শীষকে।
আশ্বিন কাড়ান কিস্কে॥”
[ ২ ]
“আঘণে পৌটি।
পৌষে ছেউটি॥
মাঘে নাড়া।
ফাল্গুনে ফাঁড়া॥”
এই ভাষা যে কতকটা দুর্ব্বোধ, তাহা অবশ্যই স্বীকার করিতে হইবে।
লগ্ন-নির্ণয়।
কি শ্বশুর মনে গণ।
লগ্ন-মান কর দুনো॥
দণ্ডে পল পলে বিপল।
চাইয়া দেখ লগ্ন সকল॥
পীড়ার পরিণাম-বিচার।
আসিয়া দূত দাঁড়ায় কোণে।
কথা কহে ঊর্দ্ধ নয়নে॥
শিরে পৃষ্ঠে বুকে হাত।
সেই দূতে পুছে বাত॥
কুটা ছিঁড়ে করে খাই।
খনা বলে ফুরাল আই॥[৩]
অশুভ বার্ত্তা যে জন ভণে।
তাঁহার মুখে যে জন শুনে॥
তিথি বার করে এক।
সাতে হরে পরমায়ু দেখ॥
এক তিন থাকে বাণ।
যম-ঘর হৈতে টেনে আন॥
দুই চারি থাকে ছয়।
অবশ্য তার মৃত্যু হয়॥
চন্দ্রগ্রহণ।
যে যে মাসের যে যে রাশি।
তার সপ্তমে থাকে শশী॥
সেই দিন যদি হয় পৌর্ণ-মাসী।
অবশ্য রাহু গ্রাসে শশী॥
যাত্রা।
দ্বাদশ আঙ্গুল করি কাঠি।
সূর্য্য-মণ্ডলে দিয়া দিঠি॥
রবির চৌদ্দ সোমের ষোল।
পঞ্চদশ মঙ্গলের ভাল॥
বুধ সতের গুরু আঠার।
শুক্র শনি বারো বারো॥
এ যাত্রায় যে জন যায়।
সংবৎসরের ফল এক দিনে পায়॥[৪]
হাঁচি জেঠি পড়ে যার।
শত গুণে লভ্য হয় তার॥[৫]
উত্তরে হস্তা দক্ষিণে শ্রবণা।
পূর্ব্বে অশ্বিনী না কর গমনা॥
পশ্চিমে যাইতে রোহিণী রোষে।[৬]
হরি হর ব্রহ্মা বাহুড়ে না আইসে॥[৭]
ভরা হইতে শূন্য ভাল যদি ভর্তে যায়।
আগে হইতে পাছে ভাল যদি ডাকে মায়॥
মরা হইতে তাজা ভাল যদি মর্তে যায়।
বামে হইতে ডাইনে ভাল যদি ফিরে চায়॥
হাসা হইতে কাঁদা ভাল যদি কাঁদে বাঁয়[৮]॥
সন্তান-নির্ণয়।
জন্মলগ্নের শুভাশভ।
লাভালাভ।
খাটে খাটায় লাভের গাঁতি
তার অর্দ্ধেক কাঁধে ছাতি॥
ঘরে বসে পুছে বাত।
তাঁর ভাগ্যে হা ভাত॥[১৩]
কৃষি-তত্ত্ব।
খনা ডেকে বলে যান।
রোদে ধান ছায়ায় পাণ॥[১৪]
দাতার নারিকেল বখিলের বাঁশ।
কমে না বাড়ে না বার মাস॥[১৫]
দিনে রোদ রাতে জল।
তাতে বাড়ে ধানের বল॥
কাতিকের ঊন জলে।
খনা বলে দুন ফলে॥[১৬]
শুন বাপু চাষার বেটা।
বাঁশের ঝাড়ে দিও ধানের চিটা[১৭]॥
চিটা দিলে বাঁশের গোড়ে।
দুই কুড়া[১৮] ভূঁই বেড়বে ঝাড়ে॥
শুনরে বাপু চাষার বেটা।
মাটীর মধ্যে বেলে যেটা॥
তাতে যদি বুনিস পটল।
তাতেই তোর আশার সফল॥
খনা বলে শুন শুন।
শরতের শেষে মূলা বুন॥
যদি না হয় অগ্রাণে বৃষ্টি।
তবে না হয় কাঁঠালের সৃষ্টি॥
আগে বেঁধে দিবে আলি।
তাতে রুইয়ে দিবে শালি॥[১৯]
তাতে যদি না হয় শালি।
খনা বলে পাড় গালি॥
বৃষ্টি-ফল।
যদি বরে[২০] আগনে।
রাজা যান মাগনে॥
যদি বরে পৌষে।
কড়ি হয় তুষে॥
যদি বরে মাঘের শেষ।
ধন্য রাজা পুণ্য দেশ॥
যদি বরে ফাগুনে।
চিনা কাউন দ্বিগুণে॥
পরমায়ু।
- ↑ আঁটি=ভয় করি।
- ↑ বঙ্গভাষা ও সাহিত্য, ৩য় সং, ৭৮—৮১ পৃঃ।
- ↑ যদি সংবাদদাতা হস্তে কুটা ছিঁড়িয়া তাহা চর্ব্বণ করিতে করিতে প্রশ্ন করে, তবে রোগীর আয়ু ফুরাইয়াছে বুঝিতে হইবে।
- ↑ বার অঙ্গুলী পরিমাণ কঞ্চী বা সরু বাখাড়ী রৌদ্রের সময় দাঁড় করিয়া ধরিলে তাহার ছায়ার পরিমাণ যত অঙ্গুলী হইবে, তদনুসারে শুভযাত্রা বিচার্য্য। ঐ ছায়ার পরিমাণ যখন রবিবারে চৌদ্দ অঙ্গুলী, সোমবারে ষোল অঙ্গুলী, মঙ্গলবারে পনেরো অঙ্গুলী ইত্যাদি হইবে, তখন যাত্রা শুভ বলিয়া জানিবে।
- ↑ যাত্রাকালে সাধারণতঃ হাঁচিতে বা টিক্টিকীর শব্দে যাত্রা অসিদ্ধ হয়; কিন্তু পূর্ব্বোক্তরূপে শুভ-যাত্রা স্থিরীকৃত হইলে ঐ সমস্ত অশুভ লক্ষণ বিশেষ লাভজনক হইয়া দাঁড়ায়।
- ↑ রোহিণী নক্ষত্রে পশ্চিমে যাত্রা নিষিদ্ধ।
- ↑ বাহুড়ে=ফিরিয়া। হরি, হর বা ব্রহ্মার ন্যায় প্রতাপশালী হইলেও ফিরিয়া আসে না, অর্থাৎ মৃত্যু নিশ্চিত।
- ↑ বামে।
- ↑ খনার বচনের পুস্তকে আমরা বরাহমিহিরের ভণিতাযুক্ত কতকগুলি পদ পাইয়াছি; এটি তাহাদের অন্যতম। বরাহমিহিরের ন্যায় রাবণের ভণিতাযুক্ত প্রবচনও পাওয়া গিয়াছে। এই সকল ভণিতা যে প্রক্ষিপ্ত, তাহাতে সন্দেহ নাই। এমনও হইতে পারে যে, কেহ বরাহমিহিরের সংস্কৃত প্রবচন অনুবাদ করিয়া খনার বচনের মধ্যে সন্নিবিষ্ট করিয়াছেন।
- ↑ গর্ভমাসের অক্ষরের সংখ্যা, গর্ভিণীর নামের অক্ষরের সংখ্যা এবং প্রশ্নোত্তরকারীর নামের অক্ষর-সংখ্যার সহিত পনেরো যোগ করিয়া মোট যত সংখ্যা হইবে, তাহা সাত দিয়া হরণ করিলে, যদি অযুগ্ম সংখ্যা অবশিষ্ট থাকে, তবে পুত্ত্র এবং যদি যুগ্ম সংখ্যা অবশিষ্ট থাকে, তাহা হইলে কন্যা হয়; কিন্তু যদি অবশিষ্ট কিছুই না থাকে, তবে গর্ভপাত হয়।
- ↑ জন্ম-লগ্নে শনি, মঙ্গল ও রাহু মিলিত হইলে সেই সন্তান বৃক্ষ-শাখায় গলায় দড়ি দিয়া মরিবে।
- ↑ যদি তাহাকে ইন্দ্রও রক্ষা করেন, তথাপি ইতরজাতির অন্ন ভোজন হইতে কেহ তাহাকে রক্ষা করিতে পারিবে না।
- ↑ যে নিজে খাটে এবং লোকজনকে খাটায়, তাহার পূর্ণ লাভ; যে অপরকে খাটায়, কিন্তু নিজে না খাটিয়া শুধু ছাতি মাথায় দিয়া কর্ম্ম পরিদর্শন করে, তাহার অর্দ্ধেক লাভ; কিন্তু যে ব্যক্তি নিজে মোটেই খাটে না, শুধু ঘরে বসিয়া সংবাদ জিজ্ঞাসা করে, তাহার ভাগ্যে অন্ন নাই।
- ↑ রৌদ্রে ধান এবং ছায়ায় পাণ বেশী হয়।
- ↑ দাতার নারিকেল কমে না, অর্থাৎ একটি নারিকেল পাড়িলে তৎস্থলে আর একটি হয়। বখিলের (কৃপণের) বাঁশ বাড়ে না; কারণ, বাঁশ যতই কাটা যায় ততই বৃদ্ধি পায়।
- ↑ কার্ত্তিক মাসে অল্প বৃষ্টি হইলে দ্বিগুণ ফসল হয়।
- ↑ চাউলহীন ধান।
- ↑ কাঠা বা কাণী।
- ↑ পূর্ব্বে আইল বাঁধিয়া তৎপরে শালিধান্য রোপণ করিলে ভাল হয়।
- ↑ বরে—বর্ষে=বর্ষণ করে।
- ↑ এই রকম বহু পদ আছে। তদ্দ্বারা খনার শ্বশুর যে বরাহমিহিরই ছিলেন, তাহা কল্পিত হইতে পারে। কিন্তু আমরা পূর্ব্বেই বলিয়াছি, এই সকল উক্তি সম্ভবতঃ পরবর্ত্তী কালে প্রবচনগুলির মধ্যে প্রক্ষিপ্ত হইয়াছে। বিশেষতঃ বঙ্গীয় প্রবাদ অনুসারে মিহির এবং বরাহকে দুই পৃথক্ ব্যক্তিরূপে কল্পনা করা হইয়াছে;—তাহার একজন পিতা এবং অপর জন পুত্ত্র। কিন্তু সুপ্রসিদ্ধ জ্যোতির্ব্বিদ্ বরাহমিহির একই ব্যক্তি ছিলেন। বরাহমিহিরের সঙ্গে বঙ্গদেশের কোনরূপ সংস্রব ছিল কি না, তাহা আলোচনীয়। যখন নানা প্রকার জনশ্রুতি ও প্রবাদে বঙ্গদেশের সঙ্গে তাঁহার সম্বন্ধ সূচিত হইতেছে, তখন মূলে কোন ঐতিহাসিক সত্য থাকিলেও থাকিতে পারে।
- ↑ জন্ম-রাশি হইতে সপ্তমে শনি থাকিলে খোঁড়া, রবি থাকিলে ভ্রমণ, মঙ্গলে অস্ত্রাঘাত, বুধে বিষয়, শুক্রে বহু ধন।
- ↑ আকা=অর্ক=রবি।
- ↑ রাহু।
- ↑ ভানুতনুজ=শনি।
- ↑ জন্ম-নক্ষত্রের পরিমাণ যত হইবে, তাহার প্রতি পলে ১২ দিন আয়ু।
- ↑ নরা=নর; গজা=গজ; (ইহাদের বয়স) বিশে=বিশ সংখ্যার সহিত; শয় এক শ; অর্থাৎ মনুষ্য ও হস্তী সাধারণতঃ ১২০ বৎসর বাঁচিয়া থাকে। হয়ের অর্থাৎ অশ্বের আয়ু উহার অর্দ্ধেক, সুতরাং ৬০ বৎসর। বলদের আয়ু ২২ বৎসর, ছাগলের আয়ু ১৩ বৎসর এবং বরাহের আয়ু ৬॥০ বৎসর।